আজ বৃহস্পতিবার, ১লা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

নভেম্বর ফিরে আসে

।। বৈশালী ।।


ভূমিকা:

নভেম্বর মাস মানে ১৯১৭’র নভেম্বর বিপ্লবের প্রসঙ্গ। মহান নভেম্বর বিপ্লবের ইতিহাসচর্চা। আমাদের কাছে পরিচিত ‘রেড অক্টোবর’ কিম্বা ‘অক্টোবর বিপ্লব’ হিশাবেও। সাবেক সভিয়েত রাশিয়ায় এর পরিচয় ছিল ‘বলশেভিক রেভলিউশান’ কিম্বা ‘গ্রেট অক্টোবর সোশ্যালিস্ট রেভলিউশান’ হিশাবে।  কিন্তু নভেম্বর বিপ্লব শুধুই কি ইতিহাসের দলিল দস্তাবেজ? নভেম্বর বিপ্লবের প্রসঙ্গ কি শুধুই ৭ নভেম্বর দিনটিতে অথবা নভেম্বর মাসব্যাপী প্রাসঙ্গিক? আমরা তা মনে করি না। আমরা মনে করি নভেম্বর বিপ্লবের ইতিহাসকে দেশকালের প্রেক্ষিতে নতুনভাবে সচল ও সজীব রাখার প্রয়াস জারি রয়েছে। রাশিয়া বা ইউরোপের ইতিহাসকে কপি-পেস্ট করার মধ্যে দিয়ে নভেম্বর বিপ্লব নিয়ে রোম্যান্টিসজমের আমরা পক্ষপাতী নই। বরং রাষ্ট্র-দেশ-সমাজ ও কালের প্রেক্ষিতে নভেম্বর বিপ্লবকে জিন্দা রাখতে চাই আমরা।

এই যেমন, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বায়িত কর্পোরেট গায়েবি লগ্নিপুঁজি হিন্দুত্ববাদীদের মাধ্যমে ভারতকে একদিকে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি ফ্যাসিবাদী রাজনীতি ও তার সংস্কৃতিতে একমাত্রিক চেহারা দেওয়ার জন্যে এনআরসি-সিএএ লাগু করে এগুলোকে কার্যকরী করতে চাইছে এবং এই লক্ষ্যে বাংলাবিদ্বেষ ছড়াতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে তারা তৎপর। আবার এই লগ্নিপুঁজি ও হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি ফ্যাসিস্টরা কৃষক বিরোধী নয়া কৃষি আইন চালু করে নতুন করে নীলকর সাহেবদের নীলচাষের মতো করে কৃষকের রক্ত শুষে নেওয়ার বন্দোবস্ত করেছে। বহুজাতিক লগ্নিপুঁজিতে কৃষির পণ্যায়ণের বন্দোবস্ত পাকাপোক্ত করা হয়েছে। এইসবের বিরুদ্ধে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের শহুরে সংখ্যগুরু মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত এখনও কোনোপ্রকার প্রতিবাদে সামিল না হলেও কৃষক, কৃষিমজুর, মজদুর, নমঃশূদ্র-দলিত ও সংখ্যালঘু মুসলমানরা ভারতব্যাপী আন্দোলনে নেমে পড়েছে। এন-আর-সি, সি-এ-এ ও এন-পি-আর-এর (নাগরিকত্ব সংক্রান্ত ফ্যাসিস্ট ভারত রাষ্ট্রের নানা কারবার) বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন প্রত্যক্ষ করা গেছে। মাঝে কোভিড ও লকডাউনের কারণে গণআন্দোলন কিছুদিন বন্ধ থাকলেও কৃষিবিলের বিরুদ্ধে এবং দলিত মেয়েকে ধর্ষণ ও লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ফের ভারতের প্রান্তিক ও শ্রমজীবী মানুষ ফের গণআন্দোলনে তীব্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমরা ৭ নভেম্বর ‘প্রতিপক্ষ’র পক্ষ থেকে এই সব আন্দোলনের সঙ্গে সংহতিজ্ঞাপন করছি শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গন থেকে।

ভাষা, শ্রেণী, বর্ণ-বর্গ ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়কে কেন্দ্র করে শুধু ভারত বা বাংলাদেশে নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার নানা প্রান্তে যেসব আন্দোলন হচ্ছে সেসবের সঙ্গে আমরা শিল্প-সাহিত্যের মাধ্যমে সম্বন্ধ গড়ে তুলতে আগ্রহী। এই আন্দোলনগুলিই আমাদের বার্তা দিচ্ছে, নভেম্বর ফুরায় না, ৭ নভেম্বর ইতিহাসের মুর্দা একটি দিন নয়, বরং ৭ নভেম্বর যেমন ফিরে আসে প্রতি বছর, তেমনই নভেম্বর বিপ্লব জিন্দা থাকে দেশে দেশে গণআন্দোলনের মধ্যে। আমরা এই ফিরে আসা নভেম্বরকে জিন্দা রাখতে চাই। আর তাই বৈশালীর আঁকা কয়েকটি ছবি ও তার পাশাপাশি ছবিগুলো থেকে প্রতিধ্বনিত হওয়া শব্দগুলো চিত্রভাষা হিসেবে যুক্ত করে আমরা পেশ করলাম ৭ নভেম্বর, ২০২০-এর সন্ধ্যায়। ছবিগুলো ভারতের নয়া কৃষি আইন বিরোধী ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী আবহে আঁকা।

অতনু সিংহ, কার্যনির্বাহী সম্পাদক, প্রতিপক্ষ।

ছবির শব্দ


‘রক্তমাখা চরণ’

কৃষকের, কৃষিমজুরের পা থেকে রক্ত ঝরেছে, মজদুরের পা থেকে রক্ত ঝরেছে, পরিযায়ী শ্রমিকের পথ রক্তে ভেসে গেছে। তবুও তারা হাঁটছে, তবুও তাঁরা হাঁটবে, ইনসাফের জন্যে। তাদের ঘামের ন্যায্য মূল্যের জন্য। উদ্বৃত্ত শ্রম থেকে যে মুনাফা ক্রমশ পর্বতের চেহারা নেয়, সেই পাহাড় ভাঙার লড়াইয়ে মজদুর হাঁটছে, কৃষক হাঁটছে। প্রান্তিক মানুষ হাঁটছে। তাদের পা থেকে রক্ত ঝরছে। সেই রক্তমাখা চরণ তারা ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাক করেছে। নিউজ চ্যানেলে দেখা গেছে সেই রক্তাক্ত পা। যে নিউজ চ্যানেল ‘সত্য’ পয়দা করে। পুঁজির ‘সত্য’। রাষ্ট্রের ‘সত্য’। ফ্যাসিবাদের ‘সত্য’। যে ‘সত্য’র সঙ্গে মানুষ থাকে না। মানুষ হেঁটে চলে একা। রাষ্ট্র, ফিন্যান্স ক্যাপিটাল, জাতীয়তবাদ- এসবকে রক্তমাখা চরণতলে পাড়িয়ে সে হেঁটে যায়। নভেম্বরের রাস্তায়।

রক্তমাখা চরণ
‘কাস্তেটা দাও শান হো’

কৃষকের, কৃষিমজুরকে ক্রীতদাস বানাতে নয়া কৃষি আইন লাগু করেছে হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকার। ঠিক যেমনটা নীলকর সাহেবরা করেছিল। চুক্তিচাষ আর কৃষকের মাঠ থেকে জলের দামে ফসল লুঠ করে গুদামের ঠাণ্ডায় দাম বাড়াবে কর্পোরেটরা, তারপর বিশগুণ দামে তা তুলে দেওয়া হবে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তের হাতে। নিম্ন মধ্যবিত্ত, প্রান্তিক মানুষরা ভুখায় মরবে। এই অবস্থার মোকাবিলায়, এই ব্যবস্থাকে প্রতিহত করতে কাস্তে হাতে কৃষকেরা রাস্তায় নেমেছে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে। তেভাগা আন্দোলনের গান ভাসছে বাতাসে, ‘হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো…’। আর নভেম্বরের ডাক। কমরেড লেনিনের মুখ। লেনিন যেন জিন্দা হয়ে উঠছেন জনতার দরবারে। গোর্কির ‘মা’ উপমহাদেশের বাস্তবতায় এই পূবদেশের গীতিকাব্য আর ফসলের ভিতর থেকে বাঙ্ময় হয়ে উঠছেন, ডাক দিচ্ছেন জেহাদের।

কাস্তেটা দাও শান হো
‘মৃত্য উপত্যকা আমার দেশ নয়’

বানোয়াট জাতীয়তাবাদ/জাতিবাদ আর রাষ্ট্রীয় লুঠের ফ্যাসিস্ট প্রকরণ কৃষক-মজুর-সহ গণমানুষকে কঙ্কাল বানাতে চেয়েছে, এই গণহত্যার মৃত্যু-আবহের বিপরীতে দাঁড়িয়ে জিন্দাবাহারের জেহাদে জেহাদে নভেম্বরকে মূর্ত করতে চাইছে কৃষক। তার ফসলের মমত্ব, তার লোকায়ত যাপন আর তার ভূমিনিবিড়তা লালঝাণ্ডার উপমহাদেশীয় আখ্যান নির্মাণে মুখর হয়ে উঠছে। সে জিন্দা হয়ে উঠছে মুর্দা রাষ্ট্রের মুখোমুখি।

মৃত্য উপত্যকা আমার দেশ নয়
‘হাজার চুরাশির মা’

একদিকে রাষ্ট্র, অন্যদিকে ইনসাফের আয়াতে আর মন্ত্রে মুখোমুখি হাজার চুরাশির মা। তার স্মৃতি জুড়ে সন্তানদের শাহাদতের দিনগুলি আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের রক্ত-ঝলমল ইতিহাস। তার জবানে জেহাদের সংকল্প। তার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নাই কোনো। শুধু ঝাণ্ডার লাঠি একখান। আর স্পর্ধা। ইতিহাসের স্পর্ধা। নভেম্বরের স্পর্ধা। মেহনতি মানুষের বিশ্ব মানব-উম্মাহ (মান-সমাজ) গঠনের স্পর্ধা। রাষ্ট্রের মুখোমুখি আমাদের এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখছি রাত কাবার হয়ে লাল অগ্নিকোণের স্বপ্ন।
হাম দেখেঙ্গে। আমরা দেখব সেই ইনসাফের সকাল।

হাজার চুরাশির মা
‘শূদ্র আর মজলুমের এই সেই ভুখণ্ড যেখানে ঘরে প্রস্তুতি চলছে যুদ্ধের

ভাষা কিম্বা বর্ণ কিম্বা লিঙ্গ কিম্বা শ্রেণীকে তাক করে উচ্চবর্ণ আর উচ্চবিত্তের পিতৃতন্ত্র এই উপমহাদেশে য্যগ যুগ ধরে যেভাবে কায়েম রেখেছে শোষণের ব্যবস্থা, আজ ফ্যাসিস্ট পরিকাঠামোয় সেই শোষণ-লুন্ঠন সব কিছুর সীমা ছাড়িয়েছে। তাই নিপীড়িত শূদ্র/মজলুম, আদিবাসী, কৃষক-মজদুর, ছাত্র-যুব আজ জোট বাঁধছে। সাম্যের সংগ্রাম আর ইনসাফের জেহাদের লক্ষ্যে শুরু হয়েছে প্রস্তুতি। হিন্দু-মুসলিম ইত্যাদি কোনো ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ বা কোনোপ্রকার জাতিবাদ এসবের মীমাংসা হতে পারে না। এই ফ্যাসিস্ট পরিকাঠামোর বিরুদ্ধে মানুষ এক হতে পারে আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বপ্নে। ভাষা, ভুমি, শস্য আর ঘামের কসমে।

‘শূদ্র আর মজলুমের এই সেই ভুখণ্ড যেখানে ঘরে প্রস্তুতি চলছে যুদ্ধের’
‘আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বন্টন’

কৃষিনিবিড় এই ভুবনে আমাদের ইনসাফ আর সমানাধিকারের আধার হলো শস্য। আমরা তাই সাম্য, সমানাধিকার আর ন্যায়বিচার বা ইনসাফের জায়গাগুলিকে ফসলকে কেন্দ্র করেই নিশ্চিত করতে চাই। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং সংস্কৃতি ও ধর্মাচারণের স্বাধীনতার কথা আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চায়। আমরা ৭ নভেম্বরকে জিন্দা রাখতে চাই।

‘আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বন্টন’

শিল্পীর পরিচয়:
বৈশালী
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতকোত্তর এবং ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ নিয়ে এমফিল করার পর বিগত ৬ বছর বিভিন্ন এনজিও’র সঙ্গে যুক্ত। WLCI, কলকাতা কলেজ থেকে ফ্যাশান টেকনোলোজি নিয়ে ডিপ্লোমা করেছেন। বৈশালী একজন স্বশিক্ষিত অঙ্কনশিল্পী এবং বিগত বেশ কিছু বছর ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন। থিয়েটার চর্চার সাথে সঙ্গে বিগত ৭ বছর; অভিনয়ের পাশাপাশি শিল্প নির্দেশনা, সেট ও পোশাক ডিজাইনিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার অলঙ্করণ বিভাগের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top