কঠিন, কিন্তু বলা দরকার

।। সম্পাদকীয় দফতর।।

মত প্রকাশের অধিকার আমরা সমর্থন করি। সেই অধিকার রাষ্ট্রের হরণ করবার অধিকারের আমরা বিরোধী। কিন্তু অধিকার কখন অন্যদের অপমানিত, লাঞ্ছিত, হেয় ও তামাশার বস্তুতে পরিণত করে সেই সীমাটুকু সম্পর্কে আগাম সচেতন থাকতে চাই। সেই সীমা আমরা স্বেচ্ছায় মানার পক্ষপাতী। সেই সীমা নৈতিক ভাবে না মেনে তার পরিবর্তে আমরা নিজেদের শাসনে রাখার জন্য রাষ্ট্রকে ডেকে আনতে চাই না। ডেকে এনে নিজেদের নীতিনৈতিকতা বোধ বা নৈতিক কর্তাসত্তাকে গোড়াতেই খুন করে বসতে রাজি না। অর্থাৎ অধিকার চর্চা করবার নামে নীতিহীন বিবেকহীন হতে চাই না। আমার অধিকার চাই, কিন্তু অন্যের মর্যাদা হরণ করে নয়। ব্যক্তির অধিকার অপরের মর্যাদা হানির বিনিময়ে নয়। রাষ্ট্রকে আমরা নীতিনৈতিকতার প্রভু বানাতে চাই না। যার ছুতায় রাষ্ট্র এক অনুচ্ছেদে অধিকার দিয়ে আরেক অনুচ্ছেদে কেড়ে নেয়- এমন রাষ্ট্র চাই না। অর্থাৎ রাষ্ট্র আইন করে বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকীর্ণ করুক, আইন করে সীমা বেঁধে দিক, বিবেকের স্বাধীনতা দেবার নাম করে আবার তা হরণ করুক, আমরা তার বিপক্ষে।

অনেক বিষয়ে হঠাৎ কিছু বলা কঠিন হয়ে পড়ে। যেমন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা যখন সজ্ঞানে অপরকে অপমানিত, হীন বা অমর্যাদা করবার হাতিয়ার হিশাবে ব্যবহৃত হয়। তখন সঙ্গে সঙ্গে বলা উচিত, না আমরা ‘শার্লি’ না। Je Ne Suis Pas Charlie। কিন্তু বিষয়টা অতো সরল নয়। কারন চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ানো ছাড়া চিন্তার বিকাশ অসম্ভব।

কিন্তু চাইলেও ‘প্রতিপক্ষ’ গুরুতর তর্কগুলো এড়াতে পারে না। সেই তর্কগুলো প্রায়ই জাতিবাদ, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা এবং আরও নানান বিভাজনের ভেদরেখা আরও গভীর করে তোলে। দূরত্ব কমায় না। বাড়ায়। অথচ তর্কগুলো মুলত আধুনিকতা, ব্যক্তি, আধুনিক বুর্জোয়া (ব্যক্তিতান্ত্রিক) রাষ্ট্র, ক্ষমতার প্রতিযোগিতা, কিম্বা ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক সংক্রান্ত বাহাস। কিন্তু হাজির হয় সভ্যতা বনাম বর্বরতা, প্রগতিশীলতা বনাম পশ্চাৎপদতা, আধুনিকতা বনাম ধর্মের বিরোধ হিশাবে।

আমরা ‘প্রতিপক্ষ’ হিশাবে সবে নিজেদের নতুন করে গুছিয়ে শুরু করবার চেষ্টা করছি। তাই হঠাৎ গুরুতর বিষয়ে মন্তব্য থেকে বিরত থেকেছি। কিন্তু ইতোমধ্যে শার্লি হেবদো নতুন করে ইসলামের রসুলের কার্টুন ছাপল; একজন হতভহাগ্য ইস্কুল শিক্ষকের শিরশ্ছেদ হোল। এসব নিয়ে দুনিয়াব্যাপী তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল। আর এখন চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। কে আসছেন ট্রাম্প নাকি বাইডেন? আসলে কিছু কি এসে যায় আমাদের?

যায়। কারন আমরা যে গোলকায়নের বৃত্তে বাস করি সেখানে ইতিহাসের কর্তা হওয়ার যোগ্যতা আমরা এখনও অর্জন করি নি। ফলে বাইরের ঢেউ খুব সহজেই আমাদের ভঙ্গুর আত্মবিশ্বাস দুমড়ে মুচড়ে দেয়। পর্যালোচনার ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা না করে আমরা প্রপাগাণ্ডার শিকার হই সহজে। পস্পরকে অবিশ্বাস করতে শুরু করি। অতএব কিছু কথা, দেরিতে হলেও, বলতে হচ্ছে।

ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার,  কার্টুন আঁকা, একজন মুসলিম কোন অপরাধ করলে তা সমগ্র ইসলামের ওপর চাপানো – ইত্যাদি পাশ্চাত্যে নতুন কিছু নয়। কিন্তু নব্য উদারবাদী বিশ্বব্যবস্থা এবং পুঁজির গোলকায়নের যুগে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েমের লড়াই পাশ্চাত্য বনাম ইসলামের লড়াইয়ে রূপ নিয়ে বিষয়টিকে একালে আরও জটিল করে তুলেছে। বিশ্ব ব্যবস্থার বৈষয়িক দ্বন্দ্ব ব্যাখ্যা করা হচ্ছে কোন দেশের সম্পদ কিভাবে লুটতরাজ হচ্ছে তার ব্যাখ্যা দিয়ে নয়, বরং সেটা হচ্ছে গুরুগম্ভীর ‘সভ্যতার দ্বন্দ্ব’ বা ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন’ দিয়ে। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান হচ্ছে অন্যায় যুদ্ধে। তার আধুনিক মতাদর্শিক রূপ হচ্ছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ। আমরা যুদ্ধাবস্থার মধ্যে আছি।

ফলে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ নিয়ে আলোচন কান টানলে মাথা আসে জাতীয় তর্ক।  ফ্রান্সের কার্টুন পত্রিকা শার্লি হেবদো একবার ইসলামের নবীর কার্টুন এঁকে সহিংস হামলার শিকার হয়েছিল। এই অভিজ্ঞতার পরও মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে তারা আবার রসুলের কার্টুন এঁকেছে। নবী মোহাম্মদ (সা)-কে ব্যঙ্গ করে প্রকাশিত কার্টুন ছবি হয়তো ব্যক্তি স্বাধীনিতার পরম হর্ষ ও এক্সটাসি, সন্দেহ নাই।  কিন্তু চরম অদূরদর্শিতা এবং সামষ্টিক দা্যিত্ববোধের অভাবও বটে।  এতে  ইসলামোফোবিয়া তথা ইসলাম বিদ্বেষের রাজনীতি  শুধু পশ্চিমা দুনিয়ায় চাঙ্গা করে তোলা হয় নি, ইসলামকে আবারও মধ্যযুগীয়, বর্বর ধর্ম হিশাবে প্রচারের চেষ্টা চলছে। আমাদের মধ্যেও তার কুফল বর্তাবে আর্শ্চর্য কী!  আমরা, বাংলাভাষীরা পরস্পরকে জানা বোঝার অভাবের কারণে একবার সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ পুষ্ট হয়ে নিজেদের দ্বিখণ্ডিত করেছি, এখনও আমরা ভুগছি। হাজার বছর এক সঙ্গে থেকেও পরস্পরের ধর্ম, বিশ্বাস, সংস্কৃতি, জীবন যাপন ইত্যাদির সম্পর্কে অজ্ঞ থেকেছি। সেই অজ্ঞতার ওপর আবার মোটা পর্দার চাদর বা পলেস্তারা পড়বার আশংকা তৈরি হয়েছে। তাই কিছু কথা না বলে আমরা এই দুঃসময়ে নিস্তার পাবো বলে মনে হয় না।

কার্টুন নিয়ে বিতর্কে  বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার তর্ক রয়েছে। আমরা চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।  শুধু তাই নয়, রয়েছে ফরাসি কার্টুন পত্রিকা শার্লি হেবদোর যে কোন বিষয়, বস্তু বা ব্যক্তিকে নিয়ে ব্যঙ্গ করার ‘অধিকার’। হতভাগ্য ফরাসি শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি তাঁর ক্লাসে শার্লি হেবদোর কার্টুন দেখিয়ে ‘ফ্রি স্পিচ’ শেখাতে গেলে তার একজন ছাত্র তার শিরশ্ছেদ করেছে। কথা উঠেছে, তাহলে তথাকথিত ‘ফ্রি স্পিচ’  আদৌ কোন ‘অধিকার’ কিনা যা সহিংস ঘটনা উসকে দেয়।  ইংরেজদের পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’ দাবি করছে, ‘ফ্রি স্পিচ’-কে এভাবে জিজ্ঞাসার বিষয়ে পরিণত করা ঠিক না।  কেন? কারন “এই ধরনের মূহূর্তে আমাদের উল্টাটা করা দরকার:  দরকার ফ্রি স্পিচ তো বটেই, সেই অধিকার ছাড়াও অন্যকে অপমানিত করবার অধিকারের প্রতি অঙ্গীকার সুদৃঢ় করা। (But in such moments, we need to do the opposite: to reaffirm commitments to free speech and the freedom to offend. দেখুন, ‘The freedom to offend is a priceless commodity’, ১৮ অক্টোববর ২০২০)। অর্থাৎ ফ্রি স্পিচের নামে অন্যকে অপমানিত করবার কারনে যদি আমাদের শিরচ্ছেদও হয়, তারপরও আমাদের বলতে হবে অপরের মর্যাদা হানি করা, অন্যদের অপমান করা আমার ‘অধিকার’। অপমান করবার অঙ্গীকারের প্রতি আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ থাকতে হবে। দারুন যুক্তি! সরি, আমরা একমত নই।

ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার,  কার্টুন আঁকা, একজন মুসলিম কোন অপরাধ করলে তা সমগ্র ইসলামের ওপর চাপানো – ইত্যাদি পাশ্চাত্যে নতুন কিছু নয়। কিন্তু নব্য উদারবাদী বিশ্বব্যবস্থা এবং পুঁজির গোলকায়নের যুগে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েমের লড়াই পাশ্চাত্য বনাম ইসলামের লড়াইয়ে রূপ নিয়ে বিষয়টিকে একালে আরও জটিল করে তুলেছে। বিশ্ব ব্যবস্থার বৈষয়িক দ্বন্দ্ব ব্যাখ্যা করা হচ্ছে কোন দেশের সম্পদ কিভাবে লুটতরাজ হচ্ছে তার ব্যাখ্যা দিয়ে নয়, বরং সেটা হচ্ছে গুরুগম্ভীর ‘সভ্যতার দ্বন্দ্ব’ বা ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন’ দিয়ে। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান হচ্ছে অন্যায় যুদ্ধে। তার আধুনিক মতাদর্শিক রূপ হচ্ছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ। আমরা যুদ্ধাবস্থার মধ্যে আছি।

দেখা যাচ্ছে পাশ্চাত্যের উদারবাদি বয়ান ও বিশ্বাসে  বিষয়টি স্রেফ ‘ফ্রি স্পিচ’ বা মত প্রকাশের অধিকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। অন্যকে অপমান করবার অধিকারও এর অন্তর্ভূক্ত। লিবারেল পত্রপত্রিকাতে এই অধিকারেরই জয়গান গাওয়া হয়।  ব্যক্তি ও মতের স্বাধীনতার নামে অপরকে অপমানিত করবার অধিকার ব্যক্তির রয়েছে এই অনুমান বা বিশ্বাসকে আমরা আধুনিক লিবারেল অসুখ বলতে পারি।  ‘প্রতিপক্ষ’ এই অসুখ থেকে মুক্ত থাকতে চায়।

বিবেক ও মত প্রকাশের অধিকার বা স্বাধীনতাকেও আমরা নির্বিচার মনে করি না। এই অধিকার মূলত আধুনিক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি। যে অধিকার ছাড়া গণতন্ত্র কায়েম কিম্বা চর্চা কোনটাই সম্ভব না। তা সত্ত্বেও প্রতিটি আধুনিক রাষ্ট্র তাদের গঠনতন্ত্র বা সংবিধানের এক অনুচ্ছেদে এই অধিকার দেয়, অথচ আরেক অনুচ্ছেদে তা কেড়ে নেয়। ভারতীয় সংবিধান ১৯ (১) অনুচ্ছেদ অধিকার দিলেও রাষ্ট্র তা ‘যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ’-এর অধীন। অর্থাৎ রাষ্ট্র আইন করে তা হরণ করতে পারে। সেটা হতে পারে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা এবং নিরপত্তা রক্ষার নামে,ঙ্ঘতে পারে বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার অজুহাতে, কিম্বা জনশৃংখলা রক্ষার দরকারে, ইত্যাদি। আধুনিক রাষ্ট্র নিয়মিত ‘জনশৃংখলা রক্ষা’র নামে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার অধিকার হরণ করে আসছে। এছাড়া রুচি, সৌন্দর্যবোধ,  আদালত অবমাননাসহ অন্য যে কোন  ‘যুক্তিসঙ্গত’ কারন দেখিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করতে পারে। ভারতীয় সংবিধানের মতোই একই রকম ৩৯ (২) অনুচ্ছেদ বাংলাদেশের সংবিধানেও রয়েছে।

মত প্রকাশের অধিকার আমরা সমর্থন করি। সেই অধিকার রাষ্ট্রের হরণ করবার অধিকারের আমরা বিরোধী। কিন্তু অধিকার কখন অন্যদের অপমানিত, লাঞ্ছিত, হেয় ও তামাশার বস্তুতে পরিণত করে সেই সীমাটুকু সম্পর্কে আগাম সচেতন থাকতে চাই। সেই সীমা আমরা স্বেচ্ছায় মানার পক্ষপাতী। সেই সীমা নৈতিক ভাবে না মেনে তার পরিবর্তে আমরা নিজেদের শাসনে রাখার জন্য রাষ্ট্রকে ডেকে আনতে চাই না। ডেকে এনে নিজেদের নীতিনৈতিকতা বোধ বা নৈতিক কর্তাসত্তাকে গোড়াতেই খুন করে বসতে রাজি না। অর্থাৎ অধিকার চর্চা করবার নামে নীতিহীন বিবেকহীন হতে চাই না। আমার অধিকার চাই, কিন্তু অন্যের মর্যাদা হরণ করে নয়। ব্যক্তির অধিকার অপরের মর্যাদা হানির বিনিময়ে নয়। রাষ্ট্রকে আমরা নীতিনৈতিকতার প্রভু বানাতে চাই না। যার ছুতায় রাষ্ট্র এক অনুচ্ছেদে অধিকার দিয়ে আরেক অনুচ্ছেদে কেড়ে নেয়- এমন রাষ্ট্র চাই না। অর্থাৎ রাষ্ট্র আইন করে বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকীর্ণ করুক, আইন করে সীমা বেঁধে দিক, বিবেকের স্বাধীনতা দেবার নাম করে আবার তা হরণ করুক, আমরা তার বিপক্ষে।

তার জন্য আমরা মনে করি সমাধান একটাই: ব্যক্তি সমাজের অন্তর্গত এই দায়টুকু ব্যক্তি নিজে নিক। সমাজ নিজে তার সাহিত্য, সংস্কৃতি দর্শন চর্চায় ব্যাক্তিকে সেভাবে গড়ে তুলুক। এখানে ‘সাহিত্য’ অর্থাৎ সকলের ‘সহিত’ একসঙ্গে বাস করবার বাসনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা রাষ্ট্র করে না। সাহিত্য করে। যে সমাজে সাহিত্য এই দায় পালন করে না, কিম্বা অপরের প্রতি সম্বন্ধ রচনার গুরুত্ব বোঝে না, সেই রাষ্ট্রে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাও আজ কিম্বা কাল অপসৃত হয়। আমরা চাই ব্যক্তি নিজের বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতা পুরাপুরি ভোগ করুক। কিন্তু ভোগ করুক নিজ দায়িত্বে। অর্থাৎ ব্যক্তি বুঝুক, সে স্রেফ ব্যক্তি মাত্র নয়, তার বিবেক ও স্বাধীনতা সমাজে অন্য সকলের সঙ্গে এক সঙ্গে ভোগ করার বিষয়, একা একা ব্যাক্তি স্বাধীনতার হর্ষে ও উন্মাদনায় উন্মত্ত হয়ে নয়।

মুশকিল হচ্ছে ব্যক্তির এই চরম ব্যক্তিতান্ত্রিক হাল পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে ঘটতে বাধ্য। কারণ পুঁজি একদিকে সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে স্রেফ পুঁজির গোলাম করে রাখে। অন্যদিকে ব্যক্তি যেহেতু পুরানা দাস ব্যবস্থা বা সামন্ত ব্যবস্থায় বাস করে না, তাই ব্যক্তি নিত্য এই ইলিউশানে ভোগে যে  সে ‘স্বাধীন’, তার কোন দায় নাই। না সমাজের প্রতি, না অন্যের প্রতি । তাই দাবি করে অপরকে ‘অপর’ করা, অপমানিত করা, হেয় করা, অপরের মর্যাদা হানি করাও তার ‘অধিকার’।

তাহলে ঠাট্টা তামাশা? না, ঠাট্টা তামাশা মজা করারও আমরা ভীষণ রকম পক্ষে। হাসি তামাশা ছাড়া মানুষ বাঁচবে কি করে? শার্লি হেবদোর ঠাট্টা তামাশা বা কার্টুন আঁকাকে আমরা শুধু অধিকার গণ্য করিনা, এটা আমাদের আত্মার খোরাক বলেও মানি। কিন্ত কোথায় তা ঠাট্টা, মজা, হাসি তামাশা আর কখন অপরের হৃদপিণ্ডে  ছুরি বসিয়ে দেওয়া– সেই হুঁশ শার্লি হেবদোর থাকা উচিত। পাশ্চাত্যের বস্তুবাদ দেহকে মন থেকে আলাদা করে বিচার করতে অভ্যস্ত, এই অনুমান থেকেই ইতরোচিত বস্তুবাদী ধারা গজিয়েছে। তাই তারা বুঝতে পারে না কখন তারা অপরের হৃদয় টুকরা টুকরা করে কাটে এবং সেখানে রক্তপাত ঘটে। ইসলামের রসুলের অপমান তাঁর উম্মতের প্রাণে কিভাবে আঘাত দেয়, সেটা এই বস্তুবাদী ধারা কখনই বোঝে না। কারন মানুষ বলতে তারা স্রেফ জীব বোঝে। তাই শিরচ্ছেদ না হলে তারা বুঝতে পারে না, অপরের হৃদপিণ্ড তারা কিভাবে টুকরা টুকরা করে। মানুষকে তারা হৃদয়সম্পন্ন সত্তা হিশাবে বোঝে না। দেহ ও মনের এই বিভাজন পাশ্চাত্য দর্শনের গভীর সংকটের ক্ষেত্রও বটে। এই বিভাজন প্রাচ্যকে বোঝার ক্ষেত্রেও এক বিরাট বাধা হয়ে আছে।  অতএব বোঝা দরকার কখন অপরের মর্যাদা ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে আমরা ক্ষুণ্ণ করি। কখন আমরা নিজেই ‘অপরায়ন’ প্রক্রিয়া আরম্ভ করি। যে আমার চির পরিচিত তাকে অপরিচিত করে তুলি; প্রতিবেশীকে শত্রু বানাই, মানুষকে আর মানুষ গণ্য করি না।

ইতিহাসে অনেক লড়াই সংগ্রামের  মধ্য দিয়ে স্বাধীন ও মুক্ত মানুষ, অর্থাৎ ‘ব্যক্তি’র  উদ্ভব ঘটেছে। ইতিহাসে ‘ব্যক্তি’র আবির্ভাব এক বিশাল ঐতিহাসিক উল্লম্ফন। আমরা এর গুরুত্ব হাড়ে হাড়ে বুঝি। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা বুঝি এই ব্যক্তি সামাজিক, সমাজ বিচ্ছিন্ন কোন সত্তা নয়। আমরা সমাজের অন্তর্গত –সেই হুঁশটুকু থাকা আমরা জরুরি মনে করি। মানুষ সামাজিক, স্রেফ বিমূর্ত রক্তমাংসশূন্য ‘ব্যক্তি’ মাত্র না। তার মর্যাদা রয়েছে। অপমানিত হলে সেও ব্যাথা পায়। ক্রুদ্ধ হয় এবং নিজের মর্যাদা রক্ষা করতে সে বদ্ধ পরিকর হয়ে ওঠে। এই হুঁশটুকু আমাদের দরকার।

মত প্রকাশের স্বাধীনতার তর্ক তাই একান্তই আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অন্তর্গত তর্ক। ধর্ম, ধর্ম পরিচয় কিম্বা ধর্মীয় সংবেদনশীলতার সঙ্গে শিল্পকলার সম্বন্ধের তর্ক তুলনামূলক ভাবে জটিল। সেই তর্ক আমরা আপাতত মুলতুবি রাখছি। তবে সেই আলোচনায় আমরা সত্বর প্রবেশ করব। ধর্ম নিয়ে আলোচনার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জটিলতা আমরা মানি।  কিন্তু ‘প্রতিপক্ষ’ বাংলাভাষীদের নিজেদের মধ্যে বোঝাবুঝির জায়গা বা ক্ষেত্র। সেই বোঝাবুঝি কিম্বা পারস্পরিক জানাশোনাকে আরও গভীর করবার কাজগুলো আমরা করতে চাই। আপাতত আমরা জানিয়ে দিতে চাই যে রাসুলে করিমের (সা) অপমানে আমরাও অপমানিত বোধ করেছি। একই সঙ্গে শার্লি হেবদোর কার্টুন কেন্দ্র করে যারা আজ অবধি উভয়পক্ষে নিহত হয়েছে তাদের সবাইকেই আমরা স্মরণ করি। এই অপচয় অনর্থক ও শোকাবহ। পরস্পরকে না জানার অন্ধকার দ্রুত কাটুক।  এই আশা করি।

Share