আজ বৃহস্পতিবার, ১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৮শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ইসলামের কোরবানি, ‘মনের পশু’ তত্ত্ব ও খ্রিস্টধর্ম (দ্বিতীয় পর্ব) 

।। ফরহাদ মজহার ।।

পাশ্চাত্যের দার্শনিকেরা দীর্ঘকাল বাইবেলের গল্প এবং খ্রিস্ট ধর্মের এই সংকটের নৈতিক জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে আসছেন। তার মধ্যে সম্ভবত সোরেন কিয়ার্কেগার্ড সামনের সারিতে আছেন। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছেন জাক দেরিদা, ইম্মেনুয়েল লেভিনা, স্লাভো জিজেকসহ আরো অনেকে। উদাহরণ আছে বিস্তর। আগ্রহীরা প্রাথমিক ভাবে সোরেন কিয়ার্কেগার্ড (১৮১৩-১৮৫৫)-এর ‘ভয় ও থর থর কাঁপুনি’ (Fear & Trembling) এবং জাক দেরিদা (১৯৩০-২০০৪) প্রণীত ‘মৃত্যুর দান’ (Gift of Death) গ্রন্থে ইসহাককে ইব্রাহিম (আঃ) কোরবানি দিতে নেবার কাহিনীর সূত্রে কিভাবে নতুন দার্শনিক পর্যালোচনার ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছেন সেই হদিস নিতে পারে।।মনে রাখা দরকার ইহুদি ও খ্রিস্টিয় ধর্মকাহিনী ও ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে আধুনিক দর্শনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। এই ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা থাকা দরকার। কিছুই আকাশ ফুঁড়ে ভূমিতে পতিত হয় নি। তাই আধুনিক পাশ্চাত্য দার্শনিকরা দার্শনিক পর্যালোচনায় খ্রিস্টীয় ধর্ম কাহিনী কিম্বা খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্ব ব্যবহার করতে কুন্ঠিত হন না। এমনকি স্লাভো জিজেক (১৯৪৯ – ) রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিষয়ক তর্কে কার্ল স্মিথ (১৮৮-১৯৯৫)-এর চিন্তা মোকাবিলার জন্য ইব্রাহিমের(আঃ) কোরবানির কাহিনী ব্যবহার করেছেন।কোরান এবং কোরানের তাফসির সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় ও ভিন্ন তর্ক…
প্রশ্ন হচ্ছে কোরানে কী আছে? কোরান আর কোরানের তাফসির এক কথা নয় এই ফারাক মনে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তাই শুধু সেই সত্যটাই তুলে ধরতে চাই যে সুরা আস-সাফফাতে ইসমাইল কিংবা ইসহাক কারও নামই উল্লেখ করা হয় নি। আমাদের উচিত সুনির্দিষ্ট ভাবে কোরানে কী আছে তার প্রতি নজর দেওয়া। কোরানুল করিম আন্তরিক ভাবে পাঠ করবার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজের বড় একটি অংশের মধ্যে প্রবল আলস্য ও অনীহা আছে। তারা কোরান ও কোরানের তাফসীরকে একাকার করে ফেলে।

কারও কারও অভিজ্ঞতা ভিন্ন হতে পারে, তবে আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই মনে করেন আল্লাহ হজরত ইব্রাহিম (আঃ)-কে তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রমাণ করবার জন্য নিজের সন্তান কোরবানি করবার ‘নির্দেশ’ দিয়েছেন। কিন্তু এটা আসলে বাইবেলের আদি পুস্তক বা তৌরাত শরিফের গল্প। কিন্তু এই গল্পকেই তাঁরা কোরানুল করিমের বয়ান মনে করেন। এটা ঠিক না। কোরানুল করিমে আল্লার ‘আদেশ’ পালন করবার জন্য সন্তানকে হত্যা ও কাঠের চিতায় বলীদানের গল্প নাই। ইসলামে আল্লাহ দয়ার দয়া, দয়াল। তিনি ‘রাহমানুর রাহিম’। তিনি আনুগত্য প্রমানের জন্য পিতাকে নিজের প্রিয় সন্তান বলি দানের কথা বলতে পারেন কি? আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনে বাইবেলের গল্পের সূত্রে এই তর্ক জারি রয়েছে।

বাইবেলে আছে, “আল্লাহ ইব্রাহিমকে এক পরীক্ষায় ফেললেন। আল্লাহ তাঁকে ডাকলেন, “ইব্রাহিম’। ইব্রাহিম জবাব দিলেন, “এই যে আমি।”

আল্লাহ বললেন, “তোমার ছেলেকে, অদ্বিতীয় ছেলে ইসহাককে, যাকে তুমি এতো ভালবাস তাকে নিয়ে তুমি মোরিয়া এলাকায় যাও। সেখানে যে পাহাড়টার কথা আমি তোমাকে বলব তার উপরে তুমি তাকে পোড়ানো-কোরবানি হিশাবে কোরবানি দাও।” (দেখুন, তৌরাত শরীফ: পয়দায়েশ ২২)

নিজের সন্তানকে হত্যা করে বেদিতে পোড়ানোর জন্য ইব্রাহিম ইসহাককে হাতপা বেঁধে কাঠ দিয়ে সাজানো বেদিতে তুলেছিলেন। সন্তানকে ছুরি দিয়ে হত্যা করতে উদ্যত হবার সময়, ‘মাবুদের ফেরেশতা’ তাঁকে সেই কাজ থেকে নিবৃত্ত করেছে। – এই হোল বাইবেলের গল্প। পরের কোন এক কিস্তিতে বাইবেলের কোরবানি গল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করব। আপাতত মোটা দাগের পার্থক্যগুলো চিনে নেওয়া যাক।

মক্কায় অবতীর্ণ ‘সূরা আস-সাফফাত’-এ আপন সন্তানকে হত্যা ও কাঠের চিতায় বলীদানের ‘আদেশ’ বা ‘নির্দেশ’ নাই। সবার আগে কি নাই সেই দিকটি বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোরানুল করিমে ইসমাইল নাকি ইসহাক কাকে কোরবানি দেওয়া হচ্ছে সে সম্পর্কেও কোন স্পষ্ট উল্লেখ নাই। তফসিরকারীরা ধরে নেন ইসমাইলের কথাই বলা হচ্ছে। কিন্তু বাইবেলে সুস্পষ্ট ভাবে ইসহাকের নাম উল্লেখ থাকলেও কোরানুল করিমে ইসমাইলের নাম উল্লেখ করা হয় নি। তবে উল্লেখ থাকা দরকার সমস্ত তাফসিরবিদ এবং আলেমগণ ইসমাইলকেই ‘কোরবানি’ হিসাবে গণ্য করেছেন। বলা যায় এই ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ একমত। এটা পরিষ্কার বলা দরকার যে ইসমাইলকেই কোরবানি দেওয়া হয়েছিল, মুসলিম তাফসিরকারকদের এই ব্যাখ্যার সঙ্গে আমাদের কোনই দ্বিমত নাই।

কোরান এবং কোরানের তাফসির সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় ও ভিন্ন তর্ক। প্রশ্ন হচ্ছে কোরানে কী আছে? কোরান আর কোরানের তাফসির এক কথা নয় এই ফারাক মনে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তাই শুধু সেই সত্যটাই তুলে ধরতে চাই যে সুরা আস-সাফফাতে ইসমাইল কিংবা ইসহাক কারও নামই উল্লেখ করা হয় নি। আমাদের উচিত সুনির্দিষ্ট ভাবে কোরানে কী আছে তার প্রতি নজর দেওয়া। কোরানুল করিম আন্তরিক ভাবে পাঠ করবার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজের বড় একটি অংশের মধ্যে প্রবল আলস্য ও অনীহা আছে। তারা কোরান ও কোরানের তাফসীরকে একাকার করে ফেলে।

সুরা আস-সাফফাতে সন্তান সম্পর্কে বলা হচ্ছে:

অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে জবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বললঃ পিত! আপনি যে আদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাই করুন। ইনশাল্লাহ, আপনি আমাকে সবুরকারী পাবেন।

(সুরা আস-সাফফাত।। ৩৭: ১০২)

বাইবেলে আল্লার ‘আদেশ’ আর কোরানে ইব্রাহিমের ‘স্বপ্ন’ দেখা মোটেও এক কথা নয়। ‘আদেশ’ মানে ‘স্বপ্ন’ না। কিম্বা ‘স্বপ্ন’ মানে ‘আদেশ’ না। কোরানে কোত্থাও নাই যে এই স্বপ্ন হজরত ইব্রাহিমকে আল্লাই স্বয়ং দেখিয়েছেন। আল্লা স্বয়ং কোরানে বলছেন, এটা হজরত ইব্রাহিম (আ)-এর নিজেরই ‘স্বপ্ন’ এবং কোরানে ইব্রাহিমের মুখ দিয়ে সেই স্বপ্নটাই সন্তানের কাছে বল হয়েছে। যেমন, “”ইব্রাহিম তাকে বলল: বৎস আমি স্বপ্নে দেখি যে তোমাকে জবেহ করছি”। শুধু তাই নয়, ইব্রাহিম সন্তানকে স্বপ্নের কথা বলে স্বপ্ন সম্পর্কে সন্তানের পরামর্শ যাঞ্চা করেছেন। তাহলে কোরান অনুসারে কোরবানির ‘আদেশ’ যেমন আল্লার নয়, তেমনি সন্তান কোরবানির সিদ্ধান্তও হজরত ইব্রাহিমের একার নয়। পিতা ও পুত্র উভয়েরই সিদ্ধান্ত। সন্তান স্বপ্নের ব্যাখ্যা কিভাবে করেছেন বা বুঝেছেন কোরান তাই উল্লেখ করেছে।

প্রচলিত তাফসীর হচ্ছে কোরান যাকে ইব্রাহিমের ‘স্বপ্ন’ বলছে তাকে বাইবেলের মতো আমাদের আল্লার ‘আদেশ’ হিশাবেই গণ্য করতে হবে। দেখা যাচ্ছে বাইবেলের গল্প সাধারণ মানুষের মনে এমন ভাবে গেঁথে গিয়েছে যে তারা আল্লার ‘আদেশ’ আর হজরত ইব্রাহিম(আ)-এর ‘স্বপ্ন’ — এই দুইয়ের বিশাল পার্থক্য ধরতে পারে না। কোরবানি সম্পর্কে তাদের ধ্যানধারণা মূলত বাইবেলের আদি পুস্তক অর্থাৎ তৌরাতের বয়ানের সঙ্গেই মেলে, কোরানুল করিমের সঙ্গে নয়। কোরানুল করিম কোত্থাও কোরবানিকে বাইবেলের মতো আল্লার ‘আদেশ’ হিশাবে উল্লেখ করে নি। ঘূণাক্ষরেও না। তবুও অনেকে কোরান মানতে চায় না; তাদের দাবি হজরত ইব্রাহিম(আ)-এর ‘স্বপ্ন’কে ‘আদেশ’ হিশাবেই আমাদের গণ্য করতে হবে।

কোরান বাদ দিয়ে তাফসিরকারকদের ব্যাখ্যাকে আমরা চূড়ান্ত গণ্য করব কিনা সেটা যার যার নিজস্ব ব্যাপার। সেটা নিয়ে এখানে আমরা তর্ক করতে বসি নি। সম্মানিত তাফসিরকারকরা অনেকেই বলেছেন নবী-রসুলদের স্বপ্ন ‘ওহি’ হয়ে থাকে, কিম্বা তাঁদের স্বপ্নকে ‘ওহি’ হিশাবেই আমাদের মেনে নিতে হবে। কিন্তু যেখানে কোরানুল করিমে আল্লা স্বয়ং নিজ সন্তানকে জবাই করার ব্যাপারকে তাঁর ‘নির্দেশ’ বলেন নি, ইব্রাহিম (আ)-এর ‘স্বপ্ন’ বলছেন, সেখানে ‘ওহি’ বনাম ‘স্বপ্ন’ নিয়ে তর্কের সুযোগ নাই। কোরান আল্লার ‘ওহি’, সেটা যেভাবে নাজিল হয়েছে সেভাবেই পড়তে হবে। কোরানই মোমিনের জন্য একমাত্র মান্য ও এবং প্রামান্য। তাফসীর নয়। আল্লার তরফ থেকে কোরান নাজিল হয়েছে, তাফসীর না। বলা বাহুল্য ‘ওহি’, ‘স্বপ্ন’ ইত্যাদির মিল বা অমিল নিয়ে দীর্ঘ তর্কবিতর্কের ঐতিহ্য আছে। সে বিষয়ে আগামি কোন একটি কিস্তিতে আমরা আলাদা আলোচনা করব। আমাদের কাজ হচ্ছে ‘আদেশ’ ও ‘স্বপ্ন’ — এই দুইয়ের ফারাক স্পষ্ট করা যাতে বাইবেল ও কোরানের ফারাক আমরা স্পষ্ট করতে পারি এবং বাইবেলে বিধৃত হজরত ইব্রাহিমে (আ)-এর কোরবানির গল্প কেন্দ্র করে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনে যে সকল তর্ক বিতর্ক চলছে সেখানে হিম্মতের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে পারি।

চাইলে সহজেই আমরা বুঝতে পারি। যদিও কিভাবে কোরানুল করিম এই গল্প বলেছে সেটা ঘনিষ্ঠ ভাবে পাঠ, কোরানে বলার ভঙ্গী এবং আরবি ভাষার অলংকারসহ মর্মোদ্ধারের কাজ অনেক গভীর ও বড়সড় কাজ। সেই চেষ্টা বাংলাদেশে নাই বললেই চলে। বলা বাহুল্য বড় বড় মহৎ তাফসীরকারকদের তাফসির আছে। ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু আক্ষরিক ভাবে কোরান পাঠের বিস্তর মুশকিলও রয়েছে। বিষয়টি আরও জটিল হয়েছে বাইবেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গয়ে কোরানের বয়ানকে বাইবেলের সঙ্গে মেলাবার চেষ্টায়। মোটা দাগে একই কাহিনী মনে হলেও বাইবেলের গল্প আর কোরানের গল্প এক না, সেটা খুবই স্পষ্ট। অথচ আজ অবধি কোরবানি সম্পর্কে যে গল্প বাংলাদেশে প্রধান বয়ান হয়ে রয়েছে সেটা মূলত বাইবেলেরই গল্পের মধ্যেই আবর্তিত হয়।

কিন্তু আধুনিক বিশ্ব – বিশেষত বর্তমান আধুনিক পাশ্চাত্যের অনুমান ও জিজ্ঞাসা মোকাবিলার জায়গা থেকে প্রচলিত তাফসিরগুলোকেও নতুন ভাবে পাঠ করা জরুরী। বলা বাহুল্য সেই কাজও হয় নি। এর ফলে বাইবেলের গল্পই ইসলামের গল্প হিশাবে চালু আছে। তাই বলা যায়, আমরা চিন্তাচেতনার দিক থেকে আসলে ‘খ্রিস্টান’ থেকে গিয়েছি। ‘মুসলমান’ হই নি। ইসলাম আদৌ নতুন কিছু বলতে চেয়েছে বা চায় কিনা সেটা আমরা আর ধরতে পারি না। চিন্তা চেতনার দিক থেকে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। ধর্মতাত্ত্বিক পর্যায় অতিক্রম করে প্রজ্ঞা বা রুহানিয়াতের স্তরে ওঠা আমাদের জন্য খুবই জরুরী ছিল। কিন্তু এখন তা বহু দূরের পথ হয়ে গিয়েছে।

ইসলাম প্রতিটি ধর্মের ঐতিহাসিকতা স্বীকার করে। হজরত ঈসা (আ), হজরত মুসা (আ), হজরত দাউদ (আ), হজরত নূহ (আ)সহ সকল নবী রসুলকেই ইসলাম মানে। সকল জনগোষ্ঠির মধ্যেই আল্লার তরফে পথ প্রদর্শকরা এসেছিলেন। কোরান অল্প কয়েক জনের মাত্র উল্লেখ করেছে। কিন্তু বোঝার দিক হচ্ছে কোরানুল করিম শুধু মুসলমানদের জন্য আসে নি। সমগ্র মানব জাতির জন্য নাজিল হয়েছে। আমাদের আলোচনাও খ্রিস্ট ধর্মকে হেয় কিম্বা ইসলামকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করা নয়। কিন্তু আমরা যদি নিজেদের ‘মুসলমান’ দাবি করি তাহলে কোরানে একই গল্প কিভাবে বলা হয়েছে নিদেন পক্ষে সেটা জানতে হবে।

আমরা খ্রিস্টিয় চিন্তা ধারণ করতেই পারি, কিম্বা খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসী হতে পারি। কিন্তু নিজেদের যদি ‘মুসলমান’ দাবি করি তাহলে নিজের ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা কোন কাজের কথা না। ধর্মতাত্ত্বিক কিম্বা দার্শনিক জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে মানুষের যে রুহানি আকুতি যুগে যুগে ব্যক্ত হয় তাকে মানুষের ইতিহাস হিশাবে বোঝা এবং তার মীমাংসার জন্য মানুষের নিরন্তর চেষ্টা সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং অবহিত থাকাই আমাদের এই লেখার উদ্দেশ্য।

নিজের সন্তানকে ধর্মের জন্য হত্যা নীতিনৈতিকতার দিক থেকে ভয়ংকর গর্হিত ও অন্যায় কাজ। অনেকে দাবি করে থাকেন ধর্মকে বিমূর্ত ভাবে মানুষের সহজ ও স্বতঃস্ফুর্ত প্রেম, ভালবাসা, নীতিনৈতিকতার উর্ধে স্থাপন করা ধর্মীয় সহিংসতা ও সন্ত্রাসের প্রধান কারণ। এ নিয়ে তর্ক হতে পারে। এই প্রশ্নের ধর্মীয়, দার্শনিক ও রাজনৈতিক মীমাংসা অবশ্যই জরুরী, এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। যুদ্ধ ও হানাহানি সমাধান নয়। পাশ্চাত্যের দার্শনিকেরা দীর্ঘকাল বাইবেলের গল্প এবং খ্রিস্ট ধর্মের এই সংকটের নৈতিক জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে আসছেন। তার মধ্যে সম্ভবত সোরেন কিয়ার্কেগার্ড সামনের সারিতে আছেন। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছেন জাক দেরিদা, ইম্মেনুয়েল লেভিনা, স্লাভো জিজেকসহ আরো অনেকে। উদাহরণ আছে বিস্তর। আগ্রহীরা প্রাথমিক ভাবে সোরেন কিয়ার্কেগার্ড (১৮১৩-১৮৫৫)-এর ‘ভয় ও থর থর কাঁপুনি’ (Fear & Trembling) এবং জাক দেরিদা (১৯৩০-২০০৪) প্রণীত ‘মৃত্যুর দান’ (Gift of Death) গ্রন্থে ইসহাককে ইব্রাহিম (আঃ) কোরবানি দিতে নেবার কাহিনীর সূত্রে কিভাবে নতুন দার্শনিক পর্যালোচনার ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছেন সেই হদিস নিতে পারেন।

মনে রাখা দরকার ইহুদি ও খ্রিস্টিয় ধর্মকাহিনী ও ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে আধুনিক দর্শনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। এই ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা থাকা দরকার। কিছুই আকাশ ফুঁড়ে ভূমিতে পতিত হয় নি। তাই আধুনিক পাশ্চাত্য দার্শনিকরা দার্শনিক পর্যালোচনায় খ্রিস্টীয় ধর্ম কাহিনী কিম্বা খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্ব ব্যবহার করতে কুন্ঠিত হন না। এমনকি স্লাভো জিজেক (১৯৪৯ – ) রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিষয়ক তর্কে কার্ল স্মিথ (১৮৮-১৯৯৫)-এর চিন্তা মোকাবিলার জন্য ইব্রাহিমের(আঃ) কোরবানির কাহিনী ব্যবহার করেছেন।

পাশ্চাত্য দর্শনে বাইবেলের গল্প ব্যবহার খুবই স্বাভাবিক এবং ন্যায্য; কারণ পাশ্চাত্য চিন্তায় খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্বের ধারাবাহিকতা বহাল রয়েছে। কিভাবে বহাল রয়েছে সেটা ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু ধর্মতত্ত্বের ধারাবাহিকতায় — ধর্মের সূত্র ধরে কিম্বা ফহর্মের পর্যালোনার মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্য চিন্তার বিকাশ ঘটেছে, এটা আমাদের বোঝা জরুরী। পাশ্চাত্য চিন্তার বাইরে কিম্বা বিপরীতে আমাদের যদি কিছু বলার থাকে তাহলে নিজ নিজ ধর্মতত্ত্বে অন্বেষণের কাজ জরুরী। উপবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার কথা আমরা বলি বটে কিন্তু উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ স্রেফ অর্থনৈতিক সম্পর্ক না, একই সঙ্গে ধর্মতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক।

এটা বোঝা কঠিন নয় যে ধর্ম এবং ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্যকে মানুষের স্বাভাবিক বা সহজাত প্রেম, ভালবাসা, নীতিনৈতিকতার জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিমূর্ত ভাবে ঈশ্বরের আদেশ বা বিধান হিশাবে হাজির করা হয়। এভাবে বিচ্ছিন্ন ভাবে ওপর থেকে আসা আদেশ হিশাবে হাজির করলে ধর্মের সঙ্গে প্রেম, ভালবাসা নীতিনৈতিকতার যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় তা মীমাংসার অতীত দ্বন্দ্ব হিশাবে হাজির হয়। এই অবস্থা ভয়ংকর বিপজ্জনক। আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন এই বিপদ সম্পর্কে সচেতন। তাই এর সমাধান হিশাবে আধুনিক দার্শনিকরা একে ‘নীতি নৈতিকতার জগতের সাময়িক মুলতুবি’ (‘Suspension of the Ethical) হিশাবে হাজির করেন এবং তা আলোচনা করেন। কিন্তু এটা ভয়ংকর বিপদ এড়িয়ে যাবার কোশেশ মাত্র, মীমাংসা নয়। অন্যদিকে একই পাশ্চাত্য ইসলামকে জঙ্গী বা সন্ত্রাসবাদী ধর্ম হিশাবে দেখানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে। অথচ ঈশ্বরের ‘আদেশ’ মোতাবেক সন্তানকে বলী দানের গল্প কোরানুল করিমের নয়, সেটা ইঞ্জিল শরিফ বা বাইবেলের। পাশ্চাত্যর চিন্তা বা মনোজগতে বাইবেলের কোরবানি গল্পের সুনির্দিষ্ট পরিণতি আছে। যার সঙ্গে সন্তানের প্রতি প্রেম ও নীতিনৈতিকতার দ্বন্দ্ব দার্শনিকরা স্বীকার করেন। কিন্তু পাশ্চাত্য এর কোন কোন মীমাংসা হাজির করতে পারছে না, অন্যদিকে ইহলৌকিক জগতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য অনন্ত যুদ্ধ চালাচ্ছে – এই দুইয়ের মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে কিনা সেটাও ভেবে দেখা জরুরী।

দ্বিতীয় বিপদ হচ্ছে এই দ্বন্দ্বের মীমাংসার ভার অলৌকিকতার হাতে সমর্পন করা। ঈশ্বর সন্তানের জায়গায় ভেড়া কোরবানি দেবার নির্দেশ দিয়েছেন। অলৌকিক গড, লর্ড বা ঈশ্বর সেটা চাইতেই পারেন। সেটাই গল্পে ঘটেছে। কিন্তু সেটা হজরত ইব্রাহিমের (আঃ) ক্ষেত্রে ঘটনা, কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে কি হবে? তাদের কাছে তো ‘ওহি’ আসবে না। ঈশ্বর বা ধর্মের প্রতি আনুগত্য প্রমাণের জন্য সন্তান বলী দেওয়া কি তাহলে সাধারণ মানুষের নিয়তি? বাইবেলের গল্প কি আমাদের ধর্মের অমীমাংসিত মৃত্যু উপত্যকার দিকেই শুধু নিয়ে যাবে?

সোরেন কিয়ার্কেগার্ড জানিয়েছেন এই গল্পে তিনি যারপরনাই ভীত এবং আতংকে কাঁপছেন। তাঁর বিখ্যাত দর্শনের বইয়ের নাম ‘ভয় ও থর থর কাঁপুনি’ (Fear & Trembling)। কিন্তু আতংক ও থর থর কাঁপুনি কি পাশ্চাত্য দর্শনে কেটেছে? জাক দেরিদা, ইম্মেনুয়েল লেভিনা, স্লাভো জিজেকসহ অন্যান্যদের লেখালিখি আমাদের বেশীদূর নিতে পারে নি। ভয় এবং কাঁপুনি রয়ে গিয়েছে। ঈশ্বর তাঁর ‘আদেশ’ পালনের ক্ষেত্রে নিঃশর্ত। তিনি কি এতোই কঠোর, নির্মম ও নিষ্ঠুর? তাহলে প্রেম ভালবাসা নীতিনৈতিকতা কি ঈশ্বরের আদেশের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য ও আত্মসমর্পন? বাৎসল্য, স্নেহ, প্রেম কিম্বা নৈতিক বোধ কি ধর্ম বা দ্বীন থেকে আলাদা কিছু?
ভালবাসি বলেই আমরা আত্মসমর্পন করি। ধর্ম যে আতংক ও অস্থিতিশীল ‘কর্তা’ নিরন্তর আমাদের মধ্যে তৈরি করে সেই আতংকগ্রস্ত অস্তিত্ব থেকে মুক্তির উপায় কি? এ নিয়েই আমরা কিছু আলোচনা শুরু করতে চাইছি। এই ল;এখাগুলো সেই বিষয় সম্পর্কে একটি পরিচিতিমূলক কিস্তি। এর আগে ‘ইসলামের কোরবানি, ‘মনের পশু তত্ত্ব ও খ্রিস্ট ধর্ম’ শিরোনামের লেখায় কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছি। এই লেখাটি পড়বার আগে সেটা পড়ে রাখলে ভাল হয়।

লিখতে গিয়ে শুরুতেই দেখছি, বাংলাদেশে সমস্যা আরও গভীর। একদমই দুয়ারের গোড়ায়। খোপ থেকে বেরিয়ে উঠানে পা দেওয়াই কঠিন। হজরত ইব্রাহিম(আঃ) এবং কোরবানি নিয়ে আমাদের সমাজে যে সকল গল্প বা ধারণা প্রচলিত তার খুব কমই কোরান থেকে নেওয়া। ফলে সাধারন মানুষের স্তরে খ্রিস্টিয় গল্প ও খ্রিস্টিয় বয়ান মোটা ময়লার আস্তরণ ফেলে রেখেছে। আগে সেটা পরিষ্কার করা জরুরী। প্রথমেই বুঝতে হবে একই গল্পের উল্লেখ থাকলেও কোরানের গল্প আর বাইবেলের গল্প এক না। প্রস্তাবনা বয়ান, পেশ করবার ধরণ ইত্যাদি একদমই আলাদা। আল্লাহ হজরত ইব্রাহিম(আঃ)কে তাঁর পুত্র কোরবানি দেবার ‘আদেশ’ বা ‘নির্দেশ’ দিয়েছেন, এই রকম গল্প কোরানে নাই। ‘মনের পশুর’ তত্ত্বও এই দিক থেকেও তাই আসলে খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্বের সমস্যা, ইসলামের না।

দুনিয়ার ধর্মগুলোর মধ্যে তিনটিই হচ্ছে সেমিটিক বা শাম জনগোষ্ঠির ধর্ম। তাদের ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যে তাই একই গল্পের উল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু গল্প একই হলেও তা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বলা। ফলে বয়ান ও ব্যাখ্যার মৌলিক বা গুণগত ফারাক রয়েছে। ভিন্ন ভাবে পেশ বা বয়ানের কারনে গল্পগুলো দিয়ে যে ধর্মশিক্ষা হাজির করা হয়, বলা বাহুল্য, তারা পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, অনেক সময় সম্পূর্ণ বিপরীত।

ইসলাম সেমিটিক বা শাম ভাষাভাষী জনগোষ্ঠির ধর্মগুলোর মধ্যে সবার শেষে হাজির হয়েছে। ইংরেজি ‘সেমাইট’ শব্দটির উৎস ওল্ড টেস্টামেন্টের (জেনেসিস ১০.১) ‘শেম’ শব্দ থেকে। লাতিন ভাষায় বাইবেল অনুবাদে এই শব্দটি রয়েছে। প্রাচীন ধারণা হচ্ছে সেমিটিয়রা নূহ নবীর জৈষ্ঠ্য পুত্র ‘শেম’-এর বংশধর। তবে এই তত্ত্ব এখন আর মানা হয় না। ইউরোপে ও আমেরিকায় আরবদের তুলনায় ইহুদিদের অধিক সংখ্যার উপস্থিতির কারনে পশ্চিমে ‘সেমিটিক’ কথাটা ইহুদিদের প্রসঙ্গেই ব্যবহার করা হয়, কিন্তু সেটা আরব দেশের অধিবাসীদের প্রসঙ্গেও খাটে; আরবরা অন্য যে কোন জনগোষ্ঠির চেয়ে তাদের শারিরীক গঠন, সামাজিক আচার-আচরণ, চিন্তা ও ভাষার অভ্যাস ইত্যাদি মিলিয়ে সেমিটিক বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে। বিভিন্নকালের লিখিত নথিপত্রের মধ্য দিয়ে দেখা যায় আরব দেশের জনগণই বরং কমবেশী একইরকম থেকে গিয়েছে। যারা আরও জানতে চান তাঁরা আরবদের ইতিহাস নিয়ে ফিলিপ হিত্তির আরবদের ইতিহাস (Phillip.K.Hitti, 1970, পৃষ্ঠা ৯) পড়ে দেখতে পারেন।

অনেকে দাবি করে থাকেন, ইসলামে এসে মানবেতিহাস ধর্মযুগের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে। আখেরি নবী বা শেষ নবী এসে গিয়েছেন। আর কোন নবী রসুল আসবেন না। এখন মানুষকে তার নিজ নিজ এবাদত, চিন্তা, বিবেক ও পর্যালোচনার হিম্মতের মধ্য দিয়ে নিজের এবং মানবেতিহাসের বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। আল্লার তরফ থেকে কর্তৃত্ব পেয়ে নবী বা রসুল দাবি করে কারো আর কথা বলার অধিকার থাকবে না। ‘আখেরি নবী’র ধারণা দিয়ে ইসলাম সেই কুফরি নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ‘এটাই আল্লা বলেছেন’ – কোন বিষয়ে এই প্রকার নিরংকুশ দাবির অধিকার ইসলাম আখেরি নবীর পরে আর কাউকে দেয় নি। ইসলাম ধর্মযুগের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে – এই দাবি তাহলে অনর্থক নয়। তাহলে এখন ‘ইসলাম’ বলে যা জারি রয়েছে সেটা কি ইহুদি কিম্বা খ্রিস্ট ধর্মেরই অপভ্রংশ?

বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে ধর্মশিক্ষার জন্য অতীতে যে সকল গল্পের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে তা নিয়ে আধুনিক কালে বিভিন্ন দিক থেকে আলাপ-আলোচনা তর্কবিতর্ক চলছে। চলবে। গ্রিক-খ্রিস্টিয় চিন্তার আধিপত্যের চরিত্র বোঝার জন্য সেই আলাপ-আলোচনা তর্ক-বিতর্কের হদিস আমাদের রাখতে হবে। সেই সকল তর্কে শামিল হবার দরকার রয়েছে। কারন আধুনিক কালে সেইসব গল্প নতুন তাৎপর্য নিয়ে হাজির হচ্ছে এবং নতুন জিজ্ঞাসা তৈরি করছে। কিন্তু বাংলাভাষীরা যদি নিজেদের খ্রিস্টীয় বয়ানের আধিপত্য থেকে শুরুতে মুক্ত হতে না পারে তাহলে তারা পাশ্চাত্য চিন্তার গোলামই থেকে যাবে, পাশ্চাত্য চিন্তার আধিপত্যকেই দীর্ঘস্থায়ী করবে এবং সেটা করবে ইসলামেরই নামে। কোরানুল করিম তাদের কাছে মজুদ থাকা সত্ত্বেও তারা নিজেরা কোনও মৌলিক অবদানে সক্ষম হবে না।

বাংলাদেশে সমস্যা আরও গভীর। একদমই দুয়ারের গোড়ায়। খোপ থেকে বেরিয়ে উঠানে পা দেওয়াই কঠিন। হজরত ইব্রাহিম(আঃ) এবং কোরবানি নিয়ে আমাদের সমাজে যে সকল গল্প বা ধারণা প্রচলিত তার খুব কমই কোরান থেকে নেওয়া। ফলে সাধারন মানুষের স্তরে খ্রিস্টিয় গল্প ও খ্রিস্টিয় বয়ান মোটা ময়লার আস্তরণ ফেলে রেখেছে। আগে সেটা পরিষ্কার করা জরুরী। প্রথমেই বুঝতে হবে একই গল্পের উল্লেখ থাকলেও কোরানের গল্প আর বাইবেলের গল্প এক না। প্রস্তাবনা বয়ান, পেশ করবার ধরণ ইত্যাদি একদমই আলাদা। আল্লাহ হজরত ইব্রাহিম(আঃ)কে তাঁর পুত্র কোরবানি দেবার ‘আদেশ’ বা ‘নির্দেশ’ দিয়েছেন, এই রকম গল্প কোরানে নাই। ‘মনের পশুর’ তত্ত্বও এই দিক থেকেও তাই আসলে খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্বের সমস্যা, ইসলামের না।

তাহলে বৈশ্বিক জ্ঞানচর্চায় অংশগ্রহণের প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে ইসলাম সম্পর্কে আমাদের অনুমান নির্ভর খামখেয়ালি চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়া। ঔপনিবেশিক ইংরেজ আমলে ইঞ্জিল শরিফ অনুবাদ ও তা ব্যাপক ভাবে বিতরণ করা হয়। খ্রিস্টান মিশনারি এবং পুরোহিতদের প্রচার প্রপাগাণ্ডার কারণে যে সকল গল্প আমরা মুখস্থ করে রেখেছি সেগুলো আসলে কোরানুল করিমের গল্প বা বয়ান নয়, বাইবেলের গল্প। বাইবেল সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করবার জন্য যে ভাষায় লেখা হয় তাকে অনেকে ইসলামি ভাষা বলে ভুল করেন। সেই ভুল কাটিয়ে ওঠা জরুরী। কোরানে একই সেমিটিক গল্প কিভাবে বলা আছে তার হদিস নিতে হলে সরাসরি কোরান পাঠ ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নাই। তুলনামূলক আলোচনা জরুরী। বলাবাহুল্য এই প্রাথমিক ভুলগুলো দ্রুত কাটিয়ে ওঠা দরকার।

শুরুতে আমরা সেটাই করব। কোরবানির গল্প কিভাবে বাইবেলে ও কোরানে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে এবং ভিন্ন ধর্মবোধ জাগ্রত করবার উদ্দেশ্যে বর্ণনা করা হয়েছে তা নিয়ে আগে আমরা প্রাথমিক আলোচনা শেষ করব। তারপর আমাদের চেষ্টা হবে:

১. বাইবেল ও কোরানের গল্পের পার্থক্য নির্দেশ করে খ্রিস্টীয় বয়ান ও খ্রিস্টিয় চিন্তা থেকে কোরানের চিন্তা বা ভাববৈশিষ্ট্য আলাদা ভাবে চেনা এবং হারিয়ে যাওয়া ধর্মভাব ও চিন্তার সূত্র ধরে নিজেদের চিন্তা শক্তিশালী করার সূত্র অনুসন্ধান। কিম্বা আদৌ তা সম্ভব কিনা সেটাও বিচার করে দেখা দরকার। বিভিন্ন ধর্মের পার্থক্য, বৈচিত্র্য এবং আধুনিক চিন্তার পরিগঠনে ধর্মের ভূমিকা আশা করি এতে আরও স্পষ্ট হবে। আমাদের নিজ নিজ ধর্মতাত্ত্বিক উপলব্ধি ও বিচারবোধের বিকাশও আশা করি এতে ত্বরান্বিত হবে। মানুষের ইতিহাস শুধু পাশ্চাত্যের ইতিহাস না হয়ে সকলের ইতিহাস হয়ে উঠবে। আধুনিক চিন্তা আকাশ ফুঁড়ে হাজির হয় নি। তার গোড়া খুঁজলে আমরা খ্রিস্ট ধর্মে এসে পৌঁছাই। সে কারণে ধর্মের তুলনামূলক পর্যালোচনা আমাদের চিন্তার সামগ্রিক বিকাশের জন্য ফলপ্রসূ হবে বলে আমরা আশা করি।

২. বাইবেলে ও কোরানুল করিমে একই গল্প উল্লেখের ধরণ, বয়ান এবং তাফসীর কি ধরনের দার্শনিক সমস্যা ও তর্কবিতর্ক হাজির করে সে সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা করা গেলে অন্যান্য গল্পগুলোর মর্মোদ্ধারে আমাদের আগ্রহ বাড়বে। ধর্মের গল্পগুলো কেন্দ্র করে একালে গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক ও দার্শনিক জিজ্ঞাসাগুলো তোলা হয় এবং তর্কবিতর্ক চলে। ইসলামের পাটাতনে দাঁড়িয়ে সেই সকল তর্ক বিতর্কে অংশগ্রহণ এবং মানবেতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসাগুলোকে বোঝা ও মোকাবিলার হিম্মত অর্জন জরুরি হয়ে পড়েছে।

ইসলামের কোরবানি, ‘মনের পশু’ তত্ত্ব ও খ্রিস্টধর্ম (প্রথম পর্ব)

ফরহাদ মজহার

কবি, চিন্তক, বুদ্ধিজীবী ও কৃষক। জন্ম: ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশের নোয়াখালি জেলায়। পড়াশুনা করেছে ওষুধ শাস্ত্র ও অর্থনীতি বিষয়ে যথাক্রমে ঢাকা ও নিউইর্কে। পেশা সূত্রে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলাদেশের ‘নয়াকৃষি আন্দোলন’-এর প্রধান সহযোদ্ধা। লালন ধারা-সহ বৃহৎ বঙ্গের ভাবান্দোলন পরম্পরার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, সমাজ ও রাজনীতি চিন্তা এবং দার্শনিক বিষয়ে বহু গদ্য রচনা করেছেন। এছাড়াও লিখেছেন নাটক। অনুবাদও করেছেন।
তাঁর বইগুলি-
কাব্যগ্রন্থ:
খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ (১৯৭২) ।। ত্রিভঙ্গের তিনটি জ্যামিতি (১৯৭৭) ।। আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে (১৯৮৩) ।। সুভাকুসুম দুই ফর্মা  (১৯৮৫) ।। বৃক্ষ: মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক বিষয়ক কবিতা (১৯৮৫) ।। অকস্মাৎ রপ্তানিমুখী নারীমেশিন (১৯৮৫) ।। খসড়া গদ্য (১৯৮৭) ।। মেঘমেশিনের সঙ্গীত (১৯৮৮) ।। অসময়ের নোটবই (১৯৯৪) ।। দরদী বকুল (১৯৯৪) ।। গুবরে পোকার শ্বশুর (২০০০) ।। কবিতার বোনের সঙ্গে আবার (২০০৩) ।। ক্যামেরাগিরি (২০১০) ।। এবাদতনামা (২০১১) ।। অসময়ের কবিতা (২০১১) ।। কবিতাসংগ্রহ (২০১১) ।। তুমি ছাড়া আর কোন্ শালারে আমি কেয়ার করি? (২০১৬) ।। সদরুদ্দীন (২০১৮)

গদ্যগ্রন্থ:
প্রস্তাব (১৯৭৬) ।। সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থান এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উত্থান প্রসঙ্গে (১৯৮৫) ।। রাজকুমারী হাসিনা (১৯৯৫) ।। সাঁইজীর দৈন্য গান (২০০০) ।। জগদীশ (২০০২) ।। সামনা সামনি: ফরহাদ মজহারের সঙ্গে কথাবার্তা (২০০৪) ।। বাণিজ্য ও বাংলাদেশের জনগণ (২০০৪) ।। মোকাবিলা (২০০৬) গণপ্রতিরক্ষা (২০০৬) ।। ক্ষমতার বিকার ও গণশক্তির উদ্বোধন (২০০৭) ।। ভাবান্দোলন (২০০৮) পুরুষতন্ত্র ও নারী (২০০৮) ।। সাম্রাজ্যবাদ (২০০৮) ।। রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠ (২০০৮) ।। সংবিধান ও গণতন্ত্র (২০০৮) ।। নির্বাচিত প্রবন্ধ (২০০৮) ।। তিমির জন্য লজিকবিদ্যা (উপন্যাস, ২০১১)
প্রাণ ও প্রকৃতি (২০১১) ।। মার্কস পাঠের ভূমিকা (২০১১) ।। ডিজিটাল ফ্যাসিবাদ (২০১২)
যুদ্ধ আরো কঠিন আরো গভীর (২০১৪) ।। ব্যক্তি বন্ধুত্ব ও সাহিত্য (২০১৬) ।। মার্কস, ফুকো ও রুহানিয়াত (২০১৮)

নাটক:
প্রজাপতির লীলালাস্য (১৯৭২)

অনুবাদ:
অর্থশাস্ত্র পর্যালোচনার একটি ভূমিকা (মূল: কার্ল মার্ক্স) (২০১০)
খুন হবার দুই রকম পদ্ধতি (মূল: রোকে ডাল্টন) (২০১১)

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top