পৃথিবীর ঘাস বিছায়ে আছে সময় ফুরাবে বলে

।। সিফাত বিনতে ওয়াহিদ ।।

।। সিফাত বিনতে ওয়াহিদ ।।

তারপর দেহ কেন মিলেছিল দেহের ভেতর—
এমন প্রশ্ন শুনে স্বর্গ থেকে পতিত হয় করুণ গন্ধম ফল
তারই তলে, পৃথিবীর ঘাস বিছায়ে আছে সময় ফুরাবে বলে
দেহ ঝরে, তার আগে ঝরে যায়, বনি আদমের মন।

একটা ছেলে

এইসব ওয়েদার কত কি ডিমান্ড করে, জানো?
এমন আমন্ত্রণে ছেলেটা হঠাৎই সিরিয়াস হয়ে উঠে। একটা নীল শার্ট আর কালো ট্রাইজারের ভেতর ঘন ঘন দমকা হাওয়া এসে বিদ্যুৎ চমকায় যেন। দু পাশে এমন বর্ষা-বাদলে লোহার রথ টেনে ভিজে উঠছে মাটি। ছেলেটার পায়ে কাদা। ক্রমাগত নিঃশ্বাস ভারী করে ট্রিগার চেপে বলে ওঠে, ‘কিন্তু এ রকম লক্ষ ফুলকির ঝাঁক আপনি তো দেখে অভ্যস্ত!’

এমন প্রশ্নে কয়েক সেকেন্ড থমকায় বৃষ্টির ছাঁট। ধীরে দম নিয়ে বলি- ‘এই তো পৃথিবী! তুমিও উড়াও, যত খুশি ফুলকির ঝাঁক উড়ে আসতে চায়, তারে উপেক্ষা না করে’। বুঝি তার সারাদেহে ঘুরে বেড়াচ্ছে শয়ে শয়ে উইপোকা। তীরবেগে ঝড় ছুটছে রঙিন সি-বিচে। এমন পত্র নিবেদনে থরথর বয়সের শুদ্ধ-বিশুদ্ধের দোলাচালে থেমে থেমে কাঁপছে সামাজিক সাইক্লোন।

শুকনো কণ্ঠে সে বলে ওঠে আবার, ‘আপনার বুকের জমিতে ভীষণ বাদ্য আছে বাজাবার। অনেকেই বাজে, বাজাতে না পারার আফসোস থাকে কারো কারো। আপনি কি ভালোবাসতে পারেন কখনো?’

বৃষ্টি থেমে আসছে। খুব স্মিত হাসি মুখে, জমে থাকা মেঘ সরাতে সরাতেই ছেলেটাকে শেষ কথা বলি – বাসি তো। এই তো এই মুহূর্তে যেমন তোমাকে বাসছি। এমন আরো আরো ভালোবাসাবাসি আসে; ফের চলে যায়, যাবে। মুহূর্তগুলো সরে গেলেই ধীরে ধীরে আমি দূরতম শূন্যে চলে যেতে জানি…

৫ জুন, ২০২১। বনশ্রী, ঢাকা।

অতঃপর তাহারা

(“We should meet in another life; we should meet in air, me and you.” ― Sylvia Plath)

আমরা বসেছি অপরের মুখোমুখি
আমরা হেঁটেছি কিছু দূর পাশাপাশি
আমরা হেসেছি আলোঝরা কোনো ঋণে
আমাদের এই অন্ধকারের দিনে।

দুজনে কি তবে বদল করেছি হাওয়া?
আমাদের এই নিয়মিত আসা-যাওয়া
এসবের তাই অর্থ কিছুটা আছে
কী যেন মায়া টেনে ধরে রাখে পাছে।

আমরা পারিনি দিতে আমাদের নাম
আমাদের ছিল এইটুকু পরিণাম
আফসোস তবু রাখিনি তো বুকে কিছু
আমি আসলেও ‘আপনি‘ও আসে পিছু।

আমাদেরও হবে যেতে কোনোদিন চলে
কথা নিভে যায়, শব্দরা পুড়ে পুড়ে
কেউ ভালোবাসে, কেউ থাকে খুব চুপ
ছোঁয় না সমান বেদনার সে অ-সুখ।

আমরা কী চাই, আমাদেরই আছে জানা?
দুদিকে বিশাল দেয়াল মেলছে ডানা
ফুরালে সময় মুগ্ধতা, হাসা-হাসি
আমরা ভীষণ ব্যস্ত বলতে, ‘আসি‘!

২৯ মার্চ, ২০২২। পি.সি কালচার, শ্যামলী, ঢাকা।

পাপ আর পুণ্যের মাঝে তুমি ফুটে থাকো গন্দম ফুল

“Alone, alone, all, all alone/Alone on a wide wide sea/And never a saint took pity on/My soul in agony.”― Samuel Taylor Coleridge)

তারপর দেহ মিলায়ে গেলে দেহের ভেতর
মলিন হয় মন,
দূরে ঢেউয়ের গর্জন
তুলে ডেকে নেয় সমুদ্রের পারে
আমারে চায়নি যে কোনোদিন,
ভালোবেসে তারে কেটে যায়- পৃথিবীর রাত থেকে দিন।

জানি, একদিন চলে যাবে সবই
যাবো আমি, যাবে চলে সেও
তবু তার পায়ের আঙুল বেয়ে থেমে থাকে-
নক্ষত্র রঙিন।
তবে কি তাই, যে পথে অদৃশ্য হয় ছায়া
সে পথে কান পেতে শুনি- হরপ্পার আদিম ধ্বনি?

তারপর দেহ কেন মিলেছিল দেহের ভেতর—
এমন প্রশ্ন শুনে স্বর্গ থেকে পতিত হয় করুণ গন্দম ফল
তারই তলে, পৃথিবীর ঘাস বিছায়ে আছে সময় ফুরাবে বলে
দেহ ঝরে, তার আগে ঝরে যায়, বনি আদমের মন।

জানে ঈশ্বর আমারে দিয়েছে ভয় যিনি,
দিয়েছে তিনিই- ভালো বাসবার ক্ষমতা আরো
আমি মেঘ পশ্চিমের আঁধার-কালো
প্রার্থনার ভাষা জানি, জানি- প্রেমও প্রার্থনাসম।

আমারে ভুলতে গিয়ে
আজও ব্যথা লাগে কারো কারো
পাবে আরো, ব্যথা যা জমা থাকে সুরে
যে স্মৃতি বুকে জেগে থাকে- ভুলতে চাওয়ার দিনে।

যেহেতু মানুষ আমি, বুকে কলঙ্ক মাখি
সেও শুভ্র-সজীব! সোনালী রোদে উপেক্ষা করে-
পৃথিবীর পাপ-পুণ্যের মিল
আর এই বুকে, আধো সাদা আধো নীল আকাশ ঝুঁকে বলে-
ভালোবেসে সয়েছি যত এ জগতের ধিক্
ঈশ্বর নিজেই প্রেমিক!

৮ মে, ২০২২। পি.সি কালচার, শ্যামলী, ঢাকা।

চলে যাওয়ার আগে, যেতে নেই, বারেবারে

গতি পাল্টাচ্ছে,
এখন কি তবে খুব বেশি দূরে চলে গেছে?
এখন কি কেবল বিদায় নেওয়াই বাকি?

বুকে ভেজা মাটি,
ঘাসের সবুজ লেগে আছে শেষ রাতের
ভাঙা বৈঠার বিষাদ ছুঁয়ে আছে অলি-গলি।

আমার দেহখানি-
চূড়ায় বসে আছে দু হাত জড়ো করে!
সব তো ঠিক করাই আছে-
চলে যাওয়া-যাওয়ি, সেও হবে একদিন।

জানি, বহিরাগতের হৃদয়ে রাখে না যে হাত
সেও চিরনমস্য থাকে!
তারে পুছি- প্রভু, ধরেছি কান, নাকে খতও দিলাম
আরেকটু কাছাকাছি থাকি।

১৫ ডিসেম্বর, ২০২১। পি.সি কালচার, শ্যামলী, ঢাকা।

ডুব

রোজ সকালে আকাশ খুলে দেখি
দুঃখ তাতে দিচ্ছে বসে তা
হঠাৎ ধু ধু কেঁপে উঠছে বুক
শব্দ ঠোঁটে, যায় না বলা যা।

ভোরের পাখি ব্যাকুল, ছটফট
ঘুমিয়ে আছে যমুনাবতীর ছেলে
চোখ জুড়ে তার উষ্ণ চুমু দিও
চোখ পুড়ে যায়, চোখ ভেসে যায় জলে।

ভিজে এলে লোনা জলের মাটি
নদীর ঢেউয়ে একলা সে সওয়ারী
ঝড় তুলে খুব ঝাঁপ দিয়ে যাও এসে
প্রলয় জ্বরে একটু করে বাঁচি।

তোমার বুকে অন্যকিছু থাকে
থাকুক, তাতে আঁচ লাগে না যেন
আমি কেবল মুহূর্ত, বুলবুলি
চোখ ফেরালেই ভুলতে বসো যাকে।

৫ মার্চ, ২০২২। পি. সি কালচার, শ্যামলী, ঢাকা।

আপনারে দেখিতে চায় মন

(If I should meet thee/After long years/How should I greet thee?/With silence and tears”― Lord Byron)

আবার দীর্ঘ রাত
বুকে সপাৎ সপাৎ
চাবুকের দাগ আসে নেমে
জোছনা ব্যতিব্যস্ত- ভুলে।

গল্পটা মায়াবী, শুধু প্রেম
একদিন ফুরায়ে যায়
উপেক্ষা করে সব ডাক
ভালোবাসা, কেবলই মায়ায় জড়ায়।

আবার দীর্ঘ রাত
মনের আকাশে ডুব দিয়েছে বিষাদ
আপনাকে ভালোবেসে
হয়েছে মূক,
নীরবে সয়ে যাওয়া-
মূর্খ ঝিনুক!

মার্চ ১৯, ২০২২। পি.সি কালচার, শ্যামলী, ঢাকা।

দেয়্যার ইজ অ্যা ব্লু বার্ড

কতবার তুমি প্রেমে পড়ো, পাখি?
উড়ে চলে যাও কতবার, দূরে দূরে!
বুকে আমারও খানিকটা জমিন আছে পড়ে,
আর বাকি সব- বৃষ্টি আসার মুহূর্তে
তোমারে না পাওয়ার সুর তুলে-
ডুবে গেছে আরেক শহরে!

কতবার ছল, করেছো জলে
ছলছল চোখে কতবারই দাঁড়াবে?
দুটোই অল্প জানি, আর জানি-
হাহাকার বয়ে বেড়ানো এ ঠোঁট
তোমার ফেরার অপেক্ষায়
খুটে যায় কালো দাগ!

কতবার অবসরে, ধুয়ে-মুছে রেখে যাবে-
একাকিনী চাঁদ! তার হাত,
ভুলে গেছে কবে কে মনে রেখেছে
কিংবা শুয়েছিল পাশ ফিরে, উদাসীন সুখে!
তোমার এই আনাগোনা, আচমকাই উড়াউড়ি
কিছুটা চাই রাখি ধরে,
বুকে এখনো খানিকটা জমিন আছে পড়ে।

১ আগস্ট, ২০২২। চন্দ্রিমা মডেল টাউন, ঢাকা।

সিফাত বিনতে ওয়াহিদ

কবি, গদ্যকার। বসবাস ঢাকায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- ‘নিঃসঙ্গতায় আরো কিছু দেখা হোক’।

Share