আজ বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

চিরানুপ্রেরক জ্যঁ-লুক গোদার

।। আর্যনীল মুখোপাধ্যায় ।।

“যে গোদার প্রথম বিশ-ত্রিশ বছর ফরাসী তথা ইউরোপীয় এবং কিছুটা মার্কিন শিল্প-সাহিত্য থেকে বেরতে চাননি, সেই তিনি একদিন বললেন, ‘সিনেমার আয়ু আইজেনস্টাইন থেকে কিয়ারোস্তামি পর্যন্ত’। অর্থাৎ সিনেমার জনক এক রুশ আর তার অন্তিম ঔজ্জ্বল্যের ধারক এক পারসিক! ! তাহলে জ্যঁ লুক, সিনেমা কি প্রাচ্যেই জন্মে প্রাচ্যেই শেষ হয়ে গেল? ”

চিরানুপ্রেরক জ্যঁ-লুক গোদার

দর্শন এক সত্তা যার হৃদকেন্দ্রে একটা প্রশ্ন ঝোলে
তার আপন অস্তিত্বের সন্দেহ সংক্রান্ত
যেন সে নিজেকে পেশ করে সর্বদা অন্য এক সত্তারূপে…
রূপক আর ধারণার মধ্যে কীসের তফাৎ?

জ্যঁ ল্যুক গোদার / Goodbye to Language

জ্যঁ লুক গোদার ভারতীয় উপমহাদেশের সিনেমা নিয়ে কখনো কোনো মন্তব্য করেছেন, আগ্রহ বা বিরক্তি দেখিয়েছেন বলে শুনিনি। মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায়-সহ কারো কারো সাথে আলাপ থাকা সত্ত্বেও কখনো কোনো মন্তব্যও শোনায় যায়নি। বিখ্যাত পশ্চিমী ঔদাসীন্য, যা ইউরোপীয়দের মধ্যে প্রবল, আমেরিকায় কিছুটা কম, তার নিদর্শন ফরাসী ‘নুভেল ভাগ’ বা নবতরঙ্গের প্রায় সব চলচ্চিত্রিদের মধ্যেই প্রচ্ছন্ন। সেই গোদার জীবনের শেষলগ্নে অতিমারীর মধ্যে কেরলের এক সিনেমা সংস্থাকে একটা জালিক (online) সাক্ষাৎকার দেন ২০২০-২০২১ সালে। সাক্ষাৎকার শুরুর আগেই প্রশ্নকর্তাকে জিজ্ঞেস করলেন , ‘বলুন তো পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য কী?”। প্রশ্নকর্তা বুদ্ধি করে বললেন, ‘আপনিই বলুন না! আপনার মনের কথা জানতেই তো এই মোলাকাত আমাদের’। গোদার পরম যত্নে বললেন –

‘জলের ওপর নিঃশব্দ তুষারপাত। এর চেয়ে সুন্দর কিছু নেই’।

-মা, ভাষা মানে কী?
– ভাষা সেই বাড়িটা যেখানে আমরা বসবাস করি
Deux ou trois choses que je sais d’elle

গোদারের অধিকাংশ ছবি ও লেখা উদ্ধৃতির নান্দনিতা ও দর্শনে ঝলমলে। চিরকাল। উক্তি ও ধারাবিবরণী। কখনো তা নিজের, কখনো অন্য পরিচালকের, অন্য জীবনের অন্যান্য মানুষের। এমনকি একটি ছবিতে (ল্য মেপ্রি) গোদার শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তিও ব্যবহার করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি আমার গোটা কবিজীবনেই জ্যঁ লুক গোদারের চিত্রলিপি থেকে যতিহীন অনুপ্রেরণা পেয়েছি। কখনো কখনো কবিতা শুরু করেছি ওঁর ছবির সংলাপ দিয়ে। যেমন ১৯৬৭ সালের ছবি “দ্যু ও ত্রোয়া সোঝ্‌ ক্য জ্য সে দে’ল” (ওর সম্বন্ধে দু-তিনটে কথা যা আমি জানি)-তে একটা সাধারণ দৃশ্য আছে একটা লিফটের মধ্যে যেখানে ছোট ছেলে তার মাকে জিজ্ঞেস করে ‘মা, ভাষা মানে কী?’। মা (আনা কারিনা) বলে, ‘ভাষা সেই বাড়িটা যেখানে আমরা বসবাস করি’। মাত্র দুটো বাক্য। গোটা ছবিটা ভুলে যাবার পরেও থেকে যায়। চিরগ্রন্থিত, চিরোজ্জ্বল।       

গোদারের প্রায় সমস্ত ছবিই নানা ব্যক্তিগত, গোপন উদ্ধৃতির সংগ্রহ। এইসব ‘ক্লু’ ধরে ফেলা-না-ফেলা দর্শকের ওপর। অনেক ছবি দেখতে দেখতে বোঝা যায় উনি কখনোই আশা করেন না যে চলচ্চিত্রচিন্তক বা আলোচক এই ইঙ্গিতগুলো আবিষ্কার করবে। করলে ভালো, না করলে আরো ভালো। লিখতে লিখতে এগুলো লেখকের পার্শ্বলিপি, সহায়কলিপি, যেমন আজকের সফটওয়ের ডেভলপার কোড লেখার মাঝে মাঝে মন্তব্য/ কমেন্ট লেখেন নিজের স্মৃতিসহায়িকা হিসেবে এবং আগামীদিনের সম্ভাব্য কোডপাঠকের সুবিধের জন্য।

এমনকি একটি ছবিতে (ল্য মেপ্রি) গোদার শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তিও ব্যবহার করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি আমার গোটা কবিজীবনেই জ্যঁ লুক গোদারের চিত্রলিপি থেকে যতিহীন অনুপ্রেরণা পেয়েছি। কখনো কখনো কবিতা শুরু করেছি ওঁর ছবির সংলাপ দিয়ে। যেমন ১৯৬৭ সালের ছবি “দ্যু ও ত্রোয়া সোঝ্‌ ক্য জ্য সে দে’ল” (ওর সম্বন্ধে দু-তিনটে কথা যা আমি জানি)-তে একটা সাধারণ দৃশ্য আছে একটা লিফটের মধ্যে যেখানে ছোট ছেলে তার মাকে জিজ্ঞেস করে ‘মা, ভাষা মানে কী?’। মা (আনা কারিনা) বলে, ‘ভাষা সেই বাড়িটা যেখানে আমরা বসবাস করি’। মাত্র দুটো বাক্য। গোটা ছবিটা ভুলে যাবার পরেও থেকে যায়। চিরগ্রন্থিত, চিরোজ্জ্বল।      

জ্যঁ লুক গোদারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ছায়াচিত্র ‘আ বু দে সুফ্‌লে’ (ব্রেথলেস) এর একটা দৃশ্যের কথা বলি। অনেকেরি হয়তো মনে থাকবে নায়ক গাড়িচোর মিশেল (জ্যঁ পল বেলমন্দো) সিনেমা হলের নামনে একটা হলিউডি ছবির পোস্টারের দিকে তাকিয়ে ছবির নায়ক ‘বোগি’ বা হাম্‌ফ্রে বোগার্টের অনুকরণে নিজের ঠোঁটের ওপর বুড়ো আঙুল চালায়। এই দৃশ্য এক ব্যক্তিগত উদ্ধৃতি, এক উদ্ঘাত বা রেফারেন্স যার মাধ্যমে পরিচালক দর্শককে একটা ইঙ্গিত দেন – যে কাহিনীর নায়ক বোগার্টিয়, হলিউডি বিচ্ছিন্নবাদী, বেপরোয়া এক ছন্নছাড়া।  

BREATHLESS (1960)

একই ছবির আরেকটি দৃশ্যে মিশেল এক সস্তার হোটেলে আমেরিকান বান্ধবী পাত্রিশিয়ার (জীন সীবার্গ) সাথে কয়েক ঘন্টা কাটাচ্ছেন। আসল উদ্দেশ্য পুলিশের গোয়েন্দাদের ফাঁকি দেওয়া। দুজনেই এলোমেলো সময় কাটায়, বিছানায় খুনসুটি করে। একসময় মেয়েদের নিয়ে কথা হয়। কোন শহরের মেয়ে কেমন? শহর তাদের চারিত্রিকতায় ছাপ ফেলেছে কিনা। নানা শহর, মূলত ফ্রাঁস বা ফরাসীভাষী দেশের, ঘুরে ঘুরে একসময় সুইস শহর লসিঅ্যান্‌-এর কথা ওঠে যখন,  জানলার ওপারে রাস্তায় এক আগুয়ান অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ আসে সাউন্ডট্র্যাকে। ‘আ বু দে সুফ্‌লে’ ছবি নির্মাণের সময় গোদারের মা লসিঅ্যান শহরে গাড়ি চাপা পড়ে মারা যান। ছেলের একটাও ছবি দেখে যেতে পারেননি মা। অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ সেই ব্যক্তিগত শোকের ইঙ্গিত।

– জীবনে আপনার বৃহত্তম উচ্চাকাঙ্খা কী?.
-অমরত্ব পাওয়া। তারপর মরে যাওয়া।

ব্রেথলেস

প্রশ্ন ওঠে – এইসমস্ত গুপ্ত চিহ্ন লেখার মধ্যে ফেলে রেখে কী লাভ? সিনেমা করা তো সাদা পাতায় কলম চালানোর মতো নিখরচার কাজ নয়। সাউন্ডট্র্যাকে শব্দটাকে নিয়ে আসতে চলচ্চিত্র সম্পাদক লাগে, শব্দ-কারিগর লাগে। তাতে খরচ আছে। প্রযোজককে এই খরচ বহন করতে হয়। এখানেই জ্যঁ লুক গোদারের আরেক কৃতিত্ব যা নিয়ে একেবারেই আলোচনা হয়না। গোদার পারতেন। ব্যক্তিগত ছবির, দৃশ্যের জন্য লগ্নিকারীদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে সে অর্থজয় করতে। ওঁর ছবি সুইডিশ, পোলিশ না নরওয়ের ছবির মতো সরকারী সাহায্যে হতো না। অনেক প্রথমদিকের ছবির প্রযোজক বদরেগারকে গোদার অনেকবার ওঁর অনেক খেপা প্রকল্পে অর্থলগ্নি করতে বাধ্য করেছেন। যেমন প্রথম দুটো ছবির পর গোদারের খেয়াল চাপে মূল ফিল্মটার (প্রতিফ্রেম) ওপর নানা ধরনের রাসায়নিক ক্রিয়াবিক্রিয়া চালিয়ে যদি তার আলোরঙের অবস্থার পরিবর্তন আনা যায়। এর জন্য একটা আস্ত গবেষণাগার বানিয়ে দেন বদরেগার। পরিচালক-বনাম-প্রযোজকের এই যুদ্ধে গোদার বারবার সফল হতেন; সে গুণ যেমন তাঁর ছিলো, আবার সমঝোতাও ছিল। হলিউড তাঁকে ছবি করার জন্য অনেকবার ডাকেন। গোদার মোটেই গররাজি ছিলেন না, পরিবর্তীকালে যতবারই উল্টো কথা বলুন। কিন্তু অতিরিক্ত সমঝোতা করতে হতো ওনাকে। ফলে হতোদ্যম হয়ে পড়েন দ্রুত। ‘ল্য মেপ্রি’ বা ‘কনটেম্পট’ ওঁর ১৯৬৩ সালের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছায়াছবি। এও এক ব্যক্তিগত প্রেমচিত্র তৎকালীন প্রেমিকা-স্ত্রী আনা কারিনাকে উদ্দিষ্ট। স্ত্রীর ভূমিকায় গোদার ফ্রাঁসের তৎকালীন যৌনবোমা ব্রিজিত বার্দোকে নেন। এই নির্বাচনের মধ্যে অন্য অভিসন্ধিও ছিলো যা ব্যবসায়িক। ‘ব্রেথলেস’ আমেরিকায় ভালো ব্যবসা করে। মার্কিন পরিবেশকরা গোদারের ছবি চাইছিলেন। ছবিতে মার্কিন অভিনেতাদেরো চাইছিলেন। গোদার জ্যাক পালান্সকে নেন। এবং সে দেশে মুক্তির আগে প্রযোজক/পরিবেশকদের চাপাচাপিতে ব্রিজিত বার্দো আর মিশেল পিকোলির দুটো শয্যাদৃশ্য রাখেন অপ্রয়োজনীয়তা সত্ত্বেও। তাঁরা চাইছিলেন বোদ্ধা দর্শক কম হলেও বার্দোর নগ্ন শরীর ও যৌনদৃশ্য দেখতে অনেকে আসবেন। আঁতেল ছবিতে একটু যৌনতা মাখিয়ে নিলে রথ দেখার সাথে কলা বেচাও হয়। এতটা আপোষ গোদারের মতো পরিচালক করবেন ভাবা যায় না।

Contempt (Le Mépris), ১৯৬৩ সালের চলচ্চিত্র

‘পিয়েরো লে ফ্যু’ (পাগলা পীয়ের) গোদারের এক আয়ুহীন সৃষ্টি। দর্পিত, বৈরি, নৈরাজ্যপূজার এক ছবি। প্রথম দৃশ্যে নায়ক পীয়ের (জ্যঁ পল বেলমন্দো) বাথটাবে শুয়ে শুয়ে সপ্তপদশ শতকী ইস্পানী চিত্রকর দিয়েগো বেলাস্কুয়েসের শেষার্ধের ছবির ওপর এক আলোচনার বই থেকে পড়তে থাকে। সেই অপূর্ব ধারাভাষ্যের মধ্যে দিয়ে গোদার ধরে ফেলেন সমসাময়িক জীবনের নাড়ি। তার জৈব মানে হারিয়ে ফেলার কথা, যার ক্ক্বাথ হয়ে বেরিয়ে আসা পণ্যলোভী সমাজ-আবর্জনা, যাকে ক্রমাগত, গোটা ছবি জুড়ে নিদারুণ ভর্ৎসনা করা হয়, যাকে ন্যাড়া করে মাথায় প্রহসনের ঘোল ঢালা হয়, এবং শেষ পর্যন্ত উড়িয়ে দেওয়া হয় আত্মঘাতী রোমান্টিক নৈরাজ্যে। এই অন্তর্লীন আন্তর্লিপিতা গোদারের চিত্রোদ্দেশ্যকে ধরার চাবিকাঠি। তার বাড়িটা, যা সাধারণ দর্শক হারিয়ে ফেলবেনই, সে বাড়িতে ফেরার মানচিত্র; অরণ্যপথে ফেলা এইসব রুটির টুকরো গোদার ছড়িয়ে দিয়েছেন – উদ্ধৃতি, ধারাবিবরণী, ও অন্যলেখার পুনর্ব্যবহারে।  

হলিউড তাঁকে ছবি করার জন্য অনেকবার ডাকেন। গোদার মোটেই গররাজি ছিলেন না, পরিবর্তীকালে যতবারই উল্টো কথা বলুন। কিন্তু অতিরিক্ত সমঝোতা করতে হতো ওনাকে। ফলে হতোদ্যম হয়ে পড়েন দ্রুত। ‘ল্য মেপ্রি’ বা ‘কনটেম্পট’ ওঁর ১৯৬৩ সালের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছায়াছবি। এও এক ব্যক্তিগত প্রেমচিত্র তৎকালীন প্রেমিকা-স্ত্রী আনা কারিনাকে উদ্দিষ্ট। স্ত্রীর ভূমিকায় গোদার ফ্রাঁসের তৎকালীন যৌনবোমা ব্রিজিত বার্দোকে নেন। এই নির্বাচনের মধ্যে অন্য অভিসন্ধিও ছিলো যা ব্যবসায়িক।

১৯৫০-এর দশকে ফরাসী নবতরঙ্গ আন্দোলন শুরু করেন কতিপয় চলচ্চিত্রি – আলাঁ হ্রেনে, ঝাক রিভেত, এরিক রোমার, ঝাক দেমি, খ্রিস মার্কার, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, ক্লদ শাব্রল, ক্লদ লেলুশ, অ্যাগনেস ভার্দা প্রভৃতি। জ্যঁ লুক গোদার যোগ দেন কয়েক বছর পর ‘আ বু দে সুফ্‌লে’ ছবি দিয়ে। বাকিটা ইতিহাস যা আজ উইকিপিডিয়াও মোটামুটি বিশ্বস্ততার সাথে বলতে পারে। এই আন্দোলন নিয়ে, আন্দোলকদের নিয়ে বইপত্রের অভাব নেই, আলোচনা, গল্পগুজব, তথ্যচিত্র অঢেল। তার মধ্যে গেলাম না।

Cinema is dead but films are being made
– JLG

Pierrot le Fou. ১৯৬৫ সালের চলচ্চিত্র

১৯৬০ সালে শুরু হওয়া জ্যঁ লুক গোদারের চলচ্চিত্রজীবন ও তার ভাষা ও আঙ্গিক যে অত্যন্ত স্বাভাবিকতা ও জৈবভাবে উত্তরাধুনিক (পোস্টমডার্ন) তা বলে দেবার অপেক্ষা রাখেনা। উত্তরাধুনিক প্রযোজনার অসংখ্য চেষ্টিত প্রয়োগ আছে যা অধিকাংশ হুঁশিয়ার লেখক-শিল্পীর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। গোদারের ছবিতে সেটা যেমন স্বাভাবিক এবং তেমনি পরিহাসপ্রিয়। আন্তর্লিপিতা, আত্মপ্রতিফলন, অবান্তরতা – এই প্রবৃত্তিগুলো তাঁর চলচ্চিত্র পরিকল্পনা ও অনুষ্ঠানে একাত্ম। পরিহাস বা ব্যাঙ্গ তার অকূস্থলে। উদাহরণস্বরূপ মনে করিয়ে দিই ওঁর নৈরাজ্যবাদী ছবি ‘উইকণ্ড’ –এর কথা। একটি দৃশ্যে নায়ক এক সরল, নির্দোষ পথচারীকে আচমকা চড় কষায়। লোকটি গালে হাত দিয়ে যখন হতবাক নায়ক (জ্যঁ পল বেলমন্দো) তাকে বলে – ‘আপনার ওপর কোন রাগ নেই আমার। ফ্রাঁস অ্যালজিরিয়ার সাথে মাঝে মাঝেই যা করে সেটাই দেখালাম আরকি’।  বহুমাধ্যম, বহুবাস্তব ও বহুক্ষেত্র বা জ্ঞানশাখার ভেতর দিয়ে শুরু হয় এক জটিল অথচ ইথারীয় যাত্রা যা পরিবিষয়কে গড়ে দেয় তার নিজস্ব স্টুডিও, যেখানে আধগড়া কাহিনি পৌঁছে দিচ্ছে তার আপন অর্থ সমাগম, বহু শিল্পীর হাতে গড়া, যদিও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নানা খোপ-খন্ডহরের জায়গা রয়েছে সেখানে, একটি সম্পূর্ণ পণ্যকে আহরণ করার অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যখন নতুন কোনো এক লিপি বেরিয়ে আসে। গোল হয়ে আসেনা, কুণ্ডলীআকারে আসে, ব্যুৎপন্ন লিপি এগিয়ে যায় আরও কয়েক ছত্র।

Cinema starts with Eisenstein and ends with Kiarostami
– JLG

হাতে-ধরা ক্যামেরা দিয়ে পূর্ণাঙ্গ ছায়াছবি তোলার কৃতিত্ব অনেকেই জ্যঁ লুক গোদার ও তাঁর সিনেমাচিত্রি রাউল কুতারকে দেন, কিন্তু ওঁদের অন্তত বিশ বছর আগে আমেরিকায় হলিউড-অবহেলিতা তীব্র প্রবিভাময়ী মায়া দেরেন ও তাঁর সহকারী এই টেকনিক ব্যবহার করেন। ‘পদ’কে পা হিসেবে ধরলে ‘ত্রিপদ’ হলো Tripod, যার ওপর ভর করে সে যুগে ক্যামেরা ছবি তুলতো। নিজের ছবির জন্য মায়া এই ত্রিপদী চরিত্রকে বদলে দিয়েছিলেন। তিনি নিজের শরীরটাকেই করে তুলেছিলেন ক্যামেরার মাউন্ট। শুধুমাত্র হাতে ধরা ক্যামেরার মধ্যে দিয়েই চলচ্চিত্রভাষার সাবলীলতা নয়, ক্যামেরার সামনেও নাচের মুদ্রায় নিজের শরীর বেঁকিয়ে চুরিয়ে সিনেমাকে এক জৈব শিল্পবস্তু করে তুলছিলেন।  বছর ১০-১৫ পরে ফরাসী নবতরঙ্গের অ্যাগনেস ভার্দা, জ্যঁ-লুক গোদাররা এই জিনিসটা করতে শুরু করে এবং পরবর্তীতে বিপুল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হন। মায়া দেরেন হারিয়ে যান। ‘সত্যবাদী ছবি’ বা ‘সিনেমা ভেরিতে’ – যার কৃতিত্বও অনেকে গোদারকে দেন- আসলে শুরু হয় কিছু পূর্বে। জ্যঁ রুশ  (Jean Rouche) নৃতত্ববিদ, গোদারের একসময়ের সহচর ও সহকারী,  তিনি ‘ক্রনিক দাঁ-নেতে’ (১৯৬১) ছবিতে পথচারীদের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে প্রথম ‘সিনেমা ভেরিতে’ তৈরি করেন। গোদার এই অভিবনবত্বগুলো আঁকড়ে ধরেছিলেন। তাকে নিজস্ব মোচড় দিতে পেরেছিলেন।  

জ্যঁ লুক গোদারের গোটা চলচ্চিত্রজীবনের দিকে তাকালে ৩-৪টে স্পষ্ট পর্ব দেখতে পাই। তিরিশ-অনূর্ধ গোদার কিছু হাতে-খড়ি ক্ষুদ্রচিত্র নির্মান করেন। সে ছবিগুলোর সব কটাই দেখেছি। একটাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষ করে একটি – ‘ইউন ইস্তোয়ার দ্যো’ (জলের ইতিহাস)। ১৯৬০ সালে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি ‘আ বু দে সুফ্‌লে’ বা ‘ব্রেথলেস’। এরপর থেকে থেকে প্রাথমিক সত্তর দশক অব্দি এক চূড়ান্ত পরীক্ষাবাদী, বেপরোয়া, রাজনৈতিক গোদার যিনি সবরকমের বিশ্বচলচ্চিত্রকেই আকারে, আধারে অবহেলা করেন। যেন তাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। তার রাজনীতিবোধ কোনো বিশেষ দেশ, সমাজ, যুদ্ধ, রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে, সমর্থনে নয়। ‘রাজনীতি’ কে সম্পূর্ণরূপে ভাবেন। সেখানে দেশ, সমাজ, মানুষ, শ্রেণী, লিঙ্গযুদ্ধ, সরকার, সেনা, সঙ্গীত, শিল্প, সিনেমা, জনসংস্কৃতি – সমস্তটা আসে। ১৯৬০ – ১৯৭৪, এই পনের বছরে গোদার ৩১টি ছবি করেন। উৎপাদনশীলতার এই বহর একমাত্র জর্মন পরিচালক রাইনার ওয়ার্নার ফাসবিন্দার ছাড়া আর কারো মধ্যে পাইনা। কেউ কেউ এই প্রথম দিকের ছবিগুলোকে দু ভাগেও দেখতে পারেন – ক) অরাজনৈতিক বিষয়ভাবনা খ) রাজনৈতিক বিষয়ভাবনা। ১৯৭০-এর শেষ থেকে যেন দ্বিতীয় পর্ব শুরু যেখানে গোদার কিছুটা ঠান্ডা, কিন্তু আপাতভাবে; হঠাৎ ধর্মের পেছনে লেগেছেন, শ্রমিক আন্দোলনগুলোর দিকে নজর দিচ্ছেন।  

তৃতীয় পর্ব শুরু হয় ১৯৯০ দশকের মুখে সোভিয়েত রাশিয়া ও লৌহযবনিকা ছিঁড়ে যাবার সময়; পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ার পুনর্গঠনের কালে। এই সময় থেকেই জ্যঁ লুক অনেক বেশি আত্ম-প্রতিফলিত, দার্শনিক, অন্তর্মুখি। তাঁর রাজনৈতিক সততা, সংবেদন মরেনি, বরং এক আত্মস্ত গভীরতর দার্শনিকতায় ন্যস্ত। যে গোদার নিয়ত পরীক্ষামুখি হওয়া সত্ত্বেও ফরাসী সাহিত্য-কবিতার ক্ষেত্রে প্রথম জীবনে পুরনো ও ধ্রুপদীর দিকেই আকৃষ্ট হয়েছেন সেই গোদার এখন সমসাময়িক সাহিত্যের দিকে মুখ তুলেছেন। ২০০৪ সালে নির্মিত ‘নোত্‌র মুসিক’’(আমাদের গান) ছবিতে পালেস্তিনিয় কবি মাখ্‌মুদ দরবিশের এক মর্মস্পর্শী সাক্ষাতকার নিচ্ছেন, যৌথতায় যাচ্ছেন অন্যান্য সমকালীন লেখক, কবি, চলচ্চিত্রিদের সাথে। ব্যক্তিগতভাবে বলবো এই শেষপর্বের গোদার আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সমাজ, সাহিত্য, ভাষা, শিল্প, রাজনীতি নিয়ে গোদার তাঁর সবচেয়ে গভীরতম, বৃহত্তম, সবচেয়ে অবান্তরতাবাদী অথচ সারবত্তায় ঠাসা ভাবনার জপমালা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। আর সিনেমাকে গড়েছেন প্রবন্ধ-কবিতার মতো। উদাহরণ তাঁর শেষদিকের প্রায় প্রত্যেক ছবি – জে এল জি / জে এল জিঃ সেলফ পোর্ট্রেট ইন ডিসেমবর (১৯৯৪), ফর এভার মোৎসার্ত (১৯৯৬), ইলোজ্‌ দেলামূর (প্রেমের পূজায়, ২০০১), ‘নোতর্‌ মুসিক’’(আমাদের গান, ২০০৪), ফিল্ম সোসিয়ালিস্মে (চিত্রসমাজবাদ, ২০১০), আদিউ ও লাঁগাজ্‌ (বিদায় ভাষা, ২০১৪) ও ল্য লিভ্‌ দিমাঝ্‌ (চিত্রপুস্তক, ২০১৮)। আমার কাছে জ্যঁ লুক গোদার এক চির-সমসাময়িক চলচ্চিত্রকার, শিল্পী, দার্শনিক ও চিন্তক হিসেবে আজীবন রয়ে যাবেন। এক অনাবিল, চিরসাম্প্রতিক আবশ্যিকতা। 

Film Socialisme, ২০১০ সালের চলচ্চিত্র

এসব সত্ত্বেও গত দশ-বারো বছর ধরে গোদার সমানে সিনেমার মৃত্যুর কথা বলে চলেছেন। প্রখ্যাত, প্রবীণ ফরাসী দার্শনিক আলাঁ বাদিউ কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ক্লে বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেমাশিল্প নিয়ে এক ভাষণে জ্যঁ লুক গোদারের কথা তোলেন আলগোছে। বাদিউ বললেন – ‘গোদার বলছেন সিনেমা আজ মৃত। কিন্তু উনি নিজে ছাড়া সকলেই ছবি করছেন’।  কেন গোদার এমন বলতেন সেটা ভাববার কথা। হয়তো সিনেমার প্রতি সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। আলোকোজ্জ্বল যেসব মঞ্চে উনি নিজের ছবিকে তুলে ধরতে পারতেন সেই সব মঞ্চে তুমুল পরীক্ষাবাদী, নৈরাজ্যবাদী, আত্মপ্রতিফলনধর্মি ছবির অভাব – এসবই কি কারণ! যে গোদার প্রথম বিশ-ত্রিশ বছর ফরাসী তথা ইউরোপীয় এবং কিছুটা মার্কিন শিল্প-সাহিত্য থেকে বেরতে চাননি, সেই তিনি একদিন বললেন, ‘সিনেমার আয়ু আইজেনস্টাইন থেকে কিয়ারোস্তামি পর্যন্ত’। অর্থাৎ সিনেমার জনক এক রুশ আর তার অন্তিম ঔজ্জ্বল্যের ধারক এক পারসিক! তাহলে জ্যঁ লুক, সিনেমা কি প্রাচ্যেই জন্মে প্রাচ্যেই শেষ হয়ে গেল?

     

গোদারের শেষ দুটি ছবি Goodbye to language (২০১৪) এবং Le_Livre_d’image (২০১৮)

আন্তর্জাতিক কেরল চলচ্চিত্র উৎসবে সিএস ভেঙ্কটিয়েশ্বরনকে দেওয়া গোদারের সাক্ষাৎকার। ২০২১

 

আর্যনীল মুখোপাধ্যায়

দ্বিভাষিক কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, চিত্রনাট্যকার ও সম্পাদক। বাংলা ও ইংরেজী মিলিয়ে ৯টি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে Conversation about Withering (২০২১, ক্রিস্তিনা স্যাঞ্চেস লোপেসের সাথে), অনাম আন্দ্রেসের একক ইস্তাহার (২০২০), স্মৃতিলেখা (২০১৩, ২০১৫), সুনামির এক বছর পর (২০০৮), চতুরাঙ্গিক/SQUARES (২০০৯, প্যাট ক্লিফোর্ডের সাথে), late night correspondence (2008), হাওয়ামোরগের মন (২০০৪) ও খেলার নাম সবুজায়ন (২০০০,২০১১)। গদ্যগ্রন্থ ‘কিনারার রূপকথা’। চারটি প্রবন্ধের বই। ইংরেজী ও ইস্পানি কবিতা সংকলিত হয়েছে অসংখ্য বিদেশী কাব্য-আয়োজনে। কৌরব অনলাইন ও The MUD Proposal সম্পাদনা করেন। পেশা – কারিগরি গণিতের গবেষণা।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top