।। শেখ সাদ্দাম হোসাইন ।।
পুলিশ অফিসার এলএসডি ট্রিপের অনুভূতি পেতে শুরু করে। জিমির দাবি নাকচ করে দিয়ে রাকা বলে, আমার সম্মতি প্রদানের ঘটনাটি কিভাবে ঘটলো আমি ভেবে পাচ্ছিনা, আর জিমিই বা কিভাবে এটা ব্যাখ্যা করছে! আমি যেহেতু মুখে বলিনি আমার সম্মতি আছে সেহেতু আমার সম্মতি ছিল কি ছিলনা এটা আমার অনুভূতিতে ছিল। আমার অনুভূতির দিকে জিমির খেয়াল ছিল? আমি নিশ্চিত না। কিন্তু জিমি কেন নিশ্চিত করে বলছে আমার সম্মতি ছিল, কেন ও আমার উপর সম্মতি চাপিয়ে দিচ্ছে। এ থেকেও ওর ধর্ষক মানসিকতা স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। আর আমি মেটাফিজিক্স করছি এটিও আমার কথা না, জিমির ভাবনা, ও এমন পুরুষতান্ত্রিক কেন? পুলিশ দুজনকে থামালেন এবং বললেন, ওয়েট, কাহিনীটা শুরু করেন।
এনলাইটেনমেন্ট
দূরে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা একটা বাতি — হতে পারে ৫০ ওয়াটের একটা বাল্ব — ধরে হাঁটতে হাঁটতে জিমি যখন বুঝতে পারে সে বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে আছে তখন হঠাৎ করে যেন তার প্রাণপাখি ফুড়ুৎ করে শূন্যে উইড়া যায়। আচমকা তার শরীর একটা ঝাঁকুনি দিয়া ছাইড়া দেয়, যেন আত্মাটা ধরা থিকা অধরাকে ছুঁইয়া দিলো আলতোভাবে। এরকম অনুভূতির সাথে ইতিপূর্বে কোনোদিন সাক্ষাৎ হয়েছে বলে মনে করতে পারেনা জিমি। জীবনে এই প্রথম সূর্য ডুবার আধাঘণ্টা পর একটা নতুন রাস্তা ধরে, একটা নতুন জায়গায় পৌঁছে যাওয়ার পর বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে থাকলে পরে জিমির মধ্যে যে অনুভূতি তৈরি হতে পারে তা তৈরি হয়েছে। বাতির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে জিমি যেন একটা কালো হাঁস দেখে ফেলেছে।
একটা কালো হাঁস দেখে ফেলার পর জিমির ভাব ও দর্শন জুড়ে কেবলই থাকতে থাকে একটি বিজলি চমকানো আলো লেগে থাকা এই আছে আবার এই নাই এরকম একটা নদী। জিমি এই নদীর দিক জানে না, কূল জানেনা, জানেনা এর দৈর্ঘ্য কিংবা প্রস্থ। কেবল জানে অপরিচিত এক দুনিয়ায়, এক নদী অনিশ্চয়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুক সমান পানিতে। স্রোতের শব্দ ইসরাফিলের শিঙ্গায় দেয়া ফুৎকারের ন্যায় বাজতে থাকে জিমির কানে; সাদা সাদা হাঁসেরা সব ডানা ঝাঁপটাতে থাকে, সেই ডানা চুয়ে পড়া অসংখ্য জলরাশির শব্দে জিমির ২৮ বছরের ধ্যান ভেঙে যায়। সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে জিমি, একটা মহাশুন্যে হারিয়ে যাচ্ছে জিমি। প্রায় অন্ধকারে এক পা এদিকে সেদিক করে কোনোমতে সারভাইব করতে থাকে জিমি।
জিমির বয়স ৫১। অবিবাহিত। কিন্তু দেখলে মনে হবে একজন ভদ্রলোক! এ আবার কেমন কথা! জিমির বাবা নেই, মা ওপারে গিয়ে ভালো আছেন বেশ কিছুদিন হলো! বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান জিমি। কাজেই জন্মের পর থেকেই আউট অব দ্য বক্স চিন্তা করে অভ্যস্ত সে! গুলিস্তানে বড় হয়েছে। ২ কাঠা জমির মালিক হওয়ায় রাস্তার কুত্তাদের পছন্দ করে। পড়াশোনা করেছে জগন্নাথে, গাঁজা খেতো ঢাবি’তে আর প্রেম করতো মোহাম্মদপুরে।
জিমির প্রেমিকার নাম ছিল রাকা। রাকা দেখতে ভীষণ সুন্দর ছিল, কেমন যেন একটা ডিভাইন ব্যাপার ছিল তার মধ্যে! তার কথা বলা, চলাফেরাতে এক ধরণের আনন্দ ছিল। আর জিমি ছিল কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির, যেন সে একজন বুঝেশুনে কথা বলা লোক, যেন বুঝে শুনে কথা বললে সত্য কথা বলা হয়, যেন এবস্যুলুট সত্য বইলা কিছু হয়! জিমি আর রাকার প্রথম দেখা হয় মহিলা সমিতির বাথরুমে। একটু ব্যতিক্রম প্রেম হওয়ার জন্য বাথরুম একটা ক্লিশে জায়গা বটে! সে যা-ই হোক, কমন একটা বাথরুম থেকে বের হয়ে জিমি জিপার লাগাতে নিলে রাকা তাকে জিজ্ঞাসা করে, “আমি কি হারিয়ে গেছি?” প্রশ্নটি শুনে রাকাকে আলোর পথ দেখায় জিমি এবং আমাদের এই দ্বীনদার ভাই-বোন একে অন্যের প্রেমে পড়ে। এসহোলস্!
সম্পর্কের কয়েক মাস অতিবাহিত হবার পর একদিন রাকা আর জিমিকে রিক্সায় করে শাহবাগ থানায় প্রবেশ করতে দেখা যায়। দুজনের চেহারাই শান্ত, কোনপ্রকার উত্তেজনা বা উদ্বিগ্নতা নেই। কোনো কিছু নিয়ে গভীর আলাপ করছিল হয়তো! থানায় প্রবেশ করে রাকা ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে। জিমি জিজ্ঞাসা করে, ঠিক আছো তো? রাকা সামান্য হেসে জানায়, হ্যাঁ, সামান্য ক্লান্ত লাগছে। যিনি মামলা নেন তিনি অন্য কোন কাজে ব্যস্ত থাকায় জিমি আর রাকাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়।
দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার ফ্রি হলে জিমি এন্ড রাকা এগিয়ে যায়। অফিসার তাদের বসতে বলে ঘটনা জানতে চান। রাকা বলে, জিমি আমাকে ধর্ষণ করেছে। একথা বলে তার পাশেই বসে থাকা জিমিকে দেখিয়ে দিয়ে বলে, এইযে এই লোকটিই জিমি। একটা অন্যধরণের বাস্তবতায় প্রবেশ করে পুলিশ অফিসার। ইতিপূর্বে এমন ঘটনা তার জীবনে ঘটে নাই। রাকা জিমিকে অভিযুক্ত করার সাথে সাথেই জিমি দাবি করে যে সে ধর্ষণ করে নাই, সে রাকার সম্মতিতেই করেছে। জিমির অভিযোগ রাকা এখন মেটাফিজিক্স করছে, একটা নতুন পরিস্থিতি তৈরি করার খায়েশ থেকে একাজ করছে।
পুলিশ অফিসার এলএসডি ট্রিপের অনুভূতি পেতে শুরু করে। জিমির দাবি নাকচ করে দিয়ে রাকা বলে, আমার সম্মতি প্রদানের ঘটনাটি কিভাবে ঘটলো আমি ভেবে পাচ্ছিনা, আর জিমিই বা কিভাবে এটা ব্যাখ্যা করছে! আমি যেহেতু মুখে বলিনি আমার সম্মতি আছে সেহেতু আমার সম্মতি ছিল কি ছিলনা এটা আমার অনুভূতিতে ছিল। আমার অনুভূতির দিকে জিমির খেয়াল ছিল? আমি নিশ্চিত না। কিন্তু জিমি কেন নিশ্চিত করে বলছে আমার সম্মতি ছিল, কেন ও আমার উপর সম্মতি চাপিয়ে দিচ্ছে। এ থেকেও ওর ধর্ষক মানসিকতা স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। আর আমি মেটাফিজিক্স করছি এটিও আমার কথা না, জিমির ভাবনা, ও এমন পুরুষতান্ত্রিক কেন? পুলিশ দুজনকে থামালেন এবং বললেন, ওয়েট, কাহিনীটা শুরু করেন।
মহিলা সমিতির বাথরুমে প্রেম হওয়ার কয়েকদিন পরের ঘটনা। কথা খুঁজে না পেয়ে জিমি হুট করেই রাকাকে জিজ্ঞাসা কইরা বসে, হাক্সলে’র ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড পড়ছো?
রাকা কিছুটা বিব্রত হয় এবং অপমানিত বোধ করে, ফলে কিছুটা রুক্ষ সুরে জিমিকে বলে, এমন প্রশ্ন করবা না আর। তুমি কি বুঝতেছ তোমার এই প্রশ্ন আমাদের আলাপ কোথায় নিয়ে যেতে পারে?
জিমি এদিকওদিক এমনভাবে তাকাতে থাকে যেন সে প্রশ্ন করার মধ্য দিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে সেটাকে সামাল দেয়ার ভাষা খুঁজতেছে। জিমি এই নিয়ে অনেকবার প্রমাণ পেয়েছে কথা না খুঁজে পাওয়ার যে অস্বস্তি তার চেয়েও প্যারাদায়ক হলো, না বলতে চেয়েও বলে ফেলা একটা কথার সূত্র ধরে আলাপ চালিয়ে যাওয়া।
জিমি কিছু না বলায় রাকা ফের বলতে শুরু করে, ভুলেও কাওকে কোনদিন জিজ্ঞাসা করবা না এইটা পড়ছেন কিনা, অইটা শুনছেন কিনা।
কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে, ঝিম মেরে বসে থাকে জিমি। এরপর বলা নেই, কওয়া নেই বেঞ্চ থেকে দাঁড়িয়ে চোখমুখ বন্ধ করে দৌড়াতে থাকে লেকের পাশ ধরে। এক দৌড়ে অনেকদূর পর্যন্ত চলে যায়। দৌড় শেষে জিমি রুকুতে যাওয়ার মতো বাকা হয়ে দীর্ঘক্ষণ হাঁপাতে থাকে। এরপর একটা বড় কড়ই গাছের তলায় বসে জিমি ভাবে, সেই কবে কতো আগে একদিন দেখা হয়েছিল রাকার সাথে, -১৭ নম্বর লেকে, আর কি হবে না দেখা?
যদি আবার দেখা হয়ে যায় রাকার সাথে সেই আশায় লেকের পার ধরে হাঁটতে শুরু করে জিমি।
জিমির হুট করেই দৌড়ে পালানোতে অবাক হয় না রাকা। রাকা জানে, কীই-বা করার থাকতে পারে! ফলে দৌড়ে পালানোর অনুভূতিটুকু যে অবশিষ্ট আছে সেকথা ভেবে বরং আনন্দিতই হয় রাকা। রাকার কাছে উপলব্ধির মূল্য অপরিসীম।
জিমিকে হেঁটে হেঁটে ফিরে আসতে দেখে রাকা। রাকা জানে নিশ্চয় মগজে এক নতুন বাস্তবতা তৈরি কইরা ফিরে আসতেছে তার প্রেমিক। কিন্তু এবার কী, রাকার মনে প্রশ্ন। গতদিন গাছে উঠে বসে ছিল। পরে নেমে এসে রাকার চোখ, ঠোট, গলা শুঁকতে শুরু করে। শুঁকে বলে, এখানে মানুষ এলো কী করে!
রাকার সন্দেহ জিমি হয়তো একটা ইমাজিনারি সত্যকে যে সত্য এক্সিস্ট করে না তবু তাকে ধইরা রাখছে, আর দিনশেষে ফিরা যাইতেছে তার কাছে। যেন সেখানে ফিরে যাইতে না পারাটাই স্বাভাবিকতা থেকে বিচ্যুতি! হয়তো এই পদ্ধতিতেই তার জীবনযাপন করতে সুবিধা হয়।
ফলে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর জিমি আবার বলে ওঠে, ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড পড়ছো কিনা এটা জিজ্ঞাসা করতে পারার আমার অধিকার আছে। তুমি কি ফ্রিডম অব স্পিচে বিশ্বাস করো না?
জিমির নারীসুলভ প্রশ্নে রাকা মনে মনে হাসলেও উত্তর দেয়, যেহেতু বিশ্বাসের আলাপ সেহেতু বিমূর্ত, সেহেতু লিটারালি করা বা না করার মতো বিষয় না।
একথা বলে জিমির আগের প্রশ্নের উত্তর দেয় রাকা, বলে, পড়ি নাই ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড।
জিমির চোখেমুখে আনন্দ ফুটে ওঠে। আনন্দে সে বলে ফেলে, পইড়ো, ডিস্টোপিয়ান নভেল। তোমার ভাল্লাগবে।
ডিস্টোপিয়ান কী?
সম্ভবত সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এরকম কিছু।
তুমি নিশ্চিত নও?
না, দেখা হয় নাই আসলে ওভাবে মিনিংটা কী। পরিশ্রমের কাজ, ক্লান্ত লাগে।
যে শব্দের মানে জানো না সে শব্দ ব্যবহার না করলেই পারো।
লোভ সামলাইতে পারিনা বুঝলা। এরকম দু একটা শব্দ প্রতিদিন উচ্চারণ না করতে পারলে কেমন যেন ভেতরটা ফাঁকাফাঁকা লাগে। ইনসিকিউরড্ ফিল হয়। মনে হয় তুমি আর ভালোবাসবে না আমায় – আমাকে ছেড়ে চলে যাবে ছাত্র ইউনিয়ন করা প্রচুর মার্ক্স পড়া বামপন্থীটির কাছে। অন্যদিকে পরিশ্রমও করতে ইচ্ছে করে না বাল!
আমি তাহলে তোমাকে ভালোবাসি তোমার এই দু-চারটা শব্দ ব্যবহারের কারণে?
তা তো বলি নাই। বলছি ওরকম আমার মনে হলে আমি ইনসিকিউরড্ ফিল করি।
তুমি এতো ট্রান্সপারেন্ট কেন?
রাকা একথা জিজ্ঞাসা করলে জিমি লজ্জায় লাল হয়ে যায়। আরেকটু গদগদ হয়ে তাকায় রাকার দিকে। রাকা পাত্তা দেয় না।
আলাপটা কন্টিনিউ করে জিমি। বলে, ট্রান্সপারেন্সি তো ভালো।
রাকার সন্দেহ হয় ট্রান্সপারেন্সি বিষয়টাকে যে জিমি ভালো বলছে, স্পষ্ট জেনেশুনে বলছে তো। তাই সে জিজ্ঞাসা করে, তুমি নিশ্চিত?
জিমি বলে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে যেহেতু ভালো আর মন্দের ধারণা ম্যান টু ম্যান ভ্যারি করে। ফলে এর তো কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। ক্ষেত্রবিশেষে ট্রান্সপারেন্সি খারাপও হতে পারে। যেহেতু ট্রান্সপারেন্সি ভালো কিনা খারাপ সেটা ব্যক্তিগত মূল্যায়ণের উপর নির্ভর করছে এখন, ফলে আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি ট্রান্সপারেন্সি ভালো। সারাটা দিনে একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলতে পেরে চাঁদে পা রাখার অনুভূতি হয় জিমির।
রাকা মৃদু হাসে কিন্তু প্রকাশ করতে চায় না। রাকার ভয় জিমি যদি আরো বেশি অলসতায় ডুবে যায়, আরো বেশি অস্পষ্ট থাকতে থাকে।
রাকার নীরবতা ভাঙাতে ডান হাতের কনুই দিয়ে কুত্তার লেজের মতো ঘষতে থাকে জিমি আর বলতে থাকে, ও রাকা, বললাম তো একটা নিশ্চিত কথা। দাও না একটা কিস।
একথা বলার পর জিমির মনে হয় সে একটা ভুল কইরা ফেলছে। রাকা যেন একটা আশার আলো দেখতে পেলো কোথাও। তার চোখ মুখ আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো। রাকা বললো, আচ্ছা ঠিকাছে। প্রতিদিন যে ক’টা নিশ্চিত করে কথা বলবা সে কটা কিস পাবা। যদি একটাও না বলতে পারো, একটাও পাবা না। যদি সারাজীবন ভরে না বলতে পারো, সারাজীবনই কিস পাবা না।
জিমি এক ভয়াবহ সংকটে পড়ে যায়। জিমির ক্ষেত্রে নিশ্চিত করে কথা বলা যতটা টাফ, ততটাই টাফ রাকাকেকে কিস না করতে পারা। যে দুনিয়ায় লাইফের আল্টিমেট কোনো মিনিং নাই (খুবই ক্লিশে একটা দার্শনিক লাইন) সে দুনিয়াতেও মানুষকে এরকম ভয়াবহ সংকটে পড়তে হয় ভেবে একটু প্যারা খায় জিমি।
রাকা জিমিকে একটানা জিজ্ঞাসা করে যায়, জিমি এই চুক্তিতে রাজি কিনা। কিস করে রাকার চুক্তিতে সই করে জিমি। কিস করার সময় জিমির মনে একটা গান বেজে ওঠে, “মাতাল হয়ে হিসু করবো দেয়ালে/যা হবার হবে দেখা যাবে কাল সকালে!”
পুলিশের মাথামুথা আওলায়া যায়। বলে, দাঁড়ান, একটা বিড়ি টাইনা আসি। বিড়ি টানতে থানার বাইরে এসে একটা মেহেগনি গাছের তলায় এসে দাঁড়ায় পুলিশ। ভাবে, ড্রাগ নেয় না তো আবার দুজনেই। কিন্তু কথাবার্তা শুনে, বডি ল্যাংগুয়েজ অবজার্ভ করে কোনকিছুতেই মেলাতে পারছেনা। ভাবে, নাকি আমি সচেতনে নাই। এইগুলো আমি কী শুনতেছি, বড়লোকের পোলাপান এসে মজা নিচ্ছে নাতো!
বিড়ি টানা শেষ হলে ফিরে আসে পুলিশ। এসে বলে, জি, তারপর?
রাকা বলতে শুরু করে। গল্পটা একারণে বললাম যাতে আপনি আমার আর জিমির চিন্তা প্রক্রিয়া নিয়া ভাবতে পারেন; কিন্তু তাই বলে এই না যে আপনি কোনো সিদ্ধান্তে চলে যাবেন। আমরা দুজন প্রেম করছি গত ৬ মাস ধরে। এর আগেও আমরা একজন অন্যজনকে চুমু খেয়েছি। এছাড়াও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় স্পর্শ করার ঘটনা ঘটেছে। ঠিক একইভাবে আজও আমরা চুমু খেলাম, এবং খুবই কাছাকাছি হলাম একজন অন্যজনের। আমরা সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সে যাওয়া ব্যতীত মোটামুটি সবই করতেছিলাম। তো এরমধ্যে একটি নতুন ঘটনা ঘটে যায়। সেটি হলো, আমরা ইন্টারকোর্সে জড়িয়ে পড়ি আর জড়িয়ে পড়ার ঘটনাটাকে আমি আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে দাবি করছি। কেননা, আমি তো ইন্টারকোর্সে যাওয়ার সম্মতি দেই নি।
জিমি কিছু বলার জন্য অনুমতি চায় অফিসারের কাছে। অফিসার অনুমতি দিলে জিমি বলতে শুরু করে, এটা আসলে খুবই এবসার্ড। আমাদের চুমু খাওয়ার ঘটনা মৌখিকভাবে ‘হ্যাঁ’ বলার মাধ্যমে ঘটেনি। আমরা একজন আরেকজনের কোথায় স্পর্শ করবো সেটা মৌখিক সম্মতির ভিত্তিতে ঘটেনি। তবে এটা কী করে অনুমান করা সম্ভব যে ইন্টারকোর্সে যাওয়ার পূর্বে মৌখিক সম্মতি নিতে হবে?
রাকা কাউন্টার আর্গুমেন্ট দেয়। সে বলে, মৌখিক সম্মতি নিতে হবে সেকথা আমি বলছি না। আমি বলছি চুমু খাওয়া বা স্পর্শ করার ক্ষেত্রে যে অভিযোগ ওঠার ঘটনা ঘটে নাই, সেটা কেন ইন্টারকোর্সের ঘটনায় ঘটতে পারবে না? চুমু খাওয়া বা স্পর্শের সম্মতি মানে ইন্টারকোর্সে যাওয়ার সম্মতি না। এমনকি যে সেক্সুয়াল টাচ ইতিপূর্বে সম্মতি পেয়েছে সে সেক্সুয়াল টাচে কোন পরিবর্তন দেখা গেলে অসম্মতির উদ্রেক ঘটতেপার
পুলিশ জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু বিষয়টি কি এমন আপনি অসম্মতি প্রকাশ করার পরেও জিমি জোরপূর্বক আপনার সাথে ইন্টারকোর্সে গেছে?
জিমি বলে ওঠে, না, অসম্ভব।
রাকা কিছুটা ব্যথিত সুরে বলে, যে ছেলেটা নিশ্চিত করে একটা কথা বলার রিস্ক নিতে চাইতো না সে ছেলেটা আজ কিভাবে এতোটা নিশ্চিত হতে পারছে সেটা ভেবেই আমার বারবার মনে হচ্ছে ও আমাকে ধর্ষণ করেছে। আমি তো কেবলই ইন্টারকোর্স শেষে বলেছিলাম, এখন তুমি যেটা করলা, এটাকে ধর্ষণ হিসেবেও এস্টাব্লিশ করা যেতে পারে। সমস্যা হলো, জিমি এ বিষয়ে আমার সাথে আলাপে গেলো না। সে সরাসরি বলে বসলো, অসম্ভব, আমি তোমার সম্মতিতেই ইন্টারকোর্সে গেছি। এখানেই ছিল আমার চ্যালেঞ্জ। ইন্টারকোর্সের ঠিক আগ মুহূর্তে আমি ইন্টারকোর্সে যাবো কি যাবো না সেই সিদ্ধান্তে পৌছানোর আগেই যে আমাকে এদিকে নিয়ে যাওয়া হলো এটা নিয়ে তো আমার কথা বলার সুযোগ রয়েছেই। আমার সাথে জোরপূর্বক ইন্টারকোর্সের ঘটনা না ঘটানো হলেও আমার সম্মতি তো ছিল না, মানে আমি তো কোনো সিদ্ধান্ত নেই নাই; ইন্টারকোর্স চলাকালীন আমি কোন প্রতিবাদ না জানালেও একথা বলার অপশন আছে। অসম্মতি না জানানো মানেই সম্মতি জানানো নয়। জিমি যখন আমার উপর সম্মতি চাপিয়ে দিতে চাইলো তখনি আমার মনে হইলো আমি তো ধর্ষণ হয়েছি তাহলে।
মামলা না করে পুলিশ অফিসারকে সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে আসে দুজন। কেও কারো সাথে কোন কথা না বলে দুজন দুদিকে হেটে চলে যায়।
২৮ বছর পর জিমির মনে হয় অতোটা নিশ্চিত আমি না হলেও পাড়তাম। কী হতো যদি আমি বলতাম, হ্যাঁ, ধর্ষণ হিসেবে যদি তুমি এই ঘটনাকে এস্টাব্লিশ করতে চাও সেটা করতে পারার সুযোগ আছে। একইভাবে সেটাকে এনকাউন্টার দেয়ারও সুযোগ আছে। হয়তো আফটার সেক্স রাকা একটা কনভার্সেশনই করতে চাইতেছিল কেবল। যে সময়, যে স্পেসে আমরা ছিলাম, তখন অমন করে ‘অসম্ভব’ বলে দেয়াটা ওর মধ্যে নিরাপত্তাজনিত সংকট তীব্র করে তুলতে পারে। আমি তো ভালোবেসে ছিলাম ওকে। আর ও তো বলে নাই তুমি ধর্ষনই করেছো আমাকে, ও বলেছিল এভাবেও দেখানো যেতে পারে। তবে কেন নিশ্চিত হতে গেলাম অতোটা।
২৮ বছর পর একটা সেন্টেন্স প্যাটার্ন সে খেয়াল করে। ২৮ বছর পর একটা চিন্তা শিফট করে আরেকটা চিন্তায়। রাকার লোকেশন খুঁজে বের করে জিমি। বরিশাল, গৌরনদী।
গৌরনদী পৌছতে সন্ধ্যা হয়ে যায় জিমির। নেমে একটা রিক্সা নিয়ে বকুলতলার মোড় পর্যন্ত যায়। এরপর মাটির রাস্তা। সে মাটির রাস্তা ধরে কিছুদূর এগোলেই জিমি দেখতে পায় দূরে একটা হলুদ রঙের বাতি টিমটিম করে জ্বলছে। বাতিটি অনুসরণ করে রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় জিমি খেয়াল করে সে বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের এরূপ অসহায়ত্ব দেখে উপহাসের হাসি হেসে আকাশের দিকে তাকায় জিমি, বলে, দয়াল, বাত্তি তো আমার লগে বিট্রে করলো। পায়ের তলার মাটি সরে যেতে যেতে জিমি ডুবে যাবে যখন তখন একটা নৌকা এগিয়ে আসতে দেখা যায়। ৮/৯ বছর বয়সী একটা ছেলে জিমিকে উদ্ধার করে। নৌকায় উঠে মাচানে দুই পা ছড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ে বেঘোরে হাসতে থাকে। সে ভাবে, কই থেকে কই নাও তুমি খোদা! তুমিই জ্ঞান দাও, তুমিই ইচ্ছা করো, তুমিই বাঁচাও, তুমিই মারো। শোয়া থেকে উঠে বসে জিমি। দেখে ছোট্ট একটা শিশু নৌকা বাইছে। সেই টিমটিম করে জ্বলতে থাকা বাতিটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শিশুটিকে জিমি জিজ্ঞাসা করে, তোমার নাম কী বাবু? শিশুটি বলে, হেন্ড্রিক্স। জিমির বুকটা কেঁপে ওঠে হালকা। টিমটিম করে জ্বলা বাতিটি স্বচ্ছ হয়ে উঠতে থাকে, আরেকটু বেশি আলো দেয়। জিমি জিজ্ঞাসা করে, তোমার মায়ের নাম কী? হেন্ড্রিক্স বলে, ধলেশ্বরী। আর তোমার নানু? নৌকা চলে আসে ঘাটে, দেখা যায় একটা হারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে আছে রাকা।
ফটোগ্রাফি- iStock, স্কেচ- DSESNIO
শেখ সাদ্দাম হোসাইন
তরুণ গদ্যকার, কবি ও চিন্তক। জন্ম: ১৯৯৫ সালে ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানায়।
পড়াশুনা: ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিং-এ বিবিএ।Share
এটা কি হলো! আরো চাই আরো চাই। এভাবেই শেষ হয়ে গেলো গল্পটা!