ফুল্লরার পঙক্তিমালা

।। রাবিয়া সাহিন ফুল্লরা ।।

তবু কোনো কোনো দিন
বারান্দায় দাঁড়ালেই কবিতা পায় বাতাসে—
লাগে যেন দূরপাল্লার কোনো গাড়ির মতন
রাস্তার সব ধূলা নিয়ে
প্যাঁপোঁ প্যাঁপ্যোঁ করে
ঢুকে গেছি কারোর নাকে ও মগজে।

কাঁথাফোঁড়

আম্মার বালিশ তুনে দেয়ার মতন ছোট ছোট কাজে মন দিতে ভালোলাগে।
ভালো লাগে সুঁইয়ে সূতা দিয়ে
একের পর এক ফোঁড়ে ফুটাতে ফুল আর পাতা।
আর অনেক ভাঁজের নকশিকাঁথায়
কথাগুলা ফোঁড়ে ফোঁড়ে গেঁথে দিয়ে মালার মতো
দুনিয়ার বড় কিছুর ফাঁকে থেকে যাওয়া ছোট কিছু হয়ে
ফ্যান্টাসির ভিতর একটা তিলের মতন আপন লাগলে
দরদের সুরে এমন চঞ্চল হয়ে উঠি—
নিজেরে মনে হয় রাবিয়াপা!
মুহাম্মদপুরে না থাকার পরও
কোনো পুকুরের পাড়ে বসে হামদর্দী অনুভব করলে
স্বপ্নে নানুআপার মুখ দেখার মতন
সান্ত্বনায় চোখে টলটল করে পানি।
যদিও ফোঁড়ে ফোঁড়ে গেঁথে রাখা কথারা জানে না কোথায় যাবে…

কুসুম কুসুম

তোমার বেখেয়ালির ভিতরেই বরং
আমি থাকি।
তোমার না তাকানোর ভিতর
আরো কিছুক্ষণ—
কুসুম কুসুম বেশরম হয়েই হয়তো
সুবাসের সুড়সুড়ি দিই তোমার নাকে।

তুমি এমন বিলাইর মতন ঘুমাও!
ঘুম ভাঙ্গে না;
বসন্ত আইলো অথচ গান গাইলা না!

চকলেটের মতন গলতে থাকা শরম চেপে
শতায়ু কচ্ছপ হয়েই যেন বসে আছি
তুমি জাগবে কি জাগবে না
এই ফাঁকে আমার পিঠেই
চারা গজালো
পাতা ছড়ালো
নতুন নতুন কুঁড়ি—বসন্ত, বসন্ত!

এমনই অস্থির এই সময়—
তবু কোনো কোনো দিন
বারান্দায় দাঁড়ালেই কবিতা পায় বাতাসে—
লাগে যেন দূরপাল্লার কোনো গাড়ির মতন
রাস্তার সব ধূ্লা নিয়ে
প্যাঁপোঁ প্যাঁপ্যোঁ করে
ঢুকে গেছি কারোর নাকে ও মগজে।

মশারা যেমন
মশারির চারপাশে ঘুরে ঘুরে
ঠিকই রাস্তা বের করে;
খুনীদের খুন হয়ে যাক ঘুম সামান্য আওয়াজে

মরিচবাতি

নিজেরে লুকানোর জায়গা খুঁজতেছি।
চারদিকে এত আলো—
বিড়ালের চোখের মতো অন্ধকারগুলা
খালি ধরা পড়ে যায়।
যেন যত আলো তত অন্ধকার!

অন্ধকার গায়ে মেখে
একটা কাঁঠাল গাছের নিচে যদি বসে থাকতে পারতাম!
যদি পারতাম আম্মার গায়ের গন্ধের মতন কাঁঠালের মুসির ঘ্রাণ নিতে নিতে
কারোর উঠানে সকাল সকাল কামরাঙার ফুল হয়ে ঝরে যেতাম!

যেকোন বাড়ির সামনে এক টুকরা অন্ধকার খুঁজতে খুঁজতে
কখনো খালপাড়ে শিলকড়ইয়ের মতন দাঁড়ায়ে থাকি।

যেন হৃদয় একটা ছাড়াবাড়ি—

আতিথেয়তার অভাবে বসন্ত আসে বসন্ত যায়।

সন্দেহ সরাতে সরাতে দেখি, দূরে
বিয়াবাড়িতে অগণিত মরিচবাতি হয়ে কে যেন জ্বলছে বিরহে!

চৈত্রের ঝিঁ ঝিঁ

আব্বুর কাছাকাছি এক টুকরা অন্ধকারে
ডাহুকের ডাকে বিলাপ তুলি সারা গেরাম যেন স্কুল হয়ে গেছে।
অক্ষরগুলা চৈত্রের ঝিঁ ঝিঁ হয়ে ডাকতে থাকলে
ঢাকের বাজনায় যেন সুখের দিনগুলাই হাজিরা দিতে চায়
অথচ ভাতের পাতিলে দুয়েকটা পাথরের মতন এমন ক্যারক্যারা আমাদের স্বর—
আম্মার মিসকল যেন একেকটা পাতা খসা।
টঙে হাঁসের নড়াচড়ার ভিতর পাশ ফিরে শুই
যেরকম মাছের ঘাইমারার মতন বাতাস এসে একেকবার বদলে দেয় ইস্যু।
এতসব কিছু ঘটে অথচ না বলার ভিতর শব্দরা
চুপ করে বসি থাকে অজস্র কবিতার ভান করে।
তোমারে পাঠানোর মতন কোন শব্দ নাই বকের স্থিরতায়—
দাদীর লাগানো হরিতকি গাছের নিচে আদিস্বর খুঁজে মরি, যদি পাওয়া যায়—
সমূহ স্ট্রেসের উপর লাগাবো প্রলেপ!

ফুলের মৌসুমে

আমাদের এত এত মিল
তবু অমিলগুলাই কেবল চাড়া দিয়ে ওঠে।
লতালেঙ্গুরেরাও আম্রিকার মতন কেবল উনিকুনি খোঁজে।
বায় মুখে বসে থাকা সকাল আটটায়
ঝড়ের মুখে ক্লান্ত গাছগুলারে দেখে মনে হয়
এরাই আমার বাপ-ভাই।

খরপাতায় প্রজাপতি বসা এই ঝিমমারা রইদে
জুম্মার গোসল কোনদিন হলো না বলে
মিলাদের সুরে সুরে কেবল দুলেছি খানিক

ফুলের মৌসুমে
মাছি তাড়াতে গিয়ে
মানুষকে চেনার ভান করা যায় কেবল
চিনতে পারার তুমুল উত্তেজনায় হয়ত লেখা যায় দুয়েকটা পংক্তি

দূরত্ব যত আপন লাগে তত মনে হয়,
মেহগনিফুলের মতন ঝরঝরে আজান
যখন কানে বাজে
মসজিদে ঢুকতে না পারার মতন অসাধ্য হতে চাই নি আমি
পরিচয় লুকাতে না পারলে কারে দিব গালি?

জিওল মাছ

অন্ধকারে নড়তে থাকা পাতার মতন আম্মা—
যেন অনন্ত গর্ভকালে
দুনিয়ার সব চিন্তা মাথায় নিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন হাওয়া।
অট্টিঅট্টি খেলার মতন সারাদিন ছক আঁকেন
আর শাড়িগুলা আলমারিতে তুলে তুলে রাখেন।

অথচ আব্বু যেন বইয়ের ভাঁজে নিজেরে গুঁজে রেখে
মাকড়সার খোসা হয়েও জালে আটকে
বসে আছেন পৌরাণিক সুরভী মেখে।

যে গাছ যুগলগন্ধি ছিল তা কাটা হয়ে গেছে কত আগে।
শৈশব ধরে সব রাস্তা চলে গেছে নানুরবাড়ি।

এত বড় বাড়ি তবু একা—
বড়চাচী কলাগাছ হয়ে যেন দরদে—
এমনকি হাঁসের পালকে, মুরকার ডাকে যেন
ছড়ায়ে ছিটায়ে থাকেন আন্দাছান্দায়!

মান্না সালওয়ার মতন সংসারের স্বাদ আর না পেলেও
পূর্বের অভিজ্ঞতায়
তবু কী যে রুটিনমাফিক ঘরের দরজা খুলে যায়!

দোয়াইঞ্জায় ঘুরতে থাকা বাতাসে যৌথজীবনের পর্দা নাচে।
মা-হারা ভেড়াটার ডাকে ডেঙ্গাআঙ্গি কাঁপতে থাকলে লাগে যে,
প্রত্যেকের ভিতরেই আছে এক জিওল মাছ
যেন ব্যাখ্যাতীত আলিফ লাম মীম!

রইদের আহাজারি

বৈশাখমায়া রইদের আহাজারি চোখেমুখে লেগে আছে যেন
যার দিকেই তাকাই—
পাখনা আলগা করা মুরকার মতন কপকপাচ্ছে সবাই।

জানি না কতদিন আর পানি টানবে হাজোরা খালায়!
পুকুরগুলা যেন লোদেহড়ে ছলছলায় হাঁসের ঠোঁটে।
দুইটা কলাপাখি শুকনা পাতার রঙে যেন মিশে আছে বিধবার বুকে!

পাতা ঝরে গেলেও থামে নাই আগুনের পোড়ন।
যে ফুল অন্ধকারে ঝরি গেল
কিছু সুরভী কি তার রেখে দিল মন?

একলা এক বেড়ে উঠা গাছ যেন বিরানভূমিতে
পাতা নাড়ে হাওয়ায়—
পিরীতি পোষে মনে যেরকম পাখিরা চঞ্চল—
ঘুমের ভিতরেও যারা ডাকে,
চায়—
আরো আরো গাছে যেন ভরে ওঠে জঙ্গল!

প্রিন্টের শাড়ি

বিষ্টির পরে এতটাই নরম হয়ে আছে মন
যেন ধান রোয়া যাবে এখন….
তোমারে ডাকার মতন স্বর জেঁকে আছে চাতকের গলায়।
মেঘ মেঘ করা এইসব দিনে
তোমার ঘুম হয়ে থেকে যাই আমি
ঘুম নাই যার জানলায় মুখ—

জানি না জন্ডিস হইছে কি না
চুনগলা পানিতে কখনো বামনী এসে ঘষলো না তো গা।
কত রছম যে আছে গেরামে—
বুবুরে,
হলুদ পানি কি কখনো গা বেয়ে নামবে না পায়ে?

দেশী মুরকা যেরকম বাড়ির কিনারে-কানারে
খুঁটে খুঁটে বিছরাইতে থাকে আদার, আমিও তারে—
যেন জীবনটাই এক শবে কদরের রাইত।
যেন আঙুলের কড়ে কড়ে বেজোড় অংকের ভিতরেই আমরা চক্কর মারতেছি।

অন্ধকার গায়ে মেখে
আড়াআড়ি পার হয়ে যাইতে যাইতে কখন যে একটা ধাড়ি বোনা হয়ে যায়—
যা বিছায়ে ব্যাঙের মতন বসে থাকা যায় উঠানে
যেখানে পানি জমে না বরং ছামারা ছড়ায়ে ছিটায়ে গায়ে জড়ায়ে থাকে—
যেন বুবুর গায়ে থাকা প্রিন্টের শাড়ি।

তোমার উসিলায়

নিজেরে যত গুঁজাতে চাই
বয়ঃসন্ধির ব্রণের মতন তবু—
ফুটে ওঠি!
কাওয়ালি গানের মতন সংসার—
আমারে ঘাড়ে করে নাচাইতেছে।
তাল রাখতে গিয়ে
কথারা এত ছোট আর মুখস্ত হয়ে গেছে
ভিতরের বাতাসটুকু ভিতরেই থেকে যায়।

কখনো তোমার উসিলায় জানালা খুললে, ভুলে
নতুন বাতাস আসে—
যেন ভাইয়ের খোঁজে হাঁটার মতন কম্প
লোমে লোমে শব্দের তীব্রতা খোঁজে।
যে শব্দরা খরচ হয় নি এখনো
তাদের তুলে আনতে চাই
কবরের মাটির মতন।

ভিতরে যেন সারাদিন এক আজান
আব্বার ছায়ার মতন স্থির—
বনের সবুজ হয়ে জাগায়ে রাখে আমার চোখ…

পানকৌড়ির ডুব

নারীর বর্ণনা দেয়া যত সহজ
পুরুষের বর্ণনা দিতে গেলেই ঘেমে যায় স্বর—
আকুল আড়ষ্টতায় চোখ মেলে দেখা যায় না মুখ।
যত চাই ধীরে আগাক তার চেয়ে দ্রুততায়
করে দেয় অপর।

এইসব না-পারাজনিত শরমিন্দাভাব ভালোলাগে।
দোল-কলমির মতন কেঁপে উঠা গোপন জাগায় আরো অধিক ঘনিষ্ঠতা।
সরে সরে আমরা কতদূর যাবো আর—
ছোট্ট এই দুনিয়া—
বাহুর বেষ্টনীতে যদি পারতাম পরমঘুম ঘুমাতাম!

তার চেয়ে এখন তোমারে না হয় হাঁটতে হাঁটতে চিনালাম
কোনটা কী গাছ আর কোন্ ফুলের কেমন সুবাস—
এমনও হতে পারে লাম্বুরহাট ধরি আগালে
নৌকায় চড়ি নাজিরারচরে দেখতে গেলাম খিরার চাষ।
শিমুলের ফুলে কলাপাখি যে কী খায়—
মাঝির খোঁজে হয়রান আমরা
অঙ্ক মিলাতে না পেরে চুপচাপ বসি বসি গুনলাম কর্ণফুলির ঢেউ।

না পারাগুলি যেন ভাসতেছে স্রোতে কচুরীপানা,
দূরে দুলতেছে ধীরে মাঝিহীন ডিঙ্গা।
রইদ বাড়তেছে ক্রমে
ছায়া প্রায় নাই
তোমারে দেখাই, দুই পানকৌড়ির ডুব!

অলংকরণ- সাইদ উজ্জ্বল

রাবিয়া সাহিন ফুল্লরা

জন্ম ০২ মার্চ ১৯৯৭। বাড়ি সন্দ্বীপ, বাংলাদেশ। বেড়ে উঠা সন্দ্বীপেই। রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশিত বই : দরিয়ার ফুল [ বাছবিচার ও প্রিন্ট পোয়েট্রি , ২০২১]

Share