আজ বৃহস্পতিবার, ১৫ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩১শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র: ইসলামী ঐতিহ্যের স্বরূপ সন্ধান

।। মাহমুদুল হাসান মাহিন ফারাজী ।।

আল্লাহর নবী বলেছেন, ‘‘সকল কাজ নিয়ত দ্বারা বিচার করা হবে। নিয়ত অনুযায়ী ব্যক্তি ফল লাভ করবে’ সুতরাং কেউ যদি প্রশান্তি ও শৌখিনতায় লিপ্ত হয়. যার মাধ্যমে সে আল্লাহর আনুগত্য ও তাকওয়াতে সহায়তা লাভ করে, তবে গানবাদ্য শোনাতে পথভ্রষ্টতা কোথা থেকে আসবে?’’

না বুঝে ভেদ-বাতেন, হারাম তোমরা বলছ ক্যান!

সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র: ইসলামী ঐতিহ্যের স্বরূপ সন্ধান


‘গান-বাজনা হারাম’ এই সিদ্ধান্তে কি সকল আলেম একমত? উত্তর হচ্ছে – নাহ। আলেমগণ একমত নন। তাঁদের মতানৈক্য বা ইখতিলাফ রয়েছে। যেমন: ইবনে তাইমিয়া বলছেন: “গান ও বাদ্য শোনা এমন একটি বিষয় যা নিয়ে মানুষের দুইটি মত আছে — হারাম ও বৈধতা।” এইযে ভিন্ন মত – তথা বিভিন্ন আলেমগণ গান-বাজনার বৈধতার পক্ষেও আলাপ করে গেছেন, সেটা না জানা থাকলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। আর যে বিষয়ে ইখতিলাফ (মতভেদ) রয়েছে– সে বিষয়ে ভিন্নমত বা অপর মতামতকে সমান শ্রদ্ধা ও তার সঠিক হবার সম্ভাবনাকে স্বীকার করাই কর্তব্য।

ইমাম শাফেয়ী (রহঃ). এসমস্ত বিষয়ে কথা বলার সময়ে ‘ইজমা হয়েছে’ কিংবা ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ এমন দাবি করার ব্যপারে নিন্দা করেছেন। যে বিষয়ে ইখতিলাফ রয়েছে সে বিষয়ে ‘সকল আলেম একমত’ কিংবা ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ দাবী করা পথভ্রষ্টতা। অধিকাংশ মানুষ ‘না জানা’র কারণে কিংবা ‘অনেকে সেইম কথা বলছে যেহেতু তার বাহিরে কোনও আলাপ নেই, তাই এমন’ মনে করত।

অথচ আমরা বিভিন্ন দলিল খুঁজলে দেখব সঙ্গীত মুসলিম ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি অনুসঙ্গ। রাসূল (সা.) সঙ্গীতকে উৎসাহিত করেছেন–ঈদের দিনে মেয়েদের দফ বাজিয়ে গাওয়া গান শুনেছেন, মদিনায় হওয়া দফ বাজিয়ে ‘তলায়াল বাদরু আলাইনা’ গেয়ে হওয়া তার অভ্যর্থনায় বিমোহিত হয়েছেন কিংবা হযরত আয়েশা (রা.).কে জিজ্ঞেস করেছেন; বরযাত্রীর সঙ্গে গায়িকা পাঠিয়েছেন কিনা!

তেমনইভাবে সাহাবি-তাবেয়ীগণের যুগেও ছিল সঙ্গীত চর্চার প্রবাহ। এমনকী অধ্যাপককে. আলীর বর্ণনায় জানা যায় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কন্য সখিনার (রহ.) গৃহে তৎকালের উন্মুক্ত সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মক্কা-মদিনার বড় বড় গায়ক–গায়িকারা এই আসরে জমা হতো। এই আসরের অন্যতম গায়িকা ‘জামিলা’ প্রথম যুগের ‘শিল্পীরাণী’ বলে পরিচিত ছিলো। আব্বাসীয় আমলের বর্ণনা দিতে গিয়ে অধ্যাপক সাহেব লিখেছেন,

আব্বাসীয় দরবারে সঙ্গীতজ্ঞগণ বিশেষভাবে পুরস্কৃত হইতেন। সঙ্গীত শিক্ষনীয় বিষয় হিসাবে গণ্য হইতো এবং মুসলমান আলেমগণ উহার প্রসংশা করিতেন।

খলিফাগণ ছিলেন সংগীত ও গায়ক–গায়িকাগণের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক, ওয়ালিদ, হিশাম ; উনারা সংগীতের কদর করতেন। আব্বাসীয় খলিফা আল মাহদী নিজেই ছিলেন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ। হারুণ অর রশিদের অধীনে বিখ্যাত একজন সংগীতজ্ঞ ও সুরশিল্পী ইব্রাহিমের মাসিক বেতন ছিল তৎকালীন দশ হাজার দিরহাম এবং তিনি তাঁকে শুধু উপহার’ই দেন সে সময়ের এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার দিরহাম। ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে যে, হারুণ অর রশিদের পৃষ্ঠপোষকতায় এক সংগীতানুষ্ঠানে শুধুমাত্র গান গাইবার গায়কের সংখ্যাই ছিল দুই সহস্রাধিক। খলিফা আল ওয়াসিক এমন সংগীতজ্ঞ ছিলেন, যিনি বীণার ব্যবহার ও শতাধিক সুরের উদ্ভাবন করেছিলেন।

মুহাদ্দিসগণের সঙ্গেও ছিলো গান-বাজনার সুসম্পর্ক। এমনকি বহু মুহাদ্দিস ও ফকিহগণ স্বয়ং সুরশিল্পীও ছিলেন। হযরত আব্দুর রহমান বিন আওফ (রা.) এর পৌত্র হযরত ইব্রাহিম বিন সাদ রাহ. ছিলেন মদীনার একজন বড় ইমাম ও বিখ্যাত মুহাদ্দিস। বেড়ে উঠেছেন রাসুলের শহর মদিনা মুনাওয়ারাতে। খতীবে বাগদাদী তাঁর ‘তারিখে বাগদাদ’ কিতাবে নিজস্ব সনদে বর্ণনা করেন ,

ইব্রাহিম বিন সাদ ১৮৪ হিজরিতে খলিফা হারুনুর রশিদের নিমন্ত্রণে ইরাকে আসেন। খলিফা তাকে সশ্রদ্ধ আপ্যায়ন করেন। তার প্রতি ভক্তি-সম্মান প্রদর্শন করেন। বাগদাদে তাঁকে গানবাদ্যের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি একে হালাল’ বলেন।

হাদিস চর্চাকারীদের (মুহাদ্দিস) একজন তাঁর কাছে আসেন তাঁর আত্মীয় ইবনে শিহাব আয যুহরির হাদিস শুনতে। কিন্তু তিনি এসে দেখলেন যে, ইব্রাহিম বিন সাদ গান গাইছেন। এটা দেখে বলে ওঠেন, ‘‘আমার খুব ইচ্ছা ছিল আপনার কাছ থেকে হাদিস শুনব। কিন্তু এখন যা দেখলাম তার কারণে কোনও হাদিসই শুনব না আপনার থেকে।’’ এর জবাবে তিনি বলেন, ‘‘তুমি চলে গেলে আমি কেবল একজন ছাত্র হারাব। আর আমি নিজের উপর কসম করে নিলাম যে, এই বাগদাদে যতদিন থাকব, ততদিন হাদিসের মজলিস শুরু করার আগে আমি গানবাদ্য করে নিব।’’ তাঁর এই বক্তব্য বাগদাদে রটিয়ে পড়ে। এমনকি খলিফা হারুনুর রশিদের কানে পৌঁছে। তিনি তাঁকে আসতে বলেন এবং কাপড় চুরির কারণে রাসুল যে মাখযুমিয়া নারীর হাত কেটেছিলেন সে হাদিসটি শুনতে চান। এটা জিজ্ঞেস করেই তিনি উদ (বিশেষ বাদ্যযন্ত্র) নিয়ে আসার আদেশ দেন এবং জিজ্ঞেস করেন, ‘‘আপনি কোন উদ দিয়ে গাইবেন? উদে মিজমার নাকি উদে তরব?’’ ইব্রাহিম বিন সাদ খলিফার উদ্দেশ্য বুঝতে পারেন এবং হেসে ফেলেন। আর বলেন, ‘‘আপনি উদে তরব-ই নিয়ে আসুন। হে আমিরুল মুমিনিন! আপনার কানে হয়ত সেই নির্বোধ লোকের ঘটনা পৌঁছেছে যে গতকাল আমাকে কষ্ট দিয়েছিল।’ ’হারুণ অর রশিদ বলেন, ‘হ্যাঁ।’ অতঃপর রশিদকে তিনি উদ বাজিয়ে গান গেয়ে শোনান –

يا أم طلحة إن البين فد أفدا
قل الثواء لئن كان الرحيل غدا

হে উম্মে তালহা! বিরহের সময় এসেছে ঘনিয়ে
সময় বেশি নেই আর, কালই আমায় যেতে হবে বিদেশে

হারুনুর রশিদ প্রশ্ন করেন, ‘‘আপনাদের মদিনার কোনও ফকিহ কি সঙ্গীত অপছন্দ করতেন? তিনি বলেন, ‘‘যাঁদের চিন্তাকে আল্লাহ আটকে রেখেছেন তারা এমন বলে।

এ ছাড়াও ইমাম মালেক রাহ. গান গাইতেন। ইমাম শাবী (রাহ.) ও গান গাইতেন। আবু হানীফা (রহ.)মনে করতেন: ‘শরিয়াসম্মত উপায়ে বাদ্যযন্ত্র থেকে উপকৃত হওয়া সম্ভব।’ তিনি আরও ফতোয়া দেন: ‘কেউ যদি কারো বাঁশি কিংবা বেহালা চুরি করে, তবে তার হাত কেটে দেওয়া হবে। এবং যদি ভাঙচুর করে তবে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’ ইমাম গাজ্জালী বলতেন: ‘সঙ্গীত হচ্ছে স্নায়ু ও মস্তিস্কের খাদ্য।’’ এ ছাড়া ইসলামের ইতিহাসে বহু ইমাম, মুহাদ্দিস, ফিলোসোফার, গবেষক ও লেখক সাহিত্যিকেরা ছিলেন সঙ্গীতের ভক্ত, শুভাকাঙ্ক্ষী ও পৃষ্ঠপোষক।

এমনকী ‘শর্তসহ’ কিংবা ‘কারণবশত’ বহু ওলামায়ে কেরাম গান-বাজনার বৈধতা নিয়ে আলাপ করে গেছেন। যেমন: আবুল মাওয়াহেব শাযেলী (রহ). তাঁর ‘ফারহুল আসমা বিরুখাসিস সিমা’ গ্রন্থে বলেন; শায়খ ইবনুল কাম্মাহ বলেন, ‘শায়খ ইযযুদ্দিন বিন আব্দিস সালামকে সকল বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, তিনি উত্তর দেন, ‘জায়েয।’ এতে শরফুদ্দিন তিলমিসানি (রহ) মিশরের লোকদের বলেন, তিনি মূলত বোঝাতে চাচ্ছেন যে বাদ্যযন্ত্রের হারাম-জ্ঞাপক কোনও বিশুদ্ধ দলিল নবির সুন্নত থেকে বর্ণিত নেই। শায়খ ইযযুদ্দিনের কাছে এই কথা পৌঁছালে তিনি বলেন, ‘‘না। আমি বুঝিয়েছি যে, বাদ্যযন্ত্র বৈধ।”

অন্য একজন আলেম হচ্ছেন হযরত শিবলী (রহ.).। ওনার সম্পর্কেহযরত কাজী ইয়াজ (রহ.) ‘আত তাজ ওয়াল ইকলিল কিতাব’-এ বলা হয়েছে; (শিবলী রহ. এর পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে) বলেছেন যে;,”তিনি সুফিকুলের শায়খ। কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব। ইমাম মালেকের মাযহাবে পারদর্শী ফকিহ ও সুফি।” এই মহান ইমাম শিবলী (রহ)-কে সঙ্গীত চর্চা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,

বাহ্যিক দিক থেকে সঙ্গীত ফিৎনা, কিন্তু আধ্যাত্মিক দিক থেকে সঙ্গীত অনুপ্রেরণা। সুতরাং যে সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে জানে, তার জন্য অনুপ্রেরণা গ্রহণ করতে সঙ্গীত শোনা বৈধ।

শায়খ ইবনে হাজম (রহ.)বলেন;

গানবাদ্যের জন্য সেই হুকুমই প্রযোজ্য হবে যে হুকুম প্রযোজ্য শৌখিন রঙিন কাপড় পরা, মনোরম জায়গায় ঘুরতে যাওয়া ইত্যাদি বিনোদনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।’

আর আল্লাহর নব বলেছেন,

সকল কাজ নিয়ত দ্বারা বিচার করা হবে। নিয়ত অনুযায়ী ব্যক্তি ফল লাভ করবে’ সুতরাং কেউ যদি প্রশান্তি ও শৌখিনতায় লিপ্ত হয়. যার মাধ্যমে সে আল্লাহর আনুগত্য ও তাকওয়াতে সহায়তা লাভ করে, তবে গানবাদ্য শোনাতে পথভ্রষ্টতা কোথা থেকে আসবে?

ইমাম গাজ্জালী (রহ.)-এর ছাত্র শায়খ কাজী আবু বকর ইবনুল আরাবী (রহ. ) বলেন ,

এসব বাদ্যের সুর দূর্বলদের অন্তরকে আকৃষ্ট করে, মন প্রশান্তি লাভ করে। মানসিক ভার হালকা হয়, যা সবার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না। আর এ কারণে মন যদি গানবাদ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়, তবে শরিয়তের পক্ষ থেকে এর অনুমোদন আছে।

ড. ইউসুফ আল কারযাভী – ইবনে হাজম ও ইবনুল আরাবী রহ. এর বরাতে উল্লেখ করেছেন গান হারাম বলে বিবৃত কোনও হাদীস সহীহ নয়৷ এমনকী তিনি শর্তসাপেক্ষে গানকে জায়েজ বলেছেন।

আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের (প্রয়াত) গ্র্যান্ড মুফতি (১৯৮২ – ১৯৯৬) শায়েখ জাদ আল হক রহ. বলেন.

অনৈতিক ও গুনাহ-এর কর্মকাণ্ডের সহিত যুক্ত না হলে, কিংবা সেই বাহানায় মানুষকে হারামের দিকে না টানলে, কিংবা মানুষকে ফরজ ইবাদত (আল ওয়াজিবাত) হতে সরিয়ে (বা ভুলিয়ে) না দিলে সংগীত শোনা, সংগীত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা, এবং বাদ্যযন্ত্র বৈধ।

এভাবে বহু আলেম উলামা ও ফকীহগণ সঙ্গীতের বৈধতা নিয়ে আলোচনা করে গিয়েছেন। মুসলিম দার্শনিক ও গবেষকগণ সেই আব্বাসীয় আমল থেকে সঙ্গীতের উপর লিখালিখি ও গবেষণা শুরু করেন। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) ইহয়ায়ে উলুমুদ্দিন গ্রন্থে বিধিসম্মত ও নিষিদ্ধ সংগীতের একটি বর্ণনা নির্ধারণ করেছেন। হযরত আবুল ফারাজ ইস্পাহানী (রহ.) সঙ্গীতের উপর ২১ খণ্ডের গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি ১০০ প্রকার স্বরলিপি নির্দিষ্ট করেন এবং এসবের মূল প্রকৃতি ও কার্যকরিতা নির্ধারণ করেন। প্রখ্যাত মুসলিম দার্শনিক আল কিন্দি সঙ্গীত সম্পর্কে ৭টি বই লিখেছেন। তারমধ্যে মাত্র ৩টি বই পাওয়া গিয়েছে।

আল ফারাবী ছিলেন তৎকালের শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ এবং আধুনিক কালের জন্যও তার সঙ্গীত বিষয়ক বিদ্যা প্রাসঙ্গিক। তিনি তৎকালে গ্রীক সঙ্গীতের ভ্রান্তিগুলো দেখিয়ে দিয়েছিলেন। যা মুসলমানদের অগ্রগতির অন্যতম নিদর্শন হিসেবে এখনও গণ্য হয়ে থাকে। তৎকালে ইখওয়ানুস সাফা নামে একদল লেখকের উদ্ভব ঘটে। মুসলিম ইতিহাসে তাঁরা সঙ্গীত সংক্রান্ত লেখালেখি করে বিশেষ আলোচিত হন। আল খাওয়ারিযমি তার ‘মিফতাহুল উলুম’ গ্রন্থেও সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করেন। সঙ্গীতে ইবনেসিনার প্রভাব ছিলো অনেক বেশি, তিনি সঙ্গীতের সাহায্যে চিকিৎসাও করাতেন; তিনি সংগীতশিল্পের একটি ভূমিকা লিখেছিলেন। এছাড়া মুসলিমদের হাত ধরেই তৎকালেই ইউক্লিডের সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থ ‘কিতাবুল মুসিকী আল কাবীর’ গ্রন্থ আরবীতে অনুদিত হয়। ‘কিতাবুন নঘম’ নামেও আরবীতে ইউক্লিডের সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থ ছিল।

বিস্তর আলোচনা থেকে এতটুকু স্পষ্ট হওয়াই যায় যে, যেহেতু সঙ্গীত আলেম উলামা, খলিফা, মুসলিম চিন্তাবিদ, সুফি, ফকিহ, গবেষক ও লেখক সবার কাছে সমানভাবে সমাদৃত ছিল, সেহেতু এটা অসম্ভব যে তৎকালে সঙ্গীতকে ‘হারাম’ গণ্য করা হতে পারে বা সঙ্গীত বিষয় বিতর্কগুলোতে মানুষ লিপ্ত ছিল। যদি তাই হতো, শাসক, আলেম, ফকীহ, সুফি, গবেষক ও দার্শনিক সবার একই সাথে সঙ্গীত নিয়ে এতটা আগ্রহ পোষণ করার কোনও কারণই থাকতোনা। কিন্তু সে সময়ে সংগীত চর্চা ও সঙ্গীত বিষয়ক জ্ঞানকে সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে বিবেচনা করা হতো।

তাহলে এই সঙ্গীত বৈধ কি অবৈধ – হালাল কি হারাম জাতীয় বিতর্কের অতি বিকাশের কারণ কি? কেন মানুষ সঙ্গীত প্রসঙ্গ আসলেই হালাল নাকি হারাম বিতর্কে লিপ্ত হয়? এর জবাবে বলা যায়- ১২৫৮ সালে বাগদাদ পতনের মাধ্যমে খেলাফতের পতন ঘটে এবং সে বাগদাদ ধ্বংসের ঘটনা আমরা সবাই জানি। হালাকু খান বাগদাদের লাইব্রেরি ধ্বংস করে মুসলিম বিশ্বকে পঙ্গু করে দেয়। অধ্যাপক কে. আলী লিখছেন; “বাগদাদের পতনের পর সঙ্গীততত্ত্ব সম্পর্কে শ্রেষ্ঠ লেখকদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়। একদল আইন প্রণয়নকারী তাহাদের (শ্রেষ্ঠ লেখকদের) স্থান দখল করিয়া সঙ্গীতের বৈধতার স্বপক্ষে ও বিপক্ষে বিতর্কে লিপ্ত হন।” সে আলোকে আমরা বলতে পারি- শ্রেষ্ঠ লেখকদের রচনাগুলো ও জ্ঞানগুলো আমাদের কাছে থাকলে হয়তো আমরা আরও আলোকিত হতাম ও সঙ্গীত বিষয়ক অজ্ঞতা দূরীভূত হতো; এবং অকারণ বিতর্কের প্রয়োজনীয়তা বিলোপ হত। আমাদের দূর্ভাগ্য যে আমাদের হাতে সে জ্ঞানসমূহ অর্জনের রিসোর্স খুবই কম।

আবার এই হারাম মত প্রসার লাভের আরেকটি কারণ হতে পারে। শেখ সাদী সাহেব ইবনে তাহের আল কায়সারানি (রহ.)-এর বই আস সিমা’ লি ইবনিল কায়সারানি হতে অনুবাদ করছেন; এই যে ইব্রাহিম বিন সাদ থেকে যারা হাদিস বর্ণনা করেছেন তাঁরা ছিলেন পরবর্তী সময়ে ইলমের জগতের হর্তাকর্তা। তাঁরা ইব্রাহিম বিন সাদের সঙ্গীত শোনার পরই কেবল হাদিস শুনেছিলেন। তাঁরা সবাই জানতেন যে, তিনি গানবাদ্যকে জায়েয বলেন।

আর এই ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন উম্মতের আশাভরসার পাত্র মহান এবং যিনি খোদাভীরুতায় একজন কিংবদন্তী ছিলেন। তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন আবু আব্দিল্লাহ আহমদ বিন মুহাম্মদ বিন হাম্বল। ইব্রাহিম বিন সাদ গান না শুনিয়ে হাদিস শোনাবেন না এমন প্রতিজ্ঞার পরেই তিনি তাঁর কাছ থেকে হাদিস শুনেছিলেন। কোনও ধরণের সন্দেহ ছাড়াই বলা যায় যে, আহমদ প্রথমে তাঁর গান শুনেছেন, অতঃপর তার হাদিস শুনেছেন- আর এই গানবাদ্য তো এমন বিষয় যার হালাল কিংবা হারাম মর্মে কোনও সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই যার আলোকে একটি অকাট্য হুকুম দেয়া যাবে। সুতরাং একে এর (আদি বিধান) বৈধতার উপর ছেড়ে দেয়া হবে।

পূর্ববর্তীদের মধ্যে যারা গানবাদ্য পরিহার করেছিলেন তারা মূলত দুনিয়াবিরাগ থেকে তা করেছিলেন। যেভাবে আল্লাহর রাসুল মসৃণ কাপড় পরা, উপাদেয় খাদ্য খাওয়া, শীতল পানি পান, সুন্দরী নারীদের সঙ্গ উপভোগ ইত্যাদি পরিত্যাগ করেছিলেন। আর জানা কথা যে, এগুলো সবই তার জন্য হালাল ছিল। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দব্ব (গিরগিটি সদৃশ মরুভূমির সরিসৃপ) খাওয়া ত্যাগ করেছিলেন। তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হয় ‘এটা খাওয়া কি হারাম?’ তিনি বলেছিলেন, ‘না, বরং আমার অঞ্চলের মানুষজন এটা খায় না তাই আমার রুচি হয় না।’’ অতঃপর রাসুলের সামনেই মানুষজন দব্ব খায়।

নবী যুগের পরে যে প্রজন্ম আসেন তারা এসব বিষয়ে কঠোরতা করেন যাতে মানুষ উত্তম বিষয়গুলো ছেড়ে এসবে মশগুল না হয়ে যায়। কিন্তু তাদের পর যারা আসে তারা অজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে গানবাদ্যকে হারাম ঘোষণা দিয়ে বসে যাতে মানুষের মাঝে দুনিয়া বিরাগী সাধু হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ হয়। তাঁরা এই বিষয়টির প্রকৃত অবস্থা এবং পরিপ্রেক্ষিত অনুধাবন করতে পারে নি। মহান আল্লাহই সঠিক বিষয়ে অধিক জ্ঞাত।

ড. ইউসুফ আল কারযাভীও এই ‘গান হারামের’ বা গানের বিষয়ে কঠোরতার জন্য পরবর্তীদের ‘অধিক সাবধানতা’ ‘কঠোর’ ও ‘কষ্টকর’ নীতি অবলম্বনকে দায়ী করেন। তিনি বলেন; “পরবর্তীরা সাবধানতার নীতি বেশি অবলম্বন করে থাকেন, এবং যাঁরা সাহাবিদের যুগের ফতোয়াগুলো দেখবে তারা দেখবে যে পরবর্তীতে ফকীহগণ সাহাবীদের সময়ের চেয়েও বেশি কঠোরতা অবলম্বন করেছেন।’’ পাশাপাশি কারযাভী সাহেব ‘গানকে হারাম বলা কিংবা গানের ব্যপারে কঠোর হওয়ার’ কারণ হিসেবে বলেছেন- পরবর্তী ফকীহগণ জাল হাদীসের খপ্পরে পড়েছেন। এবং সনদ বাছাইয়ের যোগ্যতা না থাকায় তারা এমন জাল হাদীসের গোলকে আটকে গেছেন, কেননা অসংখ্য জাল হাদীস একে অপরকে শক্তিশালী করেছে।
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে উত্তম বিচার-বুদ্ধি দান করুক। আমীন।

তথ্যসূত্র:

১। মুসলিম সাংস্কৃতিক ইহিহাস: কে. আলী।
২। আরব জাতির ইতিহাস: পি.কে. হিট্টি।
৩। দফতরে সাদী: শেখ সাদী (ব্লগ)
৪। ইসলামে হালাল হারামের বিধান: ইউসুফ আল কারযাভী।
৫। ইসলাম ও শিল্পকলা: ইউসুফ আল কারযাভী

মাহমুদুল হাসান মাহিন ফারাজী


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে স্নাতকোত্তর করছেন। কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন। ২০২১ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ গণকের বিয়াল্লিশ গণনা।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top