কবিতা, প্রেম, ম্যাজিক, বাস্তব ও সিনেমা

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ও তাসমিয়াহ্ আফরিন মৌ-এর আলাপচারিতা (প্রতিপক্ষ আর্কাইভ থেকে)

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (১৯৪৪-২০২১)

২০১৪ সালে ঢাকায় চলচ্চিত্রকার ও কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ঢাকার তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক তাসমিয়াহ্ আফরিন মৌ। ওই বছরেই ‘প্রতিপক্ষ’ অনলাইন পত্রিকায় সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর প্রয়াণের পর আমরা সেই সাক্ষাৎকারটি পুনঃপ্রকাশ করছি।
– সম্পাদকীয় দফতর, ‘প্রতিপক্ষ’।

আলাপচারিতার সূচনায় তাসমিয়াহ্ আফরিন মৌ লিখছেন,

রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি আহমেদ মুজতবা জামাল (শোভন ভাই) ফোন করে বললেন, কাল তুমি ফ্রি আছো? আমার অফিসে ছোট একটা পার্টি আছে। আমতা আমতা করলাম, অ্যা হ্যাঁ… কীসের পার্টি শোভন ভাই? তিনি সাবধানী গলায় মধু ঢেলে বললেন, আগে বল কাল কী অবস্থা তোমার? আমার আমতা আমতা করার কারণ তিনি জানেন। আমি সাধারণত কোনো পার্টিতে যাই না। নিজেকে সেখানে খুবই খ্যাঁত আর বেমানান লাগে এবং আমার হাসি পায়। আমি হাসি চাপতে পারি না এবং এলিট মানুষজন বিরক্ত হয়। শোভন ভাই আমার গলার স্বর শুনে ফাইনালি বললেন, কাল রেইনবোতে গৌতম ঘোষ এবং বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আসবেন। দুপুরে খাবেন। বাচ্চু ভাইও (নাসির উদ্দীন ইউসুফ) আসবেন। আরো কয়েকজনকে দাওয়াত করেছি। আমি বুদ্ধদেবের কথা শুনে সমস্ত আঁতলামি ঝেড়ে ট্রেনের গতিতে বলে উঠলাম, অবশ্যই আসবো! সব কাজ বাদ! শোভন ভাই বলে দিলেন ভাল ছানার সন্দেশ নিয়ে আসতে। ওকে, তাই সই।

পরদিন যথারীতি মিষ্টি কোলে হাজির হলাম। সবার আগে। মাথায় দুনিয়ার প্রশ্ন নিয়া বসে আছি। কীসের পর কী এবং কেন’র পর কী জানতে চাওয়া হবে, তা মাথার ভেতর আওড়াচ্ছি। বলাবাহুল্য সকল প্রশ্ন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত’র জন্য। অনেকের শুনতে ভালো লাগবে না, তবে বলে রাখা ভাল, ‘মনের মানুষ’ দেখার পর থেকে আমি গৌতম ঘোষের সিনেমার প্রতি আগ্রহ হারায় ফেলছি। কিছুক্ষণ পর গৌতম ঘোষ ম্যানলি ফিগার নিয়ে উদয় হলেন, তার পাশে ছোটখাট মাথায় চুল কম একজন মানুষ। হালকা সবুজ রঙের শার্ট, আকাশী জিন্স আর ভুড়িসহ মুখে লাজুক হাসি। যে কেউ, যে কারো মত সাধারণ। আমি মানুষটার চোখের দিকে তাকালাম। একজন শিল্পীর চোখ। 

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আবহাওয়া নিয়ে কথা বলতে বলতে চেয়ারে বসলেন। আমি তার পিছনে দাঁড়ালাম, মুখ নিচু করলাম আর আবেগের আতিশয্যে বলে ফেললাম, বুদ্ধদেব দা, আপনাকে আমি অনেক ভালবাসি!

তিনি আমাকে অবাক হয়ে দেখলেন এবং হাসলেন। জ্ঞানী ব্যক্তি যখন বিনয়ী এবং ভাল মানুষ হন, সত্যিকারের শিল্পী হন, তখন তাঁর প্রতি আমার বিনম্র ভক্তি আর ভালবাসা কাজ করে। তিনি বললেন, কী নাম তোমার? আমি আমার নাম বললাম এবং প্রশ্ন করতে চাইলাম। তিনি প্রশ্ন করতে বললেন, আমি করলাম এবং সেই সময় কাঁধে ট্রাইপড আর বুম হাতে এক জার্নালিস্ট এসে হাজির হলেন উইথ ক্যামেরা পারসন। এবং আসলেন আরো আরো রথি রথি গেস্ট। তিনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না। সাংবাদিকের কাছে অদ্ভুত সমস্ত প্রশ্নের জবাব, খাওয়া দাওয়া আর বিকালের অনুষ্ঠানে যোগদানের তাড়ার মাঝেই বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কয়েকবার বললেন, তোমার প্রশ্নের তো উত্তর দেয়া হলো না!

যাওয়ার সময় বললেন, কাল সকালে নাস্তার সাথে একটা মিটিং আছে। ১১টায় চলে আসো আমি যেখানে আছি। তোমার সাথে কথা বলা যাবে। পরশু ভোরে তো ফ্লাইট। আমি পরদিনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম আর পরদিন এসে গেল। ধানমন্ডির এ্যামব্রোসিয়া গেস্ট হাউজে দুই ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক উঠেছেন। আমি কাঁটায় কাঁটায় ১১টায় হাজির হয়ে দেখি নাস্তা শেষে ফটোসেশন চলছে।

ডাইনিং টেবিলেই বুদ্ধদেবদা’র সাথে বসলাম এবং কী প্রশ্ন করবো সব ভুলে গেলাম। যদিও খাতায় কিছু প্রশ্ন লিখে এনেছি। কিন্তু এসেই ওনার সামনে খাতা বের করতে লজ্জা লাগলো। মোবাইলটা বের করে বললাম, দাদা আপনার কথা রেকর্ড করি? বুদ্ধদেব বললেন ক্যান এটা দিয়া কী করবা? আমি বললাম, ধরেন, যদি কোথাও ছাপাই। এই আর কী!  বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আমার প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করছেন।

আমি বললাম, দাদা, আমি আপনার কাছে সিনেমা শিখতে চাই।

বুদ্ধদেব বললেন, শিখতে যদি চাও তাহলে কিন্তু আমার কাছে শিখা একটু অসুবিধা। যদি আমি কখনো কো-প্রডাকশান করি এখানে, ভাবছি, তাহলে তুমি সেখানে অবশ্যই থাকবে। কিন্তু তোমার পক্ষে কলকাতা গিয়ে থাকা তো সম্ভব না! দেড় মাস দুই মাস লাগবে। তার জন্য দেখছি এখানেই যদি করি তুমি থাকবে। আর সবচেয়ে যেটা ভাল, তুমি কি কবিতা পড়ো?

আমি বললাম, পড়ি, কিন্তু খুব বেশি না…

বুদ্ধদেবদা বললেন, কবিতা বেশি করে পড়বে। কবিতার জগত বেশি করে বুঝবে। এখানকার কবিতা পড়ো। ইংলিশ কবিতা তো আছেই। আমার মা ঢাকার মেয়ে কিন্তু!

আমি বললাম, আচ্ছা।

আলাপ: বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর মুখোমুখি তাসমিয়াহ্ আফরিন মৌ

সিনেমার একটা নিজস্ব ভাষা আছে। এই ভাষাটা আন্তর্জাতিক ভাষা। সেই ভাষাটা শিখতে হবে। একদম নিজের মতো করে ভাববে। একদম নিজের মতো করে দেখবে। তুমি নিজের কাছে স্পষ্ট থাকবে। আর এখন তো সবকিছু অনেক সোজা হয়ে গেছে। এখন তো তুমি নিজেই একটা ভাল ক্যামেরা কিনতে পারো, ডিজিট্যাল। বা কয়েকজন বন্ধু মিলে কিনতে পারো। বা খুব কম পয়সায় ভাড়া নিতে পারো। সেটা দিয়ে নিজেই ছবি বানাতে পারো। বড় আর্টিস্ট, বড় ক্যামেরা সেগুলো তো প্রয়োজন নেই।

বুদ্ধদেব: আমার মায়ের বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার। পুরোনো পল্টনে বাড়ি। মা অনেক গল্প করতো এখানকার। মা বলতো, মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবি না, চোখ বন্ধ। চোখ বন্ধ করে শুন। চোখ বন্ধ করে শুনে শুনে দেখতাম যে অনেক ছবি আসছে। অনেক ছবি চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যায়। সে ছবিগুলোর যে সব একটার সাথে আরেকটার যোগাযোগ আছে তা না, তবে একেকটার ম্যুড একেকরকম। তারপর মা কবিতা আবৃত্তি করতো। তখনো মা বলতো চোখ বন্ধ করে শুনতে। সেরকম কবিতা নয় যে শুধু নন্দনতত্ত্ব…। আমি বলছি অন্য জাতের কবিতা। যেমন জীবনানন্দ দাস, যেমন শঙ্খ ঘোষ, ইলিয়ট। দেখবে মাথার ভেতর অনেক চিন্তা নিয়ে এসছে। আর একটা জিনিস দেখবে। পেইন্টিং এক্সিবিশন। চোখ বন্ধ করে ভাববে। কোনো কবিতা পড়ে ভাববে। আর এর বাইরে আর একটা জিনিস মনে রাখবে। নিজের ভাষা তৈরি করবে। তোমার নিজস্ব একটা ভাষা তৈরি করতে হবে যাতে বুঝা যায় এটা তোমার তৈরি। এই ল্যাঙ্গুয়েজটা অন্য কারো মত নয়, তোমার মতো। তাহলে কী হবে, আমি যেখানেই থাকি তোমার ছবি, তোমার নাম না দেখেও বুঝতে পারবো এটা তোমার ছবি। আর চারপাশে যে সব ছবি হচ্ছে তা বিশ্বাস করবা না।

মৌ: কী বিশ্বাস করবো না?

বুদ্ধদেব: এই যে চারপাশে যে ছবি হচ্ছে, তা সিনেমা বলে বিশ্বাস করবা না। এগুলো খারাপ সিনেমা হচ্ছে। আর তুমি যদি এগুলোকে বিশ্বাস কর, তাইলে তুমি ভাবতে গিয়ে বাধা পাবে। এগুলো কোনোটাই সিনেমা নয়। বুঝতে পেরেছো? এমন বিষয় নিয়ে কাজ করবা যেটা সার্বজনীন। যেটাতে দেশ কাল সমাজ মানুষ আছে। বাংলা ছবিই বানাবা কিন্তু সব দেশের মানুষ যাতে নিজের ছবি মনে করে। মানুষ যেটাতে থাকে। মানুষের মন খারাপ, মানুষের ভাল লাগা, ভালোবাসা এসব তো সবদেশে একই রকম। মানুষ তার অনুভূতি যেন সিনেমার মধ্যে বুঝতে পারে। যোগাযোগ করতে পারে। যদি ভাবো, তবে এমন ছবি ভাবো, যা তোমাকে আনন্দ দিবে! আল্লাহকে ডাকা যেমন সাধনা। এটাও সেই সাধনার বিষয়! আরেকটা জিনিস করবে কী, ছবি তুলবে। প্রচুর ছবি তুলবে। পাগলের মত ছবি তুলবে। ডিজিটাল না, ফিল্মে। এখানে ফিল্ম এখন পাওয়া যায়? কলকাতায় পাওয়া যায় যখন তখন এখানেও পাওয়া যাবে নিশ্চই। একটা মেয়ের কথা বলি, সোহিনী। ভাল চাকরী করতো। খুব ভাল নাচ জানে। চাকরী বাকরী ছেড়ে আমার কাছে এসে কাজ শিখছে। কাজ করছে। দশ বছর হয়ে গেল আমার সাথে। এখন নিজে ছবি করছে। হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছি। সোহিনী দেখতে খুবই সুন্দর। প্রচুর নায়িকার অফার পেয়েছে। কিন্তু ও কোন লোভে পা দেয়নি। এখন নিজে সিনেমা বানাচ্ছে।

মৌ: আপনার সিনেমায় অনেক কঠিন রাজনৈতিক বিষয়, এমন কি সম্পর্কের টানাপোড়েনও অনেক কাব্যিকভাবে আসে। স্ক্রিপ্ট করার সময় কীভাবে করেন?

বুদ্ধদেব: ভাবো। ভাবলেই স্ক্রিপ্ট লিখবে না। ভাবনার সাথে থাকবে। ভাবনার সাথে বসবাস করা একটা বড় বিষয়। প্রেমিকের সাথে বসবাস করলে বুঝতে পারবে, সে কেমন, সে তোমাকে চায় কিনা, তুমি তাকে চাও কিনা? তোমাকে যদি না চায় তবে তিনমাস পর ফুস! তোমাকে ছেড়ে যাবে। তেমনি একটা ভাবনাকে বুঝতে হয়। কতটা সে আমার কাছের। কতটা নিতে পারবো। তিন মাস পর যদি সে তোমার সাথে থাকে তাইলে বুঝতে পারবে, ভারী মজার তো! এই তো সেই মানুষ যাকে আমি খুঁজছিলাম! মনে হয় না? এই ভাবনাটাকেই তো আমি চাই। লিখবে না। সাথে সাথে লিখবে না। তাকে তোমার সাথে থাকতে দিবে, তুমিও তার সাথে থাকবে। ভাবনাটাকে বন্ধ করবা না। সত্যজিৎ যেমন স্কেচ করে শুটিং-এ যেতেন আমি তেমন করি না। শুটিং এ গিয়েও নতুন ভাবনা আসতে পারে।

মৌ: আপনি শট ডিভিশনও করেন না?

বুদ্ধদেব: করি। যেটা দরকার সেটা করি। আমার অনেকগুলা স্ক্রিপ্ট নিয়ে একটা সংকলন বেরিয়েছে। দে’জ থেকে। আগে জানলে তোমার জন্য নিয়ে আসতাম।

মৌ: আমি আপনার ‘ফেরা’র স্ক্রিপ্টটা পড়েছি। আর দে’জ থেকে বের হয়েছে যখন, তাইলে এখানেও পাওয়া যাবে। আমি নিয়ে নেব। 

বুদ্ধদেব: তুমি যদি আগে থেকেই ভেবে রাখো সবকিছু তাইলে মুশকিল হচ্ছে যখন তুমি শুটিং-এ যাচ্ছো, তখন অনেক কিছু মিস করবে। তার জন্য শুটিং-এ যাওয়ার আগেই ভাবনাটা বন্ধ করে দিবে না, শুটিং এ যেয়েও ভাবনাটাকে আসতে দিবে। তুমি ‘উত্তরা’ ছবিটা দেখেছো? শেষ দৃশ্যে পাথরটা গড়িয়ে পড়ছে? প্রতিদিন শুটিং-এ আমি পাথরটাকে দেখতাম। একদিন মনে হল পাথরটা আমাকে বলছে, আমিও তো অ্যাক্টিং করতে পারি! আমাকে একটু অভিনয় করাও না! তারপর পাথরটাকে গড়িয়ে পড়ার শুটিং করি। 

মৌ: হা হা হা..!

বুদ্ধদেব: সবসময় ভাবার দরজাটা খোলা রাখবা। আমাকে লোকে বলে, আপনার ছবিগুলো এরকম কেন? আমি বলি, আমি ছবিতে বাস্তবতা মেশাই, তার সাথে একটু স্বপ্ন মেশাই, তার সাথে একটু ম্যাজিক। তারপর জোরসে শেক করি। হা হা হা। এইভাবে। (হাত ঝাঁকিয়ে দেখান) খারাপ ছবিকে সিনেমা বলে বিশ্বাস করলে হবে না। আর এগুলোকে বিশ্বাস যদি তুমি করতে শুরু কর তাহলে কিন্তু শেষ! এরকম ছবি যারা করে তারা কিন্তু কোথাও পৌঁছাতে পারে নাই। তুমি কলকাতায় বসে কী বানাইছো, পত্রিকায় আসছে, কী ব্যবসা করছে…. এগুলো কিন্তু বিশ্ব সিনেমায় থাকে না। সেখানে জায়গা করে নিতে পারেনি।

মৌ: আপনার সিনেমাতে খুবই কঠোর বাস্তবতার গল্পগুলাই দেখি। সম্পর্ক, অর্থনৈতিক সমস্যা। কিন্তু তারপরেও এগুলোর মধ্য থেকে নতুন অর্থ তৈরী করে। কবিতা তৈরী করে। এই চাঁছাছিলা কঠোর গল্প কীভাবে এত পোয়েটিক হয়ে উঠে? আসলে এই দুইটা বিষয়কে কীভাবে মিলান? কীভাবে চিন্তা করেন বা মেকিংটা আগায়?

বুদ্ধদেব ধৈর্য্য হারান না। বলেন, তোমাকে একটা কথা বললাম না যে, আমি আসলে…. আমার মতো অনেকেই করতে গেছে। করতে গেছে, পারেনি। বিষয়টা হাসাহাসির জায়গায় গেছে। যেহেতু আমি কবিতা লিখি, শুধু কবিতা লেখাই না, কবিতা চলেই আসে। … আবার সিনেমা দিয়েও কবিতা অনেকসময় অনুপ্রাণিত হয়। আর সব সময় তো ভাববেই। বাস দিয়ে যাওয়ার সময়ও তুমি দেখছো, এই যে বাস্তব তুমি চোখের সামনে দেখছো। কিন্তু তোমার দেখার বাইরেও আরো একটা জগত আছে! যে দেখাটা তোমাকে দেখতে শিখতে হবে। দেখতে জানতে হবে। চারপাশের অনেক কিছু ছড়ানো সমস্ত কিছুর মধ্যে তুমি দেখবে ছন্দ আছে। সমস্ত কিছুর মধ্যে কবিতা আছে। আমি প্রচুর মিউজিক শুনি। সব ধরনের মিউজিক শুনি। শাস্ত্রীয় সংগীত শুনি। আমি অনেক ধরণের শব্দ শুনি। হাওয়ার শব্দ, গাছের পাতার শব্দ, বিদ্যুত চমকের শব্দ, নদীতে পানি বয়ে যাওয়ার শব্দ, যা যা আছে সব শুনবা! চুপচাপ শুনবা। দেখবা, দেখতে পাচ্ছো… এই যে দেখতে পাচ্ছো, এই ইমেজটা নিয়ে আসবা। সিনেমার একটা নিজস্ব ভাষা আছে। এই ভাষাটা আন্তর্জাতিক ভাষা। সেই ভাষাটা শিখতে হবে। একদম নিজের মতো করে ভাববে। একদম নিজের মতো করে দেখবে। তুমি নিজের কাছে স্পষ্ট থাকবে। আর এখন তো সবকিছু অনেক সোজা হয়ে গেছে। এখন তো তুমি নিজেই একটা ভাল ক্যামেরা কিনতে পারো, ডিজিটাল। বা কয়েকজন বন্ধু মিলে কিনতে পারো। বা খুব কম পয়সায় ভাড়া নিতে পারো। সেটা দিয়ে নিজেই ছবি বানাতে পারো। বড় আর্টিস্ট, বড় ক্যামেরা সেগুলো তো প্রয়োজন নেই।

আমাকে লোকে বলে, আপনার ছবিগুলো এরকম কেন? আমি বলি, আমি ছবিতে বাস্তবতা মেশাই, তার সাথে একটু স্বপ্ন মেশাই, তার সাথে একটু ম্যাজিক। তারপর জোরসে শেক করি। হা হা হা। এইভাবে। (হাত ঝাঁকিয়ে দেখান) খারাপ ছবিকে সিনেমা বলে বিশ্বাস করলে হবে না। আর এগুলোকে বিশ্বাস যদি তুমি করতে শুরু কর তাহলে কিন্তু শেষ! এরকম ছবি যারা করে তারা কিন্তু কোথাও পৌঁছাতে পারে নাই। তুমি কলকাতায় বসে কী বানাইছো, পত্রিকায় আসছে, কী ব্যবসা করছে…. এগুলো কিন্তু বিশ্ব সিনেমায় থাকে না। সেখানে জায়গা করে নিতে পারেনি।

মৌ: একটা বিষয় জানতে চাই। আপনার যে ছবিগুলো দেখেছি, সেখানে মেয়ে যেই চরিত্রগুলা আসছে, ওরা অনেক বেশি… ট্র্যাডিশনাল বাঙালি নারী বলতে যা বুঝায় তার বাইরের। অনেক বেশি শক্তিশালী, ও কী করছে না করছে, তার জন্য সে দায়বদ্ধ নয় সমাজের কাছে। ও জানে ও কী করতেছে। পুরুষ চরিত্রগুলোর চেয়ে মেয়ে চরিত্রগুলো বেশি স্ট্রং লাগছে আমার কাছে। আপনি কি আসলে নারীদেরকে এভাবে দেখতে চান বলে এভাবে আনেন, নাকি সমাজের নারীরা আপনার চোখে এভাবে আসে? এই যে মেয়েরা অন্যন্য সবার থেকে আলাদা হয়ে চলে আসতেছে আপনার ছবিতে, কিন্তু খুবই সাবলীল, মনে হয় না অতিরঞ্জিত। খুবই নরমাল, আমার পাশের একজন মানুষ।

বুদ্ধদেব: তুমি রবীন্দ্রনাথের যে ৫টা-৪টা গল্প নিয়ে কাজটা করেছি সেটা দেখে নিও। আমি হাবীবকে দিয়ে যাবো।

কতক্ষণ চুপ করে থেকে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ফের মুখ খোলেন, আমি একটা জিনিস দেখি আমাদের এখানে, এই দেশে, সেটা ভারতবর্ষে বলো, পাকিস্তান বলো, বা আমাদের বাংলাদেশে বল, নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়া হয়নি। সেদিন একজায়গায় বলছিলাম যে, বিজ্ঞাপনে নারীর শরীরকে ব্যবহার করা, পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা, অত্যন্ত অন্যায়! আমার কথা ভুল বুঝো না। আমি মনে করি, একজন নারীর আবেদন শেষ হয়ে যায় না শরীরে! সেটাকে পণ্য করে ব্যবসা করাটা খুবই অন্যায়। আমি আমার মাকে দেখেছি, আমার বান্ধবীকে দেখেছি, মেয়েদের দেখছি, স্ত্রী মারা গেছেন বেশ কিছুকাল আগে, তাদের সাংঘাতিক রূপ, ভীষণ পজেটিভ! আমার মা সাংঘাতিক মেয়ে ছিলেন! এই পিয়ানো বাজাচ্ছেন, এই চিংড়ি দিয়ে কচুটা রান্না করছেন, এই কবিতা পড়ছেন…

মৌ: আপনার মেয়ে তো আপনার সাথে এ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন?

বুদ্ধদেব: হ্যাঁ আগে করেছে। এখন করছে না। ও তো মিউজিক করে। ছোটবেলা থেকে তো সে পিয়ানিস্ট। আমিও পিয়ানো বাজাই। মিউজিককে ভালোবাসে। ছোট মেয়ে পাগলের মত মিউজিককে ভালবাসে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিউজিক করছে। কম্পোজিশন করে। এখন ছবিতে মিউজিক করছে। সেদিনও একটা এ্যাওয়ার্ড পেল।

মৌ: ইন্ডিয়াতেই কাজ করছে?

বুদ্ধদেব: বোম্বেতে কাজ করছে।

মৌ: দুই মেয়েই মিউজিক নিয়ে কাজ করছে?

বুদ্ধদেব: ছোটটা তো মিউজিক নিয়েই কাজ করছে বাই প্রফেশন। বিয়ে করেছে একটা আমেরিকান ছেলেকে। শর্ত একটাই ‘আমি আমেরিকায় থাকবো না, দেশে থাকবো।’ হা হা হা! ছেলেটিও থেকে গেছে। আমার বান্ধবীকে আমি দেখেছি, ভীষণ শক্ত পোক্ত মানুষ, অসম্ভব ক্রিয়েটিভ! এদের আমি দেখেছি দেখে, এদের আমি শ্রদ্ধা করি। আমার মনে হয় আমাদের সমাজে নারীর যে কত বড় ভূমিকা, নারী যে কত ক্রিয়েটিভ হয়, সেটা আমরা দেখতে চাই না, বুঝতে চাই না। তুমি ‘দূরত্ব’ দেখেছো?

মৌ: হ্যাঁ হ্যাঁ অসম্ভব শক্তিশালী একটা মেয়ের চরিত্র…

বুদ্ধদেব: ‘দূরত্ব’ দেখার পর বিদেশে সবাই মনে করেছে আমি মেয়ে! পরিচালক, মেয়ে! হা হা হা! সেই চরিত্রটি কিন্তু সমাজ বিচ্ছিন্ন নয়! আমার মনে হয় এই দেশে, এই ভুখন্ডে যে সম্মান তাদের প্রাপ্য ছিল, সেই সম্মান তাদের দেওয়া হয় নাই। সাহিত্য না, কোথাও না। সেদিন একজন একটা ছবি দেখতে দিল। সেটা দেখে তো আমার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেছে! সেখানে করে কী, সকাল বেলা কী একটা বাটি নিয়ে আসে, জল। তো জলের মধ্যে সে তার বুড়ো আঙুলটা চুবিয়ে রাখে। আর তার স্ত্রী খায়!

এই কথা বলে বুদ্ধদেবদা কতক্ষণ ঝিম মেরে রইলেন। মনে হল তার সেই দৃশ্য মনে পড়লো!

মৌ: কোন রিচুয়াল?

বুদ্ধদেব: দেখো, রিচুয়াল তো তুমি আমি তৈরী করি। সেদিনও একটা কথা হচ্ছিলো যে সতীদাহ। এর কারণটা কী ছিল? হিন্দু ধর্মের কোথাও কিন্তু সতীদাহ লেখা নেই। সেটা করা হয়েছে কেননা তাকেও বিলুপ্ত করে দিলে যে সম্পত্তি, সেটা ভাইরা পেয়ে যাবে। পুরো সম্পত্তির জন্য এটা করা হয়েছে। তুমি যদি সেটা ধর্মের মোড়কে বেঁধে দেও, সেই ধর্মের বড়ি তোমাকে যেই খাইয়ে দেয়া হবে না, তুমি সঙ্গে সঙ্গে ধর্মটাকে ব্যবহার করতে শুরু করবে। তুমি, পতিঅন্ত তোমার প্রাণ। তার জন্যই তোমার বেঁচে থাকা। তোমার নিজের বাঁচার আর কোন অধিকার নাই। কিন্তু এটা ভাঙবে। নারী যে কত শক্তিময়ী সেটা দেখা যাবে। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নানা অনুশাসনের জন্য এখনো পুরোপুরো টের পাওয়া যায়নি।

আমি একটা জিনিস দেখি আমাদের এখানে, এই দেশে, সেটা ভারতবর্ষে বলো, পাকিস্তান বলো, বা আমাদের বাংলাদেশে বল, নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়া হয়নি। সেদিন একজায়গায় বলছিলাম যে, বিজ্ঞাপনে নারীর শরীরকে ব্যবহার করা, পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা, অত্যন্ত অন্যায়! আমার কথা ভুল বুঝো না। আমি মনে করি, একজন নারীর আবেদন শেষ হয়ে যায় না শরীরে! সেটাকে পণ্য করে ব্যবসা করাটা খুবই অন্যায়। আমি আমার মাকে দেখেছি, আমার বান্ধবীকে দেখেছি, মেয়েদের দেখছি, স্ত্রী মারা গেছেন বেশ কিছুকাল আগে, তাদের সাংঘাতিক রূপ, ভীষণ পজেটিভ!

মৌ: দাদা আপনি কমলকুমার মজুমদারের লেখা নিয়ে কাজ করেছেন।

বুদ্ধদেব: দুটো গল্প নিয়ে করেছি।

মৌ: এর কারণটা কী জানতে চাই আর আমাদের এখানে একটা তর্ক হয় সবসময় যে, যেমন সত্যজিৎও তো রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস নিয়ে কাজ করেছেন বা অনেকেই সাহিত্য নিয়ে সিনেমা করেন। তো একটা তর্ক হয় সবসময় যে আমরা সহিত্যে যা পড়ি সেটাই হুবহু আসতে হবে সিনেমায়। আর আরেকদিকে বলা হয় যে, না, সিনেমা আর্টের একটা আলাদা ফর্ম। ফলে মূল যে গল্প সেটার সাথে সিনেমার গল্পে অনেক পরিবর্তন আসতে পারে। মূল থিমও চেঞ্জ হতে পারে। আপনি কীভাবে দেখন এটাকে?

বুদ্ধদেব: তুমি একজন চলচ্চিত্র পরিচালক। তুমি একজন লেখকের কোন গল্প নিয়ে উপন্যাস নিয়ে কাজ করার কথা ভাবলে। এই অবধি ঠিক আছে। গল্প পড়লে, দুই তিনবার পড়লে, চারবার পড়লে, কিন্তু আর গল্পের কাছে যাবে না। তোমার দায় নেই গল্পকে ফলো করার। এটা তোমার কাজ নয়! তুমি একজন ফিল্মমেকার, স্বাধীন চিন্তার মানুষ। এবং আরেকটি ফর্ম নিয়ে তুমি কাজ করছো। তারও নিজস্ব একটা পথ আছে। সেটা তোমায় মাথায় রাখতে হবে। উপন্যাস বা গল্পটা তোমাকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। কিন্তু তারপর তুমি তোমার মত দেখতে থাকো। আমি তো সব সময়ই তাই করি। আমি যখন নিজের উপন্যাস নিয়ে কাজ করেছি, তখনও তাই করেছি। কেননা যেই তুমি ভাবতে শুরু করলে তোমার দায়িত্ব, ফিল্মমেকার হিসেবে তোমার দায়িত্ব হচ্ছে যে গল্পটাকে রিটেক করা, তখনই নিজের কবর নিজে খুঁড়ে ফেলবে!

মৌ: কিন্তু গল্পটাকে কি এক রাখার কোনো দায় আছে?

বুদ্ধদেব: না, কোনো দায় নেই।

মৌ: তাহলে কেন ঐ গল্পটা নিয়েই কাজ করছি আমরা?

বুদ্ধদেব: হয়তো কোথাও তোমায় সেই গল্প ছুঁয়েছিল। ঐ যে ছোঁয়া বা স্পর্শটুকু তোমাকে অনেক ভাবিয়েছে। গল্প তো লেখকের ভাবনা। তাইলে তোমার ভাবনা কী? তোমার তো একটা ভাবনা আছে? লেখকের ভাবনাই যদি করো, তাহলে সিনেমা দেখবো কেন, বইটাই পড়বো! তোমার ভাবনাটাও আমি জানতে চাই। জানতে চাই বলেই সিনেমাটা আমি দেখতে চাই। সেখানে তোমাকে এ্যা… তোমার নিজস্ব যে অনুভূতি, ভাবনা, মনন, চিন্তা সেটা প্রতিফলিত হওয়া দরকার। গল্পটা তোমার অবলম্বন। তারপর তুমি তোমার মতো করে বিকশিত হবে। তা নাহলে তো মুশকিল।

মৌ: আমরা যখন পশ্চিমবঙ্গের যাদের সিনেমা দেখে অনুপ্রাণিত হইছি, মানে ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন এবং আপনি, তারপরে তো আমরা ঐ অর্থে এত পোয়েটিক বা এত ভালো ছবি তো আমরা পাই নাই। এখন তো ধরেন ফিল্মে অনেক বেশি ইনভেস্ট করা হয়, ফলে ঐ দায়টাও থাকে অনেক সময় ডিরেক্টরের টাকা উঠানোর তারপরও গল্পের প্যাটার্ন অনেক চেঞ্জ হইছে। তারপরও আপনার কী মনে হয় যে সৃজিতরা যে কাজ করছেন, বা অনীক দত্ত “ভূতের ভবিষ্যত” করলেন বা এখন অনেক নতুন ডিরেক্টর আসছে, এই ছবিগুলোকে আপনি কীভাবে দেখেন। মানে আমাদের দেশে এই ছবিগুলো দিয়ে অনেকে কিন্তু প্রভাবিত। শেষ যে “জাতিস্মর”-ও আমরা দেখলাম। আমাদের এখানে কিন্তু খুব আলোচিত! আমরা কিন্তু নিয়মিত দেখি। আপনার কাছে কি মনে হয়, আপনি এগুলোকে সিনেমার মধ্যে ফেলবেন? আপনি যেটা বলছিলেন যে সবটা সত্য না মানা…

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বিরক্ত হয়ে তাকালেন। টেবিলের সামনে ঝুঁকে ছিলেন, এখন চেয়ারে হেলান দিয়ে আমার সাথে দূরত্ব রচনা করলেন এবং তার ঘাড় একদিকে হেলে পড়লো।

বুদ্ধদেব: দেখো, তোমাকে কিন্তু আমি আগেই একটা কথা বললাম, আগেই বললাম, যা হচ্ছে তাতে বিশ্বাস করবা না। হুম! চোখের সামনে অনেক কিছুই ঘটবে। অনেক কিছুই ঐ চোখ দেখবে, পর্দায়। কিন্তু বিশ্বাস করবে না। সেগুলোর কোন মান, মান হিসেবেও ধরবে না। বুঝতে পেরেছো? সেগুলো আদতেই কোনো সিনেমা না। এবং সেগুলোর কোন স্থায়িত্বও নেই। কোন স্থায়িত্ব নেই। একটা কথা আমি বার বার বলি যে, কেন তুমি কবিতার কাছে ফিরে যাও? কেন তুমি সুরের কাছে ফিরে যাও? তোমার মন খারাপ, তুমি ঐ গানটা শোনো, তোমার মনে আনন্দ হচ্ছে তুমি ঐ কবিতাটা আবার পড়ো। সিনেমাও তাই। এই পর্যায়ে তোমাকে নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে তোমার… কিছু টাকার জন্য তুমি যদি সিনেমা কর, খাওয়া পড়া, কিছু ছবি ছাপা হবে, ইন্টারভিউ ছাপা হবে, তাহলে…. এটা মাথায় রাখবা, তোমার এমন কাজই করার কথা ভাবা উচিৎ, দশ বছর পরও আলোচিত হবে।

মৌ: সব সময় থাকবে?

বুদ্ধদেব: আলোচনায় থাকবে। জাতিস্মরই বল বা ভূতের ভবিষ্যৎই বল…

মৌ: আপনি দেখেন এই সিনেমাগুলো?

বুদ্ধদেব একটু চুপ থেকে বলেন, দেখো অনেকসময় বাধ্য হয়ে আমাকে এগুলো দেখতে হয়। তুমি একটা জিনিসকে কীভাবে ব্যবহার করবে, সেটা তোমার উপর নির্ভর করছে। তুমি যদি চাও যে সিনেমাকে তোমার শুধুইমাত্র তোমার খাওয়া পড়ার জন্যে, শুধুই মাত্র তোমার পাকস্থলির জন্য ব্যবহার করবে, এই ছবিগুলো কোথাও যায় নাকি? কুয়োর ব্যাঙের মত কলকাতাতেই ঘুরে বেড়ায়, কখনো কখনো ঢাকায় আসে। বাইরে কিন্তু কোথাও যায় না। কুয়োর ব্যাঙ হয়ে গেলে তো মুশকিল। তার জন্যই আমি তোমাকে বুঝাচ্ছি, বিশ্বাস করবে না।

মৌ: আমি একটা জিনিস বুঝি না যে কলকাতায় অনেক বেশি সাহিত্য সিনেমা হয় মানে কালচার্ড একটা জায়গা। তারপরেও আপনি অনেক ইয়ে, মানে আপনি অনেক নীরবে থাকতে চান। আপনি কিন্তু অন্যান্য অনেক… যেমন গৌতম ঘোষকে নিয়েও অনেক বেশি আলোচনা। যেমন আমাদের এখানেও দেখতেছি। কিন্তু আপনার ছবির প্রভাব তো অনেক বেশি! বা পুরা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড যে আপনার অবস্থান! কিন্তু কলকাতায় আপনি চুপচাপ কেন?

বুদ্ধদেব: কলকাতায় চুপচাপ কারণ আমি চুপচাপ। হা হা হা! আমি তেমন একটা বের হই না। কেন কি জানো, আমার নকল মানুষ ভাল্লাগে না। আর কার সাথে মিশবো বলো? নিজের সাথে থাকার একটা লাভ আছে। নিজেকে চেনা যায়। নিজেকে শ্রম দেয়া যায়। নিজেকে তৈরী করা যায়। নিজেকে তৈরী করার তো কোন শেষ হয় না। আর কাদের সাথে মিশবো বলো, কাদের সাথে কথা বলবো? কী আলোচনা করবো? এদের… মানে… তোমায় তো গভীরভাবে প্রেমে পড়তে হবে! এমন পাগলের মতন প্রেমে পড়বে যে সব কিছু ছেড়ে দিবে! আমি এমনভাবে সিনেমার প্রেমে পড়লাম যে… আমি তো লিখতামই! ইকোনোমিক্সেরও খুব ভাল ছাত্রও ছিলাম। আমি শিক্ষকতা করতাম। আমি যখন ছেড়ে দিলাম বাবা আমার সাথে কথা বন্ধ করে দিলেন। এখন আমি দেখতে পাই জানো, ভালোবাসার কোথায় অভাব আছে! তুমি যখনই কাউকে ভালোবাসবে না, অথচ তার সঙ্গে তোমাকে থাকতে হচ্ছে, তুমি কী করবে (টেবিলে রাখা তিনভাগের একভাগ পানি ভরা গ্লাসের পানি দেখিয়ে বললেন) তোমার এইটুকু ভালোবাসা আছে, বাকিটুকু শূন্য। কিন্তু আরেকজনের কাছে তোমাকে জাহির করতে হবে যে, দেখাতে হবে যে, তুমি ভালোবাসো। বাকিটা মিথ্যা দিয়ে পূরণ করবে।

মৌ: মানে ভন্ডামী। আপনি যে এত সরাসরি সব কথা বলেন, সেটাও কি একটা কারণ যে সবাই আপনাকে এড়িয়ে চলে?

বুদ্ধদেব: কলকাতার রাজনীতিতে অনেকেই গেছে। আমি যাইনি। কলকাতার যে রাজনীতি চলছে আমি পছন্দ করি না, বিশ্বাস করি না। আর প্রয়োজন নেই তো! কী পাবো বলো? (হাসি) আমি ছবি করতে কিন্তু বেশি টাকা নেই! আমার ছবির বাইরের বিক্রির ৩০ ভাগ টাকা আমি নেই। আর আমার বেশি খরচ নাই। সাধারণভাবে থাকি।

চোখের সামনে অনেক কিছুই ঘটবে। অনেক কিছুই ঐ চোখ দেখবে, পর্দায়। কিন্তু বিশ্বাস করবে না। সেগুলোর কোন মান, মান হিসেবেও ধরবে না। বুঝতে পেরেছো? সেগুলো আদতেই কোনো সিনেমা না। এবং সেগুলোর কোন স্থায়িত্বও নেই। কোন স্থায়িত্ব নেই। একটা কথা আমি বার বার বলি যে, কেন তুমি কবিতার কাছে ফিরে যাও? কেন তুমি সুরের কাছে ফিরে যাও? তোমার মন খারাপ, তুমি ঐ গানটা শোনো, তোমার মনে আনন্দ হচ্ছে তুমি ঐ কবিতাটা আবার পড়ো। সিনেমাও তাই। এই পর্যায়ে তোমাকে নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে তোমার… কিছু টাকার জন্য তুমি যদি সিনেমা কর, খাওয়া পড়া, কিছু ছবি ছাপা হবে, ইন্টারভিউ ছাপা হবে, তাহলে…. এটা মাথায় রাখবা, তোমার এমন কাজই করার কথা ভাবা উচিৎ, দশ বছর পরও আলোচিত হবে।

মৌ: আপনি যে মাঝে মাঝেই এই ভাষায় কথা বলতেছেন এটা কি আপনার মায়ের কারণে হয়েছে? আপনার বাবা তো ঐখানেরই?

বুদ্ধদেব: না না না! আমার বাবাও এখানকারই! বাবা বিক্রমপুর!

মৌ: আচ্ছা আচ্ছা! দুইজনেই এখানকার?

বুদ্ধদেব: দুজনেই এখানকার। আমার মা হচ্ছেন ঢাকার পুরোনা পল্টনের। বাবা মেডিকেলে পড়ার আগেই চলে যান। প্রাথমিক পড়াশোনা বিক্রমপুরেই করেছেন। স্কুল অবধি বিক্রমপুর। কলেজ অব্দি বিক্রমপুর। তারপর মেডিকেল পড়ার সময় প্রথম উনি কলকাতায় যান। তারপর আর আসেননি।

মৌ: আপনারা নয় ভাই বোন! আপনি কত নাম্বার। হা হা হা!

বুদ্ধদেব হেসে দেন। বলেন: নাম্বারে আমি থার্ড! হা হা হা…! তোমার নাম্বারটা দিও তো আমার দিদিকে নিয়ে আসমু।

মৌ: আচ্ছা..

বুদ্ধদেব: আমার দিদির জন্ম এখানে। পুরানো পল্টনে জন্ম। এবারো তো আমি আসার সময় দিদি কান্নাকাটি…

মৌ: আসতে চাইছিলো?

বুদ্ধদেব মাথা ঝাঁকায়ে বললেন: আমি বললাম, দিদি আমরা কাজে যাই। তুমি গেলে সারাদিন একা…

মৌ: আলাদা বেড়াইতে আসতে হবে।

বুদ্ধদেব: আসবো। তোমার নাম্বারটা আমারে দেও তো! কলকাতা থেকে ফোন করা যাবে, কোডসহ নাম্বার দিবা।

ফোন নাম্বার এবং ইমেইল এ্যাড্রেস আদান প্রদান হলো।

মৌ: আপনি বাসায় তাইলে এই ভাষায় কথা বলেন? কালকে দেখলাম যখন ইন্টারভিউ দিতেছেন খুবই ফরমাল কলকাতার ভাষায় কথা বলতেছেন। আবার যখন খেতে বসলেন তখন এখানকার ভাষায়…

বুদ্ধদেব: বাবা মা এখান থেকে গেছেন। বাবা মা তো এই ভাষায় কথা বলতেন। আমার মামারাও এই ভাষায় কথা বলতেন। তবে বাড়িতে কলকাতার ভাষায়ই কথা বলি। কিন্তু যেহেতু বাঙাল, কিছু কিছু শব্দ তো বেড়িয়ে আসবে।।

মৌ: আর এখানে আসার জন্য একটু বেশি হইছে! হি হি হি…

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তও হাসেন।

মৌ: আর এখানে কতবার আসলেন এ নিয়ে?

বুদ্ধদেব: পাঁচবার।

মৌ: অনেকবার!

বুদ্ধদেব: কাজে আসছিলাম।

মৌ: একবার দাদা আসেন শুধু বেড়াতে। কাজ নিয়ে এসেন না।

বুদ্ধদেব: কাজ নিয়ে আসলে হয় না। ঘুরা হয় না।

মৌ: আসেন না। আপনারে সব জায়গা ঘুরে দেখাই। আমন্ত্রণে আসলে তো ঢাকার আসল চেহারা বুঝতে পারবেন না। সব উপর দিয়ে দেখবেন। আপনি হিন্দী ভাষায় ছবি করছেন?

বুদ্ধদেব: প্রচুর হিন্দী ভাষায় ছবি করছি। তুমি ‘বাঘ বাহাদুর’ দেখো নাই?

মৌ: না দেখি নাই।

বুদ্ধদেব: শেষ যে ছবিটা করলাম ‘আনোয়ার কা আজব কিসসা’ সেটাও হিন্দীতে।

মৌ: আপনার বাংলাদেশের ছবি দেখা হয়?

বুদ্ধদেব: হ্যাঁ…

মৌ: টেলিভিশন একটা ফিল্ম হয়েছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বানিয়েছেন। আপনি কালকে ইন্টারভিউ দেয়ার সময় বলতেছিলেন ছবিটা ভাল লাগছে, অভিনয় ভাল লাগছে। টেলিভিশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

বুদ্ধদেব: টেলিভিশন নিয়ে বলবো ভাল্লাগছে। একটা হচ্ছে বিষয় বিবেচনা আর একটা হচ্ছে সিনেমার ভাষায় কথা বলা। যেটা খুব জরুরী। যদিও আমার মনে হয়েছে চিত্রনাট্যটা কোথাও কোথাও আরো সমৃদ্ধ হতে পারতো। এবং শেষটা ওর আরো একটু ভাবা উচিৎ ছিল।

মৌ: শেষটার কোন জায়গাটা নিয়ে আপনার…

বুদ্ধদেব: একদম শেষটা।

মৌ: টেলিভিশনের মধ্যে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক এর সাথে যে একাত্ন অনুভব করা?

বুদ্ধদেব: হ্যাঁ হ্যাঁ। আর অভিনয়টা খুব সুন্দর ছিল। আর সবচেয়ে আমাকে টাচ করেছে সিনেমার ভাষা। সিনেমার ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করা। আর একটা জিনিস আমার খুব ভাল্লেগেছে। দেখো তোমাকেও আমি বলছি, আমাদের জীবনে হাসাটা খুব বড় জিনিস। তাই না? তুমি যদি তোমার দর্শককে হাসাতে না পারো বা মজা দিতে না পারো, তাহলে হবে না। টেলিভিশন ছবিটার একটা গুণ আছে, ছবিটা দেখতে দেখতে মাঝে মধ্যে হেসে ফেলেছি! এটা খুব বড় জিনিস। এটা আমি ভীষণ বিশ্বাস করি। আর সবার অভিনয় খুব ভাল। অসামান্য লেগেছে যিনি চেয়ারম্যানের ভূমিকা করেছেন।

মৌ: হ্যাঁ, রুমি ভাই।

বুদ্ধদেব: তুমি একটু ফারুকীর সাথে দেখা হলে বলো তো, আমার খুব ভাল্লেগেছে।

মৌ: ঠিকাছে!

বুদ্ধদেব: যেটা খুব দরকার… ওর ছবিটার মধ্যে… এটা কলকাতায়, যারা ফিল্ম করছে… তুমি যাদের কথা বললে, তারাও অত ঐ ভাষাটাকে ধরতে পারেনি। সিনেমার ভাষায় কথা বলতে না পারলে খুব মুশকিল! সিনেমার তো একটা ভাষা থাকে। তোমাদের এখানে কলকাতার ঐসব সিনেমা নিয়ে কথা যত কম হয়, তত মঙ্গল। ওগুলো কোন সিনেমাই নয়!

মৌ: হা হা হা দাদা, আমাদের বন্ধু বান্ধবরা শুনলে…

বুদ্ধদেব: আমি বলছি যে, ফারুকীর ছবি নিয়ে আলোচনা করুক! দেখুক তার মধ্যে কী আছে! ওর আরো ছবি করতে হবে। আমি চাই ও নিজেকে আরো বেশি ফোকাস করুক। ও ঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছ।

মৌ: এখন নতুন ছবির শুটিং শুরু করেছেন?

বুদ্ধদেব: না, আরাম্ভ করবো তো! ‘আনোয়ার কা আজব কিসসা’ শেষ হল। তারপর নতুন ছবির প্রি প্রোডাকশান আমি সবে শুরু করলাম। এর মধ্যে সোহিনী ওর ছবি নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিল। কেননা ও না থাকলে আমার পক্ষে ছবি করা খুব মুশকিল। সমস্ত ও সামলায়।

মৌ: সোহিনী আপনার চিফ এ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর?

বুদ্ধদেব: হ্যাঁ আমার চিফ এ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর।

মৌ: আপনার প্রোডিউসাররা কোথাকার?

বুদ্ধদেব: ভারতের।

মৌ: ছবির বাজার কোথায় বেশি?

বুদ্ধদেব: আমার দেশের (ভারতের) চেয়ে দেশের বাইরেই বেশি ছবির দর্শক। দেশের বাইরে ছবি বেশি চলে। সিনেমা হলে চলে, টেলিভিশনে চলে।

মৌ: ঐ ছবিগুলোতে সাবটাইটেল দিয়ে দেয়। না কি ডাবিংও করে?

বুদ্ধদেব: হ্যাঁ ডাবিং করে। সাবটাইটেলই বেশি। কলকাতায় না ফিল্মের অবস্থা খুব খারাপ!

মৌ: মানে আপনি আসলে স্বস্তির জায়গা পান না?

বুদ্ধদেব: ব্যতিক্রম আছে কিন্তু অধিকাংশই না ধান্দা! ধান্দা বুঝো? ধান্দাবাজি।

মৌ: বুঝি।

যেহেতু আমি কবিতা লিখি, শুধু কবিতা লেখাই না, কবিতা চলেই আসে। … আবার সিনেমা দিয়েও কবিতা অনেকসময় অনুপ্রাণিত হয়। আর সব সময় তো ভাববেই। বাস দিয়ে যাওয়ার সময়ও তুমি দেখছো, এই যে বাস্তব তুমি চোখের সামনে দেখছো। কিন্তু তোমার দেখার বাইরেও আরো একটা জগত আছে! যে দেখাটা তোমাকে দেখতে শিখতে হবে। দেখতে জানতে হবে। চারপাশের অনেক কিছু ছড়ানো সমস্ত কিছুর মধ্যে তুমি দেখবে ছন্দ আছে। সমস্ত কিছুর মধ্যে কবিতা আছে। আমি প্রচুর মিউজিক শুনি। সব ধরনের মিউজিক শুনি। শাস্ত্রীয় সংগীত শুনি। আমি অনেক ধরণের শব্দ শুনি। হাওয়ার শব্দ, গাছের পাতার শব্দ, বিদ্যুত চমকের শব্দ, নদীতে পানি বয়ে যাওয়ার শব্দ, যা যা আছে সব শুনবা! চুপচাপ শুনবা। দেখবা, দেখতে পাচ্ছো… এই যে দেখতে পাচ্ছো, এই ইমেজটা নিয়ে আসবা।

তাসমিয়াহ্ আফরিন মৌ

বাংলাদেশী চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক। ১৯৮৩ সালে ঢাকায় জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। পড়ালেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে অডিও ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় কাজ শুরু করেন, প্রথম পরিচালিত প্রামাণ্য-চলচ্চিত্র, ‘রূপান্তরের রূপকথা’। বাংলাদেশ তিনটি টেলিভিশনে সাংবাদিকতা এবং অনুষ্ঠান প্রযোজনার অভিজ্ঞতার পাশাপাশি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে তারেক মাসুদ, নাসির উদ্দীন ইউসূফ বাচ্চু, রুবাইয়াত হোসেনের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। উল্লেখযোগ্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, ‘কবি স্বামীর মৃত্যুর পর আমার জবানবন্দি’, ‘নায়িকার এক রাত’, ‘পারফর্মার’ এবং প্রামাণ্য চলচ্চিত্র, ‘টোকাই ২০১২’, ‘বিসর্জন’, ‘তারপর হবো ইতিহাস’, ‘বীর’ ইত্যাদি। তিনি জুরি হিসেবে নেপাল, ভারত এবং মিশরের একাধিক চলচ্চিত্র উৎসবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর লিখিত প্রথম ছোটগল্পের বই ‘বাক্সবন্দি’ আদর্শ, বাংলাদেশ প্রকাশনা থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়। বর্তমানে প্রথম ফিচার ফিল্ম ‘কাক’ নিয়ে কাজ করছেন।

Share