আজ বৃহস্পতিবার, ১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৮শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

গোডো আসেনি বলে গডের আসা আটকায়নি

।। গৌতম সরকার ।।

গোডো না আসা সত্ত্বেও মন্দির যেহেতু বানানো হয়নি, তাই শেয়াল বলে বেড়াতে শুরু করল যে, রঞ্জন আর গোডোকে সাইবেরিয়ার এক রিসর্টে ভডকা খেতে দেখা গেছে, সঙ্গে হ্যাম৷ একথা জানার পর থেকে কৃষ্ণের খুবই উত্তেজনা। সে প্রসেনিয়ামের সমস্ত কোণে ইন্টিমেট যৌনতার আহ্বান জানালো। অন্ধকার কতটা থাকবে আর আলোর ভূমিকা ঠিক কী হবে, সে নিয়ে মতামত চাইতে সে ছুটে যাবে মৌনীবাবার কাছে। ফিরে এসে সব্বাইকে সমান অধিকারের বিল অনুযায়ী জানিয়ে দেবে। রিহার্সাল জোরকদমে শুরু…


একটা পিপড়ে সেদিন সেন্ট্রাল এভিনিউ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মজার খেলায় মেতেছিল। প্রত্যেক চৌমাথায় সিগনাল লাল হলেই থেমে থাকা চোখগুলোর সামনে এসে কখনো সাম্বা নাচ করছিল, কখনো নিমেষের মধ্যেই এক টুকরো আফ্রিকা কিংবা হরপ্পা আঁকছিল, কখনো বা আবার এক মগ জল নিয়ে ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে বৃষ্টি বৃষ্টি বলে লাফালাফি। সবচেয়ে অদ্ভুত হলো, এই প্রত্যেক বার সিগ্নাল সবুজ হওয়ার আগে সেই পারফরম্যান্সের জায়গায় একটা করে জাপানি ঘুড়ি রেখে দৌড়ে ফুটপাতে চলে আসছিল। চোখগুলোর ভেতরের উত্তপ্ত যৌনাঙ্গরা তখন থার্ড গিয়ারে পরের লাল সিগনালের দিকে ভোকাট্টা। পিঁপড়ে থেঁতলে যাওয়া ঘুড়িটা দেখে দু’ফোঁটা জল আর তার পর এক ঝলক হাসি দিয়ে গম্ভীরভাবে হাঁটা দিচ্ছিল পরের মোড়ের দিকে।

আরেকটা লোক ওর পেছন পেছন ফলো করে চলেছিল। পিঁপড়ে এগিয়ে গেলেই থেঁতলে যাওয়া ঘুড়ির কাঠির অক্ষত অংশ তুলে নিচ্ছিল। এক সময় বর্শার ফলার মতো উঁকি দিতে লাগল অনেক অনেক কাঠি ওর মুঠো থেকে । একটা শেয়াল জানতে চাইলো, অস্ত্রগুলো কতদামে কেনা যাবে? লোকটা শেয়ালের প্রশ্ন শুনেই সব অস্ত্র ফেলে ভ্যানিশ!

এই আচমকা ঘটনায় এমন যানজট হলো যে কলকাতা শহরে বৃষ্টি ঢুকতে পারল না। সে আটকে গেল বসিরহাটের দিকে। উপায় না দেখে সে তখন পিঁপড়েকে বললো ওখানেই আসতে। কিন্তু পিঁপড়ের ততদিনে শহরের রাস্তার বুকে আমাজন দেখার অভ্যেস হয়ে গেছে। বৃষ্টিকে বললো ভগবানকে ডেকে নিতে। কিন্তু বৃষ্টির ভাষাজ্ঞান ছিল না। তাই সেটা আর হয়ে উঠল না। ধীরে ধীরে বৃষ্টি শুকিয়ে কাঠ হতে লাগল। পিঁপড়ে বলল – তাই ভালো, তুমি যেদিন শুকিয়ে কাঠ হবে আমি সেদিন কাঠপিঁপড়ে হয়ে তোমাকে চুমু খাব।

গোডো আসেনি বলে গডের আসা আটকায়নি। সেটাও কথা না। লাল শাক ভালো ফিল্টারের তলায় রেখে কমলা করা বিজ্ঞানের আশীর্বাদও গণতান্ত্রিক অধিকার। সেটাও ভাবনা নয়। আসলে…বলে গম্ভীর মুখ করে ইঁদুরটা একটা ছকের সামনে দাঁড়িয়ে। বেড়াল উল্টোদিক থেকে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করলো, তাহলে? ইঁদুরটা ভাবতে ভাবতে ছুঁচো হয়ে গিয়ে বললো, কিতকিতের ছকটা দাবার মত হয়ে যাচ্ছে।

বেড়ালটাও দাবার ঘড়গুলো দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘোড়া-হাতি-নৌকো হতে হতে একদিন ভুলে গেল যে, সেও ইঁদুর ছিল। তাই ছকের লাইনগুলো এবার হাঁটা দিল গঙ্গাসাগরের দিকে।

গোডো না আসা সত্ত্বেও মন্দির যেহেতু বানানো হয়নি, তাই শেয়াল বলে বেড়াতে শুরু করল যে, রঞ্জন আর গোডোকে সাইবেরিয়ার এক রিসর্টে ভডকা খেতে দেখা গেছে, সঙ্গে হ্যাম৷ একথা জানার পর থেকে কৃষ্ণের খুবই উত্তেজনা। সে প্রসেনিয়ামের সমস্ত কোণে ইন্টিমেট যৌনতার আহ্বান জানালো। অন্ধকার কতটা থাকবে আর আলোর ভূমিকা ঠিক কী হবে, সে নিয়ে মতামত চাইতে সে ছুটে যাবে মৌনীবাবার কাছে। ফিরে এসে সব্বাইকে সমান অধিকারের বিল অনুযায়ী জানিয়ে দেবে। রিহার্সাল জোরকদমে শুরু…

ততদিনে আবার নন্দিনী এবং মিস জুলিকে পবিত্রতম বেশ্যা বলা হবে কি না এই নিয়ে এক বিতর্ক সভার আয়োজন করে ফেলেছে চেতনাপার্টি। প্রথম পুরস্কার ওই সাইবেরিয়ার রিসর্টে পানভোজে যোগদান। প্রথম বাদে কোনো স্থান বা পুরস্কার এখন অদরকারী এবং তাই,অচল।

সমস্যা হলো প্রধান অতিথি নিয়ে। রাজাকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু রাজাকে আর বাস্তব আকারে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি উল্টোরথের দিন এমসি স্কোয়্যার থেকে ই-তে রুপান্তরিত হয়ে গেছেন। মূল সমস্যা হয়েছে রাজাকে না মারলেও অন্তত দড়ি-ফড়ি ধরে টানার সিনটা আর করা যাচ্ছে না।

অতএব ডাকা হল ভিএফএক্স বাবা বিশ্বকর্মাকে। উনি গুগলের চাকরি নিয়ে তৈরি করে ফেললেন একটা লেন্স। আধার কার্ড দেখালেই প্রথম জোড়া ফ্রি। থার্ড বেল পড়ল। সব্বাই দেখতে শুরু করল অসম্ভব তৃপ্তিদায়ক সব ভেল্কিবাজি। গোডো থেকে কৃষ্ণের সম্বন্ধে যা যা খবর শোনা বা ভাবা যেত, সব দেখতে পেল সব্বাই। আলো-অন্ধকার-মিউজিক-ডিজাইন স-অ-ব কিছু নিরবিচ্ছিন্ন তৃপ্তি দিতে লাগল। যুদ্ধ-বিপ্লব-প্রেম-দুঃখ- নীতি-শান্তি কোনো কিছুর অভাব রইল না। গোডো এল কি এল না এ নিয়ে আর ভাবনা রইল না। গড খেয়াল রাখল যাতে গণতান্ত্রিক দাবি অনুযায়ী কার্টেন আর না পড়ে। আর কপালে লাল তিলক কেটে মশা-মাছি-হায়না-পিরানহারা ফিসিফিস করে বলে যেতে শুরু করল –

শান্তা…শো চালু আছে

এক সময় নাকি বিশ্বাস ও বিভ্রান্তি দুই-ই কবিতার মুখোশ পরে ভালবাসার নাটক করত। নাটক ততদিনে সত্য ও মিথ্যা সব ল্যাবরেটরিতেই চাকরিরত, কোমরে সাইলেন্সার বন্দুক গুঁজে। রকমারি ফুল গুঁজে প্রতিদিন একেকটা কান একটা একটা করে শব্দ হারিয়ে ফেলছিল পছন্দের প্লে-লিস্ট শোনার শাসনে। মাঝে মাঝে দু-একটা লিলি ফুল ফুটলে ইঁদুরেরা খবর পেত— প্রেমের পদ্য নাকি ‘হিট’ হয় পিচ্ছিল প্লাস্টিক কোটে। সেসব শান্ত দিনে শকুনেরা শাপলা ফুল হয়ে জানলা দিয়ে ঢুকে যেত অভুক্ত ক্ষেতে। ঝলসানো ভলক্যানোর ছবি থেকে যায় যে স্থানিক-সময়ের স্নায়বিক রেখায় রেখায়, তারই গহ্বরে সতত প্রাণের নতুন সংজ্ঞা খুঁজে পায় কোনো এক অন্ধকারবাসী অকিঞ্চিৎকর মুক্ত ইলেকট্রন। বিধ্বংসী দাবানলের পাশের এলাকায় জোনাকিরা অন্ধকার চিনে চিনে আলো জ্বালায় ও নিভে গিয়ে নতুন করে আলো চেনার অভ্যাস করে। দাবানলের জ্বলন্ত হনু-কানুরা এমন নাট্যাভ্যাসকে অভ্যাসবশত ‘নাটকবাজি’ আখ্যা দেয়।

গৌতম সরকার

মূলত থিয়েটার করেন। নাট্য পরিচালক, অভিনেতা। লেখালেখি নাট্যচর্চার পাশাপাশি। কলকাতায় বসবাস।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top