‘বড় বাংলা’ কোনো পরিচয়বাদী রাজনীতির স্লোগান না

।। সম্পাদকীয় ।।

‘প্রতিপক্ষ’ নতুন রূপে ‘বড় বাংলার’ পত্রিকা হিশাবে বের হবার পর একটা বছর আমরা অতিক্রম করলাম। আমাদের জন্য এটা দারুণ খবর। প্রতিপক্ষ বের করার পেছনে আমাদের মধ্যে যে চিন্তা কাজ করেছে বা করে সেটা ‘আমাদের কথা’ পাতায় সকলের বিবেচনার জন্য আমরা কিছুটা পেশ করেছি। আগামীতে আরও আলোচনা হবে নিশ্চয়ই। এ আলোচনা আমরা চালিয়ে যাব।

প্রথম পর্যায়ে প্রতিপক্ষ চারটি সংখ্যা বেরিয়েছিল। পরে নানা কারণে আমরা আর বের করে যেতে পারি নি।  প্রতিটি সংখ্যাই বিষয়ের কারণে আলোচিত ছিল। কিছু ক্ষেত্রে আমাদের উদ্যোগ ছিল সময়ের বিচারে প্রবল সাহসের ব্যাপার। যেমন,  বাঙালি  জাতিবাদীদের রক্তচক্ষু ও বিরাগ উপেক্ষা করে বাংলাদেশে যাঁরা উর্দু সাহিত্য  চর্চা করেছেন তাদের ওপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা। বাংলাদেশের উর্দুভাষীরা বাংলাদেশেরই নাগরিক, আমরা মাতৃভাষার জন্য লড়েছি, ফলে উর্দু যাদের মাতৃভাষা, এবং সেই ভাষায় যাঁরা বাংলাদেশে থেকে কবিতা-গল্প লেখেন, সাহিত্য করেন—তাঁদের চর্চাও মাতৃভাষারই চর্চা, তাঁদের লড়াইও আমাদেরই লড়াই। আমরা সকলেই নিজ নিজ ভাষায় বাস করি। নিজ নিজ ভাষায় বাস করার মধ্য দিয়ে সকলের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপনের চেষ্টাকেই আমরা ‘সাহিত্য’ গণ্য করি। আমরা বলেছি ‘সহিত’ থেকে সাহিত্য— সকলের সঙ্গে একসঙ্গে বাসের বাসনা থেকে সাহিত্যের অংকুরোদ্গম ঘটে। পাশ্চাত্যের ‘লিটারেচার’-এর অনুবাদ হিশাবে ‘সাহিত্য’ সংক্রান্ত যে ধারণা প্রবল ভাবে আমাদের মস্তিষ্কে হাজির, সেই ভূত থেকে মুক্ত হবার ইচ্ছা থেকেই ‘প্রতিপক্ষ’ বেরোয়। সেই ক্ষেত্রে সম্ভবত ‘প্রতিপক্ষ’ কিছুটা কৃতিত্ব দাবি করতে পারে।

দুটি কথা আমরা সাধারণত বলে থাকি: একটি হচ্ছে সকলের সঙ্গে বাস করবার ইচ্ছা এবং দ্বিতীয়ত যে কোন মাধ্যমে এই বাসনার বর্তমান কিম্বা হাজির থাকা। সাহিত্য শুধু ছাপাখানার কারবার, এই দাবি আমরা নাকচ করতে চেয়েছি। ফটোগ্রাফি, সিনেমা, চিত্রকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য্য – মায় যে কোন প্রকার হাতের কাজ বা শৈল্পিক কারিগরি – সবই সাহিত্য। মানুষ স্বভাবগুণে সকলের সঙ্গে সম্বন্ধ রচনার আকুতি বোধ করে। যে জন্য বলা হয় মানুষ সামাজিক জীব। যদি তাই হয় তাহলে সমাজে শত্রুমিত্রের ভেদ জ্ঞান কিভাবে তৈরি হয়? এই জিজ্ঞাসার উত্তর দেবার দায় কিম্বা সাধ্য সাহিত্যের আছে কিনা তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে। কিন্তু দূরত্ব,  বিভাজন, কিম্বা অপরায়ন যেখানে মাথা তোলে, সাহিত্য সেখানে মনে করিয়ে দেয় মানুষ কোথাও বুঝি সর্বত্রই এক এবং অভিন্ন। সাহিত্য এই স্বভাব থেকে যখন বিচ্যূত হয়, তখন সাহিত্য প্রপাগাণ্ডা বা বিদ্যামান রাজনৈতিক বিভাজনের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এই দোষ সাহিত্য করে না, সেটা হলফ করে বলা যাবে না। করে। কিন্তু সাহিত্যকে ভেতর থেকে এই দোষ কাটিয়ে ওঠার সাধনা থাকতে হবে। এতোটুকুই আমাদের দাবি। 

‘সামাজিক’ হওয়ার অর্থ কী? মানুষ শুধু জৈবিক বা বৈষয়িক সম্বন্ধ স্থাপন করে তা তো নয়, আমাদের সন্দেহ মানুষ বুঝি পরমার্থিক তাই মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধকে কাটছাঁট কায়দায় আর্থ-সামাজিক সম্বন্ধ কিম্বা ঘোর বস্তুবাদীর মতো উৎপাদন সম্পর্কে পর্যবসিত করা যায় না। মানুষ জীব তাই জৈব-বৈষয়িক সম্পর্কের ওপর মানুষ ও মানুষের সমাজ দাঁড়ায়। কিন্তু সেখানেই মানুষের শেষ না। মানুষ কল্পনা করতে জানে, যা নাই তা নিয়ে ভাবতে পারে – এমনকি যা অসম্ভব সেই অসম্ভবের পায়ে শহিদ হয়ে যেতে মানুষ ভয় পায় না। প্রকৃতিস্থ কিম্বা অপ্রকৃতিস্থ – পাগল কিম্বা স্বাভাবিক— সকলের সঙ্গে সম্বন্ধ রচনার হিম্মত সাহিত্য ধারণ করে। কিম্বা সাহিত্য চর্চা সম্ভবত তাদের পক্ষেই সম্ভব যারা আর সবার মতো নয়, একাট্টা একরকম নয়। অন্যরকম। তাই যারা আবছা, অপরিচিত কিম্বা স্ট্রেঞ্জ তাদের হাতও ধরতে চায় প্রতিপক্ষ। বড়বাংলার যে কোন সাধকের দরবারে গেলেই আমরা দেখি পাগলদের জন্য জায়গা আছে। স্বাভাবিকতা এবং পাগলামির সীমান্ত রেখার দুই দিকেই সাহিত্য। প্রতিপক্ষ দুই দিকেই তার হাত মেলে ধরতে চায়।  ধরুক যার ইচ্ছা।

হয়তো কথাগুলোর মধ্যে আবেগ এবং রোমাঞ্চ মিশে গিয়েছে। মিশুক। সাহিত্যের জমিন কিম্বা চাষাবাদ  এই মাখামাখিরই মধ্যে । সে কারণে বৈষয়িক সম্পর্কের দ্বন্দ্ব কিম্বা রাজনীতির শত্রুমিত্র বিভাজন বা ভেদ অতিক্রম করে  যে আকুতি, কল্পনা, ইচ্ছা বা বাসনা মানুষকে দেশকালপাত্র অতিক্রম করে যাবার সাহস জোগায়, সকলের সঙ্গে সম্বন্ধ রচনার মধ্যে স্বস্তি, প্রীতি ও আনন্দ সন্ধান করে সাহিত্য আমরা সেভাবেই চর্চা করতে চাই। ‘বড় বাংলা’র ‘বড়’ কথাটার বাড়্বা বাড়ন্ত এরকমই। ‘বড়’ কথার মধ্যে ‘দুই বাংলা’র  রোমাঞ্চ নাই। বাংলাকে একত্র করবার কোন জাতিবাদী বাসনা নাই। সাহিত্যের পরিমণ্ডলে সাহিত্যের চর্চা — সেই অর্থে সাহিত্যের পরিমণ্ডল কোন সীমানা মানে না – সেটা মনে করিয়ে দেবার জন্যই ‘বড় বাংলা’।  আমাদের সাহিত্যের ভাষা বাংলা – এতোটূকুই।  সাহিত্য পরিচয়ের দেয়াল তোলে না, সেটা দাবি করা কঠিন। কারণ ইতিহাসে লিটারেচার ভেদবুদ্ধির চর্চা করে না, বা দেয়াল তোলেনি তোলে না, সেটা আমরা বলি না। তোলে। হয়তো ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়াল তোলাতুলির। কিন্তু যাকে আমরা ‘সাহিত্য’ বলতে চাইছি, তার কাজ দেয়াল ভাঙা, দেয়াল তোলা না।

তাই পরিষ্কার বলা দরকার, ‘বড় বাংলা’ কোনো পরিচয়বাদী রাজনীতির স্লোগান না। অবশ্য প্রবল আধুনিকতা এবং জাতিবাদের যুগে আমাদের অজান্তে আমরা জাতিবাদী ব্যাকরণের মধ্যে আটকা পড়ে থাকি। ছক ভেঙে বাইরে যেতে পারি না। এটা অনেকের মনে হতেই পারে। কিন্তু বড় বাংলা  সকলকে যথাসাধ্য অন্তর্ভুক্ত রাখার সাধনা, বাদ দেবার সংকীর্ণতা না। বড় বাংলা হিন্দি ভাষা কিম্বা হিন্দি সাহিত্যের বিরুদ্ধে বাঙালির সাহিত্য চর্চা না। নিপীড়িত জাতিগষ্ঠির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায় কিম্বা জাতিবাদী বা সাম্প্রদায়িক আধিপত্য মোকাবিলার রাজনৈতিক কর্তব্য আছে। থাকবে। সাহিত্য সেই দায় অস্বীকার করে না। কিন্তু সাহিত্যের কর্তব্যের শেষ সেখানে না। বরং সেখানে শুরু হয় মাত্র। তাই বড়বাংলা বাংলা ভাষার বাইরে সকল ভাষার সঙ্গে সম্বন্ধ রচনায় চরম উৎসাহী। হিন্দি ভাষাতেও জাতিবাদী অন্ধন্ত্ব ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই সাহিত্য চর্চা আছে। তাই না?

সবই আমাদের সাধ্য ও সামর্থের মামলা। ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক পরিচয়বাদের বিপদ আমরা চোখের সামনে বাংলাদেশে দেখেছি। চোখের সামনেই ঘটছে। বাঙালি জাতিবাদের পালটা ইসলামের নামে দানা বেঁধেছে ধর্মীয় জাতিবাদ বা পরিচয়বাদের অসুখ।। কেন পরিচয়বাদিতা এবং অপরায়ন মানুষের ইতিহাসে ঘটে তার বিচার আলাদা। সাহিত্যের সাধনা হিশাবে বড় বাংলার দাবি এইটুকু যে বৈচিত্রের মধ্যে সবাই কোথায় এক তাকে সাহিত্য চর্চার মধ্যে দেখানো। যেন বিভাজন, অপরায়ন, বিতাড়ন ও জিঘাংসার বিপরীতে দাঁড়ানো যায়। এটা শুধু বাংলা সাহিত্যের কাজ না। একই ভাবে হিন্দি সাহিত্যেরও কাজ। হিন্দি সাহিত্যও আমাদেরই ভাই, আমাদেরই বোন। তাই ‘বড় বাংলা’ বলার অর্থ এই নয় যে আমরা হিন্দি ভাষা বা সাহিত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি।। অন্যদিকে উপমহাদেশ ব্যাপী হিন্দি পরিচয়বাদ ও জাতিবাদের দেয়াল উঠেছে। হিংসা তৈরি হয়েছে। যারা ‘হিন্দু’ নয় ‘হিন্দুস্তান’ থেকে তাদের বিতাড়নের রাজনীতি জোরদার হয়েছে। তাই হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি সম্প্রসারণবাদের মোকাবিলা উপমহাদেশে প্রত্যকের রাজনৈতিক কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। সাহিত্যের কারবার বিভাজনের ব্যবসা না, সম্বন্ধ রচনার সমাজ বা পরিসর ক্রমাগত ‘বড়’ করতে থাকা। সাহিত্যের এই গোড়ার দায় — সকল প্রকার বাদ পড়াদের জায়গা দেওয়া, নিজের অন্তরে স্থান দেওয়া — কোন ভাষাই এড়াতে পারে না। বাংলা ভাষা যেমন পারে না, হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যেরও সেই কর্তব্য এড়াবার সুযোগ নাই। সাহিত্যের জায়গা বা পরিসর বিশাল — অনেক অনেক বড়। সেই ‘বড়’ জায়গায় আমরা সকলকে নিয়ে বাস করতে আগ্রহী। বাংলা হোক কিম্বা হিন্দি, কোন সাহিত্যই তাহলে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি সম্প্রসারণবাদকে রাস্তা ছেড়ে দিতে পারে না।

তাই বড় বাংলার ধারণায় ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ মার্কা ধারণা নাই।  এই অনুমান মাথায় রেখে অনেকে দাবি করেন বাংলাদেশের চিন্তা-দর্শন চর্চায়, রাজনীতিতে, ইংরেজ চলে যাবার পর কলোনিতে গত দুই এক দশকে বাংলাদেশে একরকম ঘোষিত ও অঘোষিত উপায়ে ‘মুসলমানি পরিচয়বাদের লেয়ার’ নির্মিত হয়েছে, তাদের আশংকাকে আমরা অমূলক বলি না। এর ব্যাখ্যার জন্য বাংলাদেশে সেকুলার জাতিবাদের ভূমিকা এবং বাঙালি জাতিবাদীরা কতটুকু দায়ী সেটাই বরং বিশেষ ভাবে আলোচনার দরকার আছে। তর্কটাকে আধুনিকতা এবং জাতিবাদের ব্যবচ্ছেদের মধ্যে নির্ণয় করতে হবে, তার বাইরে না। কিন্তু যারা ‘বড় বাংলা’ নামচিহ্ন দ্বারা ভারতীয় জাতিবাদকে প্রশ্ন করে ‘প্রতিরোধী বাঙালি পরিচয় নির্মাণ’ করবার কথা বছেন, সেই অভিযোগ অতিশয় কষ্টকল্পিত ব্যাপার। কিন্তু আমরা চাই আলোচনা হোক। এবং এর মধ্য দিয়েই ‘বড় বাংলা’র ধারণা আমরা ক্রমশ আরও স্বচ্ছ করতে পারব মনে করি।

আধুনিক জাতীয়তাবাদ ভয়ংকর জিনিস। এর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া বড়োই কঠিন।  আমাদের সীমাবদ্ধতাও আমাদের কাছে পরিষ্কার। আমরা তো পাহাড় কিম্বা সমতলের ‘আদিবাসী’ কিম্বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সঙ্গে এখনও সম্বন্ধ গড়তে পারিনি। সাঁওতাল, মুণ্ডা, কোচ, রাজবংশী, চাকমা, মার্মা— তালিকা অনেক দীর্ঘ। কিম্বা সিকিম, ভূটান কিম্বা আফগানিস্তানের সাহিত্য। সম্বন্ধ শক্তিশালী না করতে পারার ব্যর্থতা ‘সহিত’ থেকে ‘সাহিত্য’ ধারণাটির গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। উপমহাদেশের অন্যন্য ভাষাভাষীদের সঙ্গে সম্বন্ধ তৈরির কাজও বাকি। এই আত্মসমালোচনা আমরা করি। যতক্ষণ না আমরা আমাদের সম্বন্ধের পরিমণ্ডল আরও বৃহৎ ও বড় করতে না পারব, ততক্ষণ এই আত্মসমালোচনা আমাদের থাকবে।

ইতোমধ্যে আমাদের ডাকে যাঁরা সাড়া দিয়েছেন তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই। ওয়েবের পাশাপাশি খুব শীঘ্রই মুদ্রিত সংখ্যা আকারে ‘প্রতিপক্ষ’ প্রকাশিত হবে ‘পরম পত্রিকার সঙ্গে একযোগে। এর জন্যে আমরা ‘পরম’ পত্রিকার সম্পাদক বিশ্বেন্দু নন্দকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। সকলের ভালবাসা ও শুভেচ্ছা আমরা যাঞ্চা করি। সবাইকে শ্রদ্ধা, শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। 

২৩ নভেম্বর, ২০২১

শ্যামলী, ঢাকা




Share