আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩রা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.
আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩রা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আমার মা

।। পার্থ দাশগুপ্ত ।।

মা যে যুগে জন্মেছেন, বড়ো হয়েছেন, যা যা দেখেছেন, যতকিছুর মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন, যে মূল্যবোধ আশ্রয় করে জীবনের দাঁড় বেয়েছেন, ওঁর সামগ্রিক যাপনের মধ্যে তার স্পষ্ট ছাপ ছিলো৷ মা-র হয়ে ওঠার পৃথিবী আর ছেড়ে যাওয়ার পৃথিবী দুটো আলাদা পৃথিবী৷ ওঁর কল্পনাতেও থাকার কথা ছিলো না, শেষ পর্যন্ত কোন পৃথিবীটাকে উনি ছেড়ে যাবেন। কিন্তু চারদিকের এই লাফাতে লাফাতে পালটে যাওয়া পৃথিবীটার এক পাশে মা নিজের মতো করে বেঁচে ছিলেন – আপনবেগে পাগলপারা নদীর পাশে। স্তব্ধ চাঁপার তরু, গন্ধভরে, তন্দ্রাহারা।

আমার মা

মায়া দাশগুপ্ত

ইতিহাস যাঁরা লেখেন তাঁরা নানারকমভাবে একটা সময়কে দেখতে চান। কখনও শাসকের চোখ দিয়ে, কখনও সমষ্টির চোখ দিয়ে৷ কিন্তু একলা মানুষের ইতিহাস ইতিহাসবিদরা লেখেন না, লিখতে জানেন না৷ একলা মানুষের ইতিহাস তার নিজের ইতিহাস, তার নিজের গল্প৷ সে গল্প লিখতে পারেন সেই মানুষ নিজেই অথবা আর কেউ, যিনি দেখতে জানেন, দেখাতে জানেন। বিভূতিভূষণ দেখতে জানতেন, দেখাতেও জানতেন। ‘পথের পাঁচালী’ কিছু একলা মানুষের নিজেদের গল্প, যে গল্পের প্রতিটা শব্দের আধারে তাদের বেঁচে থাকার সময়ের টলটলে জল ধরে রাখা আছে৷

আমার মা-র গল্প লিখতে গেলে অন্তত একজন বিভূতিভূষণ লাগতো। অথবা হেমিংওয়ে৷ অথবা টলস্টয়৷ অথবা এঁদের সবাইকেই৷ আমাদের মতো ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে আমার মা-র গল্প বলা শুধু ধৃষ্টতাই না, একরকম অসম্ভব।

আর পাঁচজন মানুষের মতোই মা কোনও একজন মানুষ ছিলেন না। তিনি অনেকগুলো মানুষ ছিলেন। যেমন আমরা সবাই৷ কিন্তু সেই অনেকগুলো মানুষের জুতোর মাপই আর পাঁচজনের তুলনায় অনেক বড়ো৷ বাকিদের পা সে জুতোয় গলতো না৷

আমি মা-র সঙ্গে জীবনের প্রায় ৫৪টা বছর কাটালাম। খুব কম নয় সময়টা৷ এতগুলো বছরে আমার জানাশোনার মধ্যে আমি এমন কাউকে দেখিনি যাকে সবকিছু মিলিয়ে আমার মা-র কাছাকাছিও রাখা যায়৷

প্রতিভা সর্বদেশে, সর্বকালেই বিরল৷ ইংরেজিতে যাকে gifted বলে, মা সেরকম ছিলেন না৷ এমন কোনও কাজ আমি মা-কে করতে দেখিনি, যেটাতে জন্মগত প্রতিভা লাগে বা যেটাতে ওঁকে excellent বলা যেত। কিন্তু, তাঁর জীবনটা গোটাগুটি দেখা গেলে দেখা যাবে, মা একটা আস্ত ইতিহাস বই ছিলেন, যার প্রত্যেকটা পাতা আমাদের জন্য এবং আমাদের পরে যারা আসবে, তাদের জন্য জরুরি এমনকী অবশ্যপাঠ্য। আমার জানাশোনা আর কারও সম্পর্কে আমি এটা বলতে পারবো না৷ এমনকী আমার বাবা সম্পর্কেও না।

উনি গান বাঁধেননি বা জীবনদেবতার পায়ে নিজেকে সমর্পণ করেননি৷ যতটা শান্তভাবে তা গ্রহণ করা যায়, করেছেন। হজম করেছেন। এবং জীবনকে তার মতো চলতে দিয়েছেন৷ তার মানে এই নয় যে মা stoic ছিলেন, নির্বিকার ছিলেন৷ সংসারের খুঁটিনাটি ওঁর নখের ডগায় ছিল। খবরের কাগজওয়ালার কাছে কুড়ি টাকা পাওনা বা সবজিওয়ালা গত সপ্তাহে পাঁচটাকা কম নিয়ে গিয়েছিল – কারও মনে না থাকলেও মা-র মনে থাকতো। এবং মা সেটার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত শান্তি পেতেন না।

মা যে যুগে জন্মেছেন, বড়ো হয়েছেন, যা যা দেখেছেন, যতকিছুর মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন, যে মূল্যবোধ আশ্রয় করে জীবনের দাঁড় বেয়েছেন, ওঁর সামগ্রিক যাপনের মধ্যে তার স্পষ্ট ছাপ ছিলো৷ মা-র হয়ে ওঠার পৃথিবী আর ছেড়ে যাওয়ার পৃথিবী দুটো আলাদা পৃথিবী৷ ওঁর কল্পনাতেও থাকার কথা ছিলো না, শেষ পর্যন্ত কোন পৃথিবীটাকে উনি ছেড়ে যাবেন। কিন্তু চারদিকের এই লাফাতে লাফাতে পালটে যাওয়া পৃথিবীটার এক পাশে মা নিজের মতো করে বেঁচে ছিলেন – আপনবেগে পাগলপারা নদীর পাশে। স্তব্ধ চাঁপার তরু, গন্ধভরে, তন্দ্রাহারা। চারপাশটা পালটে যাচ্ছে বলে তার সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য ওঁকে নিজের যাপনটা পালটাতে হয়নি৷ অনেক কিছুতেই মা কষ্ট পেতেন সেটা বুঝতে পারতাম, কিন্তু সেটা লুকোতেও জানতেন৷ আর জানতেন নিজের চারপাশে একটা বলয় তৈরি করে তার মধ্যে বাঁচতে৷ বই আর কাছের মানুষদের মঙ্গলচিন্তা – এই ছিল একটা ক্রমাগত কুৎসিত হতে থাকা পৃথিবীকে একপাশে রেখে বেঁচে থাকার জন্য মা-র defence mechanism। তার মানে এই নয় যে, মা সত্যিটা এড়িয়ে চলতেন বা তার মুখোমুখি হতে চাইতেন না। তা না হলে একটা সময় পর্যন্ত দুটো বাংলা আর একটা ইংরেজি খবরের কাগজ আগাগোড়া পড়তেন না৷ ‘তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে;
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চ’লে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’ লিখেছিলেন জীবনানন্দ তাঁর ‘হায় চিল’ কবিতায়৷ মা যত খবর পড়তেন, ততই ওঁর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা চলকে পড়তো৷ কিন্তু সত্য যে কঠিন৷ মা কখনও সত্য নিয়ে আত্মপ্রবঞ্চনা করেননি৷

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনও আলোচনা হলেই শুনতে পাই, তিনি গোটা জীবনে অজস্র শোক পেয়েছেন, কিন্তু কোনও কিছুই তাঁর অবাস্তব প্রতিভার বিচ্ছুরণে বাধা হতে পারেনি। মা কি কম শোক পেয়েছেন? অন্তত রবীন্দ্রনাথের তুলনায় কম পাননি। মারা যাওয়ার সময়ে তিনি আমাদের এবং ওঁর পরিচিতদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন এবং ওঁর চেয়ে ছোটো বহু কাছের মানুষের মৃত্যুশোক ওঁকে সইতে হয়েছে৷ তাই নিয়ে উনি গান বাঁধেননি বা জীবনদেবতার পায়ে নিজেকে সমর্পণ করেননি৷ যতটা শান্তভাবে তা গ্রহণ করা যায়, করেছেন। হজম করেছেন। এবং জীবনকে তার মতো চলতে দিয়েছেন৷ তার মানে এই নয় যে মা stoic ছিলেন, নির্বিকার ছিলেন৷ সংসারের খুঁটিনাটি ওঁর নখের ডগায় ছিল। খবরের কাগজওয়ালার কাছে কুড়ি টাকা পাওনা বা সবজিওয়ালা গত সপ্তাহে পাঁচটাকা কম নিয়ে গিয়েছিল – কারও মনে না থাকলেও মা-র মনে থাকতো। এবং মা সেটার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত শান্তি পেতেন না।

মা ছিলেন আমার আশ্রয়ের জায়গা৷ সম্ভবত একমাত্র আশ্রয়ের জায়গা৷ আক্ষরিক এবং অন্য সব অর্থে৷ আমার চেনাশোনার বৃত্তে মা একমাত্র মানুষ যিনি আমার কোনও কাজ বা সিদ্ধান্তকে কখনও কোনও প্রশ্ন করেননি৷ আমার সাফল্যে কখনও সখনও উচ্ছ্বাস দেখিয়েছেন, যদিও সেরকম সুযোগ আমি মা-কে বিশেষ দিতে পারিনি৷ আর কোনও কাজ অপছন্দ হলে চুপ করে থেকেছেন। কৈফিয়ত দাবি করেননি৷ অধিকারবোধ ফলাননি৷ আমার সম্পর্কে ওঁর ভেতর থেকে একটা জোরের জায়গা, বিশ্বাসের জায়গা ছিলো। আমারও আত্মবিশ্বাস ছিলো যে, বাকি পৃথিবী আমার বিরুদ্ধে গেলেও মা যাবেন না৷ অন্তত আশ্রয়ের জায়গাটা কেড়ে নেবেন না৷ মা-র আশ্রয়ের মধ্যে সান্ত্বনাও ছিল, তিরস্কারও ছিলো৷ কিন্তু she loved me for who I am, not despite what I am – এটা মা ছাড়া আর কারও সম্পর্কে অন্তত আমার জীবনে প্রযোজ্য না৷

মা-র জীবন থেকে আমি বিশেষ কিছু শিখতে পারিনি৷ আমরা দুজন দু রকম মানুষ ছিলাম। কিন্তু এটুকু অন্তত শিখতে পেরেছি যে, মা-র পক্ষেই মা-র মতো হওয়া সম্ভব। আমার পক্ষে না৷ বা হয়তো আর কারও পক্ষেই না৷

মা সার্থকনামা ছিলেন। মা-র জীবনের পরতে পরতে মায়া৷ সবার জন্য৷ বাড়িতে যাঁরা পরিচারিকার কাজ করতে আসতেন বা যাঁরা ওঁর আয়া ছিলেন, কোনও অবস্থাতেই তাঁদের কোনও কাজ ওঁর পছন্দ হতো না৷ খিটমিট লেগেই থাকতো। নিখুঁত না হলে কোনও কাজটাই যে আসলে হলো না, এ বিষয়ে মা ছিলেন অত্যন্ত গোঁড়া, প্রায় নাছোড়৷ কিন্তু সে জন্য তাঁদের প্রতি ওঁর মায়ার কোনও অভাব ঘটেনি৷

কেউ কখনও ওঁর কাছ থেকে খালি হাতে ফিরেছে বলে শুনিনি৷ শেষবয়সে যা পেনশন পেতেন, চাকরিজীবনে তত বেতন পেতেন না৷ আর সেই টাকা কাকে কীভাবে বা কতভাবে দিয়ে ঝাড়া হাত পা হওয়া যায়, সেই নিয়ে ভেবে অস্থির হতেন৷

রাকা মাস্টার্স করে ফেললো। পুটুশও গ্র‍্যাজুয়েট হয়ে গেল। ছবিটবি করে নামও করেছে৷ মা ওদের সাফল্যে ছেলেমানুষের মতো উচ্ছ্বসিত হতেন। রাকা-পুটুশের অশেষ সৌভাগ্য যে, এত বছর এত কাছ থেকে ওরা মা-কে ভোগ করতে পারলো। আমার কাছে এটা যেন একটা মিউজিয়াম-এ অতীতের কিছু মহামূল্যবান জিনিসের কেয়ারটেকার-এর কাজের মতো।

এই অদ্ভুত বদলে যাওয়া পৃথিবীতে অন্তত একটা বাড়িতে একটা বিশেষ যাপন আর শিক্ষার ধারা বহমান থাকলে সেটাই মা-র প্রতি শ্রেষ্ঠ সম্মান জানানো হবে বলে আমার মনে হয়৷

Dignity শব্দটার বাংলা জানি না৷ বাংলা আদৌ হয় কি না তা-ও জানি না৷ কিন্তু, whatever she did, মা did with dignity. Utmost dignity. তারসঙ্গে সাহস এবং যাকে বলে courage of conviction.

মা এমন কিছু করেননি যাতে পৃথিবীটা একটু অন্যরকম হয়৷ কিন্তু এমন কিছুও করেননি যাতে ক্রমাগত অন্যরকম হতে থাকা পৃথিবীটা তাঁকে একদিনের জন্যও নিজের বিশ্বাস এবং যাপনের জায়গা থেকে তিলমাত্র টলাতে পারে৷ আমার কেন জানি না মনে হয়, প্রথম কাজটা হয়তো অতটা কঠিন নয়৷ একজন গান্ধী বা মার্টিন লুথার কিং অন্যরকমভাবে অন্য কোথাও নিশ্চয়ই আবার আসবেন মানব ইতিহাসে৷ কিন্তু আমার মা-র মতো মানুষ মা-র মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয়ে গেলেন। মানব ইতিহাসে একটা যাপনের সভ্যতা মা-র চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোপাট হয়ে গেল!

চিত্রকলা- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পার্থ দাশগুপ্ত

পেশায় ইঞ্জিনিয়ার৷ কর্পোরেট দাসত্ব ছেড়ে সাংবাদিকতা আর শিক্ষকতা করেছেন। নেশা বই, world movies, documentaries, সব genre-এর সঙ্গীত৷ চেতনার কেন্দ্রে মুখহীন মানুষ৷

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top