আজ রবিবার, ২১শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৬ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

জীবনস্মৃতিসৈকত

।। আর্যনীল মুখোপাধ্যায় ।।

‘স্মৃতিলেখা’ কোনো স্মৃতিকথা ছিল না। ছিল না কোনো স্মৃতির শহরের কথা, কোনো পুরনো অ্যালবামের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা। ‘স্মৃতিলেখা’ র গোটা প্রয়াসটাই ছিল ‘স্মৃতি’ জিনিসটাকে বোঝার চেষ্টা। কোথায় তার বাসা, কী তার রকমসকম, কীভাবে তার রোজকার কাজ, কীভাবে তার বুড়িয়ে যাওয়া, পুনর্জন্ম? অ্যাগ্নেস ভার্দা যেটা ফিল্মের ওপর লিখছেন, অতর্‌-সিনেমায় (যে তত্ত্ব দাবী করে চলচ্চিত্রকারও এক লেখক, ক্যামেরা তার কলম), প্রায় সেইরকমের একটা কাজ আমি না জেনে লিখছি সাদা পাতায়, এক দীর্ঘকবিতায়। রোমহর্ষ যেমন হয়, তেমনি আশীর্বাদও মনে হয়। আত্মজীবনের সৈকতে, বালিতে প্রোথিত হয়ে যাওয়া এই অসমান্তরাল, অভাবনীয় সিনেমার প্রভাব আমার কবিতায় না প’ড়ে উপায় ছিল না। চলচ্চিত্র থেকে অনবরত রক্ত টানে আমার কবিতা; কবিতার চেয়ে, সাহিত্যের চেয়ে অনেক বেশি। কাজেই ‘স্মৃতিলেখা’র প্রক্ল্প শুরু হবার সময় নানা জ্ঞানশাখা থেকে প্রেরণাসূত্র খোঁজার সময় সিনেমার দিকেও চোখ ছিল। অনেক চলচ্চিত্রিকে, সিনে-পন্ডিতদের জিজ্ঞেস করেছি। নিজেরও কিছু মনে পড়েছে, যেমন ভার্দারই সমসাময়িক ও বন্ধু আলাঁ হ্রেনের ছবি – লা’নে দেরনিয়ের মারিয়েনবাদ (Last Year at Marienbad)। কিন্তু দৈবের শুভকামনাতে অথবা অভিশাপে জানতে পারিনি অ্যাগ্নেস ভার্দার এই শেষ ছবিটার কথা। আমার কবিতার শুরুর দিকে একটা সাক্ষাৎকার ছিল। এক নামী, অকালমৃতা নিউরোবায়োলজিস্টের।

জীবনস্মৃতিসৈকত 

‘হাইপারলিঙ্ক’ শব্দটার একটা বাংলা খুঁজি। অতিযুক্ত হয়ে থাকা? পরিযুক্ত? এক চিন্তার ওপর হাঁটতে হাঁটতে কখন অন্য চিন্তায়, অন্য পরিসরে, তথ্যের গায়ে গায়ে তথ্য লেগে, যুক্ত হয়ে কাঠবিড়ালীর গড়া বাঁধের মতো।

 এক ছবিঘরের কথা পড়ছিলাম একটা কবিতায়। এক আর্ট-গ্যালারির কথা। সেখান থেকে চলে এলাম সৈকতে, তার থেকে চিত্রনির্মাণে। চলচ্চিত্র। পেরিয়ে এলাম কত গাছ, কত তল্লাট, বস্তু, চিন্তা, কত দেশ, মানুষ ঘুরে, মুহূর্তে। মস্তিক-ল্যাবের খেলনা-ট্রেন চ’ড়ে। 

একটু খুলে বলি। যুক্তরাষ্ট্রের পিটস্‌বার্গে কার্নেগি শিল্পঘর। সেখানের দেয়ালে ছবিটা। ছবিতে ছিলো খোলা জানলা দিয়ে একটা হলুদ হয়ে যাওয়া বাগান, আর জানলার সামনে ঘরের ভেতরে এক বালক, তার হাতে মার্বেলের ফুল। সে ফুলটা সযত্নে দেখে। হয়তো হেমন্ত এসেছে, সব ফুল বিগত। এই মার্বেলের ফ্লাওয়ার-আর্ট হয়তো তারই ইঙ্গিত। অবান্তরবাদী মন সেরা সেতুবিদ, সেরা পর্যটক, সেরা স্থপতি। সে দ্রুত পৌঁছে যায় কবিতায়—

এ কি ঘুম? এ কি আত্মবিস্মরণ?
এ কি অকস্মাৎ মর্মরের ফুলে অধ্যুষিত হয়ে ওঠা?
এ কি বীরের ক্ষমতা জাল? নাকি সফলতা নামে কোনো
সামুদ্রিক জাতি? নাকি দেবদারু-নামী তীর, জেলিমাছ, নৌ-অভিজ্ঞতা, ঢেউ,
আপন মুঠোর মাঝে পৃথিবীরই কীর্ণ হয়ে যাওয়া?

দূরবীক্ষণ তুমি, চেয়ে আছ, ঝঞ্ঝার মেঘে, ঐ নিলীমাবিথারে—

(পুরী সিরিজ/ উৎপলকুমার বসু)

কবিতা থেকে সৈকতের কথা এলো একজনের কথা মনে করে। সে বলেছিলো – ‘বেশিরভাগ মানুষকে খুলে ফেললে পাওয়া যাবে ল্যান্ডস্কেপ, আমাকে খুলে ফেললে কেবল ‘সৈকত’’। অশীতিপর এই চলচ্চিত্রশিল্পী ওঁর শেষ ছবিতে, স্মৃতিময় এক বিচূর্ণ আত্মকথনের মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছিলেন সৈকতের বালি ও লহরী। অনন্ত সময়কে বালি দিয়ে মাপার ধারণাটা হয়তো সৈকত থেকেই এসেছিলো।

জলজ জীবন থেকেই এই পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি, আমরা জানি। সেই চিরতরঙ্গি জলের লহরীতে জীবনের সমস্ত সংগৃহীত চিন্তাকে মিশিয়ে দিতে পারলে প্রবহমানকেই সম্মান জানানো হয়। জীবনাবসানকে তখন আর যাই হোক পূর্ণচ্ছেদ মনে হয় না। হয়তো এই রকমই একটা চিন্তাচেতনা কাজ করছিলো অ্যাগনেস ভার্দার মধ্যে। ফরাসী নবতরঙ্গ বা ‘ন্যুভেল ভাগ’ আন্দোলনের জ্যঁ-ল্যুক গোদার, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, এরিক রোমার, ক্লদ শাব্রল, জ্যাক রিভেত, আলাঁ হ্রেনে, ক্রিস মার্কার, স্বামী জ্যাক দেমি – এঁদের বান্ধবী ও সমসাময়িক অ্যাগনেস ভার্দা। ১৯৬০-এর দশকে যাঁরা মূলধারার নিয়মকে চূর্ণ করে ফরাসী চলচ্চিত্রে পরিবর্তন আনছিলেন তাঁদেরি একজন ভার্দা, যদিও গল্পবলা সিনেমার চেয়ে ওঁর আগ্রহ ছিলো চিত্রাখ্যান (photo-feature) ও তথ্যচিত্রে (feature film)। ‘বীচেস অফ অ্যাগনেস’ (২০০৮) ভার্দার শেষ ছবি।

‘বীচেস অফ অ্যাগ্নেস’-এর শুরু দিকে এক দৃশ্যে পরিচালক ভার্দা সৈকতে আয়না বসাচ্ছেন ছবির দৃশ্যের জন্য। 

প্রথমবার ছবিটা দেখতে দেখতে এক উত্তোলিত, উদ্বেল খুশী মস্তিষ্কের তারজটের সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। মনে পড়ে যায় আমার চতুর্থ বই ‘স্মৃতিলেখা’র কথা। প্রায় আড়াইশো পাতার একটি দীর্ঘকবিতা,  স্মৃতিভাবনার উপাসনায়। যে কবিতা শুরু হয় প্রায় ওই একইসময়ে—২০০৭-২০১২ – পাঁচ বছর লেগে যায় তার পরিচর্যায়। কী দুর্ভাগ্য ভার্দারর ছবিটার কথা এই দীর্ঘ কবিতার খড়কাদা বাঁধার সময় জানতে পারিনি! দেখতে পাইনি এই ছবি। ‘স্মৃতিলেখা’ কোনো স্মৃতিকথা ছিল না। ছিল না কোনো স্মৃতির শহরের কথা, কোনো পুরনো অ্যালবামের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা। ‘স্মৃতিলেখা’ র গোটা প্রয়াসটাই ছিলো ‘স্মৃতি’ জিনিসটাকে বোঝার চেষ্টা। কোথায় তার বাসা, কী তার রকমসকম, কীভাবে তার রোজকার কাজ, কীভাবে তার বুড়িয়ে যাওয়া, পুনর্জন্ম? অ্যাগ্নেস ভার্দা যেটা ফিল্মের ওপর লিখছেন, অতর্‌-সিনেমায় (যে তত্ত্ব দাবী করে চলচ্চিত্রকারও এক লেখক, ক্যামেরা তার কলম), প্রায় সেইরকমের একটা কাজ আমি না জেনে লিখছি সাদা পাতায়, এক দীর্ঘকবিতায়। রোমহর্ষ যেমন হয়, তেমনি আশীর্বাদও মনে হয়। আত্মজীবনের সৈকতে, বালিতে প্রোথিত হয়ে যাওয়া এই অসমান্তরাল, অভাবনীয় সিনেমার প্রভাব আমার কবিতায় না প’ড়ে উপায় ছিল না। চলচ্চিত্র থেকে অনবরত রক্ত টানে আমার কবিতা; কবিতার চেয়ে, সাহিত্যের চেয়ে অনেক বেশি। কাজেই ‘স্মৃতিলেখা’র প্রক্ল্প শুরু হবার সময় নানা জ্ঞানশাখা থেকে প্রেরণাসূত্র খোঁজার সময় সিনেমার দিকেও চোখ ছিল। অনেক চলচ্চিত্রিকে, সিনে-পন্ডিতদের জিজ্ঞেস করেছি। নিজেরও কিছু মনে পড়েছে, যেমন ভার্দারই সমসাময়িক ও বন্ধু আলাঁ হ্রেনের ছবি – লা’নে দেরনিয়ের মারিয়েনবাদ (Last Year at Marienbad)। কিন্তু দৈবের শুভকামনাতে অথবা অভিশাপে জানতে পারিনি অ্যাগ্নেস ভার্দার এই শেষ ছবিটার কথা। আমার কবিতার শুরুর দিকে একটা সাক্ষাৎকার ছিল। এক নামী, অকালমৃতা নিউরোবায়োলজিস্টের। তাঁর সাক্ষাৎকারের কেঠো ইংরেজী বয়ান থেকে কাব্যভাষা গড়ে নিয়ে লিখেছিলাম—

যদি স্মরণশক্তির কোনো ক্ষয় না থাকত
এক জায়গার ঝর্ণা যদি সেখানেই চিরতরে আজকের মতো
স্মৃতিকে এতটা জানা বা বোঝা যেত না। ব্যাপারটা সহজ না?
যার মামা নেই তারই তো কানা মামা চাই। বিচিত্র সব ফাঁক। তৈরি
হয়ে যায়। আমাদের অগোচরে। ফুলসাজির ভেতর। বইয়ের তাকে।
আমাদের চেনাচেনি জানাজানির ভেতর। এক একটা ঘটনা আসে
জটিল… পাগলকরা… মাথা গুলিয়ে দেওয়া। আর গোলযোগের
পর আসে সেইসব ফাঁক। যেমন anaesthetic coma-র পর
কখনো আসে Retrograde Amnesia।

চেনেন বালি দানার আকৃতি? দেখেছেন? চিনে রেখেছেন
তাকে? আর্থার শোপেনহাওয়ার বলেছিলেন স্মৃতি নতুন
কুকুরছানা কখনো। ঘাবড়ে যাওয়া ফুলদান যার ভেতরে
বালি ঝরছে। আর সেইসব দান তাদের আকৃতি অনুযায়ী গুছিয়ে
রাখছে যাতে ফেরত চাইলে দেওয়া যায়। আর সে দানের তলা
নেই। আকার মনে রাখার তার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। ক্ষমতা যেমন
স্বয়ংক্রিয় সতত বহতা ঝিলের মিঠেপানি যেমনটা প্রুস্তের
লেখা অনুপুঙ্খের সেই বিরক্তিকর স্রোত সে ক্ষমতার সুরও
ছিঁড়ে যেতে পারে। পড়ে যেতে পারে সবকটা পুঁতি। আর তখনই
খোঁজ খোঁজ। ফিকে হয়ে যাওয়া গন্ধের। যেখান থেকে
স্মৃতিভাবনার অ-আ-ক-খ। বর্ণপরিচয়। হর্হে ল্যুই বোর্হেসের
নায়কের কথা ভাবুন— সেই গল্পটা— Funes el
Memorioso

গোটা কবিতায় কোনো ক’মা চিহ্ন রাখিনি। ইচ্ছে করেই। নিরুদ্দেশ ক’মা ছিলো নিরবচ্ছিন্নতার এক গোপন প্রতীক। যে নিরবচ্ছিন্নতায় নির্মিত হয় মানবস্মৃতি। ‘বীচেস অফ অ্যাগ্নেস’-এর প্রয়াস কিন্তু আলাদা, ‘স্মৃতি কী?’ নিয়ে সেখানেও প্রশ্ন থাকলেও, ছবিটা একরকমের জীবনস্মৃতি। যদিও ভার্দাও এক প্রবহমানতায় গড়েছেন তাঁর মেমোয়ার। পরিচ্ছেদভাঙা উপন্যাসের মতো নয়, বহতা নদীর জলোচ্ছল তথ্যমুগ্ধ ধারাবাহিকতায়।  

আরো অনেক মিল ধরা পড়তে লাগলো ক্রমশ। ছবির ভাষা যেমন যৌগ, তেমনি খিচুড়ি আমার বইয়ের কাব্যভাষা— ব্রিকোলাজ সন্ধানী। আমরা সরল ভাষায় যখন বলি ‘খিচুড়ি’ শিল্প, তাকে ছোটো করি। দশটা এলোমেলো ভাবনাচিন্তা, প্রক্রিয়া-উপাদান এক ধরনের ফর্মহীনতার মধ্যে ঘেঁটে দিয়ে যে শিল্প সেটাকেই বলি ‘খিচুড়ি’। অথচ এই খিচুড়ি বা লাবড়া বা পাঁচতরকারিকেই ফরাসি নৃতত্ববিদ লেভি ক্লদ-স্ট্রাউস শিল্প ও সংস্কৃতি নির্মানের অন্যতম শক্তিমান ও স্বাভাবিক উপায় বলে মনে করেছিলেন। ক্লদ-স্ট্রাউস তাকে বলেছিলেন — ‘ব্রিকোলাজ’।

‘স্মৃতিলেখা’র প্রচ্ছদ

নানা ধরনের কাপড় থেকে সুতো নিয়ে যে বুনন সেটাই ব্রিকোলাজ। সেভাবেই অধিকাংশ মানব সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ভাষাও। অ্যাগনেস ভার্দা যে চলচ্চিত্রভাষাকে অবলম্বন করেছেন ‘বিচেস ওফ অ্যাগনেস’ ছবিতে তা এক ব্রিকোলাজ ভাষাই। ছবি, স্মৃতিচিহ্ন, তথ্যচিত্র, পুরনো রেকর্ড, অ্যানিমেশন, কার্টুন, নিজের পুরনো ছবির কিছু কিছু দৃশ্য, শিশুদের গল্প বলার বই, চিত্রকলা, পেন্টিং-এর ঢঙে নির্মিত কিছু দৃশ্য, সাক্ষাতকার, নিউসরীল, গ্রাফিত্তি, ভাস্কর্য, সাগরপাড়ের ট্র্যাপিজ – এমন কত কী জড়ো করে, তার সুতো দিয়ে বুনে বুনে এমন একটা ছবি করেছেন যেখানে স্মৃতি যেন জীবনের অনুঘটক। সৈকতের মঞ্চে এসে সে যেন বিগত জীবনের ভূমিকায় অভিনয় করে যায়। অথচ কোনো কিছুই অতীতের মতো অবিকল করে দেখান না অ্যাগনেস। কিছুটা ন্যারেশনে যান, কিছুটা রূপকথার মতো করে সাজান, নিজের ভূমিকায় নিজেই অভিনয় করেন। সে অভিনয়ের অনেকটাই আবার মেলোড্রামাময় শিশুনাট্যের মতো। রেনে ম্যাগ্রিতের এক বিখ্যাত ক্যানভাসে মাথায় সাদা ঠুলি পরানো দুই নারী পুরুষ মসলিনের ওপর দিয়ে চুম্বন করে।

বইদীর্ঘ কবিতা ‘স্মৃতিলেখা’তেও এই ব্রিকোলাজ প্রয়াস ছিলো, কী আশ্চর্য! নানা ধরনের লিপিকে এক কবিতার শরীরে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। যাকে ‘পরিবিষয়ী কবিতা’য় আমরা বলেছিলাম ‘নবলিপি’, তারই এক বিশেষ ব্যবহারে আখ্যান, কাহিনি, চিত্রনাট্য, প্রবন্ধ, ধারাভাষ্য, দিনিলিপি, চিঠি, সাক্ষাতকার, নোট, আরোপলিপি, রান্নার রেসিপি, গানের লাইন – সব মিলেমিশে একখন্ড, একশিলা হয়ে আছে। 

ছবির শুরুতে অ্যাগনেস ভার্দা ছবি-তোলার-ছবিতে চলে যান। আমরা দেখি বেলজিয়ামের এক সৈকতে সহকারী কিছু তরুণ-তরুণীকে নিয়ে পরিচালিকা ৩-৪ ভাঁজের বড় বড় আয়না বসাচ্ছেন। বসানোর সময় নড়াচড়ার মাঝে আমরা আয়নার পাটে পাটে পরিচালিকা ও তারঁ সহকারীদের টুকরো টুকরো চেহারা দেখতে পাই। সমুদ্রকে দেখি সমুদ্রে প্রতিফলিত হতে। বালিকে দেখি বালির ওপর। ধারাভাষ্যের এক জায়গায় ভার্দা বলেন অনন্ত এইসমস্ত তটে এসে শুয়ে থাকে, তাইতো আমাদের পূর্বপুরুষ পূর্বনারীরা সময়কে বালি দিয়ে মাপার চেষ্টা করেছে। জলবালি, ঢেউ, লহরীর গতি ও গীতিময়তা, জল ও আকাশরেখার মসৃণ মিলনদাগের সামনে আত্মকথন ও আত্মপ্রতিফলন শুরু করে ভার্দা চলে যান বহু বছর আগের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যখন তারা, এক ইহুদী পরিবার, নাৎসীদের  হাত গ’লে পালাতে পেরেছিলো।

ছবির সেট সাজানোর অপরিকল্পিত প্রয়াসটাকেও ছবির মধ্যে রেখেছেন ভার্দা – সেই

নানা ধরনের কাপড় থেকে সুতো নিয়ে যে বুনন সেটাই ব্রিকোলাজ। সেভাবেই অধিকাংশ মানব সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ভাষাও। অ্যাগনেস ভার্দা যে চলচ্চিত্রভাষাকে অবলম্বন করেছেন ‘বিচেস ওফ অ্যাগনেস’ ছবিতে তা এক ব্রিকোলাজ ভাষাই। ছবি, স্মৃতিচিহ্ন, তথ্যচিত্র, পুরনো রেকর্ড, অ্যানিমেশন, কার্টুন, নিজের পুরনো ছবির কিছু কিছু দৃশ্য, শিশুদের গল্প বলার বই, চিত্রকলা, পেন্টিং-এর ঢঙে নির্মিত কিছু দৃশ্য, সাক্ষাতকার, নিউসরীল, গ্রাফিত্তি, ভাস্কর্য, সাগরপাড়ের ট্র্যাপিজ – এমন কত কী জড়ো করে, তার সুতো দিয়ে বুনে বুনে এমন একটা ছবি করেছেন যেখানে স্মৃতি যেন জীবনের অনুঘটক। সৈকতের মঞ্চে এসে সে যেন বিগত জীবনের ভূমিকায় অভিনয় করে যায়। অথচ কোনো কিছুই অতীতের মতো অবিকল করে দেখান না অ্যাগনেস। কিছুটা ন্যারেশনে যান, কিছুটা রূপকথার মতো করে সাজান, নিজের ভূমিকায় নিজেই অভিনয় করেন। সে অভিনয়ের অনেকটাই আবার মেলোড্রামাময় শিশুনাট্যের মতো। রেনে ম্যাগ্রিতের এক বিখ্যাত ক্যানভাসে মাথায় সাদা ঠুলি পরানো দুই নারী পুরুষ মসলিনের ওপর দিয়ে চুম্বন করে।

বইদীর্ঘ কবিতা ‘স্মৃতিলেখা’তেও এই ব্রিকোলাজ প্রয়াস ছিলো, কী আশ্চর্য! নানা ধরনের লিপিকে এক কবিতার শরীরে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। যাকে ‘পরিবিষয়ী কবিতা’য় আমরা বলেছিলাম ‘নবলিপি’, তারই এক বিশেষ ব্যবহারে আখ্যান, কাহিনি, চিত্রনাট্য, প্রবন্ধ, ধারাভাষ্য, দিনিলিপি, চিঠি, সাক্ষাতকার, নোট, আরোপলিপি, রান্নার রেসিপি, গানের লাইন – সব মিলেমিশে একখন্ড, একশিলা হয়ে আছে। 

ছবির শুরুতে অ্যাগনেস ভার্দা ছবি-তোলার-ছবিতে চলে যান। আমরা দেখি বেলজিয়ামের এক সৈকতে সহকারী কিছু তরুণ-তরুণীকে নিয়ে পরিচালিকা ৩-৪ ভাঁজের বড় বড় আয়না বসাচ্ছেন। বসানোর সময় নড়াচড়ার মাঝে আমরা আয়নার পাটে পাটে পরিচালিকা ও তারঁ সহকারীদের টুকরো টুকরো চেহারা দেখতে পাই। সমুদ্রকে দেখি সমুদ্রে প্রতিফলিত হতে। বালিকে দেখি বালির ওপর। ধারাভাষ্যের এক জায়গায় ভার্দা বলেন অনন্ত এইসমস্ত তটে এসে শুয়ে থাকে, তাইতো আমাদের পূর্বপুরুষ পূর্বনারীরা সময়কে বালি দিয়ে মাপার চেষ্টা করেছে। জলবালি, ঢেউ, লহরীর গতি ও গীতিময়তা, জল ও আকাশরেখার মসৃণ মিলনদাগের সামনে আত্মকথন ও আত্মপ্রতিফলন শুরু করে ভার্দা চলে যান বহু বছর আগের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যখন তারা, এক ইহুদী পরিবার, নাৎসীদের  হাত গ’লে পালাতে পেরেছিলো।

ছবির সেট সাজানোর অপরিকল্পিত প্রয়াসটাকেও ছবির মধ্যে রেখেছেন ভার্দা – সেই টেকনিক যাকে মিসঁনাবীম (mise-en-abyme)বলা হয়। ছবি তৈরির ছবিটাও ফিল্মের অংশ। অঙ্কনচিত্রের ভেতরে এক অঙ্কনচিত্র। স্ফটিকের ভেতরে এক ছোট স্ফটিক। সেইরকমই একটা প্রয়াসে দীর্ঘ কবিতা স্মৃতিলেখার ভেতরেই ছিলো সে বই লেখার প্রস্তুতির গল্প, বইয়ের বিজ্ঞাপন, বইয়ের ভূমিকা – সেগুলোও কবিতার শরীরে কবিতাকারে মিশিয়ে দেওয়া ছিলো। বাহারি কবিতার তাগিদে নয়, কি দীর্ঘতম বাংলা কবিতার গিনেস রেকর্ড করতে নয়, ‘স্মৃতিলেখা’ লিখেছিলাম এক দুর্মর, অন্ত্যজ শক্তির পরিচালনায়। লিখেছিলাম–

টেকনিক যাকে মিসঁনাবীম (mise-en-abyme)বলা হয়। ছবি তৈরির ছবিটাও ফিল্মের অংশ। অঙ্কনচিত্রের ভেতরে এক অঙ্কনচিত্র। স্ফটিকের ভেতরে এক ছোট স্ফটিক। সেইরকমই একটা প্রয়াসে দীর্ঘ কবিতা স্মৃতিলেখার ভেতরেই ছিলো সে বই লেখার প্রস্তুতির গল্প, বইয়ের বিজ্ঞাপন, বইয়ের ভূমিকা – সেগুলোও কবিতার শরীরে কবিতাকারে মিশিয়ে দেওয়া ছিলো। বাহারি কবিতার তাগিদে নয়, কি দীর্ঘতম বাংলা কবিতার গিনেস রেকর্ড করতে নয়, ‘স্মৃতিলেখা’ লিখেছিলাম এক দুর্মর, অন্ত্যজ শক্তির পরিচালনায়। লিখেছিলাম–

তবু কাব্যভাষা সর্বোপরি উঠে আসে ধ্বংসস্তূপ থেকে
আর উচ্ছেদ করে দেওয়া অনুভূতির দিকে তাকালে দেখবে
ওর প্রকোষ্ঠেই আইডিয়া ছিল
সবশুদ্ধু জ্বালিয়ে দিয়েছে দাঙ্গার সময় গর্ভবতীকে
খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে তার আধপোড়া অন্ত্যজ


কিছু সোজাসাপ্টা আছে যার ছুরি এত ধারালো
যে অস্পর্শেও কাটে
তখন এসব মনে হয় মনে হয়
মানুষের হাতে রক্ত লাগে আবার সে হাতেই কালি
চাঁদ কত রূপসী এর ওই ঝর্ণা কত খালি-গা
ধ্বনির ভেতরে আছে কী গভীর খনি
আর নষ্ট হতে চাওয়া মহিলা কেন সেলাই দিদিমনি –
এসব বলবার মতো সময় আমার এর বাকি নেই


জ্ঞান এমনকী প্রজ্ঞাকেও বাসনা এসে অস্পষ্ট করে
এর যদি হয় জ্ঞানের কামনা
তারও অগ্নিকান্ড আছে
যেখানে আমার প্রত্যেক রক্তকণিকার পতঙ্গ আমাকে ঠেলে দেয় লহরীর মধ্যে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেয় ঝিনুক
সে আর ফেরে না
শুধু ফেনা ফিরে এসে দেখায় খালি-হাত
ডেলিভারি কনফার্মেশন

‘বীচেস অফ অ্যাগনেস’ স্মৃতিচিত্রের শেষের দিকে ভার্দা চলচ্চিত্র-অনুভূতিকে এক আশ্চর্য ব্যক্তিগত স্তরে নিয়ে আসেন। ওঁর এক অসম্পূর্ণ ছবির কিছু রীল প্রিন্ট করে, তাকে সরু ফালিতে কেটে, লম্বা করে জুড়ে, ঘরের দেয়ালজোড়া জানলার ওপর ব্লাইন্ডস্‌-এর মতো সাজিয়ে রাখেন। নিজেরই তোলা সেই ফালি-ফালি ছবির ভেতর দিয়ে রোদছায়া এসে পড়ে ওঁর নিজের শরীরে, ‘ছায়া-ছবি’র সেই রোদের মুখোমুখি বসে অ্যাগনেস বলেন, ‘স্মৃতি আসলে এক ঝাঁক মাছির মতো, ওরা আমায় বড্ড জ্বালায়, আমি বোধহয় ওদের মনে করতেও চাই না’।

তুলনায়, এখানে মেলেনি আমার ‘স্মৃতিলেখা’র মূলমন্ত্র। আমি স্মৃতির সংজ্ঞাকে খুঁজেছিলাম। এক এক পেশা, এক এক প্রবৃত্তি, এক এক জ্ঞানশাখার পেরিস্কোপ দিয়ে, জলতলের অন্বেষণ নিয়ে মানবজমিনের উপরিতলকে, খুঁজেছিলাম। তবু ছবি শেষে বসে থাকতে হয় এক ভাবালু, অসহয়তা নিয়ে। কোথায় এক মধ্য-চল্লিশের কবির দীর্ঘকবিতা আর এক অশীতিপর চিত্রপরিচালকের পরীক্ষামূলক ছায়াছবি! কতোটা শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত প্রয়াসে, পরিকল্পনায় ‘বীচেস অফ অ্যাগ্নেস’-এর মতো একটা ছবি হয়, সে কথা মনে করে শ্রদ্ধায় বিনত হয়ে আসে মন-মস্তক; ‘স্মৃতিলেখা’র প্রয়াস তার কাছে ওই মাছির মতোই নগণ্য। যেটুকু আত্মিক প্রয়াসের মিল তার আনন্দটাই সমুদ্রলহরীর মতো। নিরন্তর। 

আর্যনীল মুখোপাধ্যায়

দ্বিভাষিক কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, চিত্রনাট্যকার ও সম্পাদক। বাংলা ও ইংরেজী মিলিয়ে ৯টি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে Conversation about Withering (২০২১, ক্রিস্তিনা স্যাঞ্চেস লোপেসের সাথে), অনাম আন্দ্রেসের একক ইস্তাহার (২০২০), স্মৃতিলেখা (২০১৩, ২০১৫), সুনামির এক বছর পর (২০০৮), চতুরাঙ্গিক/SQUARES (২০০৯, প্যাট ক্লিফোর্ডের সাথে), late night correspondence (2008), হাওয়ামোরগের মন (২০০৪) ও খেলার নাম সবুজায়ন (২০০০,২০১১)। গদ্যগ্রন্থ ‘কিনারার রূপকথা’। চারটি প্রবন্ধের বই। ইংরেজী ও ইস্পানি কবিতা সংকলিত হয়েছে অসংখ্য বিদেশী কাব্য-আয়োজনে। কৌরব অনলাইন ও The MUD Proposal সম্পাদনা করেন। পেশা – কারিগরি গণিতের গবেষণা।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top