আজ বৃহস্পতিবার, ১৫ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩১শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

নতুন মাত্রার বলপ্রয়োগ বনাম ঐতিহাসিক প্রতিরোধ

।। সম্পাদকীয় প্রতিবেদন ।।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিশুকিশোররা সক্রিয় অংশগ্রহণ করছেন। ছাত্রীদের রাজাকার তকমা দেওয়ার পর হিংস্র হামলার দ্বারা বলপ্রয়োগের নতুন মাত্রা ও নতুন লক্ষ্যবস্তু দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ অতীতে ছাত্রী বা শিশুকিশোর ডাকসু নির্বাচন বা সড়ক আন্দোলনে যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন এবার তাদেরও আক্রমণযোগ্য আকারে আরও স্পষ্ট চিনায়ে দেওয়া হল। নতুন মাত্রার বলপ্রয়োগের ইঙ্গিত জারি হল। এই বলপ্রয়োগ, এই জুলুমশাহি, এই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছাত্ররা লড়ছেন, যুব সম্প্রদায় লড়ছেন। তাঁদের লড়াইয়ের সঙ্গে সংহতি রইল বড় বাংলার ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার।

নতুন মাত্রার বলপ্রয়োগ বনাম ঐতিহাসিক প্রতিরোধ

চাকরি দরকার। সরকারি চাকরি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য কোটা বরাদ্দ রাখার ফলে সরকারি চাকরি পাবার সুযোগ সীমিত। তাই আন্দোলন। ফলে অরাজনৈতিক ও ছাপোষা বলেই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে দেখার একটা চল আছে। সরকারি আমলা হবার বাসনার পেছনে দুর্নীতির প্রতি আকর্ষণ ও দ্রুত বড়লোক হবার সুযোগের প্রতি লিপ্সাও থাকতে পারে। কিন্তু এভাবে দেখাটা কি পর্যাপ্ত? কারণ আন্দোলন মাত্রই সমাজের নানান ভেদচিহ্নগুলো সামনে হাজির করে। শ্রমিক আন্দোলন কিংবা জাতীয় আন্দোলনও অনেক সময় অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া নিয়ে শুরু হয়। দাবি মেনে নিলে সেসব আন্দোলন নিভেও যেতে পারে। কিন্তু তার একটা রাজনৈতিক ও সামাজিক জের থেকে যায়। সেটা বোঝার বিষয়। একালের কোটা সংস্কার আন্দোলনও তেমন। আখেরি পুঁজির যুগে মানুষের যে নিখিল নাজুকতা ও প্রিক্যারিটি — তার এক অস্ফূট বন্দিশ এই আন্দোলনের প্রাণে বেজেছে। আমরা শুনছি কিংবা শুনছি না।

শব্দের রাজনীতি

দাবিটা প্রায় নিরীহই। সরকারি চাকরিতে কোটা কতটুকু থাকবে না থাকবে সেই আলাপ। কিন্তু ঘটনা সেখানে সীমাবদ্ধ থাকে নি। আন্দোলন উস্কেছে দফায় দফায়। শব্দের উস্কানি সাধারণের প্রাণকে বিচলিত করেছে। 

সরকারপ্রধান প্রশ্ন তুললেন যে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা (কোটায় চাকরি) না পেলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে? এই বক্তব্যের প্রতিবাদে ছাত্রছাত্রীরা ১৪ জুলাই রাত থেকে হলে ও রাস্তায় স্লোগান ধরে: “আমি কে তুমি কে রাজাকার রাজাকার,” সেই সঙ্গে “কে বলেছে কে বলেছে সরকার সরকার” অথবা “কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার” ইত্যাদি স্লোগান।  

রাজাকার শব্দটির এক ব্যবহার দেখা গিয়েছিল উপমহাদেশ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান দুই রাষ্ট্র হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে নেহরুর সেনাবাহিনী যখন হায়দারাবাদ দখল করতে যায় – তখন নিজামের পক্ষে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী রাজাকার নাম ধারণ করেছিল (এ বছর ভারতে তেলুগু ভাষায় “রাজাকার” নামে একটি ছবি বেরিয়েছে নেহরুশাহির অপারেশন পোলো নিয়ে — ছবিটিকে ভারতের অনেকে হিন্দুত্ববাদী বয়ান বলে শনাক্ত করেছেন।) কিন্তু শব্দটি একটি ঘৃণিত শব্দ হয়ে দাঁড়ায় তার কিছুকাল পরে পূর্ব বাংলার ইতিহাসে: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সরকার পূর্ব বাংলার মুক্তিকামী মানুষের উপর গণহত্যা ও নিপীড়ন চালানোর সময় যে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী সরকারিভাবে নিযুক্ত করে তাদের নাম দেওয়া হয় রাজাকার। বেসরকারি ঘাতক আলবদরদের পাশাপাশি এই রাজাকার বাহিনী পাকবাহিনীর হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডে সহযোগী ছিল। ফলে সঙ্গত কারণেই গণহত্যার সঙ্গে রাজাকার আলবদর শব্দগুলো জড়িত হয়। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনে “রাজাকারের ফাঁসি চাই” ধরনের স্লোগান বহুল ব্যবহৃত হয়। 

তবে নিকট অতীতে রাজাকার শব্দটির  যথেচ্ছ রাজনৈতিক ব্যবহার আমলে না নিলে সাম্প্রতিক এই স্লোগান বিতর্ক বোঝা সম্ভব নয়। গত দেড় দশকে ব্লগ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সামাজিক পরিসরে প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করতে তাকে রাজাকার, জামাতশিবির, ছাগু ইত্যাদি ট্যাগ দিয়ে তাকে নিধনযোগ্য করে তোলার রাজনীতি জোরাল হয়ে ওঠে। এর পেছনে নানা সামাজিক আলামত ছিল বৈকি। রাজনৈতিক বিভাজন ও জীবনযাত্রার অনুশাসন বিষয়ক বিরোধকে পরিচয়বাদ ও সাংস্কৃতিক রাজনীতির দ্বারা মোকাবেলার চেষ্টা করার কথা হয়তো অনেকে ভেবেছিলেন। তবে সেই চেষ্টা সেই জায়গায় থাকে নি। রাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতার একচ্ছত্রকরণের চেষ্টা এবং দেশিবিদেশি একচেটিয়া পু্ঁজির বিকাশের আবর্তে পড়ে এক বিষাক্ত ও অমোঘ পরিণামের দিকে অগ্রসর হয় এই সাংস্কৃতিক রাজনীতি।

এর একদিকে “নাস্তিক ব্লগার”দের কতলের জন্য এক শ্রেণির খারিজির উস্কানি, আরেকদিকে ক্ষমতাবানদের দলীয় রাজনৈতিক জায়গা থেকে শিবির বা রাজাকার ইত্যাদি বর্গকে নিধনযোগ্য বর্গ করে তোলা হয়। তার রক্তাক্ত পরিণতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে বিশ্বজিৎ হত্যা কিংবা আবরার হত্যার ফলে। নাস্তিকতার দায়ে অভিজিৎ রায় বা অনন্ত বিজয়ের হত্যা যেমন ঘটে আবার রাজাকার তকমায়নেরও শিকার হয় অনেকে। 

এই প্রেক্ষিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সরকারের কর্তা যখন রাজাকারের নাতিপুতির প্রসঙ্গ টেনে আনেন, তা এই নিধনযোগ্যতার সম্ভাবনাই ইশারায়িত করেছিল। অর্থাৎ রাজাকার নামক তকমার আঁটুনিতে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের সন্ত্রস্ত ও ঘায়েল করার চেষ্টা। কিন্তু বজ্র আঁটুনিতে গেরো গেল ফস্কে। ছাত্রছাত্রীরা এই তকমার অপব্যবহারে ভীত না হয়ে বরং বিদ্রূপাত্মক প্রতিবাদে বলে উঠল, “তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে সরকার সরকার/ স্বৈরাচার স্বৈরাচার।” অমনি রাজবুদ্ধিজীবীরা কাউকাউ শুরু করলেন যে “রাজাকার বলেছে রে রাজাকার বলেছে নিজেদের।”

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ স্লোগানও আন্দোলনকারীরা তুলেছে: “দেশটা কারো বাপের না।” দেশকে নিজের বাপের জাগীর মনে করা, কিংবা বংশীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে কিছু মানুষের তালুক বা প্রাগাধিকার আকারে দেশকে গছানোর রাজনীতিটাকে অন্তত চিহ্নিত করেছে মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের যথেচ্ছ রাজনৈতিক ব্যবহারের আকরণ-প্রকরণ মানুষ শনাক্ত করতে পেরেছে।

মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলার সকল মানুষের নতুন রাজনৈতিক সমাজ গঠনের দ্বারা, সাম্য মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের রাজনৈতিক বাসনাকে মূর্ত করে তুলতে গণকর্তৃত্বের আমল। যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন তারা এই রাজনৈতিক আমলেরই সামরিক প্রায়োগিকতায় শরিক হয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে সামন্তবাদী কায়দায় মুক্তিযুদ্ধকে কিছু খাস ব্যক্তির দ্বারা নিষ্ক্রিয় “অনিচ্ছুক” জনগণকে দেওয়া দান বা ভিক্ষা আকারে উপস্থাপনের রাজনীতি শুরু হয়। এই দান ও কৃতজ্ঞতা সম্পর্কেরই অনুসিদ্ধান্ত আকারে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ওয়ারিশিকে সনদধারীদের মৌরসি পাট্টা আকারে শনাক্ত করে, বাদবাকি জনগণকে দুধভাত কাঁচুমাচু প্রজা আকারে অবসিত করা শুরু হয়। জনসাধারণকে অশিক্ষিত বাঙ্গু, মূর্খ, ধর্মান্ধ, হাইল্যা, ফকিন্নি ইত্যাদি বলে অসম্মানিত করার দ্বারা তাদের রাজনৈতিক কর্তাসত্তার অস্বীকৃতি পোক্ত করা হয়। বিপরীতে শাসনের চিহ্নতন্ত্র হয়ে ওঠে কোন খাস কর্তার ব্যক্তিগত রাগ-বিরক্তি-অনুগ্রহ, বোঝা ও ভুল বোঝানো, দান-ধ্যান ইত্যাদির মামলা। খাস কর্তার ইস্থেটিক্স বা অনুভবতন্ত্রই হয়ে ওঠে রাজনীতি ও প্রশাসনের সারবস্তু। এ রাজনীতিতে গণ কর্তা হয় না৷ বরং নাচুনি আম হয়ে ওঠে। সে কর্তা-প্রযোজিত গণতামাশার ক্রীড়নক মাত্র। 

আদতে মুক্তিযুদ্ধের ভিত ছিল গণের রাজনৈতিক বাসনা ও গণকর্তৃত্ব। অস্ত্র জমা দিলেও গণকর্তৃত্ব জমা দেওয়া যায় না। তা প্রচ্ছন্ন, বিভক্ত বা শৃঙ্খলিত হতে পারে৷ কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ উত্তরাধিকারই হল এই যে, গণের রাজনৈতিক বাসনা ও কর্তৃত্ব কোন প্রভু বা জমিদারের তোয়াক্কা করে না। 

ফলে শব্দ নিয়ে খেলা করা, তার অর্থ নিয়ে এদিকসেদিক করা কারো খাস তালুক না। প্রাচীন রোমে hostis publici তথা গণশত্রু তকমার যে রাজনৈতিক ব্যবহার, তার নানা সিলসিলা আমরা আধুনিক রাষ্ট্রের রাজনীতিতেও হামেশা দেখতে পাই। ভারতে শাসকগোষ্ঠী এন্টিন্যাশনাল শব্দটি দিয়ে প্রতিপক্ষকে নিধনযোগ্য করে তোলে। বাংলাদেশে রাজাকার শব্দের অপপ্রয়োগ এধরনেরই একটি আমল। এই শব্দের মতলবি প্রয়োগকে জনসাধারণ বোধহয় নস্যাৎ করেছে।

নীতির নাড়াচাড়া

আন্দোলন নিয়ে ক্ষমতাবানেরা নানা নাড়াচাড়া করে থাকে। এই প্রসঙ্গে “পেন্ডুলাম নীতি” নামক কৌশলটি নিয়ে দুই কথা বলা দরকার। ২০১৮ সালেও কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল। আন্দোলনকারীদের উল্লেখযোগ্য অংশ কোটা বাতিল নয় বরং সংস্কার চেয়েছিল। তখন সরকার হুট করে কোটা সংস্কারের পরিবর্তে একেবারে বাতিল করে দেয়। ২০২৪ সালে এসে আদালত সরকারের সেই পরিপত্র নাকচ করে দেয়ার পর কোটা সংস্কার আন্দোলন নতুন করে শুরু হয়।

ছাত্ররা চেয়েছিল সংস্কার। কিন্তু সরকার দিয়েছিল রাতারাতি কোটা বাতিল করে। এই অতিবাড় সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হয়েছিল এ সম্পর্কে সম্প্রতি সরকারপ্রধান বলেছেন: “একবার তারা এ ধরনের আন্দোলন করছিল। আন্দোলন তো না সহিংসতা। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করেছিল। তখন আমি বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম সব কোটা বাদ দিয়ে দিলাম। তখনই বলেছিলাম যে কোটা বাদ দিলে দেখেন কী অবস্থা হয়। এখন দেখেন কী অবস্থা তৈরি হয়েছে?” 

অর্থাৎ বিরক্ত হয়ে, দেখিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য থেকে কোটা বাতিল করা হয়েছিল। পেন্ডুলামের দোলন তার ভরকেন্দ্র থেকে একবার এদিক আরেকবার ওদিকে নাড়া খাওয়ার ফলে এক নিত্য অস্থিতি বিরাজ করে। যেকোন আন্দোলন বা গণদাবিকে একটি সুস্থিত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাধানে মীমাংসিত না করে, নানা চরম সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে অমীমাংসা জারি রাখা একটি কূটনীতি আকারে ক্ষমতাবানেরা প্রায়ই আমল করেন দেখা যায়। আন্দোলনকারী বা প্রতিবাদী শক্তির ন্যায়ের অবস্থানে অটল থাকাই সম্ভবত এ সকল মতলবি লাড়াচাড়ার একমাত্র নিদান।

ইশারাসঙ্কুল

১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে শাসক দলের ছাত্র সংগঠন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শত শত ছাত্রছাত্রীকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। এই নির্মম নির্যাতনের ফলে নিছক কোটা সংস্কারের দাবি ছাপিয়ে এই আন্দোলন নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। 

আক্রমণের পটভূমি প্রস্তুত হয় আগে থেকেই। এর আগের দিন রাত থেকেই সরকারপক্ষীয় নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা “রাজাকার” স্লোগান দেওয়ার কারণে জবরদস্তি ও দমনের আদেশ, নির্দেশ, হুমকি, হ্যাজ, কেত্তন শুরু করেন। 

১৫ জুলাই দুপুর বেলা সরকারপ্রধান এক অনুষ্ঠানে বলেন, “আমার খুব দুঃখ লাগে, যখন শুনি— রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও বলে, তারা রাজাকার। তারা কি জানে, ’৭১ সালের ২৫ মার্চ সেখানে কী ঘটেছিল। ৩০০ মেয়েকে হত্যা করেছিল। ৪০ জনকে ধর্ষণ করেছিল, এদের ধরে পাকিস্তানি ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল।… এসব অত্যাচার, রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকা—এরা দেখেনি। তাই নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জা হয় না।”

এই ভাষণ প্রচারের কিছু পরে বিকাল বেলা ছাত্রলীগ ও বহিরাগতেরা লাঠি রড অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রী আহত হয়। রক্তাপ্লুত ছাত্রছাত্রীদের ছবি সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। 

রাজনীতিতে ইশারার প্রতীকী গুরুত্ব কম নয়। নিকট অতীতে শাহবাগ আন্দোলন শুরু হয় একটি ভি চিহ্ন দেখানোর প্রতিবাদে। হেফাজত আন্দোলন বেড়ে ওঠে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্টের প্রতিক্রিয়ায়। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন তীব্র হয় দুর্ঘটনায় ছাত্র নিহতের পর টিভি অনুষ্ঠানে এক মন্ত্রীর হাসিতে। 

চিহ্নে বা ইশারায় মানুষ রাগে কেন? মানুষ নানা বৈষম্য ও বঞ্চনার ভেতর বাস করে, কিন্তু মানুষ হিসাবে তার মর্যাদাকে অপমান করলে কখনো কখনো সে ফুঁসে ওঠে। এই ফুঁসে ওঠার অভিব্যক্তি অধিক অর্থময় হয় যখন প্রতিবাদী মানুষ তার বঞ্চনা ও নিপীড়নের কারণ শনাক্ত করতে পারে। 

কোটা সংস্কার আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিশুকিশোররা সক্রিয় অংশগ্রহণ করছেন। ছাত্রীদের রাজাকার তকমা দেওয়ার পর হিংস্র হামলার দ্বারা বলপ্রয়োগের নতুন মাত্রা ও নতুন লক্ষ্যবস্তু দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ অতীতে ছাত্রী বা শিশুকিশোর ডাকসু নির্বাচন বা সড়ক আন্দোলনে যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন এবার তাদেরও আক্রমণযোগ্য আকারে আরও স্পষ্ট চিনায়ে দেওয়া হল। নতুন মাত্রার বলপ্রয়োগের ইঙ্গিত জারি হল।

এই ইঙ্গিতের তাৎপর্য কম নয়। সরকারের ক্ষমতার সামাজিক ভিত ও সায় তৈরির ক্ষেত্রে শূন্য দশক থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত লেখক বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের ভূমিকা ছিল বিরাট। যেকোন ক্ষমতার পক্ষে ভাবাদর্শিক একটি তন্ত্র জারি থাকলে সুবিধা। এই ভাবাদর্শতন্ত্রটি বান্দাকে ভাবের জায়গায় গ্রেফতার বা ইন্টারপেলেশন করার দ্বারা তার অন্তরে-বাহিরে বিশেষ ধরনের কল্পকাঠামো জারি রাখে, যা বিদ্যমান শাহির পক্ষে সায় আকারে কাজ করে। 

বাছা বাছা শব্দ বা তকমাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিপক্ষ বা সমালোচকদের ঘায়েল করার অস্ত্র আকারে ব্যবহার করার যে আমল, তা এই ভাবগত গ্রেফতারি ও বান্দা-শাসনেরই একটি রাজনৈতিক কারুকৌশল। কিন্তু অতিব্যবহারে জীর্ণ এই সকল বজ্রশব্দের আঁটুনি আজ যেমন ফস্কা ও নস্যাৎ হয়ে গেছে, তেমনই বলপ্রয়োগের লক্ষ্যবস্তু আকারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের উপর হামলা ওই ভাবাদর্শিক কাঠামোর আমরা-ওরা ভেদরেখার কল্পকাঠামোকে নাচারিতে ফেলে দিয়েছে। 

নাইন-ইলেভেন পরবর্তী জমানায় মাদ্রাসার ছাত্রদের অপর আকারে চিহ্নিত করা সহজ হয়েছিল। রাজনৈতিক ডামাডোলে বিরোধী দলীয় কর্মী কিংবা বামপন্থী প্রতিবাদী ছাত্রদের মারলে সেখানে আমরা-ওরা বা আত্মপরভেদ জারি করতে মোটামুটি পেরে উঠত ভাবাদর্শতন্ত্র। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের উপর এমন হামলার পর সমাজের অপেক্ষাকৃত অরাজনৈতিকমনস্ক, সাতেপাঁচে না থাকা সুশীল মানুষেরাও প্রতিবাদ করেছেন, নিজেদের এর বিরুদ্ধে শনাক্ত করতে পেরেছেন। তবে এটাই সব মুশকিল আসান নয়। 

ডিজিটাল জমানায় রাজনৈতিক কারুকৌশলে প্রতিবাদের ন্যূনতম অভিব্যক্তিও নখদর্পণ করা সম্ভব। প্রশাসনের উল্লম্ব নজরদারি ও সমাজ-জালের আনুভূমিক নজরদারি, খতিয়ান (প্রোফাইলিং), নানাভাবে শাস্তি ও হেনস্থাকরণ ও খারিজ/ক্যান্সেল ইত্যাদি সম্ভব হয়ে ওঠার ফলে অর্থনৈতিক বা সামাজিক জীবন মূলত রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিসরের বাইরে আলাদা নিয়মে চলে না। ফলে জনগণের আমল কিভাবে একালে উৎপাদিত, প্রচারিত, সঞ্চালিত, নিয়ন্ত্রিত ও এলগোরিদমিত হয় — তা নিয়ে বিবেচনা জরুরি যেকোন গাঠনিক রূপকল্পের জন্য। 

চাকরি দরকার। কিন্তু জনগণ যে চাকর নয়, কর্তা –  সেটাই হয়তো মর্মবস্তু। বাকিটুকু দেখার অপেক্ষা।

পোস্টার গ্রাফিক্স: শিল্পী দেবাশীষ চক্রবর্তী, ঢাকা

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top