আমার মানব শরীরে গাছের অনুপ্রবেশ

।। লুবনা চর্যা ।।

যেন কোথাও যাওয়ার নাই। সহযাত্রীরা চলে গেল বড় বড় পা ফেলে, দেখলাম দূরে তাদের নৌকার মাস্তুল। আকাশে ঘন মেঘ, বজ্র-বিদ্যুৎ। আমার মানব শরীরে গাছের অনুপ্রবেশ, শুধু শিকড় আর শিকড়। কতকিছু ঘটে গেল চোখের সম্মুখে! যুদ্ধবিমান থেকে পড়লো বোমা নয়, ফুলের রূপ নিয়ে যুদ্ধে নিহত শিশুদের আত্মা। কয়েকটা বাঘ মিলে একটা খরগোশকে ধাওয়া দিল আর খরগোশ তাদেরকে পাল্টা ধাওয়া দিয়ে তুলে দিল গাছের মগডালে…

মানুষ ও ঈশ্বর

মানুষ তার সামনে মানুষকে দেখে পাশ কাটিয়ে অন্ধের মতো হাতড়াতে হাতড়াতে এগিয়ে গেল ঈশ্বরের সিংহাসনের দিকে। অথচ মানুষকে ধরা যেত, ছোঁয়া যেত, ভালোবাসা যেত, অন্তত দুইটা গালি তো দেয়া যেত। কিন্তু সে অধরা, অছোঁয়া, অভালোবাসাময় আর অগালিযোগ্য ঈশ্বরকেই বেছে নিল তার যাত্রাপথে পাশের সিটের সঙ্গী হিসাবে। মানুষের থেকে মানুষ পৃথিবীর সমান দৈর্ঘ্যের সেতু বানিয়ে রেখে দিয়েছে দূরত্বের নির্বাসনে। অথচ উল্টোপাশ ফিরলেই আলিঙ্গন। চোখে চোখ রাখলেই কতোকিছু। কত দৃশ্য, দৃশ্যের বন্ধন। তবু মানুষ কাছকে কাছছাড়া করে দূরত্বের অভিলাষী। বাসে পাশের সিটে বসে সে আর ঈশ্বর যাবে সমুদ্র দর্শনে। পথিমধ্যে ঝড়। কাফনের রঙে মেঘেদের ওড়াউড়ি। বাতাসে গাছের আন্দোলন, চাঁদ যাচ্ছে পালিয়ে। ভয়ানক একা বোধ করে সে। আরেকটা মানুষ, সেও একা বোধ করে। বসতে চাইলো পাশের খালি সিটে। কিন্তু সে বসতে দিলো না। বসতে সে দেবে শুধু ঈশ্বরকে- যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, ভালোবাসা যায় না, এমনকি দুইটা গালিও দেয়া যায় না।

কোথায় জানি যাওয়ার কথা ছিল

কোথায় জানি যাওয়ার কথা ছিল, নিজের নামে কিছু নালিশ জমে ছিল। তারপরও বসে থাকলাম ঠাঁই, যেন কোথাও যাওয়ার নাই। সহযাত্রীরা চলে গেল বড় বড় পা ফেলে, দেখলাম দূরে তাদের নৌকার মাস্তুল। আকাশে ঘন মেঘ, বজ্র-বিদ্যুৎ। আমার মানব শরীরে গাছের অনুপ্রবেশ, শুধু শিকড় আর শিকড়। কতকিছু ঘটে গেল চোখের সম্মুখে! যুদ্ধবিমান থেকে পড়লো বোমা নয়, ফুলের রূপ নিয়ে যুদ্ধে নিহত শিশুদের আত্মা। কয়েকটা বাঘ মিলে একটা খরগোশকে ধাওয়া দিল আর খরগোশ তাদেরকে পাল্টা ধাওয়া দিয়ে তুলে দিল গাছের মগডালে। আর দেখলাম আমি অন্য একটা মানুষ হয়ে নদীর কাছে শেয়ার করছি উজান-ভাটির গল্প। নদী বললো, তারও আছে জলের শেকড়। রাখাল বাঁশি বাজিয়ে গরুর পাল নিয়ে চলে গেল তেপান্তর। আমি তবু বসে আছি হালকা নীল নদীটার পাশে, নদীটা হয়ে গেছে জলজ গিটার। সারাদিন সে বাজে আর আমি গাই। বসে আছি সেই কোন্‌ কাল ধরে এখানে, ওগো আমার যে কোথাও যাওয়ার নাই।

সবুজ পাতার মতো কিছু ভালো মানুষ

সবুজ পাতার মতো কিছু ভালো মানুষ ঘিরে আছে পৃথিবীর সীমা। তাই আজও পৃথিবীকে ভালোলাগার অনুভূতি হয়। মানুষের স্বার্থপরতার ঠোঁট চুমুক দিয়ে খেয়ে নেয় কাপের সবটুকু চা। তলানিতে পড়ে থাকে কয়েকটা কালো মাথার পাতি। পাতিগুলো কিছু লোক হয়ে দীর্ঘ সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারে। সমাজের চোখে তারা নেহাত অদরকারি মানব সম্প্রদায়। তুমি যখন ছুরি দিয়ে পিৎজা কাটো স্লাইস স্লাইস করে, তারা তখন নিজের হৃদয়টাকেই কেটে অন্যকে দেয়ার মাহাত্ম্য দেখাতে পারে। নগরের গাছপালা যখন কেটে উজাড় করে নগর পরিকল্পক, তখন আমি নীল ডানার একটা পাখি হয়ে উড়ি এদের আশেপাশেই, কিছুটা অক্সিজেনের তৃষ্ণায়।

এইসব চন্দ্রগ্রস্ত রাতে

এইসব চন্দ্রগ্রস্ত রাতে ঘরের মধ্যে থাকতে নেই, এই সময় ঘরে থাকলে ভূত এসে কাঁধে চেপে বসে। যেতে হয় খোলা মাঠে, ছাদে বা নদীর ধারে- তাও সম্ভব না হলে হাঁটতে হয় পথে পথে। এমন ধবধবে দুধের ক্ষীরের মতো রাতে গ্রামে বসে যাত্রাপালা। দীর্ঘ দীর্ঘ ধানক্ষেত পাড়ি দিয়ে বাচ্চা-বুড়ো যায় পালা দেখতে আর তাদের পিছে পিছে যায় ঝাঁকে ঝাঁকে সারস পাখি। চাঁদ যেন একটা বিশাল থালা, যে থালাভর্তি বাতাসা, মুড়কি, নাড়ু রাখা আছে তাদের জন্য। চাঁদ সবসময় উৎসবের আমেজ দেয়, এমনকি ঘোর যুদ্ধক্ষেত্রেও, ভাঙচুর শহরে ফোটায় চন্দ্রফুল। হঠাৎ মৃদুমন্দ বাতাসে গাছের পাতাগুলো প্রজাপতির ডানার মতো নেচে ওঠে আর আমি ভাবি তোমার শহরেও এমন রাতে সেনাবাহিনী নয়, অতর্কিতে ঢুকে পড়েছে কিছু যাযাবর প্রজাপতি

দরজা খুলে দাও

দরজা খুলে দাও। কিছু শান্তি শান্তি ঠান্ডা বাতাস ঢুকে পড়বে ঘরে। সারাদিন দোয়েল পাখিটা শীষ দিয়ে ডাকে তোমাকে আমগাছে বসে, ঐ পাখিটার সাথে তোমার দেখা হবে। পাখিটা আসলে তোমার ছদ্মবেশী প্রেমিক, যে থাকে সাত সাগর আর চৌদ্দ নদীর ওপারে। সে-ই তোমাকে দেখতে আসে প্রতিদিন দোয়েল পাখি হয়ে। গোধূলির রেণু মেখে সময় নেচে যায় সমুদ্রের নিকটে। গাঙচিলের ডাক বাতাসের দেয়ালের এপাশে ওপাশে ধাক্কা খেতে খেতে পৌঁছে যায় স্বর্গে। স্বর্গ আসলে আমাদের অক্ষত শৈশব- এই বড় হয়ে যাওয়ার কারাগারের একমাত্র গুপ্ত দরজা। সেই দরজা খুলে দিলেই ঢুকে পড়বে শান্তি শান্তি ঠান্ডা বাতাস- তার তোড়ে রাস্তায় ছেঁড়া কাগজ, ধুলো আর পলিথিনের মতো উড়ে যাবে মনের ভার। দরজা খুলে দাও।

ছবি- লুবনা চর্যা

লুবনা চর্যা

জন্ম: ৩ ডিসেম্বর, ১৯৮১, খুলনায়। বেড়ে ওঠা ওখানেই। কৈশোরে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারপর একসময় থিয়েটার ছেড়ে নিজের লেখা ও আঁকার দিকে মনোযোগী হন। মাস্টার্সের পর ঢাকায় বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কপি রাইটার হিসাবে কাজ করেছেন। একসময় সেটাও ছেড়ে দিয়ে এখন সম্পূর্ণভাবে স্বাধীনভাবে লেখালেখি করেন, ছবি আঁকেন, লুবনার বক্তব্য, “নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই…”।

Share