আজ রবিবার, ২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

যোগেন মণ্ডলের উত্তরকাণ্ড (১৯৪৭-১৯৬৮)। এক।

ধারাবাহিক পর্যালোচনা

।। সৌরভ রায় ।।

                                        
    
পাকিস্তানের প্রথম আইনমন্ত্রী যোগেন মণ্ডলকে ‘মুসলিম-তফশিলি জোট রাজনীতির ব্যর্থ প্রচারক’ বলে বর্ণনা করে নিম্নবর্গের রাজনৈতিক সক্রিয়তার ইতিহাসচর্চাকে খারিজ করতে হিন্দুত্ববাদীরা। এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে মাত্র হাতে গোণা কয়েকজন লেখক, ইতিহাসবীদ, সমাজতাত্ত্বিক লেখালেখি করেছেন। হিন্দুত্ববাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যোগেন মণ্ডলকে নিয়ে প্রতিপক্ষে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন সৌরভ রায়। দুই পর্বে ‘যোগেন মণ্ডলের পূর্বকাণ্ড (১৯৩৭-৪৭)’ প্রকাশিত হবার পর আজ ২৯ জানুয়ারি, ২০২১ তারিখে যোগেন মণ্ডলের জন্মদিনে প্রকাশিত হলো ‘যোগেন মণ্ডলের উত্তরকাণ্ড (১৯৪৭-১৯৬৮)’-এর প্রথম পর্ব।

দেবেশ রায়ের ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ আর পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘যোগেন মণ্ডলের একাকিত্ব’ এই দুটি লেখার কাঁধে ভর করে এর আগে আমরা পড়েছিলাম যোগেন মণ্ডলের পূর্বকাণ্ড (১৯৩৭-১৯৪৭)। এই পর্বে আমাদের সহায়ক অন্বেষা সেনগুপ্তের ‘Partition and Dalit Politics in Bengal: The Figure of Jogendra Nath Mandal’, দ্বৈপায়ন সেনের ‘The Decline of the Caste Question : Jogendranath Mandal and the Defeat of Dalit Politics in Bengal’। পাশাপাশি ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা’ হিসাবে এই পর্যালোচনায় উঠে আসবে ১৯০৯ সালের ‘প্রবাসী’ পত্রিকার পাতা থেকে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘নমশূদ্রের কথা’ আর বিনোদলাল ঘোষ বি.এল.-এর ‘নমঃশূদ্র জাতির প্রতি আমাদের কর্তব্য কি?’ দেবেশ রায়ের ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ আর পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘যোগেন মণ্ডলের একাকিত্ব’ এই দুটি লেখা।  এগুলোর মাধ্যমে আমরা যোগেন মণ্ডলের উত্তরকাণ্ড অর্থাৎ ১৯৪৭-১৯৬৮-এ প্রবেশ করব। কিন্তু এর আগে যোগেন মণ্ডলের এগারো বছরের কিসসা আমরা ব্যাখ্যা করেছি বলে এই বাইশ বছরের যোগেনপুরাণ যে খুব চটপট সেরে ফেলা যাবে তা নয়, কারণ আমাদের অনেক উলটপুরাণের সম্মুখীন হতে হবে। আমি এর আগের পাঠপ্রতিক্রিয়ায় যোগেনের নিজস্ব রাজনৈতিক মতবাদ নির্মাণকাজের ঘোর ব্যর্থতার কারণ নিয়ে কিছু যুক্তিক্রম সাজিয়েছিলাম।  সেই রাজনীতির প্রাথমিক শর্ত ছিল নমঃশূদ্র হিসাবে নিজেদের পৃথক রাজনৈতিক পরিচয় তৈরি এবং মুসলিম-তফশিলি জোট রাজনীতির জমি প্রস্তুত করা। এই দুই সম্ভাব্য শক্তিবলয় তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির দাবার ছক উলটে দিতে পারলেও পারতো। যোগেন মণ্ডলের চোখধাঁধানো জয়, তাঁর পক্ষতলে নমঃশূদ্রদের এক বিরাট সংখ্যার সমর্থন, তাঁর মাথায় নানারঙের নানা বড় নেতাদের স্বতঃস্ফুর্ত প্রাথমিক আশীর্বাদ, সবই ছিল। এই যৌথঅভিজ্ঞান ও যূথশক্তিকে নিজের কবলে আনার জন্য তাঁর পালে নানা রকম বাঘ পড়া সত্ত্বেও তিনি ভুল নেতার কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। বিবিধ আকচাআকচি থেকে সমদূরত্ব রাখার মাধ্যমে যোগেন মণ্ডল এমন এক রাজনীতি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যা অতিসহজবোধ্য। কারণ “হিন্দুদের লড়াই তো একটা ফ্রন্টে – ব্রিটিশরাজের সঙ্গে। আর মুসলমানদের লড়াই তিন ফ্রন্টে – সামনে ব্রিটিশ, ডাইনে হিন্দুরা আর বাঁয়ে মোল্লারা।’ … তাইলে আমাগো, চাঁড়ালগো, শিডিউলগো, কয়ডা লড়াই? সামনে সাহেব। ডাইনে হিন্দু। আর বাঁয়ে মোল্লা? তাইলে মুসলমান আর চাঁড়ালগো লড়াই তো একডাই দাঁড়ায়।”( রায়, পৃষ্ঠা ২৬৯)।

আমাদের খুব চেনা ও বহুআলোচিত এই যুক্তিক্রম, ১৯৩২-এর ‘কম্যুনাল অ্যাওয়ার্ড’-এর অনেক আগেই পেকে উঠেছিল। সংখ্যা-রাজনীতির হিসাবকিতাবও উচ্চবর্ণের ভদ্রলোকরা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন, “পূর্ববঙ্গে মুসলমানগণের তুলনায় হিন্দুগণের সংখ্যা অতীব অল্প এবং হিন্দুগণের মধ্যে নমঃশূদ্রের সংখ্যাই অধিক। (যথা) ফরিদপুর জেলার সমস্ত অধিবাসীগণ মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা মাত্র শতকরা ৩৭ জন এবং ইহার মধ্যে উচ্চবর্ণের হিন্দুর সংখ্যা এত ক্ষুদ্র যে তাহাদের অস্তিত্ব একরূপ অণুবীক্ষণ দ্বারা উপলব্ধি করিতে হয়…”

তবু দশচক্রে ভগবান কেন ভূত হয়েছিলেন? পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দোরোখা যুক্তি বলে যোগেন একই সাথে মুসলিম নেতৃমণ্ডলী ও তফসশিলি নেতৃমণ্ডলী দুই পক্ষেরই বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। “মুসলিম নেতারা মুখে যাই বলুন, এবং জিন্না যতই যোগেন মণ্ডলকে তুরুপের তাস হিসেবে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে চালাবার চেষ্টা করুন, মুসলিম লিগের বঙ্গীয় নেতারা কিন্তু তফসিলি জাতিদের আনুগত্যের ব্যাপারে মোটেই নিশ্চিত ছিলেন না। হারুন-অল-রশিদ সংকলিত মুসলিম নেতাদের চিঠিপত্র থেকে দেখছি, সোহরাওয়ার্দি ১৯শে মে ১৯৪৭ তারিখে লিয়াকত আলিকে বেশ উৎসাহের সঙ্গে লিখছেন, ”যোগেন মণ্ডলের সাথে দীর্ঘ কথা হলো। আমরা বোধহয় ওঁর সম্বন্ধে অনাবশ্যক হতাশ হয়েছিলাম। উনি বর্ধমান, খুলনা ও ২৪-পরগণায় খুব ভালো মিটিং করেছেন।  সেখানে তফসিলি জাতিদের শীঘ্রই আমাদের দিকে নিয়ে আসা যাবে বলে মনে হয়।” আবার মাত্র দু’দিন বাদে, ২১শে মে তারিখে, তিনি ঠিক উলটো কথা লিখছেন! অনুমান করা যায় অন্য সূত্রে ইতিমধ্যে খবর পেয়ে তাঁর আগের মত বদলাতে হয়েছে। এবার লিখছেন, ”একমাত্র বর্ধমান ডিভিশনে দুটো মিটিং ছাড়া আর কোথাও আমরা তফশিলি জাতিদের সঙ্গে মিটিং করতে পারিনি। তাছাড়া তাঁদের মধ্যে কিছুটা সাড়া জাগাতে সক্ষম হলেও তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সকলেই বাংলার পার্টিশনের পক্ষে ভোট দেবে। শুধু তাই নয়, ভারত-পাকিস্তান ভাগ নিয়েও এবার ঘোষণা হয়ে গেলে, বর্ণহিন্দু বা তপশিলি কারো মতই আমাদের পক্ষে থাকবে না। এই নিয়ে যদি মারামারি হয়, পশ্চিমবাংলার মুসলিমরা সম্পূর্ণ মুছে যাবে, কেউ তাদের বাঁচাতে পারবে না। একই ভাবে, পূর্ব বাংলার হিন্দুরা একেবারে মুছে যাবে। আমরা যতই বর্ণহিন্দু আর তফশিলিদের মধ্যে তফাৎ গড়ে তোলার চেষ্টা করি না কেন, সাম্প্রদায়িক সংঘাত শুরু হলে কোনো তফাৎ বজায় থাকবে না। ক-দিন আগেই কুমিল্লা আর নোয়াখালীতে মুসলিমরা তফশিলি হিন্দুদের আক্রমণ করেছিল, ঠিক যেমন কলকাতা আর বিহারের হিন্দুরা কংগ্রেসি মুসলমানদেরও আক্রমণ করেছিল।” (চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ৬৫) আবার এদিকে “তফশিলি সমাজের ভেতর বাংলা ভাগ নিয়ে বিতর্কে যোগেন্দ্রনাথ নিশ্চিতভাবে পরাজিত হলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি যুক্তি দিলেন, বাংলা যদি ভাগ হয় তাহলে পূর্ববঙ্গে বিত্তশালী বর্ণহিন্দুরা অনায়াসেই পশ্চিমে এসে নতুন করে বসবাস করতে পারবে, কিন্তু হতদরিদ্র তফশিলিরা কোথাও যেতে পারবে না। উচ্চবর্ণহীন পূর্ববঙ্গে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের হাতে মারা পড়বে। উত্তরে রাধানাথ দাস নোয়াখালির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে লিখলেন, আমরা যদি পশ্চিমবাংলার পক্ষ থেকে নোয়াখালির নমশূদ্রদের আহ্বান করি এদিকে চলে আসার জন্য, তাহলে যোগেনবাবু তাঁর স্বজাতির একজনকেও নোয়াখালিতে ধরে রাখতে পারবেন না। দরিদ্র তফশিলিরাই বরং অনেক সহজে নিজেদের বাসস্থান বদলাতে পারে, কারণ তাদের সম্পত্তি বলে কিছুই নেই।”(চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ৬৬-৬৭) সর্বৈবভাবে ভয়ঙ্কর ভুল যুক্তি, কিন্তু সেটাই বহাল হয়ে গিয়েছিল, সেই সময়। কিন্তু দ্বৈপায়ন সেনের গভীর গবেষণা ও যুক্তিক্রম আমাদের দেখায় যে স্বাধীন পাকিস্তানের মন্ত্রীসভার সদস্য হওয়া সত্ত্বেও যোগেনের সার্বিক পরাজয় ও অবহেলিত কপর্দকহীন মৃত্যু ইতিহাসের কঠোর রথচক্রের পেষণ, রাজনৈতিক কাকতাল, বা সামাজিক সমাপতন কোনটাই নয়। তা সংগঠিত প্রচেষ্টায় যোগেন মণ্ডল ও তাঁর রাজনীতির ওপর নামিয়ে আনা এক নিষ্ঠুর নিয়তি। কন্সপিরেসি থিওরি বা ট্র্যাজিক হিরোইজম বা মহান আত্মবলিদানের সহজবোধ্য ছকের বাইরে গিয়ে আমাদের এই নিষ্ঠুর নিয়তির বস্তুবাদী স্বরূপকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তার জন্য আমার আগের লেখায় স্বজ্ঞানে অথবা অজান্তে তৈরি কিছু প্রতিপাদ্যকে আমাদের ভাঙতে হবে। যেমন, আগের লেখায় একটা ঝাপসা প্রতিপাদ্য দেওয়া হয়েছে যে বাংলার নমঃশূদ্রের সত্তারাজনীতি চেতনা ১৯২৫-এর মতুয়াপন্থা হয়ে ১৯৩৭-পরবর্তী যোগেনপন্থার দিকে বয়ে যেতে চেয়েছিল, তার আগে নমঃশূদ্রের সত্তারাজনীতি সুষুপ্ত ছিল। আর মতুয়াপন্থার উদ্ভবের অর্থনৈতিক কারণ হিসাবে দেবেশ রায় দেখিয়েছেন বাংলায় পাটচাষের প্রচলন ও তৎসঞ্জাত মুষ্টিমেয় নমশূদ্রদের আর্থিক সমৃদ্ধি। কিন্তু ১৯০৯ সালের ‘প্রবাসী’-তে এক ‘হিতৈষী সমাজসচেতন’ সাবর্ণের বয়ানে আমরা পড়ি, “পূৰ্ববঙ্গের নমঃশূদ্রের সমস্যা প্রতিদিন কী আকার ধারণ করিতেছে তাহা সকলেই জানেন। (দ্বৈপায়ন সেন উল্লেখ করেন ১৮৭২ সালে নমঃশূদ্রদের সংগঠিত এক বর্ণহিন্দু বয়কট, পৃ ৬)…এই সমস্ত দলের সভা সমিতি কাগজ পত্রে একটা কথা – খুব স্পষ্ট দেখা যায় এই যে হিন্দু সমাজের সঙ্গে কোনোরকম বিরোধ করা তাহাদের উদ্দেশ্য নহে—ইহারই আশ্রয়ে একটু সম্মানের সহিত তাহারা থাকিতে চায়।… নমঃশূদ্রদের এই আন্দোলনকে যাহারা হুজুগ বলিয়া উড়াইয়া দিতে চান, তাদের এই পর্যন্ত বলিতে পারি যে তাদের মধ্যে যে উৎসাহ দেখা যায় তাহা অনেক শিক্ষিত ভদ্রসমাজেও দুর্ল্লভ।…মনে রাখা দরকার ইংরেজ আমাদিগকে চিরায়ত্ত রাখিবার জন্য আমাদের কোন ছিদ্র পাইলেই স্বভাবতই তাহার সুযোগটুকু লইবার চেষ্টা করে। মুসলমান ইতিপূর্বে তাহার হাতে ধরা দিয়াছে, এখন যদি আমরা নমঃশূদ্রদের ন্যায্য অধিকার লাভে বাধা দিই তাহা হইলে একদিন সময় বুঝিয়া তাহারাও হিন্দুসমাজকে আঘাত করিতে ছাড়িবে না।… প্রার্থনা যে তাহারা এই সমস্যাটিকে বিশেষভাবে মীমাংসা করিবার ভার লউন। পূর্ববঙ্গের স্থানে স্থানে অবস্থা ক্রমেই সঙ্কটাপন্ন হইয়া উঠিতেছে। আমরা স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছি স্থানে স্থানে ভদ্রলোক ও নিম্নশ্রেণীর মধ্যে বিশেষ মন কষাকষি চলিতেছে, তবে এখনো তাহা কাজে প্রকাশ পায় নাই। নিজের ঘরেই যখন আগুন লাগিবার সম্ভাবনা তখন ঝগড়া করিয়া শক্তি এবং সময় নষ্ট করিলে এমনি কি লাভ হইবে?” (যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়)

আমাদের খুব চেনা ও বহুআলোচিত এই যুক্তিক্রম, ১৯৩২-এর ‘কম্যুনাল অ্যাওয়ার্ড’-এর অনেক আগেই পেকে উঠেছিল। সংখ্যা-রাজনীতির হিসাবকিতাবও উচ্চবর্ণের ভদ্রলোকরা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন, “পূর্ববঙ্গে মুসলমানগণের তুলনায় হিন্দুগণের সংখ্যা অতীব অল্প এবং হিন্দুগণের মধ্যে নমঃশূদ্রের সংখ্যাই অধিক। (যথা) ফরিদপুর জেলার সমস্ত অধিবাসীগণ মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা মাত্র শতকরা ৩৭ জন এবং ইহার মধ্যে উচ্চবর্ণের হিন্দুর সংখ্যা এত ক্ষুদ্র যে তাহাদের অস্তিত্ব একরূপ অণুবীক্ষণ দ্বারা উপলব্ধি করিতে হয়। ১৯০১ সনে আদমসুমারী রিপোর্ট হইতে নিম্নে যে তালিকা প্রদত্ত হইল তাহা দ্বারাই পূর্বোক্ত উক্তির সত্যতা সম্যকরূপে প্রতীত হইবেক। জেলা ফরিদপুরে হিন্দুর সংখ্যা ৭৩ ৩৫৫,  ইহার মধ্যে উচ্চশ্রেণীর হিন্দুর সংখ্যা, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, ও বৈদ্য ১৪ ১৬৮, নমঃশূদ্রের সংখ্যা, ৩,২৪ ১৩৫ মুসলমান ১ ১৯ ৯৩৫৭। মোট জনসংখ্যা ১৯ ৩৭ ৬৪৪। ইহা হইতে স্পষ্টরূপে দৃষ্ট হইতেছে যে ফরিদপুর জেলার হিন্দুগণের প্রধান শক্তি নমঃশূদ্রগণ।” (শ্ৰীবিনোদলাল ঘোষ, বি. এল.) অর্থাৎ আমার আগের ঝাপসা প্রতিপাদ্য, বাংলার নমঃশূদ্রের পরিচিতিসত্তার রাজনীতি চেতনা ও তার বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল সাবর্ণ পরিচিতিসত্তার রাজনীতি ১৯২৫ নাগাদ জেগেছিল তা ভুল। আমার আগের লেখার আরেকটি ঝাপসা প্রতিপাদ্য ছিল যোগেন মণ্ডলের অনুচ্চারিত বামপন্থা যা তাঁর সুভাষপ্রীতি ও বামপন্থী তাত্বিকতার মধ্যে দিয়ে উদ্ভাসিত। যদিও আমি লিখেছিলাম যে, যোগেন মনে করতেন না শ্যাখ-শুদ্দুর সহমতি শ্রেণীমৈত্রী। বামপন্থীদের মেধা ও তাঁদের তত্ত্বের প্রতি যোগেন বৌদ্ধিক ভাবে সশ্রদ্ধ ছিলেন, কিন্ত তাঁদের যুক্তি-অতিনির্ভরতা ও বর্ণ-অন্ধত্ব তাঁর নজর এড়ায়নি। কংগ্রেসের বকলমী হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে, কংগ্রেস-হিন্দুমহাসভার অঘোষিত জোটের অঘোষিত নেতা শ্যামাপ্রসাদের হিংসাবাদের বিরুদ্ধে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে যোগেনপন্থাকে খাড়া করার সময় যদি আমরা শিডিউল কাস্ট ফেডারেশনের সাথে বামপন্থীদের অঘোষিত জোটের স্বতঃসিদ্ধতা ধরে নিই, তা খুব ভুল হবে। কারণ  দ্বৈপায়ন সেনের গবেষণায় এই সত্য সম্যকভাবে লব্ধ যে, স্বাধীনতার আগে, পাকিস্তানের মন্ত্রী হওয়ার আগে যোগেন মণ্ডলের শিডিউল রাজনীতির পথরোধ ঠিক যে ভাবে করেছিল কংগ্রেসি-নিমকংগ্রেসি-হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তি, পাকিস্তান থেকে ফিরে আসার পরে, উদ্বাস্তু রাজনীতির রণাংগনে পুনঃপ্রবেশ করার সময় তাঁর পথরোধ করে ঠিক সেইভাবেই দাঁড়ায় বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তি। উদ্বাস্তু রাজনীতির বাজি জিততে বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তি যে যেকোন নৃশংস মূল্য দিতে প্রস্তুত ছিল, এই প্রতিপাদ্য শুধু প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তীর-ই নয়,  দ্বৈপায়ন সেনেরও। তাহলে আমার এর আগে তৈরি দুটি ঝাপসা প্রতিপাদ্যকে – নমঃশূদ্রসত্তার রাজনীতি মতুয়াপন্থা-উদ্ভব-পূর্ববর্তী-অনস্তিত্ব ও শিডিউলপন্থা-বামপন্থার অঘোষিত সলিডারিটি ইত্যাদি নাকচ করে আমরা ফিরে যাব দেবেশ রায়ের ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’-এর শেষ পাতায়।

চলবে

সৌরভ রায়

বাংলা ও ইংরিজি এই দুই ভাষার লেখালেখিতে রত আছেন সৌরভ রায়, এছাড়া বাংলা থেকে ইংরাজিতে নিয়মিত নানা কিছু তিনি অনুবাদ করে থাকেন। তাঁর প্রথম দিকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে। প্রায় এক দশক বিজ্ঞাপনী জগতে চাকরি করেছেন। তার পরে চিত্রবিদ্যায় দুটি স্নাতক (Dr. Bhau Daji Lad Museum – Mumbai 2012-13, School of Arts & Aesthetics, Jawaharlal Nehru University – New Delhi , 2014-16) করেছেন এবং Tasveer Ghar Fellowship 2017-18 পেয়েছেন। বর্তমানে দুটি গবেষণাপ্রকল্পের (স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের সেক্যুলারিজম বিষয়ক চিত্রজগত, আন্তর্জালে ভারতীয় Queer পুরুষদের চিত্রজগত) সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া লন্ডনের Stimulus -> Respond Magazine-এর সাহিত্য সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত।

পড়ুন

১।


২।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top