নূপুর বাজুক বঙ্গদেশে

।। নাদিয়া ইসলাম ।।

আমাদের রাধারানি, শ্রীরাধিকা, আমাদের বৃন্দাবন বিলাসীনি আদরের রাই কিশোরী আমাদের প্রেম আর মাটির ব-দ্বীপমালার গল্প। শীতের অধিবাসের রাতে তুষের আগুনের ধোঁয়া আর গুড় নারিকেল বাতাসা আতপ চালের পিঠার সোনার কাঠি রুপার কাঠির বাঁশির কুয়াশার সকালের মাঠের ভেতর দিয়ে সাইকেল চালানো সমুদ্রগর্ভের ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমির ঘুড়ি ওড়ানো আকাশে অনিচ্ছায় ছুঁয়ে ফেলা প্রেমিকের হাতের মসজিদের ভোরের আজানের অশরীরি অস্তিত্বে “আষাঢ় মাসে নব মেঘ গরজএ” পুকুরের পানিতে ঘাঁই মারা দেবীপক্ষের মুকুলিত কিশোরীর যাত্রাপালার রাতে কারুর চোখে চোখ পড়ার মতো ঝড়ের দিনে গাছ থেকে আম পড়ার মতো আদরের বিল্লিবাচ্চার কারুণ্য রসের ঈশ্বরের চাইতে তেত্রিশ কোটি দেবতার চাইতে সজীব মানুষের প্রেমের গল্প। আদিরসের যমুনায় ঝড়ের রাতে প্রেম আর নিজের শরীর আবিষ্কার করা একজন কিশোরী নৌকার মাস্তুল ধরে ঝুলে আছেন। কৃষ্ণের ঐশ্বরিক ক্ষমতা নিয়ে তার মাথাব্যথা নাই। কৃষ্ণ তাকে বোঝান, তিনিই বিষ্ণু। তাতে অবশ্য রাধার কিছু আসে যায় না, বলেন, “শঙ্খ চক্র গদা আর শারঙ্গ এড়িআঁ/ দান সাধ কেহ্নে কাহ্নাঞইঁ পথত বসিআঁ/”- আর এভাবেই নিজের প্রেম নিয়ে বিস্মিত, নিজের হাসি কান্না ঈর্ষা ক্ষোভ যৌবনের প্রথম অভিজ্ঞতায় নিজেকে স্পর্শ করার অপরাধে আপ্লুত কিশোরী দুই পা বেয়ে রক্ত ঝড়ার তীব্র ব্যথায় নিজের চুল ছিঁড়ে নিজের আমাদের মাথায় ঢুকে যান অজ্ঞাতসারে..

নূপুর বাজুক বঙ্গদেশে

সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় গাওয়া রাধারমণ দত্তের আমার খুব প্রিয় একটা ধামাইল গান আছে, ‘জলে গিয়াছিলাম সই’ নামের।

গানটার একটা লাইন এরকম- “সোনারও পিঞ্জুরা সই গো, রূপারও টাঙ্গুনি, এগু আবের চান্দুয়া দিয়া পিঞ্জুরা ঢাকুনি”- তো এই ‘আবের পিঞ্জুরা’ কী বস্তু সেই ভেবে আমি ম্যালা বছর এলোমেলো ছিলাম; এখনও আছি। কখনও আবের পিঞ্জুরাকে আমি লাল রঙের বেনারসি শাড়ি বা সুগন্ধী চাদর ভেবেছি, কখনও সন্ধ্যা হচ্ছে এমন আকাশ– কিন্তু তার মূল অর্থ বের করতে পারি নাই। এর কারণ সম্ভবত- রাধা আমার কাছে এখনও কনফিউজিং চরিত্র। গোবিন্দদাস, চণ্ডীদাস বা চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য জ্ঞানদাসদের অনেকেই রাধার বর্ণনা দিয়েছেন, গোবিন্দদাস যেমন লিখেছেন, “নয়নাঞ্চল চঞ্চল খঞ্জুরীটা/ তাতে কাজের শোভিত নীলছটা/ তিল পুষ্প সমান নাসা ললিতা/ কনকাতি/ ভাতি ঝলকে মুকুতা/ বনি সুন্দর শারদ ইন্দ্রমুখী/ মধুরাধর পল্লব বিল্ব লাগি/ গলে মোতিহার সুরঙ্গমালা।।/ কুচকাঞ্চন শ্রীফল তাহাতে খেলা/”- কিন্তু এসব শুধুই রূপের (বা বলা ভালো শরীরের) বর্ণনা, এখান থেকে আমি অন্তত রাধা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাই না।

রাধার পোশাক নিয়ে ভাবা আমার খুব বস্তুবাদী চিন্তা আমি জানি। কিন্তু আমরা, সাধারণ মানুষরা ভাব ধারণ করি সম্ভবত বস্তুর মধ্য দিয়ে, তাই রাধাকে আমার মতো একজন নারী চরিত্রে কল্পনা করা হয়তো আমার জন্য সহজ কাজ। চণ্ডীদাসের মতো রাধাভাবে ভাবিত হওয়া বা বৈষ্ণবগীতিকাব্যসাহিত্যের বাইরে বের হয়ে গৌড়ীয় রসশাস্ত্রে তার সাথে একাত্ম হওয়ার চাইতে আমার তাকে দূর থেকে নিজেকে আয়নায় দেখার মতোই সহজ। শ্রীচৈতন্যের মতো ‘বহিরঙ্গে রাধা, অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ’ বলাটা সহজ কাজ, পুরুষ প্রকৃতির ‘ইন-অ্যান্ড-ইয়াং’য়ের চক্র চিন্তা করে হাতের উপর ট্যাটু করে ফেলাও সহজ, কিন্তু এই টুইন ফ্লেমের ইটার্নাল ব্যালেন্স, হেগেলিয়ান থিসিস-অ্যান্টি থিসিসে সকল বিপরীতকে অভিন্ন ভেবে সেই বিপরীতকে নিজের মধ্যে ধারণ করা কঠিন কাজ।

রাধার কথা আসলে কৃষ্ণের কথা আসে অবধারিতভাবে এবং কৃষ্ণের কথায় ভাইসা-ভার্সা ভাবে রাধা। অর্থাৎ আমরা রাধা-কৃষ্ণকে মোটা দাগে একে অন্যের পরিপূরক ভাবেই থার্মোডায়নামিক্সের সূত্রে এনার্জি ব্যালেন্স আকারে দেখি। সেই অর্থে কৃষ্ণ ছাড়া রাধার যেমন অস্তিত্ব নাই, তেমনি রাধা ছাড়াও কৃষ্ণের অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু আমি রাধাকে কৃষ্ণের প্রতিবিম্ব ভাবতে নারাজ। কারণ “বনমালী তুমি পরজনমে হইয়ো রাধা”– বাক্যের মতো রাধার বেদনা এবং হাহাকার আমি কখনোই কৃষ্ণের ভগবৎসত্তায় নন-শ্যালন্ট এনার্জিতে দেখি নাই। প্রেম বা সাবমিশানের বিপরীতে কী উদাসীনতা থাকে নাকি ভক্তের প্রতি স্নেহ বা বাৎসল্য, সেই ইকুয়েশান আমি আজকেও সমাধান করতে পারি নাই। তাই যে যাই বলুক না কেন, আমি রাধাকে কৃষ্ণের ‘ফিল ইন দ্যা গ্যাপ’ বলে ভাবি না।

এবং এভাবে না ভাবার পেছনে আমার আরও একটা কারণ আছে। মজার বিষয় হচ্ছে, মহাভারতে, হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ এবং কৃষ্ণের জীবনী ভাগবৎ পুরানের কোথাও, রাসপঞ্চাধ্যায়ের কোথাও রাধার দৃশ্যভাবে কোনো স্পষ্ট অস্তিত্ব নাই। অথর্ববেদের গোপালতাপনী উপনিষদে কৃষ্ণকে গোপীপরিবৃত দেখা যায়, কিন্তু তাতে রাধার অস্তিত্ব নাই। এছাড়াও বলা হয়, এখানে গোপী অর্থ গো-পালক না। এখানে গোপী অর্থ অবিদ্যা কলা। আক্ষরিক অর্থের একজন গোপী এখানে যাও আছেন, তার নাম গান্ধর্বী। যে কারণে কন্সপিরেসি থিওরিস্ট সহ অনেক বৈদান্তিক বৈজ্ঞানিক বলে থাকেন বৃন্দাবনে রাধার সাথে কৃষ্ণের রাসলীলা নিতান্তই কাল্পনিক গালগপ্পো এবং কৃষ্ণের মহিমান্বিত চরিত্রকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা। এমনকি হাল আমলের বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর কৃষ্ণচরিত্রতে বলেছেন, রাধা নামে ইতিহাসে কেউ ছিলেন না।

কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্ররা মিথিকাল চরিত্র ইতিহাসেই বা খুঁজতে যান কেন আমি বুঝি না। আর বৈদিক ধর্মশাস্ত্রে থাকলে বা না থাকলে কী হয়, রাধা তো আছেন। আমাদের সংস্কৃতিতে, গানে, প্রেমে, মাথায় সব জায়গায় রাধা আছেন। তাহলে তিনি আসলেন কোথা থেকে?

আগেই বলেছি, শ্রীমদ্ভাগবৎ গীতার কোথাও রাধার স্পষ্ট উল্লেখ নাই। কিন্তু এদিকে গীতার ২/৪/১৪ নাম্বার শ্লোকে আছে,

नमो नमस्तेऽस्त्वृषभाय सात्वतां विदूरकाष्ठाय मुहुः कुयोगिनाम्।
निरस्तसाम्यातिशयेन राधसा स्वधामनि ब्रह्मणि रंस्यते नम

 শুকদেব গোস্বামী সহ অনেক পণ্ডিত এই ‘राधसा’ বা ‘রাধাশা’ অর্থাৎ কৃষ্ণর বৈভবকে রাধারাণীর পরোক্ষ রেফারেন্স হিসাবে ব্যাখ্যা করেন। বলা হয়ে থাকে, রাধাই পূর্ণ শক্তি। তিনিই আদ্যশক্তি। এছাড়াও সামবেদ ১৬৫ তে পাওয়া যায়,

“ইদং হ্যন্বোজসা সুতং রাধানাং পতে। পিবা ত্বাস্য গিবর্ণঃ।।”

যদিও এখানে ‘রাধানাং’ বলতে আক্ষরিক অর্থে রাধা বোঝানো হয় নাকি প্রকৃতি বা সৃষ্টির জ্ঞান এবং ঐশ্বর্য্যর আদির মালিক তা নিয়ে কনফিউশান আছে। একইভাবে সামবেদের ১১৭২ নম্বর শ্লোকের ‘রাধস্তন্নো’ অর্থও রাধা নয়, বরং আরাধ্য শক্তি, ১১৮০ নম্বর শ্লোকের ‘রাধসে’ অর্থ উপাসনা এভাবে বেদান্তিকরা ব্যাখ্যা করেন।

রাধাকে প্রত্যক্ষভাবে প্রথম পাওয়া যায় গাহাসত্তসঈ বা গাথা সপ্তশতী এবং পরবর্তীতে ব্রহ্মবৈবর্ত, পদ্ম পুরাণ এবং পরবর্তীতে জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যে ও চণ্ডিদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনে। এরপর চৈতন্যপরবর্তী বৈষ্ণব সাহিত্যে তিনি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। ভারতবর্ষের প্রধান ছয়টা আস্তিক্য দর্শন হচ্ছে বেদান্ত, মীমাংসা, বৈশেষিক, ন্যায়, সাংখ্য এবং যোগ। সাংখ্য দর্শনের প্রধান কনসেপ্ট পুরুষপ্রকৃতিতত্ত্ব, যেখানে পুরুষ চৈতন্য আর প্রকৃতি হচ্ছে বিশ্ব। এবং এই দর্শনে রাধাই মূলপ্রকৃতিস্থানীয়া। বেদান্ত দর্শনে কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার হলেও সাংখ্যতে এসে দেখা যায়, কৃষ্ণই বিষ্ণুকে সৃষ্টি করেছেন এবং আরও এক ধাপ এগিয়ে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডে দেখা যায়, কৃষ্ণ নিজেই রাধাকে মূলপ্রকৃতি বলে সম্বোধন করছেন, তিনি রাধাকে বলছেন, “তুমি না থাকলে আমি কৃষ্ণ, তুমি থাকলে আমি শ্রীকৃষ্ণ।”

রাধাকৃষ্ণ, মুঘল চিত্রকলায়

ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে রাধাষ্টমী বা রাধার জন্মদিন পালন হয়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে দেখা যায়, রাধা-কৃষ্ণ স্বামী-স্ত্রী, তারা থাকতেন গোলোকে, বৈকুণ্ঠের অনেক উপরে। এই বিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং ব্রহ্মা। একদিন শ্রীদামা বন্ধু কৃষ্ণকে নিয়ে বিরজা নামের গোপীর বাড়ি বেড়াতে যান। বিরজা, রাধার আর্চ-এনিমি। আর এই তথ্য শুনে ঈর্ষাকাতর রাধা কৃষ্ণকে ঠেকাতে নিজে বিরজার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। রাধার ভয়ে বিরজা গলে প্রথমে পানি, এরপর নদী হয়ে গেলেন। আর বেচারা কৃষ্ণ তাতে কষ্ট পেয়ে বেচারা বিরজাকে পুনর্জীবন দিয়ে আগের চেহারায় ফেরত নিয়ে আসলেন। কৃষ্ণ এবং বিরজার সাত পুত্র জন্মালো। কিন্তু আবার এই সাত পুত্রের কারণে তাদের প্রেমে বাধা পড়লে বিরজা নিজেই সাত পুত্রকে অভিশাপ দিয়ে সাত সমুদ্র বানিয়ে ফেললেন। এদিকে কৃষ্ণ আর বিরজার এইসব প্রেমের গল্প শুনে রাধা অভিশাপ দিলেন কৃষ্ণকে পৃথিবীতে গিয়ে বাস করার শাস্তি পেতে হবে। আর কৃষ্ণের বন্ধু শ্রীদামা রাধার এই অভিশাপের কথা শুনে রাধাকেও পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার অভিশাপ দিলেন। এদিকে রাধাও যেহেতু কম যান না, এবং অভিশাপ যেহেতু গোলকধামের নেইম অভ দা গেইম, তাই তিনিও শ্রীদামাকে উলটা অভিশাপ দিলেন অসুর বংশে জন্ম নেওয়ার। তো পরবর্তীতে একে অন্যের অভিশাপের পিংপংয়ের ফলশ্রুতিতে শ্রীদামা জন্ম নিলেন শঙ্খচূড় অসুর হিসাবে, আর রাধা জন্ম নিলেন বৃষভানু এবং কীর্তিদার কন্যা হিসাবে। যদিও বলা হয়, কীর্তির গর্ভে তার জন্ম হয় নাই। বলা হয়ে থাকে, বায়ু যোগমায়ার ফলে রাধা কীর্তির গর্ভে প্রবেশ করেন।

(এক্ষেত্রে মরাল অভ দা স্টোরি হচ্ছে, আপনি গোলকধামে থাকলে কাউকে অভিশাপ দিবেন না। দিলে নিজে উলটা অভিশাপ খাওয়ার জন্য রেডি থাকবেন।)

কিন্তু কথা হচ্ছে, রাধাকে ঠিক গোলকধামের অধিষ্ঠাত্রী অভিশাপবাজ দেবীভাবে আমরা মনে হয় কেউ দেখি না। অন্তত বাংলায় না। এমনকী ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের মতো বালক কৃষ্ণের তরুণী “কিবা উচ্চ স্তনযুগ শোভে বক্ষপরে/ নিতম্ব দেখিয়া লাজেতে বিদরে।/ করিশুণ্ড সম উরু অপূর্ব বাহার/ দেখিয়া রাধার শোভা লাগে চমৎকার/” রূপী মামী (বা মতান্তরে শ্যালিকা) চরিত্রেও না। বাংলায় রাধা পাশের বাড়ির বাচ্চা মেয়ে, পায়ে নূপুর পরা রাই কিশোরী। আমাদের পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণের মিথগুলিতে যত দেবী আছেন, যত নারী আর্কিটাইপ আছেন, তারা সবাই ক্ষমতাধর; এবং সেই ক্ষমতার নগ্ন উচ্চকিত গুণ্ডামি প্রকাশ তাদের চরিত্রে আছে। যেমন, হেরম্যাটিক সিম্বোলিজমের অন্যতম প্রধান চরিত্র সাইসের দেবী আইসিস। মিশরের সাইসের মন্দিরের গায়ে তার পরিচয় সম্পর্কে লেখা থাকে, “আমিই, আইসিস, যা কিছু হয়েছে তাই আমি, যা কিছু হবে, তাও; কোনো নশ্বর মানুষ আমাকে উন্মোচন করে দেখেনি” এই যে এই বাক্যে আইসিসের যে ঔদ্ধত্য তা তো আমাদের রাধার মধ্যে নাই। এমনকী আমাদের অঞ্চলের কালী বা তার প্রিকার্সার নৈঋতির যে প্রবল আধিপত্যবাদী দাঁড়ানোর ভঙ্গি, তা রাধায় নাই। রাধা কোমল, রাধা নরম, প্রেমভারে ব্যথায় আক্রান্ত বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় বিক্ষত কিশোরী চরিত্র। রাধারমণের ভাষ্যে রাধা যখন বলেন, “নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলা জ্বালাইয়া রে …” তখন রাধাকে দেবী ভাবা কষ্টকর। রাধা হয়তো সত্যি সত্যিই পদাবলী এবং পরবর্তীতে বৈষ্ণব সাহিত্যের কবিকল্পনা। বৈষ্ণবরা নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্যকে কৃষ্ণের অবতার বলে মানতেন, রাধা ছিলেন তার আরাধনীয়। অর্থাৎ রাস বলতে এখানে পুরুষ অর্থাৎ কৃষ্ণের সাথে ভক্ত বা প্রকৃতি বা রাধার অপ্রাকৃত লীলা বোঝানো হয়। এখানে রাস অর্থ খোঁজ। নিজের আদার-হাফের খোঁজ। এই আদার-হাফ প্রেমিকা কম, ঈশ্বর বেশি। কৃষ্ণই যদি ভারতীয় মিথের পরমপুরুষ বা পরমাত্মা বিষ্ণু হয়ে থাকেন, তাহলে রাধা হচ্ছেন জীবাত্মা বা জীবের জীবন, উকিল মুন্সির শুয়া পাখি হয়ে যে উড়ে যায়। শুয়া বা শুক এবং শারী পাখিরা আমাদের বঙ্গীয় ফিলোসফিতে মজার জায়গা নিয়ে আছে। এই পাখিদের ঝগড়া আমাদের নিজস্ব দ্বান্দিক ‘অবস্তুবাদ’।

শুক বলে আমার কৃষ্ণ মদনমোহন,
শারী বলে আমার রাধা বামে যতক্ষণ; নইলে শুধুই মদন
শুক বলে আমার কৃষ্ণ গিরি ধরেছিলো,
শারী বলে আমার রাধা শক্তি সঞ্চারিল; নইলে পারবে কেন?
শুক বলে আমার কৃষ্ণ জগৎচিন্তামণি,
শারী বলে আমার রাধা প্রেম প্রদায়িনী; সে তোমার কৃষ্ণ জানি
শুক বলে আমার কৃষ্ণ জগতের কালো,
শারী বলে আমার রাধার রূপে জগত আলো; নৈলে আঁধার কালো

অর্থাৎ উনিশ শতকের পদকার গোবিন্দ অধিকারীর এই রাধা-কৃষ্ণই আমাদের অঞ্চলের ভাবের ইন এ্যান্ড ইয়াং। কিন্তু কথা হচ্ছে রাধা-কৃষ্ণ যদি একে অন্যের প্রতিবিম্বই হবেন তাহলে কৃষ্ণ এই যে পরমাত্মা হয়ে ড্যাংড্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, বাঁশি বাজিয়ে এই যে “কী সুন্দর শ্যামরায়, ঘুইরা ঘুইরা মধু” ‘খাইয়া’ তার বহুগামী সর্বব্যাপী প্রেম অকাতরে বিলাচ্ছেন হাটে মাঠে যমুনার ঘাটে, তিনি চন্দ্রার ঘরে বসে রাধাকে ভাবছেন বটে, কিন্তু তিনি তো রাধাকে খুঁজছেন না; অথচ রাধাকে দেখেন, তিনি বিবাহিত হয়েও একগামী, তিনি সাবমিসিভ, তিনি নতজানু, তিনি একজনকেই খুঁজছেন, যিনি জানেন, তার জাত কুল সম্মান যাবে, তিনি জানেন তার ‘নারীর বেদন’ কেউ বুঝবে না, তার “অঙ্গ জ্বলিয়া যায়”- তিনি তবুও কৃষ্ণের অপেক্ষায় বসে আছেন; এই যে দুই ভিন্ন চরিত্র, তা কিভাবে একে অন্যের রিফ্লেকশান হয়? কৃষ্ণের প্রেম তো এক্ষেত্রে মানুষের নিজস্ব ঈশ্বরভাবনা, যেন ঈশ্বর সৃষ্টি করে সৃষ্টির আনন্দে খাবি খাচ্ছেন, আর ভক্তরা ফুলবেলপাতা হাতে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে তাকেই গোলকধামে খুঁজে যাচ্ছেন সারাজীবন। না। আমি রাধাকে এ কারণেই কৃষ্ণের ‘ইন’ এর বিপরীতে ‘ইয়াং’ বলে ভাবি না। আমি রাধাকে দেখি উইসডম, অর্থাৎ প্রজ্ঞা আকারে। জ্ঞানের চাইতেও যে বিদ্যা বড়। প্রকৃতিকে জানার বিদ্যা, দেহকে জানার বিদ্যা। কারণ দেহই প্রকৃতি, দেহই ভাণ্ড, দেহকে জানলেই ব্রহ্মাণ্ডকে জানা যায়। এই এই যে আমরা জন্মাই, ইস্কুলে ক্যালকুলাস আর বাংলা ইংরেজি ব্যকরণ শিখি, সপ্তর্ষীমণ্ডলের ক্রতু পুলহ পুলস্ত্য অত্রি অঙ্গিরা বশিষ্ঠ মরীচি আর পানিপথের যুদ্ধের টাইমলাইন মুখস্ত টুখস্ত করে চাকরি করে ব্যবসা করে চাষবাস করে একটাই বিয়ে (গোপনে একটাই পরকীয়া) করে রাষ্ট্রস্বীকৃত ভদ্রজনিত সংখ্যায় বাচ্চা জন্মদানকল্পে মশারির ভেতরে নিভৃতে মরেটরে যাই, এই মানব জীবনের ‘কী যেন নাই’ প্রশ্নের, এই জ্ঞানের প্রয়োগের নাম প্রজ্ঞা। বা রাধা।

ইন্টারেস্টিংলি, আইসিসের নামের অর্থও প্রজ্ঞা। তবে আইসিস যেমন জ্ঞানের ভারে তেজস্বী অহংকারী, রাধা তা নন। প্রাচীয় বিনয় তার ট্রান্সেন্ডেন্টালিস্টিক প্রজ্ঞার অংশ।

কালীঘাটের পটে বঙ্গদেশের রাধারানি

আমাদের দৃশ্যগত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য শক্তিমান বস্তুগত পৃথিবীর সাথেই অদৃশ্যমান শক্তির জ্ঞানের প্রজ্ঞার ডক্টর ফাউস্টের স্পিরিট এসেইলের মতো চিন্তার মতো দ্রুত ভাবের প্রেমের অবস্তুগত পোটেনশিয়াল এনার্জির পৃথিবী থাকে। কর্মের সাথে কর্মশূন্যতা থাকে। কিন্তু কর্মশূন্যতা তো কর্মের কাউন্টারপার্ট না। নাইয়ের কনসেপ্ট, শূন্যের কনসেপ্ট তাই ‘থাকা’ দিয়ে, ‘আছি’ দিয়ে, “I think, therefore I am” দিয়ে বোঝা যায় না। রাধার কনসেপ্ট বোঝার জন্য আমাদের কৃষ্ণের প্রয়োজন নাই। জ্ঞান দিয়ে প্রেম বুঝতে চাওয়া বোকামি, প্রেম দিয়ে সাহসের কনসেপ্ট বোঝাও সম্ভব না। কৃষ্ণ এবং রাধা- দুই পৃথক কনসেপ্ট। এবং তারা বাইনারি অর্থে, ভাব থেকে রূপে যাওয়ার চক্রাবর্তেও একে অপরের পরিপূরকও না।

কেন না, তা রাধার ইটার্নাল ফেমিনিনের মনস্তত্ত্বতেই পরিষ্কার। রাধা-কৃষ্ণকে যে জায়গাতেই আবিষ্কার করা হোক না কেন, রাধার যে অন্তর্বেদনা, রাধার যে হাহাকার, রাধার যে অতৃপ্ত শরীর এবং ততোধিক অতৃপ্ত মন, রাধার যে বিরাগ, যে ঈর্ষাকাতরতা উষ্মা ডিলেমা ক্ষোভ কমপ্লেক্সিটি লজ্জাবোধ বীতস্পৃহা অপারগতা ব্যকুলতা এবং সর্বোপরি সাবমিশানের যে তীব্র আকাঙ্খা- তা সবক্ষেত্রেই “কী করিবো ধনজন জীবন ঘরে/ কাহ্ন তোক্ষা বিনি সব নিফল মোরে”র মতোই অত্যন্ত প্রকট। এই চাহিদা কৃষ্ণের নাই। তিনি রাধাকে ভালোবাসেন অবশ্যই, কিন্তু রাধার যন্ত্রণা তিনি অনুভব করেন না। রাধার ব্যথা তার একার। তার এগজিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিস তার একার। যে কারণে ভ্রমরকে তিনি যখন বলেন, “শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে”, তখন আমরা সেই আগুনের তাপ অনুভব করি। রাধা ঈশ্বরের মতো কামহীন না। তিনি তার কামসহ, শরীরসহ ইন্দ্রিয়সহ- হাত কাটার পর হাত থেকে রক্ত গড়ানো, সেই রক্ত গড়ানোর ব্যথা সহ- শব্দহীন এবং শব্দসহ চিৎকার করা মানুষ।

এবং এ কারণেই তিনি আমাদের আত্মার কাছের অনুষঙ্গ। আমাদের দৈনন্দিন যাপনে, আমাদের আকাঙ্খায় ঘর বাড়ি থাকার পরেও বৈরাগী মাথা নিয়ে তিনি মানব জীবনের প্রজ্ঞা হয়ে বাস করেন। বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনে রাধার ট্রান্সফর্মেশান আমাদের নিজেদের ট্রান্সফর্মেশান। তিনি যে নৈতিক ডিলেমায় আক্রান্ত, সেই ডিলেমা আমাদেরও। পদাবলীর চণ্ডীদাসের রাধা আর শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনের তেরো খণ্ডের রাধার মধ্যে বেসিক পার্থক্য আছে অবশ্যই। কিন্তু সব জায়গাতেই রাধার অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট। এবং সকল অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়েও তিনি যে কলঙ্কিনী ব্যাভিচারিণী হতে ভয় পাচ্ছেন না, সমাজের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে নিজের অতি জাগতিক অতি শারীরিক চাহিদার কাছে নতি স্বীকার করতে লজ্জা পাচ্ছেন না, সেই জার্নিটাও আমাদের নিজেদের অতি বঙ্গীয় জার্নি।

কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে
আকুল শরীর মোর বেয়াকুল মন
বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ বান্ধন।

পুরুষের [বিশেষতঃ উচ্চ শ্রেণির] বহুগামিতা যেই বঙ্গীয় সমাজে সিদ্ধ ও ভাজা-ভাজা হলেও সকল শ্রেণির নারীর বহুগামিতা যেখানে ধর্মহীনতা লজ্জাহীনতা অশ্লীলতা নীতিবর্জ্জিত অপশিক্ষা অসভ্যতা সমাজ-সংসার-ধর্ম-গেলো-গেলো-গেলো হায়হায় মাতম, সেই সমাজে ঘরে স্বামী রেখে অন্য পুরুষের [হোক ঈশ্বর বা ভগবান, তবুও তো পুরুষ(সিংহের)] প্রেমে হাবুডুবু খেতে সাহস লাগে। পরকীয়া বিষয়ে আমি কী ভাবি, পরকীয়া ভালো কী খারাপ- সেটা অন্য আলাপ। কিন্তু বিয়ের মতো পিতৃতান্ত্রিক- নারীর ক্ষেত্রে একগামী লৈঙ্গিক আধিপত্যবাদী প্রতিষ্ঠানে পরকীয়াকে ‘স্বাভাবিক’ বাই-প্রডাক্ট বলে আমি মানি। ‘স্বাভাবিক’- কিন্তু তা নৈতিক কী অনৈতিক- এগেইন, সেটা অন্য আলাপ। এবং বাংলায় এই পিতৃতান্ত্রিক অমানবিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লেডি চ্যাটার্লির মতো রাধা একলাই তীব্র আন্দোলন করেছেন হিলতোলা জুতা পরে ইংরেজিতে কোনো নারীবাদী ফটরফটর স্লোগান দেওয়া ছাড়াই। তিনিই দেখিয়েছেন, প্রেমের কাছে, আকাঙ্খার কাছে নৈতিকতা কিছুই না। বিয়ের সিস্টেমের ‘বাগ’ ধরতে ইওরোপের যেখানে কয়েকশ’ বছর সময়ে লেগেছে, সেখানে রাধা আমাদের অঞ্চলের সিস্টেম ‘বাগ’ হয়ে বসে আছেন সেই চতুর্দশ শতাব্দীতেই। হ্যাঁ, রাধাকে অনৈতিক বলা সহজ। সমাজকে না বলে, ধর্মকে না বলে, প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক এবং অমানবিক না বলে, সিন্দাবাদের ভূতের মতো ঘাড়ে চেপে বসা মনুকে না বলে- নারীর দিকে আঙুল তোলা সহজ। কারণ নারী প্রলেতারিয়াতের মধ্যে প্রলেতারিয়াত। রাধা সমাজ অর্থে ব্যাভিচারিণী অবশ্যই, কিন্তু সেই ব্যাভিচারের কলঙ্ক সহ বাঙালীর রাধাকে গ্রহণ করতে সমস্যা হয় নাই। এখানেই বাংলা বেদান্তিক এবং এমনকি ইওরোপের সমাজের চাইতে অনেক অগ্রসর সমাজ; ছিলো। বাংলা ভাষার অন্যতম মজার বিষয় হচ্ছে বাংলায় কোনো লিঙ্গ নাই পৃথিবীর বেশিরভাগ ভাষার মতো। হিন্দি বলেন, ঊর্দু বলেন, আরবী ফার্সি ফ্রেঞ্চ জার্মান স্প্যানিশ এবং এমনকি ইংরেজিতেও he এবং she আছে, টেবিল চেয়ার চাঁদ তারা সূর্য দরজা জানালারও লিঙ্গ আছে। বাংলায় লিঙ্গের অনুপস্থিতি শারীরিক এবং মানসিকভাবে নারী পুরুষকে আলাদা করলেও আমরা যে একই সাথে নারী পুরুষ দুই এনার্জি ধারণ করি (বা বলা ভালো, করতাম)- তা রাধার চিত্রায়ণে আমরা দেখি। শারীরিকভাবে নারী হয়েও রাধাকে জেন্ডার ফ্লুইডভাবে শারীরিক পুরুষের মনস্তত্ত্ব ধারণ করতেও দেখি। শ্রীচৈতন্যের পুরুষপ্রকৃতিতত্ত্বের জন্য যে কারণে কৃষ্ণ পর্যন্তও যেতে হয় না, কারণ আমরা দেখি রাধা একলাই সেই তত্ত্ব ধারণ করে বসে আছেন।

কালীঘাটের পটে রাধার কোলে কৃষ্ণ সন্তানসম

আমাদের রাধারানি, শ্রীরাধিকা, আমাদের বৃন্দাবন বিলাসীনি আদরের রাই কিশোরী আমাদের প্রেম আর মাটির ব-দ্বীপমালার গল্প। শীতের অধিবাসের রাতে তুষের আগুনের ধোঁয়া আর গুড় নারিকেল বাতাসা আতপ চালের পিঠার সোনার কাঠি রুপার কাঠির বাঁশির কুয়াশার সকালের মাঠের ভেতর দিয়ে সাইকেল চালানো সমুদ্রগর্ভের ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমির ঘুড়ি ওড়ানো আকাশে অনিচ্ছায় ছুঁয়ে ফেলা প্রেমিকের হাতের মসজিদের ভোরের আজানের অশরীরি অস্তিত্বে “আষাঢ় মাসে নব মেঘ গরজএ” পুকুরের পানিতে ঘাঁই মারা দেবীপক্ষের মুকুলিত কিশোরীর যাত্রাপালার রাতে কারুর চোখে চোখ পড়ার মতো ঝড়ের দিনে গাছ থেকে আম পড়ার মতো আদরের বিল্লিবাচ্চার কারুণ্য রসের ঈশ্বরের চাইতে তেত্রিশ কোটি দেবতার চাইতে সজীব মানুষের প্রেমের গল্প। আদিরসের যমুনায় ঝড়ের রাতে প্রেম আর নিজের শরীর আবিষ্কার করা একজন কিশোরী নৌকার মাস্তুল ধরে ঝুলে আছেন। কৃষ্ণের ঐশ্বরিক ক্ষমতা নিয়ে তার মাথাব্যথা নাই। কৃষ্ণ তাকে বোঝান, তিনিই বিষ্ণু। তাতে অবশ্য রাধার কিছু আসে যায় না, বলেন, “শঙ্খ চক্র গদা আর শারঙ্গ এড়িআঁ/ দান সাধ কেহ্নে কাহ্নাঞইঁ পথত বসিআঁ/”- আর এভাবেই নিজের প্রেম নিয়ে বিস্মিত, নিজের হাসি কান্না ঈর্ষা ক্ষোভ যৌবনের প্রথম অভিজ্ঞতায় নিজেকে স্পর্শ করার অপরাধে আপ্লুত কিশোরী দুই পা বেয়ে রক্ত ঝড়ার তীব্র ব্যথায় নিজের চুল ছিঁড়ে নিজের আমাদের মাথায় ঢুকে যান অজ্ঞাতসারে।

আমাদের রাধিকা

বৃহৎ বঙ্গের সহজ ধারার ফকির, সাধুরা রাধাভাবে মানুষ ভজনা তথা প্রাণ-প্রকৃতি ভজনার তরিকা বাতলে দিতে জানেন। অথচ রসহীন বৈদান্তিকরা মেতে আছেন রাধার হত্যাযজ্ঞ প্রকল্পে। কিন্তু তারা আমাদের মাথা থেকে রাধাকে বের করতে পারবেন না। পদাবলীর রাধা তো পুতুল চরিত্র দেবী চরিত্র না, পদাবলীর রাধা আমাদের মেয়েশিশু, “আমরা রাইয়ের রাই আমাদের”– প্রেমিকা চরিত্র যিনি প্রেমপ্রস্তাব গ্রহণে নারাজ হয়েও প্রেমকে উপেক্ষা করেও অবজ্ঞা করেও ভগবানকে দিয়ে নিজের মাথায় ছাতা ধরিয়ে তাকে দিয়ে দইয়ের ভাণ্ড বহন করান। হয়তো এই আমলে লেখা হলে এই মেয়ে ঈশ্বরকে তীব্র শ্লেষ করে তাকে দিয়ে নিজের কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম রিবুট করিয়ে মাসের বাজার ও গাড়ির এঞ্জিনও ঠিক করিয়ে শেষমেশ দয়া করে তার প্রেমে পড়ে “আমার বয়ফ্রেন্ড কেন অমুক মেয়ের পোস্টে লাইক দিলেন” ভেবে আছাড়িপিছাড়ি দিয়ে কাঁদতেন। এই অবুঝ মেয়ে, অভিমানী মেয়ে কলাগাছের পাতার মতো কোমল সবুজ এলোমেলো মেয়ে কৃষ্ণ চলে গেলেই তার রূপ না, তার স্বরূপ উপলব্ধি করেন, “এগু আইনা দে মোর প্রাণপাখি পিঞ্জুরাতে থুই” বলে উথালপাথাল হন- আবার পর মূহুর্তেই তার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি জন্মায়, বাঁশির সুরে প্রেমে পড়ে যাচ্ছেন ভেবে বাঁশিই চুরি করে নিয়ে আসেন।

আমাদের জৈবিক সত্তার ঐশ্বরিক খোঁজ তাই রাধা। তিনি সেই প্রাজ্ঞ আদিসত্তা যা আমরা আমাদের দৈনন্দিন যাপনে ধারণ করি। তিনি কঠিন সত্যবাদী যুধিষ্ঠির চরিত্র না, তার জার্নি হিরো’জ জার্নি না, তিনি ঈশ্বরের মতো ন্যায়পরায়ণ না, তিনি সত্য সন্ধানের কঠিন পথে হাঁটেন না, তিনি আমাদের মতো হাত পা মাথা কনট্রাডিকশান সাথে নিয়ে সাথে হাঁটা সাধারণ মানুষের সাধারণ হাসি আনন্দ ব্যথা; তিনি চাল চড়িয়ে ভাত নিমঝোল আর পরল ভাজা রাঁধেন, হাতে রূপার খড়ি কানে রত্ন কুণ্ডল পরেন, তিনি “ভাদর মাসের তিথি চতুর্থীর রাতি/ জল মাঝেঁ দেখিলোঁ মো কি নিশাপতী।।/”-র মতো লৌকিক সংস্কার (বা কুসংস্কার) বিশ্বাস করেন, তিনি সমাজের সংস্কারে আটকা পড়েন আবার স্টিগমা ভাঙেন ট্যাবু অতিক্রম করেন এবং সেই অতিক্রম করাকরি নিয়ে আমাদের মতো ডিলেমায় ভোগেন।

আমি তাই রাধাকে সাথে নিয়ে হাঁটি। বা তিনি আমার সাথে হাঁটেন। খটখটে ল্যাবের ক্যালকুলেশান মাল্টিপোল সিকোয়েন্স এ্যালাইনমেন্টে মোটা কাচের মাইক্রোস্কোপের সেন্ট্রিফিউজের বাইরে তুষারঝড়ে আমার মাথার ভিতরের ঝড়ে রাধারাণী আমাকে কেন্দ্রে ফেরত নিয়ে আসেন, আমি ফিউম হুডের নিচে ফ্লেমেবোল সলভেন্টের বিকার হাতে নিয়ে শুনি সকাল হচ্ছে, সূর্য ওঠার গন্ধ পাই মাটিতে, হাতের গ্লাভসে টের পাই রাগ আহির ভৈরব বাজছে, আর দেখি গা ভর্তি গয়না পরা খালি পা একজন কিশোরী নদীর তীরে বসে আছেন সব আছে অথচ ‘কী যেন নাই, কী যেন নাই’ চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে, আকুল হয়ে, অপার হয়ে, তিনি জানেন না তিনি খুঁজছেন, তিনি জানেন না কী খুঁজছেন, কিন্তু তিনি খুঁজছেন। তার পায়ের নূপূর বেজে চলছে বঙ্গদেশে।

এবং তিনি খুঁজেই যাচ্ছেন।


নাদিয়া ইসলাম

লেখক, গবেষক, ভিগান, অজ্ঞেয়বাদী, বিড়ালপ্রেমিক, নারীবাদী এবং কনস্পিরেসি থিওরির একনিষ্ঠ ভক্ত। জন্ম ১৯৮৫ সালে।

Share