আমি ও তন্‌হাই

।। অর্ণব সাহা ।।

হয়তো আরেকটু দৌড়ব। হয়তো পড়ে যাব মুখ থুবড়ে।
হয়তো ময়দানে কালো গাড়ি থেকে নামিয়ে হাতকড়া
খুলে নেবে কেউ…

অস্পষ্ট লাশের জমিতে দু’ফোঁটা রক্ত জেগে থাকে!

কায়স্থপাড়ার মোড়ে রুটির দোকান ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে,
অনশ্বর!
শুধু তুমি শহর ছেড়ে চলে গেছ কয়েকহাজার মাইল
ক্যানভাসে ছড়ানো রং। মাঝখানে একটুকরো সাদা
ওখানেই সমস্ত রক্ত জমাট বাঁধবে কিছুক্ষণ পর…

সভ্যতায় রক্তই সত্যি। নিভু ক্যাফেটেরিয়া,
একটা-দুটো ল্যাম্প কেটে যাওয়া বাতিস্তম্ভ, হাত
দেখিয়ে থামানো ট্যাক্সি
সবকিছুই নিজের সত্তা ছিঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে!

তুমি নেই। একটা ফাঁকা খোলসের মতো পড়ে আছে
কলকাতা…

একটা নীল গাড়ি এসে দাঁড়াল। গম্ভীর ড্রাইভার
জানতে চাইল—“কোনদিকে যাবেন?”
বললাম—“যাদবপুর থানা বাঁ-দিকে রেখে দিক্‌শূন্যপুরের
দিকে এগোন…”

ওটা সুনীলের এলাকা। আমি কখনও যাইনি।
বড়ো রিসর্ট, খুব দামি রেস্তোঁরা দেখলে ভয় করে আমার!

তুমি সঙ্গে থাকলে মনে হয় সবকিছু আছে।
ক্ষতচিহ্ন শুকিয়ে গেছে আঙুলের ছোঁয়ায়!

নিঃসঙ্গতা। আরেক নাম ‘তন্‌হাই’
আমি তা জড়িয়ে রাখি পোষা বিড়ালের মতো

সন্ধে নামে। নীল-সাদা আলোয় ভরে ওঠে চারিদিক
অবশ মন কিছু একটা খুঁজতে থাকে
উবু-হয়ে-বসা ভিখারির সামনে এনামেলের বাটি
রাতের খাওয়া সেরে নিচ্ছে কয়েকঘণ্টা আগেই

আমি উঠি। একলা বসে থাকার কফিশপ,
অর্ধেক পড়া ‘ফ্রন্টলাইন’, টিপসের মলিন নোট,
মাথার ভিতরে ঘোরে ছোট্ট ব্রহ্মাণ্ড!

একাকিত্ব, আমায় ছেড়ে যেও না কখনও…

“জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণাধারায় এসো”
রাবীন্দ্রিক নই। জানি না পঙ্‌ক্তি ভুল হল কি না!

আর মাথায় ঘাই মারে রোজকার অশিক্ষিত চাঁদ
কলোনির জমিতে বড়ো-হওয়া বেপরোয়া চাঁদ
হাইরোড ধরে ক্রমশ ছুটে চলার ইন্ধন জোগায়…

হয়তো আরেকটু দৌড়ব। হয়তো পড়ে যাব মুখ থুবড়ে।
হয়তো ময়দানে কালো গাড়ি থেকে নামিয়ে হাতকড়া
খুলে নেবে কেউ…

অস্পষ্ট লাশের জমিতে দু’ফোঁটা রক্ত জেগে থাকে!

বেখাপ্পা আপেল। সেজানের ক্যানভাস ছিঁড়ে গেছে…
তুমি নেশাতুর। তুমি আগুন জ্বালিয়েছ গোটা নর্থ
কলকাতায়
তোমার সরু ব্লাউজ, দামি শাড়ির ছটা অমলিন
তোমার প্লেন ল্যান্ড করলে পুরো শহরে খবর হয়!

ওই কোমরের খাঁজে হাত রাখলে মনে হয় গ্লেসিয়ার
পুরো সন্ধে গলে যাচ্ছে, বরফ ছিটকে পড়ছে গড়িয়াহাটের
সমস্ত দোকানে…

যেও না। অল্প থাকো। নিঃসঙ্গ ক্যাফের আলো
আরেকটু মায়াবী করে দাও…

এক উন্মাদ মহিলা ড্রয়িংরুমে বসে চিৎকার করছে
আর আমি খুঁজছি তোমার বাসি-হয়ে-যাওয়া
ফেসবুক পোস্ট
যাতে বরফঢাকা অরণ্যের ছবিতে ছিল চেরির বাগান
ছিল অর্কিড, ছিল পিয়ানো, তোমার নিজের হাতে
সাজানো খুঁটিনাটি
পিতলের গ্রামাফোন কী নিখুঁত যত্নে ঝকঝকে, পরিপাটি
রাখতে পারো তুমি!

ঠাঁইনাড়া এই জীবন এবার সত্যিই জড়িয়ে যাবে
তোমার শরীরে…

ত্যারচা রোদ বারান্দায় এসে পড়লে জ্যামিতিক
ভাঙচুর হয়
পুরোনো রকিং চেয়ার, পা দোলানোর ফাঁকে
যখন মগজে ঘোরে অন্ধ প্রজাপতি
আমি টুকরো স্মৃতিগুলো আবার ঝালিয়ে নিই
১ ডিসেম্বর। একটা রোডসাইড কফিশপে আধঘণ্টা
কাটানোর পর
মনে হয়েছিল কালো শ্লেট মুছে ফেলছি ডাস্টার দিয়ে
পায়ের আঙুল বেয়ে উপরদিকে উঠে আসছে
আমার তন্‌হাই

স্বপ্নের মধ্যে অঙ্কুশ হাজরা, মিমি ও নুসরত
নিঃসঙ্গতার কয়েকশ কিলোমিটার পেরিয়ে আঘাটার
জল

ছড়ানো মুরগির মতো ছিন্নভিন্ন মেঘের পালক
ক্লান্ত অভিযাত্রী হাঁটছে কুয়াশা পেরিয়ে

ফাঁকা রাস্তা। দু’পাশের প্রত্যেকটা দরজা বন্ধ
অন্ধগলির মুখে খেলা করছে মরশুমি হাওয়া!

অবাস্তব দৃশ্যে উত্তেজনা হয়। চৌচির হয় শরীর।

হালকা সিগারেটের বাক্স উড়ে গেল ফুটপাথ ঘেঁষে
আমি ওই উড়ে-যাওয়া লঘু ছন্দ চোখ মেলে দেখি!

ব্যস্ত জনতার ভিড়ে চেপ্টে যায় দেহাতি জোনাকি

একটা কাগজ-টুকরো কুড়িয়ে নেবার বরাভয়
এই মাথা নীচু করে তুলে নেওয়া হাতচিঠি,
সুগন্ধী রুমাল!

১০

কারা কলকাতা-দিল্লি-চেন্নাই আপ্তসহায়ক নিয়ে ঘোরে?
কারা এসএএসের জবাব দেয় না?
হোয়াটসঅ্যাপের ব্লু-টিক অফ করে রাখে?
কারা বন্ধু নয়, চামচা পোষে সর্বক্ষণ?
কারা আজীবন যা চায়, তৎক্ষণাৎ হাতে পায়?
কাদের জন্য টেবিল ব্লক করা থাকে দামি
রেস্তোঁরায়?

কারা শেষের সেদিন ঘনিয়ে আসা টের পায় না?
আগামী ইলেকশনে উলটে যায় কাদের পাশার দান?

অর্ণব সাহা

কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গেনব্বই দশকের অন্যতম প্রধান কবি। পেশায় অধ্যাপক। তাঁর কয়েকটি কবিতার বই : ধর্ম নেই কোকাকোলা নেইব্ল্যাকহোলের বাকি অংশ, প্যারানইয়া, ২০ জুনের ডায়েরি, নিচু গিলোটিননীল রঙের হাভেলিস্বপ্নের কশেরুকা ।

Share