রবীন্দ্রবৃত্তের বাইরে হলুদ আলোয় ব্যক্তিগত রবি ঠাকুর

।। সৌরভ গুহ ।।

একটা সময় যখন মূলস্রোত আমাকে আশ্রয় দিচ্ছে না। আলোর বৃত্তে আমি ঠাঁই পাচ্ছি না। বা ঠাঁই পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করছি না হয়তো । চাকরি পাচ্ছি না, আশানুরূপ রেজাল্ট হচ্ছে না, আমি সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। এই কালপর্বে রবীন্দ্রনাথ যেন বিপক্ষ শিবিরের দেবতা আমার কাছে! যাঁর আশীর্বাণী আমাকে স্নাত করে না বরং বিব্রত করে। আমার আচরণ রাবীন্দ্রিক নয়, হওয়ার কথাও নয়। রাবীন্দ্রিক কেউ আমার লোক নয়। রবীন্দ্রনাথ রাবীন্দ্রিকদের গর্ব, রবীন্দ্রনাথ এখানে সংহার প্রবণতার প্রেরণা স্বরূপ । জয়ীর সংস্কৃতি। যা বিজিতকে অসম্মান করে চলে নিরন্তর। রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে তা করা হয়। কিন্তু এত কিছুর পরেও রবীন্দ্রনাথের গান আমাকে ছুঁয়ে ফেলে। ঘোর অন্ধকারে আমি গেয়ে উঠি, ” নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা / মন রে মোর পাথারে, হোস নে দিশেহারা।”

আমার বাড়ির নাম না জানা হলুদ গাছে
রবি ঠাকুর জন্মদিনে জড়িয়ে আছে
বেভুল পথে বন্ধকীদিন হাতড়ে ফিরে
ছোট্টবেলার কমদামী সেই সন্ধ্যা ঘিরে
যেই না পথে পা ফেলেছি
তাকিয়ে দেখি বদলে গেছি
শুধু হলুদ গাছের প্রতি-শাখে
আগের মতই রবির আভা
পঁচিশে বৈশাখে

এই লেখাটার মধ্যে একটা উঠোন ঘুমিয়ে আছে। একটা জলচৌকি, একটা নড়বড়ে বেঞ্চ আর একটা হারমোনিয়াম। হরিণঘাটার দুধের ফাঁকা বোতলে জল আর বাড়ির গাছে ফোটা হলুদ ফুলগুলো জড়িয়ে আছে। এই তো এখনই হ্যাজাক জ্বলে উঠবে। বাদল ইলেকট্রিক থেকে ভাড়া করে আনা। আর আছে একটা বেলি ফুলের মালা। বাড়ির দেয়ালে টাঙানো কবেকার রবি ঠাকুরের ছবিতে এক ফোঁটা চন্দনের টিপ। ‘আজ যে পঁচিশে বৈশাখ’। “হে নূতন দেখা দিক আর বার”… আমাদের কণ্ঠ ছাপানো গান মিশে যাচ্ছে হাওয়ায়। আর সেই উঠোন জুড়ে হ্যাজাকের হলুদ আলো। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমাদের পরিচয় পড়ার বইয়ে। আর আমার মায়ের গাওয়া রবীন্দ্রগানে। এটুকুই। আমাদের ঘরে গীতবিতান নেই। আমার মা যে রবীন্দ্রনাথের গান করেন তা প্রগলভ, সহজিয়া জনপ্রিয় যার বেশির ভাগই রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায় বাজে। বহুশ্রুত। আমাদের রবীন্দ্রনাথ রঙচঙে ক্যালেন্ডারের ছবিতে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো। ব্যানার্জি বাবুদের বাড়ির ছবিটার মতো না। সাদা কালোর মায়ায় জড়ানো। আমাদেরটা একেবারেই তা না। আমরা স্পর্শ-স্বর কাকে বলে, গ্রেস নোট কাকে বলে কিছুই তো জানি না। আমরা গাই যেভাবে গান আমাদের গাইয়ে নেয় । যেভাবে স্কুলে ক্লাবে রাস্তায় কান ধরে রাখে সুরের রেশ।

তারপর একদিন সুরের উঠোন পেরিয়ে বড় হয়ে উঠতে লাগলাম। হাফ প্যান্ট ছেড়ে ফুল প্যান্ট হব। ক্রমে আমার বাড়ির ক্যালেন্ডারের রবীন্দ্রনাথ আর আমি দূরে সরে যেতে থাকলাম। রবীন্দ্রনাথ ক্রমে আমার কাছে এক বড় দ্বিধা। খানিকটা অস্বস্তিও। আমি তো অঙ্কে ফেল করি আর অঙ্ক খাতার পেছনে ছড়া লিখি। তো একদিন পাড়ার এক সাদা গোছের প্রতিবেশী জানতে চাইলেন, আমি কী লিখি? বললাম, পাখি আর বেলুন নিয়ে ছড়া, অনেক অনেক ছড়া লিখি। তিনি খুশি হলেন না। উল্টে বললেন, “আচ্ছা বল তো এই লাইনটা রবীন্দ্র নাথের কোন কবিতায় আছে?” আমি যথারীতি গভীর শূন্যের মাঝে যেন ছিটকে পড়লাম! তা বুঝতে পেরে তিনি আরো কিছু লাইন বলে চললেন, আমি সেগুলোও স্বাভাবিক ভাবে পারলাম না। বাড়ির ক্যালেন্ডারের রবীন্দ্রনাথ আমাকে ছাপিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কত উচুঁ। আমি পার হব কীকরে ? আমার স্কুলের ফার্স্ট বয় রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তি করে। টেনে টেনে তার উচ্চারণগুলো মাষ্টারমশাইদের ভারী পছন্দের। তারপর ধরুন, বড়রাস্তার দিকে ছিমছাম বাড়িগুলোর লোকজন, যাদের সকালের প্রভাতফেরীতে কাউন্সিলর পা মেলান গদগদ ভঙ্গিতে। হঠাৎই তার বিরক্তি ভরা মুখটা ভাব গম্ভীর হয়ে ওঠে। সেই সব লালপেড়ে, পাটভাঙা শাড়ি, পাজামা পাঞ্জাবির শুদ্ধতা আমাকে অনাহুত করে ছাড়ে। আমার পালিশ না করা জুতোর দিকে তাকালে কেমন হীনমন্যতা জাগে। আমার বলতে ইচ্ছে করে, বহুশ্রুত সেই গান “নাই নাই ধুলি মোর অন্তরে”… বলতে পারিনা! পাছে আবার কী প্রশ্ন করে বসে! আমার হীন মনে ভয় জাগে। রবীন্দ্রভয় । দু’লাইন মনের খেয়ালে কবিতা লিখেছি বলে লোকে বলে রবীন্দ্রনাথ পড়া উচিৎ! “রবীন্দ্রনাথের এটা পড়োনি, ওটা পড়োনি, সেটাও পড়োনি! আর কবে পড়বে? রবীন্দ্রনাথ না পড়লে কী কবিতা লিখবে?” এখন আমি কীভাবে বোঝাই, লিখতে বসলে আমার নেশা হয়। টের পাই চোখ জ্বলছে! ঘোর লেগে আসে! রবীন্দ্রনাথেরও কি এমন হ’ত? কিন্তু এই যে ঔচিত্য আর অনৌচিত্যের শাসনকামী মনস্কতা। এই যে রবীন্দ্র ধ্বজাধারীদের শিক্ষক সুলভ দাপট আমাকে কেমন নিভিয়ে দিতে থাকে মনে মনে। রবীন্দ্রনাথ আরো আরো লম্বা হয়ে ওঠেন। অনেক উঁচু। আমার নাগালের বাইরে। থই পাই না। রবীন্দ্রনাথ আমার সকল অপমান আর অস্বস্তির হেতু। রবীন্দ্রবৃত্তের এই সাদা সাদা আলোয় আমার উঠোন জোড়া হলুদ ফুল ফিকে হয়ে আসে। তবু একদিন আমি কবিতাটা লিখেই ফেললাম, কবিতা বলুন আর ছড়াই বলুন যা দিয়ে এ লেখার শুরু। সেই লেখাটা লিখেই ফেললাম। লিখে আমি নিজেই বহুবার ভেবেছি এই লেখা আমি কীভাবে লিখতে পারি! যা নিয়ে আমার এত দ্বিধা , এত অস্বস্তি ।

একটা সময় ছিল ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে জীবন চলছিল। সত্যি বলছি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আমাকে আশ্রয় দেয়নি। আমার ভালোলাগতো না। বরং অনেক বেশি টানতেন জীবনানন্দ। তার কবিতা নির্মাণের কুহক, সংকেতময়তা এক অচেনা রহস্যের দিকে টেনে নিত। সেই একটা সময় যখন মূলস্রোত আমাকে আশ্রয় দিচ্ছে না। আলোর বৃত্তে আমি ঠাঁই পাচ্ছি না। বা ঠাঁই পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করছি না হয়তো । চাকরি পাচ্ছি না, আশানুরূপ রেজাল্ট হচ্ছে না, আমি সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। এই কালপর্বে রবীন্দ্রনাথ যেন বিপক্ষ শিবিরের দেবতা আমার কাছে! যাঁর আশীর্বাণী আমাকে স্নাত করে না বরং বিব্রত করে। আমার আচরণ রাবীন্দ্রিক নয়, হওয়ার কথাও নয়। রাবীন্দ্রিক কেউ আমার লোক নয়। রবীন্দ্রনাথ রাবীন্দ্রিকদের গর্ব, রবীন্দ্রনাথ এখানে সংহার প্রবণতার প্রেরণা স্বরূপ। জয়ীর সংস্কৃতি। যা বিজিতকে অসম্মান করে চলে নিরন্তর। রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে তা করা হয়। কিন্তু এত কিছুর পরেও রবীন্দ্রনাথের গান আমাকে ছুঁয়ে ফেলে। ঘোর অন্ধকারে আমি গেয়ে উঠি, ” নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা / মন রে মোর পাথারে, হোস নে দিশেহারা।” এ গান কেউ শুনতে পায় না। তবু গুনগুনিয়ে আমার অন্তর গায়। রবীন্দ্রনাথ বলে চলেন, “রাখিও বল জীবনে, রাখিও চির আশা / শোভন এই ভুবনে রাখিও ভালোবাসা।”

জীবন বয়ে যায়। খানিকটা যেভাবে ভাবিনি আর খানিক টা যেভাবে ভেবেছিলাম । এই ভাবা না ভাবার, চাওয়া না চাওয়ার দ্বন্দ্ব এক বিষাদের জন্ম দেয়। তাকে গাঢ় করে তোলে নাগরিক ক্লান্তি, জীবিকা নামক যুদ্ধ, বিমর্ষতা। এই বিষন্ন দেয়ালায় আমার একান্ত রবীন্দ্রনাথ মুখ তোলেন। আমার না মেলানো প্রশ্নপত্রের উত্তর দিতে বলে ওঠেন “অচেনা কে ভয় কী আমার ওরে / অচেনাকে চিনে চিনেই উঠবে জীবন ভরে।” আর কখনও তো সাক্ষাৎ আমার হয়ে নিজেই গেয়ে ওঠেন “তুমি জানো ওগো অন্তর্যামী, পথে পথেই মন ফিরালেম আমি / ভাবনা আমার বাঁধলো নাকো বাসা / কেবল তারই স্রোতের পরে ভাসা।”

আহা এমন করে তো আমি নিজেও নিজের কথাগুলো সাজাতে পারতাম না । এভাবেই রবীন্দ্রনাথ আমাকে গোপনে পেয়ে বসেন। আর আমি অবাক বিস্ময়ে অনুভব করি, “নয়ন মেলে দেখি আমায় বাঁধন বেঁধেছে / গোপনে কে এমন করে এ ফাঁদ ফেঁদেছে / আমায় বাঁধন বেঁধেছে…”

এভাবেই ওই হলুদ আলো আর হলুদ জঙলা ফুলে আমার কলোনির উঠোনে পঁচিশে বৈশাখ জেগে থাকে। ঘুমের ঘোরে সে আমাকে ডেকে নেয়, ডেকেই চলে– বলে, “সংসারের সুখে দুখে , চলিয়া যেও হাসি মুখে/ ভরিয়া সদা রেখো বুকে , তাহারই সুধা ধারা/ মনরে মোর পাথারে হোসনে দিশেহারা/”

সৌরভ গুহ

পেশায় টেলিভিশন সাংবাদিক। নিউজ লেখেন, ফিচার লেখেন। কবিতা লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে রম্য রচনার বই ‘চেনা নেতা অচেনা নেতা’। সম্পাদিত পত্রিকা ‘কবিতা কারিগর’। ২০১০ সালে প্রকাশিত হয় কবিতার বই ‘কলোনির কবিতা’। কালীঘাট পটুয়া পাড়া নিয়ে বানিয়েছেন তথ্যচিত্র ‘নগর পটুয়া’। খবরের পাশাপাশি টিভি চ্যানেলের জন্য বানান ডকু ফিচার।

Share