আমাদের গ্রাম

গদ্য সাহিত্য

।। জেসমিন নাহার ।।

শহরে ‘সমাজ’ নাই। এই অর্থে যে গ্রামে আমি ‘সমাজ’ টের পাই। শহরে সমাজ টের পাই না, যেটা টের পাই তাকে ‘বাজার’ বলে। বাজারের মধ্যে সমাজ কিভাবে হারিয়ে যায় সেটা সমাজতত্ত্ববিদের বুঝিয়ে বলার কথা। আমি সাহিত্য করতে চাই, আমার কাজ হচ্ছে আমার উপলব্ধি সরলভাবে বলা।

ছবি: অতনু সিংহ


আমাদের গ্রাম

দুই হাজার বিশ সালে কোভিড নাইন্টিন লকডাউনের কারণে আমি দু’মাস বাড়িতে ছিলাম। গ্রামে বাড়িতে বসে না থেকে আমি মাঠে ঘাটে বাটে ঘুরে বেড়াতাম। লোকের চোখে অবশ্য খারাপ লাগত। আমি আইবুড়ো মেয়ে ধিচিং ধিচিং করে ঘুরে বেড়াচ্ছি! যেখানে আমারই বয়সের মেয়েরা তিন ছেলেমেয়ের মা, আমার ছোটরা এক দুই ছেলেমেয়ের মা, সকলে ভেবেছে আমি লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে মরেছি! কথাটা যত সহজে আমি এখানে লিখে বলতে পারছি ব্যাপারটা অতো সহজ না। যে কোনো মেয়ের মতো আমারও খুবই খারাপ লাগে। গ্রামে যেতে ইচ্ছা করে না।

কিন্তু শহর কি ভালো? না। শহরে ‘সমাজ’ নাই। এই অর্থে যে যে গ্রামে আমি ‘সমাজ’ টের পাই। শহরে সমাজ টের পাই না, যেটা টের পাই তাকে ‘বাজার’ বলে। বাজারের মধ্যে সমাজ কিভাবে হারিয়ে যায় সেটা সমাজতত্ত্ববিদের বুঝিয়ে বলার কথা। আমি সাহিত্য করতে চাই, আমার কাজ হচ্ছে আমার উপলব্ধি সরলভাবে বলা।

শহরে ‘সমাজ’ নাই ‘বাজার’ আছে, ছেলেরা সহজে বুঝবে না। কিন্তু মেয়েরা বোঝে? সাধারণত শহরে কেউই জিজ্ঞাসা করে না আমি শাদি করেছি কি না! যারা করে, তাদের আমি চিনি। কেন জিজ্ঞাসা করে, তাও বুঝি। তাদের পশ্চাতদেশে কষে মনে মনে একটা লাথি মারি। আসলে আমি একা বটে, কিন্তু মোটেও নিঃসঙ্গ না। আমি খুবই ভাল আছি। যাঁরা আমাকে নিঃস্বার্থে ভালোবাসেন, তাঁদের ভালোবাসার গভীরতা আমাকে আপ্লুত করে। এই আনন্দটুকু অমূল্য। মেয়রা কেন একা থাকতে পছন্দ করে সেটা আমি আমাকে দিয়ে হাড়ে হাড়ে বুঝি।

কিন্তু আমি ব্যক্তিবাদী না, অর্থাৎ এখানে আমি ‘নারীবাদী’ ভাব নেবার ভান করতে চাইছি না। গ্রামে এখনও অনূঢ়া মেয়েদের মন্দ চোখে দেখে, এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা। তবে সেই কথা নতুন ভাবে প্রমাণ করে মানুষ বা সমাজ কতো খারাপ সেই কেচ্ছা গাইবার ইচ্ছা আমার নাই। কখনই জাগে নি। আমি সামাজিক মানুষ, সমাজে সামাজিক হওয়ার অর্থ ব্যক্তিকে নানান হিউমিলিয়েশানের মধ্য দিয়েই সামাজিক হতে হয়। গ্রামীন সমাজে  একজন অনূঢ়া মেয়ে হিশাবে আমার দ্বন্দ্ব নিয়ে আমি যতো ভাবি, ততোই আমি আমাকে এবং আমার সমাজকে আরও বড় পরিসরে ভাবতে শিখি। সেই ক্ষেত্রে সমাজকে মন্দ প্রমাণ করবার তাগিদ আমি বোধ করি না। কিন্তু নিজের সমাজকে আরও গভীরভাবে বোঝারবাসনা আমার তীব্র হয়।


শহরে ‘সমাজ’ নাই ‘বাজার’ আছে, ছেলেরা সহজে বুঝবে না। কিন্তু মেয়েরা বোঝে? সাধারণত শহরে কেউই জিজ্ঞাসা করে না আমি শাদি করেছি কি না! যারা করে, তাদের আমি চিনি। কেন জিজ্ঞাসা করে, তাও বুঝি। তাদের পশ্চাতদেশে কষে মনে মনে একটা লাথি মারি। আসলে আমি একা বটে, কিন্তু মোটেও নিঃসঙ্গ না। আমি খুবই ভাল আছি। যাঁরা আমাকে নিঃস্বার্থে ভালোবাসেন, তাঁদের ভালোবাসার গভীরতা আমাকে আপ্লুত করে। এই আনন্দটুকু অমূল্য। মেয়রা কেন একা থাকতে পছন্দ করে সেটা আমি আমাকে দিয়ে হাড়ে হাড়ে বুঝি।

যেহেতু আমি পাড়ায় পাড়ায় ঘুরি সেহেতু সকলে ভাবে আমি তাদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা  করতে গিয়েছি। বাংলাদেশের এনজিওগুলো এই মানসিক হীনমন্যতা তৈরি করে দিয়েছে। গ্রামের মানুষের ‘ক্ষমতায়ন’ দূরের কথা, তারা আত্মমর্যাদা হারিয়েছে। সে যে যা ই ভাবুক, এখন বলব অন্য কথা।

আমার ধর্ম জন্ম বা পারিবারিক সূত্রে ইসলাম।  কিন্তু আমার ‘হিন্দুপ্রীতি’ আছে। হয়তো ফকিরবাড়ির মেয়ে হিশাবে এটাও আমি জন্ম সূত্রে পেয়েছি। বান্ধবীদের কেউ কেউ আমার উপরে রেগে গিয়ে বলে আমি নাকি আগের জন্মে হিন্দু ছিলাম। এবং এখনো যখন আইবুড়ো তখন বিয়ের জন্য আমার কপালে হিন্দু পাত্র জুটে যেতে পারে। তারা কথাগুলো আমাকে নিন্দা করে বলে, নাকি আমার ফকিরি মার্কা পারিবারিক ‘ইসলাম’কে প্রশংসা করে বুঝতে পারি না।

তবে যে বাড়িতে আমি বসবাস করি সে বাড়িটা উনিশশো সাতচল্লিশের আগে ছিল দত্তবাড়ি। মুরুব্বিরা কেউ কেউ আমাকে দত্তবাড়ির মেয়ে বলেন। এভাবে বলে, “ও তুই বক্তজামালের পুতনি!! দত্তবাড়ির মেয়ে!! হাদে দ্যাখ বস বস।”  ছোটবেলা থেকে এরকম সম্বোধন শুনতে শুনতে চারপাশে যেসব কামার, কুমোর, নাপিত, ধোপা,  হাজাম এবং বাগদি বাস করতো তারা ছিল আমার খেয়াল করে দেখবার মানুষ।

ছবি: অতনু সিংহ

বড়ো কোনো হিন্দু পরিবার আমার গ্রামে নাই। দেশভাগ তাদের সকলকে ভারতে পাঠিয়েছে। ছোটবেলায় আষাঢ় শ্রাবণ মাসের প্রবল বর্ষণের পরে  আমাদের বাড়িতে নানান রকম চুলার আকৃতি ফুটে উঠতো। আমি দাদাকে বলতাম,” দাদা এই দ্যাখো গোল ইঁটের মদ্যি মাটি। দাদা বলতেন দত্তরা বোধায় আকা খুচেল একেনে।” ধানের সময়ে আমাদের বাড়ির চারপাশে ধানের চিটা, খড়কুটো ছড়ানো ছিটানো থাকে, আগেও থাকতো। প্রতিবিকালে ভ্যানের উপরে জুঙড়ায় করে নান্দা, কলসি, চালের হাড়া নিয়ে এক-দু’জন মানুষ আসতো। তারা ঠিক যেখানে আমার মা ধানের চিটা, খড়কুটা জমা করে রাখতেন সেখানে এসে ডাক দিত,  ও চাচি,  চাচি। মা আমার বড়ো বোনদের পাঠায়ে দিতেন, ওরা আমার বোনদের হাতে নান্দা কলস বুঝিয়ে দিয়ে চিটে খড়কুটো নিয়ে চলে যেতেন। সমাজে সম্পর্কের মধ্যে জীবন যাপন ও জীবন ধারণের খুবই কংক্রিট ব্যাপারগুলো থাকে, সেটা আমি কার্ল মার্কস না পড়েও ছোট বেলার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতাম। শহুরে বিপ্লবীরা যখন বড়ো বড়ো কথা বলে তখন তাদের ফাঁকির জায়গা গুলো বুঝতে আমার বিশেষ বেগ পেতে হতো না। আমি ‘প্রগতিশীল’ হই নি। ফকিরের মেয়ে ফকিরই থেকে গিয়েছি। 

সমাজজীবনে সম্পর্কের মধ্যে জীবনযাপন ও জীবনধারণের খুবই কংক্রিট ব্যাপারগুলো থাকে, সেটা আমি কার্ল মার্কস না পড়েও ছোট বেলার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতাম। শহুরে বিপ্লবীরা যখন বড়ো বড়ো কথা বলে তখন তাদের ফাঁকির জায়গা গুলো বুঝতে আমার বিশেষ বেগ পেতে হতো না। আমি ‘প্রগতিশীল’ হই নি। ফকিরের মেয়ে ফকিরই থেকে গিয়েছি। 

তারপর আস্তে আস্তে গ্রামে মাটির পাত্রের বদলে টিন, স্টিল সিমেন্ট বালির পাত্র আসতে শুরু করলো। চোখের পলকে কবে একটা প্রাচীন প্রথা আমার পাড়া থেকে উধাও হয়ে গেলো বুঝতে পারিনি। ঘরে ঘরে চাল রাখা মাটির হাড়ির বদলে এলো টিনের ব্যারেল। মাটির রিং স্ল্যাবের বদলে এলো সিমেন্টের রিং স্ল্যাব। খড়ের বদলে টালি, টালির বদলে টিন। বাড়ি বসেই গ্রামের প্রায় সব হিন্দু পরিবার গুলোকে চিনে গিয়েছিলাম। খড় নিতে আসে কুমোর, লাঙ্গলের ফাল ঠিক করতে যায় আমার বাপ কামারের কাছে, কালা মুচি আসে ছাগল ছাইড় দিতে, মনা নাপিত বাজারে বাপের চুল দাঁড়ি ছাটাই করে। তখন একচেটিয়া সকলের মাটির ঘর ছিল। ঘর লেপা মাটি দিয়ে ঘরগুলো সুন্দর করে লেপা থাকতো। প্রত্যেক বাড়ি দেখে যেমন ধনী গরিব বোঝার উপায় ছিল না, ঠিক তেমনি  হিন্দু মুসলমান পার্থক্য করতে পারতাম না আমি। কারন ধুতি-পাঞ্জাবির বালাই ছিল না।

যখন ছোট ছিলাম কার্তিক মাসে ‘আইরোহ’ হতো। একটা নির্দিষ্ট স্থানে হিন্দু মুসলমান ছেলেমেয়ে উভয়ের মুখ আইরোহর মশালে দেখা যেত। এখন আর এই আনন্দ কেউ উপভোগ করে না। জানেই না কেউ ‘আইরোহ’ নামক কিছু একটা ছিল। আমাদের ঈদে হিন্দুদের আসার তাগিদ ছিল না। কিন্তু ওদের পুজায় আমরা প্রায় প্রতিদিনই যেতাম। ছোট ছোট হাড়ি পাতিল আমি প্রথম হিন্দুদের দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান থেকেই কিনেছিলাম।  পূজামণ্ডপের দেবী কী ভীষণ সুন্দর!  ভাস্কর তার মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করেছে। কিন্তু বড়ো আপুরা শিখিয়ে দিতেন কোনোপ্রকারেই ওদের দেবীকে সুন্দর বলা যাবে না। বললে বেহেস্তে যাওয়া যাবে না। 

তাও কী হয়! দেবী মূর্তির সামনে যাওয়া মাত্রই বলে ফেলতাম, বাহ কি সুন্দর! তারপর প্রতি রাতে প্রায়শ্চিত্ত করতাম হে মহান আল্লাহ মাফ করে দাও, আর হিন্দুদের মূর্তিকে সুন্দর বলব না। তার পরেরবার পুজায় যা আমি তাই। আল্লাহ আসলেই আছেন বলে আমার মতো বালিকাকে তিনি সহ্য করেছেন। হয়তো আরশে কোথাও বসে তিনি হেসেছেন। আল্লাহ  মনুষ্য হলে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য বহু আগেই আমি ত্যাজ্য হতাম। 

যখন স্কুলে ভর্তি হলাম হিন্দুবাড়ির ছেলেমেয়ে আমার সহপাঠি হলো। পাড়ার মা চাচিদের সঙ্গে আমিও যেতাম চিতই পিঠার খোলা, মুড়ি ভাজা ঝাঁঝরি কিনতে। আর এই শীতকাল রসের সময়, প্রতিবাড়িতে রসের ভাঁড়, প্রতি দুপুরে ভাঁড় পুড়িয়ে খেজুর গাছে রস পাতাতে নিয়ে যাবার আগে প্রতিবাড়ির ছেলেমেয়ের নাকে নলেন গুড়ের গন্ধ লাগবে। সাথে কুমোর বাড়ির পাজায় কাদা লাগানো চোখে ভাসবে। জিরেন রসের ভাঁড়ের উপরে অনেক মৌমাছি পড়ে থাকতো, পাখি কোন কোন ভাঁড়ে পায়খানা করে যেতো, অনেকগুলো ভাঁড়ের মাঝে যে ভাঁড় একেবারে পরিস্কার সেই ভাঁড়ের রসে থাকতো গতদিনের পোড়ানো ভাঁড়ের গন্ধ। পাড়ার কিশোর ভাইয়েরা মিলে সন্ধ্যায় যেতো রস পাড়তে। শীতের প্রায় প্রতি রাতে জিরেন রসের সন্ধ্যায় আমরা রস খেতাম। উলা রসের গাদের মাঝে মৌমাছি বেশি বসতো। মরেও থাকতো বেশি। মাঝে মাঝে আমরা পাড়ার মেয়েরা যেতাম পাঠকাঠিকে নল বানিয়ে বিকালের পরে জিরেন রস খেতে। যার বাবার খেজুর গাছ ছিলো না তার ভাগ পড়তো তার বান্ধবীর বাবার গাছে। সকালে প্রত্যেক বাড়ির মায়েরা যখন রস জ্বালাতো তখন শিশুরা গুড়োর খামি বানায়ে পাঠকাঠির নুড়ি বানায়ে দিতাম গরম রসে ছেড়ে। খেতে কি দারুণ লাগতো। এখন শীতের বেশিরভাগ সবজিই শিশুরা মাঠে গিয়ে কাঁচা খাবে। কচি ঢেঁড়স, কচি বেগুন, পেঁয়াজের কলি, পাকা টমেটো প্রভৃতি। 

শীতকাল মানে রসের ভাঁড়। প্রতি সকালে কোনো না কোনো বাড়িতে নলেন গুড় নয়্তো জিরেন রসের ক্ষীর। আর এই ভাঁড় তৈরি হয় যে বাড়িতে সে বাড়িতে আমি এবার গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম ওদের কুমোর বাড়ি আর কুমোরবাড়ি নেই। ইঁটের বাড়ি হয়ে গিয়েছে। পাঁজাগুলো আছে। একটা বাদে অন্যগুলো নিষ্ক্রিয়। নিষ্ক্রিয় গুলো চালু হয় শুধু দূর্গা পুজার আগে। এখন পাঁজাগুলো ভরে আছে বিচুলিতে। ধীরেন পালের প্রত্যেক ছেলের ঘরে ঘরে ধান বোঝাই। প্রত্যেকে বিচুলি গাদা দিচ্ছে। এ কর্মেরও অন্যরকম সৌন্দর্য আছে।

কিন্তু কুমোরবাড়ি মানেই তো মাটির হাঁড়ি পাতিল। ঘরভর্তি থাকবে মাটির জিনিসে। কাজ চলবে কাদা মাটি নিয়ে। থাকবে মাটির ঘরবাড়ি। বৃষ্টি এলে দৌড়ে দৌড়ে মাটির জিনিস তুলবে ঘরে। আট বছর আগে তো তা ই ছিল। আশ্চর্য যে এখন আর নেই। মাটির হাঁড়ি পাতিল তৈরির চাকাটাই এখন আর পাতে না তারা। ধীরেন কাকার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলাম। বললেন,” তোমার কাকা একন আর চাকা ঘুরোতি পারে না” । জানতে চাইলাম, দাদারা কেউ শেখেননি কাকার কাছ থেকে! জবাবে বললেন, “শিকে কী করবে মা, আস্তে আস্তে তো সপ হারায়ে যাচ্ছে! একন তো আমার ছেলেরা সপ কৃষিকাজ করে খায়। প্রত্যেকে ইটির ঘর করেচে। প্রত্যেকের ঘরে বছরের চাল। বাজারে একন খালি একটা মাটির জিনিসিরই চাহিদা আছে, পায়খানা ঘরের রিং স্ল্যাব। তাই তৈরি করে মাঝে মাঝে আর পুজোর সুমায় গড়া হয় মেলার জন্যি হাঁড়ি পাতিল নকশি কারুকাজের। ” 

ছবি: জেসমিন নাহার

ধীরেন কাকার বাড়িটাকে আমার এবার কোনো গৃহস্থ কৃষকের বাড়ি বলে মনে হলো। ধীরেন কাকার পরিবারের সকলে আমার পরিচিত। আমিও তাদের পরিচিত। তার মেয়ে কমলা আমার শৈশব কৈশোরের বান্ধবী। সেই সূত্রে আমি অনেকবার তাদের বাড়িতে গিয়ে খেয়েছি, ঘুরেছি। কমলার ঘরেই মাটির হাঁড়ি  পাতিল বোঝাই করা থাকতো। তার মাঝে কমলার ঘুমানোর একটা খাট আর টেবিল চেয়ার, টেবিলে কমলার বই ভর্তি। ঘরে আসবাব বলতে যা ছিল তা ওই ওর টেবিলে রাখা অগোছালো বই আর না পোড়ানো বৃষ্টিতে ভিজে যাবার  ভয়ে ঘরে তুলে রাখা মাটির নানান পাত্র। কমলার ভাই দীলিপ ও আমাদের সাথে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়েছিল। তারপরে আর পড়িনি। এখন সে বিবাহিত। এবং তার আলাদা সংসার। আমাকে দেখে বললো, “এই কেমন আছিস জেসমিন? আয় তোর বৌদির আর আমার ঘরবাড়ি দেখে যা। কতদিন পর তোকে দ্যাখলাম। বিয়ে করিস নি এখনো?  এই দ্যাখ আমার ছেলে।” ওর ঘরবাড়ি দেখলাম। ওর ছেলের সঙ্গে ওর ছবি তুলে, ধীরেন কাকা এবং কাকির ছবি তুলে, পানি বিস্কুট খেয়ে যখন ধীরেন কাকার মেজো ভাইয়ের বাড়িতে প্রবেশ করলাম তখন পরিচিত কুমোরবাড়ির একটু নিদর্শন পেলাম। 

ছবি: জেসমিন নাহার

কমলার জেঠি মা সদ্য মাটির কাজ থেকে উঠে রান্নাঘরে রান্না শেষ করেছে মাত্র। লম্বাচওড়া কালো মেয়ে তিনি। তাঁকে আমি ছোটবেলা থেকে সবসময় কাজই করতে দেখেছি। কখনো কাদা করছেন, কখনো ধানে পা দিচ্ছে্ন, কখনো মাটির দলা বানাচ্ছেন, কখনো ছাঁচে ফেলে হাড়ি তৈরি করছে্ন। আজই শুধু রান্না শেষে বসে থাকা দেখলাম। এবং বসা থাকা পটের বিবিটির বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থার একটা ছবি তুলে নিলাম। কপালে লাল টিপ আর লাল সিঁদুর তার কালো রঙকে আরো উজ্জ্বল করে তুলতো। আজ হাঁটু সমান কাপড় তুলে,  ব্লাউজণবিহীন শরীরে শুধু শাড়ি জড়িয়ে বসে আছে সদ্য রান্না শেষ করা হলুদ মাখা হাতে। কতো সহজ জীবন। এই অনাড়ম্বর জীবন মানেই আমি বুঝি কালচার। অসুন্দর বলে জগতে কিছু নেই। সুন্দর চোখ দিয়ে দেখলে জগতের চারপাশে কেবলই সৌন্দর্য। বিয়েতে তার বাবার কত পণ দিতে হয়েছিল জানি না। তবে একটা কালো মেয়ের ভালো স্বামী তার কপালের লাল টিপ এবং ত্রিশ বছরের সংসারযাপন আমাকে শান্তি এনে দেয়। এই  জেঠিমার সঙ্গে আমি সেদিনও কোন কথা বলিনি। শুধু দু’জনের চোখে চোখে কথা হয়েছে। নীরবে ছবি তুলেছি। 

ছবি: জেসমিন নাহার

পোড়ানো পাঁজার চারিপাশে সদ্য তৈরি রিং স্ল্যাব। পাজার পাশে কাজ করছিল এক যুবক। বললাম, এগুলো তুলবেন কবে? বললে্‌ বাজারের আগের দিন। কুমোরবাড়ির পোড়া মাটির গন্ধ নাকে নিয়ে যখন আরেক বাড়িতে ঢুকছি তখন দেখি এক মহিলা ধানে পা দিচ্ছেন। এই ঘরটা আগে ছিল না। নতুন হয়েছে। আর যে বাড়িতে আমি প্রবেশ করেছি নতুন বাড়িটি ছাড়িয়ে এই বাড়িটাই আসল কুমোর বাড়ি। বাড়িতে ঢুকামাত্র দেখি একটা পাঁজায় খড়ের উপরে কাদা লেপন করছে দুজন বয়েসী নর-নারী। পাশে গিয়ে বললাম, আমি অমুক। আমি আপনাদের চিনি। আপনি খগেন কাকা, আর ইনি হলেন আপনার স্ত্রী। আমি এসেছি সরদার পাড়া থেকে। আমার দাদার নাম বক্তজামাল। আব্বার নাম খোকন ফকির (নুরুল ইসলাম)। মৃদু হেসে বললেন দত্তবাড়ি! আমি সেদিকে কান না দিয়ে বললাম পাঁজায় আগুন ধরাবেন কখন কাকা? বললেন, লেপা শেষ হলিই ধরাবো। চারিদিকে মাটির জিনিস ছড়ানো। মাটির পাত্র তৈরির চাকা খোঁজা শুরু করেছিলাম চারিদিকে। কাকিমা বললেন কী খুঁজছিস? বললাম এখানে তো চাকা ছিল বসানো। বললেন ওপাশ তো এখন বড় দাদার। চাকা তো কেউ ঘুরোই নে। ছাঁচে ফেলে তৈরি করি। চাকা উঠে গেছে কুমোরবাড়ি থেকে, আমি দুঃখ পাচ্ছি দেখে খগেন কাকা হাসছেন। রান্নাঘর থেকে তার বেটার বউ বের হয়ে উঁকি দিয়ে বললেন কিডা রে? রান্নাঘরে ঢুকে দেখি পূর্বের কমলার ঘরের রূপ। চারিদিকে মাটির পাত্র সাজানো। অল্প একটু স্থানে রান্না বান্নার কাজকর্ম। তারই মাঝে এক শিশু দেখি আমার ভাগ্নিকে ডাকছে। আমার ভাগ্নি আমার সঙ্গেই ঘুরছে। দুজনে দেখি পরিচিত। ক্লাসমেট তারা। তারা একসঙ্গে বসে কত গল্প বলা শুরু করে দিল। ছোটবেলায় ঠিক এভাবে কোন কাজে মা চাচিদের সাথে কুমোরবাড়ি এলে কমলা দেখতে পেয়ে ডাক দিত। নিজের শৈশব দেখলাম ভাইপো ভাগ্নি আর খগেন কাকার পুতনির মাঝে। 

ছবি: জেসমিন নাহার

আমি কুমোরবাড়ির চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে দেখি ঠিক ছোটবেলা আমার সম্মুখে। জুঙড়ায় ভরে খড় বিচুলি নিয়ে একটা ভ্যান এসে হাজির খগেন কাকার বাড়ি। জুঙড়ার উপরে বসে তার পুতা ছেলে। ভ্যান চালিয়ে এনেছে তার ছেলে। আমি বললাম আমাদের ওদিকে আর যায় না কেন? বললেন তোমাদেরটা কোন দিক গো? বললাম ওই যে সর্দারপাড়া। বললেন ওদিকের মানুষ বড়লোক হয়ে গেচে। তাদের মাটির পাত্র লাগে না। জুঙড়া থেকে ছোট ছেলে লাফ দিয়ে বাপের কোলে এলো, বাপ মাটিতে নামিয়ে দিলো। জুঙড়ার খড় বিচুলি খগেন কাকার পাঁজার সামনে ঢেলে দিলো।ততক্ষণে পাঁজায় কাদা লেপন শেষ। পাঁজায় আগুন জ্বলে উঠলো। আমি কাকা-কাকির সাথে গল্প করতে বসলাম। জিজ্ঞাসা করলাম ছোটবেলায় স্কুল ঘরের পেছনে লেখা থাকতো, নগেনদাকে চেয়ার মার্কায় ভোট দিন। বড় হয়ে শুনেছিলাম, তিনি আপানাদের ভাই। আমার তাকে দেখার খুব শখ। আর শখ ওই চাকায় বসে আমিও আপনার মত হাড়ি পাতিল তৈরি করা শিখবো। খগেন কাকা বললেন,”নগেন ভারতে চলে গেছে তাও প্রায় পনেরো বছর। ওকনে ওরা কাটের ব্যবসা করে। ওরা একন ভারতের লোক হয়ে গেচে। তারে একন এ দেশে পাবা কনে। দেখতি হলি ওদেশে যাতি হবে তোমায়।”

ভোট-রাজনীতি মানুষকে ভিটেছাড়া করে, নয়তো লজ্জা অপমান সহ্য করে ভিটেমাটি কামড়ে বসে থাকে। বিএনপি ক্ষমতা হারালে এরকম ভিটে বিসর্জন দিতে হয় বিএনপি মতাদর্শের মানুষকে। সেরকমই আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালেও সম্মান, দেশ, ভিটে কেউ কেউ বিসর্জন দেয় বটে।

বললাম, ভারতে চলে গেলো কেন? বললেন, “ওদেশে ব্যবসা করতি গিয়ে সুবিদা করতি পেরেচে তাই থেগ গেচে ভারতে। আইচকে কাইলকে যায়নি তো, পনেরো বচর হলে।” মধ্যেখানে এক ছোট গল্প আমি শুনেছিলাম। নগেন কাকা আওয়ামী লীগ করতেন। আমাদের এলাকার হিন্দুরা সব লীগ করে। বিএন পি ক্ষমতায় আসার পরে তার বাজারে যাওয়া, কর্ম করে খাওয়া সমস্যা হয়ে পড়েছিল। পরে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। ওখানে ব্যবসা দাঁড় করিয়ে থেকে গিয়েছেন। পরবর্তী তে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও আর ফেরেন নি। ভোট-রাজনীতি মানুষকে ভিটেছাড়া করে, নয়তো লজ্জা অপমান সহ্য করে ভিটেমাটি কামড়ে বসে থাকে। বিএনপি ক্ষমতা হারালে এরকম ভিটে বিসর্জন দিতে হয় বিএনপি মতাদর্শের মানুষকে। সেরকমই আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালেও সম্মান, দেশ, ভিটে কেউ কেউ বিসর্জন দেয় বটে। ভারতে গেলে নগেন কাকার সাথে দেখা আমি অবশ্যই করব। জানব তার ব্যবসাই প্রধান নাকি মনের গভীরে লুকানো কোন দুঃখ আর দেশে ফেরার আশা জাগায়নি তার মনে। ২০০৯ সালে যখন আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসে তখন আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামের একজনের কান হারাতে হয়েছিল। তাও একজন কান কামড়ে তুলে নিয়েছিল। কী হিংসাত্মক কাহিনী! খগেন কাকার সাথে কথা বলে, তার ঐতিহ্য হারানোর কোনো বেদনা মনে আছে বলে বোধ হলো না। বরং কেন জানি আমারই বেশি খারাপ লেগেছিল। নাকি খগেন কাকার ওই হাসিমাখা মুখের অন্তরালে তার কর্ম হারায়ে যাবার সম্ভাবনার ভয় লুকানো যা তিনি আমাকে বললেন না।

আমাদের বাড়ির পাশে দু’ঘর জোলা বাড়ি আছে। জন্ম থেকে শুনেছি ওরা তাঁত বুনতো। তাঁত বুনতো এইটা যেমন গল্প ঠিক তেমন আমার গ্রামের এই কুমোরবাড়ির দিকে গ্রামের মানুষ মনোযোগ না দিলে আজ থেকে ত্রিশ বছর পরে হয়ত গল্প ই হয়ে যাবে যে ওরা একসময় মাটির পাত্র বানাতো। 

কাকা-কাকির সাথে গল্প শেষে বাড়ি ফিরে আসছিলাম। কিন্তু পথে মনে হলো জয়দেব স্যারের সাথে দেখা করে যাই। স্যাররা পদবীতে নাপিত। স্যারের বাড়ি যেতে পথে সেই পূজামণ্ডপটা পড়ে। যে মণ্ডপের দূর্গা দেবিকে সুন্দর বলে ফেলায় বারবার আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতাম। মণ্ডপ ছাড়িয়ে দেখি বিমল দা। কমলার এই দাদা এবং বৌদিকে আমি বেশ পছন্দ করতাম। ওর ভাইপো প্রসেনজিতও আমাকে দেখে চিনতে পেরেছিলো। বিমল দার বাড়িতে গিয়ে আমি বেশি আনন্দ পেয়েছি। দেখি একপাশে ধান, ধানের বিচুলি। অন্যপাশে তার মাটির পাত্র পোড়াবার পাঁজা। পাঁজা থেকে রিং তুলে তুলে বৌদির হাতে দিচ্ছেন। আমি সামনে যাওয়া মাত্র বৌদি বললেন অনেকদিন বাদে দ্যাখলাম। তাদের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করলাম। বিমল দা আর বৌদির সঙ্গে গল্প করতে করতে ওপাশ থেকে শুনি স্যারের গলা। স্যার আমাকে ডাকছেন। জেসমিন, ও জেসমিন। বিমলদাকে বললাম, দাদা আমি খুব খুশি। আপনি এরকম আপনার কাজকে ধরে রেখেছেন। আপনাদেরও বাড়িতে তো সব ধান। বিমল দাকে বললাম। যত মডার্নই মানুষ হোক, আপনি আপনার কাজ করে যাবেন। একজন হলেও তো কিনবে মাটির পাত্র। দাদার মুখে কোন কথা বা হাসি নেই। শুধু মাথা নাড়লেন। বৌদি হাসলেন। আমি ছবি তুলে নিলাম। প্রসেনজিৎ আর তার বোনের ছবি তুলতে গেলে বোন পালালো। প্রসেনজিৎ দাঁড়িয়ে সুন্দর হাসি দিয়ে ছবি তুললো। আমি স্যারের বাড়ি গেলাম। নানান গল্প, আমার হাইস্কুলের গল্প, লেখাপড়া, তখনকার জীবন যাপন নিয়ে কথা বলে গল্পগুজব করলাম। স্যার ঘর বেঁধেছেন তা ঘুরেঘুরে দেখলাম। স্যারের ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। তাদের গল্প শুনলাম। স্যার আমার ভাইপো ভাগ্নিকে গুড় মুড়ি খেতে দিলেন।ওদের খাওয়া শেষ হলে আমরা  চলে আসার পথে মনা জামাই আর তার স্ত্রী নমিতা ফুফুর সাথে দেখা করলাম। 

ছবি: জেসমিন নাহার

এই হলো আমাদের গ্রামের মনা নাপিত। তার একজন ছেলে। সে এখন হাইস্কুল শিক্ষক। মনা জামাই এখন আর বাজারে চুল কাটে না। তিনি এখন জেলেদের সাথে মাছ ধরে। নমিতা ফুফু ভীষণ সুন্দরী ছিলেন যৌবনে। পূজা দেখতে গিয়ে নমিতা ফুফুও আমার দেখার বিষয় ছিল শিশুকালে। তার ভাইঝি জয়দেব স্যারের চাচাতো বোন সুনীতা আর সুনীতার বোন সুজাতাও বেশ সুন্দরী, নমিতা ফুফুরই মতন। ছোটবেলায় কমলা, সুনীতাদের বলতাম তোরা খুব সুন্দর। তখন ওরা উত্তর দিতো, তুই হওয়ার সাথে সাথে যদি তোর মা দূর্গা দেবীর ছবি দেখাতো তাহলে তুই আমাদের মতো সুন্দর হতিস। তাই শুনে শুনে একবার স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মা আমি হওয়ার সাথে সাথে কী করিলে? মা জবাব দিয়েছিলেন, তুমি হবার সাথে সাথে আমি তোমার অঙ্গে হাত দিয়ে দেখেছিলাম তুমি ছেলে নাকি মেয়ে হয়েছো! বলাবাহুল্য আমার মায়ের আমি ষষ্ঠতম সন্তান। এবং আমি দাইমা আসার আগেই জগতে চলে এসেছিলাম, কারো সহায়তা ছাড়া। তাই মাকেই আমার শরীরে হাত দিয়ে জানতে হয়েছিল আমি ছেলে নাকি মেয়ে। পৃথিবীর সমস্ত সদ্যোজাত শিশুর কান্নার শব্দ এক। তার জন্য মা বুঝতে পারেন নি। তার মধ্যে তিন চার ঘন্টার প্রসব বেদনা কাটিয়ে উঠেছিলেন মা।

তবে হিন্দু মেয়েদের সুন্দর হবার কাল্পনিক ধারণা মন্দ না। যাইহোক, নমিতা ফুফু আর মনা জামাই দুজনেই আমার বেশ প্রিয়। নমিতাকে সেই আট নয় বছর বয়েস থেকে দেখি আর কথা হলো আঠাশ বছর বয়সে। আর মনা জামাই আমার সেই শিশু বয়েস থেকেই যেখানেই দেখে শাশুড়ী বলে চিৎকার পাড়ে। তারা এখনো ঘর তৈরি করেনি। তাদের সেই পূর্বের ঘর দেখে একজন সুন্দরী যুবতী নারীকে দেখতে পেয়েছিলাম মূত্ররোগে আক্রান্ত শীর্ণ এক নমিতা ফুফুর দেহের মধ্যে। যে যুবতী নারী পুজার সময়ে আসা তার অতিথিদের ঘরের বারান্দায় বসিয়ে নাড়ু লুচি আর পায়েস দিয়ে আপ্যায়ন করছে। তারই অজান্তে শুধু তার সুন্দর মুখখানি দেখবার আশায় একজোড়া কৌতুহলী চোখ তার সুপারীপাতা দিয়ে ঘেরা পাচিল ফাঁক করে দাঁড়িয়ে দেখছে। জয়দেব স্যারের ভাই বসুদেব দা তাদের বংশ ধরে রেখেছে। কিন্তু সঞ্জয়দা মানে জয়দেব স্যারের চাচাতো ভাই তার বাবার মতো নাপিতের কাজ বাদ দিয়েছেন। তিনি বাজারে ইলেকট্রনিকস এর জিনিস ঠিক করেন। 

এই হলো আমার গ্রামের কুমোরবাড়ি আর নাপিতবাড়ির বর্তমান গল্প। বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। হা হা হা! এই কথা যাযাবরের দৃষ্টিপাতে পড়েছিলাম। কিন্তু তর্ক বিজ্ঞান নিয়ে নয়। সমাজ, অর্থনীতি, পরিবার প্রথা ও গ্রামীন সম্পর্কের রূপান্তর ইত্যাদি নিয়ে। আমি যখন আমার চারপাশে চোখ রাখি তখন দেখি সত্যিই সকল কিছুর পরিবর্তন এবং গতির ছন্দপতন ঘটেছে। বাড়ি ফিরে আমার ভাইকে যখন বিমলদা আর বৌদির ছবি দেখাচ্ছিলাম তখন ভাই বললেন বিমল দা তাঁর ঘর-সহ বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে সবার সাথে কথা বলেন। বললাম কেন? বললেন, তোর জয়দেব স্যার বিমলের সাথে খারাপ আচরণ করেন। আবারো বললাম কেন? বললেন, তা জানি না! তখন আমি ভেবে ভেবে বের করলাম যে বিমল দার বাড়ি স্যারের বাড়ির সামনে। স্যারের উঠানের সামনে বিমলদার বাড়ির টিনের পাঁচিল। পাঁচিলের পাশে বিমলদার মাটির পাত্র পোড়ানোর পাজা। যখন তিনি পাত্র পোড়ান, তখন স্বাভাবিকভাবেই ছাই উড়ে গিয়ে, পাঁজার ধোঁয়া স্যারের বাড়িতে যায়। স্যারের পরিবারের সমস্যা হয়। স্যার ক্ষেপে যান। বিমলদার কাজের নিন্দা জানান। স্যারের হয়ত মনে হয় প্রতিবেশি হিশেবে বিমল খারাপ। ঠিক তেমন বিমলদারও মনে হয় প্রতিবেশী হিশেবে স্যার খারাপ। 

মনে মনে ভাবি, পৃথিবীর সব প্রতিবেশী আমার বাবা আর মায়ের মতো নয়। আমরা হাজার বছর ধরে জোলাবাড়ির অত্যচার সহ্য করেছি। আব্বা একটা টুঁ শব্দ করেননি কখনো। কিন্তু স্যার একটা ঐতিহ্য কে বাঁচিয়ে রাখতে একটু ধোঁয়া আরেকটু ছাই গায়ে মাখতে রাজি নন। কিন্তু আমি বলার কে? আমি আমার স্যারের মূল্যায়ন করতে চাই না। তথাকথিত ঐতিহ্যের প্রতি আমাম্র এই দরদ নিতান্তই রোমান্টিক একটা ব্যাপার হতে পারে। কারিগরদের প্রতি দুর্বলতা! যদি আমার ভাইয়ের কথা সত্য হয় তবে দোয়া করি বিমল দা তার বাড়ি বিক্রির কোন খরিদ্দার যেন না পান, আর আমার জয়দেব স্যারকে যেন ভগবান একটু ধোঁয়া আর একটু ছাই গায়ে মাখার মন প্রদান করেন।

হয়তো ‘ঐতিহ্য’ অবাস্তব একটি ধারণা। কিন্তু আমার কৈশোরের পুরানা গ্রামের জন্য মন খারাপ হয়।

ছবি: জেসমিন নাহার

লেখক পরিচিতি:
জেসমিন নাহার

ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর। বাড়ি যশোহর জেলার শার্শায়। গোড়পাড়া সর্দারবাড়ির মেয়ে। বাবা নুরুল ইসলাম। চিশিতিয়া তরিকার ফকির ছিলেন। মা রওশানারা বেগম। গল্প লেখক। উপন্যাসও লিখছেন।

Share