‘এমন দিন কি হবে মা তারা’

।। সম্পাদকীয় প্রতিবেদন ।।

সিনেমা পরিচালক লীনা মনিমেকালাই তাঁর ডকুমেন্টারির জন্য দেশে বিদেশে বিখ্যাত। তাঁর সাম্প্রতিক ছবি ‘কালী’। সেই ছবির পোস্টারে কালীকে দেখা গেছে সিগারেট ফুঁকছেন। ছবিতে কালী আসলে কিভাবে চিত্রিত হয়েছেন তা এখনও কেউ জানে না, কেউই ছবিটি দেখে নি। কিন্তু পোস্টার দেখেই তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটেছে। কালী নারীদের কাছে পুরুষতন্ত্র ও পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই ও প্রতিরোধের প্রতীক হিশাবে বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে দীর্ঘকাল ধরেই স্বীকৃত। কালীর মুখে সিগারেট নিয়ে আলাপ-তর্ক ইত্যাদি হতেই পারে, কিন্তু সেটা ছবিটি দেখার পরে। আলাপ হতে পারে, কালীকে লীনা মনিমেকালাই আসলে কিভাবে হাজির করেছেন? বর্তমান বুর্জোয়া ফেমিনিজমের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের আইকন হিসাবে দেখাতে চেয়েছেন কি? নাকি কেবলই পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে উপমহাদেশের কালো-শ্যামলা অনার্য মেয়েদের প্রতিস্পর্ধার আইকন বানাতে চেয়েছেন? যদিও কালী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের আইকন নন। তিনি মা, জননী তাই জাত ধর্ম বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে তিনি সকলের। কালী কালেক্টিভ। তিনি শুধু মানুষী নারী না, তিনি প্রকৃতিস্বরূপা একই সঙ্গে কর্তা এবং প্রক্রিয়া, তাই তিনি মহাকাল ও আদ্যাশক্তি। তিনি সকলের হবার কারণে ভক্তের কাছে তিনি সদাই ‘জননী’, সকল সৃষ্টির তিনি কারণ। তিনিই ‘মা’। মানুষের মধ্য দিয়ে তিনিই সকল জাগতিক কর্ম করে যান, কিন্তু ‘লোকে বলে করি আমি’। তিনি ইচ্ছাময়ী তারা, সকলই তাঁর ইচ্ছা। ফলে লীনা মনিমেকলাই যদি কিছু করে থাকেন তবে সেটা কালীই স্বয়ং করিয়েছেন। এটা মায়ের কাজ, মা নিজেই বুঝবেন। কিন্তু একে হিন্দুত্ববাদীরা রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে ফায়দা লুটতে চাইছে।

এসব নিয়ে অর্থ-সমৃদ্ধ আলাপ তখনই সম্ভব যখন বড় বাংলার ভাবের গোড়ায় কালী কিভাবে সদাসর্বদা হাজির আছেন আমরা তার হদিস নেবার জন্য তৈরি থাকি। শিল্পীর স্বাধীনতাকে আমলে নিয়েই একালে নতুন তর্ক তৈরি করতে হবে, যেন বড় বাংলা তার ভাবের গৌরব ফিরে পায় আবার। তার অনার্য ও দ্রাবিড় শেকড়গুলো চিনতে পারে। কেবল তখনই শিল্পীর কন্ঠরোধ না করে তাঁর সঙ্গে আলাপে রত হওয়া যাবে। দ্রাবিড় চিত্র পরিচালক লীনা মনিমেকালাই কিন্তু জানাচ্ছেন যে তাঁর কালী কথা বলবেন বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে। কালী-শিব, কেষ্ট-রাধা, হর-পার্বতী ইত্যাদি সকল অবৈদিক মিথিক্য্যাল দেবদেবীগণকে ঘিরে বড় বাংলায় যে ভাবের চর্চা — যেমন রামপ্রসাদ বা কমলাকান্তের গানে — তা কখনই মনুবাদী পিতৃতন্ত্র কিংবা পশ্চিমা চার্চের রসকসহীন পুরুষতান্ত্রিক পুরোহিততন্ত্রের মধ্যে আটকে পড়ে নি। পড়েনি বলেই কালী বারবারই একালে নারীর সংগ্রামের প্রতীক হয়ে নানান ভাবে হাজির হন। যেন পুরুষতন্ত্রের কালপর্বটা দ্রুত পার হওয়া যায়। কালীর নানান রূপ, নানান ব্যঞ্জনা, নানান লড়াই। তিনি টরেন্টোর রাস্তায় হয়তো এখন সিগারেট ফুঁকে বেড়াচ্ছে্ন কারণ সকল প্রকার জাতিবাদ পরিচয়বাদ বর্ণবাদ বিনাশের ডাক উঠেছে বিশ্বব্যাপী। পুরুষতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থাকে ধ্বংসের জন্য তাঁকে নতুন ভাবে হাজির হওয়া দরকার হয়ে পড়েছে। সেই ক্ষেত্রে তাঁকে বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানির সিগারেট ফুঁকতে হবে, আমরা তা মনে করি না। ধূমপান স্বস্থ্যের পক্ষে হানিকর। ঙ্কিন্তু কালী বহু রঙের রূপব্যঞ্জনা। বহু স্বরের প্রতিধ্বনি। বহু অভিব্যক্তির প্রকাশ। মা বহুরূপা। গীতি-কাব্য-মস্করা-হুল্লোড়-প্রেম-অশ্রু এবং সর্বোপরি ভক্তিরসে পরিপূর্ণ। তিনি লীনা মণিমেকালাইয়েরও বটে।

আমরা মণিমেকালাইয়ের হেনস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই। এমনকি মনিমেকালাইয়ের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্রকেও যেভাবে হেনস্থা হতে হচ্ছে আমরা তারও প্রতিবাদ জানাই। মহুয়া যথার্থই বলেছেন যে কালীপূজায় আমিষ ভোগ ও কারণ বারি নিবেদন করা হয়। কিন্তু এই মন্তব্যের জেরে তাঁর ওপরেও নেমে এসেছে হিন্দুত্ববাদীদের আক্রোশ। আমরা হিন্দুত্ববাদীদের ধিক্কার জানাই। লীনা ও মহুয়ার প্রতি রইলো আমাদের সংহতি।

‘এমন দিন কি হবে মা তারা’

চলচ্চিত্র পরিচ্চালক ও কবি লীনা মনিমেকালাই

আমার কালী কথা বলবেন বর্ণ বিদ্বেষের বিরুদ্ধে
লীনা মনিমেকালাই

মা কালী সিগারেট ফুঁকছেন, ফিল্ম নির্মাতা লীনা মনিমেকালাইয়ের (Leena Manimekalai) তথ্যচিত্রের পোস্টারে কালীকে এভাবেই চিত্রিত করা হয়েছে। কালী শুধু ধূমপানই করছেন না, পেছনে এলজিবিটি’র রঙধনু পতাকা উড়ছে। পোস্টার দেখেই বিতর্কের ঝড় উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে হিন্দু ধর্মের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেবীকে ধূমপানরত অবস্থায় দেখিয়ে হিন্দুর ভাবাবেগে আঘাত দেওয়া হয়েছে। অতএব অবিলম্বে যেন পোস্টার নামিয়ে ফেলা হয়। বলা বাহুল্য, এই বিতর্ক ব্যক্তির – বিশেষত শিল্পীর নিজেকে প্রকাশ করবার অধিকারের সঙ্গে যুক্ত, লিবারেলরা যে বিষয়ে আমাদের সদাই জ্ঞান দিয়ে থাকেন। কিন্তু অন্য দিক থেকে ব্যক্তি অধিকারের সীমানা একটি জনগোষ্ঠির আত্মমর্যাদা বোধের সঙ্গে জড়িত। সেই বোধের চরিত্র সামগ্রিক ভাবে জনগোষ্ঠির সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং শিক্ষার বিকাশের তর্ক। অতিশয় বাস্তব বিষয়। মোটেও ‘অধিকার’ বা ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ মার্কা বিমূর্ত ও রহস্যজনক কিছু না। কিন্তু তর্কটা লিবারেল রাজনীতির যুগে একদিকে ব্যক্তি অধিকার মার্কা উদারবাদ, আর  অন্য দিকে ব্যক্তির বিকাশ রুদ্ধ করবার সংখ্যাগুরুর ফ্যাসিস্ট প্রবণতা এবং রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। দ্বন্দ্ব হিশাবে হাজির হয়। লীনা মনিমেকালাইয়ের কালী নিয়ে তর্ক এই দুই মেরুর মধ্যে ছোঁড়াছুঁড়ি চলছে। নয়া উদারনৈতিক মতাদর্শের আধিপত্য এবং পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার যুগে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক ভাবে অপরের সঙ্গে বাস করবার চেতনা থেকে বঞ্চিত। ‘ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট’ কথাটা এই বাস্তবতাকে আড়াল করবার জন্যই বলা হয়। এই ক্ষেত্রেও অন্যথা হয় নি। অভিযোগ হচ্ছে কালীর পোস্টার হিন্দুর ধর্মীয় সেন্টিমেন্টে আঘাত করেছে। এই বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে দুই একটি কথা বলা জরুরি হতে পড়েছে।

মা কালীকে ধূমপান করতে দেখিয়ে লীনা মনিমেকালাই ঠিক কি ব্যক্ত করতে চেয়েছেন, সেটা তাঁর ডকুমেন্টারি না দেখে বলা মুশকিল। তবে ছবি দেখার আগে শুধু পোস্টার দেখেই হিন্দু সমাজের আবেগ অপ্রত্যাশিত ছিল তাঁর কাছে। তিনি বলেছেন তাঁর কালী বর্ণবিদ্বেষের কথা বলবে। এটা আন্দাজ করা যায় কারণ তিনি সবসময়ই কোনো না কোনো সামাজিক অসুখ নিয়ে তাঁর ছবি বানিয়েছেন। তাই লীনা মনিমেকালাই ছবি মহলে, বিশেষ ভাবে ডকুমেন্টারি ফিল্মের ক্ষেত্রে, সুখ্যাত। সামাজিক-রাজনৈতিক ই্স্যু তাঁর ডকুমেন্টারিতে শক্তিশালী ভাবে উঠে আসে।  তিনি কবি, সাহিত্যেও তাঁর সুনাম আছে। দেখুন, ( Life Through Leena )ফলে তাঁর ছবি না দেখে বলা মুশকিল তিনি আসলে কালীকে কিভাবে হাজির করেছেন। উল্লেখ করা দরকার যে দেশে বিদেশের নারীবাদী আন্দোলনে কালী শক্তিশালী  প্রতীক হিশাবে দীর্ঘকাল ধরেই হাজির।

তামিল ভাষায় লীনার কমপক্ষে দশটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম রয়েছে। সবসময়ই কোনো না কোনো সামাজিক সমস্যা নিয়ে ছবি বানিয়ে তিনি ছবিকে শুধু সংস্কৃতি নয়, সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা বলবার মাধ্যম বানিয়েছেন। যেমন, “মাথাম্মা” মেয়ে শিশুদের সম্পর্কে; শিশুদের দেবতার প্রতি নিবেদন করা হয়, কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে যৌনকর্মী।  ‘পারাই’ জাতপাত অস্পৃশ্যতা সম্পর্কে,  ‘বালি পিদাম’ বাল্যবিবাহ সম্পর্কে,  ‘বালতিতে গর্ত (Holes in the Bucket) জলের অভাব সম্পর্কে। যে অভাব কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা হয়েছে। অনুমান করা যায় ‘কালী’ ছবিতেও তিনি কোন না কোন সামাজিক সমস্যাই তুলে ধরতে চেয়েছেন।

টরেন্টোর রাস্তায় মা কালী আবির্ভূত হওয়া নিয়ে আমার সিনেমা। যদি আপনি এই সিনেমাটি দেখেন তাহলে লীনা মনিমেকালাইকে গ্রেফতার করার দাবি জানাবেন না। বলবেন, লীনা তোমায় আমরা ভালোবাসি। আমার কালী কথা বলবেন বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে।

লীনা মনিমেকালাই

কানাডার টরেন্টোতে আগা খান মিউজিয়মে ‘আন্ডার দ্য টেন্ট’ শিরোনামে প্রদর্শনী চলছিল। কানাডার হিন্দু সমাজ প্রদর্শনীর একটি পোস্টার নিয়ে প্রবল আপত্তি জানায়। আপত্তি আমলে নিয়ে ভারতীয় দূতাবাস কানাডা সরকারের কাছে আপত্তি তোলে। বিষয়টি তাই কূটনৈতিক বিষয়ে রূপ নেয়। ভারতীয় দূতাবাস একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানায় যে “আন্ডার দ্য টেন্ট কর্মসূচির আওতায় টরেন্টোর আগা খান মিউজিয়ামে প্রদর্শিত একটি সিনেমার পোস্টারে হিন্দু দেবতাদের অবমাননা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই নিয়ে কানাডার হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছি আমরা। এরকম প্ররোচনামূলক কোনও বিষয়বস্তু প্রত্যাহারের জন্য কানাডার কর্তৃপক্ষ এবং আয়োজকদের কাছে আমরা আর্জি জানাচ্ছি” । এরপর ‘আগা খান মিউজিয়াম’ একটি বিবৃতি প্রকাশ করে বলল, “আমরা গভীরভাবে অনুতপ্ত যে ‘আন্ডার দ্য টেন্টের’ ১৮টি ভিডিওর একটি এবং সেই ভিডিওর সাথে থাকা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টগুলি অসাবধানতাবশত হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের মনে আঘাত করেছে৷” উল্লেখ্য, কানাডার টরোন্টোতে অবস্থিত এই ‘আগা খান মিউজিয়ামে’ই প্রদর্শিত হচ্ছিল লীনা মনিমেকালাইয়ের ‘কালী’ সিনেমার পোস্টারটি।

সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট বিশেষত টুইটারে লীনা মনিমেকালাই তাঁর পোস্টারসহ যে টুইট করেছিলেন  সেই প্রসঙ্গটি ডিজিটাল মিডিয়া এবং তার ব্যবহারকারির সম্পর্ক সম্বন্ধে যেমন নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করেছে। তেমনই একই সঙ্গে ডিজিটাল মিডিয়ার সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্কও গুরুত্বপূর্ণ তর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। নেটিজেনদের বড় এবং প্রভাবশালী একটা অংশ লীনার বিরুদ্ধে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাতের অভিযোগ তুলেছে। পরিচালককে গ্রেফতারির দাবিও তুলেছে তারা। ইতোমধ্যে  দিল্লি এবং উত্তরপ্রদেশে তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়েছে। লীনা বলেছেন, “টরেন্টোর রাস্তায় মা কালী আবির্ভূত হওয়া নিয়ে আমার সিনেমা। যদি আপনি এই সিনেমাটি দেখেন তাহলে লীনা মনিমেকালাইকে গ্রেফতার করার দাবি জানাবেন না। বলবেন, লীনা তোমায় আমরা ভালোবাসি। আমার কালী কথা বলবেন বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে”। টুইটারে হিন্দু সমাজ যে প্রতিক্রিয়া ও আপত্তি জানিয়েছে ভারতীয় দূতাবাস তারই চাপে কানাডার সরকারকে কুটনৈতিক অনুরোধ জানাতে বাধ্য হয়। এর মধ্যেই লীনার বিরুদ্ধে ভারতে দুইটা এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। অযোধ্যার এক পুরোহিত তাঁর মুণ্ডচ্ছেদের হুমকিও দিয়েছেন। ছবির পোস্টার নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও বিতর্ক তুঙ্গে।

তর্কটা লিবারেল রাজনীতির যুগে একদিকে ব্যক্তি অধিকার মার্কা উদারবাদ, আর  অন্য দিকে ব্যক্তির বিকাশ রুদ্ধ করবার সংখ্যাগুরুর ফ্যাসিস্ট প্রবণতা ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। লীনা মনিমেকালাইয়ের কালী নিয়ে তর্ক এই দুই মেরুর মধ্যে ছোঁড়াছুঁড়ি চলছে। নয়া উদারনৈতিক মতাদর্শের আধিপত্য এবং পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার যুগে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক ভাবে অপরের সঙ্গে বাস করবার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। ‘ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট’ কথাটা এই বাস্তবতাকে আড়াল করবার জন্যই বলা হয়। এই ক্ষেত্রেও অন্যথা হয় নি।

ভারতে ডিজিটাল মিডিয়া ও ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। ভারত সরকার টুইটারকে তাদের প্লাটফর্ম থেকে কিছু পোস্ট বা কনটেন্ট সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেয়। এর বিরুদ্ধে টুইটার-ইন্ডিয়া আদালতের শরণাপন্ন হয়। টুইটারের দিক থেকে আদালতের শরণাপন্ন হবার সারকথা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী সরকার যেসব দাবি জানাচ্ছে, সেগুলো স্বেচ্ছাচারী কিম্বা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি। চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা টুঁটি টিপে মেরে ফেলার চেষ্টা। হিন্দুত্ববাদীদের প্রচার চলবে, কিন্তু অন্যদের কথা বলতে দেওয়া যাবে না। বলা বাহুল্য চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং কথা বলবার অধিকারের প্রশ্ন ডিজিটাল যুগে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ হাতের কাছে ভাল উদাহরণ। এখানে ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে প্রবল ভাবে। যেসব পোস্ট টুইটারের প্লাটফর্ম থেকে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে স্বাধীন শিখ রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন জানানো পোস্ট, কৃষকদের আন্দোলন সম্পর্কে কথিত মিথ্যাচার, এবং কোভিড মোকাবেলায় ভারত সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনামূলক বিভিন্ন পোস্ট বা কমেন্ট। টুইটার জানিয়েছে সম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তাদেরকে ভারতের অনেকগুলো একাউন্ট বন্ধ করে দিতে বলা হয়েছে। বলা বাহুল্য, এর মধ্যে রানা আইয়ুবের একাউন্টসহ আরও অনেকের একাউন্ট রয়েছে। টুইটার আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার অর্থ দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে, কমবে না। মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে সরব হয়েও কোন ফল পাওয়া যাবার সম্ভাবনা নাই। সরকারের সিধা বক্তব্য হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোকে ভারতের আইন মেনে চলতে হবে, কিন্তু সরকার নিজে সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিকদের চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের অধিকার মানবে না।  

গত বছর ভারতে কৃষকদের তীব্র আন্দোলন চলার সময় ভারত সরকারের আইনি নোটিশের পর টুইটার প্রায় আড়াইশোটি একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছিল। এটা করা হয়েছিল ‘জন-শৃঙ্খলা’-র  অজুহাত দেখিয়ে। এসব একাউন্টের মধ্যে অনেক অনুসন্ধানী সংবাদ সাময়িকী, মানবাধিকার কর্মী এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর একাউন্ট ছিল। দিল্লির বাইরে কৃষকদের যে অবরোধ ছিল, তার প্রতি এইসব একাউন্ট সমর্থন জানাচ্ছিল। তবে বন্ধ করার ছয় ঘণ্টার মধ্যেই টুইটার আবার এসব একাউন্ট আবার খুলে দেয়। তখন তারা বলেছিল, এসব একাউন্ট বন্ধ রাখার যথেষ্ট যুক্তি নেই। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে টুইটারকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়, ভারতে ব্যবসা করতে চাইলে স্বাগতম, কিন্তু সেটা করতে হবে ক্ষমতাসীনদের আরোপ করা নির্দেশ অনুযায়ী,  সরকারের ভাষায়, ‘ভারতীয় আইন-কানুন মেনে’।

ভারত সরকার বলেছে, টুইটারসহ বড় সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোকে কনটেন্ট সরিয়ে নেয়ার অনুরোধ করার পরেও তারা সেটা মানেনি। এরপর গত মাসের শেষের দিকে ভারতের তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় টুইটারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেয়। ভারতের তথ্য প্রযুক্তি আইনের জোরে জাতীয় নিরাপত্তা এবং জনশৃঙ্খলার অজুহাতে যে কোন অনলাইন কনটেন্ট ভারত সরকার ব্লক করে দিতে পারে। অন্যদিকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ‘কমিউনিটি স্ট্যানডার্ড’-এর নামে ফেইসবুক টুইটার ইউটিউব ইত্যাদি কর্পোরেশানো বন্ধ করে দিতে পারে। কিম্বা তাদের প্রচার সীমিত করে দিতে পারে। এর সমাধান কিভাবে হবে এই মূহূর্তে আমাদের জানা নাই, কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতির নামে কোন টুইট বা পোস্ট বন্ধ করাকে আমরা যত সরল ভাবে পক্ষে ও বিপক্ষে দাঁড়াই, সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।

‘ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট’

ধর্মীয় অনুভূতির প্রসঙ্গ নতুন করে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে সূচনা হোল আবার। স্বাধীন সিনেমা পরিচালকের তথ্যচিত্রে কালীর সাজে সজ্জিত অভিনেত্রীর মুখে সিগারেট দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছে কারা? হিন্দুত্ববাদী শিবির! ঠিক। যে বিষয়টা নিছকই ব্যক্তির অধিকার কিম্বা শিল্পীর স্বাধীনতা না, একটি সমাজের মর্যাদার প্রশ্নও বটে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ব্যাপারটা কি আসলেই একাট্টা ‘হিন্দু’ নামক কোনো ধর্মীয় পরিচিতির? সেই দিক থেকে কিছু আলোচনা করা যাক। 

প্রথমত কালী কখনোই হিন্দুত্ববাদীদের ধর্মীয় অনুভূতির বিষয় নয়। কেননা, কালী মূলত তন্ত্রের দেবী। আর হিন্দুত্ববাদীদের যে হিন্দু পরিচিতি তা মূলত বৈদান্তিক। বৈদিক আধারেই ঔপনিবেশিক আমলে ‘হিন্দু’ নামক একটি ফেব্রিকেটেড রিলিজিয়নের উদ্ভব ঘটে ব্রিটিশ প্রভুদের সৌজন্যে। হিন্দু নামে ধর্ম নাই কোনো। শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব, গাণপত্য ইত্যাদি নানা ধর্ম আছে। তার পাশাপাশি আছে বৈদিক ধর্ম। কিন্তু হিন্দু বলে কোনো ধর্ম ছিল না। নেই। বৈদিক আধারে শাক্ত, শৈব, সাংখ্য, বৈষ্ণব ইত্যাদি ধর্মীয় বিদ্যাঘরকে একটি মঞ্চে নিয়ে এসে তাকে ‘হিন্দু’ হিসাবে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়ার সূচনা মাত্র অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে। এবং বৈদিক চিন্তার সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান বাকি অধিকাংশ সনাতনী ধর্মমতগুলির।

কালী তন্ত্রের দেবী। শাক্তের দেবী। শক্তির দেবী। কালী অবৈদিক। কালী একদিকে যেমন কৈবল্যদায়িনী, তেমনই তিনি বিনির্মাণের প্রতীক। তিনি স্বনির্ভর। তিনি কালের আদি। ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন তিনি ছিলেন। তাঁর থেকে কালের ধারণা জন্ম নিয়েছে।

কালী একটি পরিব্যাপ্ত ডিসকোর্স। বঙ্গে কালীর আদিতে কোনো পৌত্তলিক রূপ ছিল না। বঙ্গে বহিরাগত ব্রাহ্মণদের দ্বারাই নিরাকার শক্তি কালীর পৌত্তলিক রূপকল্পনা সামনে আসে। এটা আসে আগমবাগীশের দ্বারা। শুধু তাই নয় দেবাদিদেব মহাদেবের উপরে তাঁকে দণ্ডায়মান করেও তাঁর জিভ বের করে দেওয়া হয়, যেন-বা পুরুষকে পদানত করাটা তাঁর বিরাট ভুল। অর্থাৎ পুরুষতন্ত্রের ঝাণ্ডা উঁচা রাখতেই কালীকে লজ্জার জিভ কাটতে বলা হয়। বলে, বৈদিক ব্রাহ্মণরাই। অথচ কালী যে প্রকৃতি শক্তি, সেই প্রকৃতি বিহনে শিব শব মাত্র। অর্থাৎ মৃত। প্রকৃতি বিহনে পুরুষ যে অচল তা বঙ্গ সেই সাংখ্য তত্ত্বের আমল থেকেই বলে এসেছে। তাই শিবতত্ত্ব — অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতির যুগল ভাবনা। শিবলিঙ্গ হলো নিরাকার ব্রহ্মের চিহ্ন, যে চিহ্ন একাদিক্রমে পুরুষ এবং প্রকৃতি। কালীর পায়ের নিচে শিব পদানত না হলে তাঁর বেইল নাই, তিনি মড়া কেবল। গৌরীর সঙ্গে গায়ে গা না লাগিয়ে থাকলে শিবকে কে-ই বা চিনতো। তো বঙ্গের এই আদি দ্বৈতাদ্বৈত তত্ত্ব থেকেই পুরুষ, প্রকৃতি তথা দুইয়ের মিলেমিশে অদ্বৈত কর্তাসত্তার আইডিয়া। এছাড়া যোগ পরম্পরায় কালী ধ্যানের একটি বিশেষ পর্যায়ও বটে। কিন্তু সব মিলিয়ে বঙ্গের কালীতত্ত্বে প্রকৃতি তথা নারীর বিশেষ স্থান রয়েছে — পুরুষের মুখাপেক্ষী নয়। বরং পুরুষ তার অধীনস্থ। তো এমন আইডিয়া বড় বাংলার সাহিত্য সম্ভার, চিত্রকলা-সহ নানা শিল্পমাধ্যম নানাভাবে উদযাপন করেছে। তার প্রভাব পড়েছে গোটা উপমহাদেশে।

কালী সিগারেট

তো উপমহাদেশেরই একজন সিনামা পরিচালক কালীর সজ্জায় কোনো নারীর মুখে সিগারেট বসালে তা নিয়ে আলাপ-তর্ক ইত্যাদি হতেই পারে, ছবিটি দেখার পরে। আলাপ হতে পারে, কালীকে কি তিনি আজকের বুর্জোয়া ফেমিনিজমের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের আইকন হিসাবে দেখাতে চেয়েছেন? নাকি কেবলই পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে উপমহাদেশের কালো-শ্যামলা অনার্য মেয়েদের প্রতিস্পর্ধার আইকন বানাতে চেয়েছেন? যদিও কালী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের আইকন নন। বরং কালী কালেক্টিভ। প্রকৃতিস্বরূপা তিনি। তিনি চালিকাশক্তি। তিনি তাঁর কর্ম করে যান। মানুষের মধ্য দিয়েই, কিন্তু ‘লোকে বলে করি আমি’। সকলই তাঁর ইচ্ছা।

এসব নিয়ে আলাপ তখনই সম্ভব যখন শিল্পীর স্বাধীনতাকে আমলে নেওয়া হবে। তাঁকে উড়িয়ে না দিয়ে, তাঁর কন্ঠরোধ না করে তাঁর সঙ্গে আলাপে রত হওয়া যাবে। কেননা, মনে রাখা দরকার, কালী-শিব, কেষ্ট-রাধা, হর-পার্বতী ইত্যাদি সকল অবৈদিক মিথিক্য্যাল দেবদেবীগণকে ঘিরে যে চর্চা তা কখনই মনুবাদী পিতৃতন্ত্র কিংবা পশ্চিমা চার্চের মতো রসকসহীন পুরুষতান্ত্রিক পুরোহিতন্ত্রের ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না বরং তা ছিল মাল্টিলেয়ারড। বহু রঙের রূপব্যঞ্জনা। বহু স্বরের প্রতিধ্বনি। বহু অভিব্যক্তির প্রকাশ। কালী গীতি-কাব্য-মস্করা-হুল্লোড়-প্রেম-অশ্রু ও সর্বোপরি ভক্তিরসে পরিপূর্ণ। তাই কালীর নামের সিগারেটও তৈরি হয়েছে বাংলায়, কালীর ছবিকে মোড়কের মধ্যে রেখে বিড়ির প্যাকেট অবধি তৈরি হয়েছে বঙ্গের বিড়ি শ্রমিকদের কুটির শিল্পে। কালীপূজায় যে শুধু মদ নিবেদন করা হয়েছে তাই নয়, বরং কালীর ছবি বাংলা মদের বোতলের স্টিকারে ছাপানো হয়েছে যুগ যুগ ধরে। কেউ রাগ করেন নাই। মুণ্ডপাত করতে চান নাই কারো। মদ অবশ্যই সবার রুচিসম্মত নয়। কিন্তু মদ্যপানের বিপক্ষে থাকা লোকজনও এই নিয়ে শোরগোল জুড়ে দেন নাই। কিন্তু আজ যখন একটি বেরসিক, বেরঙিন, পেশীবহুল হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানি মতাদর্শ সর্বগ্রাসী হয়ে উপমহাদেশকে গ্রাস করতে উদ্যত, যখন তারা সকল সনাতনী রূপের নিরাকরণ করে কেবল গেরুয়া ঝাণ্ডাকেই সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তখনই তাদের কল্পিত ধর্মীয় অনুভূতির ভূত এসে নৃত্য শুরু করে উপমহাদেশীয় সাংস্কৃতিক রাজনীতির উঠানে।

আমরা বলতে চাই, আমাদের শিব-কালীও নৃত্য করতে জানেন। তাঁরা নাচলে কিন্তু প্রলয় নৃত্য হবে। কোনো মনুবাদীর হিম্মত নাই সে নৃত্য ঠেকানোর।

দেবাদিদেব মহাদেবের উপরে তাঁকে দণ্ডায়মান করেও তাঁর জিভ বের করে দেওয়া হয়, যেন-বা পুরুষকে পদানত করাটা তাঁর বিরাট ভুল। অর্থাৎ পুরুষতন্ত্রের ঝাণ্ডা উঁচা রাখতেই কালীকে লজ্জার জিভ কাটতে বলা হয়। বলে, বৈদিক ব্রাহ্মণরাই। অথচ কালী যে প্রকৃতি শক্তি, সেই প্রকৃতি বিহনে শিব শব মাত্র। অর্থাৎ মৃত। প্রকৃতি বিহনে পুরুষ যে অচল তা বঙ্গ সেই সাংখ্য তত্ত্বের আমল থেকেই বলে এসেছে। তাই শিবতত্ত্ব অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতির যুগল। শিবলিঙ্গ হলো নিরাকার ব্রহ্মের চিহ্ন, যে চিহ্ন একাদিক্রমে পুরুষ এবং প্রকৃতি। কালীর পায়ের নিচে শিব পদানত না হলে তাঁর বেইল নাই, তিনি মড়া কেবল। গৌরীর সঙ্গে গায়ে গা না লাগিয়ে থাকলে শিবকে কে-ই বা চিনতো। তো বঙ্গের এই আদি দ্বৈতাদ্বৈত তত্ত্ব থেকেই পুরুষ, প্রকৃতি তথা দুইয়ের মিলেমিশে অদ্বৈত কর্তাসত্তার আইডিয়া।

অর্দ্ধনারীশ্বর

এক্ষেত্রে আরও বলা দরকার, আলোচিত ওই পোস্টারে কালীর সাজে সজ্জিত সিনে-চরিত্রের হাতে জেন্ডার ইকুয়ালিটি বা LGBT’এর রঙধনু পতাকাও দেখা গেছে। সিগারেট বাদে এই পতাকাটিও তর্কের বিষয় হয়েছে। কালীর হাতে এলজিবিটিকিউ-এর পতাকা তুলে দিয়ে লীনা যে রাজনৈতিক বার্তা দিতে চেয়েছেন তাকে আমলে নিয়ে বস্তর আলোচনা হতে পারে। বাংলার ভাবের জায়গা থেকেও এই বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ হওয়া উচিত। বড় বাংলার ভাবের পরিসরে এলজিবিটি বাইরের কিছু নয়। বড় বাংলা এই অর্থেও ‘বড়’। পুরুষ ও প্রকৃতির যুগল সম্বন্ধের কথা কালী ও শিব, এই দুই অবৈদিক দেবদেবী প্রসঙ্গে আগেই আমরা বলেছি। বলেছি যে শিবলিঙ্গ ব্রহ্ম চিহ্ন হিসাবে পুরুষ ও প্রকৃতির যুগল-অদ্বৈত হিসাবে আমাদের দৃশ্যপটে হাজির। কালীকে বুঝতে গেলে শিবতত্ত্ব বোঝা যেমন জরুরী, তেমনই শিবকে বুঝতে গেলে পুরুষের পাশাপাশি প্রকৃতিকে বুঝতে হবে। এই লিঙ্গদ্বয়ের সাম্য সনাতনী মিথলজিতে উপস্থিত, উপস্থিত অর্দ্ধনারীশ্বরের তত্ত্ব ও তার মূর্তরূপ হিসাবে। সুতরাং আজকের এলজিবিটি’র রাজনৈতিক বার্তার অন্তর্বস্তু উপমহাদেশের চিন্তাজগতেও আলোচনা ও তর্কের বিষয় হোক। অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না।  

‘ধর্মীয় অনুভূতি’ ধারণাটির অপব্যবহার আছে, আমরা এই প্রকার কোনো বিমূর্ত ধারণাকে প্রশ্রয় দিতে চাই না। কিন্তু তর্কটা ব্যক্তি অধিকার বনাম ধর্মীয় অনুভূতি না। বরং ব্যাক্তি অধিকার বনাম মানবিক মর্যাদা। কোনো ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠিকে সচেতন ও সজ্ঞানভাবে হেয় করা , অপমান করা বা কারো মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করারা চেষ্টা আমরা নিন্দা করি। তাছাড়া তথাকথিত ধর্মীয় অনুভূতি কি শুধুই আধুনিক হিন্দুত্ববাদীদের? শাক্তের কি ধর্মীয় অনুভূতি নাই? শৈবের কি ধর্মীয় অনুভূতি নাই? বজ্রাযানীর কি ধর্মীয় অনুভূতি নাই? মহাযানীর নাই? বৈষ্ণবের নাই? ঔপনিবেশিক ও আধুনিক এককাট্টা জাতিবাদী ‘হিন্দু’ পরিচয় এদের প্রতিনিধিত্ব করে না।

আধুনিক হিন্দুত্ববাদীরা এমন এক বিদ্বেষের রাজনীতি কায়েম করতে চাইছে যাতে শুধু মুসলমানরা আক্রান্ত হচ্ছে তা নয় বরং উপমহাদেশের নানা মত-পথ বিশ্বাস আক্রান্ত হয়ে চলেছে। এই যেমন শাক্তের বিচার-আচার, পূজা পদ্ধতি, আমিষ ভোগ নিবেদনের রীতিকে খণ্ডন করে উত্তর ভারতীয় বৈদিক শাকাহারি নিয়ম চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী শিবির। হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে যখন পশ্চিমবঙ্গের সাংসদ মহুয়া মৈত্র ন্যাযত জানাচ্ছেন যে কালীপূজায় মদ-মাংস নিবেদন করাই রীতি অর্থাৎ কালী মদ-মাংস খান, তখন তাঁকেও গ্রেফতারের দাবি উঠেছে গেরুয়া শিবির থেকে। অথচ কালীপূজা-সহ সকল প্রকার শক্তিপূজায় মৎস্য, মাংস ও কারণ বারি বা মদ নিবেদন করার রীতি বঙ্গের শাক্তধর্মে বহু প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। তন্ত্রাচারে মদ-মাংসের ব্যবহার অতি প্রাচীন। 

শাক্ত সংস্কৃতিতে, শাক্ত সাধনায়, শক্তি আরাধনায় নিরামিষ খাদ্য দ্রব্যাদির বদলে আমিষ ব্যবহার, আমিষ ভোগ ব্যবহারই রীতি, অভ্যাস, ঐতিহ্য। এক্ষেত্রে শাক্ত সংস্কৃতিকে যদি কেউ নিরামিষ খাদ্য ব্যবহারে অভ্যস্থ করাতে চায়, সেটা কি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুভূতিতে আঘাত নয়? সাংস্কৃতিক আগ্রাসন নয়? উত্তরপ্রদেশ-সহ হিন্দি বলয়ের ‘হিন্দু’রা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৈদান্তিক সংস্কৃতির। তাদেরও আমরা জোরজবরদস্তি মাছ-মাংস খাওয়ানোর বিপক্ষে। আবার উত্তরপ্রদেশেই ভিন্ন আচার-সংস্কৃতি-বিশ্বাসের মানুষজন তারা তাদের আচার-বিশ্বাস নিয়েই থাকবেন তারা আমিষ খাবেন, তারা একেশ্বরের এবাদত করবেন কিংবা তারা প্রকৃতিপূজা করবেন, সেই এখতিয়ারও তাদের সমাজের নিজস্ব। কিন্তু কোনো উর্দুভাষী মুসলমান খাবার দোকানদার আমিষ খাবার বিক্রি করার সময় চটজলদি মোড়ক হিসাবে খবরের কাগজ ব্যবহার করলে এবং তাতে সোকল্ড হিন্দু দেব-দেবীর ছবি থাকলে সেটাকে যদি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হিসাবে ধরা হয়, তাহলে বুঝতে এই যাদের বিবেচনা, এই যাদের বিচার- তারা পরিচয়বাদী রাজনীতির সাইকোপ্যাথ ছাড়া কিছুই নয়। কাগজের মোড়ক ব্যবহার অসংগঠিত খাবার ব্যবসায়ে খুবই সাধারণ ব্যাপার, এটাতে কেউ আলাদা করে দেখে না বা দেখার সুযোগ নাই যে খাবারের মোড়ক হিসাবে ব্যবহার করা কাগজে কিসের ছবি আছে। আসলে উল্টোটাই এক্ষেত্রে সত্যি, প্রথমত ঘুরিয়ে আমিষ খাবারের বিরুদ্ধে বিষোদগার হেতুই ইউপির হিন্দুস্তানি মুসলিম খাবার ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ তুলে তাকে ইউপিতে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাশাপাশি নূপুর শর্মা নবী মোহাম্মদ (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে কুরুচিকর ও বিকৃত ব্যাখ্যায় মন্তব্য পেশ করার কারণে গোটা বিশ্বে হিন্দুত্ববাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে তার কাউন্টারে হিন্দুত্ববাদীরা এখন কথায় কথায় নানা কিছুতে তাদের ধর্মীয় অনুভূতি আঘাত পাওয়ার মতো উপাদান খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাই ‘হিন্দু’ দেব-দেবীর ছবিওয়ালা কাগজ টুকরো খাবারের মোড়ক হিসাবে ব্যবহার হওয়ার মতো মামুলি ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে বলে যুক্তি সাজানো হচ্ছে, প্রতিহিংসা চরিতার্থে উর্দুভাষী মুসলিম পথব্যবসায়ীকে হাজতে পাঠিয়েছে ইউপি পুলিশ।

কালীপূজার আমিষ ভোগ

নবী মোহাম্মদ (সাঃ)-এর বিষয়ে যে মন্তব্য তা এই কারণেই কটুক্তি কেননা, ওই মন্তব্যে ইতিহাস, বিশ্বাস ও আধ্যাত্ম ইত্যাদির অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। কীভাবে সেই অপব্যাখ্যা তা আলাপের জন্য অবশ্য ভিন্ন পরিসর রয়েছে। শুধু এটুকু এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে তথ্যকে পেশ করা হয়েছে ইসলাম ও মুসলমানদের হেয় করার জন্য। পেশ করবার ভাষা, অভিব্যক্তি ও বাচনভঙ্গিমার বিচার ভঙ্গিমা বিচার করলেই সেটা বোঝা যায়। তথ্য পেশ করবার চরিত্র দ্বারা ইতিহাসের অন্তর্বস্তুকে বিকৃত বা হেয় করা হচ্ছে! নূপুর শর্মা সবটাই করেছেন। তাই তা শুধু মুসলমানের ঈমানকে আঘাত দিয়েছে তা নয়, বরং যে কোনো ধার্মিক ও রুচিশীল মানুষের রুচিতেও তা আঘাত করেছে।

এর সঙ্গে কালী বিষয়ে ছবি কিংবা দেব-দেবীর ছবিওয়ালা কাগজের টুকরোকে আমিষ খাবারের চটজলদি মোড়ক হিসাবে মুসলমান দোকানির ব্যবহারের ঘটনাকে এক করা যায় না। যারা এটা করেন তারা অবশ্যই ধর্মের নামে রিলিজিয়াস আইডেন্টিটির ভেদ-বিভেদ ও বিদ্বেষের রাজনীতি ছড়াতে চান। পশ্চিমা দুনিয়া এভাবেই ইসলামবিদ্বেষ ছড়িয়েছে, আর সেই পশ্চিমা দুনিয়ার মতো করে আধুনিক হিন্দুত্ববাদীরা এমন এক বিদ্বেষের রাজনীতি কায়েম করতে চাইছে যাতে শুধু মুসলমানরা আক্রান্ত হচ্ছে তা নয় বরং উপমহাদেশের নানা মত-পথ বিশ্বাস আক্রান্ত হয়ে চলেছে। এই যেমন শাক্তের বিচার-আচার, পূজা পদ্ধতি, আমিষ ভোগ নিবেদনের রীতিকে খণ্ডন করে উত্তর ভারতীয় বৈদিক শাকাহারি নিয়ম চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী শিবির। হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে যখন পশ্চিমবঙ্গের সাংসদ মহুয়া মৈত্র ন্যায্যত জানাচ্ছেন যে কালীপূজায় মদ-মাংস নিবেদন করাই রীতি অর্থাৎ কালী মদ-মাংস খান, তখন তাঁকেও গ্রেফতারের দাবি উঠেছে গেরুয়া শিবির থেকে। অথচ কালীপূজা-সহ সকল প্রকার শক্তিপূজায় মৎস্য, মাংস ও কারণ বারি বা মদ নিবেদন করার রীতি বঙ্গের শাক্তধর্মে বহু প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। তন্ত্রাচারে মদ-মাংসের ব্যবহার অতি প্রাচীন। 

মহুয়া মৈত্র, সাংসদ, কৃষ্ণনগর, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ।

পরিস্থিতি কঠিন। সংবেদনশীল শিল্পী, সাহিত্যিক, সমাজকর্মীদের এক হয়ে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, পরম্পরা, গণসমাজ ইত্যাদির পক্ষে কাজ করে যাওয়া ছাড়া উপায় নাই। আধুনিক পরিচয়বাদী/জাতিবাদী পন্থায় এর মোকাবিলা সম্ভব নয়। বরং আমরা বড় বাংলা তথা উপমহাদেশের প্রাণ-প্রকৃতি-পরমের যে সমন্বয়বাদী সমাজ তার পক্ষে চারুভাষ্য হাজির করতে পারি। আমরা ফের বলতে পারি মানুষ ভজনার মধ্যে দিয়ে পরমের এবাদতের কথা।  

কথা হোক, কিন্তু ধর্মীয় সেন্টিমেন্টের নামে নয়। ব্যক্তি অবশ্যই সমষ্টি বা সমাজের কাছে দায়বদ্ধ।  তেমনই সমাজের উচিত নয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষমতার জোরে শিল্পীর কন্ঠ টিপে ধরা।

এমন দিন কি হবে মা তারা।
যবে তারা তারা তারা বলে তারা বেয়ে ঝরবে ধারা॥
হৃদিপদ্ম উঠবে ফুটে, মনের আঁধার যাবে ছুটে,
তখন ধরাতলে পড়বো লুটে, তারা বলে হব সারা॥
ত্যজিব সব ভেদাভেদ, ঘুচে যাবে মনের খেদ,
ওরে শত শত সত্য বেদ, তারা আমার নিরাকারা॥
শ্রীরামপ্রসাদ রটে, মা বিরাজে সর্বঘটে,
ওরে অন্ধ আঁখি দেখ রে মাকে, তিমিরে তিমির ভরা॥

রামপ্রসাদ

 


Share