আজ সোমবার, ২২শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

কবি ফরহাদ মজহারের মোকাবেলা

শিমুল সালাহ্উদ্দিন

বলতে বলতে প্রায় পাঁচ বছর বেরিয়ে গেল, তরুণ কবি শিমুল সালাহ্উদ্দিন এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন। একটি সাহিত্য পত্রিকায় আংশিক বেরিয়েছিল। এখন পুরোটা শিমুল সালাহ্উদ্দিনের অনুমতি নিয়ে এখানে ছাপা হোল। ওপরের ভুমিকাটুকু শিমুল সালাহ্উদ্দিনের। আশা করি চিন্তার পাঠকদের ভাল লাগবে। [সম্পাদনা পরিষদ]

… … …

কবি ফরহাদ মজহার তাঁর চিন্তা ও কর্মের ভেতর দিয়ে ইতোমধ্যে কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন। ১৯৪৭ সালে নোয়াখালীতে জন্ম নেওয়া এ চিন্তকের যেমন আছে অনুসারীদল তেমনি আছে কট্টর নিন্দুকসমাজ। জীবনযাপন, কাজ, কাব্য, সঙ্গীত, নাটক, চিন্তাভাবনা, কৃষি, শিল্প, প্রকৃতি, ভাবান্দোলন, রাজনীতি সব মিলিয়েই তাঁর পক্ষে-বিপক্ষেও তর্ক, যুক্তি, ভর্ৎসনা চলে চা-খানায় ও অন্তর্জালে। নিজের সব কাজ ছাপিয়ে সত্যিকারের কবিতার পাঠকরা সবসময় উচ্চে তুলে ধরে ফরহাদ মজহারের কবিতাই। এই সাক্ষাৎকারে মূলত কবি ফরহাদ মজহারের মুখোমুখি হয়েছিলেন তরুণ কবি শিমুল সালাহ্উদ্দিন তাঁর কবিতার মোকাবেলা করতে। সাক্ষাৎকারটি প্রথমে মৌখিকভাবে গৃহীত হওয়ার পর কিছু যোজনবিয়োজনের জন্য কবিকে প্রদান করা হয়। সাক্ষাৎকারটি প্রাথমিকভাবে নেওয়া হয়েছিল ফরহাদ মজহারের শ্যামলীর বাসায় ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে। ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১১ সাক্ষাৎকারটি চূড়ান্ত হয় কবির যোজনবিয়োজন ও পূর্ণসম্মতিক্রমে। সাক্ষাৎকারটির একটি অংশ ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল সাহিত্যের মাসিক কাগজ নতুনধারায়।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আমি এর মধ্যেই আপনার লেখা পাঠের মাধ্যমে জেনেছি (মিডিয়া অর্থে, প্রিন্টেড এবং ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে) আপনি অপাঙ্ক্তেয়। কিন্তু আপনার কবিতা বলে অন্য কথা। চা-খানায় আর আপনার বিপরীতে ওঠা স্বরের বাইরে আপনার কবিতা বাংলাসাহিত্যকে দিয়েছে অনির্বচনীয় প্রকাশের এক বাঙ্ময় দ্যুতি। এমন একটি পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমি আপনাকে আবিষ্কার করতে চাই। আপনি কবিতাকে সেই শিউলি কিংবা বকুলশৈশবে প্রথম যেদিন আবিষ্কার করেছিলেন সেদিনের কথা বলুন। কিভাবে আপনি প্রথম কবিতাকে চিনলেন? আপনি কবিতা লিখতে পারেন এই সত্য কবে বিশ্বাস হয়ে উঠল আপনার ভেতরে? প্রথম কবে কবিতা আপনাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল?

ফরহাদ মজহার : আসলে দিনক্ষণ হিসাব করে বলা কি কোনো কবির পক্ষে সম্ভব? কবিতা এমন একটা বিষয়, যা আপনার জীবনে কখন এল তা দাগ দিয়ে শনাক্ত করা মুশকিল। যখন আপনি সবে কথা বলতে শিখছেন তখন একদিকে আপনি বড়দের কাছ থেকে ভাষা শিখছেন, অন্যদিকে নানান বিস্ময়, ইন্দ্রিয়োপলব্ধি, আবেগ, অভিজ্ঞতা ইত্যাদিকে ভাষায় ধরতে গিয়ে নিজেই নিজের ভাষা তৈরি করছেন।

তত্ত্ব দিয়ে বুঝতে চাইলেও সেটা অনায়াসেই বোঝা যায়। যেমন, একদিকে ভাষাটা সামাজিক, অথচ এই সামাজিক সম্পদটা আপনি যখন ব্যবহার করেন তখন আপনি নিজের মতো করেই তো ব্যবহার করেন। তাই না? আর যখনই আপনি তা করতে যাবেন তখনই তার একটা সৃষ্টিশীল ব্যবহারের সম্ভাবনা থেকেই যায়। শিশুদের লক্ষ করুন, তাদের কথা, তাদের ভাঙাচোরা বাক্যগঠন পদ্ধতি, নানাবিধ ধ্বনি ও অস্ফুট উচ্চারণের মধ্যেই কি কবিতার স্বাদ পাই না আমরা? যা সে মা-বাবা বা বড়দের কাছে শেখে নি হঠাৎ, তেমনই কিছু বুলি শিশু নিজেই আবিষ্কার করে আমাদের তাক লাগিয়ে দেয়। যে কারণে আমি মাঝে মাঝে ভাবি কবিতা রচনার ব্যাপারটা একদিক থেকে শিশুসুলভ কাজই বটে। কবি যখন কবিতা লিখতে বসেন তখন এক ধরনের শিশু হয়েই ভাষা নিয়ে তাকে খেলতে হয়। ভাষার মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে শিশু হয়ে প্রবেশ ও বসবাস করতে শেখার মধ্য দিয়েই কবিতা তার কারবারগুলো ঘটায়।

________________________________________

আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ভাষাসম্পন্ন ‘মানুষ’ নামক জীবমাত্রেই কবি হয়েই ভূমিষ্ঠ হয়, কিন্তু ‘কবিতা’ বলতে আমরা অবশ্য ভিন্ন কিছু বুঝি। একটা বিশেষ কালে যে ধরনের লেখাকে ‘কবিতা’ বলে, সেই ধরনের লেখা না হলে আমরা যে কোনো ভাষা ব্যবহারকেই, তা যতই সৃষ্টিশীল হোক, কবিতা বলি না।

________________________________________

আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ভাষাসম্পন্ন ‘মানুষ’ নামক জীবমাত্রেই কবি হয়েই ভূমিষ্ঠ হয়, কিন্তু ‘কবিতা’ বলতে আমরা অবশ্য ভিন্ন কিছু বুঝি। একটা বিশেষ কালে যে ধরনের লেখাকে ‘কবিতা’ বলে, সেই ধরনের লেখা না হলে আমরা যে কোনো ভাষা ব্যবহারকেই, তা যতই সৃষ্টিশীল হোক, কবিতা বলি না। তাহলে আপনার প্রশ্ন হচ্ছে এই ধরনের সাহিত্যগ্রাহ্য কবিতা, সাহিত্যের মানদণ্ড দ্বারা মাপজোক করা কবিতা আমাকে কখন নাড়িয়ে দিল? আমি কখন লিখলাম? সেই মানদণ্ডেরও তো ইতিহাস আছে, বিবর্তন আছে। প্রশ্ন তাহলে, কখন ‘আধুনিক’ কবিতা আমাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল।

যতদূর মনে পড়ে আমার প্রথম কবিতা বৈষ্ণব পদাবলীর অনুকরণে লিখেছিলাম, যখন ক্লাস এইট কি নাইনে পড়ি। কী লিখেছিলাম এখন মনে নাই, তবে সেখানে বিরহে কাতর রাধিকার কথা ছিল, কিছুটা রাবীন্দ্রিক, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’-র অনুকরণ ছিল হয়তো। তবে চৌমুহানি কলেজে যখন পড়ি, গ্রামে, আধা গঞ্জে, ততদিনে বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ হাতে এসে গিয়েছে। এদের কবিতা পড়ে ‘ভেতর থেকে নাড়া’ খাই আমি। এই নাড়া খাওয়ার স্বাদটা আমি ভুলতে পারি না। আর তার ফলেই কবিতা, ‘আধুনিক’ কবিতা এসে আমার ওপর আকস্মিক আছর করতে শুরু করে। কিন্তু একই সঙ্গে ভাষার স্বাভাবিক সাহচর্যের যে স্বাদ এবং তার যে বিস্ময়কর শক্তি ‘আধুনিক’ কবিতার সঙ্গে তার বিরোধটা আমার মন থেকে কখনই যায় নি। যতই বয়স বেড়েছে, আধুনিক কবিতার প্রতি আমার সন্দেহ ও সংশয় ততই বেড়েছে, কখনো কমে নি।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ-এ বিশেষ করে যুদ্ধে খোকনের (নিখুঁত) স্ট্র্যাটেজি ও বিদ্রোহের কাছে আরোগ্য প্রত্যাশী আমার দিনরাত্রী- তে আমার মনে হয়েছে একজন বিপ্লবী যোদ্ধা এসে দাঁড়ালেন জনতার মঞ্চের অগ্রভাগে। এই কাব্যগ্রন্থে আমি কোনো ধোঁয়াশা, তিরিশি আধুনিকতার বাহক কোনো ইমেজচাতুর্য দেখি নি, কবি যেন সবকিছু সরাসরি বলতে চাইছেন। বলতে চাইছেন তাঁর বিশ্বাস ও চিন্তাকে। এই কবিতাগুলোর পেছনের চিন্তাকথা জানতে চাইছি…

ফরহাদ মজহার : মনে রাখতে হবে ষাট দশকের উত্তাল গণ অভ্যুত্থানের কালপর্ব এবং মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা ধারণ করছে এই কবিতা। ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত বিচার করলে এগুলো মুক্তিযুদ্ধের কবিতা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের একটা ভাবগত বা দার্শনিক দিক ধরবার প্রচেষ্টা ছিল। নভেম্বর মাসে ১৯৭২ সালে কবি রফিক নওশাদ শব্দরূপ প্রকাশনী থেকে ‘খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ’ প্রথম প্রকাশ করেন। শ্লোগান নাই, চড়া স্বর নাই। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজের সঙ্গে নিজের যে-দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়েছিল কবিতাগুলো কাব্যিক জায়গায় দাঁড়িয়ে তারই বুঝি মোকাবেলা করতে চাইছে, সেইভাবে এখন পাঠ করলে, কবিতাগুলো অনুধাবনের সুবিধা হতে পারে। তবে, বলাবাহুল্য, কবিতা যখন কবিতা হয়ে ওঠে, আদৌ যদি কবিতাগুণে সিক্ত বলে পাঠকের মনে হয়, কবিতাকে তখন আরো নানান দিক থেকে পাঠ করা সম্ভব। সে বিচার পাঠকরাই করবেন।

কী ছিল তখন মনে? কী ছিল পেছনের ‘চিন্তাকথা’? (‘চিন্তাকথা’ শব্দবন্ধটি দারুণ লাগল।—শি. সা.)। কিন্তু কবিতার মধ্যে তৈরি হওয়া চিন্তা কি আগেই তৈরি থাকে? নাকি কবিতা লিখতে লিখতেই কবিতার মধ্যেই, কবিতার কথার মধ্যেই দানা বাঁধতে থাকে চিন্তা? কবিতাগুলো পড়তে কাজে লাগতে পারে সেই কথা মনে রেখে দুই একটা কথা বলছি।

ষাটের মাঝামাঝি থেকেই সামনে যুদ্ধ, আমরা টের পাচ্ছি। একই সঙ্গে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গণ-আন্দোলনের নেতৃত্বে উঠে আসছিল, কবিতাগুলো সেই শ্রেণি সম্পর্কেও সন্দিহান। সেই সংশয় ও সন্দেহ কবির নিজেকে নিয়েও, নিজের ‘খোকন’-এর সঙ্গে তার মোকাবিলা ততদিনে শুরু হয়ে গিয়েছে।

______________________________________

নভেম্বর মাসে ১৯৭২ সালে কবি রফিক নওশাদ শব্দরূপ প্রকাশনী থেকে ‘খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ’ প্রথম প্রকাশ করেন। শ্লোগান নাই, চড়া স্বর নাই। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজের সঙ্গে নিজের যে-দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়েছিল কবিতাগুলো কাব্যিক জায়গায় দাঁড়িয়ে তারই বুঝি মোকাবেলা করতে চাইছে, সেইভাবে এখন পাঠ করলে, কবিতাগুলো অনুধাবনের সুবিধা হতে পারে।

________________________________________

কবিতার বইটি ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয়বার প্রকাশ করবার সময় ভূমিকায় আমি লিখেছিলাম যে, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বদলে দিয়েছে। লিখেছি, ‘খোকন, কবি আমার, তুমি ভেবেছিলে পদ্যে পদ্যে তোমার দিন যাবে, দিন যাবে আকাশকুসুম নন্দনতত্ত্বে। কিন্তু বাইরে যুদ্ধ, বাইরে মৃতদেহ, বাইরে ইতিহাসের অভ্যন্তর থেকে প্রতিপুরুষ তোমার বিপক্ষে তৈরি হয়ে উঠছেন। অতএব লড়াই, এবং লড়াই। কে জিতবে এবং কে হারবে আমি জানতাম না। খোকন নাকি প্রতিপুরুষ? কেবল জানতাম এ এক রক্তক্ষয়ী লড়াই। আমার ভেতরে এবং আমার বাইরে সে কী ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। আমি এখন আর আগের মতো নাই…’ ইত্যাদি।

মুক্তিযুদ্ধ ‘খোকন’-কে বদলে দিয়েছে কবিতা বা শিল্পকলা সম্পর্কে তার নিজ শ্রেণির যে সকল চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা ইত্যাদি—সকল ক্ষেত্রে ওলট-পালট ঘটে গিয়েছে। যুদ্ধটা শুধু বাইরের ব্যাপার ছিল না, একই সঙ্গে নিজেকে বদলে নেবার, নিজে বদলে যাবার, নিজের রূপান্তর ঘটাবার ব্যাপারও ছিল। পদ্যে পদ্যে আকাশকুসুম নন্দনতত্ত্বে দিন কাটাবার দিন শেষ হয়েছে খোকনের। জয় হয়েছে প্রতিপুরুষের। বাংলা কবিতাকে এরপর নতুন পথ ধরে হাঁটতে হবে।

আপনি ঠিকই ধরেছেন এই কাব্যগ্রন্থে কোনো ধোঁয়াশা, তিরিশি আধুনিকতার বাহক, কোনো ইমেজচাতুর্য ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এটাও শেখায় যে বাংলা ‘আধুনিক’ কবিতার কালপর্ব বাংলা কবিতার ইতিহাসের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য হলেও, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যে রক্তের সমুদ্র পেরিয়ে এসেছি তার পর সেই ইতিহাসকে কবিতার ‘প্রতিপুরুষ’-এর নজর দিয়ে আবার দেখে নিতে হবে, ঝাড়াই-বাছাই করতে হবে। ‘খোকন’-এর চোখ দিয়ে দেখলে চলবে না, যে ‘খোকন’ আধুনিক বাংলা কবিতার মধ্যে এ যাবৎকাল বেড়ে উঠেছে। কবিতাকে শুধু কলাকৈবল্যবাদ বা নিছক নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাপার-স্যাপার, শুধু আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পর্যবসিত করা অসম্ভব। কেরানির মতো পাশ্চাত্যের ‘আধুনিকতা’-র অনুকরণও নয়। মুক্তিযুদ্ধের পর ত্রিশদশকীয় কাব্যাদর্শ-কে আমি ‘কেরানিসুলভ’ কাব্যাদর্শ বলি, অনেক সময়। কেরানির পেশাকে ছোট করবার জন্য নয়, কিম্বা ত্রিশের কবিদের ছোট বা উপেক্ষা করবার জন্যও নয়। খেয়াল করতে হবে, বলি ত্রিশের ‘কাব্যাদর্শ’ সম্পর্কে। ত্রিশের কবিদের সবাইকে এক ছকে একাট্টা আলোচনা, ‘ত্রিশের কাব্যাদর্শ’ বা বাংলা ‘আধুনিক’ কবিতার বাঁধাই করা নকশা ধরে বিচার করা বাতুলতা। তাঁরা প্রত্যেকে স্বতন্ত্র, একই রকম নন, তাঁদের ‘কাব্যাদর্শ’ একই ছিল এই অনুমানও ভুল বা নিছকই অনুমান।

________________________________________

ত্রিশদশকীয় কাব্যাদর্শ-কে আমি ‘কেরানিসুলভ’ কাব্যাদর্শ বলি, অনেক সময়। কেরানির পেশাকে ছোট করবার জন্য নয়, কিম্বা ত্রিশের কবিদের ছোট বা উপেক্ষা করবার জন্যও নয়।

________________________________________

আজ যখন ‘খোকন ও প্রতিপুরুষ’ নিয়ে ভাবি, তখন বুঝি আসলে নিজের সঙ্গে নিজের একটা তোলপাড়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম আমি তখন। কবিতা লিখতে শিখেছি ‘আধুনিক” কবিতা পড়েই, এভাবেই তো খোকনের বেড়ে ওঠা। অথচ সহজেই বুঝতে পারছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে ইতিহাস ও আবহ তৈরি হয়েছে তার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা ও ভাবের একটা বড়সড় বদল ঘটিয়ে দেবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বিশেষত বাংলা কবিতার মধ্যে গণ-মানুষের ভাষা ও ভাব একাকার হয়ে যাবার যে শর্ত ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তা টের পাচ্ছিলাম। তাকে পুরাপুরি কাজে লাগাবার একটা ঐতিহাসিক তাগিদ বোধ করছিলাম, উপলব্ধি করছিলাম। কিন্তু ‘খোকন’-কে যেন আমি রাজি করাতে পারছিলাম না। সে ‘আধুনিক’ কবিতার আরামের ‘ঘর’ ছেড়ে জনগণের সঙ্গে পথে নামতে রাজি নয়। বুঝতে পারছিলাম এর জন্য ‘খোকন’-কে পুরাপুরি দোষ দেওয়া যাচ্ছে না। আসলেই কি আধুনিক বাংলা কবিতার কাঠামোর মধ্যে থেকে ও বাস করে সেটা সম্ভব? যে বিপুল জনগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল সে জনগোষ্ঠীর ভাব ও ভাষার কাছে কিভাবে বাংলা কবিতা পৌঁছাবে? আধুনিক কবিতার যে আবহে ‘খোকন’ কবি, সে আবহের মধ্যে ‘খোকন’-এর তো বদলে যাবার সম্ভাবনা নাই। অতএব খোকনের ‘প্রতিপুরুষ’ এই টালমাটাল ইতিহাসের মধ্যে ‘খোকন’-কে চ্যালেঞ্জ করতে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কবি তার এই সত্তাকে—অর্থাৎ প্রতিপুরুষ খোকনকে ‘খুন করে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চাইছে’ :

সবুজ ভেজা নিউরনকে খুন করে ঘুম পাড়িয়ে রাখব

তোমার বন্দী রক্তমাংসে। বিপ্লবে-বিদ্রোহের স্পর্শে

হৃষ্টপুষ্ট বাড়বো আমি খোকন এবার আমার পালা

খুন হয়ে যাও, ঘুমিয়ে থাকো—আমি এবার বাইরে যাবো।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : এই কাব্যগ্রন্থের মাতৃভাষা/মাতৃভূমিতে আপনি বিশাল এক দ্বন্দ্বের সামনে আমাকে ফেলেছেন। আমারও এই অক্টোবরে পঁচিশ বছর পুরবে। আপনি একইসাথে দেশমাতৃকাকে আম্মা এবং প্রিয়তমা আপা বলছেন। আবার বলছেন, আমি তো বিদ্যা চাই না, রাখিস মা এই দাসরে মনে, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাথে এই কবিতার কি কোনো সম্পর্ক আছে? যদি থেকে থাকে তবে এর সাথে আপনার সিনক্রোনাইজেনশনটা কিভাবে আবিষ্কার করলেন?

ফরহাদ মজহার : আগের ব্যাখ্যা থেকেই আশা করি পরিষ্কার হবার কথা যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও অভ্যুদয়ের সঙ্গে শুধু ‘খোকন ও তার প্রতিপুরুষ’ নয়, আমার সব কবিতাই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ‘খোকন ও প্রতিপুরুষ’-এ যে দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত ও ইশারা সেটা কি আমার একার সমস্যা? মোটেও নয়, বরং বাংলা ভাষার, বিশেষত বাংলাদেশের কবিতারও সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান হয়েছে বলে আমি মনে করি না। মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বাংলা কবিতাকে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের গণ্ডি বা ‘ঘর’ থেকে আরও ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাবার, বাংলাদেশের গণ-মানুষের ভাষা ও ভাবের মধ্যে বসবাস করতে পারার শক্তি অর্জন করার দরকার ছিল, একটা দায় আমাদের রয়ে গিয়েছে। কিন্তু কী করে কবিতাকে শেখাব আমরা, বা কী করে সেই ধরনের কবিতা আমরা লিখব সেটা সবসময়ই আমার কাছে শুধু নয় বাংলাদেশের সব কবিদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ হিশাবে থেকে গিয়েছে। এই অন্বেষণই কবি হিশাবে আমাকে বাংলাদেশের ফকির, দরবেশ, বয়াতিদের কাব্য ও ভাবের প্রতি অনুরক্ত করে তুলেছে। আমি নিশ্চিতভাবে আশ্বস্ত হয়েছি যে এটা খুবই সম্ভব। এই আশ্বস্তি থেকেই আমি তথাকথিত ‘আধুনিক’ কবিতা আর বাংলাদেশের গণ-মানুষের ভাব, ভাষা ও কাব্যের মধ্যে কোনো কৃত্রিম বিভাজন টানতে রাজি না। জালাল উদ্দিন খাঁ, আব্দুল হালিম বয়াতি বা খালেক দেওয়ানসহ আরো বহু কবিকে ‘আধুনিক’ কবিদের তুলনায় আমার অসাধারণ মনে হয়। বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে সর্বত্র এদের কাব্যের সরব উপস্থিতি বিস্ময়করই বলতে হবে। ফকির লালন শাহের কথা নাই-বা বললাম।

ঠিক একই কারণে তরুণরা তাদের লেখালিখিতে তথাকথিত প্রমিত ভাষার মধ্যে কৃত্রিমভাবে বন্দি না থেকে তাদের নিজেদের মুখের ভাষাকে যখন কবিতা বা সাহিত্যের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, আমি তাকে সমর্থন করি। তাদের এই নিরীক্ষা নিয়ে অনেকে আপত্তি করেন, তাদের ক্রিয়াপদের ব্যবহার অনেককে ভীত করে তোলে। আমি বরং দেখি, যে দ্বন্দ্বটা জারি রয়েছে আমাদের ইতিহাস, রাজনীতি, ভাষায় বা সাহিত্যে, সেই দ্বন্দ্বই ভিন্নভাবে ভিন্ন পরিস্থিতিতে সামনে চলে আসছে। মীমাংসাটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই হবে। বাংলা সাহিত্যের ভাষা আর মুখের ভাষার যে ফারাক তাকে সংক্ষিপ্ত করে আনার সীমা ও সম্ভাবনা এই চর্চার মধ্য দিয়ে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং উঠছে বলে আমি মনে করি।

আসলে এই কবিতাগুলো আমার বিশ থেকে ২৫ বছর বয়সের রচনা। আর এই বিশেষ কবিতাটি যখন লিখছিলাম তখন আপনার মতোই আমার বয়স ২৫ বছর।

________________________________________

‘রাখিস মা এই দাসেরে মনে’ তো আমার নয়, বড়ো এক কবির কাছ থেকে ধার করা। তাঁর মতো বা আমার আগে আসা কোনো কবির মতো বিদ্যা বা জ্ঞান আমার নাই। কিন্তু আমি (অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ) মাতৃভাষা/মাতৃভূমির জন্য যে রক্ত দিয়েছি মধুসূদন বা রবীন্দ্রনাথ কি দিয়েছে? এটাই ছিল এই কবিতায় একটি প্রশ্ন। এখানেই বাংলাদেশের কবি হিশাবে আমার কীর্তির জায়গা।

________________________________________

ঠিকই, আম্মা-আপা, আপার মতো প্রিয়তমা ইত্যাদি কেন লিখেছিলাম সেটা এখনও আমাকে ভাবায়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মাতৃভূমি/মাতৃভাষাকে ‘আম্মা’ জ্ঞান করার অভ্যাস কাটিয়ে উঠতে পারি নি। সেই সময় যে ভাবটা কাজ করছিল সেটা বোধহয় ছিল এরকম যে, প্রথাগত ভাবে মাতৃভূমিকে শুধু মা বলে ডাকবার রীতি পরিহার করবার একটা পথ খুঁজছিলাম। পুরুষতন্ত্র একদিকে নারীকে দাবিয়ে রাখে, অন্য দিকে নারীকেই ‘দেবী’ বানায়, মাতৃভূমিকে জননী জ্ঞান করে—এইসকল কলকব্জা থেকে বেরুবার পথ খুঁজছিলাম। ঐ চেষ্টা করতে গিয়ে কাব্যের যে আবছা জগতে চলে যাচ্ছিলাম তারই পরিণতি এই সকল সম্বোধন।

দ্বিতীয়ত, কবি বলেই হয়তো মাতৃভাষা আর মাতৃভূমিকে আমি আলাদা করতে শিখি নি, আলাদা করি না। উভয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এতই ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ যে তাকে ‘তুইতোকারি’-র সম্পর্ক জ্ঞান করছিলাম আমি। এই সম্পর্ক ‘আবোলতাবোল’। এর কোনো মানে নাই, যেন কবির ইচ্ছে হয়েছে বলেই পরস্পরবিরোধী সম্বোধনে ‘আবোলতাবোল’ বকছে।

‘রাখিস মা এই দাসেরে মনে’ তো আমার নয়, বড়ো এক কবির কাছ থেকে ধার করা। তাঁর মতো বা আমার আগে আসা কোনো কবির মতো বিদ্যা বা জ্ঞান আমার নাই। কিন্তু আমি (অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ) মাতৃভাষা/মাতৃভূমির জন্য যে রক্ত দিয়েছি মধুসূদন বা রবীন্দ্রনাথ কি দিয়েছে? এটাই ছিল এই কবিতায় একটি প্রশ্ন। এখানেই বাংলাদেশের কবি হিশাবে আমার কীর্তির জায়গা।

এই জন্যই আমার প্রার্থনা, ‘আমায় পরিপার্শ্বে রাখ’ আর এই দাসকে যেন বাংলাভাষা ও বাংলাদেশ ভুলে না যায়। ইত্যাদি।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : খোকন ও তার প্রতিপুরুষ-এ আপনি প্রচুর থিসিস ও এন্টিথিসিস তৈরি করেছেন। আপনার এই মেকিং কি হেগেলের দ্বান্দ্বিকবস্তুবাদী চিন্তাপ্রসূত? যদি শ্রেণিহীন, জাতপাতহীন সমাজ তৈরি হয় সেখানেও কি আপনার খোকন ও আরেক এন্টি-খোকন তৈরি হবে না? খোকন ও তার প্রতিপুরুষ-এর কী প্রতিক্রিয়া আপনি তখনকার সমসাময়িক পরিমণ্ডলে পেয়েছিলেন?

ফরহাদ মজহার : আমি বলেছি আগেই, নানাভাবে কবিতা পাঠ করা সম্ভব। তবে এত সরলভাবে হেগেলের থিসিস/এন্টি-থিসিস কবিতায় ব্যবহার করি নি। কবিতা কোনো ফর্মুলা মেনে চলে কি? হতে পারে যে জাতপাতহীন শ্রেণিহীন সমাজ কায়েম হবার পর ইতিহাসের নতুন সমস্যা আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। তার রূপ বা চরিত্র কী হবে সেটা আমরা জানি না। জানব যখন জাতপাতহীন শ্রেণিহীন নারী-পুরুষ ভেদহীন সমাজ আমরা তৈরি করতে পারব। ইতিহাসের এখনকার যে কালপর্ব সেটা অতিক্রম করে যাবার পরই এই প্রশ্ন আদৌ কোনো প্রশ্ন কিনা আমরা ধরতে পারব। বুঝব।

যে খোকন নিয়ে কথা বলছি আমরা সেও তো দেশকালপাত্রে নির্দিষ্ট। তাকে বিমূর্ত জ্ঞান করার সুযোগ কই? ফলে ভিন্ন কোনো অবস্থায় খোকনের আরেক এন্টি-খোকন তৈরি হবে কি না তা নিয়ে চিন্তা অনেক আগাম চিন্তা হয়ে যাবে।

খোকন এবং তার প্রতিপুরুষের প্রতিক্রিয়া সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে খুবই ভালো হয়েছিল। এই কবিতা পুস্তিকাটি দিয়েই কবিদের সভায় বা কাব্যের জগতে পুনরায় আমার প্রবেশ ও স্বীকৃতি।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : ত্রিভঙ্গের তিনটি জ্যামিতি কাব্যগ্রন্থের নূহ এবং তার নভোজাহাজ, লালন ফকির, অহঙ্কার, সিংহষাঁড় প্রভৃতি কবিতাতে আপনি অসাধারণ সব রূপক ব্যবহার করেছেন। এবং আমি খেয়াল করেছি প্রথম কাব্যগ্রন্থে ইসলামি পুরাণের ব্যবহার নাই, কিন্তু দ্বিতীয় গ্রন্থ থেকেই আপনি সেদিকে ধাবিত হয়েছেন। ইসলামি পুরাণ ব্যবহারের চিন্তা কোন প্রেক্ষাপটে আপনার মধ্যে আশ্রয় লাভ করল? আপনিই লালন ফকির (কবিতা- লালন ফকির)—এই বয়ানের প্রেক্ষাপট বা অন্তঃস্থ দর্শন কী?

ফরহাদ মজহার : ইসলামি পুরাণ আমি দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে সচেতনভাবে ব্যবহার করেছি কি? ঠিক যে দুই একটি জায়গায় এসে গিয়েছে। কিন্তু সেটা সজ্ঞানে এসেছে মনে পড়ে না। মনে রাখতে হবে কবিতাকে সাধারণ মানুষের ভাব ও ভাষার মধ্যে স্থাপনের তাগিদ মুক্তিযুদ্ধের উপলব্ধি থেকেই, প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকেই আমার মধ্যে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কবিতার প্রকল্প হিশাব আবছাভাবে হলেও দানা বাঁধছিল। সেটাই অনেক পরে ‘এবাদতনামা’-তে এসে ঠেকেছে, কিন্তু ততদিনে আরো অনেক জিজ্ঞাসা, উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা আমার ভাঁড়ারে জমা হয়েছে।

বাংলা ভাষা ও ভাবে গণমানুষের মধ্যে জীবন্ত যে কোনো পুরাণ, গল্প, বয়ান, কেচ্ছা সবকিছুর প্রতিই আমার আগ্রহ প্রবল—শুধু ইসলামি পুরাণ নয়। এই কবিতাপুস্তিকায় যে ‘ত্রিভঙ্গ’ তিনি তো ইসলামি পুরাণের নন। যাঁর তিনটি জ্যামিতির কথা বলা হয়েছে তিনি আর কেউ নন, খোদ কৃষ্ণ। কৃষ্ণ বাঁশি বাজাবার সময় শরীরকে তিন ভাঁজ করে ফেলতেন বলে তাঁর আরেক নাম ‘ত্রিভঙ্গ’।

কবি হিশাবে আমার আদর্শ কবি হচ্ছেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ। আমি তার মত কবি ও দার্শনিক হতে চেয়েছি, কিন্তু কিভাবে সেটা সম্ভব তার মীমাংসা আমি আজও করে উঠতে পারি নি। সেই যোগ্যতাও আমার নাই।

________________________________________

ইসলামি পুরাণ বা বাংলাদেশের গণমানুষের মধ্যে ইসলাম-অনুপ্রাণিত ভাব ও ভাষা রাজনৈতিক আত্ম-পরিচয়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কবিতায় আত্মস্থ করার কাজ আমার কাছে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।

________________________________________

অসাম্প্রদায়িক জায়গা বা যে কোনো প্রকার রাজনৈতিক আত্ম-পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে যা কিছু আমাদের বিবিধ ধর্মে, ঐতিহ্যে, ভাষায়, সংস্কৃতিতে, পুরাণে, কেচ্ছায়, কাহিনিতে রয়েছে তাকে আত্মস্থ করতে হবে কবি হিশাবে, এই দাবি আমি সবসময়েই করে এসেছি। বাংলার ভাব ও ভাষার বিকাশের শর্তও এই চেষ্টার মধ্যে নিহিত। সে হিম্মত আমরা তো এখনও অর্জন করতে পারি নি।

ইসলামি পুরাণ বা বাংলাদেশের গণমানুষের মধ্যে ইসলাম-অনুপ্রাণিত ভাব ও ভাষা রাজনৈতিক আত্ম-পরিচয়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কবিতায় আত্মস্থ করার কাজ আমার কাছে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। কিন্তু সে সব নিয়ে আমি কাজ করতে শুরু করেছি অনেক পরে। ততদিনে আমি এটাও জেনে গিয়েছি যে শ্রীচতন্য, নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতাচার্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ফকির লালন শাহ অবধি যে ভাব ও ভাষা ‘নদিয়ার ভাব’ নামে দানা বেঁধেছে সেই ভাবের জায়গায় দাঁড়িয়ে ইসলাম, ইসলামের ইতিহাস, ইসলামের গল্প, কেচ্ছা, বয়ান ইত্যাদির আত্তীকরণের দুর্দান্ত শক্তি নদিয়ার ভাবের মধ্যে প্রবলভাবে চর্চা করা হয়েছে। আমাকে নতুন করে পুরানা চাকা আবিষ্কার করতে হবে না জেনে পুলকিত বোধ করেছি। বরং নদিয়ার ভাবের মধ্যে ডুবে যাওয়াকেই, তখন মনে হয়েছে সবচেয়ে জরুরি কাজ।

কেন আমি ‘লালন ফকির’? সেটা তো কবিতার মধ্যেই বলার চেষ্টা আছে :

তুমি আমার গুরু তুমি লালন ফকির

এবং আমি লালন করছি তোমার দেহ

পুষছি তোমার দৃষ্টি, তোমার দেহতত্ত্ব

অচিন পাখি, নভোজাহাজ,

নিখিল থেকে নিচ্ছি টুকে দেহের খাতায়

চারটে সময় চারটে ঘড়ির

যেন সময় ফস্কে না যায়

যেন আমি কাঁটায় কাঁটায় বলতে পারি—

‘আমিই হচ্ছি লালন ফকির’।

আমার তো মনে হয় এর বেশি আমার আর বলার নাই। তবে লালনের ঘড়িটা ‘চতুর্মাত্রিক’, সেটা আমার এই কবিতাটি লেখার সময় মনে হয়েছিল। যদিও লালন ও নদিয়ার ভাব সম্পর্কে আমি পরে আরও অনেক বিস্তৃত ও গভীরভাবে জানার সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু সহজ-সরলভাবে বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে ত্রিভঙ্গের তিনটি জ্যামিতি লেখার সময় আমার মনে হয়েছিল দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও অবস্থানের ত্রিমাত্রিকতার বাইরের যে জগৎ সেই জগৎটার হদিস না নিলে লালন বা নদিয়ার ভাব সম্পর্কে কিছুই বুঝব না আমি। কিন্তু সেটা মিস্টিরিয়াস বা মরমি কোনো জগৎ নয়। সেটা ইহলৌকিক চর্চা বা লালনের ভাষায় ‘করণ’ কর্মের বিষয়। সেটা করতে হবে ‘দিন ধরে তিনের সাধন’ চর্চা করে। লালনের গানের কথা ভুলভাবে গাওয়া হয়, তাই ধরিয়ে দিচ্ছি:

‘সময় গেলে সাধন হবে না

দিন ধরিয়ে তিনের সাধন কেন করলে না’… ইত্যাদি

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : ‘নৃতত্ত্ব’ নামে একটি কবিতা লিখেছেন আপনি। আপনাকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে এই কবিতাটিকে আমি নিজে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। আমি নিজে নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। আপনি বলছেন এ কবিতায় ‘কারণ আমি আমার আপন ইন্দ্রিয় থেকে জন্মলাভ করি’। একটা জ্ঞানকাণ্ড হিসেবে নৃবিজ্ঞানের উদ্ভব, বিকাশ ও বর্তমান কর্মপরস্পরা সবসময়ই বিতর্কের ভেতর দিয়েই এগুচ্ছে। আপনার জীবন ও কাব্যদর্শনে নৃতত্ত্ব কিভাবে তার ভূমিকা পালন করে? আপনার দৃষ্টিভঙ্গিকে কি নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বলা যাবে?

ফরহাদ মজহার : ‘আমি আমার আপন ইন্দ্রিয় থেকে জন্মলাভ করি’—হয়তো এই ঘোষণার মধ্যে আমাকে আপনি ব্যাখ্যা করার জন্য ‘নৃতত্ত্ব’ কবিতাটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। নৃবিজ্ঞানের উৎপত্তি ঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চায়। ঠিক যে তার উদ্ভব, বিকাশ ও বর্তমান কর্মপরম্পরা সবসময়ই বিতর্কের ভেতর দিয়ে এগুচ্ছে। ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডের ভার বা ভূত নিজের কাঁধ থেকে নৃবিজ্ঞান নামাতে পেরেছে কিনা সন্দেহ।

তবে কবিতাটির শুরুতে ভূমিকা হিসাবে ব্রাকেটে আমি এই দাবি করে শুরু করেছিলাম যে, ‘নৃতত্ত্ব’ বিজ্ঞানের চূড়ান্ত পর্যায়’ (কিন্তু দর্শনের নয়)। দর্শনকে আলাদা রাখি, কারণ দর্শনের কাজ হচ্ছে এই বিভাজনের বৈধতাকে প্রশ্ন করা, খোদ জ্ঞানপদ্ধতির পর্যালোচনা করা। আর দশটা বিজ্ঞানের মতো একদিকে ‘বিষয়ী’ (Subject) আর অন্যদিকে ‘বিষয়’ (Object) হয়ে বিভাজিত মানুষ যখন নিজেকেই নিজে জানার, বোঝার বা গবেষণার অধীনে আনবার পদ্ধতি রপ্ত করে তখন বিজ্ঞানের বিকাশের দিক থেকে সেটা জ্ঞানচর্চার এক চূড়ান্ত মুহূর্ত। মানুষ নিজেকেই নিজের বিষয় জ্ঞান করছে, অন্য বিজ্ঞানের মতো বিষয় তার কাছ থেকে আলাদা কিছু নয়। তার নিজের ইন্দ্রিয় ও চৈতন্যই তার নিজেকে বিশ্লেষণ করার পদ্ধতিসিদ্ধ মাধ্যম। এই চর্চায় মানুষ নিজেকেই নিজে ভাঙে, কিন্তু নিজেকেই আবার নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে নিজেকে নৃতাত্ত্বিক জ্ঞানকাণ্ডের মধ্যে পুনরায় নির্মাণ করে। কবিতার দিক থেকে এই ভাবটা ধরতে চেয়েছি এই কথা বলে যে, এর মানে দাঁড়ায় ‘আপন ইন্দ্রিয় থেকে আপনাকে পুনর্নির্মাণ করা’। তবে সাবধান করেছি। এই কথা বলে রেখেছি যে, এই কবিতায় নৃতত্ত্ব কবিতার বিষয় নয়, কিন্তু নিজেকে নিজের ইন্দ্রিয় থেকে আবার নির্মাণ করার এই ‘আবহ’-টা কবিতার মধ্যে আছে বলে এর নাম দিয়েছি ‘নৃতত্ত্ব’।

আমার জীবনে নৃতত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষত প্রাণ, পরিবেশ, নয়াকৃষি, পদ্ধতিসিদ্ধ বা লৌকিক জ্ঞানের তুলনামূলক বিচার ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রে। এই বিজ্ঞানের সঙ্গে আমাকে সর্বক্ষণই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বজায় রাখতে হয়।

আপনি হয়তো জানেন আমি সার ও কীটনাশক ছাড়া কৃষকদের নিয়ে চাষাবাদের চেষ্টা করি। সেটা করতে আমাকে একদিকে হাজার বছর ধরে কৃষিতে বিকশিত লোকায়ত জ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়, কৃষক সমাজের সামাজিক চর্চা, আচার, রীতি ও সংস্কৃতির খোঁজখবর নিতে হয়, অন্যদিকে গত কয়েক দশকে প্রাণবিজ্ঞানের (biological science) ক্ষেত্রে যে বিপুল আগ্রগতি হয়েছে তারও খবর রাখতে হয়। পদ্ধতিসিদ্ধ জ্ঞান বা বিজ্ঞান (Formal Knowledge System) আর লোকায়ত জ্ঞানের (informal knowledge) যে কৃত্রিম বিভাজন এখনো জারি আছে আমি তার ঘোর সমালোচক। সেই সমালোচনা ও পর্যালোচনায় নৃতত্ত্ব জ্ঞান চর্চার একটি বিশেষ পদ্ধতি হিসাবে আমার খুবই কাজে আসে।

কিন্তু আমার দৃষ্টিভঙ্গিকে নৃতাত্ত্বিক বলা যাবে না, কারণ আমার উৎসাহ কাব্যে ও দর্শনে এবং আমার চর্চার চরিত্র রাজনৈতিক। ক্ষমতা বিশ্লেষণ, শ্রেণি বিচার ও নারীপুরুষ ভেদবিরোধী একটা দৃষ্টিভঙ্গি মাথায় রেখেই আমি আমার কাজ করি। একই সঙ্গে দর্শনও হাত ধরাধরি করে চলে। উদাহরণ দিচ্ছি।

সার ও কীটনাশক ছাড়া চাষাবাদের পেছনে প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে একটা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। প্রকৃতির ওপর ‘দখলদারি’ কায়েমের, আধিপত্য প্রতিষ্ঠার যে ধারা তার বাইরে দাঁড়াবার জন্য একটা রাজনৈতিক-দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি বা অবস্থানের প্রয়োজন রয়েছে। আপনি কি প্রকৃতির দখলদার হবেন, তার কর্তা সাজবেন, নাকি তার লালনপালনের দায় নিয়ে নিজের বিকাশ নিশ্চিত করবেন, কারণ শেষ বিচারে আপনি নিজেও তো প্রকৃতি। অন্যদিকে, প্রকৃতি স্থির বা অপরিবর্তনীয় কিছু নয়, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির প্রাণ-রাসায়নিক আদান-প্রদানের গতিশীল চরিত্র কেমন হবে সে সম্পর্কেও একটি পর্যালোচনামূলক দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা চাই। রাজনৈতিকভাবে আপনি কৃষকসমাজ ও কৃষিব্যবস্থাকে ধ্বংস করে খাদ্য উৎপাদনের ভার দুনিয়ার অল্প কয়েকটি বহুজাতিক কম্পানির হাতে তুলে দেবেন, নাকি প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্র রক্ষার জন্য লড়বেন সেটা সরাসরি একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। প্রগতি মানেই কৃষিসভ্যতাকে ধ্বংস করে নগরায়ন বা আধুনিক সভ্যতা—এই ধারণাকে আমি বিপজ্জনক মনে করি। তার মানে এই নয় যে, আমি, কৃষি সভ্যতাই চিরকাল টিকে থাকুক, তা চাইছি। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে অবশ্যই, কিন্তু তার প্রণোদনা থাকবে প্রাণের রক্ষা, বিকাশ ও উৎসবের মধ্যে।

‘নৃতত্ত্ব’ কবিতাটিতে এই সবের অনেক রেশ আপনি সহজেই ধরতে পারবেন যদি আপনি আমার কথাগুলো মনে রাখেন। কবিতাটিতে নৃতত্ত্ব বিষয় নয় বটে, কিন্তু নিজেকে নিজইন্দ্রিয় থেকে পুনর্নির্মাণের যে তাগিদ এই কবিতায় বোধ করেছি, তার জন্যই এর নাম রেখেছিলাম ‘নৃতত্ত্ব’।

________________________________________

আধুনিকতার বিচার অনেক বড় একটি বিষয়। ঔপনিবেশিকতা, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা থেকে আধুনিকতাকে আলাদা করা যায় না, আলাদা করা যায় না গ্রিক-খ্রিস্টিয় সভ্যতার আধিপত্য বা খবরদারি থেকে।

________________________________________

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনার সবগুলো কাব্যগ্রন্থগু পাঠের পর আমার উপলব্ধি আপনার কাব্যবোধ মোটেও তিরিশি আধুনিকতা-তাড়িত নয়। কিন্তু ত্রিভঙ্গের তিনটি জ্যামিতি নামের মধ্যে তিরিশি আধুনিকতার গন্ধ রয়েছে! এই প্রসঙ্গটি আপনি কিভাবে মোকাবেলা করবেন? আধুনিকতা নিয়ে আপনার অবস্থান কী? আপনার আধুনিকতা—আপনি কিভাবে নিজেকে বোঝান?

ফরহাদ মজহার : কিভাবে ত্রিভঙ্গের তিনটি জ্যামিতির তিরিশি আধুনিকতার গন্ধ রয়েছে ব্যাখ্যা করে বললে উত্তর দিতে পারতাম। কিন্তু খোকন ও প্রতিপুরুষ সম্পর্কে বলতে গিয়ে যে আধুনিক কবিতার ‘ঘর’-এ কবি বেড়ে উঠেছে তার সীমাবদ্ধতার কথাটি অস্বীকার করেছি কি? সেই ঘরেই তো তাকে খুন করে ঘুম পাড়িয়ে রাখা। তাই না? কিন্তু তার বিপরীতে যে প্রতিপুরুষ লড়াই করে বেড়ে উঠতে চাইছে সেটাই বোধহয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হতেই পারে যে, কবির যে তাগিদ ও সংকল্প কবি সেখানে ব্যর্থ হয়েছে। তার বিচার পাঠকদের ওপর।

আধুনিকতার বিচার অনেক বড় একটি বিষয়। ঔপনিবেশিকতা, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা থেকে আধুনিকতাকে আলাদা করা যায় না, আলাদা করা যায় না গ্রিক-খ্রিস্টিয় সভ্যতার আধিপত্য বা খবরদারি থেকে। এটা জেনেও আমার যে ‘আধুনিকতা’, যদি আদৌ তেমন কিছু থেকে থাকে, তবে সেটা ‘আধুনিকতা’ নামে আমরা যার মোকাবিলা করছি তাকে নাকচ বা বাতিল করে দেওয়া নয়, বরং তার পর্যালোচনা করা, একটি ইতিহাস-সচেতন বা ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা।

অন্যদিকে যেসকল ভাব, ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, পুরাণ, আখ্যান ইত্যাদি ‘আধুনিকতা’-র দাপটে আজ হারিয়ে গিয়েছে, যেসব আমরা ‘অনাধুনিক’ বলে পরিহার করি, তার মধ্যে মানবেতিহাসের অনেক কিছু অর্জন রয়ে গিয়েছে যার পুনরাবিষ্কার ও পুনরুদ্ধার আমি জরুরি মনে করি। অর্থাৎ আগামী দিনে মানুষের নতুন ইতিহাস গড়বার জন্য হারিয়ে যাওয়া অর্জনগুলোর খোঁজখবর নিতেই হবে। ‘আধুনিকতা’-ই মানুষের শেষ ইতিহাস নয়।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : ফরহাদ মজহার লিখেছেন—কবিতা কি দিতে পারে গরিবেরে সশস্ত্র বিপ্লব? যে কোনো ন্যারেটিভের মতোই কবিতাও কি বিপ্লবের ভাষা তৈরি করতে পারে না?

ফরহাদ মজহার : কবিতা অবশ্যই আমাদের ‘বিপ্লবের ভাষা’ দিতে পারে, ‘বিপ্লবের ভাষা’ নির্মাণ করতে পারে কবিতা। প্রথম বিপ্লবের খুন ভাষা থেকেই আগে বের হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কবিতাকে কি ‘সশস্ত্র বিপ্লব’ দিতে পারে? অবশ্যই না। সেটা কবিতার কাজ নয়, সেটা বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের কাজ। কবিতার সীমা ও সম্ভাবনা যেন আমরা ভুলে না যাই।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনার বহুল পঠিত ও আলোচিত কবিতাগুলির একটি ‘কর্তৃত্ব গ্রহণ করো, নারী’। এই কবিতার একটি ভুল ব্যাখ্যা বাজারে চাউর আছে যে, এখানে নারীর পুরুষকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ববান হয়ে ওঠার কথা বলে তাকে ‘সাপেক্ষ’ আকারে দেখে আপনি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন ঘটালেন।

ফরহাদ মজহার : ঠিকই বলেছেন, এটা অবশ্য ভুল পাঠ ও ভুল ব্যাখ্যা। কবিতা এখানে ‘পুরুষ’ শব্দটিকে তার লিঙ্গজ্ঞাপক অর্থ থেকে বিচ্যুতি ঘটিয়ে ভিন্ন একটা অর্থে ব্যবহার করবার চেষ্টা করেছে, চেষ্টা হয়েছে কাব্যিক দ্যোতনা বজায় রেখে। সেদিকে নজর না দিলে ভুল ব্যাখ্যার বিপত্তি ঘটতে পারে। মনে হতে পারে এত কথা বলার পর বুঝি বলা হচ্ছে নারী যেন তবুও পুরুষকে ‘গ্রহণ’ করে। কিন্তু জীবরূপী পুরুষকে গ্রহণ করবার কথা তো এখানে বলা হচ্ছে না। নারীকে ‘সাপেক্ষ’ আকারে দেখার তো প্রশ্নই আসে না। আমাদের সমাজে পুরুষতন্ত্রকে বায়োলজিকাল বা নারীপুরুষের প্রাকৃতিক বা জৈবিক পার্থক্য দিয়ে বুঝবার একটা রেওয়াজ রয়েছে। সেখান থেকেও এই ধরনের বিপত্তি ঘটেছে, কবিতাটির মধ্যে অন্যায়ভাবে পুরুষতান্ত্রিকতা খোঁজা হয়েছে।

কবিতার নামেই স্পষ্ট যে ‘পুরুষ’ কথাটিকে এখানে তার বায়োলজিকাল বা লিঙ্গ-সর্বস্ব অর্থ থেকে বিচ্যুত করে তার সামাজিক-রাজনৈতিক দিকটাকে স্পষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের দিকটার প্রতি নজর ফেরানোর। কবিতাটির শেষ লাইনগুলোতে সেটা খুবই স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে :

‘আজ আমি তোমাকে বলতে এসেছি/ পুরুষ শব্দের অর্থ হচ্ছে কর্তৃত্ব/ এবং তোমার কর্তৃত্ব গ্রহণ করার সময় হয়েছে নারী/ পুরুষকে গ্রহণ কর’।

অর্থাৎ বায়োলজিকাল ‘পুরুষ’-কে গ্রহণ করার কথা বলা হচ্ছে না। নারীকে ‘কর্তৃত্ব’ গ্রহণ করবার কথা বলা হচ্ছে। লিঙ্গচিহ্ন দিয়ে নারী ও পুরুষকে চেনা ও তার দ্বারা পুরুষতন্ত্র ব্যাখ্যা করবার যে পুরুষতান্ত্রিক ধারা চালু আছে তাকেই তো বরং কবিতাটি চ্যালেঞ্জ করছে। তাই না?

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনার অসময়ের নোটবই-এর ‘অসময়ের নোটবই’ কবিতার একটা অংশ উদ্ধৃত করছি আমি—‘শরিয়ত সাক্ষী, ওদের কাছে আল্লা হচ্ছে/লিভার ব্রাদার্স কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার/ শরিয়ত সাক্ষী, আধুনিক পরওয়ারদিগারের নাম হচ্ছে/ খোলাবাজার অর্থনীতি/ যাও সুবর্ণা, বিক্রি হয়ে যাও/বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে/থিয়েটার করে বলো,/”লাক্স, বিশ্বজুড়ে তারকাদের সৌন্দর্য সাবান”/যাও শাকিলা, আমি কোমল মসৃণ ত্বকের গান শুনতে চাই/ আমি নূরজাহান, গাঁয়ের মেয়ে, আমার বগলতলে ঘাম নাই/আমি দুর্গন্ধ লুকিয়ে রাখি না। আমি ভূত হয়ে বসেছি টেলিভিশনের সামনে/তোমাদের দেখবো/যাও নিপা নাচো, আমি তোমার নৃত্য দেখে পাগল হয়ে যাই/যাও বিপাশা অভিনয় করো/ উহ্ আহ্ কী ভালো তোমার অভিনয়, বলো/কেবল লাক্স জানে আমার ত্বক কি চায়!’—এই যে আমি উদ্ধৃত করলাম, আর আগে কর্তৃত্ব গ্রহণ কর, নারীর প্রসঙ্গ তুললাম, এইখানে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে নারীর যে পরিবেশন, যা তার অবস্থাকে আপহোল্ড করতে গিয়ে তাকে পণ্য করে ফেলছে, কবি ফরহাদ মজহার, আমি মানি কবিরাই নবী, তদুপরি বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার এর সমাধান কিভাবে দেবেন? পণ্য হওয়া নারীকে আপনি কিভাবে কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে বলতে পারেন?

ফরহাদ মজহার : এখানে আপনি ভিন্ন প্রসঙ্গে এলেন। দুটো কবিতার বিষয় ভিন্ন। নারীর পণ্য হওয়ার জন্য তো নারী দায়ী নয়, পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাই দায়ী। বিজ্ঞাপনের যেসব নারীদের নাম এখানে নিয়েছি, সেটা একান্তই কবিতার প্রয়োজনে। এঁদের কারো প্রতিই আমার ব্যক্তিগত স্নেহ বা শ্রদ্ধার কোনো অভাব নাই। কিন্তু খুবই দ্রুত যখন নারীর পণ্যে পরিণত হবার প্রক্রিয়া আমি দেখলাম তখনই এই ‘অসময়’ সম্পর্কে কবিতা লিখবার তাগিদটা আমি বোধ করলাম। এই ‘অসময়’ বা পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করা ছাড়া তো এখানে নারী বা পুরুষ কারুরই কোনো মুক্তি নাই।

ঠিক যে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা যখন সর্বব্যাপী হয়ে ওঠে তখন তাকে পুরুষতন্ত্র থেকে আলাদা করে বিচার করতে পারবেন না। পুরুষতন্ত্র-বিরোধী লড়াই একই সঙ্গে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাবিরোধী লড়াইয়ে পরিণত হতে বাধ্য। যে নারী এই লড়াইয়ে শামিল তাকেই তো এই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে হবে। নয় কি? আপত্তি কোথায়?

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : বৃক্ষ: মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক বিষয়ক কবিতা গ্রন্থের ‘মানবকুসুম’ কবিতাটির কথা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমার প্রশ্ন, কুসুমে কুঙ্কুমে ঢাকা পরিমল যে মানবচরিত্র, আপনার যে ‘মানবকুসুম’ ধারণায়ন তার সাথে দেশভাগের বছরে জন্ম নেয়া আপনার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খতিয়ান কী? মানুষ নিয়ে কি আপনি আজও আশাবাদী?

ফরহাদ মজহার : দেখুন, যুদ্ধ, রক্তপাত, হিংসা, হানাহানি ইত্যাদির মধ্য দিয়েই তো মানুষের ইতিহাস। ‘মানুষ’ নিয়ে আশাবাদ তো আমার একার আশাবাদ নয়। মানুষে যদি আশা না থাকে তাহলে কাব্য বা সাহিত্য কিভাবে সম্ভব? যদি সাহিত্য মানুষের উপর আশা না রাখার কথা বলে, তবুও কেন তাকে এই নিরাশার কথাটা শোনানোর জন্য জন্য সাহিত্যের আশ্রয় নিতে হলো? প্রকারান্তরে মানুষের ওপর এক ধরনের আস্থা আমরা এখানেও দেখি।

কবিতাটি পুরুষতন্ত্রকে আরেকটি জায়গা থেকে দেখবার চেষ্টা করছে। প্রকৃতির মধ্যে প্রাকৃতিক ‘বিভিন্নতা’ আছে, কিন্তু ভেদ নাই। প্রকৃতি লিঙ্গোদ্দীপক নাম গ্রহণ করে না। ‘অথচ মানুষের মধ্যে এইসব অশ্লীলতা আছে’।

প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খতিয়ান টানা তো অনেক বড় একটি কাজ। এতটুকু বুঝি বিপদ, সংকট ও চ্যালেঞ্জ আছে সামনে অনেক, কিন্তু আমরা এগিয়ে এসেছি, পিছিয়ে যাই নি।

________________________________________

কিন্তু সেই সময় বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক সংস্থা রপ্তানিমুখী উন্নয়নই বাংলাদেশের দেশগুলোর উন্নয়নের পথ—এই দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠছিল।

________________________________________

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : শেষ পর্যন্ত ফরহাদ মজহারের চিন্তা ও স্পষ্ট বক্তব্যের তীব্র ক্ষুরধার পেরিয়ে আমরা সুভাকুসুম দুই ফর্মাতে পাই নিটোল প্রেমের কবি, আমাদের উঠোনে খেলা করা কাঠের খেলনা বন্দুক নিয়ে খেলা কবি ফরহাদ মজহারকে। এই দুইফর্মায়ও বিতর্ক উস্কে দেবার মতো অনেক কিছু লিখেছেন আপনি। যেমন স্নেহে যৌনাকাঙ্ক্ষা হয়, যেমন বাংলা কবিতার প্রতি! তবু সবকিছু ছাপিয়ে বৃক্ষ আর মানুষের সম্পর্কই যেন প্রধান হয়ে উঠেছে। যেখানেও আপনি চেয়েছেন ‘আমি চাই সমগ্রতা”। আপনার অপরাহ্ণে কি সংসারের সমস্ত উত্তর মিলেছে?

ফরহাদ মজহার : কবি কি প্রেমিক নয়? প্রেম তো থাকবেই, তারই চেষ্টা ‘সুভাকুসুম দুই ফর্মা’য়। ঠিক যে সমগ্রতার প্রতি এই কবিতায় আকুতি আছে। কিন্তু বলুন তো, কোনো কবি কি অপরাহ্ণে সংসারের সমস্ত উত্তর পেয়েছে?

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : সুভাকুসুম দুইফর্মার ‘বাংলা কবিতার প্রতি’ কবিতাটি বলছে যে, বাংলা কবিতা কেবল রবীন্দ্রনাথ আর আপনার ফোন ধরে। আমি পুরো কবিতাটি উদ্ধার করছি—শুনেছি অনেকে নাকি তোমাকে পেয়েছে টেলিফোনে/যোগাযোগে ব্যস্ত তুমি গৃহে গৃহে পাড়ায়/কে যায় উচ্ছন্নে কার হাঁটু ভাঙে শিল্পের পবনে/ তাদের নাম্বার তুমি টুকে রাখ নিজের খাতায়/ আমি আর্ত রিসিভার তুলে নিয়ে ত্রস্ত হাতছানি/ দিয়ে যাচ্ছি বারবার, টেলিফোন বাজে, বেজে যায়/ কেবল বাজো না তুমি। ওদিকে ধ্বনিত কোনো বাণী/ প্রাণিত করে না প্রাণ, কাটে দিন ব্যর্থ প্রচেষ্টায়।/ তাহলে রবীন্দ্রনাথ পেয়ে যেত তোমাকে কি করে/ অত দ্রুত অনায়াসে? ব্যক্তিগত তোমার নাম্বার/তাঁকে দিয়েছিলে কেন? যদি ছিল তোমার অন্তরে/এত বেশি পক্ষপাত অন্যদের নিয়ে বারবার/এই প্ররোচনা কেন? অন্যেরা টেলিফোন করে/ বাজে ফোন, তুমি শোন, কিন্তু কিছু বল না উত্তরে।—আমার প্রশ্ন হলো, বাংলা কবিতা কি কেবল রবীন্দ্রনাথ আর আপনার সাথেই কথা বলেছে আদতে? এখন অবধি বাংলা কবিতার যে ধারা তাকে আপনি কিভাবে বিশ্লেষণ করেন?

ফরহাদ মজহার : এটা তো অভিমানের কবিতা। বাংলা কবিতা রবীন্দ্রনাথের টেলিফোনে সাড়া দিয়েছে, কিন্তু আমার (কিম্বা আরো অনেকের) ফোনে সাড়া দিচ্ছে না। এই ব্যর্থতার অভিমান এই কবিতায় আছে। বাংলা কবিতার ধারার সঙ্গে যুক্ত থাকার একটা বাসনা এই কবিতার মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়েছে হয়তো। রবীদ্রনাথের মতো বড় মাপের কবিদের হাত ধরে কবিতা যেখানে এসে দাঁড়ায়, তার পরের সব কবিদেরই কাজ হয় বড় কবির আধিপত্য থেকে বের হয়ে আসা, কবিতার ভিন্ন সম্ভাবনাকে দেখানো। সেই দিক থেকে বাংলাভাষার কবিতা নিঃসন্দেহে অনেকদূর এগিয়েছে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনার উচ্চারণ রাজনৈতিক বক্তৃতামঞ্চের মাঝখানে শিরোভাগে দাঁড়ানো শ্লোগানমাস্টারের মতন। যেমন— লেফটেনান্ট জেনারেল ট্রাক, তুমি আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছো বিপ্লবের সামনে, বেরো তুই শুয়োর, গুবরে পোকার শ্বশুর প্রভৃতি। এর সাথে সাথে আপনি লিখেছেন মন্দ গতির খসড়া গদ্য। লেখার এরকম আঙ্গিক কেন বেছে নিলেন? লেফটেনান্ট জেনারেল ট্রাক খসড়া গদ্যে কেন অন্তর্ভুক্ত হলো (যেহেতু বইটির অন্য কবিতাগুলোর সাথে এই কবিতার মেজাজের পার্থক্য আছে)?

ফরহাদ মজহার : তাই কি? এই কবিতাগুলো বাংলাদেশে একটি বিশেষ ধারার কবিতা-আন্দোলন গড়ে ওঠার সঙ্গে জড়িত, যাকে আমরা বলি, ‘লিপ্ত ধারার কবিতা’। আশির দশকে সামরিক স্বৈরশাসক বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের ক্ষেত্রে এই কবিতাগুলো শুধু কবিতার দায় নয়, একই সঙ্গে রাজনৈতিক দায়ও বহন করেছে।

কবিতা রাজনৈতিক দায় বহন করে কিনা সেটা পুরানা তর্ক। এর মীমাংসাও স্পষ্ট। নিশ্চয়ই করে। সেটা কবি ও কবিতার মর্জির ওপর যেমন নির্ভর করে, তেমনি নির্ভর করে বিশেষ সময় ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। মূল প্রশ্ন হচ্ছে কবিতাগুলো কবিতা হয়ে উঠেছে কিনা।

লেফটেনান্ট জেনারেল ট্রাক ও আরো কয়েকটি কবিতা নিউজপ্রিন্টে শিশিরের আঁকা স্কেচ নিয়ে প্রথমে বেরিয়েছিল। সামরিক শাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে এই কবিতাগুলোর ভূমিকা ছিল অসামান্য। এই ধারার কবিতা আলাদা করে বের করার মতো যথেষ্ট ছিল না। সেই কারণেই ‘খসড়া গদ্য’ পুস্তিকাতে কবিতাটি স্থান করে নেয়।

আপনি ঠিকই ধরেছেন এই গ্রন্থের অন্যান্য কবিতার মেজাজের সঙ্গে এই কবিতাটির পার্থক্য আছে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : কিভাবে লেখা হলো ‘অকম্মাৎ রপ্তানিমুখী নারীমেশিন’-এর কবিতাগুলো? ‘আমাদের ভালোবাসা, মেহেরজান’ ও ‘নিম্নপদস্থ সকাল সাড়ে সাতটা’ বিষয়ে বিশেষভাবে বলবার অনুরোধ করছি।

ফরহাদ মজহার : যখন অকস্মাৎ রপ্তানিমুখী নারীমেশিন লিখি তখন এখনকার মতো পোশাকশিল্প কারখানার বিকাশ ঘটে নি। কিন্তু সেই সময় বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক সংস্থা রপ্তানিমুখী উন্নয়নই বাংলাদেশের দেশগুলোর উন্নয়নের পথ—এই দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠছিল। এর সার কথা ছিল পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি এবং বিদেশের বাজারে কম দামে পোশাক রপ্তানিই আমাদের শিল্প বিকাশের পথ। কিন্তু মেশিনপত্র, কাঁচামাল, বিশেষত কাপড় আনতে হবে আবার বিদেশ থেকেই। সস্তা নারীশ্রম শোষণ করবার মধ্য দিয়ে নব্য ধনিক শ্রেণি গড়ে তোলাও এই নীতির অংশ। কিন্তু এর জন্য সস্তায় শ্রমিক পাওয়া দরকার। তার যোগান নিশ্চিত করা হয়েছে বাংলাদেশের দারিদ্র্য-পীড়িত গ্রামগুলো থেকে। সে গ্রামগুলো থেকে আসা কিশোরী মেয়েদের যখন ঢাকার রাস্তায় খুব ভোরে দল বেঁধে পোশাক তৈরি কারখানায় যাচ্ছে দেখি, তখন অস্ফুটভাবেই বলে উঠি, ‘আজ আমার প্রভাতের মধ্যে উটপাখি/ আজ আমার প্রভাতের মধ্যে উট এবং পাখি’। মনে হয়েছিল, ‘নির্বিকার এক প্রভাত উদিত হচ্ছে নির্বিকার এক শহরে’।

আমি প্রতিদিনই এই কিশোরী মেয়েদের দেখতাম আর ওদের জায়গায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে ত নিয়ে ভাবতাম।

বাংলাদেশের সুষম অর্থনৈতিক বিকাশের যে সম্ভাবনা ছিল, আমার মনে হয়েছে, রপ্তানিমুখী উন্নয়ননীতি তাকে জব্দ করে দিয়েছে। ফলে কবিতায় এসে গিয়েছে এই ধরনের বাক্য, ‘উড়ে যাবার ক্ষমতা নেই তোমার/পাখির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তুমি জন্মগ্রহণ কর অথচ পাখি হতে পার না’।

কবিতা এই ধরনের তথাকথিত ‘অকাব্যিক বিষয়’-কে কবিতার মধ্যে ধরতে সক্ষম কিনা তারই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল অকস্মাৎ রপ্তানিমুখী নারীমেশিন বইয়ের প্রায় সব কবিতাতেই।

একদিকে রপ্তানিমুখী উন্নয়ননীতির প্রতি অবিশ্বাস যেমন ছিল, ঠিক তেমনি এই কিশোরী মেয়েরা যে জগৎকে পেছনে ফেলে শহরে চলে এসেছে তার প্রতিও আমার কোনো মোহ ছিল না। ‘ওরা পেছনে রেখে এসেছে নিরন্ন গ্রাম, মন্বন্তর ও হাভাতে আঁতের মোচড়/ ওরা পেছনে রেখে এসেছে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা গ্রামীণ শৃংখল…’ ইত্যাদি। ফলে একই সঙ্গে লেখা হয়ে গিয়েছিল, ‘শহর শহর শহর—হোক এই শহর উটপাখির শহর/ কিন্তু কোথাও এই শহরে আছে ডানা, আছে স্বর্গীয় ভবিষ্যৎ/ তারা ভান করে পশ্চাৎকে ঠেকিয়ে তারা ভবিষ্যতে চলেছে’…ইত্যাদি।

________________________________________

কবিতা এই ধরনের তথাকথিত ‘অকাব্যিক বিষয়’-কে কবিতার মধ্যে ধরতে সক্ষম কিনা তারই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল অকস্মাৎ রপ্তানিমুখী নারীমেশিন বইয়ের প্রায় সব কবিতাতেই।

________________________________________

পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমার কবিতা বিভিন্ন সময় নানাভাবে দাঁড়াতে চেয়েছে। ‘আমাদের ভালবাসা মেহেরজান’ কবিতাটির মধ্যেও তার জের আছে পুরা মাত্রায়। যেমন, এই পদটি যে, ‘আমার ভালোবাসা একই সঙ্গে নারী এবং পুরুষ’। কিম্বা, ‘আমাদের অদ্বৈত একত্রীভবনের প্রতি এই পঙ্ক্তিমালা, মেহেরজান/ যুগপৎ নারী ও পুরুষের বিলুপ্তির দিকে লক্ষ্য রেখে প্রণীত হলো’। কবিতাটিতে ধর্মতত্ত্ব নারীকে যেভাবে পুরুষের পাঁজর থেকে তৈরি বলে দাবি করে তার তীব্র প্রতিবাদও ছিল।

আমি যখন পুরুষতন্ত্রকে কবিতায় মোকাবেলা করছি তখন নারীর প্রশ্ন বা নারীবাদ বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় ছিল না, বা আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে নি। বরং পুরুষ কবিদের কবিতায় নারীর অধঃপতনই দেখেছি। নারী যেন নিছকই যৌন কামনার বস্তুর অধিক কিছু নয়। কবিতায় নারী যেভাবে হাজির থাকত তাতে আমি একদিকে পুরুষ আর অন্যদিকে কবি হিশাবে খুবই বিব্রত বোধ করতাম। সম্ভবত সেই অস্বস্তি থেকে এই ধরনের কবিতা লিখিত হয়েছে।

‘নিম্নপদস্থ সকাল সাড়ে সাতটা’ ঢাকা শহরে নিম্ন মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী মানুষের সকালের ছবি আঁকার একটা চেষ্টা ছিল হয়তো। পোশাক কারখানার কিশোরী মেয়েদের দল বেঁধে ঢাকার রাস্তায় যাবার ছবি যেমন হঠাৎ মন কেড়েছিল, তেমনি নিম্নবিত্তের সকালের ছবিটা এই কবিতায় ধরতে চেয়েছিলাম। এতটুকুই মনে পড়ে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : মেঘমেশিনের সঙ্গীত কাব্যগ্রন্থের ছন্দ আমাকে পাঠকালে দুলিয়ে ভাসিয়ে নিয়েছে। একইভাবে কবিতার বোনের সঙ্গে আবারও। এ দুটি কাব্যগ্রন্থ পড়লে মনে হয় তিরিশের কবিদের চেয়ে নজরুল ও জসীমউদ্দীন আপনার বেশি আপনজন। আমার প্রশ্ন, মেঘমেশিনের সঙ্গীত-এর ভূমিকায় আপনার প্রশ্ন নিয়েই। আপনি প্রশ্ন করছেন, ‘মাত্রাবৃত্ত কি তাহলে বিপ্লবী যুগের ছন্দ?’—এ প্রশ্ন কেন? এ প্রশ্নের কোন মীমাংসায় কি পৌঁছেছেন? কবি ফরহাদ মজহারের ছন্দ-অনুধ্যান জানতে চাই।

ফরহাদ মজহার : হঠাৎ মনে হয়েছিল একটি কবিতার বই বের করব শুধু মাত্রাবৃত্তে। মাত্রাবৃত্তের প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ ছিল আমার। প্রথম যখন কবিতাপুস্তিকাটি বেরোয় তখন ভূমিকায় লিখেছিলাম, ‘…মাত্রাবৃত্তের পক্ষে একটু দাঁড়ানো দরকার, কারণ গদ্যে লেখা কবিতাকে বাদ দিলে স্বরবৃত্তের দিকে ঝোঁকটাই দেখছি আজকাল বেশি…অন্যদিকে অক্ষরবৃত্ত কি ছন্দ নাকি স্বরবৃত্তমূলক গদ্য? স্বরবৃত্তের চেয়ে যে একধাপ আগুয়ান, কিন্তু স্বরবৃত্তের স্বভাব যে এখনো ত্যাগ করে নি’।

এই কবিতাগুলো লেখার সময় আমার মনে হতো মাত্রাবৃত্তে কোথায় জানি মেঘের স্বভাব আর মেশিনের পদার্থবিদ্যা একাকার হয়ে আছে। এই ছন্দে লিখতে গেল আলুথালু আর গড়িমসি চিন্তার সঙ্গে একটা রফা না সেরে বসলে কবির পক্ষে মাত্রাবৃত্তে লেখা কঠিন। অর্থাৎ আটোসাঁটো বাঁধুনি ও নিয়মের কাছে ধরা দিয়েই কেবল কবিকে মাত্রাবৃত্তে লিখতে হয়। দাবি করেছিলাম বিপ্লবের যুগে মানুষের সকল চিন্তা ও মনীষা অবশ্যই একটি পরিকল্পনা খাড়া করে কাজ করে। ঠিক তেমনি ছন্দের একটা সুমসাম পরিকল্পনা মাথায় না রাখলে বুঝি মাত্রাবৃত্তে কবিতা লেখা কঠিন। এই ধরনের কাব্যিক আবদারের ওপর দাঁড়িয়েই প্রশ্ন করেছিলাম মাত্রাবৃত্ত কি তাহলে বিপ্লবী যুগের ছন্দ?

একান্তই কবির প্রশ্ন। এর উত্তর অনুসন্ধানের কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক আকুতি তখন ছিল কিনা মনে পড়ে না। এখনও নাই। প্রশ্ন তোলার মধ্য দিয়ে খানিক কাব্যিক বিস্ময় উৎপাদনই সম্ভবত আকাঙ্ক্ষা ছিল।

________________________________________

তবে বাংলাদেশে এই চিন্তা প্রবল যে, ধর্মের সঙ্গে প্রগতিশীলতার বিরোধ মীমাংসার অতীত। ধর্মমাত্রই প্রতিক্রিয়াশীল একটা ব্যাপার। আর যদি সেটা ইসলাম হয় তো তাহলে আর কোনো কথাই নাই।

________________________________________

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : এবাদতনামা-কে বাংলা কবিতার একটি বড় ঘটনা বলা যায়। এ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো নিয়ে আমার অনেক প্রশ্ন। প্রথমে এর প্রকাশ পরবর্তী সময়ে কী প্রতিক্রিয়া আপনি পেয়েছেন সেসব শুনতে চাই।

ফরহাদ মজহার : দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। যাঁরা বাংলা কবিতার ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন, বাংলা কবিতায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে আগ্রহী, তাঁরা এই কবিতা পুস্তিকাটি প্রকাশের পরপরই লুফে নিয়েছিলেন এবং অকাতরে প্রশংসা করেছেন। চেষ্টাটাই ছিল অভিনব। কাব্যভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার গুরুত্ব তাঁরা অনায়াসেই ধরতে পেরেছিলেন। তাঁরা এটাও বুঝেছিলেন যে, বাংলার ভাব, ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে থেকে আমি আশলে কী মোকাবেলা করবার চেষ্টা করছি। আমার দাবি ছিল আধুনিকতার মোকাবেলা করতে গিয়ে নিপীড়িত জাতি ও ধর্মবোধ নিপতিত হয়েছে পাঁড় রক্ষণশীলতায়, এবং নিজ নিজ ধর্ম ও জাতিবোধের পরিণতি ঘটেছে চরম অসহিষ্ণুতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতায়। অথচ প্রতিটি ধর্মভাবের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, টেনশান ও অগ্রসর চিন্তা নির্মাণের উপাদান রয়েছে তাকে আমরা উপেক্ষা করে চলেছি। তাকে যদি আমরা বাংলাভাষা ও ভাবের মধ্যে আত্মস্থ করতে না পারি তাহলে আমাদের ভাব, ভাষা ও সংস্কৃতির বাইরে একটা ধর্মতাত্ত্বিক, সাম্প্রদায়িক ও চরম প্রতিক্রিয়াশীল রূপ নিয়ে ধর্ম হাজির হবে, যাকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা হবে কঠিন কাজ। যে কারণে দাবি করেছিলাম, এবাদতনামা একদিকে সাম্রাজ্যবাদ অপরদিকে প্রতিক্রিয়াশীলতার কবল থেকে নিজেদের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধারের একটা প্রচেষ্টা। এবাদতনামা একদিকে নতুন চিন্তার ধারা হিশাবে যেমন সাড়া জাগিয়েছিল, অন্যদিকে এমন এক পাঠকশ্রেণি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল যারা আধুনিক কবিতা সাধারণত পড়ে না। কিম্বা কবিতাই পড়ে না। এরা বাংলাদেশের অতি সাধারণ মানুষ। আমি এদের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছি আন্তরিকভাবে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে একটা সম্পর্ক চেয়েছি।

তবে বাংলাদেশে এই চিন্তা প্রবল যে, ধর্মের সঙ্গে প্রগতিশীলতার বিরোধ মীমাংসার অতীত। ধর্মমাত্রই প্রতিক্রিয়াশীল একটা ব্যাপার। আর যদি সেটা ইসলাম হয় তো তাহলে আর কোনো কথাই নাই। ইসলামকে দানবীয় করে তোলার যে সাম্রাজ্যবাদী প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখে আসছি, তাঁরা সেই ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন নন। তাঁদের অনেকে অস্বস্তি বোধ করেছেন, অনেকে আমার নিন্দাও করেছেন। তাদের অনেকে বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দ থাকুক সেটাও অপছন্দ করতেন। কিন্তু মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলেন কারণ কবিতায় ঠাকুর রামকৃষ্ণ, শ্রী চৈতন্য, কালী—সকলেই এসেছেন অনায়াসে। বাংলা ভাষা, বাংলা কবিতা ও বাংলার ভাবের প্রশস্তি গাওয়া হয়েছে সর্বত্র। ফলে এদের আপত্তি শেষাবধি টেকে নি। শেষমেষ, আপনি যেমন বলেছেন, এবাদতনামা বাংলা কবিতার একটি ‘বড় ঘটনা’, সেই সত্যই আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : এবাদনামা ১২, ‘বাংলা তোমার নয়’-এ আপনি আল্লাকে বলছেন, খুশি আমি, বাংলা তোমার নয়, যদি হতো তবে—/বেহুদা তোমার ডাঁট বেড়ে যেত বাংলার গৌরবে।—এই যে বাংলা ভাষার সাথে আল্লার হরফ মানে আরবি নিয়ে আল্লার সাথে বাহাস, আপনার এই চিন্তা তো বাংলা কবিতায় এক্কেবারেই নতুন! এত সাহস এত হিম্মত কি আপনি বাঙালি বলেই করতে পারলেন? না, আরো ছোট করে ঐতিহাসিক কারণে করলেন? জাতীয়তাবাদে বা এথনোসেন্ট্রিজমে কি আপনার আস্থা আছে?

ফরহাদ মজহার : অবশ্যই আমি বাংলা ভাষার কবি, বাংলা ভাষার মধ্যে আমার বসবাস, আমার ভাবের সরোবর আমার নিজের ভাষা। ইসলাম এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম, কিন্তু তারা আরব নয়, ইরানি নয়। শুধু মুসলমানদের নয়, প্যালেস্টাইন, ইরাক বা আফগানিস্তানের জনগণসহ দুনিয়ার যে কোনো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ন্যায় সঙ্গত লড়াই সমর্থন প্রগতিশীল রাজনীতির অন্তর্গত। আমি বাংলাভাষী, কিন্তু বাংলাদেশের অন্যান্য জাতি বা ভাষাগোষ্ঠীর নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার অধিকারের পক্ষে আমাকে দাঁড়াতেই হবে, কারণ ওর মধ্য দিয়েই আমি আমার নিজের ভাষা ও ভাবের মধ্যে বসবাসের হক আদায় করি।

ফলে বাংলা ভাষার পক্ষে আল্লার সঙ্গে বাহাস করাটাই তো আমার পক্ষে স্বাভাবিক। অন্য ভাষার কবি তার ভাষার পক্ষে একইভাবে বাহাসে লিপ্ত হতেই পারে। এটা শুধু বাঙালি হওয়া না-হওয়ার ব্যাপার নয়, যে কোনো ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে এই বাহাস সম্ভব। কবিতাটি সেই সম্ভাবনার দিকেই নির্দেশ দেয়।

নিপীড়িত জাতির মুক্তি সংগ্রামে নিঃশর্ত সমর্থন দেওয়া আর ‘জাতীয়তাবাদী’ হওয়া এক কথা নয়। জাতীয়তাবাদ ফ্যাসিস্ট রূপ নিতে পারে। সে সম্ভাবনা থাকে বলে আমি জাতীয়তাবাদে সন্দিহান। কোনো প্রকার এথনোসেন্ট্রিজমে আমার আস্থা নাই।

অন্যদিকে জাতীয় নিপীড়ন বা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হলে একটি জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করা দরকার। এই ধরনের লড়াইয়ের দরকারে ঐতিহাসিক কারণেই একটা বয়ানের দরকার হয়। একাত্তর সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ানের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে সে কারণে খাটো করে দেখা উচিত নয়। কিন্তু এখন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে নতুন বয়ান দরকার। আমরা আমাদের জনগোষ্ঠীকে কিভাবে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ রাখব, সেই বিষয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। এবাদতনামা সেই দিক থেকেও পাঠ করা যেতে পারে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আজ আছি কাল নাই, কাল যদি না থাকি তো প্রভু/আমার এ জায়নামাজ লোকে যেন রাখে হেফাজতে/হাঁটু ও পায়ের নানা আলামতে ছেঁড়াখোঁড়া; লোকে/এবাদত যেন বোঝে—তৎসঙ্গে বোঝে ইতিহাস (এবাদতনামা ৩২, কচি হাঁটু কচি পায়ে)—এইখানে জায়নামাজ হেফাজতে রাখা আর এবাদত বোঝার সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্কটা কী রকম?

ফরহাদ মজহার : এবাদতনামা-র যে ‘এবাদত’ তাকে তো ধর্মের জায়গা থেকে বোঝা যাবে না, বিশেষত পাশ্চাত্য অর্থে একে যদি আমরা ‘রিলিজিয়ন’-এর বাংলা অনুবাদ হিশাবে বুঝি। কিম্বা নিছকই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অবস্থান থেকেও নয়। অন্যদিকে ইসলামসহ সব ধর্মকেই তো আমরা মোল্লা-পুরোহিত-যাজক শ্রেণির বাইরে সাধারণ মানুষের লড়াই সংগ্রামের জায়গা থেকে বোঝার চেষ্টা করি না। যে কারণে এই দেশের জনগোষ্ঠীর বেড়ে ওঠার ইতিহাসের মধ্যে থেকেই এই ‘এবাদত’।

এই কবিতায় তারই উদ্যাপন আছে। আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, আমাদের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের দিকে কবিতাটি নজর ফেরাবার ইশারা দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, নদীয়ার চাঁদ শ্রী গৌরাঙ্গ শচী মায়ের সঙ্গে যে বালখিল্য খুনসুটি করেছিলেন সেই ইতিহাস মনে রাখতে হবে। সোজা কথায় ফকির লালন শাহের কথা মতো ‘নদীয়ার ভাব’-কে বাদ রেখে বাংলা ভাষা, কাব্য বা দর্শনের কোনো মানে দাঁড়ায় না, বাংলাদেশের ইতিহাস কথাটারও কোনো অর্থ হয় না। ফলে এই ‘এবাদত’ ভিন্ন এক এবাদত যা ইতিহাসকে তার প্রার্থনার মর্মে রেখে নতুন ভাবের ভজনা করছে, কবিতার নতুন সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত দেবার চেষ্টা করছে। সহজেই বলতে পেরেছে :

‘গোরাচাঁদ নেচে যায় হাসিয়া কাঁদিয়া নাচে প্রেমে/সঙ্গে অদ্বৈতাচার্য ঊর্ধে্ব তুলি বেহুঁশ দু হাত/ প্রভু দেখ নাচিতেছে; নাচিতেছে কাহার এশেকে/ একবার দেখে যাও, এসে শুধু দেখো গো চাহিয়া!’

কবির আকুতির মধ্যে কবির জায়নামাজ ইতিহাসের কোথায় পাতা হয়েছে তার ইঙ্গিত রয়েছে। জাতপাত-বিরোধী, শ্রেণি ও নারীপুরুষ ভেদবিরোধী সকল সাম্প্রদায়িকতা ও আত্মপরিচয়ের ঊর্ধ্বে রাখা এই জায়নামাজ হেফাজতে না রাখলে আমরা এগিয়ে যাব কী করে?

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : এবাদতনামা ৫১-তে আপনি শ্রী শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর সঙ্গে নামাজ আদায় এর কথা বলেছেন। গৌরাঙ্গ তো মুসলমান না, তিনি কিভাবে নামাজ আদায় করবেন?

ফরহাদ মজহার : এবার তাহলে বুঝুন, আমি নামাজ, এবাদত ইত্যাদি কী ভাব ব্যক্ত করবার জন্য ব্যবহার করেছি। বলেছি, ‘গোস্বামীরা বোঝে নাই। নদীয়ায় প্রভু নিরঞ্জন/স্বয়ং মর্তে এসে প্রেমভাবে করেছিলা বঙ্গদর্শন’। এই পদটির ওপর পুরা কবিতাটি দাঁড়িয়ে আছে।

‘এবাদতনামা’ তো কোনো মুসলমান কবির কবিতার বই নয়, বাংলা ভাষা ও ভাবের মধ্যে যে কবির বসবাস সেই কবির রচনা। তার বেড়ে ওঠার ইতিহাসে জৈন, বৌদ্ধ, হিন্দু, ইসলাম, খ্রিস্টিয় সবই রয়েছে। ফলে যে সম্প্রদায়েই কবির জন্ম হোক, সাম্প্রদায়িকতার সীমানা তো কবি অতিক্রম করে যাবেই। সেটা সম্ভব, অনায়াসেই সম্ভব। ‘এবাদতনামা’ লিখতে গিয়ে সেই চেষ্টা করেছি। কিন্তু কবি করলে কী হবে, পাঠকের মধ্যে যদি সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি থাকে তাহলে তাকে কবি কিভাবে অতিক্রম করবে?

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : এবাদতনামা ৩৬, ‘বিবি খদিজা’য় আপনি বলছেন—সব নারী জানে তুমি খাটো হয়ে আছো এইখানে/ তোমার খাতিরে কভু প্রকাশ্যে তা জাহির করে না—এই যে নারীরে আপনি সবার উপরে জায়গা দিলেন, এর কদর রাখতে হলে বর্তমান নারীসমাজের প্রতি কবি, বুদ্ধিজীবী, নারীর সুহৃদ ফরহাদ মজহারের বক্তব্য কী?

ফরহাদ মজহার : সব নারী জানে কিভাবে এর কদর রাখতে হবে। আমি কবি হিশাবে কবিতা লিখেছি, নিজের দায় ও কর্তব্য পূরণের জন্য। কিন্তু নারীকে তার লড়াই-সংগ্রামে কোনো পুরুষের উপদেশ দেওয়ার পক্ষের লোক আমি নই। সেই ধৃষ্টতাও আমার নাই। বাংলাদেশের মেয়েরা যথেষ্ট সক্ষম এবং এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতাসম্পন্ন অনেকেই আমাদের সমাজে আছেন। আমাদের কাজ তাদের পাশে থাকা এবং সমর্থন দিয়ে যাওয়া। সে ক্ষেত্রে যদি কবিতাগুলো পুরুষদের মধ্যে কোনো অনুপ্রেরণা তৈরি করতে পারে, তাতেই আমি খুশি।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : অসময়ের নোটবই-এ আপনি লিখেছেন কবিতা ‘বিদ্রোহী জাহানারা আসছে’। জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী জাহানারা ইমামকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন আপনার কোন রাজনৈতিক অবস্থান থেকে?

ফরহাদ মজহার : জাহানারা ইমাম জাতীয়তাবাদী ছিলেন কিনা সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। তাঁর জাতীয়তাবাদ কি জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত দলীয় রাজনীতির বয়ানের সঙ্গে তুল্য, নাকি তার বিচার আলাদা? তাছাড়া রাজনীতির জায়গা থেকে তাঁকে বিচার করা তো কবিতার কাজ নয়। তিনি নানা কারণে মুক্তিযুদ্ধের একটা প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। যা কবি হিশাবে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। ক্যান্সারের সঙ্গে তার লড়াইয়ের মধ্যে একটা অভূতপূর্ব তাৎপর্য ছিল, যা আমাকে গভীর ভাবে নাড়া দেয়। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা আনা হয়েছিল, এই মামলা মাথায় নিয়ে তিনি দেশের বাইরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মরদেহ উড়োজাহাজে যখন বাংলাদেশে আনা হয়েছিল সে দিনটিকে আমি এই কবিতায় উদ্যাপন করতে চেয়েছি।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : অনেকের মতে, দরদী বকুল আপনার সেরা কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থে আপনিই পৃথিবীর সুখে ও অসুখে রাষ্ট্রবিজ্ঞান হয়ে উঠতে চেয়েছেন। আপনার পদ্য এত পাঠের পথ খোলা রাখে যে কেউ—আপনার জবানিতেই আছে—কেউ তাকে পদ্য বলে, কেউ বলে উদ্ভিদবিজ্ঞান। আবার বকুল নগরে আপনি ম্লেচ্ছ হয়ে সৈয়দ, ব্রাহ্মণের লাথি খাচ্ছেন—দরদী বকুল কাব্যগ্রন্থ নিয়ে এই কাব্যের পাঠক ফরহাদ মজহারের কাছে তার অনুভূতি ও চিন্তার অবস্থান জানতে চাই।

ফরহাদ মজহার : যাঁরা গীতিকবিতা পছন্দ করেন তাদের ভালো লেগেছে, জানি। আমি তো সবসময় কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি, এটাও একটা পরীক্ষার ফল।

নিজের কবিতা সম্পর্কে কবির অনুভূতি ও চিন্তা ব্যক্ত করা কঠিন কাজ। কী চিন্তা কাজ করেছে সেটা তো কবিতা হয়ে ‘দরদী বকুল’ বইটিতে রয়েছেই। যদি আলাদা করে গদ্যেই বলতে পারতাম তাহলে কবিতা লিখলাম কেন?

তবে এই সময় কবি হিশাবে আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটছিল, বুঝতে পারছিলাম। কাব্যিক রূপান্তর। কিন্তু তার পুরা তাৎপর্য আমার কাছে এখনও পুরাপুরি ধরা দেয় নি। হয়তো এই ধরনের কবিতায় আমি আবার ফিরে যাব।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

ফরহাদ মজহার : আপনাকেও ধন্যবাদ শিমুল।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top