আজ রবিবার, ২১শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৬ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

তিনটি ভাষার তিনটি কবিতা

।। ভাষান্তর- জাহিন ফারুক আমিন ।।

তিনজন কবির কবিতা রয়েছে এখানে। তিন দেশের। কবি হিশাবে তাঁদের মধ্যে একটা কাব্যিক সম্বন্ধ আবিষ্কার করা সম্ভব, কিন্তু এখানে আমাদের উদ্দেশ্য মূলত বিভিন্ন দেশে কবিতার বিভিন্ন ধারার কবিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।

অবতার সিং সান্ধু ওরফে পাশ

পাঞ্জাবী কবি এবং মাওবাদী বিপ্লবী। তিনি ‘পাশ’ নামে খ্যাত। জন্ম ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ ঈসায়ি সালে, ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের জলন্ধরে, একটি মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে। ১৯৮৮ ঈসায়ি সালের ২৩ মার্চ খালিস্তানপন্থী আততায়ীদের হাতে নিজগ্রামে খুন হন। তাঁর জনপ্রিয় ও বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে, ‘সবসে খতরনাক হোতা হ্যায় হামারে স্বপ্ন কা মর জানা’। এখানে সেটি বাংলায় রূপান্তর করা হোল। সামন্ত ভূস্বামী, জোতদার, নতুন গজিয়ে ওঠা বেনিয়া, পুঁজিপতি এবং কৃষিতে তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের ফলে জাত ও শ্রেণীর মধ্যে যে সংঘাত গড়ে উঠেছিল সেই সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা বিপ্লবী নকশাল আন্দোলনের মধ্যে অবতার সিং বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁর প্রথম বিপ্লবী কাব্যগ্রন্থ বেরোয় ১৯৭০ সালে। নাম, ‘লৌহ কথা’। তখন কবি পাশের বয়স মাত্র ১৮ বছর।

অবতার সিং সান্ধু (পাশ)-র কন্ঠস্বর চড়া; সেই বিপ্লবী কন্ঠস্বর পছন্দ হয় নি অনেকের। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। দুই বছর তিনি জেলে আটক থাকেন। ছাড়া পেয়ে মাওবাদী ফ্রন্টে যোগ দেন। এই সময় তিনি বিপ্লবী বাম আন্দোলনের নেতা হিশাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তারপরও পাঞ্জাব একাডেমি অব লেটার্স-এ একটা ফেলোশিপও জুটে যায়। উগ্র জাতিবাদী অন্ধত্বের বিরোধিতার কবি অবতার সিং (পাশ) কবিমহলে যেমন খ্যাত, তেমনি নিপ্লবী রাজনীতির ইতিহাসেও স্মরণীয়।

মুরীদ আল-বারগুথি

ফিলিস্তিনি কবি ও লেখক। জন্ম ৮ জুলাই ঈসায়ি ১৯৪৪, ফিলিস্তিনের বনি জায়েদ শহরের দেয়ার ঘাসানা গ্রামে। জেলে আটক ও উন্মুল উদ্বাস্তু হয়েই দীর্ঘ জীবন কাটিয়েছেন। মৃত্যু ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ঈসায়ি সালে জর্ডানে। সহজ সরল ভাষায় কবিতায় নিজের কথা বলবার পরিচ্ছন্নতার জন্য খ্যাত। লড়াইয়ের ময়দানে থেকেও শান্ত, স্পষ্ট ও সিধা কায়দায় বলা কবিতার একটি শক্তিশালী ধারা যারা ধারণ করেন তাদের সামনের সারির কবিদের একজন।

১৯৭০ থেকে শুরু করে আজ তক বারগুথির ১২টি কবিতার বই বেরিয়েছে। তাঁর সাতশ পাতার কবিতা সংগ্রহও প্রকাশিত। গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি সাক্ষাৎকারে বারগুথি বলছেন, “যখ্ন আমি লিখি তখন আমি আমার কবিতা থেকে নিষ্ঠুর স্বাস্থ্যসম্মত কাব্যনিষ্ঠায় উপমাগুলো কেটে ফেলি, ঠিক যেমন গাছ থেকে পেকে ওঠা ফল গুলো আমরা কাটি”। নিজের কবিতা তিনি বিস্তর কাটাকাটি করেন। কবিতার বিস্তর পরিমর্জনা দরকার হয়, সব বড় কবিরাই কমবেশী সেটা মানেন।

তাঁর বই رأيت رام الله -র ইংরেজি অনুবাদ I Saw Ramallh। ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকায় এডওয়ার্ড সাইদ এই কেতাবটি সম্পর্কে বলেছিলেন, “দীর্ঘকাল দেশান্তরী থাকার পর ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ১৯৯৬ সালের গ্রীষ্মে রামাল্লায় প্রত্যাবর্তনের জমাট আর দুর্দান্ত কাব্যিক বর্ণনা, উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব যাপনের অন্যতম রচনাগুলোর একটি বয়ান”।

রন প্যাজেট

রন প্যাজেট (Ron Padgett) মার্কিন কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার এবং অনুবাদক। জন্ম ১৭ জুন ঈসায়ি ১৯৪২, আমেরিকার ওকলোহামা রাজ্যে। বর্তমানে নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা, এবং ‘পোয়েট্রি প্রজেক্ট এট সেইন্ট মার্কস্‌ চার্চ’-এর প্রধান হিশেবে কাজ করছেন। তিনি নিউ ইয়র্ক কাব্যান্দোলনের New York School-এর সঙ্গে যুক্ত। তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ কবিতার বইয়ের নাম Great Balls of Fire বেরোয় ১৯৬৯ সালে। প্যাজেট ২০০৯ সালে শেলি স্মৃতি পুরস্কার পান। ২০১৮ সালে তিনি মার্কিন পোয়েট্রি সোসাইটি থেকে ফ্রস্ট মেডাল লাভ করেন।

পঞ্চাশ ও ষাট দশকে নিউইয়র্কে একটা সময় ফ্রাংক ও’হারা (Frank O’Hara) জন এশবেরি , John Ashbery, (জেমস স্কুলেয়ার) James Schulyer, (কেনেথ কচ, ) Kenneth Koch,, বারবারা গেস্ট (Barbara Guest) প্রমুখে হাতে একটি কাব্যধারা হিশাবে নিউ ইয়র্ক স্কুল কাব্যান্দোলন গড়ে ওঠে। আর্টিস্টদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহবত থেকে এই কাব্যধারার উৎপত্তি বলে অনেকে দাবি করেন। বিশেষত জ্যাকসন পোলক (Jackson Pollock), উইলিয়াম দ্য কুনিগ (Willem de Kooning) জ্যাস্পার জন (Jasper Johns), ল্যারি রিভার্স (Larry Rivers ) প্রমুখের সঙ্গে কবিদের সঙ্গ এই কাব্যধারার প্রেক্ষিত তৈরি করে। ষাট দশকের পরে আরও অনেকে নিউ ইয়র্ক কাব্যান্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন তাদের মধ্যে রয়েছে টেড বেরিগান (Ted Berrigan), এবং এন ওয়াল্ডম্যান। ( এলিস নটলি) Alice Notley, এন ওয়াল্ডম্যান (Anne Waldman), রন প্যাজেট (Ron Padgett), প্রমুখ।
নিউ ইয়র্ক কাব্য আন্দোলনের খ্যাতি কবি ও আর্টিস্টদের ঘনিষ্ট অন্তরঙ্গতা কবিতায় যে ছাপ ফেলেছে সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারনে। বিমূর্ত এক্সপ্রেসানিজম কবিতার ধ্বনি, বলার ভঙ্গি এবং বাক্য বিন্যাসের চরিত্রের ওপর ছাপ ফেলেছে। জীবন যাপনের প্রতি তাদের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীও তাদের খ্যাতির আরেকটি কারন, প্রচলিত জীবন যাপনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ যার একটা বৈশিষ্ট্য – সেটা কবিতাতেও ছাপ ফেলেছে। দৈনন্দিন জীবনের তথ্য, ঘটনা, বিষয়াদি তাদের কবিতায় এমন ভাবে হাজির রাখতে তারা উৎসাহী যাতে শিল্পকলা এবং জীবন যাপনের মধ্যে ফারাক রাখা ও ফারাক বোঝা দুঃসাধ্য করে তোলা যায়। কবিতা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য তাঁদের খ্যাতি যেমন গড়ে উঠেছিল, তেমনি একাডেমিক জ্ঞানচর্চার গরিমা এবং এস্টাব্লিশমেন্টের বিরোধিতাও এদের মধ্যে প্রবল ভাবেই রয়েছে। এই সব সত্ত্বেও এদের কবিতায় দার্শনিকতার তাগিদ হাজির আছে বেশ। এর দ্বারা নিয় ইয়র্ক পোয়েট্রিকে চেনা যায়। – সম্পাদনা বিভাগ

সবচেয়ে ভয়ংকর

অবতার সিং সান্ধু

মেহনত লুট হয়ে যাওয়া সবচেয়ে ভয়ংকর নয়
পুলিশের মার খাওয়া সবচেয়ে ভয়ংকর নয়
গাদ্দারি কিংবা লোভের খাবলা সবচেয়ে ভয়ংকর নয়।

শুয়ে বসে ধরা পড়ে যাওয়া খারাপ বটে
ভয়ে ভয়ে চুপ থেকে মরে যাওয়া খারাপ বটে,
কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর নয়।

সঠিক জেনেও কপটতার কোলাহলে চুপ থাকা খারাপ তো বটেই,
জোনাক জ্বলা টিমটিমে আলোয় পড়তে বসা,
কিংবা হাত মুঠি করে সময় পার করে দেওয়া খারাপ তো বটেই,
কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর নয়।

সবচেয়ে ভয়ংকর হল,
মড়ার মতো শান্তিপূর্ণ হয়ে থাকা
না রেগে সব সয়ে যাওয়া
রোজ রোজ কামলা দিতে বেরিয়ে যাওয়া
আর কাজ শেষে ঘরে ফিরে আসা

সবচেয়ে ভয়ংকর হল আমাদের স্বপ্নের মরে যাওয়া।

সবচেয়ে ভয়ংকর হল ঐ ঘড়িটা,
যেটা আমাদের কব্জিতে চলতে থাকে
কিন্তু দৃষ্টিতে হয়ে থাকে নিথর।

সবচেয়ে ভয়ংকর হল ঐ চোখটা,
যেটা সবকিছু দেখে হিমশীতল হয়ে থাকে
যেটা পৃথিবীকে ভালবাসার দৃষ্টিতে চুমু খেতে ভুলে গেছে
কিংবা সেই চোখ যেটা দুনিয়াবি ধোঁয়াশায় ,
জীবনের অকারণ বিষণ্ণতায় হারিয়ে গেছে।

সবচেয়ে ভয়ংকর হল ঐ চাঁদটা,
যেটা প্রতিটা খুনের পর বিরানভূমিতে জ্বলে ওঠে
কিন্তু যার আলো আমাদের চোখকে মরিচের গুড়ার মতো জ্বলায় না।

সবচেয়ে ভয়ংকর হল ঐ গান,
যেটা আমাদের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে বিলাপ করে
আর এমনভাবে বাজে যেন মনে হয়
আতংকিত মানুষের দরজায় গুন্ডার মতো কড়া নাড়ছে।

সবচেয়ে ভয়ংকর হল ঐ রাত,
যার আকাশ জীবিত আত্মায় ছেয়ে আছে
অথচ শোনা যাচ্ছে হায়েনার গর্জন আর পেঁচার ডাক,
যেন অনন্ত অন্ধকার বন্ধ করে দিয়েছে
অস্তিত্বের সব দরজা-জানালার কপাট

সবচেয়ে ভয়ংকর হল সেই দিগন্ত,
যেখানে আত্মার সূর্যটা ডুবে যায়
আর যার মরা চিলতে রোদ
আমাদের শরীরের পূর্বদিক বরাবর ঢুকে যায়।

মেহনত লুট হয়ে যাওয়া সবচেয়ে ভয়ংকর নয়
পুলিশের মার খাওয়া সবচেয়ে ভয়ংকর নয়
গাদ্দারি কিংবা লোভের খাবলা সবচেয়ে ভয়ংকর নয়।

সবচেয়ে ভয়ংকর হল আমাদের স্বপ্নের মরণ।

তর্জমা

মুরীদ আল-বারগুথি

কবি বসে লিখছে ক্যাফেতে।

বৃদ্ধা ভাবছে
চিঠি লিখছে মাকে,
তরুণী ভাবছে
লিখছে প্রেমিকাকে,
বাচ্চা ভাবছে
আঁকিবুঁকি,
সওদাগর ভাবছে
ব্যস্ত সে, কায়কারবারে
মুসাফির ভাবছে
লিখছে পোস্টকার্ড,
ভৃত্য ভাবছে
মেলাচ্ছে সে দেনার অংক,
আর গুপ্তচর
এগিয়ে আসছে, ধীরে, কবির দিকে।

আরও একটি

রন প্যাজেট

যখন ছিলে ছোট, শিখেছিলে
মাত্রা আছে তিনটা
দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বেধ
এই যেমন জুতার বাক্স
তারপর জানলে,
আছে এক চতুর্থ মাত্রাও
সময়
হুম
পরে কেউ কেউ বলল, থাকতে পারে আরও আরও মাত্রা,
পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম….

আমি কাজ সারি
বারে বসে বিয়ার সাঁটাই
গেলাশের মধ্যে তাকাই,
ভাল্লাগে আমার।

জাহিন ফারুক আমিন

চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। জন্ম ১৭ জুন ১৯৯৩, বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায়। বর্তমানে দিল্লীর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ আর্টস এন্ড এস্থেটিক্‌সে অধ্যয়নরত

Share

1 thought on “তিনটি ভাষার তিনটি কবিতা”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top