আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩রা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.
আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩রা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আত্মহত্যার পরে

অণুগল্প

।। নিষাদ প্রধান ।।

মনে আছে খালি তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার জায়গাগুলা। ধনুকের মতো বাকানো লাল বিল্ডিং, ঘেরা মাঠ যেইখানে ছদ্ম মানুষ, প্রকৃত শেয়ালেরা ঘুরে বেড়াইতো। তারা সেখানে গাল পাড়তো দুনিয়ার তাবৎ শেয়ালদের আর অপেক্ষা করতো কবে তারাও মানুষের ভেক ছেড়ে সেই পালে যোগ দিতে পারে। কোনো কোনো শেয়ালের সাথে তোমার ছিলো ভাব। তোমার কাছাকাছি এসে ওরা কিছুক্ষণের জন্য যেন মানুষ জন্মের আশ মেটাতো। শুধু ততক্ষণই তাদের চোখে জমতো প্রকৃত অশ্রু। ওইসময়গুলাতে আমার কখনও কখনও মনে হইতো আমিও বোধহয় একটা শিয়ালই। তোমার ভেতর দিয়া আমার মানব জন্ম হইছে আর ভুলে গেছি আমার সেই ধূর্ত পুর্বজন্ম।

আত্মহত্যার পরে

ভূত জন্মটা মানুষ জন্মের মতোই, স্মৃতিহীন। এইটা অবশ্য আমার জানার কথা ছিল না, বাকিসব ভূতেদের মতোই। কিন্তু ‘জীবনভর কাজের ক্ষতি করে’ নস্ট্রালজিয়া আমারে জাতিস্মর করে তুলছিলো। অবশ্য যেকোনো জাতিস্মরের মতোই আমার স্মৃতি ছিল আবছা আবছা, কুয়াশায় ঢাকা। তখনো ঢাকা শহরের রাস্তা মফঃস্বল বালকের মতো অচেনা। শুধু এতটুকু আমার পরিষ্কার জানা আমি আজ এখানে কোনো এক কাফেরকে ভালোবেসেছিলাম বলে।

যতক্ষণ বেঁচে ছিলাম বুঝি নাই মৃত্যুটাও তোমার কাছেই যেতে চাওয়া।

যাওয়ার শুরুটা যেখানে তা এই নেক্রোপলিসের হারলেম। বহুদশক আগে কোনো এক নয়া ইহুদীর জন্মলগ্নে এখানে বাস ছিল হারাম রক্তবীজদের। তাদের ধুয়ে মুছে গড়া হইছে নয়া সংখ্যাগুরুর উপনিবেশ। এসবও অবশ্য আমার জানার কথা না। এই শহরের যেকোনো জায়গার মতোই মনোটোনাস ল্যান্ডস্কেপ। গায়ে গা লাগানো উচু বিল্ডিং, কংক্রিটের রাস্তা, নিস্প্রভ সোডিয়াম আলো, শীর্ণ কুকুরের পাল। শুধু মানুষ আর গাড়িতেই তফাৎ এর সঙ্গে নেক্রোপলিসের যেকোন ধনী পাড়ার সাথে। এখানকার মানুষগুলোও কুকুরগুলোর মতো শীর্ণ, চোখেও অনেক কম ক্ষুধা। তাই এত রাত্তিরে তাকে কিছুতে আলাদা করা যাচ্ছে না।

এইসব মনোটোনি ঠেলে আমায় তোমার বাড়ি পথ খুজতে হবে। কিন্তু তোমার বাড়িটা কোথায়? জানি না। জানতাম কি কখনো? তাও মনে নাই।

মনে পড়ে, তোমার পাশে হেঁটে যাওয়ার সময় রাস্তায় শত-সহস্র চোখের অবিশ্বাস।
মনে পড়ে মিছিলে-স্লোগানে তোমার চাওয়াকে পড়তে চাওয়ার চিৎকার

মনে আছে খালি তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার জায়গাগুলা। ধনুকের মতো বাকানো লাল বিল্ডিং, ঘেরা মাঠ যেইখানে ছদ্ম মানুষ, প্রকৃত শেয়ালেরা ঘুরে বেড়াইতো। তারা সেখানে গাল পাড়তো দুনিয়ার তাবৎ শেয়ালদের আর অপেক্ষা করতো কবে তারাও মানুষের ভেক ছেড়ে সেই পালে যোগ দিতে পারে। কোনো কোনো শেয়ালের সাথে তোমার ছিলো ভাব। তোমার কাছাকাছি এসে ওরা কিছুক্ষণের জন্য যেন মানুষ জন্মের আশ মেটাতো। শুধু ততক্ষণই তাদের চোখে জমতো প্রকৃত অশ্রু। ওইসময়গুলাতে আমার কখনও কখনও মনে হইতো আমিও বোধহয় একটা শিয়ালই। তোমার ভেতর দিয়া আমার মানব জন্ম হইছে আর ভুলে গেছি আমার সেই ধূর্ত পুর্বজন্ম।

কিংবা একটা পুরনো বিল্ডিংয়ে চারতলায় একটা লম্বা ঘর যেখানে নীতিবাগীশ রোবটেরা শুকরদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতো তাদের যন্ত্র যন্ত্র স্বরে। আর তার মাঝে তুমি হৃদপিন্ডের মতো ধক্ ধক্ ধক্ করতা। আমি সেই সুরে এতটাই মোহাবিষ্ট হতাম যে আমার কখনো যন্ত্রগুলোকে মানুষ বলে ভুল হতো, আপন লাগতো।

কিংবা মনে পড়ে দুখিনী মানচিত্রের মতো ছড়ানো একটা লেকের পাড়। যেখানে গৃহপালিত যন্তুসকল তাদের মনিবদের মনমতো হওয়ার কসরত করে সকাল সন্ধ্যা। নেক্রোপলিশের মেলানকোলি থেকে পালায় প্রেমিক-প্রেমিকারা করে পূর্ণতার খোজ।

মনে পড়ে তোমার পাশে হেঁটে যাওয়ার সময় রাস্তায় শত-সহস্র চোখের অবিশ্বাস।
মনে পড়ে মিছিলে, স্লোগানে তোমার চাওয়াকে পড়তে চাওয়ার চিৎকার।

অবশেষে রাস্তাতেই তোমার বাড়ি পথের খোঁজ পাইলাম। সে কবে দুইটা পিষে ফেলা ফুলের জন্য বেদনায় থরো থরো হয়ে তুমি রাস্তায় চিৎকার করতে করতে নাড়ায় দিছিলা শুকর-শেয়ালে মিলিত খাদকযন্ত্র সেই থেকে রাস্তায় তোমার সুবাস লেগে ছিলো। আমি অনুগত কুকুরের মতো সেই সুবাস শুকে শুকে তোমার বাড়ির পথে চললাম….

আমারে নিয়া তুমি কি ফিল করতা? রাগ? বিরক্তি? করুণা? যাই করো নিপুণ সার্কাসের মেয়ে, তুমি কি নিখুঁত লুকায় রাখতা তোমার ইমোশন! কী সুন্দর আধা প্রশ্রয় আধা শাসনে পালতা আমায়! কোনোদিন তোমার অনুভূতিরে পড়া হয় নাই আমার।

কিন্তু আজকে প্রথম উন্মোচিত হইলা তুমি… তোমার দুচোখে কী আদিম ভয়!

– কী চাইস তুই?

সবসময় তোমার পাশে বসে থাকার সময় যা হইতো আজও তাই হইলো। গলার মধ্যে জমাট বেধে মহাবিশ্বের জন্মলগ্নের সেই আদিম ব্যাথা, যা কিছুতেই উগরাতে পারি না, পাছে মহা বিষ তোমাকে সংক্রামিত করে।
কিংবা…
আমি ভাবছিলাম, যেমন রুমী বলছিলো “নিস্তব্ধতা হইলো সৃষ্টিকর্তার ভাষা”- তুমি আমাকে সেই ভাষাতেই বুঝবা…
কিন্তু তুমি আমায় একা ছেড়ে গেলা ‘সেই গাছেদের দলে’। আমার আশেপাশে ভীড় করলো শতসহস্র অচেনা মুখ, চেনা যন্ত্রণার মূর্তি।

আমার আর নির্বাণ হইলো না।

অলংকরণ- সাইদ উজ্জ্বল

নিষাদ প্রধান

পড়াশুনা- পাবলিক রিলেশন, ইউল্যাব, ঢাকা। আগ্রহ- চিন্তা, ভাষা, দেহ।Share

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top