মাধবীর বাড়ি ফেরা

ছোটগল্প

।। ক্যামেলিয়া আলম ।।

এক ছেলে রিক্সার হ্যান্ডেলে হাত দেয়। বাকিদের জ্বলজ্বলে চোখগুলোতে মাধবীর ঘেমে ওঠা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। হাতড়ে বেড়াতে থাকে মন, কী করা যায়? কীভাবে ঠেকানো যায়? কেবল একটাই কাজ, এদের কালক্ষেপণ করানো। ছয়টা দানবীয় মুখের মাঝে মাধবীর চোখ হাতড়ে বেড়াতে থাকে একটা মানুষের মুখ…

অলঙ্করণ: বৈশালী

১.

থিয়েটার থেকে ফিরতে আজ বাড়াবাড়ি রকমের রাত হয়ে গেল। দুশ্চিন্তা হচ্ছে বাড়ি ফিরতে। সিঙ্গেল থাকে বলে ফ্ল্যাটের নিয়ম কানুনের বাড়তি চাপ থাকে মাধবীর মাথায়। নারী হবার কারণে নজরবন্দীও বেশি। আরেক বিরক্তিও মাথার মাঝে ঘুরপাক খেতে থাকে। রাত হলেই থিয়েটারের কোনো না কোনো ছেলেকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফেরা। আজ ফিরছে মনা ভাইয়ের সাথে। বিশালদেহী মনা ভাইকে মাধবীর বিরক্ত লাগে বরাবরই। মাধবীর একার জীবন, একা চলবার সাহস নিয়ে সুযোগ পেলেই রসাল মন্তব্য করে বসে।

‘‘কিরে, তসলিমার চামচা, রাত হইলেই তোমগো নারীবাদ কই যায়?’’

আজ তারই সাথে ফেরার তাড়া। কিছুই করার নাই, কারণ মনা ভাইয়ের বাসাই একমাত্র মাধবীর বাসার কাছাকাছি। এক রিক্সায় মাধবী আর মনা চুপচাপ ফিরছে। ভাঙা গলায় মনা ভাই গান ধরল, ‘মন মাঝি খবরদার, আমার তরী যেন ডোবে না, আমার নৌকা যেন ভেড়ে না…’। মাধবী ডুবে গেল ভিন্ন ভাবনায়। সেতুর সঙ্গে অল্প কিছুদিন হলো সম্পর্ক হয়েছে। প্রেমের শুরুটা বরাবরই এত চমৎকার থাকে! রোজ সেতু কলেজ গেটটায় এসে যখন দাঁড়ায়, মাধবীর সারা-সময়ের ক্লান্তি নিমেষে উবে যায়। মাধবী ইডেনে বাংলায় পড়ে। সেতু চাকরি করে এক এনজিওতে। সেতু যে প্রাণ থেকে ভালোবাসে তা মাধবী বেশ টের পায়। ওর পড়া, থিয়েটার, টিউশনি, রাত করে ফেরা… সবেতেই সেতুর সমর্থন আর প্রশংসা মাধবীর রুক্ষ জীবনের ঝরণাধারা। বাবা তিনবোন রেখে ছোট বেলায় অন্য সংসার বেঁধেছে। মায়ের সাথে ওদের তিন বোনের প্রতিদিনের সংগ্রাম মাধবীকে পুরোই থমকে দিত যদি সেতুর সঙ্গে ওর প্রেম না হতো! এমন সময়ই হুট করে রিক্সা থামলো। চমকে ওঠা মাধবী দেখে মনা ভাই রিক্সায় পাশে নাই। দ্রুত পেছন ফিরে দেখে সংসদ ভবন এলাকার এক অন্ধকার পার্কের দিকে যাচ্ছে।
‘‘মনা ভাই, কই যান?’’
‘‘খাড়াও আইতেছি’’ বলেই পার্কের অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
ভয়ঙ্কর বিরক্তি নিয়ে মুখ ঘোরাতেই রিক্সাওয়ালা ‘আফা, একটু বহেন’ বলেই চলে যায় একটু দূরের গাছের আড়ালে প্রকৃতির ডাকে।
চরম বিরক্তি নিয়ে সোজা হয়ে বসতেই দেখে ৫/৬টা ছেলে গল্প করতে করতে আসছে। যদিও তারা এখনও মাধবীর অস্তিত্ব টের পায় নি। কিন্তু কতক্ষণ আস্ত এক অবয়ব না দেখে চলবে? মাধবীর বুক ঢিবঢিব করতে থাকে। রিক্সার হুড তুলবে? নাহ! যদি অন্যরকম ভাবে? হয়তো গল্প করতে করতে পাশ দিয়ে চলে যাবে। ভয় পাওয়ার কিছুই নাই। মানুষই তো! পেছন ঘুরে মনা ভাইকে খুঁজতে থাকে চোখ, ঠিক তখনই শোনে,
‘‘ওই দ্যাখ, একটা মাল’’
‘‘আরে, খাসা তো!’’
রিক্সার খুব কাছে আসতে আসতেই মাধবীর চোখ শেষ চেষ্টার মতো রাস্তায় টহলদার কোন পুলিশ খুঁজে বেড়ায়।
নাহ, কোথাও কেউ নাই। সামনে সত্যিই দাঁড়ানো ছয় ছয়টা ছেলে। যাদের কাছ থেকে মদের ঝাঁঝালো গন্ধটা নাকে এসে বাড়ি দিচ্ছে।
এক ছেলে রিক্সার হ্যান্ডেলে হাত দেয়। বাকিদের জ্বলজ্বলে চোখগুলোতে মাধবীর ঘেমে ওঠা শরীর কাটা দিয়ে ওঠে। হাতড়ে বেড়াতে থাকে মন, কী করা যায়? কীভাবে ঠেকানো যায়? কেবল একটাই কাজ, এদের কালক্ষেপণ করানো। ছয়টা দানবীয় মুখের মাঝে মাধবীর চোখ হাতড়ে বেড়াতে থাকে একটা মানুষের মুখ। ওদের ঠিক পেছনেই খাটো মতো এক ছেলের নরম চোখে মাধবীর চোখ আটকে যায়।
‘‘ভাইয়া, আপনি এতো রাতে এখানে? কেমন আছেন? কতদিন পরে আপনাকে দেখলাম? আমায় মনে নাই? আমি আপনার বোনের বান্ধবী, মাধবী। আপনার বাসায় মাঝেমাঝেই আসতাম। আপনি যে কী লাজুক ছিলেন!’’ বলে নিজের অভিনয়ের হাসিটা নিজের কানেই বেখাপ্পা লাগে।
ছেলেগুলোর মাঝে ইতস্ততা টের পায়। ওদের চাহণি এবার সেই ছেলের দিকে। সে কিছুটা অপ্রস্তুত।
‘‘ঠিক , চিনতে পারছি না…’’
কথা কেড়ে নিয়ে মাধবী বলতে থাকে, ‘‘আরে ভাইয়া, চিনবেন কী করে? আপনি তো মুখই তুলে তাকাতেন না আমাদের দিকে’’। আবারও মাধবীর বেখাপ্পা হাসিতে নিশুত-নৈঃশব্দ ছমছম করে বেজে ওঠে। ‘‘তা ভাইয়া, এ দিকটায় কী করছেন এত রাতে? এরা আপনার বন্ধু? জানেন তো আমি থিয়েটারে কাজ করি। রিহার্সাল শেষ হতে হতে এত রাত হয়ে যায় যে কী বলবো আর! আপনারা নাটক দেখেন? মহিলা সমিতিতে এই দশ তারিখে আমাদের শো আছে। চলে এসেন। দাওয়াত দিয়ে রাখলাম আগে-ভাগেই। ওহ ভালো কথা, ভাইয়া, আপনার মা কেমন আছে? কী যে মজার রান্না করতোন! বিশেষ করে, শুটকি মাছ। এখনও মুখে লেগে আছে, জানেন? আজই গিয়ে বলবেন, মাধবীর সাথে দেখা হয়েছে। দেখবেন কী বলেন! কী ভালোই না বাসতেন’’।
এর মাঝে অস্থিরতা টের পায় ছেলেগুলোর মাঝে।
‘‘চিনস তুই?’’ এক ছেলে প্রশ্ন করে।
আরেক ছেলে, ‘‘বইনের বান্ধবী তো হইছে কী?’’
‘‘আরে নাহ, পরে ফ্যাসাদে পইড়া যামু’’ টুকরো কথাগুলো কানে ভেসে আসতে থাকে মাধবীর। দেখতে পায়, খাটো ছেলেটার ইতস্তত চাহনি। মাধবী আড়চোখে আরেকবার বোঝার চেষ্টা করে মনা ভাই ঠিক কোথায় আছে এখন? এর মাঝে রিক্সাওয়ালা এসে দাঁড়িয়েছে ওদের পেছনে। শীর্ণ দেহটায় কোনোই ভরসা নাই। এরা রিক্সা থেকে এই লোককে সরে যেতে বললে এখনই তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। মাধবী ভাবতে থাকে আর কী বলা যায়! বেশি বললে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনাও আছে। অচেনা মানুষ নিয়ে কতো আর গল্প বানানো যায়। ওদের পারস্পরিক চোখাচোখি হয়ে একজনের এগিয়ে আসার মাঝেই কাঙ্খিত গলা টের পায় মাধবী।

‘‘ওই কেডারে..’’

ছেলেগুলোর চমকে ওঠে। রিক্সার অপর প্রান্তে মনার শরীরটা দেখে।
‘‘মাধবী, ঠিক আছো?’’
বিশালদেহী মনাভাইয়ের বজ্রকন্ঠ ওদের দ্রুত রিক্সা থেকে সরিয়ে নেয়। মাধবী হাসি মুখ রেখেই বলে, ‘‘ওকে ভাইয়া, দেখা হবে, খালাম্মাকে অবশ্যই বলেন, আমি আসবো কয়েকদিনের মাঝেই’’। ছেলেগুলো খুব দ্রুত সরে যায় রিক্সা থেকে।

মনা লাফ দিয়ে রিক্সায় ওঠে। গাঁজার গন্ধ ভুড়ভুড় করছে মুখে। মাধবীর চোখে পানি এসে যায়, ‘‘উফ, মনা ভাই, আপনি এভাবে একা রেখে যেতে পারলেন?’’
মনার লাল চোখে অবাক চাহনি। ‘‘ওরা কিছু কইছে তোমারে? তোমার চোখে পানি ক্যান? ওই রিক্সা থামা তো..’’

এই কথা লাফিয়ে নামতে চাওয়া মনার হাত তড়িৎ গতিতে আঁকড়ে ধরে মাধবী। ‘‘না , মনা ভাই, না, আমার কিছু হয় নাই। ওরা আমার বান্ধবীর ভাই। আপনি বসেন তো!’’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে মাধবীর। কেবল আকাশের ওই শূন্যতায় নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে জলে ভেসে যাওয়া চোখগুলো।

‘‘ও , এইটা কও…’’ বলে গলাখাঁকারি দিয়ে ফুরফুরে মেজাজে উদাত্তকন্ঠে আরেকখান গান শুরু করে, ‘মনে বাবলা পাতার কষ লেগেছে, ধুইলে যায় না সাবানে, গুরু আমার মনের ময়লা যাবে ক্যামনে? ও গুরু, মনের ময়লা, যাবে ক্যামনে?’ গাঁজার সম্মোহনে আবেগ যেন ঝরে পড়ে মনার কন্ঠে। ভীষণ মিষ্টি শোনায়! ধোঁয়াচ্ছন্ন মাথায় মনা ভাবতেও পারে না, ছয়জনের সাথে কখনই একলা পারা যায় না!

রিক্সার প্যাডেলের শব্দ আর জমাট অন্ধকারে ভেসে আসা বাতাস মাধবীকে বলতে থাকে কেবল-

‘গুরু আমার মনের ময়লা যাবে ক্যামনে?’

২.

তেতো হওয়া জীবন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে। জীবন বড় সুন্দর! বারেবারে বিশ্বাস করতে চেষ্টা করে মাধবী। কিন্তু জীবন হয়তো সেজন্যই অট্টহাসি হেসে যাপিত জীবনের গুটিগুলো নিয়ে ফেলে দেয় সাপের মুখে।

রিহার্সালের শেষ কয়টা দিন সিদ্ধান্ত নেয় বাড়ি না ফেরার। প্রিয়া আপাকে বলে কয়ে তার বাড়িতেই কাটিয়ে দেয়। প্রতিটি বিবর্ণ দিন শেষে সামান্য রোদ্দুর যেমন বিদ্যুৎ চমকায়, মাধবীর চলটে ওঠা জীবনে সেতু ঠিক তেমনই। এ শহরে মাধবীর নাটক বারেবারে দেখতে আসে শুধুমাত্র সেতু। শো শেষে চাঁদের আলোটুকু শহরের এত আলোর মাঝেও ঠিক ঠিক চোখে পড়ে সেতুকে নিয়ে রিক্সায় করে যখন বাসায় ফেরে। সারাটা দিন- সারাটা রাত নিজেকে নিজে চালাতে চালাতে ক্লান্ত শরীর সেতুর কাঁধে ভর দিয়ে দমটুকু যখন ছাড়ে, নিজেকে মনে হয় গ্রাম্য কোন সরলা কৃষাণ বধু, যার মুখে সুখের হাসি লেপটে থাকে নিজ জীবনের ভার কৃষাণের হাতে তুলে দিয়ে। পরজীবী হবার মাঝেই জীবন যেন পায় স্বার্থকতা।

এর মাঝে ডাক পড়ে মাধবীর বড় পা’র বাসায়। দ্ইু ছেলে মেয়ে নিয়ে বড় পা’র সমৃদ্ধির ঘর। দুলাভাই ব্যবসায়ী হওয়াতে চারপাশে জমকের ছড়াছড়ি। দমবন্ধ হওয়া বাড়িতে মাধবীর যেতে হয় নিতান্ত প্রয়োজনে। বড় পা’র মেয়ে অনিন্দিতার ভীষণ জ্বর। ছেলেটা মাত্র এক বছরের। সংসার সামলাতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে আপাকে। আর আরেক বিষয়ও আছে, এই দুলাভাই ই মাধবীদের সংসারে হাতখরচ দেয় আর ওর পড়ার খরচও যোগায়। অগত্যা ধানমন্ডির বিশাল এপার্টমেন্টে বেশ কয়টা দিন থাকার প্রিপারেশন নিয়েই আসা হয় তার।

মাধবীকে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাসটুকু ছাড়ে সুরভি। দুই বাচ্চা নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে চোখের কোণে কালি দেখে আঁতকে ওঠে মাধবী। নিজেকে বড় স্বার্থপর মনে হয়। আপাটার কোনো খোজঁই নেয় না সারাটা মাস। কেবল মাসের শুরুতে একরাশ লজ্জা নিয়ে টাকাগুলো নিতে আসে, তখনই কেবল কিছু শব্দ বিনিময় হয় দুই বোনের। টেবিল ভর্তি খাবার কোনরকম খেয়ে মাধবীর ইতস্তত শরীর এরপরই দ্রুত বেরিয়ে যায়। আপাও কখনো বাধা দেয় না। ফাঁকা হওয়া মনের শ্বাস নেওয়া মাধবী ঘরগুলোয় চোখ বুলায়। আপার বাসায় সবই বিশাল। হাতিলের বড় খাট, উঁচু দেয়ালের মাথা ছোঁয়া আলমারি, ক্রিস্টালের চকচকে ড্রইংরুম, চমৎকার রঙিন খাবারে ঠাসা দুই কপাটের ফ্রিজ, রান্নাঘর ছাড়া বাকি ঘরগুলোয় শীতের আমেজ- এই তীব্র গরমেও খাটগুলোয় কম্বল তাই যত্নে রাখা। কেবল এই বিশাল বাড়িতে বাচ্চাদের পড়ার বই, দৈনিক পত্রিকা, খুচরো কিছু প্রসাধনী ও বিনোদন ম্যাগাজিন ছাড়া ছাপা অক্ষরের কিছুই নাই।

মাধবী এসেই কাজে নেমে পড়ে। অনিন্দিতা আর রাজনকে নিজের কাছে নিয়ে আপাকে প্রথমেই ঘুমাতে পাঠায়। রাজনকে নাওয়ানো, খাওয়ানো, অনিন্দিতার মাথায় পানি ঢেলে গা মুছিয়ে জোর করে স্যুপটুকু খাইয়ে খাটের এক পাশে শুয়ে শুয়ে গল্প শোনাতে থাকে। আপার পরিশ্রান্ত মুখটি হাঁ হয়ে আছে। একটু পরপর ছোট ছোট শ্বাস নেওয়া বুকটি দ্রুত ওঠা নামা করছে গভীর ঘুমে। দেখে বড় মায়া হয় মাধবীর। একসময় দুলাভাই ফিরে আসে। মাধবীকে দেখেই হইচই করে আনন্দ প্রকাশ করে। চমৎকার এক আড্ডা হয় খাবার টেবিলে। গেস্ট-রুমটি বেশ দূরে বেডরুম ছেড়ে, তবু মাধবী বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। রুমের দরজা বন্ধ করে স্বস্তির এক নিশ্বাস ফেলে মনে পড়ে সেতুর কথা। ভাবতে থাকে, দিনকয়েক কলেজ যাবে না, তাই রোদ্দুরটুকুর সাথেও দেখা হবে না। কেমন যেন উতলা লাগে! পাগলের মতোন ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে হয় এ বাড়ি ছেড়ে। কিন্তু জীবন যে বড় হিসেবের।

পরদিন অনিন্দিতার রিপোর্ট আসে বাসায়। টাইফয়েড। রোগের চাইতেও মিজান চৌধুরীর কাছে যা বড় হয়ে দাঁড়ায়, তা মা হিসেবে সুরভির ব্যর্থতা। রাতে থমথমে খাবার টেবিলে সবাই। মাধবী হালকা করতে বলতে শুরু করে,
‘‘রোগ ডায়াগনসিস করা গেছে, সেটাই জরুরি। এখন কেয়ারফুল থেকে চিকিৎসা চালালেই ঠিক হয়ে যাবে।’’
সুরভি আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করে, ‘‘এতো সাবধানে চলি, এরপরেও কী করে যে হলো? বুঝলাম না…’’
মিজান সশব্দে ফেটে পড়ে, ‘‘ওই মাথারি, কী রোগ হইছে বুঝছস? বুঝছস কিছু? গু পেটে গেলে এইসব রোগ হয়। … হাত ধোস না!’’
সুরভি থামাতে চেষ্টা করে, ‘‘কী বলো এসব! আমি …’’
ঝনঝন শব্দে টেবিলের থালা মাটিতে ভাঙে। ‘‘…,ফকিরের গুষ্টি, সারামাস গিলস আর চৌদ্দ পুরুষ গিলাস, সার্ভিস দিতে ভুল ক্যান হয়!’’
মাধবীর মাথা ভনভন করতে থাকে। কোনো রকম উঠে দাঁড়ায়। দ্রুত নিজ রুমে যায়। চিৎকার আর ভাঙাচোরার শব্দে মাথার ভেতর কেমন শূন্য লাগে। সদ্য এনেসথিয়ায় চারপাশের শব্দ আর আলো যেমন কমে আসে কিছুক্ষণের মাঝে, তেমন এক স্তব্ধতা বিরাজ করে ব্রেইন সেলগুলোয়।

সেই রাতে অনিন্দিতার জ্বর হুট করে বেড়ে যায়! মাঝরাতে আধো-জাগরণ আর আধো ঘুমের মাঝে দরজায় জোড়ে ধাক্কার শব্দে ধড়মড়িয়ে জাগে মাধবী। দরজায় সুরভির চেহারা আলুথালু, ‘‘অনিন্দিতা মরে যাচ্ছে মাধবী, মরে যাচ্ছে !’’…
এক ছুটে অনিন্দিতার সামনে গেলে দেখতে পায় গাঢ় লাল চোখ, শরীর প্রায় বাঁকা। মাধবী হ্যাঁচকা টানে অনিন্দিতাকে নিয়ে বাথরুমে যায়। কল ছেড়ে পানি দিতে থাকে।
‘‘আপা, সাপোজিটরি আন, ডিপে রাখা…’’
প্রায় আড়াইটার দিকে জ্বর ১০২-এ নেমে আসে। সুরভি মাথার কাছে ঠায় বসা। মাধবী পায়ের কাছে। প্রবল শারীরিক মানসিক চাপে দুজনেরই চোখ লেগে আসে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলো জানেনা, আচমকা ঘুম ভাঙে মাধবীর। প্রথমটায় মনে হয় কী যেন চেপে বসেছে গায়ের উপর। তন্দ্রা কাটতেই টের পায় বুকের আনাচে কানাচে শক্ত এক হাত হাতড়ে বেড়াচ্ছে। প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে শরীর। চেপে বসা হাত ধাক্কা দিয়ে সরাতে না পারলে চিৎকার বেরিয়ে আসে মাধবীর মুখ থেকে। আলোকজ্জ্বল ঘরে সুরভির অবাক চাহনি! দেখতে পায় কেবল মাধবীর জামার তলায় মিজানের হাত!
মাধবী এক ঝটকায় উঠে পড়ে হতভম্ব মুখে !

‘‘ছিঃ! এত জঘন্য আপনি! আপনার মেয়ের এই অবস্থা!
‘‘এই চুপ, চুপ বেশ্যা কোথাকার! নাটক কইরা এখন আমার জামাইর উপরে দোষ?’’
চমকে মাধবী তাকায় সুরভির দিকে।
‘‘বাইর হ, বাইর হ, আমার বাড়ি থেকে, প্রথমদিন থেকেই দেখছি , ক্যামনে আমার জামাইরে উসকাইছস! খালি পিরিতের আলাপ, হাসাহাসি, আজ নিজ চোখের সামনে দেখলাম!’’
‘‘আপা, তুই কী বলিস? কী বলিস? তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?’’
‘‘এখনই বাইর হোবি।’’

হাত ধরে এক টানে বিছানা থেকে মাধবীকে মাটিতে ফেলে দেয়! দুই বোনের ক্যাচালে না থাকাই শ্রেয় মনে করে মিজান। নিঃশব্দে ঘর ছাড়ে।

রাত্রি তিনটায় মাধবীকে পথে নামতে হয়! চারপাশ জমাট অন্ধকার। কোথাও কেউ নাই। শুধু ভাবে, বাড়ি ফিরতে হবে এবার।

৩.

মধ্যবিত্ত না সাবঅলটার্ন জানে না মাধবী। এ ঘটনার পরে কেবল বোঝে, নিজের খরচ নিজে যোগাড় করতে হবে, করতেই হবে। পাশ করবার আগেই হুট করে সুযোগ পেয়ে যায়। কাজ নেয় এক এনজিওতে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঢাকার বাইরে প্রচুর সময় দিতে হয়। মাধবীর এক্টিভিটি খুব দ্রুতই তাকে নিয়ে যায় সাফল্যের দরজায়। ইতিমধ্যে অনার্স পাশও করে। গ্রাজুয়েট থাকায় আর কাজের সাবলীলতায় মাধবীর পজিশন বাড়তে থাকে। কাজের শুরুতে সেতু বারেবারে বাঁধা দিয়েছিলো। চেয়েছিল, মাধবী মাস্টার্স শেষ করুক আগে। বিয়ের পর কোন কলেজ বা স্কুলে মাস্টারি করলে দিব্যি চলে যাবে সংসার। আর এই কয়দিন সেতুই তাকে হাতখরচ দেবে। মাধবী কিছুতেই রাজী হলো না। পরনির্ভরশীলতার অসম্মান ওকে পাল্টে দিয়েছে ভীষণ। খুব আনমনা থাকে। সারাক্ষণই ক্যারিয়ার আর পয়সার চিন্তা। সেতুর সঙ্গেও প্রায়শই রাগারাগি হতে থাকল।

মাধবীর উপর সেতুর এই বিরক্ত ভাব মাধবীর চোখে পড়লো বেশ পরেই। মাধবী ধরেই নিয়েছিলো, সেতু ওকে ভীষণ বোঝে। ওর সম্মানবোধকে ঠিকই শ্রদ্ধা করবে, ওর ক্যারিয়ারিস্ট হবার স্বপ্নে সেতু থাকবে বরাবরের মতোই উচ্ছ্বল। কিন্তু প্রথম ধাক্কাটা খেলো যেদিন মাধবী প্রমোশন পেল প্রোগ্রাম চিফ হিসেবে।

সেতুর অফিসের ফোন বেজে উঠলো। মাধবীর ফোন, উচ্ছ্বসিত গলা।
‘‘সেতু, আমি প্রোগ্রাম চিফ এখন, বেতন ৫০০০ টাকা বাড়লো।’’
ওইপাশ থেকে সেতুর ঠাণ্ডা কন্ঠস্বর, ‘‘আমি তোমায় বহুদিন বলেছি, কাজের সময় অফিসে ফোন দেবেনা।’’
‘‘আমি জানাবো না তোমায় আমার এতো বড় সুখবর!’’
‘‘ওকে কনগ্রেচুলেশনস!’’

ফোন ছাড়ার শব্দে মাধবী থমকে যায়। ধীর হাতে ফোন রাখে। ভাবতে থাকে বিষয়টি নিয়ে। ‘‘এ সেই সেতু! যার কাছে গেলেই প্রজাপতির জীবন ছেড়ে গুটিপোকার জীবন হবার সাধ জাগতো!’’

মাধবীর ব্যস্ততা বেড়ে যেতে থাকে। বাড়তে থাকে সেতুর সাথে দূরত্বও। অফিস থেকে প্রতিদিনই ফোন করত, দুইটা কথা বলতে না বলতেই সেতুর বিরক্তিতে ফোন রেখে দেওয়ায় একদিন হাজির হয় সেতুর অফিসে।
বহুদিন পরে দুইজন আবার আগের মতো গল্প , আড্ডায় মাতে। জীবন বড় সুন্দর , কথাটা আবার মনে হয় মাধবীর। সেই দিনই হুট করে সেতু প্রপোজ করে বিয়ের। এতো দিনের চেনায়ও মাধবীর মুখ লাল হয়, ভালো লাগার ঘাম জমে মুখটায়। সেতু মুগ্ধ হয়ে তাঁকিয়ে থাকে মাধবীর দিকে। কিছুক্ষণের মাঝেই দুইজনের প্রবল হাসি, বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা, কল্পনার ঘর সাজানো নিয়ে কথা বলতে বলতে সেতু থামায় মাধবীকে।
‘‘এই, সবই যখন কল্পনা করছিস, বাসর রাতের কল্পনাটাও সাজা তো! কী কী করবি, বলতো?’’
দুইজনের উচ্চকিত হাসিতে পথ চলতি মানুষগুলো ঘুরে তাঁকায়। ওদের বেপরোয়া হাসি তবু থামে না।

দুইজনের পরিবারেই জানানো হয়। পরিবারে বাধা তেমন নাই। মাস ছয়েক পরে বিয়ের সম্ভাব্য দিনক্ষণও ঠিক হয়। এর মাঝে মাধবীর এক চিঠি আসে লন্ডন থেকে। সাইকো ড্রামার উপর মাস্টার্সের জন্য এপ্লাই করেছিল, সেখানে মাধবীর চিঠি গ্রানটেড হয়েছে। অগাস্ট সেশন থেকে কোর্স শুরু। তবে এর আগে যোগাড় করতে হবে লাখ পাঁচেক টাকা।

অফিস করেসপনডেন্টকে জানায় বিষয়টি। টাকা সংগ্রহের জন্য ফান্ডিং এর যে ব্যবস্থা আছে, তা থেকে কিভাবে কী জোগাড় করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ নিতে গেলে উল্টো চিত্র পায়। তাদের নানা ভাসা ভাসা কথায় টের পায় ওদের আসল বক্তব্য, মাধবী এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, তার গিয়ে বিদেশি ডিগ্রী কেন নিতে হবে? বিষয়গুলো অবাক করে মাধবীকে।
‘‘আপনারা না নারী উন্নয়নের কথা বলেন! নারীদের জন্য কাজ করেন? আমি আপনাদের অফিসেরই এক সিনসিয়ার কর্মী। আমি উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবো না?’’
‘‘উচ্চশিক্ষা নিয়ে তুমি কী আর দেশের জন্য কাজ করবে? বিদেশে পাততাড়ি গুটাবা।’’
‘‘তাই বলে, এক লিগ্যাল সুযোগ আমি পাবো না?’’

মর্জিনা আপার আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে খুঁজতে থাকে পথ। সেতুর কাছে আনন্দের খবর বলার চাইতে দুশ্চিন্তার কথাটি বলতে গিয়ে আরেকবার হোঁচট খায়।

— এর মানে, তুমি বিদেশ যেতে চাইছো?
— চাইছি মানে? যাবো না? ১৩০ জনের মাঝে যে দুইজন সিলেক্টেড হয়েছে অফিস থেকে এর মাঝে আমি একজন। আরেকজন মর্জিনা আপার মেয়ে।
— বিয়ের কী হবে?
— বিয়ে করেই যাবো।
— আগস্টে গেলে বিয়ে করবে কী করে? ডিসেম্বরে বিয়ের দিন ঠিক করলাম না? ফ্যামিলিতে তো তা ই জানানো হলো।
— আমরা কি পর, সেতু? আপাতত কোর্ট ম্যারেজ করে রাখবো। ফিরে এসে প্রোগ্রাম করব।

সেতু কিছুই বলে না। চুপ হয়ে যায়। বিদায়ের সময় মাধবীর সেদিন কী কারণে যেন অশান্ত হয় মন! এর কারণ কী? সেতুর থেকে এভাবে বিদায় তো প্রায়ই নেয়। আজ কেন এত খারাপ লাগছে?

ফান্ডিং এর টাকা যোগাড় করার অসাধ্য কাজটা মাধবী যেদিন করতে পারে, নিজের ভাগ্যকেই নিজের কাছে অবিশ্বাস্য লাগে। হুট করে মনে হয় মাসখানেক সেতুর সাথে দেখা হয় না। ফোন করলে জানে সেতু অসুস্থ, ছুটিতে আছে। সেতুর বাসা চেনে। দ্রুত যায়। দরজা খোলে সেতুর মা। অন্যদিনের মতোন জড়িয়ে না ধরে কেমন যেন আড়ষ্ট দেখায় তাকে।

‘‘সেতু কই ঘরে?’’

এর আগেও কয়েকবার এসেছে। সেতুর ঘরটা বেশ চেনে। কোনো জড়তা না করে সেতুর মা বাধা দেবার আগেই ঘরটার কাছে যায়। পর্দা সরিয়েই ধাক্কা খায়। মিলা, সেতুর কাজিন, সেতুর মাথায় পানিপট্টি দিচ্ছে। মাধবী থমকে গিয়েও জোড় করে হেসে সেতুর পাশে গিয়ে বসে। সেতু অপ্রস্তুত। মিলার মুখ শক্ত।

— জ্বর কবে থেকে?
— এই তো দিন দুয়েক
— ও আচ্ছা’

তিনজনেই হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। পরিবেশটা কেমন যেন জগদ্বলের পাথর চাপার মতো গুমোট হয়ে থাকে! গলাখাঁকারি দিয়ে সেতু বলে, ‘‘তা টাকার জোগাড় করতে পারলে?’’
‘‘হ্যাঁ’’
সেতুর জ্বলে ওঠা চোখ শান্ত হয়ে বলে,
‘‘বাহ, বেশ ভালো, তা কবে যাচ্ছো, ঠিক করেছো?’’
‘‘হুম জুলাই এর ২৮ এ বিমানের টিকেট পেয়েছি। এখনও কাটিনি। কাল পরশুর মাঝে কাটবো।’’
এই কথা বলে চুপ থেকে ফের বলে, ‘‘সেতু, আমি পার্সোনালি তোমার সাথে কথা বলতে চাই’।’’
সেতু মিলার দিকে তাকালে, নিঃশব্দে বেরিয়ে যায় সে।


— বিয়ে কবে করছি, সেতু? সামনের সপ্তাহে?
— আরে এতো হুলুস্থূলের কিছু নাই, ফিরে এসো আগে। আর বিয়েতে পরিবারের দোয়ার বিষয়ও তো আছে। হুট করে কোর্ট ম্যারেজ করলে তারা কষ্ট পাবে!
— তাহলে ঘরোয়া প্রোগ্রাম করি, তোমার বাসাতেই বিয়ে হোক।
— মাধবী, আমি বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। তাদের একটা সম্মান আছে। মেয়ে এসে ছেলের বাড়িতে বিয়ে করছে, এতে তাদের সম্মান নষ্ট হবে না?’
— ওকে, আপার বাসায় এ্যারেঞ্জ করি।
— মাধবী, আমার ফ্যামিলির কালচার তোমার মতোন আধুনিক না। বিয়ের দশদিনের মাথাতেই বর ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেবার বিষয়টি কেউ ভালোভাবে নেবে না। আমরা তো ছন্নছাড়া না। আমাদের ফ্যামিলি বিশাল। সবাইকে নিয়েই তো আমাদের চলতে হয়।

মাধবীর মনে হতে থাকে পায়ের নীচের মেঝে ওকে টেনে ধরেছে। সব কেমন ফাঁকা লাগছে। এই সেতু, সেই সেতু? যার বুকে রাতের পর রাত কল্পনায় থেকে নিজের ক্লান্তি ভুলেছে, সামনে এগিয়ে চলার আনন্দ পেয়েছে!

মাধবী ফিরে আসে। অভিমানী হয়ে সেতুর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে। আজীবন অভিমান তো মাধবীই ভাঙাতো! এখন বড় ক্লান্ত লাগে। সব যুদ্ধ কি ওরই ?

লন্ডন যাবার আগের দিন ছটফট করতে থাকে মাধবী। এমন সময় বেশ জোড়ালো শব্দে কলিংবেল বাজে। কুরিয়ারের এক চিঠি। আলতো হাতে খুলতেই ঝলমলে সোনালী ফিঁতা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। সেতুর বিয়ের কার্ড। দশ মিনিট লাগে বুঝতে বিষয়টি।

মাধবীর মনে পড়ে সেতুর কাছ থেকে শোনা এক পুরাকথা। এক কাছিম দিনের পর দিন নিজের আপদ বিপদ দূর করে এক ম্যাজিক লাঠি দিয়ে। একসময় কাছিমের বড় সাধ জাগে ডায়নোসারের মতোন অতিকায় প্রাণী হবার। নানাভাবে চেষ্টা করেও তা হতে পারে না। ঈশ্বরের কাছে আকুল হয়ে জানতে চায়, কী করে নিজের কচ্ছপের জীবনের ইতি ঘটাবে! ঈশ্বর তার ম্যাজিক লাঠি ফেলে দিতে বললে কচ্ছপ সাথে সাথেই হাত থেকে ফেলে দেয় সমুদ্রের অতলে। এক নিমিষে পরিণত হয় বৃহদাকার ডায়নোসারে!

সঙ্গোপনে এক নিঃশ্বাস আটকে মাধবী বিয়ের কার্ডটা টুকরো করে জানালার কাছে যায়। রাস্তার উপর ছুঁড়ে দেয় ছেঁড়া টুকরোগুলো। দাপুটে বাতাসে তা উড়ে উড়ে ছড়িয়ে পড়ে ড্রেনে, রিক্সার চাকায়, ভ্যানের উপর, সাদা গাড়ির উদাম পিঠটায়!

অলঙ্করণ: বৈশালী

লেখক পরিচিতি:

ক্যামেলিয়া আলম

প্রভাষক, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা। গল্পের পাশাপাশি প্রবন্ধ লেখেন। কিছুদিন ‘বার্তা-২৪’-এ ‘নারীশক্তি’ পেজের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। একসময় থিয়েটার সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

Share