বিস্মৃতির ঋত্বিক ও একগুচ্ছ ডকুমেন্টারি

।। অতনু সিংহ ।।

কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত বাংলার লোকনন্দন, লোকগাথা এসবকে নিজের মতো করে অবলীলায় চলচ্চিত্রে প্রয়োগ করেছেন ঋত্বিক। বাংলার সাধারণ মানুষকে ঋত্বিক চলচ্চিত্রে করে তুলেছিলেন মিথিক্যাল, ‘Larger than life’ । বেশ কিছু সনাতনী মিথকে তিনি বাংলার অবৈদিক লোকজীবনের মতো করে বিনির্মাণ করেছিলেন। এইসব বিষয়গুলো কোনো এক অজ্ঞাত কারণেই চর্চার অভাবে অনেকটাই বিস্মৃত। আর এই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে ঋত্বিকের বেশিরভাগ ডকুমেন্টারিও। এই লেখায় ঋত্বিকের চারটি ডকু্মেন্টারি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে এই চারটি তথ্যচিত্রের ইউটিউব লিঙ্ক। ঋত্বিক ঘটকের জন্মদিনে ‘প্রতিপক্ষ’র শ্রদ্ধা।

বিস্মৃতির ঋত্বিক ও একগুচ্ছ ডকুমেন্টারি

ইউরোপমন্যতার সমান্তরালে বৃহৎ বঙ্গের নিজস্ব চলচ্চিত্র ভাষার জন্ম দিয়েছিলেন চলচ্চিত্রী ঋত্বিক কুমার ঘটক। তাঁর চলচ্চিত্র বঙ্গের আত্মভুবন পাঠের মাধ্যম। কেননা, এই বড় বাংলার নিজস্ব দর্শনজগত, নান্দনিকতা ও ভাববৈচিত্র্যকে ধারণ করেছে তাঁর চলচ্চিত্রসমূহ। যে ভাষার অনুসরণ করতে দেখা গেছে ঋত্বিক পরবর্তী উপমহাদেশের অনেক চলচ্চিত্রীকে। কিন্তু ঋত্বিকের চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্রের অভিসন্দর্ভ এবং তার ভাষা সম্পূর্ণভাবে পর্যালোচিত হয়নি।

প্রথমত ঋত্বিকের কয়েকটি মাত্র কাহিনীচিত্রের ব্যাপারেই লোকজনকে কথা বলতে দেখা যায়। ঋত্বিক পরিচালিত মুক্তিপ্রাপ্ত কাহিনীগুলোর ব্যাপারে কিছু সামান্য আকাদেমিক কাজ হলেও হলেও দুয়েকটি ছবি বাদে আজকের দর্শক সমাজের কাছেই বেশিরভাগ ছবির মর্মবস্তু প্রায় অপরিচিতই। দ্বিতীয়ত মুক্তিপ্রাপ্ত এইসব কাহিনীচিত্রগুলো আখ্যান ও আঙ্গিক ও দার্শনিক প্রস্তাবে বহুমাত্রিক হলেও কেবলমাত্র ‘বাংলাভাগ’ বা ‘দেশভাগ’ বাদে অন্যান্য অতি-গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে চলচ্চিত্রমহলেও তেমন আলাপ হয় না। পত্রপত্রিকায় ঋত্বিক স্মরণ কিংবা তাঁর চলচ্চিত্রের পর্যালোচনার ক্ষেত্রেও ‘দেশভাগ’ বা ‘বাংলাভাগ’ বাদে সমান গুরুত্বপূর্ণ বাকি বিষয়গুলো চাপা পড়ে থাকে। বরং ঋত্বিক ঘটকের নৈরাশ্য, হতাশা, মাতলামো ও তাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পপুলার মিথের সস্তা গসিপ দারুণ জনপ্রিয়। তৃতীয়ত ঋত্বিক ঘটকের তৈরি প্রামাণ্যচিত্রগুলির বিষয়ে চলচ্চিত্রমহল এবং চলচ্চিত্রবিদ্যার আকাদেমিক জগত চরম উদাসীন।

আমরা সংক্ষেপে ঋত্বিকের চলচ্চিত্রের দার্শনিকতার নিরীখে তাঁর তৈরি তথ্যচিত্র বা ডকুমেন্টারিগুলোর ব্যাপারে এই লেখায় আলোচনা করব। রিলিজ হওয়া ফিচার ফিল্মগুলোর থেকে সংখ্যায় অনেক বেশি ঋত্বিক নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র বা ডকুমেন্টারি। যেগুলো ঋত্বিকের চলচ্চিত্র-চালচিত্রেরই অংশ। অর্থাৎ তাঁর চলচ্চিত্রের অভিযাত্রা যে ডিসকোর্স তৈরি করেছিল, কাহিনীচিত্রের মতোই তার অংশ প্রামাণ্যচিত্রগুলো। ঋত্বিকের মুক্তিপ্রাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্রগুলো পর্যালোচনা করলে স্পষ্টতই বোঝা যায়, কেবলমাত্র বাংলাভাগের যন্ত্রণা হতাশা তাঁর ছবির বিষয় হয়ে ওঠেনি। বরং ঔপনিবেশিকতা আর উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ্যবাদের কারসাজিতে বাংলাকে বাধ্যত ভাগবাঁটোয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ঋত্বিক যে চলচ্চিত্রগুলো নির্মাণ করেছেন তার ভরকেন্দ্রে মূর্ত হয়েছে বঙ্গের ভূমিমানুষ ও তাঁদের অন্দরজগত। ঋত্বিক নিজে মার্ক্সবাদী কিন্তু ইউরোপের ইতিহাসের চোখ দিয়ে মার্ক্সবাদের বঙ্গীয় ফলিত প্র্যাক্টিসের বাইরে গিয়ে বঙ্গের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সমসাময়িকতার মতো করে মার্ক্সীয় সমাজবীক্ষাকে চলচ্চিত্রে প্রয়োগ করেছেন। ঔপনিবেশিকতা ও ধর্মীয় জাতিবাদে ক্ষতবিক্ষত বাংলার পুনরুত্থানের লক্ষ্যে ঋত্বিক চেয়েছিলেন কৃষিকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির রাজনৈতিক নির্মাণ। এ কারণে মার্ক্সবাদের সঙ্গে তিনি কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং-এর ‘যৌথনির্জ্ঞান’, ‘ফার্টিলিটি কাল্ট’ ইত্যাদিকে সংযুক্ত করেছিলেন। লক্ষ্য ছিল, চলচ্চিত্রে কৃষিবিপ্লবের কাব্যিক ইস্তেহার রচনা। কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত বাংলার লোকনন্দন, লোকগাথা এসবকে নিজের মতো করে অবলীলায় চলচ্চিত্রে প্রয়োগ করেছেন ঋত্বিক। বাংলার সাধারণ মানুষকে ঋত্বিক চলচ্চিত্রে করে তুলেছিলেন মিথিক্যাল, ‘Larger than life’ । বেশ কিছু সনাতনী মিথকে তিনি বাংলার অবৈদিক লোকজীবনের মতো করে বিনির্মাণ করেছিলেন। এইসব বিষয়গুলো কোনো এক অজ্ঞাত কারণেই চর্চার অভাবে অনেকটাই বিস্মৃত। আর এই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে ঋত্বিকের বেশিরভাগ ডকুমেন্টারিও।

ঋত্বিকের যে কয়েকটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখতে পাওয়া যায়, সেগুলো হলো, ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান’ (১৯৬৩),  ‘আমার লেনিন’ (১৯৭০), ‘দুর্বার গতি পদ্মা’ (দ্য টার্বুলেন্ট পদ্মা) (১৯৭১) ও ‘রামকিঙ্কর বেইজ’ (১৯৭৫)। এগুলো ছাড়াও আরও বেশ কিছু নির্মাণ করেছিলেন ঋত্বিক, যেগুলোকে সংরক্ষণ করে রাখা হয়নি। যেমন, ‘দ্য লাইফ অফ দ্য আদিবাসিজ’ (১৯৯৫), ‘প্লেসেস অফ হিস্টোরিক ইন্টারেস্ট ইন বিহার’ (১৯৫৫), ‘পুরুলিয়ার ছৌ’ (‘দ্য ছৌ ড্যান্স অফ পুরুলিয়া’) (১৯৭০), ‘ওঁরাও’ ইত্যাদি ছবির নাম করা যায়। যেগুলোর বিষয়ে কোনো সম্যক ধারণা না এখন আর কারো নেই। একইভাবে ঋত্বিকের তৈরি কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্র দেখার সুযোগ খুব কমজনেরই হয়েছে। এগুলোও হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির আড়ালে।

বেশ কয়েকটি শর্টফিল্ম ও বিজ্ঞাপন চিত্র রয়েছে, যেমন- সিজার্স (১৯৬২), ফিয়ার (১৯৬৫), রঁদেভু (১৯৬৫), সিভিল ডিফেন্স (১৯৬৫), সায়েন্টিস্টস অফ টুমরো (১৯৬৭), ইয়ে কওন (হোয়াই / দ্য কোয়েশ্চন) (১৯৭০)।

ঋত্বিকের যেসব তথ্যচিত্র আমরা দেখতে পাই, সেগুলোর বিষয়ে সংক্ষেপে আলাপ করব।

কেবলমাত্র বাংলাভাগের যন্ত্রণা হতাশা তাঁর ছবির বিষয় হয়ে ওঠেনি। বরং ঔপনিবেশিকতা আর উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ্যবাদের কারসাজিতে বাংলাকে বাধ্যত ভাগবাঁটোয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ঋত্বিক যে চলচ্চিত্রগুলো নির্মাণ করেছেন তার ভরকেন্দ্রে মূর্ত হয়েছে বঙ্গের ভূমিমানুষ ও তাঁদের অন্দরজগত। ঋত্বিক নিজে মার্ক্সবাদী কিন্তু ইউরোপের ইতিহাসের চোখ দিয়ে মার্ক্সবাদের বঙ্গীয় ফলিত প্র্যাক্টিসের বাইরে গিয়ে বঙ্গের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সমসাময়িকতার মতো করে মার্ক্সীয় সমাজবীক্ষাকে চলচ্চিত্রে প্রয়োগ করেছেন। ঔপনিবেশিকতা ও ধর্মীয় জাতিবাদে ক্ষতবিক্ষত বাংলার পুনরুত্থানের লক্ষ্যে ঋত্বিক চেয়েছিলেন কৃষিকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির রাজনৈতিক নির্মাণ। এ কারণে মার্ক্সবাদের সঙ্গে তিনি কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং-এর ‘যৌথনির্জ্ঞান’, ‘ফার্টিলিটি কাল্ট’ ইত্যাদিকে সংযুক্ত করেছিলেন। লক্ষ্য ছিল, চলচ্চিত্রে কৃষিবিপ্লবের কাব্যিক ইস্তেহার রচনা।

‘আমার লেনিন’ (১৯৭০)

কমিউনিষ্ট রুশবিপ্লবী ও সমাজবিজ্ঞানী ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিনের জন্মশতবর্ষে পোয়েটিক আখ্যানকেন্দ্রিক ‘আমার লেনিন’ নামক ডকুমেন্টারি ফিল্মটি নির্মাণ করেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। এই ছবিটির প্রসঙ্গে আলোচনায় যাওয়ার আগে উল্লেখ করতে হয়, চলচ্চিত্রমহল এই ব্যাপারে অবগত যে ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র আঙ্গিকে প্রাথমিকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল সোভিয়েত মন্তাজ স্কুল। বিশেষত চলচ্চিত্রকার সের্গেই আইজেনস্টাইন ও তাঁর চলচ্চিত্র আঙ্গিক। যদিও মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী ঋত্বিক মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদকে বাংলার প্রেক্ষাপট ও বঙ্গীয় সমাজচেতনার জায়গা থেকে পর্যালোচনা করেছেন, সেভাবেই সোভিয়েত মন্তাজ কিম্বা আইনজেনস্টাইনের চলচ্চিত্র-আঙ্গিককে অনুকরণ করেননি। বাংলার লোকজগত ও লোকশিল্পের নিরীখে যে চলচ্চিত্রভাষা গড়ে তোলার চেষ্টা তিনি করেছেন, তাতে কিছুটা প্রভাব রেখেছিলেন আইনজেনস্টাইন, এ কথা বলা যায়। যে প্রসঙ্গে এই বিষয়টা উল্লেখ করতে হলো, সেটা এই যে ঋত্বিকের চলচ্চিত্রভাষা ও চলচ্চিত্র আঙ্গিকের পুরোটাই ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায় তাঁর এই ‘আমার লেনিন’ নামক প্রামাণ্যচিত্রটিতে।

ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ভাঙা বাংলার (পশ্চিমবঙ্গ) একটি প্রান্তিক গ্রামের ভূমিহীন কৃষক গ্রামের যাত্রা থেকে প্রথম লেনিনকে জানছেন। তারপর বন্ধুর কাছ থেকে লেনিন বিরচিত ‘গ্রামের গরীবদের কথা’ বইটি উপহার পেয়ে আরো জানছেন লেনিনকে।  লেনিনকে জানতে গ্রাম থেকে শহর কলকাতায় পোঁছে যাচ্ছে আসছে ওই ভূমিহীন কৃষক যুবা।  কলকাতায় তখন লেনিন জন্মশতবর্ষ পালিত হচ্ছে। ধর্মতলায় উদ্বোধন হচ্ছে লেনিন ভাস্কর্যের। রাস্তার নামকরণ হচ্ছে, ‘লেনিন সরণী’। চালু হচ্ছে ‘লেনিন পাঠশালা’। শহরে লেনিনচর্চার মাঝে উপস্থিত থেকে ভূমিহীন ওই কৃষক যুবা ফের ফিরে যাচ্ছে তার গ্রামে। ভূমিহীন কৃষকদের সংগঠিত করে লেনিনবাদী শিক্ষায় জমিদারের কাছ থেকে সবহারানো কৃষিজীবীদের জমি পুনর্দখলের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে সে। ইতিহাসের পাতা থেকে জ্যান্ত হয়ে ওই যুবকের মধ্যে ফিরে আসছেন আমাদের লেনিন। ভূমিদখলের লড়াইয়ের এই দৃশ্যগুলিই ঋত্বিক পরে ব্যবহার করেছেন তাঁর শেষ পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্র ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’তে।

এই ছবিতে ফর্মাল প্রামাণ্যচিত্রের মতো করে কোনো সাক্ষাৎকার রাখা হয়নি। শুধু চিত্রভাষা সেলুলয়েডে কবিতা রচনা করেছে, যে কবিতার আখ্যান ধরে রেখেছে ঋত্বিক ঘটকের কন্ঠে ভাষ্যপাঠ বা ভয়েস ওভার। আর জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের মিউজিক ছবিটিকে পূর্ণ করে তুলেছে। বেশ কয়েকটি গণসঙ্গীতের ব্যবহার রয়েছে ছবিতে। পাশাপাশি একটি লোকগান, ‘কাউয়ায় ধান খাইলো রে, খাইবার মানুষ নাই/ খাইবার বেলায় আছে মানুষ/ কাম করিতে নাই, কাউয়ায় ধান খাইলো রে…’ এছাড়া ‘লেনিন লেনিন/ নুতন আশা নুতন এদিন/ নুতন আকাশ নুতন আলো/ এদিন আমার, লেনিন লেনিন…/’ ভয়েস ওভারের সঙ্গে পাশাপাশি এই গানটি এ ছবির কাব্যিক আখ্যানের যোগসুত্রের তৈরির সেতু হয়ে উঠেছিল। এই ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফিতে ছিলেন ধ্রুবজ্যোতি বসু, সম্পাদনায় রমেশ যোশী। প্রযোজনায় সুশীল করণ।

এই ছবিটিকে ভারত সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তবে গণপ্রজাতন্ত্রী পোল্যান্ড সরকার সে দেশে ছবিটি প্রদর্শন করে, কিন্তু ঋত্বিকের জীবতবস্থায় ছবিটি মুক্তি পায়নি ভারতে। তাঁর মৃত্যুর প্রায় আড়াই দশক পরে ছবিটি মুক্তি পায় পশ্চিমবঙ্গে।

‘দুর্বার গতি পদ্মা’ (দ্য টার্বুলেন্ট পদ্মা) (১৯৭১)

মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রগুলোর মধ্যে ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘দুর্বার গতি পদ্মা’ ছবিটি প্রথম সারিতে থেকে যাবে। যদিও এই ছবিটাও হারিয়ে গিয়েছিল। অনেক কসরতের পর ভারত সরকারের ফিল্ম আর্কাইভ থেকে খুঁজে পাওয়া গেছে। এটি একটি ডকু-ফিকশন, যাতে একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত প্রচুর রিয়্যাল ফুটেজের পাশাপাশি রয়েছে তথ্যের আখ্যানকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য বেশ কিছু ফিকশনাল দৃশ্য। এই ডকু-ফিকশনে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রে অভিনয় করেছেন কলকাতা ও বোম্বের বিখ্যাত বাঙালি অভিনেতা বিশ্বজিৎ। ছবির শুরুতেই তাঁকে দেখা যায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকায় সেলুট ঠুকে ক্যামেরার দিকে স্মিতমুখে বলছে, ‘আপনারা অপেক্ষা করছিলেন? হ্যাঁ আমরা এসে ইতিহাসের বাঁকের মুখে এসে পড়েছি…’ তারপর তিনি শান্তিপ্রিয়, কৃষিমুখর, নদীনালা ঘেরা বাংলাদেশের সঙ্গে বহির্জগতকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। ছবিটিতে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ, বাংলার সহায়সম্বলহীন ভূমিসন্তান, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প, উদ্বাস্তু শিবির, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে পশ্চিমবঙ্গ  ও ত্রিপুরার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের দৃশ্যশ্রাব্য ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে রয়ে গেছে। ছবিতে অভিনয় করতে দেখা যাচ্ছে দেখা যাচ্ছে মুম্বাই চলচ্চিত্র জগতের ন অভিনেত্রী নার্গিস দত্তকে। চিরায়ত বাংলার, দুখিনী বাংলার রূপ তাঁর মধ্যে এই ছবিতে প্রকাশ করতে চেয়েছেন ঋত্বিক। ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে গ্রেইট মাদার আর্কিটাইপ যেভাবে বিভিন্ন নারী চরিত্রের মধ্যে ধরা দেয়, তেমনই এই ডকু ফিকশনে নার্গিস হয়ে উঠেছেন বাংলা মায়ের আর্কিটাইপ। এই ছবিতে গান গেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, শচীনদেব বর্মন, নির্মলেন্দু চৌধুরী, সুবীর সেন, চন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়, দীলিপ কুমার, মান্না দে, পশুপতি ভট্টাচার্য। কলকাতা ও বোম্বের চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত জগতের কলাকুশলীরা  মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা-সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় যেসকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছিলেন, তার বেশ কিছু মুহূর্ত ধরা আছে এই ছবিতে। এই সেই ছবি যেখানে অভিনেতা দিলীপ কুমারকে দেখা গেছে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে গান গাইতে। এছাড়া এই ছবিতে দেখা গেছে হেমামালিনী ও সুনীল দত্তকে।

এই ডকু-ফিকশনে ভিস্যুয়াল মন্তাজের পাশাপাশি শব্দমন্তাজের প্রয়োগ দারুণভাবে প্রয়োগ হয়েছ। এমনকি ভিস্যুয়াল ও সাউন্ডের দ্বন্দ্বে অডিও-ভিস্যুয়াল মন্তাজের সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে দর্শককে পরিচয় করিয়েছেন ঋত্বিক।

এই ছবিতে চিত্রকর চিত্তপ্রসাদের আঁকা একাধিক ছবিকে দারুণভাবে ব্যবহার করেছেন ঋত্বিক। ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফির সফল দায়িত্ব পালন করেছেন আনন্দ গডনিস, সম্পাদনায় তরুণ দত্ত, শব্দ-গ্রহণে এস এম সুরাতওয়ালা। প্রযোজনায় অভিনেতা বিশ্বজিৎ। ছবির আখ্যান, পরিচালনা ও সঙ্গীত পরিচালনা স্বয়ং ঋত্বিক ঘটকের। ছবিটিতে ভয়েস ওভারে শোনা গেছে ঋত্বিকের কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি। যদিও এই ছবিটিকে পরে ইংরাজীতে ডাবিং করে ভারত সরকারের ফিল্ম ডিভিশন। এই ডাবিং ভার্সানটাই এখন দেখতে পাওয়া যায়। বাংলা ভাষায় নির্মিত ডাবিং ছাড়া মূল ছবিটির কোনো হদিস নেই।

রামকিঙ্কর বেইজ (১৯৭৫)

বাংলার প্রখ্যাত চিত্রকর, ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজের ওপর তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে শান্তিনিকেতনে টানা ৪ দিন শুটিং করেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। আরও কিছু শুটিং বাকি ছিল। কিন্তু ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি চিরতরে বিদায় নিলেন। তথ্যচিত্রটি অসম্পূর্ণ হয়ে থাকলো। পরে ঋত্বিক মেমোরিয়াল ট্রাস্টের পক্ষ থেকে ছবিটি সম্পূর্ণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। দৃশ্যায়িত ফুটেজ ও কিছু রেকর্ডেড সাউন্ড জোগাড় করে ছবিটিকে এডিট করা হয়, ঋত্বিক যেভাবে ছবিটিকে সাজাতে চেয়েছিলেন সেই ক্রমপরম্পরা মাথায় রেখেই। ঋত্বিকপুত্র ঋতবান ঘটক এই তথ্যচিত্রটি শেষ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৬ মিমি ক্যামেরায় এই তথ্যচিত্রটি ঋত্বিকের একমাত্র রঙিন ছবি।

আমরা সকলেই জানি রামকিঙ্করের চিত্রজগত এবং ভাস্কর্যগুলোর ক্ষেত্রে মূর্ত হয়ে উঠেছে ভূমিবাংলা ও বাংলার নিম্নবর্গের ভূমিসন্তানের জগত। সেই মতো এই তথ্যচিত্রে রামকিঙ্করের ভাস্কর্য ও চিত্রকলার পাশাপাশি শান্তিনিকেতন সংলগ্ন নিম্নবর্গের মানুষের (সাঁওতাল) যাপন, শান্তিনিকেতনের চারপাশের ভূমিমানুষের জগত এই ছবিতে উঁকি দিয়েছে।

ছবিতে রামকিঙ্করের ‘সাঁওতাল দম্পতি’, ‘মিল কল’, ‘সুজাতা’, ‘রবীন্দ্রনাথ, ‘গান্ধী’ ইত্যাদি ভাস্কর্যকে দেখানো হয়েছে ছবিতে। বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য প্রসঙ্গে ঋত্বিক আলাপ করেছেন রামকিঙ্করের সঙ্গে। যেমন, ঋত্বিক জিজ্ঞাসা করছেন রামকিঙ্করকে, ‘‘আপনি যখন রবীন্দ্রনাথের পোর্ট্রেট করছিলেন, তখন উনি আপনাকে কী বলেছিলেন শিল্প সম্পর্কে?’’ রামকিঙ্কর উত্তর দিচ্ছেন, “উনি প্রথমে দেখে নিলেন কোথাও লোক আছে কিনা। কারণ অনেক সময় ওনার সঙ্গে লোক থাকত তো, সেক্রেটারিরা থাকতেন। সেই জন্য সব দেখে নিলেন। আমি ওধারে, পোর্ট্রেট করছি ওঁর। উনি বসে বসে লিখছিলেন আর কী, তারপরই বললেন, দেখো, যখন কিছু দেখবে, বাঘের মতো ঘাড় মুচড়ে ধরবে। পিছনে আর তাকাবে না। এই হল শেষ কথা।’’

‘গান্ধী’ ভাস্কর্যটির ব্যাপারে ঋত্বিক আর রামকিঙ্করের আলাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই ছবিতে। তথ্যচিত্রটিতে দেখা যাচ্ছে বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘গান্ধী’র সামনে দাঁড়িয়ে আলাপ করছেন ঋত্বিক ও রামকিঙ্কর। সকলেই জানে, শান্তিনিকেতনের কলাভবনে গান্ধীর ভাস্কর্য নির্মাণ করতে গিয়ে তার পায়ের তলায় কিছু মানুষের মাথার খুলির ভাস্কর্য স্থাপন করেছিলেন রামকিঙ্কর। এই ব্যাপারে ঋত্বিক আর রামকিঙ্করের আলাপচারিতা এইরকম-

ঋত্বিক: আচ্ছা কিঙ্করদা, এই গান্ধিজীর পায়ের তলায় নরকঙ্কালের এই মুণ্ডুটা কী? মানেটা কী?
রামকিঙ্কর: ওটার মানে সহজ… যুগযুগান্ত ধরে ওই লোকগুলো পায়ের তলায় পড়ে আছে। আজকে এই বুড়োর পায়ের তলায় সেই স্কালটা দেখানো হয়েছে।
ঋত্বিক: (ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে) কাট ইট!

‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান’ (১৯৬৩)

ভারতের সঙ্গীত নাটক একাডেমির প্রযোজনায় ১৯৬৩ সালে বাংলা তথা উপমহাদেশের সঙ্গীত সাধক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁয়ের ওপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন ঋত্বিক ঘটিক। প্রায় ২৫ মিনিটের এই স্বল্পদৈর্ঘ্যের এই ফর্মাল প্রামাণ্যচিত্রে আলাউদ্দিন খাঁয়ের সুরজীবনকে চিত্রায়িত করা হয়। কিন্তু তথ্যচিত্রটিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করার ফলে এটির ভিস্যুয়ালের অবস্থা রুগ্ন। ইউটিউবে ছবিটিকে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু দৃশ্যত এই ছবিটি ভিস্যুয়াল আবছা হয়ে গেছে সংরক্ষণের ব্যাপারে ভারতের সঙ্গীত নাটক একাডেমির যত্নের অভাবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করা এই সঙ্গীত সাধকের ‘ওস্তাদ’ হয়ে ওঠার তথ্যবহুল আখ্যান রয়েছে এই ছবিতে। কীভাবে তিনি উজির খাঁর শিষ্যত্ব আদায় করেছিলেন কীভাবে তিনি নিজেই হয়ে উঠলেন ধ্রূপদী সঙ্গীতের ওস্তাদ এসব কিছুর তথ্যমূলক দৃশ্যশ্রাব্য প্রকাশিত হয়েছে এই ছবিতে। ভারতীয় ধ্রূপদী সঙ্গীতের এই বটবৃক্ষের ছায়ায় পরম যত্নে লালিত-পালিত হয়ে উপমহাদেশীয় ধ্রূপদী সঙ্গীতের শাখাগুলি পুষ্প-পল্লবে ভরিয়ে তোলা আলি আকবর খাঁ, অন্নপূর্ণা দেবী,  রবিশঙ্কর, তিমিরবরণ, বিষ্ণু দাস প্রমুখ বঙ্গসন্তানরাও উঁকি দিয়েছেন এই তথ্যচিত্রে। উপমহাদেশের, বিশেষত বৃহৎ বঙ্গের ধ্রূপদী সঙ্গীতের ভিত্তি যে এখানকার লোকজগত, লৌকিক সুরসম্ভার, এটা বুঝে নেওয়ার ব্যাপারে জন্য ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জীবন সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। যাত্রাপালা, পালাগান, কীর্তন এইসকল বিষয়ে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই তাঁর সঙ্গীত জীবনের সূচনা, আর তাঁর এই লৌকিক সুরযাপনের অভিজ্ঞতায় ভর করেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সুরের ওস্তাদ— এই বিষয়টির আভাস রয়েছে ঋত্বিক কুমার ঘটক নির্মিত এই ডকুমেন্টারি ফিল্মটিতে। ছবির একেবারে শেষে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সুরের যে অর্কেস্ট্রেশনের ধ্রুপদী সঙ্গীতের লোকায়ত শিকড়কে দারুণভাবে তুলে আনা হয়েছে। সুরের অর্কেস্ট্রেশনের পর ঋত্বিক ছবিটিকে শেষ করেছেন আজানের ধ্বনি ব্যবহার করে। প্রকৃতি (সুর) আর পুরুষ (সত্ত্বা) মিলেমিশে গায়েবি পরমের সন্ধান চালাতে দেখা গেছে ওস্তাদ আলাউদ্দিনের উপর নির্মিত এই তথ্যচিত্রতে।

এছাড়া ঋত্বিকের আরো কিছু ডকুমেন্টারি ফিল্ম, কিছু শর্টফিল্ম, বিজ্ঞাপনী ছবি আর পাওয়া যায় না। সবগু্লোই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে।

পড়ুন-

বৃহৎ বঙ্গের চলচ্চিত্রী ঋত্বিককুমার ঘটক

অতনু সিংহ
কবি, গদ্যকার, স্বাধীন চলচ্চিত্রকর্মী ও ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক।

Share