নিত্যদাসের গান

।। দীপাংশু আচার্য ।।

সবজান্তাদের জানায় কেবা?
দাসের কর্ম চরণ সেবা
জ্ঞানযোগীদের বলবে কেবা?
দাসের কাজ তো তোমার সেবা
তাই ‘আমি’ ‘আমি’ বন্ধ ক’রে,
‘তুঁহু’ ‘তুঁহু’ কর পিরিতে
চাই না আমি মুক্ত হতে

এক।

ওরে আমার মন
তোর কেমন রসায়ন
(তুই) চেতনাকে রাখিস ঢেকে নকল আমি দিয়ে
চেতনাকে রাখিস ঢেকে মিথ্যে আমি দিয়ে
সাধুরা তাই তোর সাথে দেয় গোরাচাঁদের বিয়ে
সাধুরা দেয় মনের সাথে গোরাচাঁদের বিয়ে…

দুঃখসুখের সূক্ষ্ণ ফাঁদে
মূর্খ মগজ ডুকরে কাঁদে
মন রে আমি রোজ ফ্যাসাদে — পড়ছি তোকে নিয়ে
ও মন আমি ঘোর ফ্যাসাদে — পড়ছি তোকে নিয়ে
সাধুরা তাই তোর সাথে দেয় গোরাচাঁদের বিয়ে
সাধুরা দেয় মনের সাথে গোরাচাঁদের বিয়ে…

শোন রে আমার মন-সেয়ানা
মায়ায় যে তোর মুন্সিয়ানা
ভুলব না সেই প্ররোচনায় — খিল দেবো ইন্দ্রিয়ে
ভুলব না তোর প্ররোচনায় — খিল দেবো ইন্দ্রিয়ে
সাধুরা তাই তোর সাথে দেয় গোরাচাঁদের বিয়ে
সাধুরা দেয় মনের সাথে গোরাচাঁদের বিয়ে…

মনের চোরা বালির পাশেই
সাক্ষী সাগর সদাই ভাসে
ডুবলো অহং নিত্যদাসের — সেই সাগরে গিয়ে
ডুবলো অহং নিত্যদাসের — নির্বিকল্পে গিয়ে
যেই না দিলাম মনের সাথে গোরাচাঁদের বিয়ে
সাধুরা দেয় মনের সাথে গোরাচাঁদের বিয়ে…

দুই।

পাথরে নেই পরমার্থ, ভেতরে তার বাস
ব্রহ্ম হেত বৃথাই তোরা কুম্ভমেলায় যাস…
পাথরে নেই পরমার্থ, ভেতরে তার বাস
ব্রহ্ম-খোঁজে বৃথাই খ্যাপা কুম্ভমেলায় যাস…

এক যে আছে হরিণ, তার নাভিতে কস্তুরী
তাও সে খ্যালে, এদিক সেদিক মিথ্যে লুকোচুরি
(এক যে আছে হরিণ, তার নাভিতে কস্তুরী
তাও সে খ্যালে এদিক ওদিক মিথ্যে লুকোচুরি)
অন্তে মৃগ জানতে পারে নিজস্ব নির্যাস
পাথরে নেই পরমার্থ, ভেতরে তার বাস….

সংসার ত্যাগ ক’রে যাকে খুঁজিস হিমালয়…
সেই চেতনা সর্বব্যাপী, দূরের কুটুম নয়
তোরই মনে, দেহের কোণে সজাগ বারোমাস
পাথরে নেই পরমার্থ, ভেতরে তার বাস

মায়ার বাঁধন চিনলে আসল সাধন হবে শুরু
রূপের কাছেই অরূপ আছে, চ্যালার ঘরেই গুরু
(আরে) লড়াই-লীলায় জড়াই না তাই
এই  রঙ্গলীলায় জড়ায় না তাই অধম নিত্যদাস
পাথরে নেই পরমার্থ, ভেতরে তার বাস
পাথরে নেই পরমার্থ, ভেতরে তার বাস

তিন।

আমার মাথার ভেতর শ্মশান আছে, পুড়ছে মড়া উড়ছে ছাই
এই চিত্তকে তুই দে বুঝিয়ে, কে নিত্য আর কে নিতাই
তোর ভৃত্যকে তুই দে বুঝিয়ে কে নিত্য আর কে নিতাই!

আবার এই শ্মশানের এক কোণে এক ভুতের মতন হিজলগাছ
তার নিচে মন বসলে ধ্যানে, ভাঙবে জ্ঞানের আতসকাচ
খ্যাপা দেখবি তখন এই শরীরেই জড়িয়ে হরি যাচ্ছে তাই…
এই চিত্তকে তুই দে বুঝিয়ে, কে নিত্য আর কে নিতাই
তোর ভৃত্যকে তুই দে বুঝিয়ে কে নিত্য আর কে নিতাই!

চিতায় জ্বলে নিথর কায়া, হাওয়ায় দোলে আত্মারাম
ঢেউ জানে, আর কেউ জানে না, কোথায় তোমার গোলকধাম
তাই ঢেউয়ের সাথে সঙ্গ ক’রেই অতল ধারায় তলিয়ে যাই
এই চিত্তকে তুই দে বুঝিয়ে, কে নিত্য আর কে নিতাই…
তোর ভৃত্যকে তুই দে বুঝিয়ে কে নিত্য আর কে নিতাই?

নদীর কুলে জমলো কতো মায়ার পলি দেখবি চল
কান্নাহাসির ফসল যত ভাসিয়ে দেবে কালের জল
তাও খুব চেনা এই রূপদরিয়ায় ডুব না দিয়ে উপায় নাই
এই চিত্তকে তুই দে বুঝিয়ে, কে নিত্য আর কে নিতাই
তোর ভৃত্যকে তুই দে বুঝিয়ে কে নিত্য আর কে নিতাই!

আমার হবেই হবে প্রাণ উতলা, শুনবো রে যেই বাঁশির সুর
(আমার) শ্যামের বাসা, আলোয় ঠাসা, শ্মশান থেকে অনেকদূর!
তাই কৃষ্ণকে হাত করবো ব’লে রাধার সাথে সই পাতাই
এই চিত্তকে তুই দে বুঝিয়ে, কে নিত্য আর কে নিতাই
তোর ভৃত্যকে তুই দে বুঝিয়ে কে নিত্য আর কে নিতাই!

আমার মাথার ভেতর শ্মশান, তাতে জ্বলছে আমার নিজের লাশ
জ্বলছে আকাশ, জ্বলছে পাতাল, বলছে অধম নিত্যদাস
কবে গিলবে আমায় লীলার হাঙর, তোমার পায়ে মিলবে ঠাই?
ও শ্যাম তোর চরণে মিলবে ঠাই?
এই চিত্তকে তুই দে বুঝিয়ে, কে নিত্য আর কে নিতাই…
তোর ভৃত্যকে তুই দে বুঝিয়ে কে নিত্য আর কে নিতাই!

চার।

নিত্য আমি যুক্ত হলাম
তোমার শিরায় তোমার স্রোতে
চাই না আমি মুক্ত হতে

আমি থাকবো বাঁধা
কালোয় — সাদায়…
আমি থাকবো বাঁধা
কালের ধাঁধায়
গ্রীষ্ম বর্ষা আর শরতে…
চাই না আমি মুক্ত হতে

ওরে নাছোড়বান্দা বুঝবি কবে?
মুক্ত হলেই অভেদ হবে
মন নাছোড়বান্দা বুঝবি কবে?
তুই মিশলে পরেই অভেদ হবে
তখন থাকবে না রূপ, থাকবে না রঙ,
পারবি না আর ফুল কুড়োতে…
তাই, চাই না আমি মুক্ত হতে

তিনটি বাল্যসখার সনে
চড়াই গরু বৃন্দাবনে
সত্ত্ব তম রজ’র সনে
দিব্যি আছি বৃন্দাবনে…
গোপাল আমার গুণের অতীত,
নামলো ধরায় প্রেম বিলোতে…
তাই, চাই না আমি মুক্ত হতে

সবজান্তাদের জানায় কেবা?
দাসের কর্ম চরণ সেবা
জ্ঞানযোগীদের বলবে কেবা?
দাসের কাজ তো তোমার সেবা
তাই ‘আমি’ ‘আমি’ বন্ধ ক’রে,
‘তুঁহু’ ‘তুঁহু’ কর পিরিতে
চাই না আমি মুক্ত হতে

নিত্যদাস সেই অধম গোলাম.
তোমার চক্রে বন্দী হলাম
নিত্যদাস সেই অধম গোলাম
তোর চক্কোরে বন্দী হলাম
আমি বংশীধারীর অংশ হয়েই
আসবো ফিরে এই জগতে
চাই না আমি মুক্ত হতে…

পাঁচ।

চোখ বলে আজ ঘুম যাবো না, মন বলে তুই জাগ
আমি ক্যামন ক’রে লুকোই শ্যামা এমন অনুরাগ…

জগৎ যখন মায়ায় একাকার
আমায় তো তুই দিস না দ্যাখা আর
মাটির আলো দুলতে থাকে ক্ষীণ
বল, ক্যামন ক’রে চুকোবো তার ঋণ?
ক্যামন ক’রে ক্যামন ক’রে
খাঁচার ভেতর আয়না ওড়ে
কাচের গায়ে জন্মদিনের দাগ
আমি ক্যামন ক’রে লুকোই শ্যামা এমন অনুরাগ…

মনের ভেতর আরেকখানা মন
মাঝখানে তার গোপন বাতায়ন
এক-দিকে রাত, অন্য-পাশে ভোর
বল, ক্যামন ক’রে সঙ্গ পাবো তোর?
ক্যামন ক’রে ক্যামন ক’রে
ঘনিয়ে আসা গানের ঘোরে
হচ্ছে ঘন জন্মদিনের দাগ…
আমি ক্যামন ক’রে লুকোই শ্যামা অ্যামন অনুরাগ

নিত্যদাসের অধম চোখে আজ
আঁকলো গোরা চাঁদের কারুকাজ
পাতায় পাতায় ঝিনুকভাঙা জল
আমি ক্যামন ক’রে অন্ধ হবো বল?
ক্যামন ক’রে ক্যামন ক’রে
উধাও হবো তোর ভেতরে
থাকবে প’ড়ে জন্মদিনের দাগ…
আমি ক্যামন ক’রে লুকোই শ্যামা অ্যামন অনুরাগ

চোখ বলে আজ ঘুম যাবো না, মন বলে তুই জাগ

ছয়।

আমার গাঁজার বনে লাগলো আগুন, মজলো গোটা পাড়া…
রাইকিশোরী তোমার নেশায় জগৎ মাতোয়ারা

গেল রাজার কানে খবর
তিনি পাঠান অবর-শবর
তারা মারতে এসে নিজেই ম’লো, ভিজলো সুরের ধারায়
রাইকিশোরী তোমার নেশায় জগৎ মাতোয়ারা…

আমি শিব ঠাকুরের চ্যালা
ভাসাই কৃষ্ণচূড়ার ভেলা
যেন অথৈ জলে কাজলমাখা তোমার নয়নতারা
রাইকিশোরী তোমার নেশায় জগৎ মাতোয়ারা…

নেশায় আসলো ছুটে লোকে
এসেই লাগলো ধাঁধা চোখে
দেখি, দুব্বো-ঘাসে তোমার নুপুর কুড়িয়ে পেলো কারা
রাইকিশোরী তোমার নেশায় জগৎ মাতোয়ারা…

যখন কল্কে আমার হাতে
থাকেন নন্দদুলাল সাথে
যখন কল্কে আমার হাতে
তখন নন্দদুলাল সাথে
অধম নিত্যদাসের আঁজলাতে আজ, কদম ফুলের চারা…
রাইকিশোরী তোমার নেশায় জগৎ মাতোয়ারা…

আমার গাঁজার বনে লাগলো আগুন, মজলো গোটা পাড়া
রাইকিশোরী তোমার নেশায় জগৎ মাতোয়ারা মাতোয়ারা…

সাত।

সর্পকুলের একজনাকেই চিনি
মূলাধারে ঘুমিয়ে থাকেন যিনি
ধ্যানের যোগে জাগালে সাপটিকে
ছোটেন তিনি সহস্রারের দিকে
তিনিই স্বয়ং কুলকুণ্ডলিনী
দিব্যসর্প কুলকুণ্ডলিনী

ইড়ায় মাতা মহামায়ার বাসা
পিঙ্গলাতে পিতা শিবের ঘর
সুষুম্নাতে সাপের যাওয়া আসা
মানুষ জনম অর্ধনারীশ্বর
এই তত্ত্বে প্রজ্ঞাটি তাঁর থিতু,
সর্পটিকে পোষ মানালেন যিনি
সাত চক্র আগলাবে ছয় ঋতু
সুষুম্নাসাপ কুলকুণ্ডলিনী
দিব্যসর্প কুলকুণ্ডলিনী

চক্রশিকড় মগ্ন মূলাধার
স্বাধিষ্ঠান, নাভি, হৃদয় আর
বিশুদ্ধ ও আজ্ঞাচক্র শেষে
পৌঁছবে মন সহস্রারের দেশে
সহস্রারে বদ্ধ কিছুই নয়
পিতা-মাতার মিলন সেথায় হয়
নিত্যদাসের মুক্তিও সেইদিনই
মিলন ঘটান কুলকুণ্ডলিনী
মুক্তিদায়ী কুলকুণ্ডলিনী
দিব্যসর্প কুলকুণ্ডলিনী

আট।

সবই মায়া… এই দেহ-দুনিয়ায়
যাবে ফুরিয়ে, যা যা কুড়োলি হায়!

শ্যামসত্তা রাধাপ্রকৃতি মিলে
জন্ম মৃত্যু লেখে নিখিলে
জীবনের নদী শুধু বয়ে যায়
সবই মায়া…

ওরে মন, নিবি নিজেকে চিনে
ডুব দিবি একা, খুব গহীনে…
তোরই স্বরূপ চির-চেতনায়
বাকি, সবই মায়া…

চিত্ত চঞ্চল হলো ভারি
বাঁশিসুরে ডাকে বনবিহারী
(বাঁশিসুরে ডাকে মনমুরারি…)
নিত্যদাস বলে, গুরু ভজি আয়—
সবই মায়া…

ছবি- পাঁচুগোপাল দত্ত

দীপাংশু আচার্য

পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের কবি ও লেখক। গীতিকার, জাদুকর, অভিনেতা ও কমেডিয়ান। জন্ম ১৯৮৫ সাল। বসবাস, হুগলী জেলার শেওড়াফুলিতে।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: যেটা খুশি বেছে নাও (২০০৬)
অন্যান্য কবিতার বই:
উবু সব মাদারির ভিড় (২০১০), মায়ার মাদুলি (২০১১), দ্বিচারী (২০১২), জ্বরের জাদুকর (২০১৭), চ্যুত ; লুন্যাটিক (২০২০)
সদ্য প্রকাশিত আধ্যাত্মিক বই:Parama Tatva – The Theory of Everything (2020)

Share