আজ সোমবার, ৫ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ইসলামের কোরবানি, ‘মনের পশু’ তত্ত্ব ও খ্রিস্টধর্ম (প্রথম পর্ব)

।। ফরহাদ মজহার ।।

প্রাণী উৎসর্গ নতুন কিছু নয়, ইসলামের একচেটিয়াও নয়। কিন্তু ঈদ-উল-আযহার কোরবানির কথা উঠলেই সত্যিকারের পশুকে রিচুয়ালিস্টিক মেটাফর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ‘মনের পশু’ বিসর্জন দেওয়ার যুক্তি সামনে আনেন একদল তথাকথিত পশুপ্রেমী। আবার আরেক দল কোরবানির নামে পশু মাংস সংরক্ষণ ও ভক্ষণকে ভোগবাদী সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই করে তোলেন দারুণভাবে, কোরবান্নির মাসে বেড়ে যায় ফ্রিজের কেনাবেচা। এই পরিস্থিতিতেই কোরবানি ও কোরবানির তাৎপর্য প্রসঙ্গে ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন কবি, চিন্তক ও ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ফরহাদ মজহার। তাঁর সেই বিখ্যাত লেখা আবারও ঈদ-উদ-আযহা উপলক্ষে প্রবন্ধটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। সকলকে ঈদ-উদ-আযহার শুভেচ্ছা।

আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’

যাঁরা ঈদ এলে প্রায়ই নিজেকে মহান পশু দরদী প্রমাণ করবার জন্য পশু কোরবানি না দিয়ে ‘মনের পশু’ কোরবানির তত্ত্ব দিয়ে থাকেন,তাদের কিছু বিষয় বিবেচনার জন্য পেশ করছি। আশা করি তাঁরা ভেবে দেখবেন।

প্লথমত, প্রায় সব ধর্মেই নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী পরমের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য ‘কোরবানি’র বিধান আছে। বলাবাহুল্য তাকে ‘কোরবানি’ বলা হয় না। বলা হয় ‘বলী’, ‘ঈশ্বরের জন্য রক্তোৎসর্গ’ ইত্যাদি। আরবিতে ‘উদিয়া’ শব্দের অর্থ ‘রক্তোৎসর্গ’। সেই দিক থেকে ‘ঈদুল আজহা’ কথাটার অর্থ দাঁড়ায় ‘রক্তোৎসর্গের উৎসব’। এই ভাষাগত ইঙ্গিত থেকে নৃতাত্ত্বিকরা দাবি করতে পারেন আরব দেশের প্রাচীন প্রথার সঙ্গে এই উৎসবের সম্পর্ক রয়েছে। তবে উর্দু ও ফারসি ভাষাতে আরেকটি আরবি শব্দ ‘কোরবান’ থেকে ‘কোরবানি’ কথাটার চল হয়েছে।

অনেকে মুসলমান হিসাবে নিজের সম্প্রদায়গত পরিচয় প্রধান করে তুলতে চান, তাই ভুলে যান আল্লাহ বিভিন্ন ও বিচিত্র নানান সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছে, সকল বৈচিত্রের উৎসও তিনি। ভাষার বৈচিত্রও তাঁরই সৃষ্টি, তাঁরই মহিমা। ‘পরমের সন্তুষ্টি লাভ’ কথাটা আরবি ভাষায় না হওয়ায় ভাষাগত প্রকাশভঙ্গির কারনে অনেকে একাত্ম বোধ নাও করতে পারেন।  কিন্তু আল্লাহ তো অবশ্যই ইসলামের দিক থেকে পরম সত্য, সেই দিক থেকে ‘পরম’ ধারণার সঙ্গে একাত্ম বোধ না করাও সমস্যা। বাংলায় ‘পরম’ কথাটির সঙ্গে একাত্মবোধ না করার কোন যুক্তি নাই। অতএব যাকে মানুষ পরম সত্য বলে জানে তার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য ‘রক্তোৎসর্গ’ অতি প্রাচীন সামাজিক রীতি।

তবে ইসলামের ইতিহাসে যাঁরা সাম্প্রদায়িকতা ও চিন্তার সংকীর্ণতাকে প্রশয় দেন না, তাঁরা ‘আল্লার সন্তুষ্টি বিধান’ ছাড়াও কোরবানির মধ্য দিয়ে আল্লার নৈকট্য লাভের কথা বলেন। কারন ‘কোরবানি’ শব্দটি যে ধাতুরূপ থেকে উৎপন্ন – অর্থাৎ‘করব’ – তা কোন কাম্য বস্তু বা বিষয়ের প্রতি নৈকট্য বোঝায়। কোন কিছু নিবেদনের মধ্য দিয়ে নৈকট্য লাভের বাসনা। ধাতু নির্ণয় বা ভাষার ব্যুৎপত্তি বিচারের দিকে না গেলেও আমরা জানি, মোমিনের জীবনে আল্লার নৈকট্য লাভের চেয়ে বড় প্রত্যাশা আর কিছু হতে পারে না। আল্লার নৈকট্য একই সঙ্গে সকল প্রকার সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা ও সাম্প্রদায়িকতার কোরবানিও বটে।

বলাবাহুল্য ভোগবাদী সমাজে ধর্মের গভীর ইশারা, তাৎপর্য কিম্বা প্রস্তাবনা নানা কারনে যারপরনাই অপরিচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ভোগসর্বস্ব জীবনে ধর্মাচারের তাৎপর্য বা সামাজিক ব্যঞ্জনা হারিয়ে যায় বা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। সমাজে তা আর ভাববার বিষয় হয়ে উঠতে পারে না, ভোগী সমাজে ধর্ম নিয়ে ভাববারও আর অবসর থাকে না। অথচ ভাষার প্রতীক, ইশারা, উপাখ্যান, কল্পনা পরমের প্রতি আন্তরিক নৈকট্য লাভের বাসনা তৈরি করে। সেই বাসনার ঘোর অনুপস্থিতির ফলে এই ধরনের সমাজে ধর্মচর্চা আদতে ধর্মহীনতায় পরিণত হয়। ‘আল্লার নৈকট্য লাভ’-এর কথা মুখে বলা হয় বটে, কিন্তু কোরবানি এখন যেভাবে ভোগীদের মাংস খাবার উৎসব আর ফ্রিজ বিক্রির মাসে পরিণত হয়েছে তাতে ‘আল্লার সন্তুষ্টি লাভ’ কিম্বা ‘নৈকট্য লাভ’ নিছকই কথার কথা হয়ে উঠেছে। অথচ চরম প্রহসন হচ্ছে এই যে ভোগবাদিতার সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক নাই। কিন্তু কোরবানি ভোগবাদে পরিণত হয়ে গিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, আজকাল প্রায় প্রতিবছরই ইসলাম বিরোধী প্রপাগাণ্ডার অংশ হিসাবে কোরবানিকে নিছকই পশু হত্যা হিশাবে চিহ্নিত করবার চেষ্টা করা হয়। এই চেষ্টা নতুন নয়। তবে সেকুলারিজম, নাস্তিকতা এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধকে ন্যায্যতা দেবার জন্য ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ বিধানকে নিন্দিত করে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা সাম্প্রতিক। একে পশু হত্যা হিশাবে প্রকট করে তোলার মধ্য দিয়ে মুসলমানদের হিংসা, হিংস্রতা এবং প্রাণীর প্রতি নির্দয়তা সহজেই প্রমাণ করা যায়। যেহেতু কোরবানি শব্দটি বিশেষ ভাবে মুসলমানদের ধর্মচর্চার সঙ্গে যুক্ত, তাই একে একান্তই মুসলমানদের নির্দয়তা হিশাবেই বিচার করা হয়। কোরবানির বিরুদ্ধে বিশেষ প্রচারও তাই ইসলাম ও মুসলমানদেরদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের তীব্রতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘কোরবানি’র বিরুদ্ধে প্রপাগাণ্ডাও তীব্র হয়েছে।

তৃতীয়ত, অথচ ধারণাগত ভাবে যাকে মানুষ ‘পরম’ জ্ঞান করে তাকে সন্তুষ্ট করবার বিভিন্ন চর্চা অন্যান্য ধর্মেও রয়েছে। ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিভিন্ন কারণে ও প্রয়োজনে পশু উৎসর্গের উদ্ভাবন ঘটেছে। অনেক সময় পরমের মধ্যস্থতায় সামাজিক ঐক্য দৃঢ় করবার প্রয়োজন হয়েছে। মূল কথা হচ্ছে পশু উৎসর্গ শুধু মুসলমানরা করে না। পশু উৎসর্গে মুসলমানদের কোন একচেটিয়া নাই। তার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন গল্প, বয়ান, ব্যাখ্যা ও আচারের পার্থক্য আছে। কোরবানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গল্প, উপাখ্যান, মিথ কিম্বা ইতিহাস বর্ণনার নিজস্বতা এবং স্বাতন্ত্র রয়েছে। ফলে তাদের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও ব্যাখ্যাও ভিন্ন। বয়ান ও ব্যাখ্যার পার্থক্য ও তাৎপর্য বিচারের  দিকটা গুরুত্বপূর্ণ। দরকারি, কিন্তু এখানে ধর্মতত্ত্বের তুলনামূলক আলোচনা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। ব্রং আধুনিক সেকুলার চিন্তায় ও সমাজে কোরবানির প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী কিম্বা পশু বলি দেওয়া কিভাবে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে  খ্রিস্টিয় চিন্তার সঙ্গে যুক্ত সেটাই আমরা বোঝার চেষ্টা করব। সেই দিকটার প্রতি নজর ফেরানোই আমাদের বিশেষ উদ্দেশ্য। তবে মনে রাখা দরকার আধুনিক সেকুলার চিন্তা ও সমাজের উৎপত্তি খ্রিস্টিয় ইউরোপে। এটা  আমাদের সবারই জানা যে জৈন বা বৌদ্ধ ধর্মে জীব হত্যা মহাপাপ। কিন্তু এই সকল ‘ধর্ম’  আধুনিকতার — বিশেষত ইসলাম বিদ্বেষী আধুনিক মন মানসের ভিত্তি নয়, ফলে সেই সকল ধর্ম এখানে আমামদের আলোচনার বিষয় নয়। তাই জৈন বা বৌদ্ধ ধর্মের জীবের প্রতি অহিংসা এখানে আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। কিন্তু কোরবানি বা পশু বলিকে নিন্দা করবার খ্রিস্টীয় তত্ত্ব আমাদের জানা দরকার।  যার ভিত্তিতে আধুনিক পাশ্চাত্যে কাকে ‘সভ্য’ আর কাকে ‘অসভ্য’ ও ‘বর্বর’ গণ্য করে তার মানদণ্ডও তৈরি হয়েছে।  

রোমান সম্রাট মারকাস অওরেলিয়াস (১৬১ – ১৮০) যুদ্ধে জয়ী হয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য জুপিটারের মন্দিরে পশু বলী দিচ্ছেন । জুপিটারের মন্দিরে সামনে বলীর পশুসহ এই ছবি রোমের ক্যাপেটিলিন মিউজিয়ামের রক্ষিত রয়েছে)

চতুর্থত, পরমের সন্তুষ্টির জন্য প্রাণী উৎসর্গ করার বিধানের বিরোধিতা করা একান্তই খ্রিস্টিয় চিন্তা। আধুনিক পাশ্চাত্যে তার উদ্ভব এবং আধিপত্যের সূত্র খ্রিস্টিয় চিন্তার পরিমণ্ডলের মধ্যেই। তাতে সমস্যা নাই। আমরা চিন্তায় খ্রিস্টিয় হতেই পারি। কিন্তু এর সঙ্গে ঐতিহাসিক ভাবে যুক্ত রয়েছে বর্ণবাদ ও ঔপনিবেশিক ইতিহাস। পাশ্চাত্যে ধর্মের ইতিহাসের দিক থেকে বিচার করলে কোরবানির কিম্বা অন্য কোন ধর্মে প্রাণ উৎসর্গ করবার বিধানের নির্বিচার বিরোধিতা  নিতান্তই ঔপনিবেশিক মানসিকতা এবং বর্ণবাদ। পশুপ্রেম দিয়ে তাকে আচ্ছাদিত রাখা হয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে এক্মাত্র নিজেদের সভ্য আর যারা কোরবানি দেয়, কিম্বা বলী দেয়, তাদের ‘অসভ্য’ ও ‘বর্বর’ বলে চিহ্নিত করা। এই দিকটি প্রথমেই বোঝা দরকার। 

খ্রিস্টধর্ম বিশ্বের একটি প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম।  খ্রিস্টিয় চিন্তার বশবর্তী হয়ে কেউ নিজের বিশ্বাস বা ধর্ম চর্চার অংশ হিসাবে প্রাণী উৎসর্গ করবার বিরোধিতা করতেই পারেন। কিন্তু গোড়ার কি বিশ্বাসকে যৌক্তিক রূপ দিতে গিয়ে খ্রিস্টধর্ম  রক্তোৎসর্গের বিরোধিতা করে সেটা বুঝতে হবে।  খ্রিস্টিয় বিশ্বাস অনুযায়ী নিজেকে ক্রুশকাঠে উৎসর্গ করে যীশু সর্বোচ্চ কোরবানির নজির দিয়েছেন। মানুষ মাত্রই পাপী, মানুষকে সকল প্রকার পাপ থেকে মুক্ত করেছেন যীশু। যীশুর রাজ্যে প্রবেশ করাই পরম পিতার নৈকট্য লাভ। খ্রিস্টান হিসাবে এই ধর্মীয় নৈতিকতা চর্চার অধিকার খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসীদের অবশ্যই রয়েছে।  কিন্তু প্রাণী কোরবানির বিরোধিতা করতে গিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষতা, প্রাণী প্রেম,অহিংসবাদ, নৈতিকতা ইত্যাকার বাগাড়ম্বর প্রদর্শন খুবই বিরক্তিকর। বাগাড়ম্বরের মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক মনমানসিকতা ও বর্ণবাদের চর্চা করা হয়। কোরবানি কেন্দ্র করে এই সব বাগাড়ম্বর প্রবল হয়ে ওঠে। প্রাণীর প্রতি প্রেম কিম্বা অহিংসা চর্চা আমরা করব না তা নয়, কিন্তু বাগাড়ম্বরবাদীরা একে ইসলাম বিদ্বেষের হাতিয়ার এবং ইসলাম নির্মূল রাজনীতিকে উসকে দেয়। এই রাজনীতি অবিলম্বে মোকাবিলা করা দরকার। এই উপদ্রব সম্পর্কে সতর্ক হবার আরও কারন আছে।

বিভিন্ন ধর্মীয় উপাখ্যান কেন্দ্র করে চিন্তা ও নীতিনৈতিকতার তর্কবিতর্ক বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন ভাবে দানা বেঁধেছে। সেই তর্কাতর্কির নিজস্ব ঐতিহ্য  রয়েছে। এই ঐতিহ্য সদাসর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ। একালের দার্শনিকেরাও তাই সেই দিকে মনোযোগী। সেই তর্কে যদি আমরা সঠিক ভাবে সঠিক ভাবে অংশগ্রহণ করতে চাই ইসলাম বিদ্বেষী নানান কিসিমের বাগাড়ম্বরবাদীদের মোকাবিলা জরুরী। এই বাগাড়ম্বর উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদী ইসলাম নির্মূল রাজনীতি থেকে আলাদা কিছু না।

পঞ্চম বিষয়, খ্রিস্ট ধর্মের চোখে প্রাণি বলীদান ‘পাগানিজম’ – বর্বরদের চর্চা। বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি, জাতি বা জনগোষ্ঠি অসভ্য ও পশ্চাৎপদ। তারা ধর্ম কি জানে না। তাই দাবি করা হয়, তাদের ধর্মান্তরিত বা ধর্মশিক্ষা দেওয়া দরকার।  খ্রিস্ট ধর্মই একমাত্র সত্যিকারের ধর্ম। যীশু নিজেকে নিজে ক্রসে ‘কোরবানি’ দিয়ে সেটা প্রতিষ্ঠা করেছেন। যীশুর কোরবানির চেয়ে আর বড় কোন কোরবানি আর কিছুই হতে পারে না। যীশুর ক্রসে ‘ক্রুসিফাইড’ হওয়াই হচ্ছে মানবেতিহাসের শ্রেষ্ঠ কোরবানি। কোরবানির চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন তিনি। এই মহান আত্মোৎসর্গের পর অন্য সকল কোরবানি নিরর্থক। সত্যিকারের ধর্ম হাজির হয়েছে, অন্য সকল ধর্ম মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এখন কর্তব্য হচ্ছে ক্রুসেড পরিচালনা এবং অসভ্য ও বর্বর জনগোষ্ঠিকে খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করা। ‘পরম পিতা’র সন্তুষ্টি বিধানের জন্য পশু কোরবানি বন্ধ করা। পাগান বা বর্বরদের বিপরীতে খ্রিস্টধর্মের মাহাত্ম প্রমাণের জন্যই পশু কোরবানি খ্রিস্টধর্ম নিষিদ্ধ করেছে। তাই যারা কোরবানির বিরোধিতা করেন, তারা খ্রিস্টান না হতে পারেন, কিন্তু যে যুক্তি তারা দিইয়ে থাকেন সেটা একান্তই খ্রিস্ট ধর্মেরই যুক্তি। তারাও বলেন ধর্ম পালনের জন্য পশু উৎসর্গ করা বর্বরদের কাজ। যে সকল ধর্ম এটা করে সেই সকল ধর্ম বর্বরদের ধর্ম। যারা এইসব বলেন তারা খ্রিস্টান না হয়েও আসলে খ্রিস্টানই বটে! সাধু!

ষষ্ঠত, তবুও ফারাকটাও খেয়াল রাখতে হবে।  খ্রিস্ট ধর্ম তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গী কিম্বা ধর্মীয় মতাদর্শের দিক থেকে সৎ। ধর্ম নিরপেক্ষতা, প্রাণী প্রেম, নৈতিকতার বাগাড়ম্বর খ্রিস্ট ধর্ম করে না। প্রাণী কোরবানির বিরোধিতা খ্রিস্ট ধর্মের দিক থেকে একই সঙ্গে ‘কোরবানি’র ন্যায্যতা প্রমাণও বটে। যদি আল্লার সন্তুষ্টি অর্জন বা নৈকট্য অর্জনই আমাদের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে মানুষের মুক্তির জন্য নিজেকে কোরবানির দেবার চেয়ে বড় উৎসর্গ আর কী হতে পারে ! কিন্তু ‘মনের পশু’ কোরবানির তত্ত্ব যারা দিয়ে থাকেন, তাঁরা নিজেদের সেকুলার প্রমাণ করবার জন্য এই সৎ অবস্থান গ্রহণ করেন না। তাঁরা যীশুর মতো মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে রাজি না। তাই তাঁরা ‘মনের পশু’ বধ করবার কথা বলে সস্তায় হাততালি পেতে চান।

সপ্তম, আবারও বলি, খ্রিস্ট ধর্মের যুক্তি হচ্ছে চূড়ান্ত কোরবানির উদাহরণ প্রদর্শিত হয়েছে। আর কোন কোরবানির দরকার নাই। যাঁরা মহান যীশুর উদাহরণ দেখে উজ্জীবিত তাদের উচিত প্রভুর প্রেমের জগতে আশ্রয় লাভ করা। মুশকিল হচ্ছে এই সততা একই সঙ্গে বর্ণবাদ, ঔপনিবেশিকতা ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ঘৃণারও ভিত্তি। এর দ্বারা কারা সভ্য আর কারা অসভ্য, অপরিষ্কার ও হননযোগ্য সেই মানদণ্ডও নির্ধারিত হয়ে যায়। সাদারাই একমাত্র সভ্য এবং তারা খ্রিস্টান। খ্রিস্টধর্ম বর্ণবাদী হোয়াইট সুপ্রিমেসির মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায় । কিন্তু যারা পশু কোরবানিকে বর্বর মনে করেন এবং ভাবেন যে এটা বুঝি ধর্ম নিরপেক্ষ নৈতিক অবস্থান — তারা বুঝতেই পারেন না আসলে ব্যাপারটা অতো সিম্পল নয়। নিজেদের অজান্তেই তারা হোয়াইট সুপ্রিমেসি ও বর্ণবাদের জয়গান গাইছেন। কিন্তু নিজের চেহারা লুকিয়ে। আপনি যদি খ্রিস্টান না হয়ে থাকেন, আপনি নিজেই বলুন আপনাকে কী বলা যায়!

অষ্টম, ইসলাম হজরত ঈসা আলাইহে ওয়া সাল্লামের এই কোরবানিকে মান্য করে। তিনি আল্লার রাসুল এবং তাঁকে রসুল হিসাবে মানা ইসলামে মোমিন হিসাবে বাধ্যতামূলক। দ্বিতীয়ত, হজরত ঈসা আলাইহে ওয়া সাল্লামের মতোই আল্লার সন্তুষ্টি ও মানুষের মুক্তির জন্য নিজেকে নিজে আল্লার পথে কোরবানি দেওয়া ইসলামের চূড়ান্ত একটি আদর্শ যার সঙ্গে ‘জিহাদ’-এর ধারণা যুক্ত। অর্থাৎ আল্লার সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে কোরবানি দেওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত থাকা। হজরত ঈসার (আ) মধ্যে এই বিশুদ্ধ জিহাদি এবং প্রেম মূর্তির যুগল সম্মীলন ঘটেছে বলে তিনি ‘রুহুল্লা’। তাঁর মধ্য দিয়ে নাফসানিয়াতের বিরুদ্ধে রুহানিয়াতের বিজয় ঘটেছে,এবং আল্লার সন্তুষ্টি বিধানের পথে মানুষ রুহানিয়তের পরম যে রূপ প্রদর্শন করতে পারে তার নজির সৃষ্টি হয়েছে। আল্লা তাঁকে তাই নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন। আখেরি নবির আগে আল্লার নৈকট্য লাভের চূড়ান্ত রূপ হজরত ঈসার (আ) মধ্যেই দেখা যায়। এতে প্রমাণিত যে মানুষের পক্ষে এই হাল বা স্বভাব অর্জন সম্ভব, মানুষই সত্যের জন্য আল্লার রাহে শহিদ হতে পারে। কারন এই দুনিয়ায় আল্লাহ মানুষকে আল্লার খলিফা হিসাবেই – রুহানিয়াতের শক্তি সম্পন্ন করেই — পাঠিয়েছেন। ফলে শুধু মৃত্যুর পর বেহেশতের লোভে,দোজখের ভয়ে কিম্বা ব্যাক্তিগত স্বার্থের বশবর্তী হয়ে নয়, বরং জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের মুক্তি এবং আল্লার সৃষ্টি প্রতিটি প্রাণের হেফাজত ও সুরক্ষার জন্য ইসলাম জিহাদের কথা বলে। হজরত মোহাম্মদ (সা) শুধু মুসলমানদের মুক্তির জন্য আসেন নি। তিনি সকল মানুষের জন্যই এসেছেন। শুধু মানুষও নয় – পশু পাখি কীট পতঙ্গসহ আল্লার সকল সৃষ্টির জন্য রহমত হিসাবেই তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে। অতএব খ্রিস্ট ধর্মের সঙ্গে হজরত ঈসা (আ) রুহুল্লাকে নিয় ইসলামের কোন ঝগড়া নাই। অবশ্য তাঁকে নিয়ে গল্পের বয়ান ও ব্যাখ্যায় ফারাক আছে।

কিন্তু বিরোধ তো অন্য ক্ষেত্রে আছেই। খ্রিস্ট ধর্মের সঙ্গে ইসলামের বিরোধের প্রথম ক্ষেত্র হচ্ছে খ্রিস্ট ধর্ম হজরত ঈসাকে আল্লার পুত্র বানিয়ে প্রতিটি মানুষের মধ্যে রুহানিয়াতের বিকাশের সম্ভাবনা কার্যত অস্বীকার করে। এতে দাবি করা হয় আল্লার পুত্র না হলে ইহলৌকিক মানুষের পক্ষে এই প্রকার রুহানিয়াতের শক্তি অর্জন অসম্ভব।  দ্বিতীয়ত ইসলামের অভিযোগ, আল্লার কোন ছেলে মেয়ে নাই। হজরত ঈসা আল্লার পুত্র নন। ইসলাম এখানে খ্রিস্টিয় ধারণার বিপরীতে দাঁড়ায়। একত্ববাদের আদি রসুল হজরত ইব্রাহিম বা আব্রাহামের শিক্ষাকেও এই ক্ষেত্রে খ্রিস্টধর্ম বিরোধিতা করে। যীশুকে আল্লার পুত্র বলার মধ্য দিয়ে ইসলামের প্রধান আপত্তি হোল এটা শেরেকি।  ইসলাম শেরেকি বরদাশত করে না। তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিরোধের জায়গা হচ্ছে খ্রিস্ট ধর্ম সভ্য/বর্বর, সাদা/কালোসহ মানুষের মধ্যে মানুষের যে বিভাজন তৈরি করে ইসলাম তার বিরোধী। ইসলাম সকল প্রকার বর্ণবাদ ও সামাজিক বিভাজনের বিলোপ সাধনের মধ্য দিয়ে নিজেকে ন্যায্য এবং শক্তিশালী ধর্ম হিসাবে আরব দেশে আবির্ভূত হয়েছিল।

খ্রিস্ট ধর্মের বিরুদ্ধে ইসলামের আপত্তি বা অভিযোগ নিয়ে তর্ক হতে পারে।  তবে দুটো ধর্ম হজরত ঈসা আলাইহে ওয়াসাল্লাম কিম্বা যীশুকে মেনেও তাঁর তাৎপর্য বিচার করতে গিয়ে কোথায় পরস্পর ্থেকে পৃথক হয়ে যায় কিম্বা হয়ে গিয়েছে সেই দিকে নজর রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের সকল অভিযোগের সারকথা হচ্ছে প্রচলিত খ্রিস্ট ধর্ম হজরত ইব্রাহিম আলাইহে ওসাল্লামের একত্ববাদের শিক্ষা থেকে সরে গিয়েছে  এবং ঐতিহাসিক ভাবে খ্রিস্ট ধর্ম যে খ্রিস্টিয় ইতিহাস ও খ্রিস্টিয় সভ্যতার উদয় ও বিবর্তন ঘটিয়েছে তার গোড়ায় রয়েছে ঔপনিবেশিকতা ও বর্ণবাদ। 

হিন্দু ধর্মে বলী। ধর্মচর্চার দিক থেকে প্রতিটি অনুষ্ঠানেরই নিজস্ব অর্থ রয়েছে। ধর্মের অন্তর্গত প্রতীকী ভাষা, ধারণা ও ঐতিহ্য থেকে বিচার না করলে এই উৎসর্গকে স্রেফ নির্দয় পশু হত্যাই মনে হবে।

এবার আসা যাক আখেরি নবি কেন হজরত ঈসার (আ) নজির থাকা সত্ত্বেও খ্রিস্টিয় চিন্তার বিপরীতে আবার কোরবানির প্রচলন করলেন। এর প্রধান কারন হজরত ইব্রাহিম। একত্ববাদের প্রধান পুরুষ হিসাবে হজরত ইব্রাহিমের মহিমা আবার কায়েম করাই ছিল্ল আল্লার রসুলের প্রধান লক্ষ্য। আল্লার সন্তুষ্টি বিধান যদি রুহানিয়াতের পথ হয়ে থাকে তাহলে হজরত ইব্রাহিম স্বপ্নে সেই ইঙ্গিত পেয়ে তাঁর সন্তানকে কোরবানি করতে চেয়েছিলেন। কোরবানির এই নজির যেন আমরা ভুলে না যাই। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘আল্লা এক ও অদ্বিতীয়’ – ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌ — এই সত্য হজরত ইব্রাহিমই (আ) সবচেয়ে স্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করেছিলেন। ইসলামপন্থিরা রসুলের উম্মত, কিন্তু হজরত মোহাম্মদ সাল্লেল্লাহে ওলাইহে ওয়া সাল্লাম তার উম্মতদের দৃঢ় ভাবে এই শিক্ষাও দিয়েছেন যে তাঁর উম্মতেরা একই সঙ্গে  ‘মিল্লাতে ইব্রাহিম’-এরও অন্তর্ভূক্ত। শেরেকির বিরুদ্ধে লড়তে হলে হজরত ইব্রাহিম (আ:) ও তাঁর শিক্ষা কোন ভাবেই ভুলে যাওয়া যাবে না। অন্য সকল নবি রসুল তাঁরই ধারাবাহিকতা বহন করে, তাই তাঁরাও সকলে ইসলামের নবি, ইসলামের রসুল। ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্ম ইব্রাহিম বা আব্রাহামকে অস্বীকার করে না। কিন্তু ইসলামের অভিযোগ হজরত মুসা ও হজরত ঈসার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে তারা হজরত ইব্রাহিমের একত্ববাদ থেকে সরে গিয়েছে, তাই তারা ‘মিল্লাতে ইব্রাহিম’এর অন্তর্ভূক্ত হবার সাধনা না করে অন্যদের কাছ থেকে নিজেদের ফারাক করতে চায়। মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ না করে বিভক্ত করে। — অথচ তারাই আবার বড় গলায় হজরত ইব্রাহিমকে তাদের পূর্বপুরুষ হিসাবে দাবি করে। তাদের সুপথে আনবার জন্যই হজরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহকে স্মরণ ইসলামে বিশ্বাসীদের জন্য বাধ্যতামূলক। আল্লার আদেশ পালন করতে গিয়ে হজরত ইব্রাহিম নিজের পুত্র সন্তানকে কোরবানি করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ঘটনার স্মরণে কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব। এই দিন হজরত ইব্রাহিম আলাইহে ওসাল্লামকে স্মরণ করবার দিন। একই ভাবে এই দিন মিল্লাতে ইব্রাহিমের প্রতি অঙ্গীকারেররও দিন।

গল্পটি কিভাবে আমরা সাধারণত শুনি? যদিও কোরানুল করিমের সঙ্গে আমাদের শোনা গল্পের বিশেষ সঙ্গতি নাই, তবু প্রচলিত গল্প সম্পর্কে একটু ধারণা দিচ্ছি। হজরত ইব্রাহিম যখন হজরত ইসমাইলের গলায় ছুরি চালাতে যাচ্ছিলেন,গলা কাটছিল না। তিনি পাথরে ছুরি শান দিলেন। দিয়ে পাথরে ছুরির ধার পরীক্ষা করলেন, পাথর দুই ভাগ হয়ে গেলো। এরপর তিনি আবার সন্তানের গলায় ছুরি চালাতে গেলেন – কিন্তু কোন কাজ হোল না। কিন্তু তাতেও গলা কাটলো না। ইসলামের গল্প হচ্ছে এই যে হজরত ইব্রাহিম বললেন, হে ধারালো ছুরি, তুমি পাথর দ্বিখণ্ডিত করতে পারো, কিন্তু আল্লার সন্তুষ্টির জন্য আমার কাজে বাধা হয়ে উঠছ কেনো? আল্লাহ ছুরিকে কথা বলার ক্ষমতা দিলেন। ছুরি বলল, আপনি একবার আমাকে হজরত ইসমাইলকে কোরবানির আদেশ দিচ্ছেন, আর আল্লাহ সোবহানুতাআলা আমাকে হাজার বার নিষেধ করছেন। আমি তাঁর অধীন। এসময় আল্লার নির্দেশে জিব্রাইল হজরত ইসমাইলের পরিবর্তে দুম্বা কোরবানির জন্য হাজির হয়েছেন। পুরা ঘটনার মধ্যে জিব্রাইল আল্লার মহিমা আল্লা কিভাবে প্রকাশ করেন তার নজির দেখে বলে উঠলেন আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর। হজরত ইব্রাহিম এই ঘোষণা শুনে পিছে ফিরে দেখলেন জিব্রাইল দাঁড়ানো। তিনি সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর দিলেন ‘লা ইলাহা ইল্লালাহ’। ছুরির নীচে স্বেচ্ছায় নিজের গলা পেতে রাখা হজরত ইসমাইল যোগ করলেন ‘ আল্লাহু আকবর, ওয়া লিল্লাহিল হামদ’ – আল্লাহ মহান, সকল প্রশংসা শুধু আল্লার জন্যই। এই গল্পের নানা বয়ান থাকতে পারে, কিন্তু প্রতিটি মুসলমানের জন্য এই মূহূর্তটি চরম আবেগের বিষয়। কোরবানির এই তিনদিন এই সত্য ক্রমাগত উচ্চারণ প্রতিটি মোমিনের জন্য নিত্য জিকির হয়ে ওঠে: ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’

অন্য যে কোন ধর্মের ইতিহাসের মতো ইসলামের ইতিহাসও সরল পথে এগোয় নি। তার অনেক মোড়, বাঁক, স্ববিরোধিতা, দ্বন্দ্ব আছে; আছে নানান মত ও মাজহাব। মানুষের বৈচিত্র ও বিভিন্নতার নিরাকরণ না ঘটিয়েও দুনিয়ার সকল মানুষকে একদিন এক্ত্রিত করতে হবে – রক্ত, গোত্র, আভিজাত্য, গোষ্ঠি, ভূখণ্ড, নৃতাত্ত্বিক কিম্বা ভাষা বা সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ অতিক্রম করে মানুষ একদিন ঐক্যবদ্ধ হবে — ইসলাম এই স্বপ্ন দেখেছিল বলে তার আবির্ভাব ও বিকাশ ঘটেছিল দ্রুত। হজরত ইব্রাহিম সেই স্বপ্নের দ্রষ্টা। যে কারণে আখেরি নবি জেরুজালেমের দিক থেকে রুকু ইব্রাহিম খলিলুল্লার স্মৃতিজড়িত মক্কার দিকে ফিরিয়ে নেন — রুকু বদলের এই ইতিহাসের তাৎপর্য বুঝতে হবে। আখেরি নবি ভেবেছিলেন ইব্রাহিমের মধ্য দিয়ে তিনি সেই সময়ের সকল একত্ববাদী ধর্মকে ঐক্যবদ্ধ করবেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ ও বিবাদের মীমাংসা করবেন। হজরত ইব্রাহিম সেই দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর সম্মানেই তাই কোরবানির ঈদ পালন ওয়াজিব করা হয়েছে।

কিন্তু  ধর্ম তো নিজের সন্তান ও পরিবারকে ভালবাসতে শেখায়? প্রাণীকে ভালবাসতে শেখায়। এটাই তো বিধান, ধর্মীয় আইন। এ কেমন ধর্ম যেখানে নিজের সন্তানকে উৎসর্গ করবার আদেশ আসে? ইব্রাহিম (আ) সেটা পালনও করেন!  কিন্তু ধর্মের এই পারাডক্স, ধাঁধা কিম্বা স্ববিরোধিতার উত্তর ধর্মতত্ত্ব আদৌ দিতে সক্ষম কিনা সেটাই একালের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অবশ্যই আপনাকে সন্তান, পরিবার, সমাজ কিম্বা সকল মানুষকে ভালবাসতে হবে। ইসলামে ‘দয়া’ গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। আল্লাহ ‘প্রভু’ বটে, কিন্তু তাঁকে ‘প্রভু’ ডাকা ইসলামের পছন্দ নয়। বিসমিল্লাহের রাহমানুর রাহিম —  তাঁর সেই ‘ইসম’ বা নামই পছন্দের যেখানে তাঁকে মোমিন দয়ার দয়া বা দয়ালু হিসাবে ডাকেন, যেখানে পরম দয়ালুর এবাদতে মশগুল থাকেন, এবং তাঁর মতোই দয়াবান হবার সাধনা করেন। ফলে তিনি আদেশ দেন বটে, কিন্তু তাঁর বান্দাকে কোলেও টেনে নেন।

তাহলে এটাও বোঝা দরকার, ধর্মতত্ত্বের সীমানা যেখানে টানা হয় সেখান থেকেই এবাদতের জগতের শুরু, তাঁর ডাকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পনের ক্ষেত্রটি জেগে ওঠার ঘটনাও এখানেই ঘটে। সেই ক্ষেত্র হচ্ছে সকল প্রাণের প্রতি দয়া, সকল প্রাণির প্রতি রহমত, নিজের সন্তানসহ সকল সন্তান ও সকল মানুষকে ভালবাসাকে নিছকই ধর্মীয় বা সামাজিক বিধান দিয়ে বোঝা যায় না। আমাদের নীতিনৈতিকতার তর্কগুলো বরং বারবারই এই ধরনের গল্পে বা বয়ানে নাড়া খায়। মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে জগতের সকল সম্পর্ক  আল্লার মধ্যস্থতায় দিব্য হয়ে ওঠে। বাংলার ইসলামে তাই আল্লার ইসম বা নাম হচ্ছে ‘দয়াল’: রাহমানুর রাহিম।

কিছু কথা বলে রাখলাম আপাতত এটা বোঝাবার জন্য যে কোন বিষয়কে আংশিক বা একদেশদর্শী ভাবে বিচার করা মোটেও ঠিক নয়। অর্থাৎ কোরবানি দেবার দরকার কি? ‘মনের পশু’কে কোরবানি দিলেই তো হয় – এগুলো কুতর্ক। যাঁরা এইসব পপুলিস্ট কথাবার্তা বলেন তাঁরা আসলে নীতিগত ও কৌশলগত উভয় দিক থেকেই মারাত্মক ভুল করেন। প্রথমত বোঝা যায় ধর্ম ও ধর্মতত্ত্বের ইতিহাস সম্পর্কে তাঁদের কোন ধারণাই নাই। দ্বিতীয়ত তাঁরা আসলে যে খ্রিস্টিয় তত্ত্বই ধোপদুরস্ত ধর্মনিরপেক্ষতার ভান ধরে প্রচার করছেন সেটা তাঁরা নিজেরাই জানেন  না। যা মূলত বর্ণবাদী তত্ত্বও বটে: তাদের মনের পশুর তত্ত্ব না মানলে ‘কোরবানি’ ধর্ম চর্চার দিক থেকে বর্বব ও অসভ্য।

ইসলামের সমালোচনা বা পর্যালোচনা করুন, কিন্তু না বুঝে বা না জেনে নয়। প্রপাগান্ডার শিকার হবেন না।

সরি, ‘মনের পশু’ তত্ত্ব মেনে নেওয়া যায় না।

  তবে কোরবানি এখন ধর্মীয় নয়,  ভোগবাদের ‘উৎসব’ হয়ে উঠেছে। তাই যাঁরা সত্যি সত্যিই ভোগবাদের বিরোধিতা করেন বিরোধিতা করেন, তাঁদের অনেক যুক্তি আছে। আমি তা সমর্থন করি। তাঁরা ‘মনের পশু’র ধারণা সামনে এনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলতে চান, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ন্যায্য। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতা সম্পর্কে অসচেতন থেকে তুলবার ধরণ এবং ধর্মের ইতিহাস ঘনিষ্ঠ ভাবে পাঠ না করায় এতে ভুল বোঝার সম্ভাবনাই বেশী। এটা তো সত্যি যে আমাদের কিছু বৃত্তি, চরিত্র ও আচরণ রয়েছে যা বিপজ্জনক। পশুর প্রতি নির্দয় হওয়া, অতিরিক্ত ধর্মোৎসাহের কারনে পশু হত্যা বাড়িয়ে দেওয়া, ইত্যাদি। প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি দরদ ইসলামের নীতি, কিন্তু সেই দরদের অভাব আমাদের কাতর করছে না। এগুলো গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ। তবে পশুকে জীব হিসাবে ইসলাম মানুষের চেয়ে হীন মনে করে না। মনের পশুকে হত্যা যদি সিদ্ধ বলে গণ্য হয় তাহলে বাস্তবে পশু কোরবানি দেওয়া অগ্রহণযোগ্য কেন তার কোন যুক্তি নাই। উভয় ক্ষেত্রে পশু হত্যার কথাই বলা হচ্ছে। এই জন্যই ইসলাম কথাটাকে ‘পশু’ প্রতীক দিয়েও বলতে নারাজ। এই ক্ষেত্রে সঠিক শব্দ হচ্ছে ‘নাফসানিয়াত’ — মানুষের নিজের নফস থেকে মুক্ত হতে না পারা। কিন্তু মুক্ত হবার পথ হচ্ছে ‘জিহাদ’। অর্থাৎ নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ। কিন্তু ‘জিহাদ’ শুনলে অনেকের গা হাত পা কাঁপতে থাকে — সমস্যা এইখানে।

শুধু বলে রাখি, কোরবানির ঈদ মোটেও ‘উৎসব’ নয়, এটা পরীক্ষার দিন। মানুষের রুহানিয়াত অর্জনের সম্ভাবনা স্বীকার করে নিজেকে আল্লার পথে যে কোন সময় কোরবানি দেবার শপথ নেবার দিন, মোমিন সেভাবেই এই দিনটি পালন করেন। সেই ক্ষেত্রে তাঁদের অবশ্যই কিছু বিষয় পালন জরুরী বলে ছেলেবেলা থেকে আলেম ওলামা মুফতিদের কাছ থেকে জেনেছি। সেটা হোল,(১) কোরবানির গোশত একবেলার বেশি যেন ঘরে না আসে সেইদিকে খেয়াল রাখা; (২) বাকি গোশত গরিবদের মধ্যে অবশ্যই বিলিয়ে দিতে হবে। কোরবানির গোশতের তারাই হকদার। এই দিনে গরিবকে তার হক থেকে বঞ্চিত করার চেয়ে বড় কোন গুনাহ আর হতে পারে না। তিন ভাগ করে এক ভাগ আত্মীয় স্বজনদের দেওয়ার বিধান আছে। এই বিধান কোন ছহি হাদিসের ওপর ভিত্তি করে প্রামান্য নিয়ম হিসাবে না, ঐতিহ্য হিসাবে গড়ে উঠেছে। তাছাড়া গরিবের মধ্যে সেই সব আত্মীয়স্বজনও অন্তর্ভুক্ত, যারা গরিব। ফলে গরিবের হকের ওপর জোর দেওয়া একালে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

. কোরবানির গোশত জমিয়ে রেখে খাওয়ার মধ্যে যে ভোগবাদিতা ও ভোগী আচরণ গড়ে উঠেছে তা কোন ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। দুঃখিত। যারা মাংস খেতে চান তো খান। তবে দয়া করে মিল্লাতে ইব্রাহিমের অপমান করে ঈদের দোহাই দিয়ে এই ভোগবাদিতার পক্ষে যুক্তি দেবেন না। ভোগবাদিতার সঙ্গে কোরবানির কোন সম্পর্ক নাই। এর সঙ্গে সম্পর্ক পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ ও ব্যক্তিতন্ত্রের। ইসলামকে অবশ্যই এই পুঁজিতন্ত্র ও ভোগবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ভাবে দাঁড়াতে হবে। না দাঁড়ালে ভোগবাদীদের চরিত্রই ইসলামের চরিত্র বলে সবাই মারাত্মক ভুল করবে। আর এখন তাই ঘটছে। আলেম ওলামা মওলানা মুফতিদের এই ক্ষেত্রে ভূমিকা রয়েছে। এখন ঈদের যে রূপ তা ভোগবাদিতারই প্রতিযোগিতা। দয়া করে এর সঙ্গে কেউ ইসলামকে জড়াবেন না। সবার কাছে আবেদন, ভোগবাদিতার বিরোধিতা করুন। মাংস খাওয়া আর গরু জবাইয়ের উৎসবের সঙ্গে ইসলামের কিম্বা মিল্লাতে ইব্রাহিমের দাবিদার কোন মোমিনের সম্পর্ক আছে বলে অন্তত আমার সীমিত পড়াশুনায় মনে হয় নি। যারা জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ ও মুফতি – মতামত দেবার অধিকারী — তাঁরাই ভাল জানবেন।

ফরহাদ মজহার

কবি, চিন্তক, বুদ্ধিজীবী ও কৃষক। জন্ম: ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশের নোয়াখালি জেলায়। পড়াশুনা করেছে ওষুধ শাস্ত্র ও অর্থনীতি বিষয়ে যথাক্রমে ঢাকা ও নিউইর্কে। পেশা সূত্রে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলাদেশের ‘নয়াকৃষি আন্দোলন’-এর প্রধান সহযোদ্ধা। লালন ধারা-সহ বৃহৎ বঙ্গের ভাবান্দোলন পরম্পরার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, সমাজ ও রাজনীতি চিন্তা এবং দার্শনিক বিষয়ে বহু গদ্য রচনা করেছেন। এছাড়াও লিখেছেন নাটক। অনুবাদও করেছেন।
তাঁর বইগুলি-
কাব্যগ্রন্থ:
খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ (১৯৭২) ।। ত্রিভঙ্গের তিনটি জ্যামিতি (১৯৭৭) ।। আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে (১৯৮৩) ।। সুভাকুসুম দুই ফর্মা  (১৯৮৫) ।। বৃক্ষ: মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক বিষয়ক কবিতা (১৯৮৫) ।। অকস্মাৎ রপ্তানিমুখী নারীমেশিন (১৯৮৫) ।। খসড়া গদ্য (১৯৮৭) ।। মেঘমেশিনের সঙ্গীত (১৯৮৮) ।। অসময়ের নোটবই (১৯৯৪) ।। দরদী বকুল (১৯৯৪) ।। গুবরে পোকার শ্বশুর (২০০০) ।। কবিতার বোনের সঙ্গে আবার (২০০৩) ।। ক্যামেরাগিরি (২০১০) ।। এবাদতনামা (২০১১) ।। অসময়ের কবিতা (২০১১) ।। কবিতাসংগ্রহ (২০১১) ।। তুমি ছাড়া আর কোন্ শালারে আমি কেয়ার করি? (২০১৬) ।। সদরুদ্দীন (২০১৮)

গদ্যগ্রন্থ:
প্রস্তাব (১৯৭৬) ।। সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থান এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উত্থান প্রসঙ্গে (১৯৮৫) ।। রাজকুমারী হাসিনা (১৯৯৫) ।। সাঁইজীর দৈন্য গান (২০০০) ।। জগদীশ (২০০২) ।। সামনা সামনি: ফরহাদ মজহারের সঙ্গে কথাবার্তা (২০০৪) ।। বাণিজ্য ও বাংলাদেশের জনগণ (২০০৪) ।। মোকাবিলা (২০০৬) গণপ্রতিরক্ষা (২০০৬) ।। ক্ষমতার বিকার ও গণশক্তির উদ্বোধন (২০০৭) ।। ভাবান্দোলন (২০০৮) পুরুষতন্ত্র ও নারী (২০০৮) ।। সাম্রাজ্যবাদ (২০০৮) ।। রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠ (২০০৮) ।। সংবিধান ও গণতন্ত্র (২০০৮) ।। নির্বাচিত প্রবন্ধ (২০০৮) ।। তিমির জন্য লজিকবিদ্যা (উপন্যাস, ২০১১)
প্রাণ ও প্রকৃতি (২০১১) ।। মার্কস পাঠের ভূমিকা (২০১১) ।। ডিজিটাল ফ্যাসিবাদ (২০১২)
যুদ্ধ আরো কঠিন আরো গভীর (২০১৪) ।। ব্যক্তি বন্ধুত্ব ও সাহিত্য (২০১৬) ।। মার্কস, ফুকো ও রুহানিয়াত (২০১৮)

নাটক:
প্রজাপতির লীলালাস্য (১৯৭২)

অনুবাদ:
অর্থশাস্ত্র পর্যালোচনার একটি ভূমিকা (মূল: কার্ল মার্ক্স) (২০১০)
খুন হবার দুই রকম পদ্ধতি (মূল: রোকে ডাল্টন) (২০১১)

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top