![](http://protipokkho.com/wp-content/uploads/2021/04/rsz_add_a_heading_18.jpg)
।। মুখোমুখি মনোরঞ্জন ব্যাপারী ।।
পশ্চিমবঙ্গের দলিত সাহিত্য আকাদেমির চেয়ারম্যান, লেখক, কথা সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ব্যাপারী পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন, ২০২১-এ হুগলী জেলার বলাগড় বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী হয়েছেন। জীবন সংগ্রাম থেকে সাহিত্যকর্ম এবং রাজনীতি, সবেতেই মনোরঞ্জন ব্যাপারী বর্ণময় চরিত্র। বাংলার দলিত সাহিত্যের নক্ষত্র। এক সময় রিকশা চালিয়েছেন, বাবুর্চি হিসাবে রান্না করেছেন স্কুলের ক্যান্টিনে, তার মধ্যেই চালিয়ে গেছেন সাহিত্যকর্ম। এই মুহূর্তে গোটা ভারতে তাঁর সাহিত্যকর্ম ও ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে পরিচিত নন, সাহিত্য জগতে এমন কম মানুষই আছেন। এমন একজন মানুষ বিধানসভা ভোটে লড়ছেন ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করতে চেয়ে। তাঁর কেন্দ্রে ভোটের আগে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন অতনু সিংহ।
এটা এমন একটা নির্বাচন, যেখানে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে ভোটের মাধ্যমে লড়াই করছে বাংলা। এই লড়াইয়ের আমি একজন সৈনিক মাত্র।
অতনু সিংহ: একজন লেখক হিসাবে আপনি সংসদীয় গণতন্ত্রের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আমরা জানি এর আগে এক সময় আপনি সংসদীয় রাজনীতির বাইরে বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে সেভাবে আস্থাও ছিল না আপনার। কিন্তু এখন আপনি ভোটের ময়দানে। এই লড়াইটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মনোরঞ্জন ব্যাপারী: ভোটে এই জন্যে লড়ছি যে আজকে ফ্যাসিবাদী শক্তি যেভাবে বাংলার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যেভাবে গোটা ভারতবর্ষটাকে গ্রাস করতে চাইছে, যদি তাদের প্রতিহত করা না হয় তাহলে গণতান্ত্রিক পরিসর ধ্বংস হবে, পশ্চিমবঙ্গে বাঙালির শিল্প-সমাজ-সংস্কৃতি সব ধ্বংস হয়ে যাবে। আমরা যারা লেখালেখি করি, আমরা লিখব কাদের জন্যে আর কারা পড়বে… যে অস্থিরতা ওরা তৈরি করতে চাইছে, মানুষে মানুষে বিভাজন, দাঙ্গা-হাঙ্গামার যে পরিবেশ ওরা সৃষ্টি করতে চাইছে, ওরা যদি এতে সফল হয়ে যায়, তাহলে তো আমাদের এই লেখালেখি করার মতো অবস্থাটাও তো আর থাকবে না, তখন তো আপনাকে-আমাকে আত্মরক্ষার জন্য অনবরত পালিয়ে বেড়াতে হবে! কারণ, আমাদের লেখাগুলো তো ওদের মনঃপূত হবে না… দিলীপ ঘোষের বক্তব্য কী মাঝে মধ্যে নিশ্চই শুনতে পাচ্ছেন… তো ওদের প্রতিহত করার জরুরি নিজেদের প্রয়োজনেই, আমরা কলম চালিয়ে ওদের রুখতে পারব না। এমনিতে অবশ্য বলা হয় অসির চেয়ে মসি বেশি শক্তিশালী, কিন্তু আমার মতে সেটা শান্তিপর্বে। কিন্তু যুদ্ধপর্বে অসি আর মসি যদি মুখোমুখি হয়, তাহলে অসিই জেতে, মসি জিততে পারে না। তাই বলব এখন মসির লড়াইটা থাক, যেহেতু অসি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওরা, তাই ওরা যে ভাষা বোঝে ওদের সেভাবেই জবাব দিতে হবে।
![](https://protipokkho.com/wp-content/uploads/2021/04/rsz_monoranajan1.jpg)
অতনু: একজন লেখককে প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করানোটা কি এই মুহূর্তে ব্যতিক্রমী কোনো ঘটনা? কেননা, আমরা একটা সময় দেখতাম, গণআন্দোলনে কিংবা সংসদীয় রাজনীতিতে লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীদের একটা জায়গা ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে মূলধারার রাজনীতির সংসদীয় লড়াইয়ের ক্ষেত্রে লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের থেকে গ্ল্যামার দুনিয়ার লোকজনের গুরুত্ব অনেক বেশি। পশ্চিমবঙ্গের এবারের নির্বাচনেও প্রায় সবকটি রাজনৈতিক পক্ষেই টলিউডের লোকজনের ভিড়… তার মাঝখানে আপনি একমাত্র ব্যক্তি, যার পরিচয় শুধুমাত্র একজন লেখক…
মনোরঞ্জন: বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে, গণবিপ্লবে লেখক, কবিদের অংশ নিতে আমরা সকলেই দেখেছি। আমাদের বঙ্গদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। আমিও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে থেকেছি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে আমার এই লড়াইয়ের পিছনে যার অবদান তিনি এক এবং একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন একজন যিনি নিম্নবর্গের, নিম্নবর্ণের, অসহায় মানুষের কথা ভেবেছেন। তিনি হয়তো মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বলেননি বা বলেন না… কিন্তু মুখে সমাজতন্ত্রের কথা যারা বলেছেন বা বলেন, তাঁদের বেশিরভাগ কী করেছেন বা করতে পারছেন আমরা সবাই সে বিষয়ে অবগত। যারা ওসব বলেছিল তারা শুধু মুখেই বলেছিল, কিছুই করেনি। অন্যদিকে মমতা কেবলমাত্র সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষের কথা ভাবেন যে তাই নয়, বরং তিনি তাঁর ভাবনাগুলোকে বাস্তবে প্রয়োগ করেন। আমরা দেখেছি , পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তিনি এমন ৬৪টি প্রকল্প নিয়ে এসেছে, যেগুলোর দ্বারা সরাসরি উপকৃত হয়েছেন সমাজের গরীব, অসহায়, পিছিয়ে থাকা মানুষগুলো। দলিত মানুষ, অসহায় মানুষ, নিম্নবর্গের মানুষ, গরীব মানুষ- এদের জন্য ওনার দরদের শেষ নেই, আমি তারে যতটুকু দেখেছি বা জেনেছি তাতে করে এটাই বলা যায়। ওনার মতো করে উনি চেষ্টা করছেন নীচুতলার মানুষের জন্যে, এই ব্যবস্থার মধ্যে যতটুকু করা সম্ভব। এই বিষয়গুলো দেখেশুনে এই মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত না হয়ে থাকতে পারিনি।
![](https://protipokkho.com/wp-content/uploads/2021/04/rsz_mono-6.jpg)
ভেবে দেখুন, উনি একজন ব্রাহ্মণ কন্যা হয়েও ‘দলিত সাহিত্য আকাদেমি’ তৈরি করলেন। দলিত সাহিত্যে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু কী? পরিস্কারভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য। তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভেবেছেন আমাদের সাহিত্যের মধ্যে, আমাদের কন্ঠস্বরের মধ্যে কিছু সত্যি রয়েছে। আর তাই আমাদের কন্ঠস্বরকে আরও শক্তিশালী করে তোলার জন্যে ৫ কোটি টাকার ফান্ড দিয়েছেন দলিত সাহিত্য আকাদেমির মাধ্যমে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তিগতভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে মনে করেন, জন্মজনিত কারণে কোনো মানুষকে ‘অপরাধী’ চিহ্নিত করা, তাদের অগ্রগমনের পথে বাধা তৈরি করা, অবরোধ তৈরি করা- এটা অন্যায়। এই বাধাটা যাতে চূর্ণ হয়, এটা ভেবেই তো উনি দলিত সাহিত্য আকাদেমি তৈরি করেছেন। আমাদের কন্ঠস্বরকে, আমাদের লেখনীকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছেন। আর এই আকাদেমির দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দিয়েছেন। মনে রাখবেন, কেবলমাত্র একজন লেখককে উনি ভোটের লড়াইয়ে নামাননি, উনি একজন দলিত সাহিত্যিককে নির্বাচনে প্রার্থী করেছেন। আর এটা এমন একটা নির্বাচন, যেখানে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে ভোটের মাধ্যমে লড়াই করছে বাংলা। এই লড়াইয়ের আমি একজন সৈনিক মাত্র।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তিগতভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে মনে করেন, জন্মজনিত কারণে কোনো মানুষকে ‘অপরাধী’ চিহ্নিত করা, তাদের অগ্রগমনের পথে বাধা তৈরি করা, অবরোধ তৈরি করা- এটা অন্যায়। এই বাধাটা যাতে চূর্ণ হয়, এটা ভেবেই তো উনি দলিত সাহিত্য আকাদেমি তৈরি করেছেন
অতনু: আপনি এক সময় নকশালবাড়ির বিপ্লবী কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। আপনার লেখার ক্ষেত্রেও দেখা যায়, নিম্নবর্গের, নিম্নবর্ণের মানুষের হয়ে আপনি কথা বলছেন এবং সেই কথাগুলোর মধ্যে কোথাও একটা শ্রেণী সচেতনতা রয়েছে। আমাদের বাংলায়, বিশেষত পশ্চিম বাংলায় তথা গোটা উপমহাদেশের নানা জায়গায় ক্লাস এবং কাস্ট যে মিলেমিশে আছে, এই বিষয়টাকে যারা নানাভাবে তাদের সৃজনকর্মে, বয়ানে নিয়ে এসেছেন, আপনি তাদের মধ্যে অন্যতম। আপনার কাছে যেটা জানতে চাই তা হলো, আপনি কি এমন কখনও অনুভব করেছেন যে আমাদের এখানকার মূল ধারার সো-কল্ড মার্ক্সবাদী রাজনীতিতে শ্রেণী ধারণার মধ্যে বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা এই সকল পরিচিতিগুলো বিচ্ছিন্ন করে রাখার একটা প্রবণতা রয়েছে?
মনোরঞ্জন: একেবারেই। এখানকার ওই মেইনস্ট্রিম লেফটরা এটা উপলব্ধিই করতে পারেন নি যে এখানকার শ্রেণী পরিচিতির মধ্যেও বর্ণবিভাজন, লৈঙ্গিক বিভাজন এবং জাতিসত্তা ও ভাষা প্রশ্নগুলো মিলেমিশে আছে। এটা হয় তারা উপলব্ধি করতে পারেননি অথবা উপলব্ধি করলেও এই বিষয়টাকে এড়িয়ে চলতে চেয়েছেন। এখানকার বেশিরভাগ কমিউনিস্টরা হলেন ভদ্রবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি। আর এই ভদ্রবিত্ত মানেই উচ্চবর্ণ। তারা মনে করেন নিম্নবর্ণের মানুষ যারা কিংবা আদিবাসী ও মুসলমান যারা, তারা নাকি উচ্চবর্ণের থেকে অনেক পিছিয়ে! হা হা! এজন্যে এই তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টি সিপিএমএর পলিটব্যুরোতে দেখুন নিম্নবর্ণের জায়গা নেই, বাঙালি মুসলমানের উল্লেখযোগ্য কোনো উপস্থিতি নেই। মহিলাদের জায়গাও খুবই কম। সেখানে গুটি কয়েক্ল উচ্চবর্ণের মানুষ বছরের পর বছর চেয়ার আগলে বসে রয়েছেন। এর ফলে এক সময়ে যে কমিউনিস্ট আন্দোলন বাংলায় তথা উপমহাদেশে যে আলোড়ন তৈরি করেছিল, তা ক্রমশই শূন্যের কোটায় মিলিয়ে গেল! এর কারণ, কমিউনিস্ট পার্টি যাদের লড়াইয়ের প্লাটফর্ম হিসাবে উঠে এসেছিল, তাদের কন্ঠস্বর তাদের প্রতিনিধিত্ব ধারণ করতে পারল না। কিছু তাত্ত্বিক কচকচানির মধ্যে আর ক্ষমতার ভাগবাঁটোয়ারার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল মেইনস্ট্রিম কমিউনিস্টরা। এই উচ্চবর্ণের তাত্ত্বিক বিপ্লবীদের কাছে বিপ্লব না হলে কিছুই যায় আসে না। কারণ উচ্চবর্ণের প্রতিনিধি হওয়ার কারণে, বর্ণহিন্দু হওয়ার কারণে শ্রেণীর লড়াইয়ে তাদের আন্তরিকতা ছিল না, জেদ ছিল না। এই লড়াইটা যে জিততেই হবে, বিদ্যমান এই ব্যবস্থাটা যে ভেঙে ফেলতেই হবে- এমন কোনো সংকল্প তাদের মধ্যে ছিল না। তারা খালি নেতাগিরির দোকানদারি চালিয়েছেন, এই কারণেই নিম্নবর্ণের ও নিম্নবর্গের মানুষলে তারা কাছে টানতে পারেননি। নকশালবাড়ির কথাটা ভিন্ন। নকশালবাড়ির রাজনীতির প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু ভুলভ্রান্তি থাকলেও ওই লড়াইটা এই বৈষম্য আর নিপীড়নের ব্যবস্থাকে সমূলে উচ্ছেদ করার ডাক দিয়েছিল সামগ্রীকভাবে। তার ব্যর্থতার পেছনে সামগ্রীকভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ব্যর্থতা-সহ আরও কিছু কারণ হয়তো রয়েছে। আবার নতুন কোনো সম্ভাবনাও থাকতে পারে। সেইটা ভিন্ন পরিসরে আলোচনার বিষয় হতে পারে।
![](https://protipokkho.com/wp-content/uploads/2021/04/rsz_mono11.jpg)
অতনু: আপনি মতুয়াদের নিয়ে বই লিখেছেন। মতুয়াদের নিয়ে আপনার কাজ রয়েছে। বাংলার ভক্তি আন্দোলনে মতুয়াদের যে অবদান তা নিয়ে আপুনার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। এই মতুয়ারা নিম্নবর্ণের, নিম্নবর্গের মানুষ। ব্রাহ্মণ্যবাদের দ্বারা তারা যুগ যুগ ধরে শোষিত হয়েছে। ইনফ্যাক্ট মতুয়াদের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মধ্যেই রয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই-সংগ্রামের ঐতিহ্য, বাংলার নিম্নবর্ণের মানুষের ভক্তি আন্দোলনের ইতিহাস… এত কিছুর পরেও ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে দেখা গেল মতুয়াদের একটা অংশ আজ বাংলায় বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে পরিণত হয়েছে… ব্রাহ্মণ্যবাদী বিজেপির এই সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর রহস্যটা কী?
বর্ণবিভাজনের বিরুদ্ধে, জাতপাতের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে যে সচেতনতা তৈরি করার কথা ছিল সো-কল্ড বামেরা তা মোটেই পারেনি। উল্টে উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিত্ব করেছে, ভদ্রবিত্ত সমাজের সুপ্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতায় উস্কানি দিয়েছে। ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই মরিচঝাঁপির গণহত্যা ঘটিয়েছে। আমরা তো কেউ ভুলে যাইনি মরিচঝাঁপির কথা।
মনোরঞ্জন: একটু আগে যে বিষয়ে কথা বলছিলাম তার জেরে টেনে বলব, ৩৪ বছর সিপিএম শাসন ক্ষমতায় ছিল, তারপরেও তারা ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির মূলে কোনোরকম কুঠারাঘাত করতে পারেনি, রাজনীতি সচেতন পরিবেশ গড়ে করে তুলতে পারেনি, সংস্কার মুক্ত ব্যবস্থা তৈরিতে ব্যর্থই থেকে গেছে। বর্ণবিভাজনের বিরুদ্ধে, জাতপাতের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে যে সচেতনতা তৈরি করার কথা ছিল সো-কল্ড বামেরা তা মোটেই পারেনি। উল্টে উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিত্ব করেছে, ভদ্রবিত্ত সমাজের সুপ্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতায় উস্কানি দিয়েছে। ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই মরিচঝাঁপির গণহত্যা ঘটিয়েছে। আমরা তো কেউ ভুলে যাইনি মরিচঝাঁপির কথা। আমরা ভুলে যাইনি ওপার বাংলা থেকে আসা নিম্নবর্ণের বাঙালিদের ওপর কীভাবে মরিচঝাঁপিতে হামলা চালিয়ে ছিল হামলা সিপিএম। মার্ক্সবাদের বুনিয়াদি কথাগুলোও তো এরা ক্যাডারদের রপ্ত করায়নি। তোলাবাজি, প্রমোটারি করে গেছে কেবল। আর কিভাবে ভোট অটুত রাখা যায় তার কৌসুলি খেলায় নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে।
![](http://protipokkho.com/wp-content/uploads/2021/04/71ja6CMyPhL._AC_UY218_.jpg)
ভোটে জিতে জিতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে গেছে কেবল। কিন্তু চিন্তা-চেতনায় কোনো পরিবর্তন করেনি। জ্যোতিরিন্দ্র বোস মারা গেলেন যখন, তখন আমরা দেখলাম, তাঁর বাড়িতে একদিকে গণসঙ্গীত হচ্ছে, অন্যদিকে ব্রাহ্মণ ডেকে শ্রাদ্ধ হচ্ছে… চন্দন বসুকে আমরা দেখলাম রাম মন্দিরের জন্য কোটি টাকা দিচ্ছেন… গাছের কোনো নাম হয় না, ফল দিয়ে গাছের নাম হয়, চন্দন বসুকে দেখেই বোঝা যায় জ্যোতি বসু কী ছিলেন! সরি, সম্মান বজায় রেখে কথা বলতে পারছি না, মরিচঝাঁপির গণহত্যাকারীর ব্যাপারে সম্মান দেখাতে পারছি না। তো এই রাজনীতি সচেতন কোনো পরিবেশের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় না থাকতে পেরে, নিম্নবর্ণের মানুষের কাছে সিপিএমও যা বিজেপিও তাই। তার উপরে এই মতুয়াদের ভিতরে মুসলিমবিদ্বেষ ইঞ্জেক্ট করা হয়েছে সুক্ষ্যভাবে। শুধু মতুয়ারা নয়, পূর্ববঙ্গ থেকে বাঙালি হিন্দুদের বেশিরভাগের মধ্যেই মুসলমানবিদ্বেষ ইঞ্জেক্ট করা হয়েছে। বিজেপি শিকড় বসাতে চাইলো মতুয়াদের মধ্যে এই মুসলিমবিদ্বষকে জাগিয়ে তুলতে পারলো সহজেই, ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা করে, বাংলাভাগের অপব্যখ্যা করে… বাংলা ভাগটা যে হিন্দু-মুসলমানের বিষয় নয়, এর পিছনে কায়েমী স্বার্থবাহী গোষ্ঠিগুলোর স্বার্থ জড়িয়ে ছিল, হিন্দু মঝাসভা-কংগ্রেস, বানিয়া এরা ছিল, এগুলো বামফ্রন্ট সরকারও সামনে আনেনি (অথচ কমিউনিস্টরা এটা পারতো), তাই সহজেই উদ্বাস্তু হওয়ার ঘটনার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীরা মতুয়াদের একটা অংশের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে পেরেছে… আপনি দেখবেন সাম্প্রতিক সময়ে ওপার বাংলা (বাংলাদেশ) থেকে যত বাঙালি হিন্দু এপারে এসেছেন তাদের মধ্যে মুসলিমবিদ্বেষ প্রবল। অর্থাৎ এইরকম একটা পরিবেশ, পরিস্থিতি সমগ্র বঙ্গদেশ জুড়ে তৈরি করা হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে। এই মুসলিমবিদ্বেষ, ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা- এগুলো এত সহজভাবে হতে পেরেছে কারণ উচ্চবর্ণের বর্ণবিভাজনের সমাজ-রাজনীতির বাইরে সোকল্ড বামপন্থীরা বের হতে পারেননি একদিকে, অন্যদিকে নিম্নবর্গের মানুষদের দূরে ঠেলেছে। অন্য দিকে আজ বিজেপি এই নিম্নবর্ণের, নিম্নবর্গের মানুষকে মুসলিমবিদ্বেষের মতো নানা ছলচাতুরিতে বিভ্রান্ত করে নিজেদের দিকে টেনে আনার কাজটা সহজেই করতে পারছে। আপনি নিশ্চই জানবেন, ওপার বাংলাতেও আরএসএস-এর শক্ত ঘাঁটি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে বাঙালি হিন্দুদের হিন্দুত্ববাদের পাঠ দেওয়া হচ্ছে, মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে! আমি তো বলব, সাম্প্রতিক সময়ে ওপার বাংলা থেকে সুপরিকল্পিতভাবে দলে দলে বাঙালি হিন্দুদের এপারে নিয়ে আসা হচ্ছে। এই যে বিজেপি অনুপ্রবেশ অনুপ্রবেশ করে লাফায়, অনুপ্রবেশ যদি হয়ে থাকে তবে সেটা বিজেপিই করাচ্ছে। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সটা তো আর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নয়, ওটা তো ভারত সরকারের, দিল্লির, তাহলে তো এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ যদি হয়ে থাকে তাহলে তার দায় ভারত সরকারের এবং ভারতের কেন্দ্রীয় শাসক দলের। একদিকে বিহার, ইউপি থেকে দলে দলে হিন্দিভাষীদের পশ্চিমবঙ্গে ঢোকানো হয়েছে, কারণ হিন্দিভাষীরা ম্যাক্সিমাম বিজেপি, অন্তত এই বাংলায় এসে তারা বিজেপিই করে… অন্য দিকে নানা কারণে, নানা কূটরাজনীতির শিকার হয়ে বাংলাদেশের যে অংশের নিম্নবর্ণের বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ তৈরি হয়েছে, সম্ভবত সেই অংশের মানুষকে দলে দলে এপারে নিয়ে আছে আরএসএস-বিজেপি, তাদের দিয়ে এপারে মুসলিমবিদ্বেষের রাজনীতি, হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিকে প্রসারিত করার চেষ্টা চলছে, যাতে প্রভাবিত হচ্ছে এপারের নিম্নবর্ণের বাঙালি হিন্দুরাও… অথচ ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে, হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের বাঙালি হিন্দু, বাঙালি মুসলিম আর আদিবাসীদের ঐক্য জোরালো হতে পারতো, সেটা যাতে না হতে পারে, সেজন্যেই ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিই ভরসা বিজেপির। যাতে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের রাজনীতি এই বাংলার নিজস্বতাকে ধ্বংস করে ফেলে…মুসলিমবিদ্বেষ, টাকা দিয়ে ভোট কেনা- এরকম নানা কারণ রয়েছে মতুয়া এলাকায় বিজেপির ভোট বাড়ার পিছনে। গত লোকসভা নির্বাচনে ওইসব এলাকায় ভোট কেনার জন্যে বিজেপি নাকি ৩৫ কোটি টাকা খরচ করেছিল, সত্যি-মিথ্যে জানি না, আমি এমনটা শুনেছি। এই বিধানসভা নির্বাচনে তো আরও অনেক অনেক টাকা উড়ছে, তবে বিজেপি এবারে সুবিধা করতে পারবে না। নিম্নবর্ণের মানুষেরা, নমঃশূদ্ররা বিজেপির খেলা ধরে ফেলছে বলেই আমার বিশ্বাস।
ওপার বাংলাতেও আরএসএস-এর শক্ত ঘাঁটি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে বাঙালি হিন্দুদের হিন্দুত্ববাদের পাঠ দেওয়া হচ্ছে, মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে!
অতনু: এবারের নির্বাচনে মতুয়া প্রভাবিত আসনগুলোতে বিজেপি কতটা সুবিধা করতে পারবে বলে মনে করেন?
মনোরঞ্জন: ওই যে বললাম মানুষ বিজেপির খেলা ধরে ফেলেছে। মতুয়া ভাইবোনরা অনেকেই বুঝতে পেরেছেন ব্রাহ্মণ্যবাদী, লুঠেরা বিজেপর চরিত্র। তাঁরা অনেকেই বিজেপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। নাগরিকত্ব নিয়ে বিজেপির ভাঁওতাবাজির বিষয়টাও আশা করি তাঁরা বুঝছেন। তাঁরা বুঝছেন ওই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনটা আসলে ঘুরিয়ে নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার আইন। নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন ওইটা নয়। মতুয়ারা বুঝতে পারছেন, মুসলমান, মতুয়া, নমঃশূদ্র, আদিবাসী-সহ গোটা বাংলার গণশত্রু বিজেপি। আমি যেখানে দাঁড়িয়েছি সেখানে আমার সমর্থনে মতুয়া সম্প্রদায়ের বহু মানুষ মিছিলে আসছেন, মুসলিম-মতুয়া, সাধারণ বাঙালি সবাই এক হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন।
মতুয়া ভাইবোনরা অনেকেই বুঝতে পেরেছেন ব্রাহ্মণ্যবাদী, লুঠেরা বিজেপির চরিত্র। তাঁরা অনেকেই বিজেপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। নাগরিকত্ব নিয়ে বিজেপির ভাঁওতাবাজির বিষয়টাও আশা করি তাঁরা বুঝছেন। তাঁরা বুঝছেন ওই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনটা আসলে ঘুরিয়ে নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার আইন। নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন ওইটা নয়।
অতনু: কিছুদিন আগে বাংলাদেশের ওড়াইকান্দিতে মতুয়া মন্দিরে মোদি গেলেন। ঢাকাতেও গেলেন। তা নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। বেশ কিছু মানুষের প্রাণ গেল মোদির বিরোধিতা করতে গিয়ে। কিভাবে দেখছেন এই ঘটনাকে?
মনোরঞ্জন: আরএসএস-বিজেপি আপ্রাণভাবে চেয়েছে মোদিকে দিয়ে বাংলাদেশে একটা দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি করতে, যাতে তার প্রতিক্রিয়ায় এপারেও একটা দাঙ্গা বাধানো যেত… এটা করা গেলে ভোটে বিজেপি ফায়দা তুলতে পারতো…
অতনু: এই মুহূর্তে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের শাসক দলের সম্পর্ককে কীভাবে দেখছেন?
মনোরঞ্জন: বাংলাদেশ একটা ছোট রাষ্ট্র। ভারতের ভয়ঙ্কর চাপের কাছে হয়তো বাধ্য হয়েই রাষ্ট্রীয়ভাবে তারা তোয়াজ করে চলছে।
অতনু: আপনি বরিশালের মানুষ। বরিশালের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ যোগেন মণ্ডল। যিনি নিজেও দলিত, আদিবাসী আর মুসলমানের ঐক্য চেয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ ও সম্ভাবনা- এগুলোকে কীভাবে দেখেন?
![](https://protipokkho.com/wp-content/uploads/2021/04/rsz_mono-8.jpg)
মনোরঞ্জন: এই প্রশ্নটার উত্তর এত স্বল্প পরিসরে দেওয়া যাবে না। যোগেন মণ্ডলকে নিয়ে কথা বলতে হলে আলাদা করে বলতে হবে। তবে এই চর্চাটা যে জরুরি, এটা বলতে পারি এখন।
অতনু: আপনাকে এবং তৃণমূল কংগ্রেসকে বিজেপির পাশাপাশি সংযুক্ত মোর্চাকেও মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সোকল্ড বাম, কংগ্রেস আর আইএসএফকে আপনি কীভাবে দেখছেন? কখনও কি মনে হচ্ছে না যে একযোগে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই হলে ভালো হতো?
মনোরঞ্জন: আপনি নিশ্চই লক্ষ্য করেছেন যে বিজেপি নেতাদের মতো সিপিএম কিংবা রাজ্য কংগ্রসের নেতারা আর ওই আব্বাস সিদ্দিকী একইভাবে মমতাকে যেভাবে হোক ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে চাইছেন! এরা তো কেউই বিজেপিকে সেভাবে আক্রমণ করছে না যতটা মমতা তাঁদের আক্রমণের লক্ষ্যে রয়েছেন! তাহলে কেনই বা ভাববো যে এনারা ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের ক্ষেত্রে আন্তরিক! ওঁরা যেকোনো প্রকারে মমতাকে সরাতে চান। বিজেপি নয়, ওঁদের প্রথম শত্রু মমতা।
অতনু: একুশের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে গণমাধ্যমের ভূমিকাকে কীভাবে দেখছেন?
মনোরঞ্জন: ভারতের গণতন্ত্রের অন্যান্য স্তম্ভের মতো গণমাধ্যমও বিপণ্ণ। গণমাধ্যম বিক্রি হয়ে গেছে। অনেক সাংবাদিক তো আমাকে বলছেন, ব্যক্তিগতভাবে তাঁরা লজ্জিত। চাকরি বাঁচানোর জন্যে তাঁদের এইসব করতে হচ্ছে! আসলে গণমাধ্যম আর গণমাধ্যম নেই। সবকটাই এখন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ একটা ছোট রাষ্ট্র। ভারতের ভয়ঙ্কর চাপের কাছে হয়তো বাধ্য হয়েই মোদিকে তোয়াজ করে চলছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
অতনু: পশ্চিমবঙ্গের একজন লেখক, পাঠক হিসাবে বাংলাদেশের এই মুহূর্তের সাহিত্য সম্পর্কে কী বলবেন?
![](https://protipokkho.com/wp-content/uploads/2021/04/mono-10.jpg)
মনোরঞ্জন: বাংলাদেশের সাহিত্য, পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য- এইভাবে আমি কখনোই দেখি না। আমি বাঙালি, বাংলাভাষী, বাংলা ভাষায় আমি লিখি। বাংলা ভাষায় লিখিত সাহিত্য সবটাই বাংলা সাহিত্য, বাংলা সাহিত্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশকে আমি আলাদা করি না। শুধু পশ্চিমবঙ্গের বা কেবলমাত্র বাংলাদেশের সাহিত্য দিয়ে বাংলা সাহিত্য হয় না। সবটা মিলিয়েই বাংলা। বাংলা সাহিত্য আগামীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বৈচিত্রের মধ্যে দিয়ে।
মনোরঞ্জন বাবুর সাক্ষাৎকার অসাধারন ও সঠিক!