মণিপুরের ইতিবৃত্ত

।। সম্পাদকীয় প্রতিবেদন ।।

বিগত কয়েক মাস ধরে মণিপুরে যে সাম্প্রদায়িক হামলা ও নারী নিগ্রহ চলছে, তাতে উপমহাদেশের সামগ্রীক সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সহাবস্থানের ভারসাম্য পুরোমাত্রায় বিপর্যস্ত হওয়ার উপক্রম। তাই মণিপুরের ঘটনাক্রমের পর্যালোচনা দরকার। আর এই পর্যালোচনা বড় বাংলার সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রতিপক্ষ’তে পেশ করার কারণ, প্রথমত মণিপুরের সঙ্গে বৃহৎ বঙ্গের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। মণিপুরী ভাষা বাংলা হরফে লেখা হয়। বঙ্গের ভাবান্দোলন এক সময় মণিপুরকে প্রভাবিত করেছিল। মণিপুরী-বিষ্ণুপ্রিয়া সংস্কৃতির আধ্যত্মিক বা ধর্মীয় যে প্রকৃতিবাদী ঐতিহ্য তার সঙ্গে মিলে-মিশে গিয়েছিল পুরুষ-প্রকৃতির দৈতাদ্বৈত সাংখ্য দর্শন হয়ে শ্রীচৈতন্যের অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্বের লীলাময় ভাবচেতনা। শুধু তাই নয় বাংলার ইসলমচর্চাও প্রভাব ফেলেছিল মণিপুরে। আবার উল্টোদিকে মণিপুরী শিল্প-সংস্কৃতির প্রভাব বাংলাতেও পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং প্রভাবিত হয়েছেন। রাবীন্দ্রিক নৃত্যের মধ্যে মিশে গিয়েছিল মণিপুরী নৃত্য। এমনকী ‘চিত্রাঙ্গদা’র প্রেক্ষাপটও মণিপুর, যুদ্ধে পারদর্শী চিত্রাঙ্গদা স্বয়ং পুত্রবেশে মণিপুরের রাজকন্যা। আর তাই অবশ্যই এই নৃত্যনাট্যের আঙ্গিক মূলত মণিপুরী নৃত্যশৈলী নির্ভর। দ্বিতীয়ত, ২০২৩-এ মণিপুরে যে সহিংসতা ও নারীদ্বেষী ঘটনাক্রম সামনে এসেছে, তা নিছক মণিপুর বা ভারত বা ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যেকার একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এই ঘটনাক্রম যে ইম্প্যাক্ট তৈরি করেছে তা বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পর্যালোচনার দাবি রাখে। সাহিত্য যেহেতু সমাজ, ইতিহাস ও গণমনঃস্তত্ত্ব বিচ্ছিন্ন নয় তাই মণিপুরের ঘটনা বিষয়ে আমাদের পর্যালোচনাটাও জনসমক্ষে তুলে ধরা প্রয়োজন। আজকের ভুবনায়িত বৈশ্বিক সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা, জাতীয়তা, জাতিবাদ, ধর্মীয় জাতিবাদ ও প্যাট্রিয়ার্কির বিষয়গুলো মণিপুরের ঘটনার মধ্যে কীভাবে ক্রিয়াশীল, তা খুঁজে দেখা দরকার। কারণ, এই প্রতিটি বিষয় আমাদের যাপিত জীবন এবং সামাজিক ক্ষেত্রকেও নিয়ত নানাভাবে অস্থির করে তুলছে।

মণিপুরের আতঙ্কিত কুকি নারী ও শিশুরা

মণিপুরের ঘটনাকে শুধু কুকি উপজাতির উপর অন্য আরেক জনজাতির হামলা কিংবা একদা মাতৃতান্ত্রিক মণিপুরের আজকের বাস্তবতায় নারীদের ওপর সংগঠিতভাবে হামলাকে কেবলমাত্র পিতৃতন্ত্রের নয়া-উন্মেষ বলেও চিহ্নিত করা যাবে না। বরং দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে মণিপুরের উপর ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা যে নিপীড়ন চালিয়ে আসছে সেই নিপীড়নকেই এখন হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি শাসক উত্তরপূর্বের এই পাহাড়ি উপত্যকার আভ্যন্তরীন হিংসার রূপ দিতে মরিয়া। যাতে দূরের দিল্লি থেকে নয় বরং মণিপুরের মাটিতে বসেই দিল্লি বা আসলে নাগপুরের হয়ে কাজ সারতে পারে মণিপুরেরই একাংশের অধিবাসী। যেকোনো আধিপত্যকামী, সম্প্রসারণবাদী শক্তি যেভাবে কোনো নির্দিষ্ট দেশীয় ভূমিতে লুঠ ও দখলের কার্যক্রম পরিচালনা করে, সংঘ পরিবার ও তাদের রাজনৈতিক দল বিজেপি ঠিক সেটাই মণিপুরে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে করছে। এটা করার পিছনেও তাদের লক্ষ্য কার্যত একই। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রকে যেভাবে এক দেশ, এক ভাষা এক সংস্কৃতি ও একমাত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি পূর্ণ ফ্যাসিস্ট জাতিরাষ্ট্রে বদলে দেওয়ার চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই চালাচ্ছে সংঘ পরিবার এবং ভারত রাষ্ট্রের আপাত-গণতান্ত্রিক সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে ফ্যাসিস্ট হিন্দি-হিন্দুত্ব মতাদর্শের কার্যক্রমে যেভাবে কুক্ষিগত করে ফেলেছে, তাতে পরিস্কার, ভারতের বহুদেশীয়, বহুত্ববাদী, বহুজাতিক সত্তাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে একটি প্রবল বর্ণবাদী, বিত্তবাদী ও পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করার দ্বারপ্রান্তের সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আছে হিন্দুস্তানি, হিন্দুত্ববাদী রাম-হনুমান সন্ত্রাসীদের অপরাধী গ্যাঙ।

কিন্তু তাদের এই ব্যবস্থা কায়েমের সামনে চ্যালেঞ্জ ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জ বা প্রতিরোধের বার্তাবহন করার মতো এলিমেন্ট ছিল বা রয়েছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্ব্বিক মূলনিবাসী জাতিসত্তা, বিভিন্ন বেদ-বিরোধী সনাতনী ধর্মীয় স্কুল (বিশেষত জাতবৈষ্ণব, মতুয়া, প্রাকৃত ধর্মসমূহ) এবং ইসলাম ও কমিউনিস্টদের মধ্যে (সিপিএম বা ভারতের সংসদীয় বামেরা নয়)। মণিপুর ভারত রাষ্ট্রের কাছে বরাবরই থ্রেট হিসেবে নিজের স্বাতন্ত্র্য অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে। কেননা, ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরেও মণিপুর বরাবরই নিজেদের জাতিগত বৈচিত্র্যের মধ্যেকার কমন-মিনিমাম ঐক্যের জায়গাটুকু অটুত রেখেই তাদের জাতীয় অধিকার আন্দোলন, এমনকী আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম জারি রেখেছিল। আর সেই সংগ্রামকে দমন করতে ভারত রাষ্ট্রও কোনোরকম কুণ্ঠাবোধ করেনি। খুন, ধর্ষণ, গণহত্যা, গণধর্ষণ- এসবই চলেছে বিশেষ সামরিক আইন আফস্পার মাধ্যমে। আমরা আজও ভুলে যাইনি থাংজাম মনোরমা কিংবা পেবম চিত্তরঞ্জনের কথা। এমনকী দীর্ঘতর কালব্যাপী অনশন চালানো ইরম শর্মিলার কথাও। আমরা ভুলে যাই্নি, ভারতীয় সেনা ছাউনির সামনে মণিপুরী মা-বোনেদের নগ্ন হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনের চিত্র, যেখানে লেখা ছিল, ‘ইন্ডিয়ান আর্মি কাম অ্যান্ড রেপ আস!’ কিন্তু এত কিছুর পরেও মণিপুর অন্তর্গতভাবে বিক্ষিপ্ত কয়েকটি সামান্য বিবাদ ব্যতীত ঐক্যবদ্ধ ছিল। জাতি-ধর্ম নির্বিষেষে মণিপুরবাসী সংকল্পবদ্ধ ছিল নিজেদের জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠায়, দৃঢ়তর ছিল আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক শাখা বিজেপি পূর্ণদ্যমে ভারতের ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারত রাষ্ট্রের পূর্বেকার আধিপত্যকামী চরিত্রকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে সকল জাতিসত্তা, সকল ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং সকল ভাষাকে সর্বগ্রাসী হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি রাজনীতি দিয়ে গিলে খেতে চেয়েছে। এ জন্য তারা প্রথমেই টার্গেট করেছে বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ও অবৈদিক সনাতনী ধর্মগুলোকে। যেসব নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী না তো বৈদিক হিন্দুত্বের সঙ্গে, না তো সেমেটিক ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত বরং তাদের প্রাচীন অবৈদিক প্রাকৃত-প্রকৃতিবাদী সনাতনী ধর্মগুলোর সঙ্গেই সম্পর্ক অটুত রেখেছে, সেসব জাতিগোষ্ঠীকে তাদের ধর্মীয় পরিচিতিকে ছলে-বলে-কৌশলে বর্ণাশ্রমিক বৈদিক হিন্দুত্বের ছত্রছায়ায় নিয়ে এসে ইসলাম ও খ্রিষ্টিয় ধর্মাবলম্বী ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে তৈরি করছে জাতিদাঙ্গার পরিস্থিতি। এতে করে এইসকল জাতিসমূহের অন্তর্গত ঐক্য বিনষ্ট হচ্ছে, আর সেই সুযোগেই তাদের জল-জমি-জঙ্গল দখল করার পাঁয়তারা ছকছে সাম্রাজ্যবাদী বৈশ্বিক পুঁজির উপমহাদেশীয় দালাল আরএসএস-বিজেপি।

সেনা ছাউনির সামনে একদা মণিপুরের নারীদের বিক্ষোভ
ভারতীয় আধিপত্যে শহীদ পেবম চিত্তরঞ্জনের স্মরণে ২০২২ সালের মৌনমিছিল।

মণিপুরে মৈতেই উপজাতির সঙ্গে কুকি উপজাতির দ্বন্দ্বের জায়গাটা এভাবেই তৈরি। কুকিরা মণিপুরে এক অর্থে বহিরাগত হলেও, তারা বহুকাল মণিপুরেই রয়েছে। বহু যুগ আগে নাগাল্যান্ড থেকে কুকি ও নাগারা মণিপুরে আসেন। যেভাবে বহু যুগ আগে আর্যরা বঙ্গে এসেছিল, তারপর ক্রমে তারা বঙ্গের অধিবাসী হয়ে যায়। কুকি ও নাগাদের নাগাল্যান্ড থেকে মণিপুরে আগমনের ইতিহাস অতটাও পুরোনো না হলেও, বহুকাল ধরেই তারা সেখানে রয়েছে। মৈতেইরা ধর্মে বৈষ্ণব। কুকিরা অনেকাংশে খ্রিষ্টান, আবার কেউ কেউ মুসলিমও। বলে রাখা ভালো, মৈতেই-সহ মণিপুরের আদি অধিবাসীরা এক সময় প্রাচীন এক প্রকৃতিবাদী অবৈদিক ধর্ম পালন করতেন। মণিপুরী-বিষ্ণুপ্রিয়া থেকে মৈতেই সকলেই ছিলেন সেই ধর্মের অনুসারী। তাদের ধর্মের নাম ‘আপোকপা ধর্ম’ বা ‘সানামাহি ধর্ম’। বঙ্গদেশের শ্রীহট্ট থেকে বৈষ্ণব সাধুরা এসে মৈতেইদের বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত করেন। অন্যদিকে বঙ্গ থেকে এক সময় মণিপুরের রাজা তাঁর দেশে বঙ্গ থেকে হাজারখানেক সৈন্যকে নিয়ে আসেন, যাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন ধর্মীয় পরিচিতিতে মুসলিম, জাতি পরিচিতিতে বাঙালি। তাঁদের পরম্পরায় কুকিদের অনেকেই মুসলিম। আবার মণিপুরের অন্যান্য অধিবাসীদের মধ্যেও ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা রয়েছেন।

মণিপুরী নৃত্যে রাসলীলা
কুকি উপজাতির নাচ

সংঘ পরিবারের সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং হল এই মুহূর্তে এরকম যে প্রথমে হিন্দুত্বের ছাতাকে প্রসারিত করো। এক্ষেত্রে বৈদিক বর্ণাশ্রমপন্থী হিন্দুত্বের থেকে যেসকল অবৈদিক সনাতনী ধর্মের সমান্তরাল অবস্থান এবং যারা জেহাদ ঘটিয়ে বহু আগেই বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে গেছে, তাদেরকে মাথায় মস্তিস্ক প্রক্ষালন যন্ত্রের সংস্থাপন ঘটিয়ে তা দিয়ে মগজ ধোলাই চালাও এবং তাদের ভাবতে শেখাও যে তারা ‘হিন্দু’ আর তারপর তাদের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দাও, ‘মুসলমানেরা বহিরাগত, তারাই সমস্যার মূল কারণ, তারা সন্ত্রাসী, মুসলমান খেদাও, মুসলিমদের মারো’। অথচ যারা এই কথা প্রচার করে তাদের প্রত্যেকের পূর্বপ্রজন্ম লুঠেরা বর্বর আর্য, বাংলার প্রেক্ষিতে যদি আলোচনা করা যায়, দেঝা যাবে তারাই বাইরে থেকে এসে বৃহৎ বঙ্গের ভূমিসন্তানদের ‘শূদ্র’-এ পরিণত করেছিল, লুঠ করেছিল জল-জমিন-জঙ্গল। আর এই বৈদিক সন্ত্রাসীদের বর্ণাশ্রম প্রথা থেকে মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে পীর-আউলিয়াদের অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ‘নিম্নবর্ণ’-এর ভূমিসন্তানকে জাতপাতহীন ইসলামের ছত্রছায়ায় এনে সামাজিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় তাঁরা ছিলেন অগ্রণী। আর তার বাইরে চৈতন্য-নিত্যানন্দদের ভাবান্দোলন বঙ্গে বেদ-বিরোধী যে বিপ্লবের সূচনা করেচ্ছিল তা এখানকার ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী গণসমাজের ভিত শক্ত করেছে। বেদ ও বর্ণাশ্রম বিরোধী সেই ঝাণ্ডা এই সেদিনও মতুয়ারা দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছিল। কিন্তু গোটা বিশ্বের অতিদক্ষিণপন্থীরা এবং আগ্রাসী পুঁজির ‘লিবারাল’ কারবারিরা যে ইসলাম বিদ্বেষ ও কমিউনিষ্ট বিদ্বেষের নয়া-জাতিবাদী রাজনীতিকে সামনে এনে যে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং চালাচ্ছে, তারই উপমহাদেশীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে সাম্রাজ্যবাদের একনিষ্ঠ দালাল বর্ণবাদী আরএসএস। এরা এখানকার নমঃশূদ্র ও আদিবাসীদের প্রথমে হিন্দু বানানোর পাঁয়তারা করছে এবং তাদেরকে সামনে রেখেই ইসলাম ও কমিউনিষ্ট নির্মূলের কাজটা তারা সেরে ফেলতে চায়, এ কাজে সফল হলে পরের ধাপে তাদের লক্ষ্য ফের এই নমঃশূদ্র ও আদিবাসীদের পিছনের সারিতে ঠেলে দিয়ে বর্ণহিন্দু ও বিত্তবাদীদের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা। আসলে নমঃশূদ্র/দলিত, আদিবাসী ও মুসলিম ঐক্য মানেই ভূমিতে ভূমিসন্তানের অধিকার অটুত থাকা। ইসলামবিদ্বেষ কায়েম করে এই ঐক্য ভাঙতে পারলে, এই ভূমিকে বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে বহিরাগত বৈদিক বর্ণবাদীরা ভাগ করে খেতে পারবে, তাই ঐক্য ভাঙো, লুঠ চালাও। উদাহরণ হিসেবে মতুয়াদের কথা বলা যায়। যে হরিচাঁদ মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেছেন, ডাক দিয়েছেন ব্রাহ্মণ্যবাদমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার, সেই হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদের মতুয়া ধর্মের আজকের ভক্তদের একাংশ পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্বের ছাতার তলায় এসে মুসলিমবিদ্বেষের সুরে সুর মেলাচ্ছে। বিজেপির ভোটবাক্স ভরিয়ে তুলছে। আদিবাসীদের অনেকের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার।

সানমাহি ধর্মের মন্দির

মণিপুরের মৈতেইরা প্রথমত ‘আপোকপা ধর্ম’ বা ‘সানামাহি ধর্ম’-এর মানুষ। দ্বিতীয়ত তারা বৈষ্ণব। কিন্তু বৈদিক বর্ণাশ্রমবাদীরা তাদের ‘আপোকপা ধর্ম’ বা ‘সানামাহি ধর্ম’কে নিষিদ্ধ করে। ১৭৩২ সালে কাংলা ফোর্টের সামনে তাদের প্রাচীন ধর্মসাহিত্যসমূহ ‘পুয়্যা’ পুড়িয়ে দেয় হিন্দু মিশনারীরা। এ কারণে প্রতিবছর মণিপুরী মেরা মাসের ১৭ তারিখ ‘প্যুয়া মৈথব’ দিবস পালন করা হয় হিন্দু মিশনারীদের আগ্রাসনের কালো স্মৃতিকে স্মরণ করতে। মৈতেইরা আপোকপার পরে বৈষ্ণব ধর্মের ছত্রছায়ায় এলেও তাদের হিন্দুত্বে নিয়ে আসার কাজটা জারি ছিল আরএসএসের উপমহাদেশব্যাপী কর্মকাণ্ডের মধ্যেই। হিন্দু বলে ধর্মীয় পরিচয় ঔপনিবেশিক আমলেই তৈরি। তার আগে সনাতনি ধর্ম সমূহের মধ্যে মূল বিভাজনটাই হচ্ছে বেদ ও বেদ পূর্ববর্তী অবৈদিক ধর্মে বিভজানকে ঘিরে। বৈদিক ধর্ম উপমহাদেশে বাকি সনাতন ধর্মগুলির মধ্যে নতুন। কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতির সুবিধার্থে বৈদিক ধর্মের ছত্রছায়ায় অবৈদিক ধর্মগুলিকে এনে একত্রিভাবে নাম দেওয়া হল ‘হিন্দু’। কিন্তু বর্ণাশ্রমপন্থী বৈদিক ধর্মই যেহেতু ঔপনিবেশিক হিন্দু ধর্মের ভিত্তি তাই হিন্দু ধর্ম তার ইজের কাঠামোর মধ্যেই অবৈদিক চিন্তাগুলিকে প্রবলভাবেই দমন করেছে। বৈষ্ণবরা হিন্দু নয়। কিন্তু তারপরেও জোর করে তাদের হিন্দু বানানোর পাঁয়তারা গেরুয়া আধিপত্যবাদীরা চালিয়ে আসছে। এতো কিছু করেও মণিপুরের নন-সেমেটিক জাতিগোষ্ঠীগুলিকে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান প্রোজেক্টের ‘হিন্দু’ বানানো যায়নি। যেভাবে মণিপুরকেও হিন্দিল্যান্ড বা হিন্দুস্তান বানানো যায়নি। উত্তরপূর্বের মঙ্গোলয়েড নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলির বৌদ্ধ, বৈষ্ণব ও প্রকৃতিবাদী ধর্মীয়সত্তাকে বিভিন্ন জায়গায় হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি খোপের মধ্যে আনা গেলেও, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ইত্যাদি রাজ্যের গণচরিত্রকে কিছুতেই বদলানো যাচ্ছিল না। কিন্তু দীর্ঘকালের কংগ্রেস শাসিত ভারতের কেন্দ্রীয় স্তর থেকে দীর্ঘকালীন দমন-পীড়নে ক্ষুব্ধ মণিপুরবাসীর সেন্টিমেন্টকে উস্কে বিজেপি ক্ষমতায় চলে আসে মণিপুরে। আর এসেই হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি রাজনীতির লীলাভূমি হিসেবে মণিপুরকে চিহ্নিত করে এখানকার জনগণের ঐক্য ভাঙার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে। আর তার জেরে ‘হিন্দুত্বের ছাতার তলায় নিয়ে আসা মৈতেইদের লাগিয়ে দিয়েছে সেমেটিক ধর্মাবলম্বী কুকি, নাগা প্রভৃতি উপজাতির বিরুদ্ধে। এতে মণিপুরের জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম বা ব্যাটল ফর লিবারেশন যেমন ধাক্কা খেয়েছে, তেমনই উগ্র হিন্দি-হিন্দু জাতীবাদী আরএসএস বিজেপির পরিস্কার হচ্ছে। কায়েম হচ্ছে এক দেশ, এক জাতি, এক ভাষা, এক ধর্ম, এক সরকার, এক নিশানের ব্যবস্থা। বহুজাতিক ভারতকে ভারতীয় হিন্দুজাতির ভূখণ্ড বানানোর যে চেষ্টা শুরু করেছিল আরএসএস আজ তার দ্বারপ্রান্তে তারা, যেখানে থাকবে মনুবাদী বৈদিক বর্ণাশ্রম ধর্ম কেবল, হিন্দিই হবে একমাত্র সরকারি ভাষা, আর সরকার চালাবে আদানি-আম্বানির পোষ্য মোদি-শাহ-ভাগবতের মতো উকুনরা। আর তারপর গিলে খাওয়া হবে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকেও। আর এই কার্যক্রমকে সফল করতে গেলে অবশ্যই দরকার নারী ও শিশুর ওপর হামলা, যেকোনো সাম্রাজ্যবাদী লুঠ ও আগ্রাসনের নিয়মই এটা। তার ওপর মণিপুর চরিত্রগতভাবে মাতৃতান্ত্রিক। তাই সেখানকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিন্যাসকে ধ্বংস করতে হলে দরকার পিতৃতন্ত্রের প্রবল উত্থান। মনুবাদী রাজনীতির ধারক-বাহকরা তো তাই স্বাভাবিকভাবেই একদিকে জাতিদাঙ্গা বাধানোর পাশাপাশি চিত্রাঙ্গদাদের টার্গেট করবেই। সেটাই করা হয়েছে। বীরেন সিং-এর রাজনৈতিক পরিকাঠামোর মধ্য দিয়ে সেটাই করেছে দিল্লির সন্ত্রাসবাদী হিন্দু শাসকরা।

আজ যদি এই পিতৃতান্ত্রিক হিন্দুত্ববাদীদের আমরা সমূলে গোটা উপমহাদেশ থেকে উপড়ে ফেলতে না পারি, তাহলে আমাদের ঘরের মা-বোন-স্ত্রী-প্রেমিকা-বান্ধবীদেরও এভাবেই মোহন ভাগবত, নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহদের দলবলের হাতে লাঞ্ছিত হতে দেখব, দেখব আমাদের জল-জমি-জঙ্গল লুঠ হয়ে যেতে।

সূত্র-1. Ethnicity in Manipur by Lucy Zehol (Published by Regency Publiction, 1998)
2. Wounded land- Politics and Identity in Modern Manipur- by John Parratt (Published by Mittal Publication, 2005)
3. Peace Process in Manipur- Armed Conflict, State Repression, and Women- by Lokendra Arabam (Published by Omeo Kumar Das institute of social changes and devolopment)
4. কুঙ্গ থাঙের ব্লগ

Share