আজ শুক্রবার, ১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.
আজ শুক্রবার, ১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আমারে যে জাগতে হবে

ঘরের ভারসাম্য থেকে দুনিয়ার সাম্য: সম্পাদকীয় প্রতিবেদন

বঙ্গে ‘লক্ষ্মী’ হলেন প্রধান শস্য ধানের টোটেম। যেহেতু ‘লক্ষ্মী’ মূলত ফসল ও তার সুষমবন্টনের টোটেম, তাই তিনি লৌকিক দেবী। এবং বঙ্গের নানাবিধ অবৈদিক সাংস্কৃতিক রিচ্যুয়ালের মধ্যেও ‘লক্ষ্মী’র উপস্থিতি রয়েছে। বড় বাংলার তন্ত্রের আদি ভাবসমূহও (নব্যতন্ত্র নয়) আসলে প্রকৃতিকে জানার বঙ্গীয় অনার্যবিদ্যা। এই প্রতিবেদনে এবার ‘লক্ষ্মী’ বানান পরিহার করা হচ্ছে। বঙ্গে লক্ষীর কোনও লখসমী ভার্সান নেই। ওসব বাউনবাদীদের কারবার। বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বঙ্গের শস্য, জল-জমিন-জঙ্গল সাফ করে আধিপত্য কায়েম করতে সংস্কৃত টোনে লক্ষীকে লখসমী করেছিল, যা ওই ‘লক্ষ্মী’ বানানের অন্দরে রয়ে গিয়েছে।

এই প্রতিবেদন যখন লেখা হচ্ছে তখন বড় বাংলায় অনেক সনাতনী মা-বোন-বান্ধবীরা লক্ষীর আরাধনা করছেন। কিন্তু লক্ষী কি কেবলই একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় পরিচিতির মানুষের দেবী নাকি লক্ষী একটি চেতনা, যা আমাদের মাটি, আমাদের ফসল, আমাদের প্রকৃতি ও তার ভারসাম্যের বার্তাকে ছড়িয়ে দেয়। যে ভারসাম্যের মধ্যে থাকলে গৃহে আসে শান্তি, আর ঘরের শান্তিই তো দুনিয়ার সাম্যের প্রধান সূচক। আজ এথনোসেন্ট্রিক মানুষ যখন শুধুই নিজের রিপু আর সম্পদ-বৈভবমুখী হয়ে গিয়ে দ্বীন-দুনিয়ার কথা থেকে বিস্মৃত হচ্ছে. দেদার সে প্রকৃতি ধ্বংস করছে, পশু-পাখীদের অধিকারের ব্যাপারে যখন খুব মানুষই সচেতন, তখন এই পারিপার্শ্ববিচ্যুত মানুষের সামনে দেবী লক্ষীর রূপের অন্দরে ভারসাম্যের বয়ান আমরা পাঠ করতে পারি। প্রথমত, লক্ষীকে সম্পদ-প্রাচুর্য-বৈভবের দেবী না ভেবে শস্য ভারসাম্যের প্রতীক হিসেবে দেখা যেতে পারে। তিনি পুঞ্জিভূত সম্পদের দেবী নন, বরং যে সমৃদ্ধি শান্তি আনে, যে সমৃদ্ধিতে ঘর তথা ঘরের ভিতরের প্রাণ আলোকিত হয়ে ওঠে তিনি সেই সমৃদ্ধি ও শান্তি সুনিশ্চিত করা ক্রিয়াসমূহের প্রতীক। আর প্রাচুর্যময় সম্পদ বা পুঞ্জিভূত সম্পদের দেবতা কিন্তু কুবের। কুবেরের কোনও আলাদা করে মঙ্গলবার্তা, শান্তি ও ভারসাম্যের বার্তা নাই। তাই লক্ষী আর কুবেরের মধ্যে গুলিয়ে ফেলা যায় না।

লক্ষীর বাহন পেঁচা। পেঁচা প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও বাস্তুভারসাম্যের গুরুত্বপূর্ণ পাখি এক। তাই তিনি লক্ষীর বাহন। এই যে নিরাকার ঈশ্বরের অগুন্তি গুণের প্রতিটি গুণবাচক রূপকল্পনায় বিভিন্ন সনাতনী দৈবমূর্তির সঙ্গে একেকটি পশু-পাখিকে বাহন হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছিল, এর অর্থ নিয়ে আমরা ভেবেছি কী? এই প্রতিটি পশু-পাখি শুধুই টোটেম নয়, বরং এসবের গুরুত্ব আরও। সামগ্রীক প্রাণ-বৈচিত্র‍্যের সঙ্গে মানব সমাজের নিবিড় সম্পর্ক। বাস্তুতন্ত্রে বা বাস্তু ভারসাম্যে প্রতিটি প্রাণের গুরুত্ব রয়েছে। প্রতিটি পশু-পাখি-পতঙ্গ-কীট আমাদের খাদ্যশৃঙ্খলে বিশেষ অবদান রাখে। তাই দুনিয়ায় ভারসাম্য সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে গেলে শুধুই মানুষের হকের কথা ভাবা অর্থহীন। বরং গাছপালা, পশুপাখি, কীট-পতঙ্গ– সবার হকের কথা মাথায় রেখেই মানব সমাজের অগ্রগতির রূপরেখা তৈরি করা যেতে পারে। বড় বাংলার দার্শনিক ও বিপ্লবী মওলানা ভাসানির রাজনীতির মূল প্রতিপাদ‌্য হয়ে উঠেছিল এই প্রাণ-প্রকৃতির মেলবন্ধন। প্রাণ-প্রকৃতির মেলবন্ধন হলে তবেই পরমের হদিশ মেলে, সে কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানি। এই প্রাণ-প্রকৃতি ও পরমের মেলনবন্ধন সূত্রে বৃহৎ বঙ্গের দেবী কোজাগরী লক্ষীর বাহন পেঁচা তাই শস‌্যনিবিড় বঙ্গে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। কোজাগরী লক্ষীপুজোয় রাত জেগে পাঁচালি পাঠ করা হয়। আমাদেরও তাই জাগতে হবে। চৈতন্য জাগতে হবে। মানুষের সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক, জাতিবাদী, সাংস্কৃতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে যেমন চৈতন্য সজাগ করে লড়াই করতে হবে, তেমনই মনুষ্য কর্তৃক প্রকৃতি ও প্রাণীজগতের ওপর বেইনসাফির বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে হবে।

এই চৈতন্যের হদিশ লক্ষী-ভাবের মধ্যেই রয়েছে। লক্ষী কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের শুধুই রিচ্যুয়ালনির্ভর দেবী নন। বরং তিনি শস্য-শ্যামল বড় বাংলায় শান্তি, সহাবস্থান, সাম‌্য ও সমৃদ্ধির বার্তা। বাঙালি মুসলমান কোজাগরী লক্ষীপুজো করে না ঠিকই, কিন্তু ‘হিন্দু’ বাঙালির চেয়ে লক্ষীর গুরুত্ব সোকল্ড নিম্নবর্গের বাঙালি ও বাঙালি মুসলিমের জনজীবনে বেশি। দেবী হিসাবে নয়, মঙ্গলভাব হিসাবে এবং ফসলের সঙ্গে জীবনের সম্পৃক্ততার জায়গা থেকে লক্ষী তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালি মুসলমানের কথার মধ্যে সাবলীলভাবেই ‘লক্ষীটি’, ‘লক্ষী মেয়ে/ছেলে’, ‘অলক্ষী’ এইসব শব্দ দৈনন্দিন কথামালায় আখছাড় লক্ষ্য করা যায়। এমনকী পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়া, রোজাদার, হজ্ব করা বাঙালি মুসলিম পরিবারের গৃহিনীকেও বলতে শুনেছি ‘এত ভাত নষ্ট কোরো না, লক্ষী চলে যাবে…’ আসলে নিম্নবর্গের বাঙালি ও বাঙালি মুসলমানের সঙ্গেই বঙ্গের ভূমিজগত ও ফসলের সম্পর্ক নিবিড়। বর্ণহিন্দু বাঙালির সেই সম্পর্ক নাই৷ ফলত ফসলের মাহাত্ম্য বা লক্ষীকে বাঙালি মুসলমানই ভালো চেনে। তাই পরিচয়বাদী জায়গার উর্দ্ধে উঠে প্রাণ-প্রকৃতি ও পরমের সম্মিলনের দৃষ্টিকোণ থেকে আসুন আমরা লক্ষীর গৃহচেতনার মধ্যে দিয়ে দ্বীন-দুনিয়ার শান্তি-সহাবস্থান-সাম্যের স্বপ্ন দেখি।

ছবি: সুদেষ্ণা মজুমদার
Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top