![](http://protipokkho.com/wp-content/uploads/2020/10/3_22.jpg)
পহেলা কার্তিকে প্রতিবছরের মতো কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে ফকির লালন সাঁইয়ের তিরোধান দিবস পালিত হয়ে গেল। তার তিরোধান ঘটেছে ১২২ বছর আগে, সে কারনে এবার ১২২ তম তিরোধান দিবস। প্রতিবারের মতো হাজার হাজার ভক্ত জড়ো হয়েছিলেন তার প্রতি ভক্তি জানাতে। নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতেও সকাল থেকে গোষ্ঠ গান শুরু হয়ে সন্ধ্যায় দৈন্য গান এবং তারপর রাত পর্যন্ত ফকির লালন সাঁইয়ের গান গেয়েছেন এবং তাঁর ভাব ও নিত্যদিনের কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করেছেন লালন ভক্তরা। প্রতিবছরেই লালনের কোন একটি গানের কথা ধরে আলোচনার সূত্রপাত করা হয়। সূত্র ধরে নানান বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে প্রবেশ চলে। এখানে সাধারণ মানুষ আসেন নিজের খরচে, কষ্ট করে থাকেন সামান্য কিছু খেয়ে।নবপ্রাণ আখড়াবাড়ীতে যে গানের অনুষ্ঠান হয় তা তাঁরা মন দিয়ে শোনেন।
ফকির লালন সাঁইয়ের তিরোধান ১লা কার্তিক। সাধু সঙ্গের নিয়মানুযায়ী শুরু হয় ১লা কার্তিক সন্ধ্যায় অধিবাস দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়, তার পরের দিন বাল্যসেবা ও পূর্ণসেবা দিয়ে সাধুসঙ্গের কাজ শেষ হয় আর সারাক্ষণ লালনের গান চলতে থাকে। তিনদিন ধরে অনুষ্ঠান । তবে লালন একাডেমি পাঁচদিনের অনুষ্ঠান প্রবর্তন করেছে। তাছাড়া সাধকদের আপত্তি সত্ত্বেও লালন একাডেমি তিরোধান দিবসকে ‘উৎসব’ হিশাবে পালন করে। এই দিন লালন তিরোধান করেছিলেন, অতএব সাধকদের জন্য তা শোকের সময়। লালন একাডেমির কাছে এটা ‘স্মরণোৎসব’।
এবার নবপ্রাণ আখড়াবাড়ির অনুষ্ঠান মওলা বক্সের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়েছে। দেলবার শাহের ঘরের ফকির মওলা ছেঁঊড়িয়ায় অত্যন্ত পরিচিত মানুষ। তার তিরোধান ঘটেছে এই বছর (২০১২) ১৬ অগাস্টে, অর্থাৎ বাংলা ২ ভাদ্র ১৪১৯ তারিখে।
এবারে নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি্র বিষয় ছিল, ‘আপনারে আপনি চিনিনে’। এই কালাম বা গানটির বিশেষ তাৎপর্য আছে। লালন নানান গানে যে সকল বিষয় বিচার করেছেন এখানে সেই সকল চেনা বিষয় নয়, বরং সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয় উপস্থাপন করেছেন। এই বিষয়ে তিনি অন্য কোন গানে ফিরে এসেছেন দেখা যায় না। এই গানে তিনি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছেনঃ নিজেকে নিজে কিভাবে চিনব? এই দিনদুনিয়ায় ‘আমি’ বা আমার মধ্য দিয়েই তো অধর নিজেকে ধরা দিচ্ছেন। অর্থাৎ আমি জগতকে যেভাবে দেখি, জগত সেভাবেই আমার কাছে ধরা পড়ে। জগত আমার ভেতরে বা বাইরে, ইহকালে বা পরকালে, অতীতে বা ভবিষ্যতে যে রূপেই হাজির থাকুক, যে আমি ‘বর্তমান’ তার মধ্য দিয়েই তো জগত বর্তমান হয়ে ওঠে। জগতকে আমরা জানি বুঝি বা ধরতে পারি। জগত নামক যে ব্যাপার সতত ঘটমান, আমার মধ্য দিয়েই তো সেটা ঘটে। তাহলে যে ‘আমি’র বর্তম্না হওয়ার মধ্য দিয়ে জগত বর্তমান হয়, সেই ‘আমি’কে জানা জরুরী। নিজেকে না জানলে জগতকে জানা হয় না।
________________________________________
আপনারে আপনি চিনি নে।
দিন দোনের পর যার নাম অধর
তারে চিনবো কেমনে।।
আপনারে চিনতাম যদি
মিলতো অটল চরণ-নিধি
মানুষের করণ হত সিদ্ধি
শুনি আগম পুরাণে।।
কর্তারূপের নাই অম্বেষণ
আত্মারে কি হয় নিরূপণ
আপ্ততত্ত্বে পায় শতধন
সহজ সাধক জনে।।
দিব্যজ্ঞানী যে জন হল
নিজতত্ত্বে নিরঞ্জন পেল
সিরাজ সাঁই কয় লালন র’ল
জন্ম-অন্ধ নিজ গুনে।।
সাধকেরা সবসময় আত্মতত্ত্বের কথা বলে থাকেন। বলেন, নিজেকে জানো, তাহলে সকলই জানা হবে। আত্মতত্ত্বের মধ্য দিয়েই তাঁরা অতীতের শতধন পেয়েছেন। কিন্তু এই আত্মতত্ত্বকেই লালন প্রশ্ন করছেন। ঠিক আছে, নিজেকে জানা দরকার, কিন্তু ‘আত্মা’-কে নিরূপন করবার পথ কি শুধু নিজেকে ‘জানা’? ‘আমি’ নামক যে সত্তাকে আমরা উপলব্ধি করি তার কাজ কি শুধু জানা, নাকি করাও বটে? তাহলে আমাকে ‘আত্মারূপ’ হিশাবে জানা যথেষ্ট নয়, আমি কি করি, কাজের মধ্য দিয়ে আমি নিজেকে যে রূপে প্রকাশ করি তাকেও জানা দরকার। অর্থাৎ আমার ‘কর্তারূপ’-কেও জানতে হবে। তাই বলছেন, ‘কর্তারূপের নাই অন্বেষণ/ আত্মারে কি হয় নিরূপন?’ – যদি কর্তারূপের অন্বেষণই না হোল তাহলে আত্মারূপের নিরূপন কিভাবে হবে? বা, কর্তারূপ অন্বেষণ না করে আমাকে জানা হোল, বা আমাকে আমি জানলাম সেটাই বা কিভাবে বলব? মানুষ যে শুধু ‘আমি’ নয় বা ‘আত্মা’ মাত্র নয়, একই সঙ্গে সে জগতে, সমাজে, ইতিহাসে কর্তা – সেই সকর্মক কর্তাকে না চিনলে আত্মাকে জানা হয় না
ভেঙে বা ব্যাখ্যা করে বলছি এই কারনে যে এই কথা বাংলার সাধনার জগতে ফকির লালন সাঁইয়ের আগে এভাবে কখনই বলা হয় নি। জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাবে ‘আমি’ বা আমাকে জানা সাধকের জন্য যথেষ্ট নয়, মানুষ কিভাবে নিজে কর্তা হয়ে জগত, সমাজ ও ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছে সেই মানুষকেও অন্বেষণ করতে হবে। বিচার করতে হবে এই ‘কর্তা’ যে সময়টুকু নিজেকে বর্তমান রেখেছে সেই সময়টুকু সে কি করেছে? সেই কর্তারূপের বিচারও তাহলে করতে হবে।
মানুষের ‘করণ’ সিদ্ধি তাহলে শুধু ডুগডুগি বাজিয়ে উদাসী গান গেয়ে গেলে হবে না। সমাজ ও ইতিহাস বিচ্ছিন্ন আধ্যাত্মবাদী ধারা থেকে ফকির লালন সাঁইয়ের ধারার পার্থক্য এই ধরণের গানের মধ্য দিয়ে সহজেই বোঝা যায়। বাংলার ভাবচর্চার ইতিহাসে এই গানটির গুরুত্ব অতএব অসাধারণ। বাংলার ভাবচর্চার ধারার মধ্যে সম্পূর্ণ নতুন কথা বলা হয়েছে এই গানে। এই নতুন কথাটা ধরতে ও বুঝতে হলে বাংলার ভাবচরররচার ধারা ঘনিষ্ঠ ভাবে অনুসরন করা জরুরি। পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের এই কাজটি না করলে এই গানের তাৎপর্য অনুধাবন করা অবশ্য কঠিন হয়ে পড়ে।
এই বছর নবপ্রাণ গানটির তাৎপর্য আরও স্পষ্ট করে তোলার জন্য তাদের অনুষ্ঠানের শিরোনাম করেছে ‘আপনারে আপনি চিনি নে’।
রামু, উখিয়া, পটিয়া, টেকনাফে বৌদ্ধ উপাসনালয় ও বৌদ্ধ জনপদ জ্বালিয়ে দেবার ঘটনার যে বেদনা তাকে ধারণ করে নিজেকে সকল সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের উর্ধে তুলবার লড়াই বাংলার সাধকদের ধারা। অপরকে নয়, নিজেকে শোধন না করে এর মোকাবিলা অসম্ভব। এই আলোয় নিজেকে আলোকিত করে তুলবার জন্য মোমের আলোয় সকলের সমবেত নীরবতা।
এবারে যখন লালন ভক্তরা ছেঁউড়িয়াতে গেছেন ঠিক তার কয়েকদিন আগেই দেশের অপর প্রান্তে ঘটে গেছে এক মর্মান্তিক ঘটনা। রামু, উখিয়া, পটিয়া ও টেকনাফে বৌদ্ধ মন্দির ও জনপদ জ্বালিয়ে দেবার মতো ঘটনা ঘটেছে। কয়েকটি মন্দিরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ নিয়ে দোষারোপ চলছে, কিন্তু নিজেদের আত্ম-সমালোচনা করবার কোন প্রয়াস দেখা যাছে না। কিন্তু লালন ফকিরকে সঠিকভাবে স্মরণ করতে হলে, নিজের জাত-ধর্ম পরিচয় না জানানোর পেছনে যে দর্শন ও রাজনীতি ছিল সে সব কথাও বুঝতে হবে। সেই দিক থেকে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রামু, উখিয়া ও পটিয়াতে বৌদ্ধ মন্দিরে আগুন লাগিয়ে মন্দিরে বৌদ্ধ মুর্তির ক্ষতি সাধন করে বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে গভীর ভাবে আহত করার বেদনা নবপ্রাণ আখড়াবাড়ির অনুষ্ঠানেও জারি ছিল। বৌদ্ধ সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। সাধক সম্প্রদায় বা সম্প্রদায়গত পরিচয় পরিহার করে চলেন, তদের কাছে জাতপাত, সম্প্রদায় ভেদ, নারীপুরুষে পার্থক্য নাই। এই ঘটনায় শুধু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের ক্ষতি হয় নি। সারাদেশের মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত। কারন এর মধ্য দিয়ে যে সাম্প্রদায়িক বিষের প্রকাশ ঘটেছে তার জের সহজে যাবে না, যদি নিঃশর্তে আমরা সকলে নিজেদের ভেতরে নিজেরা না তাকাই।
আখড়াবাড়িতে এই ঘটনার জন্য তাই বাইরের কাউকে দোষারোপ না করে, নিজের দিকে তাকাবার কথা উঠেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ অবশ্যই দরকার, কিন্তু সবার আগে নিজেদের উপলব্ধি পরিচ্ছন্ন করা এবং সম্প্রদায়গত পরিচয় অতিক্রম করে মানুষের সঙ্গে মানুষের দিব্য সম্পর্ক নির্মাণের তাগিদ আরো তীব্র করবার কথা উঠেছে। বাংলার ভাবান্দোলনে মানুষ ভজনার রাজনৈতিক তাৎপর্য অনুধাবনের প্রয়োজনীয়তা আরও তীব্র ভাবে অনুভূত হয়েছে।
তাই ১৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় সাধুদের সন্ধ্যাবাতি, চালপানি ও গুরু ভক্তির পর সবাই নবপ্রাণ আন্দোলনের ডাকে এক্ত্র হন মঞ্চে। সামনে ততক্ষণে শত শত মানুষ এসেছে গেছেন, তাঁরা জানতেন এমন অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে তাই যোগদান করতে এসেছেন। মঞ্চে একদিকে সাদা পোশাকে সাধু-গুরুরা আসন নিয়ে বসেছেন, অন্যপাশে নবপ্রাণ সঙ্গীতঘরের শিক্ষার্থীরা, এবং মাঝখানে সকল যন্ত্রী। মঞ্চের সামনে সর্বস্তরের মানুষ। তাঁদের হাতে একটি করে মোমবাতি দেয়া হোল, সবাই নীরবে দাঁড়ালেন,এই সময় মাইকে সংক্ষেপে উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হোল, রামু, উখিয়া, পটিয়া ও টেকনাফের বৌদ্ধ মন্দিরে ও বৌদ্ধ জনপদে যা ঘটেছে তাতে আমরা সবাই মর্মাহত।আঘাত পেয়েছেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষেরা। মানুষ হিশাবে আমরা সবাই একই আঘাত পেয়েছি। তাই শুধু প্রতিবাদ নয়, মোমের প্রদীপ হাতে আমরা সেই অন্ধকার কাটিয়ে উঠতে চাই, আর যেন কোথাও এমন ঘটনা না ঘটে, তার জন্যে আহবান জানাই।সবাই নীরবে দাঁড়িয়ে, হাতের প্রদীপ জ্বালিয়ে দিলেন একে অপরকে। এই সময় মঞ্চ থেকে রওশন ফকির হাতে একতারা নিয়ে নিতালে গেয়ে উঠলেন, ‘আমার কই হোল সেই মনের মতো মন’।
আমার হয়না রে সে মনের মত মন
কি-সে জানব রে সেই রাগের করণ।।
পড়ে রিপুর ইন্দ্র ভোলে
মন বেড়ায়রে ডালে ডালে,
দুই মনে এক মন হইলে এড়ায় শমন।।
রসিক ভক্ত যারা
মনে মন মিশাল তারা
শাসন করে তিনটি ধারা, পেল রতন।।
কিসে হবে নাগিনী বশ
সাধব কিসে অমৃত রস
সিরাজ সাঁই কয় বিষেতে নাশ হলি লালন।।
গান যেন রওশন ফকির গাইছেন না, শব্দ নিঃসৃত হচ্ছিল প্রত্যেকে্র হাতের প্রদীপ থেকে, প্রত্যেকের মনের কথা হিশেবে। এই অন্ধকার কাটিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের সেই মন তৈরি করতে হবে।নিজের মধ্যে যে সাপ বাস করে তাকে বশ করবার সাধনা করতে হবে।
গান এক সময় শেষ হোল। প্রদীপ জ্বলছে।রামুর আগুনে যে অন্ধকার মনের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে এই প্রদীপের আলোয় তা ধুয়ে মুছে ফেলার আকুতি ও প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হোল । ফরহাদ মজহার অপরকে দোষারোপ না করে নিজেকে নিজে সমালোচনার মধ্য দিয়ে রামু, উখিয়া, পটিয়া ও টেকনাফসহ আজ অবধি বাংলাদেশে সম্প্রদায়গত বিভেদ ও হিংসার যতো ঘটনার যারা শিকার তাদের প্রতি একাত্ম হবার আহ্বান জানিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করলেন। নিজেদের ভেতরে যে বেদনা তা সকলে মিলে প্রকাশ করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানালেন।
সবাই প্রদীপ নিয়ে বসে গেলেন গান শুনতে। একে একে লালনের গান হোল, জাত গেল জাত গেল বলে, সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার…………। সব গানে মানুষের কথা, জাত, ধর্ম ভেদ-বিচার দূর করার লড়াই…।
এর মধ্য দিয়েই এবারের সাঁইজির ১২২ তম তিরোধান দিবস ছেঁঊড়িয়া আখড়াবাড়িতে শেষ হোল।