![](https://protipokkho.com/wp-content/uploads/2021/11/rsz_2দিনে_দেখা_তারা.jpg)
।। হোসাইন মোহাম্মদ ওমর খৈয়াম ।।
স্যামুয়েল বেকেটের ভ্লাদিমির আর এস্ট্রাগনের মতন মনে হয় মাঝেমাঝে। সবসময়ই একটা না একটা গডোকে খুঁজছি, আর গডোও বারবার তার দূতকেই পাঠাচ্ছে। নিজে আর আসে না। ধুর, ইদানিং খালি এইরকম হারিয়ে যাচ্ছি মাথার মধ্যে। সিঁড়িঘরের কাচে আটকানো জানালার সামনে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বেকেটের কথাই মনে পড়া লাগলো!
দিনে দেখা তারা
দিনে সূর্যের উজ্জ্বলতার কারণে নাকি খালি চোখে তারা দেখা যায় না। এক কেজি টমেটো কিনে দাম দেয়ার সময় কেন যেন হঠাৎ এই কথা মনে পড়লো। টমেটো-টমাটো একই কথা। জাহাঙ্গীর স্যার বলেছিলেন ক্লাসে একবার।
কিন্তু এই কথা হঠাৎ আসলো কেন? ভাবতে ভাবতে টপ করে রাস্তাটা পার হয়ে গেলাম। সামনের চারতলা বাড়ির তিন তলায় থাকি। বড় ভাই আর আমি। ভাই চাকরি করেন তাই বউ খুঁজছেন, আমি চাকরি করিনা তাই গার্লফ্রেন্ড খুঁজছি। আগে দুজনই চাকরি খুঁজতাম একসাথে। এখন আমি একাই।
স্যামুয়েল বেকেটের ভ্লাদিমির আর এস্ট্রাগনের মতন মনে হয় মাঝেমাঝে। সবসময়ই একটা না একটা গডোকে খুঁজছি, আর গডোও বারবার তার দূতকেই পাঠাচ্ছে। নিজে আর আসে না। ধুর, ইদানিং খালি এইরকম হারিয়ে যাচ্ছি মাথার মধ্যে। সিঁড়িঘরের কাচে আটকানো জানালার সামনে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বেকেটের কথাই মনে পড়া লাগলো!
এই এডিএইচডি’র ফাঁড়া বড় কঠিন। করি এক ভাবি আরেক, আবার ঠিক তার পরেই ভাবি এক করি আরেক। ডাক্তারি বুলিতে মনঃসংযোগে ব্যর্থ তড়িৎ-করিৎকর্মা। ব্যস্ত থাকতে ভালবাসি। কিন্তু, কীভাবে কোত্থেকে যেন হাজার হাজার ভাবনা এসে হাজির হয় এমনি এমনি।
একবার বাইরে যাওয়ার সময় ঘরের জামা বদলিয়ে জুতা পরতে যাওয়ার ঠিক আগেই মনে হল যে, মাইকেল শুমাখারের টপ স্পীডটা কত ছিল তা আর মনে পড়ছে না। জানতাম, কিন্তু ২-৩ মিনিট খুব মনে করার চেষ্টা করেও লাভ হলো না। শেষে ল্যাপটপের ব্রাউজার খুলে বসলাম। হ্যা এইতো, ঘন্টায় ৩৯৭.৩৬ কিমি। বাইরে অপেক্ষমাণ বন্ধুদের আরো ১৫ মিনিট অপেক্ষায় রেখে শুমাখারের নামের প্রথমাংশ মাইকেল নাকি মিশেল তা নিয়ে একটা ডিবেট দেখে ফেললাম রেডিটে। দেখে বিরক্ত লাগলো, কারণ আমাকে এর আগেও অনেকে ‘মিশেল’ বলতে বলেছে। আমার মাইকেলই পছন্দ।
এডিএইচডি নিয়ে প্রেম করাও কঠিন। কারণ প্রেম প্রেমিক-প্রেমিকাকে প্রথমে সুখভাবনায় গ্রাস করে। এর মাঝেই এডিএইচডি রোগী মনঃসংযোগ হারায়। দেখা যায় শুধু অপরপক্ষই প্রেমের কব্জায় আছে, এই পক্ষ সময়ে সময়ে মনেমনে প্রেম থেকে না বলে ছুটি নেয়।
অনেকে আমাকে ভাবুক বলেছে আমার হারিয়ে যাওয়া দেখে। কিন্তু বন্ধুদের আড্ডায় তারকোভস্কির আলোচনার মধ্যে যে আমি আমার ভাত খাওয়ার প্লেটের নিচের একটা দাগ বাড়ি খেয়ে হয়েছে নাকি ঘষা খেয়ে হয়েছে তা নিয়ে ভাবি, তা কেউ জানে না। এমনকি প্লেট নিয়ে ভাবতে ভাবতে রে চার্লসের কথাও মনে পড়ে। কারণ, রে চার্লসের প্লেটের নিচে এমন দাগ থাকলে উনি টের পেতেন না। তবে রে চার্লস যে প্রেমিক পুরুষ ছিলেন মানতেই হবে।
পাশের বাড়ির তিনতলাতেই একটা মেয়ে থাকে। কয়েকমাস ধরে থাকছে। বয়স ২২-২৩ হবে। সুন্দর। আবার নরম-সরমও মনে হলো। কী জানি বাপু! ডয়েলের মতন ভাবতে পারলে ভাল ছিল। বারান্দায় আসলে যতটুক দেখা যায় অতটুকুতেই অনেক কিছুর ধারণা হতো। তারপর কখনো সামনাসামনি কথা হলে এক-দুই কথায় অবাক করেও দেওয়া যেত। তাতে একসময় হয়তোবা পটানোও যেত।
গতকাল বন্ধু তাহরিমের সাথে রাষ্ট্র সমর্থিত ডিজিটাল সার্ভেইলেন্স নিয়ে কথা হচ্ছিল। আলোচনা নিজের দেশের সরকার, আমেরিকা, চীনের টেকনোলোজি হয়ে বেন্থাম পর্যন্ত পৌঁছায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। প্যানপটিকনের প্রয়োগ এই যুগে কোন মাত্রা পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম তা ভাবতে গিয়ে ঘাড়ের পিছনে শিরশির করে উঠল। তারমানে আমি কার কার সাথে প্রেম করতে গেলাম তাও চাইলে জানা যাবে এখন! রে চার্লস এই সময়ে থাকলে কী করতেন?
কয়েকটা বই জমে আছে। পড়ে ফেলতে হবে। সবকয়টা থেকেই একটু একটু করে পড়া হয়েছে। একটু পড়লেই লেখার আলোচ্য বিষয় নিয়েই চিন্তায় মশগুল হয়ে যাই। এরপর চিন্তার সূতাটা আলগা হতেই থাকে। সেই আলগা সূতা আরেক বইয়ের আলোচ্য বিষয়তে গিয়ে গিট্টু লাগায়। এরমধ্যে বারান্দায় গিয়ে একটু দাঁড়ালে গিট্টুটা খোলা যায় মাঝেমাঝে। তবে সাহিত্য নিয়ে লেগে থাকা যায়। লেখা নিজেই একাধারে বনে, নদীতে, মরুভূমিতে দৌড়ায়। রাশে হাত দিয়ে রাখলেই হল, দিকনির্দেশনা দিতে হয়না।
তবে রে চার্লসের মতন হোক আর রহিম-রুপবানের মতনই হোক, প্রেম আমাকে নাকি একটা করতেই হবে। এতে চিন্তায় না হলেও জীবনে নাকি স্থিতি আসে।
পাশের বাড়ির তিনতলাতেই একটা মেয়ে থাকে। কয়েকমাস ধরে থাকছে। বয়স ২২-২৩ হবে। সুন্দর। আবার নরম-সরমও মনে হলো। কী জানি বাপু! ডয়েলের মতন ভাবতে পারলে ভাল ছিল। বারান্দায় আসলে যতটুক দেখা যায় অতটুকুতেই অনেক কিছুর ধারণা হতো। তারপর কখনো সামনাসামনি কথা হলে এক-দুই কথায় অবাক করেও দেওয়া যেত। তাতে একসময় হয়তোবা পটানোও যেত।
দাদিকে ছোটবেলায় একবার ডয়েলের বুদ্ধির উদাহরণ দেওয়ার পর দেখলাম উনি তেমন একটা মানেননি সবকিছু। বললেন, “অল্প বয়েসের সন্ন্যাসী, ভাতেরে কয় পেস্যাত”। মহিলা মানুষের চিন্তা বোঝা কঠিন।
আরে ওইতো, আবার আসলো মনে হয় বারান্দায়। উৎসুক হয়ে জানালার দিকে হাঁটা দেওয়ার আগেই এইদিকে একনজর দেখে ভেতরে চলে গেল।
![](https://protipokkho.com/wp-content/uploads/2021/11/rsz_1young-woman-on-balcony-hunt-web.jpg)
এই যাহ! কথায় কথায় বুয়ার কথা মনে পড়লো। কেন, তা বুঝলাম না। আজকে বুয়া আসবেননা। কয়টা প্লেট ধোয়ার আছে। সিংকটা রান্নাঘরের জানালার সাথেই। জানালার ওপারেই ওই বাসার জানালা। সবসময় পর্দা দেয়া থাকে। ঠাকুরমশাই কী যেন বলতেন? ও হ্যাঁ, ‘সোমত্থ মেয়েছেলে’। ঘরে সোমত্থ মেয়েছেলে থাকলে বাপ-মায়ের এইভাবে পর্দা টেনে রাখাই স্বাভাবিক।
একটা প্লেট আর স্টাইরিনের আই অ্যাম ক্লিশে তিন লাইন যাওয়ার পরেই দেখি পর্দা নেই, কন্যা গ্রিলে হাত দিয়ে দাঁড়ানো। তাকানো তো মনে হয় এদিকেই। একবার দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। ওপাশ থেকে আওয়াজ আসলো,
– বাসার বুয়া কোথায় আজকে?
– জ্বি?
– নরমালি তো বুয়াকে দেখি কাজ করতে। আজকে আসেনি? (বাহ, বাসার বুয়ার খবরও রাখে। ডয়েলও তো ঠিক এভাবেই লক্ষ্য করতেন!)
– নাহ।… আপনার বাসায় কেউ নেই মনে হচ্ছে? (এটা কোন প্রশ্ন?!)
– দাওয়াতে গেছে সবাই।
– ও আচ্ছা।
– আমার হাজব্যান্ড আপনার মতো মাঝেমাঝে কাজ করলে ভাল হতো।
– আমার হাজব্যান্ড দরকারের সময়ও কাজ করতে চায় না। মাঝেমাঝে আপনার মতো কাজ করলে ভাল হতো।
রান্নাঘরের জানালাটা টেনে দিলাম। চেষ্টা করলেও দিনে সূর্যের উজ্জ্বলতার কারণে নাকি খালি চোখে তারা দেখা যায় না।
ঢাকা, ৬ই সেপ্টেম্বর ২০২১
Courtesy: Page Waterman
হোসাইন মোহাম্মদ ওমর খৈয়াম
![](https://protipokkho.com/wp-content/uploads/2021/11/omor.jpg)
ডাকনাম তামিম। কবি এবং অনুবাদক হলেও মাঝে মাঝে ছোটগল্প লেখেন। পেশায় গবেষক; বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন। জন্ম ঢাকায় হলেও নিজের পরিচয়ের ক্ষেত্রে পিত্রালয় পটুয়াখালীকে প্রাধান্য দেন। সমাজ, মানুষ, আর রাজনীতি নিয়ে ভাবেন আর লেখেন, কিন্তু নিজেকে সকল বিষয়ের একনিষ্ঠ অমনোযোগী ছাত্র ভাবতেই বেশি পছন্দ করেন।