সন্ধ্যা বলতে পাড়ার মোড়ে আজানডাক

।। অপর্ণা হাওলাদার ।।

মধ্যবিত্ত ভাড়াটে ঘরে তুলসীগাছের চল ছিল না, জায়গা কই?
সন্ধ্যা বলতে কেবল জানি পাড়ার মোড়ে আজানডাক, পড়তে বসা।

হিন্দুঘরে জন্ম আমার, গরুর মাংস চুলায় বসে না মায়ের হাতে শাখা সিঁদুর,
আজও সন্ধ্যা বলতে পাড়ার মোড়ে আজানডাক।

আমরা কি কেউ স্বীকার করবো?

যতটা যত্নে তোলা আছে অক্ষর, মাত্রামোহ;
যতটা গভীরে গ্রহণ করেছি শব্দময়তার বিচূর্ণ প্রত্যাঘাত;
তার কিছুমাত্র যত্নে তুলে নেইনি কোনো মানুষ—

এই অভিযোগে অসত্যতা নেই, তবে—
ধরো, এমন যদি হয়,
(তুমি, কিংবা তোমাদের যে কেউ)
পুরোনো তোমাকে তুলে এনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়
নতুন আমার সামনে। আর দুজন ‘মুখোমুখি’ আমরা
সরাসরি সম্প্রচারিত হই ব্রহ্মাণ্ডের সকল তরঙ্গে;
তোমার একহাতে আমার সেইদিনের সুইসাইড নোট আর
আমার একহাতে আজকের আত্মবিক্রয়ের রুপালী রসিদ—

আমরা কি কেউ স্বীকার করব—
আমরা পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছিলাম! একদিন?
আজন্ম অপরিচিতের অহংকার ছিল
আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে? আর ছিল কুঁজো শরীরে ককুনবাদ—
আমরা চলতে চলতে কিংবা থেমে থাকতে থাকতে এড়িয়ে গেছি পরস্পরের চোখ!

দর্পণের সামনে কেউ কোনোদিন হন্তারক দেখেনি বলেই আমরা নিষ্পাপ;
আমরা কেউ অস্বীকার করব?

সন্ধ্যা, তুলসীগাছ এবং আজান

বাংলাদেশের মফস্বলে জন্ম আমার নমঃশূদ্র পদবীতে
মধ্যবিত্ত ভাড়াটে ঘরে তুলসীগাছের চল ছিল না, জায়গা কই?
সন্ধ্যা বলতে কেবল জানি পাড়ার মোড়ে আজানডাক, পড়তে বসা।

হিন্দুঘরে জন্ম আমার, গরুর মাংস চুলায় বসে না মায়ের হাতে শাখা সিঁদুর,
আজও সন্ধ্যা বলতে পাড়ার মোড়ে আজানডাক। কাজ কি বাকি?

সবটা মিলেই আমার আমি, জলের মতো
যা পেয়েছি পথের ধারে বইছে সবই রক্ত জুড়ে।
কার তাতে কী?

আপোষকামী

কিশোরীর শুকিয়ে যাওয়া দড়ি পাকানো স্তনে ঝুলে থাকা মানুষাকৃতির শিশু নিয়ে
আমার যে লেখাটা কোথাও প্রকাশিত হবে না,
তাকে দলিল ধরে বিচার করা যাবে শকুনের প্রকৃত জীবন—

এ বড় অদ্ভুত গণঅভ্যুত্থান; আমি এবং অন্যান্য
সব বিপ্লবীরাও সিঁটকে যাচ্ছে শ্রমিকের ঘামের গন্ধে।

যখন—
কলম ফেলে বসে থাকি একলা মধ্যবয়সী যে কোনো বিষাদ

নামধাম খুলে রাখি, কেবল সর্বনামের মতো চেয়ে-চেয়ে থাকি
এইসব অপর্ণারা হেঁটে হেঁটে যায় আমার বাড়ির ভেতর কিংবা সামনের ফুটপাতে—
আমি তাদের আসতে বলি না— থাকতে বলি না একদণ্ড কোথাও আমার কাছে।

আমার যা গেছে এইসব সমান্তরাল দেহদের ভিড়ে,
আমি জানি তা যাওয়ারই কথা ছিল।

গন্তব্য নয়, পথ


অনেক দূর হেঁটে গিয়ে ফিরে আসতে ইচ্ছে হোলো;
কোনদিক যাবো কিংবা কেন এসব প্রশ্ন নেই কোথাও
মাথার মধ্যে ইতিনেতি কোনোই বাচক নেই, এবার—
খুন করতে ইচ্ছা হোলো এই জন্মে নিহত হলেও হোতো।

বাঁশীর সুরে থমকে দাঁড়াই, ঐ অবকাশ নেই এখন আর—
এমন দিন ছিল কখনও। এই জন্মের কাহিনী সেটা?
মনেও নেই। এখন কেবল দৌড়ে যাওয়া ঠিক যেন এক
খুনের মামলা মাথায় নিয়ে শশব্যস্ত গ্রামীণ যুবক।

অপর্ণা হাওলাদার

অর্থনীতির শিক্ষক ও গবেষক। জন্ম বরিশাল, বেড়ে ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। ঢাকা শহরের উদয়ন বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ভিকারুন্নিসা নুন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স করেন। ২০১১ সাল থেকে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে প্রবাসে, ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি শেষ করেন আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় থেকে। মূল কাজের ক্ষেত্র পরিবেশ ও কৃষি। বর্তমানে আমেরিকার পীটসবার্গে চাথাম বিশ্ববিদ্যালয়য়ে অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

 

Share