ভদ্রলোকের সংস্কৃতি ও বাংলা

।। অরূপশঙ্কর মৈত্র ।।

কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালিদের যে ছোট গণ্ডি, তা আসলে কতটা বাংলা ও বাঙালির সঙ্গে সম্পর্লিত তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কুয়ার ব্যাঙ কলিকাতার বাবু বাঙালির মন-মগজের মধ্যে যা কিছু বাঙালি সংস্কৃতি বলে ক্লেইম করা হয় তা নিয়ে লিখলেন অরূপশঙ্কর মৈত্র। ছুঁয়ে গেলেন কলকাতার বাইরে বিস্তৃত ‘ছোটলোক’ বাঙালির প্রসঙ্গও।

চরিত্র বলতে কিন্তু ভাল মন্দ বোঝাচ্ছি না। না দুশ্চরিত্র, না সুচরিত্র। চরিত্রহীনও নয়। ক্যারেকটার নয়। এক্ষেত্রে চরিত্র বলতে ধর্ম। ধর্ম মানে রিলিজিয়ন নয়। ধর্ম মানে প্রপার্টিজ। ছোটবেলায় কেমিস্ট্রিতে পড়তে হত, অক্সিজেন কিম্বা কপারের প্রপার্টিজ। কেউ বলত না, কার্বন ডাই অক্সাইড দুশ্চরিত্র। ওটা আমরা বলি, গাছেদের কাছে ওটা প্রাণবায়ু। প্রপার্টিজ মানে সম্পত্তি। হ্যাঁ, আচার, খ্যাদ্যাভ্যাস থেকে মোচ্ছব, মেলা থেকে নানা টোটেম বিশ্বাস, অজস্র অনন্ত বহমান লোকাচারের ধারা মিলেমিশে একটা ধর্মতলা। একটাই ধর্মতলা। সব পথ যেখানে এসে মিলিত হয়। সেটাই বাঙালির চরিত্র।

বাঙালির সংস্কৃতি নিয়ে একটি লেখা লিখতে অনুরুদ্ধ হয়েছি। তো শুরুতেই আমার সারকথাটা বলে নেই। বাঙালি চরিত্রে নৈরাজ্যবাদী।
অনেকেই হয়তো বিরক্ত হবেন। এখানে তিনটে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এই শব্দগুলো নিয়ে একটা শব্দছক কষা যাক।
প্রথমে “বাঙালি”।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, বাঙালি বলতে কাদের বোঝানো হচ্ছে? সহজ উত্তর, যার বা যাদের মাতৃভাষা বাংলা। তাহলে পরের প্রশ্ন হবে বাংলা ভাষা কাকে বলে? সহজ উত্তর হল “বাঙালি” যে ভাষায় কথা বলে। এটা টটোলজি। অনেকটা “যেদিকে সূর্য ওঠে তাকে পুর্বদিক বলে। আর পুর্বদিকে সূর্য ওঠে”র মত। অনেকে বাঙালি বলতে একটা জাতি বোঝেন, কেউ কেউ জাতিসত্ত্বা বলেন। আমার কাছে বাঙালি জাতিও নয়, জাতিসত্তাও নয়। বাঙালি একটি সভ্যতা। ইউনিক সভ্যতা। যেমন মায়া সভ্যতা, মিশরিয় বা সিন্ধু সভ্যতা, তেমনি। আরও নির্দিষ্ট করে বললে সভ্যতার ককটেল। তাহলে প্রশ্ন হবে সভ্যতা বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? সভ্যতা বলতে কালচার বোঝাচ্ছি। যার বাহন হল ভাষা। এক্ষেত্রে বাংলা ভাষা। ভাষা বাংলা, আর বোঝানোর জন্য ইংরেজি ‘কালচার’ শব্দটা ধার করতে হচ্ছে? সংস্কৃতি বলতে অসুবিধে কি? সত্যি কথা বলতে কি সংস্কৃতি শব্দটা আমাদের ভোকাবুলারিতে ছিল না। ইংরেজরা আসার পর সাহেবদের সঙ্গে সাহেবি কালচার এসে পৌছেছিল! ‘আমরা ইংল্যান্ডের মত কাশি, ফ্রান্সের মত হাসি, পাও ফাঁক করে সিগ্রেট খেতে বড়ই ভালবাসি’। বিদ্যাসুন্দরী মার্কা খেউর হটিয়ে শেক্সপিয়ার এসে গেল। বাঁচা গেল। উঃ। বেদ উপনিষদের সঙ্গে রুশো ভলতেয়ারের মেলবন্ধনে ব্যাপক চর্চা শুরু হল। এবার এই কালচারের একটা দেশজ প্রতিশব্দ খুব দরকার হয়ে পড়ল। কী বলা যায়? বাংলায় কি তার আগে কালচার ছিল না? ছিল তো বটেই কিন্তু কোন শব্দে তা বোঝানো যেত? জানিনা। বাংলা চাষবাসের দেশ। কৃষিভিত্তিক সভ্যতা বলেন বিদ্বজ্জনেরা। অবশ্য বিদ্বজ্জনেরা কোনোদিন ভুল করেও মাঠে নেমে লাঙল ধরেন নি। নদীতে জাল ফেলেন নি। কামারশালায় হাতুড়ি পেটান নি। চাষি, জেলে, কামার, কুমোরদের কাজ ভদ্রলোকদের জন্য নয়।বিশেষত কলকাতার ভদ্রলোকেরা। তাঁরা পড়াশুনো করেন, বেদ, বেদান্ত, পুরাণ উপনিষদ পেরিয়ে, ভলতেয়ার, রুশো, কান্ট, স্মিথ, লক, ছাড়িয়ে মার্ক্স, লেনিন, গ্রামসি, অ্যালথুজার, ফুকো। তাঁরা পাঠশালা, চতুষ্পাঠি, টোল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন। তাঁরা শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী হন, রাজনৈতিক নেতা হন। সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বড়বাবু, মেজবাবু, দত্ত কিম্বা গাঙ্গুলীসাহেব হন। তাঁরা কলিকাতার ভারতসভা হল, টাউন হল, এবিপি আনন্দ, ত্রিগুণা সেন অডিটোরিয়াম আলো করেন। লিটল ম্যাগাজিন করেন। সেখানে নিম্নবর্ণের প্রবেশ নিষেধ। মাটি? ছিঃ। নেহাই? ছ্যাঃ। জাল? ছোঃ।

ভেবে দেখা দরকার, যদি কলকাতার কালচারাল চালচিত্রের ওইসব বাল্মীকি, ব্যাসদেব, শঙ্করাচার্য, চন্ডীদাস, ভারতচন্দ্র, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গদর্শন, বিবেকানন্দ, নন্দলাল, সত্যজিৎ, জীবনানন্দ, শম্ভুমিত্র, উৎপল দত্ত, পরিতোষ সেন, দেশ, আনন্দবাজার, সুনীল, শক্তি, শঙ্খের হাত ধরে যে কালচার গড়ে উঠেছে তাকে বাংলার সভ্যতা বলা হয়, তাহলে খাল বিল নদী নালা কৃষিকেন্দ্রিক যা কিছু এই বাংলায় গজিয়েছে সবই অসভ্যতা বলতে হয়। সাজানো বাগান আর জঙ্গল তো এক নয়। প্রথমটি মানুষের সৃজন, অপরটি প্রকৃতির। যে কোনও একটাকে সভ্যতা বলতে হবে। একজন বন্দ্যোপাধ্যায় পদ্মানদীর মাঝি কিম্বা চট্টোপাধ্যায় গফুর মিয়াঁর যাপন বর্ণনা করলে সেটা সভ্যতার অঙ্গ আর নদীর মাঝি কিম্বা মিয়াঁ গফুর যখন তার দেখা জমিদারবাড়ির যাপন বর্ণনা করে সেটা ইতর হয়ে যায়! শুধু দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। মানিক বা শরৎচন্দ্রের কলম নিঃসৃত একটি অক্ষরের মত অক্ষর রচনা করতে আজন্ম সাধনা করতে হবে। তবু বলি, “পদ্মানদীর মাঝি” কি ওই মাঝিদের কাছে আদপেই পৌঁছেছে? বোধহয় নয়? উচ্চবর্ণ ভদ্রলোকের পৃথিবীতে ওই মাঠে মাটিমাখা হাত, হাতুড়ি ধরা হাত, বটি ধরা হাত, মাকু টানা হাত, ঘুর্ণায়মান চাকায় কুমোরের কাদালাগা হাতে যা কিছু রচিত হয়, সেসব অসভ্যতা। আজ এই বর্ণভেদি সভ্যতা আর অসভ্যতা আমার বাংলায় ঠিক কী চেহারায় উপস্থিত? তাকি অতীত নাকি আজও বর্তমান? ‘কালচার’ এসে পড়ায় বিপদ হয়ে গেল। কালচারের যে একটা বাংলা প্রতিশব্দ চাইই-চাই। যেহেতু ইওরোপীয় ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, হাজার দশেক বছর আগে কৃষির আবিষ্কারের সঙ্গেই আধুনিক সভ্যতার শুরু, তাই কৃষি থেকেই কালচার শব্দের জন্ম। চাষ অর্থাৎ কাল্টিভেট থেকে কালচার। এখানে তাহলে কালচারের বাংলা হতে পারে কৃষ্টি। অসুবিধে নেই কেননা, কৃষি শব্দটি সংস্কৃত, প্রাকৃত নয়। অতএব অচ্ছুৎ নয়। যোগেশচন্দ্র রায়বিদ্যানিধি এই কৃষ্টি শব্দটি প্রথম কালচারের প্রতিশব্দ হিসাবে প্রয়োগ করতে শুরু করেন বলে দাবি করেছেন। অমনি উচ্চবর্ণ মহলে প্রবল প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। চাষবাসের সঙ্গে যা কিছু সম্পৃক্ত তাই আমাদের কাছে ঘৃণার। খাজনাটুকু ছাড়া। “চাষার ছেলে কি চিরকাল চাষাই হবে? ন্যানো গাড়ির ড্রাইভার হবেনা?” আমাদের সভ্যতা বা কালচার কৃষি থেকে আগত? হতে পারে ইওরোপে তাই, কিন্তু এখানে? এই বাংলায়? নোংরা প্যাচপেচে কাদার মধ্যে আমাদের (বৈদিক) সভ্যতার জন্ম? আহা নোংরা বলছ কাকে? ওটাতো মাটি। (সুধীর চক্রবর্তী)। মাটি? অনেকদিন আগেই আমরা মাটিকে ঘেন্না করতে শিখেছি। “দিল সব মাটি করে” মানে নষ্ট হয়ে গেল। মাটি=নষ্ট। কৃষ্টি ভদ্রলোকদের মেনে নেওয়া কঠিন।

বাবু-বিবির যাপন। ছবি- গৌতম মুখোপাধ্যায়

রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভদ্রলোক সভ্যতার মূর্ত প্রতীক। তিনি কী বললেন? তিনি ‘‘কৃষ্টি’’ শব্দটাকে একেবারেই সহ্য করতে পারলেন না৷ বললেন, ‘‘কালচার শব্দের একটা নতুন বাংলা কথা হঠাৎ দেখা দিয়েছে; চোখে পড়েছে কি? কৃষ্টি৷ ইংরেজি শব্দটার আভিধানিক অর্থের বাধ্য অনুগত হয়ে ঐ কুশ্রী শব্দটাকে কি সহ্য করতেই হবে৷ এঁটেল পোকা পশুর গায়ে যেমন কামড়ে ধরে ভাষার গায়ে ওটাও তেমনি কামড়ে ধরেছে।” (এখানে লক্ষণীয় কবির উপমা। এঁটেল পোকা। বাংলার মাটি মূলত এঁটেল আর দোআঁশলা। কেননা, বাংলার মাটি মূল ভারত ভূখণ্ডের মত গণ্ডোয়ানা টেকটনিক প্লেট থেকে গজায় নি। গজিয়েছে অজস্র জলধারা বাহিত পলিমাটি থেকে। কাজেই এঁটেলমাটির এঁটেলপোকা ছোটলোক বাংলার ঐতিহ্য। তা ভদ্রলোকদের কাছে আদপেই সহনীয় নয়।

লক্ষ্য করবেন, দোআঁশলা শব্দটিও। ভদ্রলোক সমাজে সাধারণত নিন্দার্থেই ব্যবহৃত হয়। অথচ, আমাদের ক্ষুধার অন্ন ওই দোআঁশলা মাটিতেই সবচেয়ে ভাল তৈরি হয়।)। কালচার-এর বাংলা তবে কি হবে? এমন সময় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এসে নাকি বললেন, প্রাকৃত ভাষা (অর্থাৎ ছোটলোকেরা যে ভাষায় কথা বলে) সংস্কার করেই তো সংস্কৃত ভাষার জন্ম হয়েছিল। তাহলে কালচারের বাংলা প্রতিশব্দ ‘সংস্কৃতি’ হতে পারে কী? সংস্কার থেকে সংস্কৃত যেমন? হ্যাঁ, হ্যাঁ, সংস্কৃতি হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ অনুমোদন করলেন৷ তিনি আরও বললেন, এই শব্দটি আগেই ছিল, বৈদিক সাহিত্যে “সংস্কৃতি” ছিল। “আত্মসংস্কৃতির্বাব শিল্পানি”। যার অর্থ Arts indeed are the culture of soul. মারাঠি হিন্দিতেও কালচার বলতে সংস্কৃতি বলা হয়। রবীন্দ্রনাথ বললেন সাংস্কৃতিক ইতিহাস ক্রৈষ্টিক ইতিহাসের চেয়ে অনেক বেশি শ্রুতিমধুর।বিদ্যানিধি মেনে নেননি। এই নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ শুধু ক্ষুব্ধ নন, রীতিমত ক্রুদ্ধ হয়েছেন। যেন ‘কৃষ্টি’ শব্দের ব্যবহারকারিদের মুখদর্শন করবেন না। “যে মানুষ কালচারড, তাকে কৃষ্টিমান বলার চেয়ে সংস্কৃতিমান বললে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হবে”।

বাংলার মাটি মূল ভারত ভূখণ্ডের মত গণ্ডোয়ানা টেকটনিক প্লেট থেকে গজায় নি। গজিয়েছে অজস্র জলধারা বাহিত পলিমাটি থেকে। কাজেই এঁটেলমাটির এঁটেলপোকা ছোটলোক বাংলার ঐতিহ্য। তা ভদ্রলোকদের কাছে আদপেই সহনীয় নয়।

এবার দ্বিতীয় শব্দ ‘চরিত্র’।

না, চরিত্র বলতে কিন্তু ভাল মন্দ বোঝাচ্ছি না। না দুশ্চরিত্র, না সুচরিত্র। চরিত্রহীনও নয়। ক্যারেকটার নয়। এক্ষেত্রে চরিত্র বলতে ধর্ম। ধর্ম মানে রিলিজিয়ন নয়। ধর্ম মানে প্রপার্টিজ। ছোটবেলায় কেমিস্ট্রিতে পড়তে হত, অক্সিজেন কিম্বা কপারের প্রপার্টিজ। কেউ বলত না, কার্বন ডাই অক্সাইড দুশ্চরিত্র। ওটা আমরা বলি, গাছেদের কাছে ওটা প্রাণবায়ু। প্রপার্টিজ মানে সম্পত্তি। হ্যাঁ, আচার, খ্যাদ্যাভ্যাস থেকে মোচ্ছব, মেলা থেকে নানা টোটেম বিশ্বাস, অজস্র অনন্ত বহমান লোকাচারের ধারা মিলেমিশে একটা ধর্মতলা। একটাই ধর্মতলা। সব পথ যেখানে এসে মিলিত হয়। সেটাই বাঙালির চরিত্র।

এরপর শেষ শব্দ নৈরাজ্যবাদী।

এই অসাধারণ শব্দটাকে বাঙালি ভদ্রলোকেরা বারবার ভুল ব্যবহার করে করে মন্দ করে দিয়েছে। বেচারা নৈরাজ্য। দূরে গাছতলায় একা একা বসে রোদ বৃষ্টি ঝড়ে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কেঁদে মরছে। না আছে মাথার ওপর ছাদ, না আছে পায়ের তলায় পাকা মেঝে। খোলা আকাশ আর কাদামাটি। নৈরাজ্য ইংরেজি অ্যানার্কি অর্থে। কেওস অর্থে নয়। এবার দেখা যাক, নৈরাজ্য কী? নেই রাজ্য থেকে নৈরাজ্য। রাজ্য তো রাজা ছাড়া হয় না। তাহলে রাজা নেই, অর্থাৎ শাসন নেই। শাসন নেই মানে শৃঙ্খলা নেই, মানে শৃঙ্খল নেই। এতো ভদ্রলোক বাবুদের জন্য বিপজ্জনক। রোজ মিডিয়ায় বিশুপাগলারা গলা সপ্তমে চড়িয়ে গুষ্টির শ্রাদ্ধ করছে, গেল গেল, চারদিকে আইন শৃঙ্খলা আর থাকল নাগো, কী হবে। হাউ হাউ। রবিঠাকুর এমন একটা অবস্থা আন্দাজ করে বলেই গেছেন, “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে”। আমরা সবাই রাজা। আবার অ্যানার্কি মানে নো আর্ক। আর্ক তো ক্লাস এইটে বৃত্ত পড়বার সময় পড়তে হয়েছে। কলকাতাসহ সারা বাংলায় যত জমিদার বাড়ি বা মন্দির বা মসজিদ বা গীর্জা বা রাইটার্স বিল্ডিং বা কোনও বড় স্থাপত্য, আর্ক ছাড়া অসম্ভব। কেননা, প্রত্যেকটা স্থাপত্যে রাজা আছে, শাসন আছে, আইনকানুন আছে, শৃঙ্খলা আছে। এই আর্ক না থাকা মানেইতো অ্যানার্ক।

চর দখল: এস এম সুলতান

এবার প্রশ্ন বাঙালির চরিত্র নৈরাজ্যবাদী কেন?

এখানে বাঙালি মানে বাংলার মূলনিবাসী। যারা শ্রমজীবী। ভূপ্রকৃতি যাদেরকে ক্ষ্যাপা বাউন্ডুলে করে তুলেছে। তারা নৈরাজ্যবাদি। আর যারা ভদ্রলোক পরশ্রমজীবি। যারা শ্রমকে ঘৃণা করে,  যারা শৃঙ্খলা পছন্দ করে, তারা  রাজ্যবাদি। রাজ্যবাদ, নৈরাজ্যবাদ। একটা ডাইকটমি। ডায়ালেকটিকস। ইউনিটি অফ অপোজিটস। এটা কিন্তু ডিভিশন অফ লেবার নয়। সে বস্তু  সারা পৃথিবী জুড়েই আছে। একদল শ্রমজীবী, আর একদল পরশ্রমজীবী। ইওরোপ, আমেরিকা সব জায়গায় ডিভিশন অফ লেবার আছে। কিন্তু সেটা বংশপরম্পরায় নয়। তারা শ্রমকে ঘৃণাও করে না। দরিদ্র ব্রাহ্মণ, খেতে পাচ্ছে না, তবু হাল-বলদের কাজ করবে না। যজমানি করে পেট চালাবে। এখানে আজকে রাজা কালকে ফকির হতেই পারে, ভিক্ষেও করতে পারে, আমাদের বৈদিক শাস্ত্রে ভিক্ষে জায়েজ, কিন্তু হারগিস লাঙল কিম্বা হাতুড়ি ধরবে না। ক্লাসে মবিলিটি হয়। কাস্টে হয়না। এদেশে ক্লাসের চেয়ে কাস্টের গুরুত্ব বেশি। বংশপরম্পরা। চোদ্দপুরুষ কথাটা এই জন্য আমাদের সোসাইটিতে এত গুরুত্বপূর্ণ।

এখন প্রশ্ন হল রাজ্যবাদী, নৈরাজ্যবাদীরা এখানে কি বরাবর সহাবস্থান করছে? না,  রাজ্যবাদীরা আজকের ভাষায় বহিরাগত। প্রথমত এই রাজ্যবাদীদের আমার বাঙালি বলতে একটু অস্বস্তি হয়। বলা যায় বাঙালি পরিচয়টা এরা চুরি করেছে। আমার হিসেবে এখানে স্টেটিস্ট বা রাজ্যবাদীরা ম্যাক্সিমাম দেড় থেকে দু’হাজার বছর আগে এসে পৌঁছে ছিল। তার আগে ওদের কাছে বাংলা ছিল একেবারেই ব্রাত্য এলাকা। বলে রাখি, সেযুগে বাংলা বলতে শুধু দক্ষিণ-পুর্ববঙ্গ বোঝাতো। মূলত ভাটি এলাকা। গঙ্গা থেকে মেঘনা। সেযুগে পৌণ্ড্র বা বরেন্দ্রভূমি যা পরবর্তীকালে গুড়ের জন্য  গৌড় নামে বিখ্যাত হয়েছিল আর রাঢ় অঞ্চলকে কিন্তু বাংলার অংশ ধরা হোতো না। তাহলে গৌড়বঙ্গ, রাঢ়বঙ্গ? সেই যুগের কোনও সাহিত্য, সে বৈদিক পুরাণ হোক অথবা, বিদেশিদের ভ্রমণকাহিনী হোক, পাণ্ডুলিপি শিলালিপি কোথাও গৌড়ের সঙ্গে বা রাঢ়ের সঙ্গে ‘বঙ্গ’ শব্দটা নেই। আছে সমতট এবং বঙ্গের আলাদা করে উল্লেখ। যেখানে তট সমান হয়ে যায়, সেটাই সমতট। অর্থাৎ ভাটি বা নাব্য এলাকা। সম এবং তট এই আর্যভাষার প্রয়োগ বলে দেয়, এই নামকরণ কাদের। আমরা অনেকেই জানিনা, আফ্রিকা নামটা আফ্রিকানদের দেওয়া নয়, আফ্রিকার বাইরের অধিবাসিদের। যেমন হিন্দুস্তান নামটা। সেইযুগে বঙ্গ ছিল ব্রাত্য এলাকা। তাদের চোখে বাংলায় থাকতো সরু সরু ঠ্যাংওয়ালা পক্ষির দল। কিচিরমিচির করে পাখির ভাষায় কথা বলে।  এখানে আর্যাবর্ত থেকে কেউ আসত না। নিষিদ্ধ এলাকা তাই। যেমন আমাদের কাছে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গল নিষিদ্ধ। কারণ সেখানে মানুষ খেকো বাঘ আছে। বঙ্গে ছিল সাপখোপ, জোঁক, বিছে, মৌমাছিদের অবিরাম লীলা। তাই উত্তরের রাজ্যবাদি পরশ্রমজীবীদের কাছে এই বাংলা ছিল ইতর অসভ্য-বর্বর অসুর, ডাকাতদের এলাকা। এমন ভয়ঙ্কর দুর্গম জল কাদা নদী-খাল-বিল-দহ-সাগরে মানুষ থাকতে পারে? পাছে কেউ ভুল করে চলে যায় তাই বলা হতো ওখানে গেলে পতিত হয়ে যেতে হবে। ফিরে আসতে হলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তাদের কথা রবীন্দ্রনাথ গানে বলেছেন চলো নিয়ম-মতে। দূরে তাকিয়ো নাকো, ঘাড় বাঁকিয়ো নাকো, চলো সমান পথে। ‘হেরো অরণ্য ওই, হোথা শৃঙ্খলা কই? পাগল ঝর্নাগুলো দক্ষিণপর্বতে।’ ও দিক চেয়ো না, চেয়ো না, যেয়ো না, যেয়ো না, চলো সমান পথে।

হয়তো শকুন টুকুন ভাবত। নাকি হাড়গিলে? ইন্টেরেস্টিংলি হাড়গিলে জাতীয় শকুনদের ম্যাক্সিমাম দেখা যায় কিন্তু এই সাউথইস্ট এর বাংলা আসাম বার্মা অঞ্চলগুলোয়।

সেযুগে বাংলা বলতে শুধু দক্ষিণ-পুর্ববঙ্গ বোঝাতো। মূলত ভাটি এলাকা। গঙ্গা থেকে মেঘনা। সেযুগে পৌণ্ড্র বা বরেন্দ্রভূমি যা পরবর্তীকালে গুড়ের জন্য  গৌড় নামে বিখ্যাত হয়েছিল আর রাঢ় অঞ্চলকে কিন্তু বাংলার অংশ ধরা হোতো না। তাহলে গৌড়বঙ্গ, রাঢ়বঙ্গ? সেই যুগের কোনও সাহিত্য, সে বৈদিক পুরাণ হোক অথবা, বিদেশিদের ভ্রমণকাহিনী হোক, পাণ্ডুলিপি শিলালিপি কোথাও গৌড়ের সঙ্গে বা রাঢ়ের সঙ্গে ‘বঙ্গ’ শব্দটা নেই। আছে সমতট এবং বঙ্গের আলাদা করে উল্লেখ। যেখানে তট সমান হয়ে যায়, সেটাই সমতট। অর্থাৎ ভাটি বা নাব্য এলাকা। সম এবং তট এই আর্যভাষার প্রয়োগ বলে দেয়, এই নামকরণ কাদের। আমরা অনেকেই জানিনা, আফ্রিকা নামটা আফ্রিকানদের দেওয়া নয়, আফ্রিকার বাইরের অধিবাসিদের। যেমন হিন্দুস্তান নামটা। সেইযুগে বঙ্গ ছিল ব্রাত্য এলাকা। তাদের চোখে বাংলায় থাকতো সরু সরু ঠ্যাংওয়ালা পক্ষির দল। কিচিরমিচির করে পাখির ভাষায় কথা বলে।

তাহলে প্রশ্ন ওঠে এখানে হঠাৎ এই রাজ্যবাদীদের আসা শুরু হলো কি করে?

খবর পৌছে গেছিল এই বাংলা সাংঘাতিক উর্বরা আর প্রচুর সম্পদ। সোনার বাংলা। বরাবরই এই সোনার বাংলার ওপর নজর পড়েছে ওই উত্তরভারতীয় দস্যুদের। সোনার বাংলা কিম্বা সুনার বঙলা। প্রথমে বণিকদের নজরে পড়লো। বৈশ্যদের। তারা ছুটে এলো। কিন্তু দূর্গম প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে, ভিতরে প্রবেশ করি সে সাধ্য ছিলনা একেবারে। তাই প্রান্তে প্রান্তে বাণিজ্য নগরী। তাম্রলিপ্ত। তারপরে বণিকদের বাণিজ্য করার প্রয়োজনেই ক্রমশ এখানে শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন হল। বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ডরূপে পোহালো শর্বরী। রাজদণ্ডের সঙ্গে রাজদণ্ড চালানোর জন্য দরকার হয়ে পড়ল প্রশাসকের দল। আইসিএস, ডব্লিউবিসিএস, আইপিএস অফিসার। এবং বৈদিক ব্রাহ্মণদের ওই উত্তর থেকে নিয়ে আসতে হলো নানা উপঢৌকন দিয়ে। তারা এসে এখানে রাজ্য বা স্টেটহুড প্রতিষ্ঠা করল। স্টেট কিংবা রাজ্য অথবা রাষ্ট্র আমাদের খুব চেনা। বাড়ি থেকে বেরুলেই আমাদের রাজ্যের সঙ্গে দেখা হয়। কখনো রাস্তার মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ। একটু পরেই থানা। মন্ত্রীর কনভয়, পঞ্চায়েত। অথবা নানা সরকারী নির্দেশ, আধার থেকে বার্থ সার্টিফিকেট। কিন্তু নৈরাজ্যবাদ কি? কিভাবে?

যদি আমরা সমাজ সমুদ্রের গভীরে যাই, তাহলে কিন্তু দেখব নৈরাজ্যবাদের টানা চোরাস্রোত আজও রয়েছে। এই নৈরাজ্যবাদ রাজ্যবাদিদের চক্ষুশূল। তাই তারা এটাকে নিন্দার্থে ব্যবহার করে। আকাশে তাকিয়ে দেখলে দেখা যায় পাখিদের নৈরাজ্য।

নৈরাজ্যের সূত্র বাসা। আমরা যেখানে থাকি। বাড়িকে বাসা বলে বাঙালরা। ছোটবেলায় বাবা ঠাকুরদার মুখে বাসা শব্দটা বার বার শুনেছি। পদ্মাপারে কোথায় যেন আমাদের বাসা আছিল। বাঙালরাও বাড়ি বলে, বাড়ি হোম অর্থে। আর বাসা রেসিডেন্স অর্থে। বেটার শেল্টার। আশ্রয়। শেল্টার টেম্পোরারি হয়। এখানে বাসাও টেম্পোরারি। ওই যে দেখা যাচ্ছে দূরে, মরা নদীর পাশে ছোট্ট একটা কুঁড়ে। ওটা আমার বাসা। একটা ভালো বাসার খোঁজেই সারাজীবন ছোটা। ভালোবাসা। বাংলার ভূপ্রকৃতি কিছুতেই এই ভালোবাসা স্থায়ী হতে দেয় না। বাসা ভেঙে যায়, ভালোবাসা হারিয়ে যায়! আবার নতুন করে অন্য জায়গায় গিয়ে বসতি স্থাপন করতে হয়, বাসা বাঁধতে হয়। যেহেতু নৈরাজ্যবাদী শ্রমজীবী বাঙালি ভালো বাসা খুঁজে বেড়াত তাই উনিশ শতকে ভালোবাসা শব্দটাই অশ্লীল ছিল রাজ্যবাদিদের কাছে। ভূপ্রকৃতির এই নৈরাজ্যই আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। আমরা জানি এই কিচিরমিচির পাখির দলের জীবনের নিশ্চিন্ত স্থায়ি ঠিকানা, আশ্রয় বাসা সম্ভব নয়। আর স্থায়িত্ব না থাকলে রাজ্য হয়না। আমাদের পল্লীগীতির মধ্যে বারবার এই ভাবনাটা ফুটে উঠেছে। লোকে বলে বলেরে ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার। কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যেরও মাঝার। কিম্বা আধুনিক গানেও। দুটি পাখি দুটি তীরে, মাঝে নদী বহে ধীরে/ একই তরু শাখা পরে/ ছিল বাধা লীলা ভরে/ অজানা সে কোন ঝড়ে/ ভেঙে নিল বাসাটিরে।

বাংলা সেদিনও ছিল ব্রাত্য। আজও ব্রাত্য। আসামে বাঙালি গণহত্যা হয়। আমাদের এখানকার ভদ্রলোক রাজ্যবাদীরা সেই নিয়ে আদৌ চিন্তিত হয় না। হয়না কেননা তারা আত্মীয়তা বোধ করে না। বাংলার নৈরাজ্যবাদিরা কিন্তু মেয়েদের প্রশ্রয় দেয়। মা বোনেরা এখানে বটি ঝাঁটা নিয়ে তাড়া করতে পারে। ভারতের আর কোথাও বটি নেইতো। মেয়েরাই বাঙালি সভ্যতার রক্তের ধারা। ওখানে রক্তপাত হলে সভ্যতার যন্ত্রণা শুরু হয়। তারা ব্রত করে। তাই বাংলা ব্রাত্য। একটা মজার তথ্য দিয়ে আপাতত থামছি। থামছি কেননা, বাঙালি সভ্যতার নৈরাজ্য নিয়ে আরও অনেক কথা আছে। পরে একসময় আলোচনা করা যাবে।

সারা ভারতে একমাত্র বাংলা আর ওড়িয়া ভাষার ব্যকরণে কোনও জেন্ডার বায়াস নেই। অর্থাৎ নারী পুরুষের ভেদাভেদ এই দুই ভাষায় নেই। আর সব ভাষায় কোনও না কোনও ভাবে আছেই, কম অথবা বেশি।

নৈরাজ্যবাদী বাঙালি নিয়ে আবার আর একদিন আলোচনা বসা যাবে’খন। 

প্রচ্ছদের ছবি: গৌতম মুখোপাধ্যায় ও এস এম সুলতান

অরূপশঙ্কর মৈত্র

নাট্যকার, নাট্য পরিচালক ও লেখক। নিবাস: দক্ষিণ কলকাতা।

Share