দেওয়ালের ওপাশে

।। মোহসেনা সিদ্দিকা ।।

ফোনের নিচেই আমার ছাইরঙা কুকুরটা কী আরামে ঘুমাচ্ছে! সেই একমাস বয়সে রাস্তা থেকে তুলে এনেছিলাম। এখন কত্ত বড় হয়েছে, বাবুর খেলার সাথী হয়েছে সে। আরে জানালা দিয়ে কাক এসে টেবিলের জলের গ্লাসটা উলটে দিল! হুশ হুশ করে দৌড়ে জানালা আটকে দিতে গেলাম আর কীভাবে যেন… কীভাবে যেন… মেঝেতে পড়ে গেলাম! মাথাটা কেমন ঝিম ধরে গেল। সবকিছু কেমন যেন আবছা হয়ে আসছে৷ শক্তি পাচ্ছি না উঠে দাঁড়াতে! কলের শব্দটা কানে বাজছে শুধু। উফ! আমি পারছি না! উঠতে পারছি না! প্লিজ আমাকে একটাবার খুলে দাও! আমার বাবু বাথটাবে! আমি উঠতে পারছি না!

দেওয়ালের ওপাশে

শুয়ে আছি যেন কয়েকশত বছর ধরে। আর কতদিন এভাবে রাখবে আমাকে! উফফফ!! ভয়ংকর যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়! বিপ বিপ করতে থাকা মেশিনের শব্দটা মাথার ভেতরে ঢুকে গেছে। অসহ্য!!! সবকিছু অসহ্য!!  

হঠাৎ একটা কাক এসে বসল পাশের টেবিলটার উপর। কি আজব! এই কদাকার বিশ্রি কাকটা আমায় দেখতে এসেছে! অথচ আমার নিজের লোকজন আমায় দিব্যি ভুলে এখানে ফেলে মনের সুখে দিন কাটাচ্ছে। অহ! অবশ্য সুখে তো থাকবেই এখন। তারা যা চেয়েছে তা তো পেয়েছেই! আমার সুখ তো কারোরই সহ্য হত না, এখন আমার কষ্টতেই তাদের সুখ। ভালো, থাকুক।  সবাই সুখেই থাকুক।

এই চার দেয়ালে আজ শুধু দুটি প্রাণী।  আমি সদ্য আগত কাকটির দিকে মনোযোগ দিলাম।  মাথা নেড়ে নেড়ে খুব গম্ভীরভাবে দেখছে আমাকে। হয়তো সেও বুঝে নিয়েছে যে আমি আজ ওর তুলনায় যথেষ্ট অসহায়, আর হয়ত ভর্ৎসনা দিচ্ছে আমাকে! নাহহ!! এই অসহায় অবস্থা একদম শেষ করে দিচ্ছে আমাকে! হাতের কাছের সমস্ত কিছু এই বিচ্ছিরি কাকটার দিকে ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করছে! এক টানে শরীর থেকে ওর ডানা দুটো আলাদা করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে! তখন ও নিজেও আমার মতো অসহায় হয়ে পড়ে থাকবে! আমি একা কেন এভাবে পড়ে থাকব!

হঠাৎ একটা টেলিফোন বেজে উঠল। রুমের দেয়ালে থাকা ক্যাটক্যাটে লালরঙা ফোনটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে কে ফোন দেয়? কে আমার সাথে কথা বলতে চায়? আমি তো কারো সাথে কথা বলতে চাই না। আমার কথা বলার মানুষটাকে তো অই মুখোশধারী জানোয়ারগুলো নিয়ে গেছে!

লাল টেলিফোনের নিচে চোখ নামাতেই দেখি একটি ছাইরঙা কুকুর। শুয়ে আছে না কি ঘুমুচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। ও এত আরামে শুয়ে আছে কেন! আমি তো এত আরামে চোখ বুজে থাকতে পারিনা! এই নিকৃষ্ট কুকুরটা কেন আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে এভাবে শুয়ে থাকবে! উফফ! উঠে যেয়ে একটা লাত্থি দিয়ে ওর কোমরটা ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে! আমার ভালো থাকা তো কেউ সহ্য করতে পারেনা, আমি কেন অন্যেরটা করব?

আমি তো.. আমি তো.. ওর সাথেই ভাল থাকতাম। আমার জীবনে আর কিছুই প্রয়োজন ছিল না!  অভ্রের সাথে কাগজে কলমে যেদিন দুজনের রাস্তা ভিন্ন করে নিলাম সেদিনও তো আমি একটাবারের জন্য চোখের পানি ফেলিনি! 

 উফফ! অসহ্য! এত শব্দ! এত শব্দ! এত শব্দ আসছে কোত্থেকে? বাথরুম থেকে!  বাথরুমে কে কাঁদে?? বাবু? ও বাথরুমে কী করে!! ওকে বাথরুমে কে রাখল! উফ! মাকে কত্তবার বলেছি আমি না থাকলে বাবুকে চোখের আড়াল না করতে! নাহ! এদের দিয়ে কিচ্ছু হবেনা। আমাকেই সব করতে হবে। উঠতে যাব, অমনি কোথায় যেন আটকে গেলাম। আমি উঠতে পারছিনা কেন! আরে, এসব কী! আমাকে বেঁধে রেখেছে কেন! আজব! আমার বাবু বাথরুমে একা বসে কাঁদছে আর আমাকে এরা এভাবে বেঁধে রেখেছে!! সমস্যা কী সবার! আমার সাথে এমন করে কি মজা পাচ্ছে এরা! এদের কেমন করে বোঝাব যে বাবু আর কিছুক্ষণ বাথরুমে থাকলে তো ওর ঠান্ডা লেগে যাবে। তারপর রাতভর কাঁদবে, তারপর ওকে বুকে নিয়ে আমিও কেঁদে রাত পার করব!

এই তো কিছুদিন আগে ওকে বাথটাবে গোসল করিয়েছি। কল ছেড়ে দিলে তার কী আনন্দ!! পানিতে বসে তার ছোট্ট ছোট্ট হাতে থাবা দিয়ে দাঁতহীন মাড়িতে খিলখিল করে হাসে আমার মানিকটা। কলিজাটা জুড়ায় আমার। সেদিন হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠল! অনেকক্ষণ ধরেই বাজছিল। বাবুকে বাথটাবে বসিয়ে আমি দেয়ালে ঝুলানো লাল টেলিফোনটার কাছে গেলাম। অফিস থেকে ফোন এসেছে। ফোনের নিচেই আমার ছাইরঙা কুকুরটা কী আরামে ঘুমাচ্ছে! সেই একমাস বয়সে রাস্তা থেকে তুলে এনেছিলাম। এখন কত্ত বড় হয়েছে, বাবুর খেলার সাথী হয়েছে সে। আরে জানালা দিয়ে কাক এসে টেবিলের জলের গ্লাসটা উলটে দিল! হুশ হুশ করে দৌড়ে জানালা আটকে দিতে গেলাম আর কীভাবে যেন… কীভাবে যেন… মেঝেতে পড়ে গেলাম! মাথাটা কেমন ঝিম ধরে গেল। সবকিছু কেমন যেন আবছা হয়ে আসছে৷ শক্তি পাচ্ছি না উঠে দাঁড়াতে! কলের শব্দটা কানে বাজছে শুধু। উফ! আমি পারছিনা! উঠতে পারছিনা! প্লিজ আমাকে একটাবার খুলে দাও! আমার বাবু বাথটাবে! আমি উঠতে পারছিনা! আমি চিৎকার করতে লাগলাম… দোহাই লাগে তোমাদের.. একটু খুলে দাও… বাবু আমাকে না পেয়ে কাঁদছে! প্লিজ কথা শোনো কেউ!  

হঠাৎ দরজা খুলে গেল। দু’জন সাদা জামা পড়া মানুষ এসে আমায় চেপে ধরল! আমি কত্তবার তাদের বোঝাতে চেষ্টা করলাম, বাবু বাথরুমে কাঁদছে, আমায় যেতে দাও প্লিজ। দোহাই লাগে! আমায় কেউ বাবুর কাছে নিয়ে যাও!  কেউ শুনলোনা! একজন চেপে ধরে হাতে একটা কী যেন দিয়ে দিল…

কেমন ঘোলা হয়ে আসছে চারপাশ…
বাবুর কান্নাও ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসছে।

মোহসেনা সিদ্দিকা

নিজেকে একজন ‘ডিলার অব হোপ’ হিসেবে দেখা এই লেখিকার জন্ম ১৯৯৭ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলায়। স্কলারশিপ পেয়ে বর্তমানে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করছেন ডেনমার্কের অরহুস ইউনিভার্সিটিতে। কবিতা ও প্রকৃতির মাঝে মিশে যেতে পছন্দ করেন তিনি।

Share