লালনচর্চা ও ভাবান্দোলন

।। সাক্ষাৎকার ।।

এ বছর কোভিডের অজুহাতে ছেঁউড়িয়ায় লালন সাঁইজীর ১৩০তম তিরোধান দিবসে কোনো অনুষ্ঠান ও সাধুসমাবেশ হয়নি। পশ্চিমবমঙ্গের নদীয়া অঞ্চলেও লালন স্মরণ অনুষ্ঠান স্থগিত ছিল। কিন্তু সাধুগুরু ভক্তসমাজ লালনকে নিজেদের মতো করে স্মরণ করেছেন। ১লা কার্তিক লালনের তিরোধান দিবসে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট গবেষক, শিক্ষাবিদ এবং বড় বাংলায় লালনচর্চার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব সুধীর চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা হয়। লালনচর্চা ও ভাবান্দোলন বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রতিপক্ষের কার্যনির্বাহী সম্পাদক কবি অতনু সিংহের সঙ্গে । সেই আলাপচারিতা পাঠকের দরবারে পেশ করা হলো।


সুধীর চক্রবর্তী

‘লালন সাঁইজীর ভাবকে আর এই ভাবের তত্ত্বায়নের জায়গাগুলোকে নিয়ে কাজ করার সময় এসে গেছে। কিন্তু এখন যখন এই ভাবের বিষয়টা বোঝার উপযুক্ত সময়, তখন আমরা মজেছি লালনের জাত কী, জাতি কী, তাঁর গোত্র কী এইসব নিয়ে। এবং তাঁকে নিয়ে নিজেদের মনগড়া গল্প, তাঁকে নিয়ে মনগড়া সিনেমা, তাঁকে নিয়ে বহুরকম কাণ্ডকারখানা হয়ে যাচ্ছে, যেগুলো এক ধরনের ‘unintended consequences’…’

প্রশ্ন: এই মুহূর্তে গোটা উপমহাদেশের জাতিবাদ-পরিচয়বাদ, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের জাতিবাদ বা ফ্যাসিবাদ বড় বাংলার মানুষের যাপিত জীবনে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। হিন্দুত্ববাদ, মুসলিম পরিচয়বাদ, এমনকি ইসলামোফোবিয়া ছড়াতে এক ধরনের আধুনিক সেক্যুলার মৌলবাদের উত্থানও দেখা যাচ্ছে। এগুলো বড় বাংলার মানুষের যাপিত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে প্রত্যক্ষভাবে। এই অবস্থায় এই ধরনের পরিচয়বাদী ফ্যাসিস্ট রাজনীতি ও তার সাংস্কৃতিক নির্মাণকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে বৃহৎ বঙ্গের ভক্তি আন্দোলন বা ভাবান্দোলন কি কোনো পথ দেখাতে পারে? আরেকটা কথা, আপনি লালনচর্চার সঙ্গে দীর্ঘ সময় নিবিড়ভাবে যুক্ত থেকেছে্ন। লালনচর্চার দিকটির কথা মাথায় রেখেই যদি বলেন এই ভাবান্দোলনের সামনে প্রতিবন্ধকতা কী কী?

উত্তর: ফ্যাসিবাদ বা জাতিবাদ যাই বলুন না কেন, এগুলোকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে ভাবান্দোলনের ধারা সত্যিই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কী বলব বলুন, ভাবান্দোলনের ধারা আজকের এই আধুনিক বাস্তবতায় তো নতুন করে খুব বেশি ছড়ায়নি। ফরহাদ মজহারের ‘ভাবান্দোলন’ বইটাই বা কতজন পড়েছেন! ফরহাদ মজহার এককভাবেই ভেবে চলেছেন। এই ভাবনার ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে আমার মানসিক যোগাযোগ রয়েছে, সম্পর্ক রয়েছে। আমার যেটা বলার, আমি ১৯৭১ সাল থেকে লালনের ভিটায় যাচ্ছি। তখন তো ছেউড়িয়ায় এত লোক যেত না। কয়েকজন সাধক থাকতেন কেবল। এখন তো ছেউড়িয়া রীতিমতো একটা ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে গেছে।  তার থেকেও বড় কথা, ছেউড়িয়াও এখন একটা রাষ্ট্রনৈতিক ব্যাপার, দেখে যেমনটা মনে হয় আর কী! আগে এটা কেবলমাত্র লালনের সমাধিস্থলই ছিল। এখন তো… যাইহোক সেই কথায় যাচ্ছি না… এখন লালন হিন্দু নাকি মুসলমান, জন্মসূত্রে তিনি কী ছিলেন, এইসব নিয়ে কতো কথা হচ্ছে, যাইহোক… কিন্তু লালন ছিলেন প্রচ্ছন্নতাবাদী। তিনি নিজেকে খুব একটা প্রকাশ করতে চাননি। অর্থাৎ জাহেরের চাইতে বাতুনটা বেশি। ফকিরিয়ানার এটা মস্ত বড় দিক, আরেকটা কথা, লালন কিন্তু বাউল ছিলেন না। তিনি ছিলেন ফকির। ফকিরের কোনো ফিকির থাকে না। সে অর্থে ফকিরের কোনো ব্যাকগ্রাউন্ডও নেই। সব কিছুকে মুছে তবেই তো ফকির হওয়া যায়। আমরা মুছতে পারি না। আমরা মুছতে পারি না আমাদের ব্যক্তি পরিচয়, আমাদের পিতৃপরিচয়, জন্মভুমির পরিচয়, আমাদের পরিচয় এত বেশি যে কী বলব, তার সঙ্গে আবার ডিগ্রিটিগ্রি যুক্ত হয়ে, ডক্টরেট-টক্টরেট যুক্ত হয়ে যাচ্ছেতাই একটা অবস্থা হয়। হিন্দু সমাজে যারা ব্রাহ্মণদের পরিচিতি দেওয়ার ধরনটা খেয়াল করবেন, নিজেদের দেবতা মনে করে আর অব্রাহ্মণদের দাস-দাসি…

যেটা বলছিলাম, আমরা যখন বড় হচ্ছি তখন ওইদিকে পুর্ব পাকিস্তানের গণজীবন ঠিক কেমন, এটা আমাদের জানার উপায় ছিল না, কারণ, ভারত আর পাকিস্তানের মাঝে তখন লৌহপ্রাচীর। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ গঠন হওয়ার পরে আবার যাতায়াত শুরু হলো। বাংলার ভাবান্দোলনের নতুন সম্ভাবনার রাস্তাটাও খুলেছিল সেই সময়, ভাবান্দোলন তো রাষ্ট্রনীতির বাইরের ব্যাপার। যেমন আকাশ, বাতাস, জল, নদী, সমুদ্রের অধিকার সবার, ভাবনারও তো অধিকার সবার। এখন অনেকে বলছেন, লালন নামটাও হয়তো বানানো, সেটা আমি বলতে পারব না, তবে লালন নিয়ে যা-সব চলছে তাতে মনে হয় লালন বোধহয় এখন একটা ফ্যাশন, কিন্তু ফ্যাশনের কথা তো লালন ভাবেননি। লালন নিজের জন্মপরিচয়, পিতৃপরিচয়, এসব জানাননি, এমনকি লালনের গুরু সিরাজ সাঁই সম্পর্কেও কিছু জানা যায় না। অনেকে আবার লিখে ফেলেন অমুকটা হলো সিরাজ সাঁইয়ের পদ, যদিও আমরা যারা গবেষক, আমরা জানি এগুলো ভিত্তিহীন, এমন কিছু আমরা পাইনি। যাঁরা সাধক তাঁরা নিজেদের প্রচ্ছন্ন করে রাখেন, এমনকি দেখবেন তাঁদের গানের বা পদের ভাষাও সান্ধ্য, আবছায়া… এটা হলো অভিসন্ধিত ভাষা, বিশেষ কোড ল্যাঙ্গুয়েজ।

মজার বিষয় হচ্ছে, সংস্কৃতিকে আমরা চালনা করতে পারি না, সে তার মতোই চলে, এখন আমি ভাবছি সংস্কৃতি আমার মতো চলবে, তা কিন্তু চলবে না,  সুরিয়ালিস্ট কবি, লেখক, সমাজচিন্তক আন্দ্রে ব্রেতো বলেছিলেন, সংস্কৃতির লক্ষণ হচ্ছে ‘unintended consequences’ বা অনিচ্ছাকৃত পরিণতি। আমরা চাইছি না, কিন্তু সেটা হয়ে যাচ্ছে। লালনকে নিয়ে আজকে যেসব কথা হয়, লালন সেসব চাননি। আমি যখন লালনের ওপর কাজ শুরু করেছি ৭০-৭১ সালে, বিভিন্ন আখড়ায় যেতাম বিভিন্ন সাধুগুরুর কাছে, তখন কিন্তু তাঁরা প্রায় কিছুই বলতে চাইতেন না। তার আগে ক্ষিতিমোহন সেনরা যেসব চেষ্টা করেছেন, তাঁরা তো কিছুই বার করতে পারেননি প্রায়, আমরা কিছুটা পেরেছি, কিন্তু এটা বুঝেছি লালনকে বুঝতে গেলে চৈতন্যের ভাব, বৃহৎ নদীয়ার ভাব এগুলোকে বুঝতে হবে। যেটা ফরহাদ মজহারও বলছেন বারবার, এই ভাবাদর্শ কিন্তু পাশ্চাত্যের চিন্তাপদ্ধতির একেবারে বিপরীত। এই ভাবকে, এই ভাবের তত্ত্বায়নের জায়গাগুলোকে নিয়ে কাজ করার সময় এসে গেছে। কিন্তু এখন যখন লালন সাঁইজীর ভাবের বিষয়টা বোঝার উপযুক্ত সময়, তখন আমরা মজেছি লালনের জাত কী, জাতি কী, তাঁর গোত্র কী এইসব নিয়ে। এবং তাঁকে নিয়ে নিজেদের মনগড়া গল্প, তাঁকে নিয়ে মনগড়া সিনেমা, তাঁকে নিয়ে বহুরকম কাণ্ডকারখানা হয়ে যাচ্ছে, যেগুলো ওই ‘unintended consequences’… আমি জোরের সঙ্গে এটাই বলতে চাই যে লালন যা চাননি, লালন ঘরের সাধকরা যা চান না, শুভবুদ্ধি মানুষরা যা চান না, আমরা যা চাইনি, সেইসব চারিদিকে হয়ে চলেছে। এটাই ট্রেন্ড, যে লোকটা নিজের পরিচয় জানাতে চাননি সচেতনভাবে, তাঁকে নিয়ে ডাক টিকিট কেন? তাঁকে নিয়ে কল্পিত মূর্তি এঁকে যা ইচ্ছে করে বেড়ানো, কারো হাতে একটা একতারা ধরিয়ে দিলেই লালন হয়ে গেল নাকি?

সবচেয়ে অদ্ভুত লাগে, লালনের নামে এমন কিছু গান বাজারে চলছে, যেগুলো লালনের লেখা নয়, লালনের ভাব বা ভাবাদর্শের সঙ্গে মেলে না এমন গানও লালনের নামে চলছে! এখন চারিদিকে যারা এত লালনের গান গেয়ে বেড়ান, তাঁদের তো সাধারণ বুদ্ধিই নেই, লালন কীভাবে বুঝবেন!  হয়তো তাদের গলা ভালো, যোগাযোগও ভালো, কিন্তু লালন গাইবার জন্য যে মগ্নতা চাই, যে উপলব্ধির স্তরে পৌঁছানো চাই, সেসব তাদের নাই। লালনের গান একটা জার্নি। যেমন রামপ্রসাদের গান। রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে এঁদের পার্থক্য, লালন বা রামপ্রসাদের গানের কোনো ক্রম নেই। অর্থাৎ কোন গান কবে বাঁধা হয়েছিল, কোন বয়সে লেখা, এসব জানা যায় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে সব জানা যায়। তাই লালনকে নিয়ে কথা বলার আগে বা এই চর্চার আগে আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে যে আমরা লালনকে তাঁর মতো করে নিতে পেরেছি কি না। শিক্ষিত সমাজ লালনকে খুব একটা নিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। ফরহাদ মজহারের মতো দুয়েকজন ব্যতিক্রমী লোক হয়তো আছেন, যাঁদের জীবনাচরণটা পালটে গেছে লালনকে বুঝতে গিয়ে। কিন্তু আমরা তো আমাদের জীবনকে পাল্টাতে পারিনি। আমরা সব দিক বজায় রেখে রবীন্দ্রনাথের কথাও বলবো, আবার নজরুলের কথাও বলবো আর লালনের কথাও বলবো! একসঙ্গে সব হয় না, লালনের কথা বলতে হলে লালনের কথাই বলবো। কিন্তু দেখবেন লালনের গানের নানা ভার্সান রয়েছে, সুর এবং কথা—এই দুই ক্ষেত্রেই। এমনকি লালনগীতির অনেক বিখ্যাতদের মধ্যেও দেখেছি লালনের ভাবের কাছে যেতে পারেওনি, বরং আমি অনেক অখ্যাত ফকিরদের কাছে লালনের গান শুনেছি, তাঁরা যেমন মগ্নতা নিয়ে গাইতেন, এখন তেমন কোনো সঙ্গীত শিল্পীই নেই।

এটা বিরাট মাইনাস পয়েন্ট লালনচর্চায় যে তিনি মারা গেছেন বেশি দিন হয়নি, অথচ তাঁকে নিয়ে তেমন কোনো ঠিকঠাক ডকুমেন্টশন নেই। অথচ তাঁর সমসাময়িক অনেকের ব্যাপারেই প্রচুর কিছু জানা যায়, কিন্তু লালন সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। তবে লালনের প্রচ্ছন্নতার দিকটাকেও সম্মান জানানো উচিত, তাঁর গান যতটুকু আমরা পাই, তাঁর যতটুকু ভাব আমরা পাই, সেইটাকে ধরে রাখা দরকার। আমাদের মতো বিরল সংখ্যক কিছু মানুষ থাকুক ক্ষতি নেই, কিন্তু যাঁরা থাকবেন এই ধারায়, এই চর্চায়, তাঁদের কর্তব্য লালনকে যাতে সঠিকভাবে মূল্যায়ণ করা হয়, যাতে তাঁর ভাব মানুষের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছানো যায় সেই চেষ্টা করে যাওয়া। কিন্তু সেটার বদলে একদল লোক নিজেকে জাহির করেন আমি লালন বিশারদ, আমি ডক্টরেট, আমি অমুক ইত্যাদি। আমি জীবনে কোনোদিন আমার নামের আগে ডক্টরেট কথাটা লিখিনি। ডক্টরেট, এমএ, বিএ- এসবের কী মূল্য আছে লালনচর্চায়? এগুলোর কোনো মানেই হয় না।
আসলে লালনকে নিয়ে দুই বাংলায় রাষ্ট্রনৈতিক/ রাজনৈতিক বিকৃতি যেমন হয়েছে বা হয়ে চলেছে, তেমনই ব্যক্তিতান্ত্রিক বিকৃতিও কম নয়! একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে অন্য বিশেষজ্ঞের মতের এত তফাত যে দেখতেই খুব লজ্জা লাগে। একেকজন লালনকে নিয়ে এমন সব অদ্ভুত গল্প তৈরি করেছেন যে তাঁদের দেখে ঘৃণা হয় রীতিমতো। নিজেদের মনগড়া পরিচিতি, মনগড়া গল্প তাঁরা লালনের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন।
তো যে বিষয়ে কথা হচ্ছিল, পরিচয় বা পরিচিতি, আমার তো এখন মনে হয় নামের সঙ্গে পদবী জুড়ে দেওয়াটাও একটা পাপ। রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ এসব বললেই তো ল্যাটা চুকে যায়, ঠাকুর বা রায় এইসব জুড়তে হবে কেন! মানুষ যদি নিজের আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে নিজের কূল, শীল, গোত্র, শিক্ষাগত যোগ্যতা এসব নিয়ে কথা বলেন, তাহলে সেটাই পরিচয়বাদের সবচেয়ে বড় দিক হয়ে দাঁড়ায়। লালনের জীবন পরিচয়বাদের উর্দ্ধে, লালনের পথ, লালন ধারা পরিচিতির গণ্ডির বাইরে। লালনবাদ যদি আজকের পরিচয়বাদকে প্রতিহত করার একটা উপায় হয়ে থাকে, তাহলে লালনকে ঘিরে বিকৃতি বন্ধ করতে হবে। লালনচর্চা দুয়েকজনের বাইরে ভ্রান্ত পথে চলেছে, এখনও চলছে।

প্রশ্ন: আপনি বিশদে লালন বিকৃতির নানাদিক তুলে ধরলেন পরিচয়বাদকে কেন্দ্র করে। আচ্ছা, লালনচর্চার বিকৃতির মধ্যে কি কোথাও ভদ্রলোকের সংস্কৃতি, ভদ্রলোকেদের রাজনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রমিতায়ণ ইত্যাদি বিষয়গুলোর যোগাযোগ রয়েছে?

উত্তর: একেবারেই। ভাবুন না, ভদ্রলোকেদের পাঠক্রমে এত কিছু রয়েছে, অথচ লালনের ঠাঁই হয়নি। তাঁকে তো পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে পড়ানো উচিত ছিল। লালন কী বা কেন, এসব তো কেউ জানলোই না। কেবল টিপিক্যাল কয়েকটা গান শিখেছে ভদ্রবিত্তদের এই সমাজ। আমি চেষ্টা করেছিলাম পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে রবীন্দ্রনাথের গান যাতে পড়ানো হয়, কারণ রবীন্দ্রনাথের গান তো পড়ানো হতো না, গাওয়া হতো। আমি পশ্চিমবঙ্গের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত পাঠ্য করতে পেরেছিলাম। আমায় শর্ত দেওয়া হয়েছিল, আপনি পাঠ্য করতে পারেন, কিন্তু আপনাকেই পড়াতে হবে! রবীন্দ্রনাথের ২৫টা গান পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। আমি অবসর নেওয়ার পরেও এখনও ওই গানগুলো পড়ানো হচ্ছে। তো ২৫টি লালনের গানও তো সিলেবাসের মধ্যে আনা যায়। কিন্তু কলকাতার সভ্য সমাজ, এলিটিস্ট সমাজ, তারা কেউ লালনকে পাত্তা দেয় না! উলটে লালন চর্চার নামে নিজেদের ভাবনা লালনের সঙ্গে জুড়ে দেয়, লালনকে বিকৃত করা হয়।

প্রশ্ন: আপনি বারবার এই বিকৃতির বিষয়টায় জোর দিচ্ছেন। এই সূত্রেই আরেকটি বিষয় মনে এলো, লালনের ভাবকে দেহতত্ত্বের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার বিষয়টি। আমরা জানি রাঢ়ি তন্ত্রের ডিসকোর্সের মধ্যে দেহতত্ত্ব বা দেহসাধনা/ কামসাধনার বিষয়টি রয়েছে, কিন্তু লালন তো চৈতন্য-নিত্যানন্দ-অদ্বৈতাচার্য ধারার সাধক, পাশাপাশি নবী মোহাম্মদ (সা.)-এর ভাববিচার তিনি গ্রহণ করছেন এবং নিজেকে নদীয়ার পরম্পরাতে বিকশিত করছেন। এই ধারা তো তন্ত্র ও দেহতত্ত্বকে খারিজ করেছে। প্রেম সাধনা, যুগল সাধনা আর দেহতত্ত্ব তো এক নয়। দেহতত্ত্বের সঙ্গে লালনকে জুড়ে দেওয়ার ব্যাপারটা বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে আপনি ছাড়া অন্য যারা লালন নিয়ে কাজ করেন (নাম বলতে চাইছি না) তাঁরা অবলীলায় করে গেছেন। কেন? পাশাপাশি এই ধরনের বিকৃতি কি গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’ বা অমিতাভ চক্রবর্তীর ‘কসমিক সেক্স’-এর মতো সিনেমাগুলো থেকে আরও বেশি পপুলার হয়েছে আগের থেকে?

উত্তর: হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন। বিকৃতির আগেও ছিল। কিন্তু এখন সেটার আবার বাণিজ্যিকীকরণ ঘটে গেছে। এই ধরনের সিনেমাগুলো যার উদাহরণ। ফলে এই বাণিজ্যিক কারণে বিকৃ্তি ঘটলে, বিকৃতি যে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠবে তা এই ধরনের রাষ্ট্রকাঠামোর ক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক। তবে যে সিনেমাগুলোর কথা বললেন, এগুলোর প্রভাব কলকাতা বা তার আশপাশের শহরাঞ্চলে কিছুটা থাকতে পারে, বৃহত্তর সমাজে, বৃহৎ বঙ্গে এসবের তেমন প্রভাব নেই।

কিন্তু এই বিকৃতিটা নানাভাবে আছে। ওই যে বললাম, নিজেদের মনগড়া ভাবনা লালনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয়, আস্তে আস্তে প্রকৃত লালনচর্চা ঠিকই উন্মোচিত হবে। কিন্তু আপাতত এই মুহূর্তে এর কোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক বা প্লাটফর্ম নেই, দুই বাংলাতেই নেই। রাঢ়ি তন্ত্রের সঙ্গে লালনকে জুড়ে দেওয়্যাটাও ওই ‘unintended consequences’। দ্যাখেন রবীন্দ্রনাথের গান নিয়েও যা ইচ্ছে করা হচ্ছে বাংলায়। বিশ্বভারতীর কী অবস্থা হয়েছে দেখুন। অথচ গান্ধীর সবরমতির আশ্রম কিন্তু ঠিকই আছে, ওইগুলোতে কেউ হাত দিতে সাহস পায় না। এমনকি পণ্ডিচেরিতে অরবিন্দর আশ্রম ও তাঁর দর্শন কিন্তু যেমন ছিল তেমনই… আসলে যেহেতু লালন সাধারণ মানুষের, আর সংস্কৃতিও সাধারণ মানুষের, তাই আবার ওই ‘unintended consequences’-এর ব্যাপারটা এর ব্যাখ্যায় চলে আসবে।

প্রশ্ন: লালনচর্চা-সহ বড় বাংলার ভাবান্দোলনের ধারাগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে, সেই কারণে গবেষণার ক্ষেত্রে, ভাবচর্চার প্রসারে পদ্ধতিগতভাবে কী কী করা যেতে পারে বলে মনে হয়?

উত্তর: আমাদের সমাজের একতা অদ্ভুত বিষয় হলো, কোনো কিছুকে আকাদেমিক ক্ষেত্রে সিলেবাসের মধ্যে না আনলে লোকে সিরিয়াসলি নেয় না। লালন-সহ বাংলার ভাবান্দোলনের ধারাগুলোর ক্ষেত্রেও এটাই ব্যাপার। তাই লালনকে পাঠ্যতালিকার মধ্যে আনতে হবে বলে আমি মনে করি। আর ওই যারা নিজেদের বাউল বলে ক্লেইম করে গানটান করেন, তাঁদের হাত থেকে লালনকে উদ্ধার করে ভাবুকদের হাতে আনতে হবে।

প্রশ্ন: এই পর্যায়ে আপনাকে শেষ প্রশ্ন, লালন ছাড়াও বৃহৎ নদীয়ায় চৈতন্য-নিত্যানন্দ পরম্পরার অনেকগুলি সাধন তরিকার ঘর আছে। যেই ঘরগুলির সঙ্গে লালনের প্রচুর মিল, আবার অমিলও রয়েছে। তেমনই বৃহৎ বঙ্গে আরও নানারকম ভাবধারা রয়েছে, সেইসকল ভাবধারা একত্রেই তো ভাবান্দোলন তৈরি করতে পারে বৈচিত্র্য ও তাদের মধ্যে ঐক্যকে সুদৃঢ় করে। অথচ এই বৈচিত্র্যগুলোকে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে, সব কিছু তালগোলে এক করে ফেলে উদোর পিণ্ডি বু্ধোর ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে, এই প্রবণতাকে কীভাবে দ্যাখেন?

উত্তর: দেখুন আমাদের সমাজে রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামো, শিক্ষা কাঠামো, অর্থ কাঠামো এগুলো সবই শহুরে ভদ্রবিত্তদের হাতে। কিন্তু ভাবান্দোলনের স্পিরিটতা প্রান্তিক মানুষের। গ্রামের, প্রান্তরের। তো এই চর্চা, এই আন্দোলনকে নিচুতলা থেকেই জাগাতে হবে। যারা গবেষণা করতে চান, তাঁদের ঘুরতে হবে, সাধকদের সঙ্গে মিশিতে হবে। ক্যামেরা নিয়ে, টেপরেকর্ডার নিয়ে ঘুরলে হবে না। আর এই যে এত বাউল-ফকির উৎসব হয় এত শহর এলাকায় এগুলোতো কিছু নয়, মদ-গাঁজা খাওয়া আর রাত জেগে ফুর্তি করার উপায় ছাড়া। শহরের লোকেদের দিয়ে হবে না। গ্রামকে জাগাতে হবে। চারণ কবিদের মতো গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হবে।

Share