আজ বৃহস্পতিবার, ৮ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বাংলার ভাবসম্পদঃ মনসা

Author : ফরিদা আখতার

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের একটি গ্রাম পাঁককোলা। মনসাপুরান পদ্মাপুরান চন্ডিমঙ্গল ইত্যাদি আশ্রয় করে বাংলাদেশে ভাবুকতার যে চর্চা তা স্বচক্ষে দেখার জন্য শ্রাবন মাসের ২৫ তারিখ (অগাস্ট মাসের ৯ তারিখে), আমরা পাবনার ঈশ্বরদী থেকে গাড়ীতে করে পাঁককোলা গেলাম । বোন ‘বুড়ি’ ও ভাই শামসুল ফকির – জ্যোতিধামের ফকির লবান শাহের ভক্ত-যুগল এই আয়োজন করেছেন। ‘বুড়ি’ বা সকলের প্রিয় ‘বুড়িমা’ নিজেই উৎসাহ নিয়ে এই আয়োজন করেছেন। বুড়ির বয়স ৩০ – ৩২ বছরের বেশি হবে না। বড়রা স্নেহে বুড়ি বলে ডাকতে ডাকতে তার এই ভারী সুন্দর নামটি চিরস্থায়ী হয়ে গিয়েছে।

তাঁদেরই আমন্ত্রণে ও ফরহাদ মজহারের পরিকল্পনায় আমাদের যাওয়া। পাক্ষিক চিন্তা বাংলার ভাবান্দোলনের ধারাকে শিব ও পার্বতির পুরাণ দিয়ে বোঝার একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পদ্মাপুরান, মনসা পুরান ইত্যাদি শিবপার্বতির যুগল ভাবকে নানান দিক থেকে বিচারের চেষ্টা কিনা সেটা তত্ত্বজ্ঞানীরা বিচার করবেন। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল গবেষকদের বইয়ের কাহিনী বা মনসার কোন গল্প নয়, বাংলাদেশের মানুষ শিবপার্বতি, মনসা বা পদ্মাকে কিভাবে দেখে তা স্বচক্ষে দেখা। পাক্ষিক চিন্তার পক্ষ থেকে সুজন আমাদের সঙ্গ নিলেন। দৌলতপুর থেকে যোগ দিলেন বেলো আপা ও ভাই রওশন ফকির। আমাদের সঙ্গ নিল সীমাদাস সীমু। ছবি তোলার জন্য যোগ দিল রজ্জব আর শামিউল। বলাবাহুল্য, এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত লেখা আসবে। এখানে আমার নিজের অভিজ্ঞতা চিন্তার পাঠকদের জন্য খানিক বয়ান করে রাখতে চাই।

ভেড়ামারার পর থেকে দৌলতপুর যাবার রাস্তা আমাদের কিছু চেনা আছে কিন্তু তার পর থেকে রাস্তা একেবারে অচেনা। গাড়ীতে যারা আছে সবারই একই অবস্থা। তাই দৌলতপুরের পর ঘোড়ামারা, এবং তারপর পাঁককোলা গ্রামে যাব, তা বেশ উৎকন্ঠায় ফেলে দিল আমাদের। এদিকে রাত প্রায় ৮টা – ৯টা বেজে যাচ্ছে। রাস্তার দু’ধারে আলো বলতে কিছুই দেখা গেলো না। দোকানপাট আসলে একটু আলো দেখা যায়। সেখানে ব্যাটারী দিয়ে টেলিভিশনও চলছে। আকাশও অন্ধকারে ভরা। পরদিন অমাবস্যা। পথের মোড়ে মোড়ে মনে হচ্ছিল অন্ধকার ঘাপটি মেরে বসে আছে। গাড়ীর হেড লাইটের আলোতে গাড়ির জন্য রাস্তা ছেড়ে বুঝি এক পাশে ঝুপটি অন্ধকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার খুব গরম পড়ছে তাই মানুষজন সব ঘরের বাইরে। বিশেষ করে পুরুষরা খালি গায়ে রাস্তার ধারে মাচার ওপর বসে আড্ডা দিচ্ছে। তারা আমাদের খুব উপকার করলেন। কিছু দূর এগিয়েই আমাদের গাড়ী থামিয়ে সীমা দাস প্রশ্ন করছেন, এবার কোন দিকে যাবো? সোজা গিয়ে ত্রিবেণীর মাথায় ডান দিকে যাবেন, কিংবা বলে বাম দিকে যাবেন। লক্ষ করলাম, ঘোড়ামারা থেকে পাঁককোলা যেতে গিয়ে বেশ কয়েকটি, ত্রিবেণী, অর্থাৎ তিনটে রাস্তার মোড় আছে। দোকানের সামনে বসে থাকা মানুষ বলছেন ডাইনে বা বাঁয়ে যাবার কথা, কিন্তু সাইকেল চালক থাকলে বলছে, ‘পাঁচ কিলো’ পথ। তিন রাস্তার মোড়কে এই অঞ্চলে ‘ত্রিবেণী’ বলে। মনে পড়ল আমরাতো আসলে নদিয়ায়। এই অঞ্চলে ভাবি আলাদা।

এভাবে এগিয়ে যখন পাঁককোলার কাছে আসলাম তখনই সামনে দেখি শামসুল ফকির ও রওশন ফকির দাঁড়িয়ে আছেন। পরে অবশ্য শুনেছি, গ্রামের নাম পাঁককোলা আর বলে না। পাঁক মানে কাদা, এখন এখানে পাকা রাস্তা হয়েছে, একটি ছোট ব্রীজও আছে। কাদা আর খুব একটা নেই। তাই এখন এই গ্রামের নাম পাক (পবিত্র) কোলা।

রওশন ফকির ও বেলো আপা এবং শামসুল ফকির ও বোন বুড়ি জ্যোতিধামের ফকির লবান শাহের ভক্ত। আমাদের তাঁরা অভর্থনা জানালেন নিজেদের রীতি অনুযায়ী চাল-পানি ও ভক্তির মাধ্যমে। তারপর মুড়ি, চা ও ফল সেবা হোল। চারিদিকে অন্ধকার, আখড়াবাড়ীতে কিছু মোমবাতি জ্বলছে। প্রচন্ড গরম, গাছের পাতা একটিও নড়ছে না। আমরা আখড়াবাড়ির খোলা অংশে বসে আছি, এখন অপেক্ষা মনসা ভাসান পালা দেখার। আখড়াবাড়ির সামনের মঞ্চের আয়োজন করা হয়েছে। তেমন কিছুই নয়, চারটি খুঁটি গেড়ে ওপরে সামিয়ানার কাপড় দেয়া হয়েছে। মাঝখানে বর্গাকৃতি করে শিল্পীদের বসার ব্যবস্থা।

আমরা যেখানে বসে আছি সেই বারান্দার একটি কোনায় দেখলাম কয়েকজন (মনে হয় ১২ বা ১৩ জন হবেন) আলো আঁধারীতে বসে আছেন। বুঝতে পারি নি যে তাঁরাই এই মনসা ভাসানের শিল্পী। বুড়ী শিল্পীদের মধ্যে টিম লীডারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি নিজে একদিকে সংগঠক অন্য দিকে শিল্পী। খুব বিনয়ী মাঝ বয়সী মানুষটি ফরহাদ মজহারের সাথে নিজেদের সম্পর্কে বলছিলেন। তিনি নিজে গত ৩০ বছর ধরে এই মনসা ভাসান পালাটি করছেন। তাঁর ওস্তাদ এখন মুরুব্বী (অর্থাৎ বুড়ো) হয়েছেন তাই তাঁকে সব দায়িত্ব নিতে হয়। দেখলাম মনসা ভাসানের সব কিছুই তাঁর ভাল ভাবে জানা আছে। তাঁর কথা বলার ভঙ্গী এবং আচরণ দেখে আমরা প্রায় সবাই নিশ্চিত ধরে নিয়েছিলাম, তিনি সম্ভবত জন্মসুত্রে মুসল্মান পরিবারের মানুষ। আলোচনার এক পর্যায়ে তার সাথে ভবিষ্যতে যোগাযোগ করার জন্য নাম জানতে চাইলেন ফরহাদ মজহার। তিনি বললেন, তাঁর নাম “আব্দুল কাদের”। হঠাৎ চমকে গেলাম, এতো গভীর ভাবে তিনি এই পদ্মার ও মনসার পুরাণ এবং বিশেষ ভাবে মনসার ভাসান নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন, তা পরম নিষ্ঠা ছাড়া অসম্ভব। কিছুক্ষণ পর তাঁদের পরিবেশন দেখেই বুঝলাম। এই দেশের সাধারণ মানুষ কিভাবে গণসংস্কৃতিকে ধারণ করেছে সেই অভিজ্ঞতা আমাকে উদ্বেল করে তুলল। অবিশ্বাস্যই বলতে হবে।

পাশের বারান্দায় বসা সব পুরুষরা একে একে পোষাক পরে এবং মেক-আপ নিয়ে তৈরী হলেন। সকলেই সম্প্রদায়গত ভাবে মুসলমান পরিবারের খেটে খাওয়া মানুষ, তাদের একটি অংশ কোন বিশেষ পোষাক বা মেক-আপ ছাড়াই যন্ত্র নিয়ে বাজাতে শুরু করলেন। সেখানে ব্যাটারীর সাহায্যে একটি “এনার্জী সেভিং” লাইট জ্বলছে। বাজনার শব্দে ঘুরঘুট্টি প্রাক-অমাবস্যার অন্ধকারে নিমজ্জিত গ্রামের নিরবতা ভাংগতেই দর্শক আসতে শুরু করলো।

আমরাও এতক্ষণ শুরু হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বসলাম। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম, চারকোনা মঞ্চের চারদিকে গোল হয়ে ছোট বড় (ছোট শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ মানুষ) এই মনসার ভাসান দেখবার জন্যে এসেছেন। কাউকে ঠিক হয়ে বসার জন্যে বলতে হচ্ছে না, সবাই নিজ দায়িত্বে চুপচাপ বসে পড়েছেন।

শুরু হোল বন্দনা দিয়ে। কোন মাইক নেই, খালি কন্ঠেই গাইছেন তাঁরা। যদিও একটু বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু আমি খুব অবাক হ্লাম, দর্শকের ধৈর্য এবং সহযোগিতা দেখে। তাঁরা নীরবে শুনছিলেন, কোন প্রকার হৈ চৈ নেই। এমনকি যখন তিনজন পুরুষ মেক-আপ নেয়ার পর নারীর রূপ নিয়ে এসে হাজির হলেন, বেহুলা, মনসা ও সনকা – তখনও কোন প্রকার হৈ চৈ হোল না। দেখে আমি সত্যি নিজেই দর্শকদের ব্যাপারে মুগ্ধ হলাম। তাঁরা আসলেই বেহুলা- লক্ষিন্দরের পালা শুনতেই এসেছেন। আব্দুল কাদের শুরুতে আমাদের বলে দিয়েছিলেন যে পুরো মনসার পালা করতে গেলে তিন দিন লেগে যাবে, কিন্তু যেহেতু সেই সময় এখন আমাদের নেই তাঁরা শুধু একটি অংশ করবেন, সেটা হচ্ছে বেহুলা লক্ষিন্দরের বিয়ে এবং বাসর রাতের ঘটনা। বেহুলা-লক্ষিন্দরের গল্পের এই অংশটি বাংলাদেশের মানুষ সবাই জানে। তবে এর মধ্যে এমন কয়েকটি বিষয় আছে, যার সাথে মনসাকে পুজা দেয়া এবং তাঁকে দেবী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্ন জড়িত। তাই বেহুলা-লক্ষিন্দরের গল্পে সাপ কামড় দিয়ে কত খারাপ কাজ করেছে, এতো দিন যেভাবে বুঝেছি, এই পালা দেখে সেই ভাব আমার কেটে গেছে।

পালাতে গান, নাচ এবং কিছু সংলাপের ভারী সুন্দর মিশ্রণ আছে। যারা নাচ করছেন তাঁরা একই সাথে গানও করছেন। গত এক সপ্তাহ ধরে কয়েক জায়গায় অনুষ্ঠান করে এখানে এসেছেন বলে দুই এক জনের গলা ভেঙ্গে বসে আছে। জোরে গাইতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু তবুও তাঁরা গেয়ে গেছেন। কোন গান সংক্ষেপ করেননি। দর্শক একটু উতলা হলেও তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন, মাইক ছাড়া শোনা যায় এমন করে গাইতে।

নাচ খুব অসাধারণভাবে তাঁরা উপস্থাপন করলেন। শরীরের অঙ্গভঙ্গী দেখে কেউ বুঝবে না এঁরা নারী নয়। মনসা দেবীর নাচে সাপের ভঙ্গী, চোখের কাজ, জিহবা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন দেবীর মনোভাব কেমন। অভিনয়ের পাশাপাশি গল্পতি খুব ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁরা। সংলাপের সাথে মিলিয়ে রাগ বা কান্না এবং বিশেষ করে কৌতুকগুলো পুরো পালাতে ভালভাবে সংযোজন করেছেন। দর্শকের কথা ভেবে হাসির খোরাক যুগিয়েছেন কিছুটা অপ্রয়োজনীয়ভাবেও। কিন্তু সে সময় দেখেছি, কিশোর বয়সী ছেলে মেয়েরা হেসে কুটি কুটি হচ্ছিল। বুড়োরাও হাসতে কার্পণ্য করে নি। কাজেই গল্প যতোই দুঃখের হোক, গল্পের সে অংশে যাবার আগে বিনোদনের বিষয়টি তাঁরা মনে রেখেছেন।

সংলাপের মধ্যে যেমন আদি ভাব ছিল, তেমনি বর্তমান যুগের ভাষাও যুক্ত হয়েছে। ইংরেজী বাংলা মিশিয়ে কথা বলা, বিশেষ বাংলা শব্দ প্রয়োগ খুব তাৎপর্যপুর্ণ মনে হয়েছে। যেমন বিশ্বকর্মা যখন বেহুলা- লক্ষিন্দরের বাসর ঘর বানাবার জন্য যাচ্ছে তখন মনসা দেবী তাঁকে বলছেন বাসর ঘরের “দক্ষিন কর্নারে” ছিদ্র বা ফুটো রাখতে হবে। ‘কর্নার’ শব্দটি ইংরেজী কিন্তু মনে হয়, কর্নার না বললে দর্শক বুঝবে না। আবার বিশ্বকর্মা কথা বলতে গিয়ে বারে বারে ভুল করছেন তখন চাঁদ সওদাগর বলছেন ‘কারেক্ট করে বল’। বেহুলা- লক্ষিন্দরের বাসর ঘরে আনন্দময় সময়টি বোঝাতে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পাশা খেলা হোল, তখন কে জিতেছে জানার জন্য ধর্মযাজককে বলছে, ‘তুমি আমাদের সাক্ষী, তুমি আমাদের বুদ্ধ্বিজীবি’।

এভাবে রাত প্রায় ১ টা পর্যন্ত পালা চললো, দর্শকের ঘুম নেই। সবাই বসে আছে, এমন সময় ব্যটারীর বাতিটি নিভে গেলো। পালার এই অংশ ছিল দুটি সাপ বেহুলার ঘরে গিয়ে নাচানাচি করছে, আর বেহুলা তাদের দুধ খাইয়ে বশ করে ফেলেছে। লাইট নাই রাতও অনেক হয়েছে। আব্দুল কাদের তখন লক্ষিন্দরের ভুমিকায় অভিনয় করছেন। তিনি বললেন আজ এখানেই থাক। কারণ লক্ষিন্দরকে সাপে দংশন করে ফেললে আর বন্ধ করা যাবে না।

সকালে আবারও পালা হোল। লক্ষিন্দরকে কালনাগিনী সাপে দংশন করেছে, বিষের যন্ত্রণায় লক্ষিন্দর কাতরাচ্ছে, সবই হোল। এরই মধ্যে সুযোগ হোল আমাদের বেহুলা, মনসা ও সনকার ভুমিকায় অভিনয়কারী মিজান ও নুরুজ্জামানের সাথে কথা বলার। নারী রূপেই এই পুরুষ দু’জন সুন্দর করে কথা বললেন। সীমা দাস সীমু এবং আমার কৌতুহ্ল মেটাবার মতো প্রশ্নের উত্তর দিলেন বিরক্ত না হয়ে। তাঁদের পরিবারে স্ত্রী-সন্তান আছে। সঙ্গীত ভালবাসেন তাই এই কাজকে জীবিকা অর্জনের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। দীর্ঘ দিন ধরে এই পালা করছেন, তাই সব সংলাপ মুখস্থ। পুরো বই মাথার ভেতরে। অনেক সাধনা করতে হয়, নাচ এবং গানের জন্য।

তবে দর্শক-স্রোতা না থাকলে, তাঁরা টিকবেন না। এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা সম্পর্কে কি তাঁরা সচেতন আছেন? কিংবা প্রশ্ন তোলা যেতে পারে এটা রক্ষা করার দায়িত্ব কি তাঁদের একার? নিশ্চই না।

বলতেই হবে, আমি মুগ্ধ হয়েছি।

৩০ শ্রাবণ ১৪১৭। শ্যামলী

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top