।। বিশ্বেন্দু নন্দ।।
ওয়েলেসলির অকাট্য লক্ষ্য ছিল, ফরাসি বিপ্লবের ছোঁয়াচে প্রভাব থেকে সাম্রাজ্য বাঁচানো। তিনি লিখলেন, ‘‘যখন ফরাসি বিপ্লবের ডাকে উত্তেজিত ইওরোপিয় মহাদেশ থরথর করে কাঁপছে, সে সময় ভারতে কোম্পানির সামরিক এবং অসামরিক যুবা আমলাদের মননকে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, ধর্মীয় নানান বিপজ্জনক, বিভ্রান্তিকর নীতিমালা ছড়িয়ে পড়া থেকে রক্ষা করতে হবে। করণিকদের অপ্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটিযুক্ত এবং অনিয়মিত শিক্ষার গোড়ায় গলদ থেকে গেছে। রাষ্ট্র, ধর্ম নিয়ে তাদের মনের তৈরি হওয়া বিভ্রান্তি দূর করতে চাকরির প্রথমস্তরেই প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা কাঠামোর মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে পারলে ভারতে সাম্রাজ্য নিরাপদ এবং স্থিতিশীল হবে’’। তিনি বললেন, ‘‘এই প্রকল্পে কোম্পানির আমলাদের প্রশিক্ষিত করবে দেশিয় শিক্ষিতরা’’। বলা দরকার তিনি এবং বার্ক দু’জনে ভারতকে গ্যালিক সাম্যতত্ত্বের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন।
ফরাসী বিপ্লবের তাত্ত্বিক বিরোধিতা এবং উপনিবেশে নতুন শাসক-আমলা তৈরির কারখানা
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ তৈরির উদ্দেশ্য শুধু আমলাদের এদেশের উপযোগী করে তৈরি করা নয়, বা এশিয়ায় প্রাচ্যবাদের শেকড় গজানোর উদ্যমই নয়, একই সঙ্গে ফরাসি দেশের বিপ্লব থেকে উদ্ভুত গণতন্ত্রের বার্তাকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া রুখে দেওয়ারও প্রাণান্ত প্রচেষ্টা ছিল।
ফরাসি বিপ্লবের সমর্থনে ১৭৯০-এর দিকে মেট্রোপলিটনে ছড়ানো-ছিটোনো সমর্থনের সুর শোনা গেলেও ক্ষমতাশালীদের পক্ষ থেকে চরম বিরোধিতা হতে থাকে। হেস্টিংসকে শূলে চড়ানো এডমন্ড বার্ক, যিনি আজও ‘ভারতবন্ধু’ নামে পরিচিত, ১৭৯০-এর Reflections on the Revolution in France- এ মন্তব্য করছেন, “সাম্য প্রকৃতিদত্ত নয়, প্রকৃতি বিরোধী”!তিনি বললেন:
লিবার্টির ধারণাকে আক্রমণ করে তিনি বললেন,”Stands stripped of every relation, in all the nakedness and solitude of metaphysical abstraction’‘।
মার্টিনিক আর সেন্ট ডমিনিকে বিদ্রোহের বিরুদ্ধে সেনা পাঠিয়ে দমন করা হয়। বার্ক বললেন, “এই বিদ্রোহ মানবজাতির বিশ্ব স্বাধীনতার অধিকারের অপপ্রয়োগ!”
১৭৯৩-এ ফ্রান্স ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে; বাইশ বছর ধরে চলতে থাকা ব্রিটিশ-ফরাসি যুদ্ধ ব্রিটেনের ভিত্তিমূল নড়িয়ে দিয়েছিল। ব্রিটেন তখন প্রায় দ্বিধাবিভক্ত। একের পর এক অধিকার হরণের পালা শুরু হয়েছে মেট্রোপলিটনে। ১৭৯৪-এ হেবিয়াস কর্পাস তুলে নেওয়া হলো, একের পর এক জন-অধিকার খর্ব করার আইন Treason and Sedition Act (1795), The Unlawful Oaths Act (1797), The Corresponding Societies Act (1799) এলো এবং সর্বশেষে জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হলো। এত সবের মধ্যেও, মোটামুটি ফ্রান্স যে সব উপনিবেশ থেকে লাভ করছে, সে সবগুলো দখল নেওয়ার বিষয়ে ক্ষমতাসীন সাম্রাজ্যবাদীরা একমত হলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফরাসি উপনিবেশগুলি দখলের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের বেশ কয়েকটি ফরাসি উপনিবেশগুলি দখল নিলো ব্রিটেন।
কিন্তু চলতে থাকা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে ১৭৯৬তে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে ফ্রান্স। ১৭৯৭ সালে ইওরোপে ব্রিটেন প্রায় একা হয়ে পড়ে। একমাত্র বন্ধু অস্ট্রিয়া আত্মসমর্পন করেছে; পিছু হঠতে হঠতে আইরিশদের সহায়তায় ফরাসিদের হাতে বিধ্বস্ত হতে হতে বেঁচে যায় ব্রিটিশ বাহিনী। রয়্যাল নেভিতে বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং ডাচ আর স্পেনের উপকূল আর উত্তমাশা অন্তরীপে সেই বিদ্রোহ ছিড়য়ে পড়তে থাকে। যদিও ১৭৯৭ সনে ফরাসি বিপ্লবের তীব্র বিরোধী বার্ক প্রয়াত হলেও তাঁর তত্ত্ব অনুসরণ করেই যৌথভাবে রাজনৈতিক ও সামাজিক নীতি প্রণয়ন করতে থাকেন টোরি আর হুইগেরা।
একইসঙ্গে ১৭৮০তে ইংলন্ডে প্রথম ঝর্ণার জলে যন্ত্র চালিয়ে মিল তৈরি হচ্ছে। মিলের শ্রমিক পেতে বড় পুঁজির পক্ষে দাঁড়িয়ে গ্রামের কারিগর, চাষি আর পশুপালকদের উচ্ছেদ করতে হচ্ছে শাসকদের।
উনবিংশ শ’তে ভারত ব্রিটেন আর ফ্রান্স
ফরাসী বিপ্লব প্রেক্ষিতে লর্ড মর্নিংটন ওরফে রিচার্ড ওয়েলেসলি ১৭৯৭-এ ভারতীয় উপমহাদেশের কোম্পানি সাম্রাজ্যের সর্বেসর্বা, গভর্নর জেনারেল রূপে মনোনীত হলেন। ওয়েলেসলি তাত্ত্বিকভাবে মুক্ত বাণিজ্যের সমর্থক, আইরিশ অভিজাত, ভাই আর্থার ওয়েলেসলি ভবিষ্যতের ডিউক অব ওয়েলিংটন এবং ফরাসি বিপ্লব তত্ত্বের চরম বিরোধী বার্কের তাত্ত্বিকতার অনুগামী। যেহেতু রিচার্ড ওয়েলেসলি কোম্পানির বোর্ড অব কন্ট্রোলের সদস্য ছিলেন, ভারতের সে সময়ের রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থা এবং ফরাসীদের মনোভাব ইত্যাদি সম্বন্ধেও সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন।
১৭৯৮-এ উপনিবেশের রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে পৌঁছতে না পৌঁছতেই নতুন গভর্নর জেনারেল স্থানীয় খবর কাগজগুলোর মাধ্যমে জানলেন, নেপোলিয়ানের নেতৃত্বে ফরাসিরা মিশর হয়ে ভারত আক্রমণের পরিকল্পনা করছে! মালাবার উপকূলে ফরাসি সাম্রাজ্য আর তাদের বন্ধু টিপু সুলতান যৌথভাবে উপমহাদেশের ব্রিটিশ স্বার্থে ঘা দেওয়ার পরিকল্পনা ছকছে। কলকাতার এক খবরের কাগজ সূত্রে জানা গেল, আজকের মরিসাস (Isle de France)-এর গভর্নর Anne Joseph Hyppolite Malartic টিপু আর ফরাসিদের মধ্যে সন্ধিস্থাপনের মাধ্যমে ফরাসি নাগরিকদের টিপুর সেনা বাহিনীতে স্বেচ্ছাব্রতের ডাক দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি জানলেন, নিজাম শাসিত হায়দ্রাবাদে চোদ্দ হাজার ফরাসি সেনা উপস্থিত হয়েছে!
১৭৯৮-এর ২৬ নভেম্বর কোম্পানির গোপন কমিটি নেপোলিয়নের মিশর দখলের সংবাদ পাঠাল লন্ডন থেকে। নীল নদের যুদ্ধে নেলসনের বাহিনীর জয় সত্ত্বেও ১৯ এপ্রিল ১৭৯৯-এর ডেসপ্যাচে কোম্পানি ওয়েলেসলিকে জানাল, তিনি প্রয়োজনে ভারতীয় ব্রিগেড নিয়ে লোহিত সমুদ্র মার্ফত নেপোলিয়নকে আক্রমণ করে চমকে দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন।
ওয়েলেসলি দেরি না করে সম্ভাব্য ভারত আক্রমণ রুখতে ৩ হাজার সেনা মিশরে পাঠালেন। পারস্য উপসাগরের বুশহরের কোম্পানির রেসিডেন্ট মেহদি আলি খান এবং জন ম্যালকমকে পারস্যের শাহের কাছে দূত হিসেবে পাঠিয়ে ফরাসিদের ভারত আক্রমণের যে কোনও সম্ভাবনায় সাহায্যের প্রার্থনা জানিয়ে রাখলেন। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে হায়দ্রাবাদে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে অবাক ফরাসিদের হারিয়ে সেনাদের বন্দী করলেন। রানীর ৩৩তম পদাতিক বাহিনীর সেনানায়ক, ভাই কর্নেল আর্থার ওয়েলেসলিকে সেনাপতি জর্জ হ্যারিসের নেতৃত্বে ফরাসিদের যেকোনো রকম সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন রোখার দায়িত্ব দিলেন। হায়দ্রাবাদের নিজামের বাহিনীর সহায়তায় বিপুল ইংরেজ সেনাবাহিনী মহীশূর আক্রমণ করে ১৭৯৯ সালের মার্চ মাসে। শ্রীরঙ্গপত্তনমের যুদ্ধে টিপুর মৃত্যু হলে ভারতে ফরাসিদের সাম্রাজ্য বিস্তারের সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। মহীশূরের পূর্ববর্তী রাজার নাবালক সন্তানকে সিংহাসনে বসিয়ে টিপুর অর্ধেক রাজ্য গ্রাস করে ইংরেজ।
বলপ্রয়োগে ফরাসিদের হারাবার পর ওয়েলেসলি কলকাতার রাজধানীতে বৌদ্ধিক বিজয়ের তোড়জোড় শুরু করলেন। লন্ডনের অনুসরণে শুরু হল খবর কাগজের ওপর নজরদারি। ভারতে সরকারিভাবে প্রত্যেক ইওরোপিয়র বাধ্যতামূলক ভিসা বলবত হল। ব্রিটিশ কোম্পানির যুবা আমলারা স্বাভাবিকভাবেই ফরাসী বিপ্লবের সাম্যের ডাকে প্রভাবিত হতে পারেন আশংকা করে, এই প্রথম কোম্পানির চরিত্রে বদল আনার চেষ্টা করলেন ওয়েলেসলি। কোম্পানিকে শুধু একটি কর্পোরেট সওদাগর থেকে ভারতের প্রশাসনিক শাসকে রূপান্তরিত করার উদ্যম নিলেন তিনি। এই উদ্যমের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে সাম্রাজ্যের কাজকর্মে এবং তার প্রজাদের ওপর।
বিপ্লবতত্ত্বের প্রভাব রুখতে শিক্ষাকেন্দ্র
১৮০০ সালের ১০ জুলাই একটি প্রতিবেদনে ওয়েলেসলি লন্ডনের কর্তাব্যক্তিদের কলকাতায় বিদ্যালয় তৈরির পরিকল্পনা বিস্তৃতভাবে পাঠালেন। বার্ক ১২ বছর আগে ওয়ারেন হেস্টিংসের বিরুদ্ধে কোম্পানির চরিত্র বিশ্লেষণের যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন, ওয়েলেসলিও বার্কের তাত্ত্বিক অবস্থান নকল করলেন।
তিনি লিখলেন, ‘‘কোম্পানি আর শুধু বাংলার বিপুল অঞ্চল আর তিনটে প্রেসিডেন্সিতে আটকে নেই, দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তার কবলে। কোম্পানি এমন এক সাম্রাজ্যের মালিক, যার আয়তন অধিকাংশ ইওরোপিয় রাষ্ট্রের আয়তনের থেকে অনেক বড়। এমতাবস্থায় কোম্পানির দায় এবং দায়িত্বকে নতুন দৃষ্টিতে ঢেলে সাজাতে হবে’’। এই প্রতিবেদনে তিনি বললেন, কোম্পানির কর্মচারীদের এই বহুভাষিক দেশে আরও বেশি দায়িত্বপূর্ণ হতে হবে –
সাম্রাজ্যের নানান কাঠামো তৈরিতে উইলিয়াম জোনসের সময় থেকে যে উদ্যম নিয়েছিল কোম্পানি প্রশাসন, ওয়েলেসলির প্রস্তাব সেটিই কাজের পরিপূরিক হিসেবে গণ্য হতে পারে।
ওয়েলেসলি জানালেন কোম্পানির রাজত্বের ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় আদালতের কাজকর্ম চলছে। এছাড়াও যে আইন অনুসারে কোম্পানির কর্মচারীরা শাসন করে সেগুলিও ব্রিটিশ জাত নয় বরং-
to which the natives had long been accustomed under their former sovereigns, tempered and mitigated by the voluminous regulations of the Governor-General in council, as well as by the general spirit of the British constitution.
একই তত্ত্বে জুড়ে দিলেন রাজস্ব আদায় এবং ব্যবসায়িক চুক্তিগুলোকেও। ইওরোপে যে ধরণের ব্যাংকিং, প্রশাসনিক, ব্যবসায়িক নিয়মনীতি চলে, তার কাঠামো, ব্যবস্থাপনা এদেশের থেকে আলাদা। ফলে আমলাদের এ উপমহাদেশের ভাষা, আইন, ব্যবহার এবং প্রথা ইত্যাদি শেখানো খুব জরুরি কাজ।
এদেশে আসা রাইটার, ফ্যাক্টর বা মার্চেন্ট যে ধরণের শপথ নেয়, ওয়েলেসলি জানালেন তার সময়ে তাদের কাজকর্ম সেই পরিধির অনেক বাইরে ছড়িয়ে গিয়েছে। তাঁর দাবি, কোম্পানির আমলাদের শপথ নিতে হবে যে তারা যেকোনো ব্যবসায়িক স্বার্থের বাইরে থাকবে। ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যের অধিকাংশ কোম্পানির যুবা করণিক প্রাথমিকস্তরের অঙ্ক আর হিসাব করার জ্ঞান সম্বল করে কোম্পানির চাকরিতে ঢুকেছে (প্রাসঙ্গিকভাবে জানিয়ে রাখি ফিলিপ লসন এবং জিম ফিলিপ আওয়ার এক্সারেবল ব্যান্ডিটির ২২৭ পাতায় বলছেন, প্রাকপলাশী যুগে কোম্পানির নিম্নতম রাইটার (কেরানি) হিসেবে যোগ দেওয়ার শংসাপত্রর জন্য একজন ডিরেক্টর ৪০০০ পাউন্ড (ঘুষ) নিতেন, যখন পিজে মার্শাল ব্রিটিশ বেঙ্গল দ্য ব্রিটিশ ব্রিজহেড গ্রন্থে বলছেন সে যুগে গভর্নর সব মিলিয়ে পেতেন ২৪০ পাউন্ড, কাউন্সিলর ৪০ পাউন্ড, ফ্যাক্টর ১৬ পাউন্ড, রাইটার মাত্র ৫ পাউন্ড(১৭৪৪এ মাদ্রাজে আসা ইনৈক রাইটার ক্লাইভ পেতেন বছরে এই অর্থ – যিনি ছয়ের দশকে নবোবদের নবোব রূপে গণ্য হবেন)। তাদের এখন নতুন দায়িত্ব সামলাতে প্রস্তুত করতে হবে। এছাড়াও অধিকাংশের শিক্ষার অভাব এবং পরম্পরার সংস্কৃতি বিষয়ে জ্ঞান না থাকার জন্যে তারা প্রায়শই কুঁড়েমি, বিলাসব্যসন এবং নানান বিলাসী আশকারায় ঢলে পড়ে। নবতম বিপুলতম দায়িত্ব সামলাতে করণিক, আমলাদের জন্যে একটি বিদ্যালয় প্রয়োজন যেখানে সরকার পরিচালনার এশিয় এবং ইওরোপিয় নীতিমালা শিক্ষার পাঠ্যক্রম থাকবে।
ওয়েলেসলির অকাট্য লক্ষ্য ছিল, ফরাসি বিপ্লবের ছোঁয়াচে প্রভাব থেকে সাম্রাজ্য বাঁচানো। তিনি লিখলেন, ‘‘যখন ফরাসি বিপ্লবের ডাকে উত্তেজিত ইওরোপিয় মহাদেশ থরথর করে কাঁপছে, সে সময় ভারতে কোম্পানির সামরিক এবং অসামরিক যুবা আমলাদের মননকে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, ধর্মীয় নানান বিপজ্জনক, বিভ্রান্তিকর নীতিমালা ছড়িয়ে পড়া থেকে রক্ষা করতে হবে। করণিকদের অপ্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটিযুক্ত এবং অনিয়মিত শিক্ষার গোড়ায় গলদ থেকে গেছে। রাষ্ট্র, ধর্ম নিয়ে তাদের মনের তৈরি হওয়া বিভ্রান্তি দূর করতে চাকরির প্রথমস্তরেই প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা কাঠামোর মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে পারলে ভারতে সাম্রাজ্য নিরাপদ এবং স্থিতিশীল হবে’’। তিনি বললেন, ‘‘এই প্রকল্পে কোম্পানির আমলাদের প্রশিক্ষিত করবে দেশিয় শিক্ষিতরা’’। বলা দরকার তিনি এবং বার্ক দু’জনে ভারতকে গ্যালিক সাম্যতত্ত্বের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন।
ভারতে তো বটেই, ইওরোপেও এই ধরণের শিক্ষাকেন্দ্র ছিল না। ওয়েলেসলি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে নতুন শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব পাঠালেন। টিপু হত্যার প্রথম বছর পূর্তিতে ৪ মে ১৮০০য় এ বিষয়ে একটা ডিক্রি জারি করা হলো। বিস্তৃতির পরিকল্পনা করা হলো কেমব্রিজ আর অক্সফোর্ডের ব্যপ্তিতে। উদ্বোধন হল ১৮০০ সালের ২৪ নভেম্বর। ঠিক হলো ল্যাটিন, গ্রিক ছাড়াও শেখানো হবে ইংরেজি, ন্যাচারাল হিস্ট্রি, ন্যাচারাল এবং এক্সপেরিমেন্টাল ফিলোজফি, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, অর্থনীতি, রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং ভূগোল। নতুন চাকরিজীবিরা বাংলায় পা দিয়েই আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত, ছয়টা আঞ্চলিক ভাষা যথাক্রমে হিন্দুস্তানি, বাঙলা, তেলুগু, মারাঠি, তামিল আর কন্নড়সহ হিন্দু, ইসলামি, ব্রিটিশ আইন, ইওরোপিয় ইতিহাস এবং ভারতীয় ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব(antiquities) শিখবে। এই বিদ্যাগুলির অধিকাংশই ফোর্ট উইলিয়ামে জ্ঞানী দেশিয়রা পড়াবেন বলে ঠিক হলো।
উল্লেখ্য, তখনও ইওরোপের কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই এতসব কিছুই পড়ানো হত না। এর আগে হেস্টিংস একবার আর্থিক লাভের টোপ দিয়ে পড়াবার চেষ্টা করেছিলেন তা চরমতম ব্যর্থ হয়েছিল। ১৭৮৪তে মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জন্ম হয়েছিল এশিয়াটিক সোসাইটির। উদ্দেশ্য ভারতবর্ষের অতীত গৌরব কীর্তন এবং মহার্ঘ উপনিবেশের সঙ্গে তার যোগাযোগ নির্ণয়। এশিয়াটিক সংগঠনে কো্নো দেশিয় স্থান পায় নি, শুধু কাজে যোগ দিয়েছিলেন কয়েকজনমাত্র। এশিয়াটিক রিসার্চেসে বহু প্রখ্যাত সমাজ, অর্থনীতি, ধ্রুপদী ভাষা, শিল্পকলা এবং দক্ষিণ এশিয়ার সমাজকাঠামো নিয়ে লিখেছেন। এশিয়াটিকে সদস্যপদ পাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিগত জ্ঞানচর্চার আকাঙ্ক্ষার উচ্চাশা সাধন করার জন্যে। নিজেরা নিজেদের নির্বাচিত করে পরস্পর পিঠচাপড়ানি ক্লাব তৈরি করেছিলেন। কিন্তু শতাব্দ শেষে বাংলার আইন এবং ভাষা জানা জরুরি হয়ে পড়ছিল এবং সেই দক্ষতা অর্জন কোম্পানি চাকুরেদের ইচ্ছের ওপর ছেড়ে দিতে রাজি হলো না কোম্পানি। ১৭৮৯-এর ২১ ডিসেম্বর ওয়েলেসলি লিখছেন:-
‘ইউনিভার্সিটি অব দ্য ওরিয়েন্ট’ স্থাপনের প্রস্তাবে ওয়েলেসলি বাংলায় ইওরোপিয়দের তৈরি প্রাচ্যতত্ত্বের খামতিগুলো মিটিয়ে প্রাচ্যতত্ত্ব পড়া বাধ্যতামূলক করলেন এবং একইসঙ্গে ব্রিটিশ আর দেশিয় বন্ধুদের (কপিল intermediaries শব্দটা ব্যবহার করেছেন) এতদিনের বন্ধনহীন সম্পর্ককে প্রাতিষ্ঠানিকতায় বেঁধে ফেলতে চাইলেন। শিক্ষকতার জন্যে এশিয়াটিক সোসাইটির ব্রিটিশ ওরিয়েন্টালবাদী সদস্য এবং সেখানকার দেশিয় জ্ঞানী সহযোগীদের বেছে নিলেন। পড়ানো ছাড়াও ছাত্রদের কোম্পানি শাসিত এলাকাগুলিতে মহাবিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের জন্যে নতুন ধরণের পুঁথি জোগাড়েও উৎসাহ দিলেন ওয়েলেসলি। ১৮০৫এর মধ্যে বিভিন্ন এলাকার ভাষার প্রমিতিকরণ এবং ব্যকরণের কেন্দ্রিকরণের কাজ সম্পন্ন হলো। বিপুল ভারতে প্রশাসন চালাবার কাঠামো তৈরির জন্যে ভাষার প্রমিতিকরণ জরুরি ছিল।
প্রথম তিন বছরে ২ লক্ষ ৫০ হাজার পাউন্ড বিদ্যালয়ের জন্যে ব্যয় করলেন যা অক্সফোর্ড আর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ ব্যয়ের সঙ্গে তুলনীয়। প্রথম বছর খরচ হলো ৭৮৭৫০ পাউন্ড। ব্রিটিশ শিক্ষকেরা মাইনে পেতেন ৩২০ পাউন্ড/মাসে এবং দেশিয় সহযোগীরা পেতেন ইওরোপিয় শিক্ষকদের তুলনায় একদশমাংশ থেকে এক পঞ্চাশাংশ।
ব্রিটিশ দৃষ্টিতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ
সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকেরা বিশ্বাস করতেন, উত্তমাশা অন্তরীপ পেরিয়ে আসার পরই বহু ব্রিটনের মনে প্রাচ্যের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় একটা অদ্ভুত মনোভাব চারিয়ে যেত যে তারা একটা অদ্ভুত এলাকায় প্রবেশ করছে! এই মনোভাব ছড়িয়ে যেত ইওরোপিয়দের হাতে চালিত ভারতীয় প্রশাসন চালনায়, এবং প্রভাব পড়ত মেট্রোপলিটন ব্রিটিশ সমাজেও।
তিনটি বিষয়ের আলোচনা এই অবস্থা বুঝতে সাহায্য করবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বোর্ড অব কন্ট্রোল, ওয়েলেসলির ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, ইউনিভার্সিটি অব দ্য ওরিয়েন্ট প্রকল্পে উৎসাহী হয়ে পড়ে। কিছু হাতে গোণা ধর্মযাজক বলেছিল উপনিবেশের পরিবেশ খ্রিষ্টিয় নৈতিকতা নষ্ট হয়। তবে এই ধারণা পাত্তা পায় নি। শুধু তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক দর্শন পাড়ানোর যোগ্য মানুষ নেই বলে কোর্ট অব ডিরেক্টর তাদের খরচে মেট্রোপলিটন থেকে একজন স্কটিশ জ্ঞানী জেমস ডুইন্ডলকে(১৭৪৬-১৮১৫) পাঠান। পুর্বের সঙ্গে ব্যবসা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, ডুইন্ডল কিন্তু বিষ্ফোরক বিশেষজ্ঞও ছিলেন এবং ফরাসী জ্ঞানীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিষ্ফোরক বিষয়ে শেষতম গবেষণা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন।
ইউনিভার্সিটি অব দ্য ওরিয়েন্ট শুরুর পর্বে ওয়েলেসলির বিপুল বিনিয়োগ কিন্তু কোম্পানির অংশিদারেরা ভালোভাবে নেয় নি। কোম্পানির লভ্যাংশ কমতে শুরু করায় কোম্পানির অংশিদারদের দেয় লাভের পরিমাণ, ডিভিডেন্ড কমেছে। ওয়েলেসলি দেশিয় আইরিশ অভিজাতদের সঙ্গে রক্ষণশীল লর্ড ক্যাসেলরের(Castlereagh) সমর্থন পেয়েছেন। ক্যাসলরে ১৮০২ সালে বোর্ড অব কন্ট্রোলের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ওয়েলেসলির বিপ্লব বিরোধী মনোভাবকে মান্যতা দিতেন বলেই এই প্রস্তাবের গুরুত্বটা বুঝেছিলেন। কোম্পানির উচ্চতম কর্তৃপক্ষ ওয়েলেসলির পাশে দাঁড়ানোয় এই প্রকল্পকে বানচাল করা অংশিদারদের পক্ষে সম্ভব না হলেও, তাদের চাপে কোম্পানি একটা সমঝোতায় আসতে বাধ্য হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে ইওরোপিয় কৃষ্টি বিষয়ে শিক্ষা ইংলন্ডেই দিতে হবে বাকিটা ভারতে হোক। কোম্পানির অন্যতম কর্তা ডেভিড স্কটের ভাষায় “the College was sacrificed to the private trade agitation”। এতদসত্ত্বেও ওয়েলেসলি, যৌথভাবে ভারতীয় এবং ইওরোপিয় শিক্ষকদের দিয়ে পড়ানোর পরিকল্পনায় অনড় থাকলেন। ১৮১৬’য় হেলিবেরিতে নতুন শিক্ষাকেন্দ্রে ব্রিটিশ অর্থনীতিক টমাস ম্যালথাস পড়াতেন; এছাড়াও ভারত থেকে শিক্ষক নিয়ে গিয়ে সেখানে পড়ানো হতো। ওয়েলেসলির পরিকল্পনার সুফল ভোগ করে গিয়েছে কোম্পানি। ১৮৩১-এ কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে প্রত্যেক বছর বের হওয়া ৪১ জন পড়ুয়া কোম্পানিতে যোগ দিতেন। এরা ভারতে অন্তত দশ থেকে কুড়ি বছর কাটিয়ে লন্ডনে ফিরিতেন ব্যাঙ্গার্থে ‘নবোব’ উপাধি নিয়ে এবং হয় কোম্পানির উচ্চতম পদে অথবা রাজনীতিতে যোগ দিতেন। কিছু সফল নবোব পার্লামেন্টেও পৌঁছে যেতেন, কিছু মানুষ বিজ্ঞানের সেবক হতেন। মনে রাখা দরকার, ১৮৩০-এর ভারত এবং ব্রিটেনে চলতে থাকা ফোর্ট উইলিয়ামকেন্দ্রিক শিক্ষা বিতর্কের মধ্যে দিয়ে উঠে এলেন জেমস মিল আর ব্যাবিঙ্কটন মেকলের মতো আমলা। ওয়েলেসলির প্রকল্পে তৈরি হল নতুন ধরণের ভদ্রবিত্ত যারা পেশাদার, সাম্রাজ্যের যে কোন কাজ সম্পাদনে দক্ষ।
১৮৫৮তে কোম্পানি আমলা তৈরির কারখানার দায়িত্ব দেওয়া হল অক্সফোর্ডকে। ১৮৮৩-তে অক্সফোর্ডের আধুনিক ইতিহাস পাঠনের দপ্তর, ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউটে যে সংস্কৃত শ্লোকটি খোদিত করে বসানো হয়, সেটিতে স্পষ্টভাবে স্বীকার করা হয় যে ঔপনিবেশিক কাঠামোয় প্রশাসকেরা তৈরি হয়েছেন:- –
ভারতে কাজ করা ব্রিটিশেরা দুর্বিনীত ছিল এই তত্ত্ব মেনে নিয়েই বলছি, উইলিয়াম কলেজ ওঠা বিতর্ক, উপনিবেশ এবং মেট্রোপলিটনে উভয় ক্ষেত্রের শিক্ষানীতি প্রণয়নে বিপুল প্রভাব ফেলেছিল। পাঠকদের এতদিনের তৈরি করা উল্টো মনোভাবটাও মাথায় রাখতে বলব উপনিবেশে আধুনিকতার তত্ত্ব প্রয়োগের গবেষণাগার ছিল মেট্রোপলিটন – এবং সম্ভব হয়েছিল সেই তত্ত্ব সফলভাবে চর্চিত হওয়া এবং সেটি উপনিবেশে প্রয়োগের সফল প্রক্রিয়া প্রণয়নে।
প্রবন্ধের শেষপ্রান্তে এসে অন্য ধরণের একটা দৃষ্টিভঙ্গী উপস্থাপনা করব। আপাত দৃষ্টিতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ যতই বৈপ্লবিক লাগুক (যদিও আমাদের, মানে কারিগরদের কাছে এইটা একটা ঔপনিবেশিক কাঠামো চাপিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয় ), এটা কিন্তু উনবিংশ শতকের প্রথমপাদের ব্রিটিশ ব্যবস্থায় নতুন কিছুই ছিল না। আদতে এটির উদ্ভব কোন ব্যক্তিকেন্দ্রিক মানুষের ক্রিয়ায় নয়, এটাকে সেই সময়ের লন্ডনের মোটামুটি সংখ্যাধিক্যের মনোভাবের প্রতিফলন হিসেবেই দেখা দরকার। আদতে বেশ কিছু ব্রিটিশ সংস্কারক ফরাসি বিপ্লব তত্ত্ব উদ্ভুত ব্রিটিশ ভদ্রবিত্তের ভয় আর অস্বস্তিকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ প্রকল্প স্বস্বার্থানুকূলে নিয়ে আসার উদ্যম নেয়। এছাড়াও মেট্রোপলিটনে আরও একটি বিপ্লব সংগঠিত হচ্ছিল যার নাম শিল্পবিপ্লব, এই সবগুলি একসঙ্গে জুড়ে নিয়ে নতুন ধরণের নীতি নির্ধারণ করার দিকে এগোতে শুরু করল রাজনীতিকেরা। তারা বললেন, শিল্পবিপ্লবের ফলে উদ্ভুত অবস্থা গ্রাম্য দারিদ্রনাশক, যদিও এই অবস্থা সাময়িকভাবে সামাজিক বিপর্যয় তৈরি করবে! বিজ্ঞান আর ধর্ম পরস্পর শয্যাসঙ্গী – উদাহরণস্বরূপ উইলিয়াম পালেকে জন মেয়ার্ড কেনস ম্যালথাসের আর্থ-রাজনৈতিকতার তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে অতীব সম্মান প্রদর্শন করেছেন। কেনস মনে করতেন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নিউটন ছাড়া যার প্রভাব সব থেকে বেশি ছিল পালের। পালে মূলত বৈজ্ঞানিক চিন্তায় স্তরীভূত প্রকৃতি তত্ত্বএর উদ্গাতা, যে তত্ত্বের সরাসরি প্রভাব পড়েছে স্তরীভূত সমাজ তত্ত্বে।
উযোগিতাবাদীদের বৈজ্ঞানিক মানবহিতৈষণা তত্ত্ব (scientific philanthropy০) – ডেভিড আওয়েনের ইংলিশ ফিলানথ্রপিতে পাচ্ছি হাম্ফ্রে ডেভির বক্তব্য –১৮০২-১৮১২’র মধ্যে বিভিন্ন বক্তৃতায় বলেছিলেন। এগুলি উল্লিখিত হয়েছে Elements of Agricultural Chemistry, in a Course of Lectures for the Board of Agriculture বিষয়ক বক্তৃতামালায়। প্রথম বক্তৃতাতেই ডেভি বলছেন:-
… এটাকে সম্বল করে ‘Society for Bettering the Condition of the Poor’ এবং’ Board of Agriculture’ নীতি গ্রহণের উদ্যম নেয়। উনবিংশ শতাব্দে মেট্রোপলিটন এবং উপনিবেশের নানান শিক্ষা কেন্দ্রর সহযোগিতায় এই তত্ত্ব ফুলে ফলে বিকশিত হয়ে বাড়তে থাকা গোটা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বিশ্বকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। এই দুই বিপ্লব (ফরাসি আর শিল্প) শুধু নতুন শিক্ষাকেন্দ্রর পৃষ্ঠভূমিই তৈরি করে নি, নব্য জ্ঞানচর্চার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। একই সঙ্গে যে নতুন ধরণের পরিবেশ তৈরি হল, সেই পরিবেশের নানান স্পর্ধা সামলাতে এটি নতুন ধরণের জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র তৈরি আর তার ব্যবস্থাপনার বাস্তব দাবি পেশ করেছে।
এই ধরণের সফল শিক্ষাকেন্দ্রের বহুল চর্চিত উদাহরণ হল রয়্যাল ইন্সটিটিউট। ১৭৯৯তে লুঠেরা অত্যাচারী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অংশিদার এবং কর্মকর্তাদের আর্থিক বিনিয়োগে জন্ম। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠায় যে উদ্বেগ কাজ করছিল, এই সংগঠনটি তৈরির উদ্দেশ্যও প্রায় তাই – ফরাসি বিপ্লবের তত্ত্ব বিরোধী সামাজিক এবং রাজনৈতিক তাত্ত্বিক বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় গরীবদের অঙ্গীভূত করা। খুব গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই সংগঠনটির প্রাথমিক দু’জন প্রস্তাবক কোম্পানি কর্তা, রিচার্ড জোসেফ সুলিভান এবং জন কক্স হিপ্পিসিলি। এরা ১৭৯৯তে আগামী দিনের কোম্পানি আমলা তৈরির জন্যে রয়্যাল ইন্সটিটিউট তৈরির প্রস্তাবনা পেশ করেন যা এক্কেবারে ওয়েলেসলি প্রস্তাবিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজেরে প্রস্তাবনার নকল।
বোর্ড অব ট্রেড এবং কোম্পানিকে বারুদের রসায়ন, কৃষি দ্রব্য, চামড়া সংরক্ষণ ইত্যাদির বৈজ্ঞানিক, প্রাযুক্তিক পরামর্শ দেওয়া ছাড়াও রয়্যাল সোসাইটির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল জননের উদ্দেশ্যে (তথাকথিত) বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা আয়োজন করা, বৈজ্ঞানিক (প্রযুক্তিগত) পত্রিকা ছাপানো এবং জনগনেশের দেখাশোনার জন্যে বৈজ্ঞানিক হাতিয়ার এবং গবেষণাগার প্রতিস্থাপন করা।
হাম্ফ্রে ডেভির তুকতাকমূলক (wizard experimentalist) বৈজ্ঞানিক গবেষণা দেখতে মানুষ ভেঙ্গে পড়ল সোসাইটিতে। ১৮০২ সালে তার প্রথম বক্তৃতায় ডেভি বললেন বিজ্ঞান প্রমান করে দিয়েছে সমাজ দুটি মৌলিক নীতিতে তৈরি – সম্পত্তির অধিকার আর অসাম্য-
The unequal division of property and of labour, the difference of rank and condition amongst mankind, are the sources of power in civilized life, its moving causes, and even its very soul; and in considering and hoping that the human species is capable of becoming more enlightened and more happy, we can only expect that the great whole of society should be ultimately connected together by means of knowledge and the useful arts; that they should act as the children of one great parent, with one determinate end, so that no power may be rendered useless, no exertions thrown away
স্বাভাবিকভাবে ব্রিটিশ বিশ্বায়নের প্রকল্পে নানান ধরণের স্বার্থনিবেদিত অস্বাভাবিক বন্ধুত্বের ফসলে ফরাসি বিপ্লবের ধারণাগুলি তখন প্রায় অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। ব্রিটিশেরা সেই মুহূর্তে বৈজ্ঞানিক লব্জ দিয়ে ফরাসি বৈশ্বিক বিপ্লববাদকে আটকে রাখার কাজে সফল হলো আর এই কাজে তারা ভারতীয় অভিজাত ভদ্রবিত্তকে সঙ্গে পেল।
[ কপিল রাজ-এর Relocating Modern Science Circulation and the Construction of Knowledge in South Asia and Europe, 1650–1900 বইটির অনুসরণে। ]
ছবি: ইন্টারনেট
লেখক পরিচিতি:
বিশ্বেন্দু নন্দ
লেখক, গবেষক, সংগঠক। উপনিবেশপূর্ব সময়ের সমাজ অর্থনীতিতে কারিগরদের ইতিহাসের খোঁজে সর্বক্ষণের কর্মী। হকার, কারিগর সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় তিন দশক। বাংলায় পরম্পরার উৎপাদন বিক্রেতাদের বিষয়ে লিখেছেন নিরন্তর। বাংলার উপনিবেশপূর্ব সময়ের পরম্পরার চাষী-হকার-কারিগর-ব্যবস্থা বিষয়ে খোঁজ করছেন। দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ছাড়াও দেশীয় প্রযুক্তি বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে। ‘পরম’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। অড্রে ট্রুস্কের আওরঙ্গজেব, ম্যান এন্ড দ্য মিথ, স্বেন বেকার্ট এম্পায়ার অব কটন, যদুনাথ সরকারের মুঘল এডমিনিস্ট্রেসন, আহকমই আলমগিরি অনুবাদ করেছেন। পলাশীপূর্বের বাংলার ৫০ বছর, পলাশীপূর্বের বাংলার বাণিজ্য দুটি মৌলিক পুস্তকের রচয়িতা।
অনেক শিক্ষনীয় একটা লেখা। ভালো লাগলো।