।। অতনু সিংহ ।।
গত ১১ মার্চ ঢাকার বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে ‘লেখার স্বাধীনতা’ শীর্ষক বঙ্গীয় সাহিত্য সভার আলোচনায় কবি ও চিন্তক এবং বড় বাংলার সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রতিপক্ষ’র প্রধান সম্পাদক ফরহাদ মজহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেছেন। ফরহাদ মজহারের ওই বক্তৃতাটির ইউটিউব লিঙ্কটি পেশ করার পাশাপাশি আরো প্রাসঙ্গিক কিছু আলাপ নোক্তা আকারে পেশ করা হচ্ছে যা ‘বড় বাংলার সাহিত্য’ ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত।
লেখার স্বাধীনতা ও বড় বাংলার সাহিত্য
ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একুশে বইমেলায় ‘আদর্শ’ প্রকাশনা’কে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয় নি। ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে ‘লেখার স্বাধীনতা’, ‘লেখা প্রকাশের স্বাধীনতা’, ‘লেখকের স্বাধীনতা’ ইত্যাদি বিষয়ে নানা স্তরে নতুন করে আলাপ-আলোচনা সামনে চলে এসেছে। সেই সূত্রে বাংলাদেশের ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সভা’ ‘লেখার স্বাধীনতা’ শীর্ষক আলোচনাচক্রের আয়োজন করে। প্রতিপক্ষ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ফরহাদ মজহার সেই সভায় হাজির হয়েছিলেন ‘আদর্শ’ প্রকাশনাকে বাংলা একাডেমির বইমেলায় অনুমতি না দেবার প্রতিবাদে। সেখানে ‘লেখার স্বাধীনতা’ বিষয়ে তাঁর বক্তৃতায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় তিনি তুলে ধরেছেন, যা ব্যাক্তি লেখকের সঙ্গে সমাজের সম্বন্ধ বিচারের পুরানো কিন্তু সার্বজনীন তর্কের অন্তর্গত। সেই তর্ক শুধুমাত্র বাংলাদেশের সাহিত্য, সমাজ, রাজনীতির গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বক্তৃতার সারকথা সাধারণ ভাবে লেখকের সঙ্গে তাঁর সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক বিচারের তর্ক। উপমহাদেশের সাহিত্য ভাবনার পর্যালোচনার দিক নির্দেশও ওর মধ্যে নিহিত।
‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার মূল স্লোগান ‘বড় বাংলার সাহিত্য’ – সাহিত্য সদা সর্বদাই ভাষা, সাহিত্য বা সংস্কৃতির রাজনৈতিক মানচিত্র ও সংকীর্ণ পরিচায়বাদকে অস্বীকার করে। ‘সাহিত্য’ অপরে ‘সহিত’ সম্বন্ধ রচনা করতে চায় — তাই ফরহাদ মজহারের বক্তৃতাটি বড় বাংলার লেখক ও পাঠকের কাছে এখানে আমরা হাজির করছি। এই লেখার নীচে লিংক দেখুন।
‘বড় বাংলা কোনো পরিচয়বাদী স্লোগান নয়’, ‘সাহিত্য মানে লিটারেচার নয়’, ‘মাতৃভাষা ও বহুভাষিকতা’, ‘বড় বাংলার রবীন্দ্রনাথ’, ‘সক্রেটিস কেন বই লিখলেন না’, ‘পঁচাত্তর বছরের সীমান্ত ও বড় বাংলা’, ‘এই বেলা তোর ঘরের খবর জেনে নে রে মন’, ‘প্রকৃতি প্রকৃতি সংসার, সৃষ্ট সবজনা’-সহ বিভিন্ন লেখায় আমরা রাজনৈতিক মানচিত্রের সঙ্গে সাহিত্যের দুনিয়ার ব্যবধান বোঝার চেষ্টা করে আসছি। এই সকল লেখা কোনোটা বা পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ফরহাদ মজহার স্বয়ং লিখেছেন, কখনও-বা তাঁরই অনুপ্রেরণায় এই পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে আমি লিখেছি, কোনোটা সম্পাদকীয় প্রতিবেদন হিসেবে সম্মিলিতভাবে লেখা হয়েছে। আমাদের সাহিত্য বিবেচনাকে সমাজ, সংস্কৃতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখি না। কিন্তু সাহিত্য কীভাবে সংকীর্ণ গহ্বর থেকে আমাদের টেনে বের করে আনে এবং অপরের সহিত সম্বন্ধ পাতানোর ক্ষেত্রে ঘটক হয় সেই অতিপরিচিত কথাগুলোই একালে আমরা ভুলে বসে আছি। পুরানা কথাই আমরা নতুন ভাবে আমরা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আমাদের শেকড় যদি কেউ সন্ধান করতে চান সেটা বড় বাংলার ভক্তি আন্দোলনের রসসাগরে, যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ প্রেমের সম্বন্ধ দ্বারা রসসিক্ত। কারন ‘অপর’-এর সঙ্গে আমরা যদি সাহিত্য বা সম্বন্ধ পাতাতে চাই তাহলে অকারণ ভালবাসাই সেই সম্বন্ধের ভিত্তি। প্রেমের ঠাকুর চৈতন্য থেকে এই সাদাকথাটুকু আমরা শিখেছি। যার ঝাণ্ডা এখনও বাংলার ফকির, বয়াতি, দরবেশ, সুফি ও বাংলার ভক্তি আন্দোলনের নানান ধারা বহন করে চলেছে।
বড় বাংলার ভৌগলিক পরিসর দ্বিরাষ্ট্রীয় বিভাজনে বিভক্ত। ভারত ও বাংলাদেশ, এই দুটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির মধ্যে ফারাক বিদ্যমান। সেই ইতিহাস, বলাবাহুল্য আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতকে অনেকাংশেই অভিমুখ দান করে। কিন্তু তারপরও ৪৭ পূর্ববর্তী সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের বাইরে কেউ নাই। ফলে বাংলা সাহিত্য নানাভাবে অতীতকে বহন করবে, এতে সন্দেহ নাই। অতীতের দিকে আমরা বারবারই ফিরে তাকাব বর্তমানকে পুরাপুরি বুঝে ওঠার দরকারে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিভাজন সত্ত্বেও ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ক্ষেত্রগুলো অন্বেষণ এবং সকল বাংলাভাষিদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়াকে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই কালে আমরা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে করি। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ভূরাজনৈতিক নতুন বিন্যাসের যে সম্ভাবনা ফুটে উঠছে তাকে আমলে নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে বোঝাপড়া, পরস্পরকে জানা এবং সম্ভাব্য মৈত্রীর জায়গাগুলো শক্তিশালী করবার আমরা পক্ষপাতী। সেই ক্ষেত্রে সাহিত্য অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমরা মনে করি।
পুঁজি দুনিয়াকে নতুন করে ভাগবাঁটোয়ারা করে নিচ্ছে, হয়তো-বা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন। বাজার ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন নয়, বরং ভেদবুদ্ধিকেই আরও তীক্ষ্ণ করে। নতুন বাস্তবতায় সাহিত্যের ভূমিকা কী হতে পারে সেটা নিছকই তাত্ত্বিক বাহাস নয়, রীতিমতো ব্যবহারিক প্রশ্ন। কংক্রিট ব্যবহারিক জিজ্ঞাসা আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। এ-সকল প্রেক্ষাপটে ‘বড় বাংলার সাহিত্য’ চিন্তাকে উপমহাদেশের বাংলা ভাষাভাষী গণমানুষের ইতিহাস, সমসাময়িক জীবনযাপন ও দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখতে চাই আমরা। সাংস্কৃতিক একাত্মতা ও সাংস্কৃতিক গণ-ঐক্য গড়ে তোলার মজবুত বাসনা আমাদের আছে। বৃহৎ বঙ্গের দার্শনিক পরম্পরার সঙ্গে বিশ্বের সকল অগ্রণী চিন্তার মেলবন্ধন ঘটাতে আমরা তৎপর রয়েছি। ‘বড় বাংলা’র মধ্যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বা বহুজাতীয় সাংস্কৃতিক পরিসর রয়েছে, তার মূলগত ঐক্য ও সম্বন্ধের জায়গাগুলো আমাদের কেন্দ্রীয় ভাবনার অংশ। সাহিত্য আমাদের কাছে পারিপার্শ্ব-বিচ্ছিন্ন কোনো বিমূর্ত নন্দনতাত্ত্বিক চর্চা নয়। বরং ‘সহিত’ শব্দটির সঙ্গেই সাহিত্যের সম্পর্ক। আমরা সম্বন্ধলিপ্সু এবং অপরের সঙ্গে সম্পর্ক রচনায় বিশ্বাসী। সেটাই আমরা লালন করি। ‘লেখার স্বাধীনতা’ বিষয়টিও ‘সহিত’ থেকে ‘সাহিত্য’ হওয়ার যে সামষ্টিক প্রক্রিয়া, তার সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ বড় বাংলার মানুষের সঙ্গে, প্রাণ-প্রকৃতি ও পরম্পরার সঙ্গে সম্বন্ধ গড়ে তোলাই আমাদের সাহিত্য বিবেচনা।
গত ১১ মার্চ, ২০২৩ তারিখে ফরহাদ মজহার যে বক্তৃতা পেশ করেছেন, তাতে তিনি ‘লেখার স্বাধীনতা’ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে স্পষ্টভাবে ‘বুর্জোয়া’ হয়ে ওঠার কথা বলেছেন এবং এই ‘বুর্জোয়া’ হয়ে ওঠার কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশে একাত্তরে মুক্তি সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের বুনিয়াদি চিন্তাকাঠামো, বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের মৌলিকচিন্তাগুলো থেকে সরে এসে যে সাংবিধানিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, সেসব প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েমের যে আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণায় ব্যক্ত হয়েছি সেই রক্তস্নাত সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাসনার দিকে তিনি ইঙ্গিত করছিলেন। বাংলাদেশ সেই বাসনা বা সামষ্টিক অভিপ্রায় বাস্তবায়িত করতে ব্যর্থ হয়েছে। পুরোনো প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক পেছনে ফেলে নিজেকে ‘বুর্জোয়া’ বা স্বাধীন ব্যক্তিসত্তা হিসাবে ভাবতে পারা বিশাল বিপ্লব বটে। সমাজ প্রতিষ্ঠার স্ট্রাগেলের মধ্যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব যে অতি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ সে কথাও তিনি স্মরণ করিয়েছেন।
কিন্তু ওই বক্তৃতাতেই ব্যক্তি যখন নিজেকে সমাজের বিপরীতে স্থাপন করে বা ‘সমাজ বিরোধী’ হয়ে ওঠে সেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী শিল্প ও সাহিত্যভাবনার বিরুদ্ধেও তিনি কথা বলেছেন। অর্থাৎ স্বাধীন ব্যক্তির বিকাশ যেমন জরুরি তেমনি সমাজের বিপরীত পেটি বুর্জোয়া শ্রেণির চরম আত্মস্বাতন্ত্রবাদী চিন্তা ও সাহিত্যচর্চারও তিনি কঠোর সমালোচনা করেছেন। ব্যক্তির স্ফুর্তি ও বিকাশ সমাজে, সামাজিকতার মধ্যে। তাই সম্বন্ধ বা ‘সাহিত্য’ চর্চাই ব্যাক্তি ও সমাজের দ্বন্দ্ব ও সম্বন্ধের জটিল দিকগুলো খোলাসা করে। সাহিত্য সমাজতত্ত্ব না হয়েও সমাজতত্ত্বের ভূমিকা পালন করে। সমাজকে সহজে সাহিত্য দিয়ে বোঝা যায়। নিজের ভাষা, দেশীয় পরিসর, সমষ্টির ইতিহাস, নিজ পরিসরের দার্শনিক পরম্পরার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পক্ষে তিনি সওয়াল করছেন।
বুর্জোয়া চিন্তার উন্মেষের সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রবাদ বুর্জোয়া চিন্তার চরম পরাকাষ্ঠা নয়। সমাজকে সামষ্টিক ভাবে বুঝতে না পারার অক্ষমতা এবং সাহিত্যকে ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রবাদী সাহিত্যে পর্যবসিত করা বুর্জোয়া শ্রেণীর কারবার না। সেটা পেটিবুর্জোয়া বা প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক ক্ষুদে উৎপাদকদের সংকীর্ণ স্বভাবের সঙ্গেই যুক্ত। তাছাড়া ইওরোপে শ্রেণিকাঠামো তৈরি হওয়ার ইতিহাস ও শিল্পবিপ্লবকেন্দ্রিক সমাজ-রাজনৈতিক ইতিহাসচর্চা আর বড় বাংলা তথা উপমহাদেশের সমাজবিবর্তনের ইতিহাস এক নয়। অতএব পাশ্চাত্যের শ্রেণী গঠন ও বাংলার শ্রেণীর শ্রেণী পরিগঠনও এক রকম নয়। তাদের ইতিহাস আলাদা। শ্রেণীর ধারণাও একরকম নয়। বড়বাংলায় ‘বুর্জোয়া’ একটি গালি, যা পেটি বুর্জোয়ার ধনী হবার আকাঙ্ক্ষাজাত ব্যর্থতা ও নিরাশা থেকে জন্ম নেওয়া নীচ-মানসিকতা।
বড়বাংলায় বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশ ঘটে নি, যেটা ঘটেছে সামন্ত ও ক্ষুদে উৎপাদকদের সংকীর্ণ স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত পেটিবুর্জোয়া মানসিকতা। ব্যক্তির বিকাশ পেটিবুর্জোয়ার চরিত্রে এসে থমকে গিয়েছে। যে কারণে ‘বুর্জোয়া’ বা ‘বুর্জোয়া শ্রেণি’-কে আমরা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বর্গ বলে গণ্য করি না। ‘বুর্জোয়া’ ধারণাকে অর্থনৈতিক বর্গ গণ্য করে ‘বুর্জোয়া’কে ধনি বা সম্পদশালী অর্থনৈতিক শ্রেণি বুঝি। ধনী ও সম্পদশালীদেরই আমরা ‘বুর্জোয়া’ বলে থাকি। তাই সমাজতন্ত্রকে অধিকাংশ সময়ই ধনীদের সম্পদ আত্মসাৎ করে নিজেদের মধ্যে বন্টন বুঝি আমরা অধিকাংশই। কিন্তু অর্থশালী হওয়ার মানেই বুর্জোয়া হওয়া নয়, অর্থ থাকলেই রাজনৈতিক শ্রেণিগত চরিত্র পেটিবুর্জোয়ার বলয় অতিক্রম করতে পারে না। যদি ঔপনিবেশিক আমলে বাংলায় বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশ ঘটত তাহলে সাতচল্লিশে দেশ ভাগ হত না । উনবিংশ শতাব্দির তথাকথিত নবজাগরণ পাশ্চাত্য শিক্ষিত ইংরেজের তাঁবেদার সামন্ত, উচ্চ বর্ণের হিন্দু ও পেটি বুর্জোয়া শ্রেণির ফসল। ঔপনিবেশিকতার ঔরসে যদি বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশ ঘটত তাহলে নিজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থেই বুর্জোয়া শ্রেণি বাংলা ‘ভাগ’ করত না।
এটাও বিশেষ ভাবে বোঝা দরকার যদি বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশই হত তাহলে কলকাতা বা পশ্চিম বাংলাও হিন্দুত্ববাদের ভিত্তি হয়ে উঠতে পারত না। এটা পরিষ্কার থাকা দরকার কলকাতায় গড়ে ওঠা বাংলা সাহিত্য হিন্দুত্ববাদের পীঠস্থান — এই ঐতিহাসিক সত্য এখন আরও স্পষ্ট হচ্ছে। কমিউনিস্ট ইশতেহারে মার্কস এবং এঙ্গেলস বুর্জোয়া শ্রেণী বলতে বুঝিয়েছেন যারা ‘ঐতিহাসিক ভাবে ‘খুবই বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেছে’। তাঁরা বলেছেন, “বুর্জোয়া শ্রেণি যেখানে প্রাধান্য পেয়েছে সেখানে সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক পিতৃতান্ত্রিক ও প্রকৃতি শোভন সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে। যে সব বিচিত্র সামন্ত বাঁধনে মানুষ বাঁধা ছিল তার স্বভাব সিদ্ধ ঊর্ধ্বতনদের কাছে, তা এরা ছিঁড়ে ফেলেছে নির্মমভাবে”। আমরা তা এখনও পারি নি। আমাদের পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর ঔপনিবেশিক হ্যাংওভারই কাটছে না, ‘বুর্জোয়া’ হওয়া তো দূরের কথা। বাংলা সাহিত্যে পেটি বুর্জোয়া সংকীর্ণ চিন্তার আধিপত্য ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণেই এখনও রয়েছে । যারা দাবি করেন, সাহিত্যে কোনো রাজনীতি বা তত্ত্ব বা বুদ্ধির উপাদান থাকবে না, তারা নিতান্তই পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীর সংকীর্ণ জগতে বসে এইসব কথা বল। বাংলা সাহিত্যের এই এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা। পেটিবুর্জোয়া কালপর্ব অতিশয় দীর্ঘ হবার কারণে এই ধরণের অন্তঃসারশূন্য কথাবার্তা শোনা যায়, যার কোনো তাত্ত্বিক কিম্বা ব্যবহারিক মূল্য নাই।
সাহিত্য যে কোনো বিষয় নিয়েই হতে পারে। ‘বুর্জোয়া’ মানে যে নিজের স্বাধীন ব্যক্তিসত্তাকে রাজনোতিক ভাবে উপলব্ধি করে। ফলে সাহিত্যে স্বাধীন ব্যক্তি কি লিখবে না লিখবে কিম্বা কিভাবে লিখবে বা লিখবে না সেটা একান্তই স্বাধীন লেখকের নিজের ব্যাপার। তর্ক হচ্ছে পেটিবুর্জোয়া যেভাবে নিজেকে সমাজের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে ভোগে, স্বাধীন ব্যক্তির কাছে সেটাই একমাত্র অবস্থা নয়। কারণ সমাজের সঙ্গে ব্যাক্তির সম্বন্ধ নির্ণয় যে সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটি ক্ষেত্র সেটা বুর্জোয়া চেতনা অর্জন করা ছাড়া উপলব্ধি করা অসম্ভব।
বহজাতিক ও বহুত্ববাদী বড় বাংলার বৈচিত্র্যের মধ্যে যে ভাষিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য রয়েছে, সেটিই আমাদের চিন্তা পরিকাঠমোয় জতিবাদি চিন্তার বিপরীতে বড় বাংলার সাহিত্য ও নন্দনতাত্ত্বিক পরিসর হয়ে উঠতে পারে। বড় বাংলা বলতে রাজনৈতিকভাব যুক্ত বাংলা গঠনের কোনো প্রস্তাব নয়। য়ামরা দিবাস্বপ্নে ভুগি না। যদিও শুধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিরিখে চিন্তা করলে ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পরিসর’ নির্মাণের ক্ষেত্রে আলাপ আরো বিস্তৃত ও গভীর হবে, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ও রাজনৈতিক আলাপের আরো গভীরে আমাদের যেতে হবে। কিছু বিষয় ফরহাদ মজহার তাঁর বক্তৃতায় ছুঁয়ে গেছেন, কিন্তু বড় বাংলার নিরিখে ‘জাতীয়’ সংস্কৃতি কোন জাতিবাদী প্রকল্প নয়, বরং বড় বাংলার সকলের সঙ্গে, বড় বাংলার গণমানুষের সকলের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ঐক্য তৈরির প্রস্তাব। নতুন সম্বন্ধ তৈরির সম্ভাবনা অন্বেষণ। বড়বাংলা কোন জাতিবাদী রোগে ভোগেনা, কিন্তু ভাষা হচ্ছে আমামদের আবাস, যার মধ্য দিয়ে আমাদের হৃদয়, বুদ্ধিসহ সকল বৃত্তি স্ফূর্তি লাভ করে।
‘সহিত’ থেকে ‘সাহিত্য’- এই চিন্তার মধ্যে প্রকৃতি, সমাজ, ইতিহাস, গণমানুষ ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পৃক্ত। এই প্রসঙ্গে গ্রীক দার্শনিকের বিখ্যাত পর্যবক্ষেণ-এর কথা ১১ মার্চের বক্তৃতায় ফরহাদ মজহার স্মরণ করিয়ে ছিলেন যে মানুষ আসলে ‘পলিটিক্যাল অ্যানিম্যাল’। অর্থাৎ অন্যান্য জীবকুলের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য যদি আমামদের নির্ণয় করতে হয় তাহলে সেটা কথা বলার ক্ষমতা। তাই মানুষ সামাজিক হতে পারে। মানুষ অপরের সঙ্গে সম্বন্ধ তৈরি করতে সক্ষম। আমরা পস্পরের সদঙ্গে আলাপ বা ডায়ালগে যেতে পারি। আর এই আলাপ বা ভাববিনিময়টাই আসলে রাজনৈতিক হয়ে ওঠা। এই ভাববিনিময় বা ডায়ালগ তৈরি করা, সম্পর্ক স্থাপন করার মধ্যে দিয়েই আমরা আমাদের ‘সাহিত্য’ রচনার বাসনা রাখি। আর তাই সাহিত্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বদলে সমষ্টির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনা তৈরি করে। এই সম্ভাবনাকে আমাদের চিন্তা ও চর্চায় জ্যান্ত রাখতে চাই আমরা। সমষ্টির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন লক্ষ্যেই আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐক্য ও সাহিত্য নির্মাণে রত হয়েছি। আর এই হতে পারাটা বা আমাদের ভাবপ্রকাশের ইচ্ছা ও উদ্যোগটাই আমাদের রাজনৈতিক অভিমুখটা ঠিক করে দেয়। আমাদের লেখার স্বাধীনতাকে নিশ্চয়তা দান করে।
কিন্তু এই সম্বন্ধ ও সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে আমাদের সামনে আজ বেশ কিছু বাধা উপস্থিত হয়েছে। যেগুলো ফরহাদ মজহার অনেকটাই উল্লেখ করেছেন তাঁর বক্তৃতায়। সেই প্রসঙ্গে আরও কিছু বলা প্রয়োজন। প্রথমত, ঔপনিবেশিক সময়কালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও তার মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বড় বাংলার মধ্যে যে বাবু সম্প্রদায়ের উত্থান ঘটিয়েছে, বৃহত্তর সমাজ ও রাজনৈতিক পরিসরক থেকে বাংলার গণমানুষ — বাঙালি মুসলমান, বাঙালি নমঃশূদ্র ও বাংলার নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠিগুলোকে পস্পর থেকে বিচ্ছিন করে দিয়েছে। ।এই সকল জনসমষ্টির পারম্পরিক জ্ঞান, ধর্মীয় বিশ্বাস, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে তারা খারিজ করতে চেয়েছে। বাংলা ভাষাকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মাধ্যমে সংস্কৃত ভাষার সন্তান হিসাবে দেখানো বা প্রমিতায়ন প্রকল্প আসলে বাংলা ভাষা থেকে বহু দেশীয় অনার্য শব্দ এবং আরবি-ফার্সি শব্দ বাদ দিয়ে তৎসম, তদ্ভব শব্দ আমাদের ভাষাকাঠামোর মধ্যে ঠেসে দেওয়া। এটি একটি পরিকল্পিত কার্যক্রম। ঔপনিবেশিকদের মাধ্যমে যে কলকাতা শহর গড়ে উঠেছিল, সেই শহর কালক্রমে বর্ণহিন্দু জমিদার ও বণিকদের দ্বারা বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষিক রাজনীতির পাওয়ার সেন্টার হয়ে উঠেছিল। আর তার দ্বারাই পাশ্চাত্ত্যের আধুনিকতাকে আমদানি করে ঔপনিবেশিক-পূর্ব সময়কার আমাদের ভাষিক, সাংস্কৃতিক , দার্শনিক ও পারম্পরিক জ্ঞানের ভাণ্ডারকে ধামাচাপা দেওয়া কাজটা ‘সুন্দরভাবে’ হয়েছিল। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বাংলার নিম্নবর্গের ভূমিমানুষদের ‘অপর’ করে দেওয়ার কাজটাও চলেছিল সুন্দরভাবেই ।
এর প্রতিক্রিয়াতেই এক সময় বাংলা ভেঙে দু’ভাগ হল! কিন্তু এই ঔপনিবেশিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম বাংলার সবপ্রান্তেই শিল্প-সাহিত্যের মধ্যে খুব প্রবলভাবেই সচল থেকেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সম্ভাবনা ছিল ঔপনিবেশিকতা ও বর্ণবাদী কালচারাল হেজিমনি থেকে মুক্ত হয়ে করে বাংলার ভূমিমানুষের ভাষা ও যাপনকে সাহিত্যের কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসা, বিশেষত স্বাধীন বাংলাদেশে। কিন্তু তা হয় নাই। বরং ঔপনিবেশিক মনন ও কলকাতার সাংস্কৃতিক প্রমিতায়নের হ্যাংওভার বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যেও আধিপত্য বিস্তার করেই রেখেছিল। এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে যারা কথা বলেছিলেন, তাঁদের ভাব ও বয়ান কিছুটা হলেও নব্বই দশক থেকে ঢাকায় প্রভাব ফেলতে থাকে। দ্বিতীয়ত, মুশকিলের আরেকটা জায়গা হল, কলকাতার সাংস্কৃতিক বর্ণবাদ ও ঔপনিবেশিক চিন্তাকাঠামোর বিরুদ্ধে কথা বলাটা ক্রমে হিন্দু জাতিবাদের পাল্টা মুসলিম জাতিবাদের বয়ানের সঙ্গে মিশে গেল কালক্রমে। সেক্যুলার চিন্তার সমান্তরালে সকল ধর্মচর্চার স্বাধীনতা ও ধর্মের পারম্পরিক সাংস্কৃতিক উপাদানকে বাংলার ভাবপরম্পরার নিরিখে সাহিত্য ও শিল্প পরিকাঠামোর কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসার বদলে ‘মুসলিম’কে জাতি হিসেবে কল্পনা করে মুসলিম জাতিবাদী শিল্প-সাহিত্য নির্মাণ স্রেফ ধর্মীয় পরিচয়বাদে পর্যবসিত হওয়া। ভাষিক, সাংস্কৃতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে ইসলামের মহিমা বর্ত্মান করে তোলা নয়। । আসলে কলকাতার ঔপনিবেশিক ও বর্ণবাদী সাংস্কৃতিক অবকাঠামো যেমন ঔপনিবেশিক-আধুনিক জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থার ফসল, তেমনই মুসলিম জাতিবাদী শিল্প-সাহিত্যের কল্পনাও ওই একই ব্যবস্থার বিপরীত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এক মূদ্রার দুই পিঠ।
বড়বাংলার সাহিত্য তাই জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থার আধুনিক সাহিত্য ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বাংলার ভাব, পারম্পরিক জ্ঞান, নিজস্ব দার্শনিক জগত ও আমাদের ধর্মবৈচিত্র্য থেকে উপাদান সংগ্রহ করে আজকের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের চিন্তাজগতকে সজীব করে তোলার একটি সামাজিক ও নন্দনতাত্ত্বিক প্রয়াস। নিজ সাহিত্য ও দর্শনের বিদ্যাঘরগুলোর ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে আসলে ভাষা ও সংস্কৃতি ক্রমশই শিকড় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আমরা তাই বড় বাংলার চিন্তার নূর সংগ্রহ করি বৌদ্ধ ধর্ম, শাক্ত-শৈব-বৈষ্ণব-সহ সকল অবৈদিক সনাতনী পারম্পরিক ধর্ম থেকে এবং অবশ্যই ইসলাম থেকে। আমাদের আলো দেয়, জ্ঞানচৌতিশা, নবীবংশ, নূরনামা, পদ্মাবতী, চণ্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত, বিদ্যাসুন্দর-সহ বাংলার যতেক স্বর্ণকাব্য। আমরা আল-কুরআনের আলো আমাদের ভাবনার ঘরে জ্বালিয়ে রাখি যেমন, তেমনই আমাদের ঘরে আলো-বাতাস হয়ে আসে সাংখ্য ও অচিন্ত্যভেদাভেদ। আমরা ভক্তিভাবে, মানুষ ভজনার সক্রিয়তার ভিতর দিয়ে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বর্তমানতার ভিতর, রাধাভাবে সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে প্রাণ-প্রকৃতি ও পরমের সম্মিলন ঘটাতে চাই। এই চাওয়ার মধ্যেই নির্ণিত হয় আমাদের রসবৃত্তির জগত,আমাদের কামনা ও আকাঙ্খাগুলি — আমাদের খাদ্যব্যবস্থা, কৃষির সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন সম্পর্ক- এসব কিছুর সঙ্গে আমাদের সাহিত্য-সক্রিয়তার সম্পর্ক সজীব রাখার কথা ভাবি। লেখার স্বাধীনতাকে আমরা শুধুই ব্যক্তি লেখকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী লেখার স্বাধীনতা হিসেবে দেখি না। বরং আমরা লেখার স্বাধীনতা বলতে বুঝি যে পরিসর আমাকে আমার কমিউনিকেশন বা ডায়ালগ দ্বারা পারিপার্শ্বের সঙ্গে সম্বন্ধ সজীব রাখতে দেয়, তাকে। পশ্চিমী লির্বাটি ও লিবারিলিজমের জায়গা বা দৃষ্টিকোণ থেকেও আমরা স্বাধীনতাকে দেখি না। বরং লিবারিলজিমের নামে পুঁজি যখন গণসমষ্টির ওপর খবরদারি করে আমরা তার বিপক্ষে দাঁড়াই। ফরহাদ মজহার তাঁর বক্তৃতায় মার্কস এবং লেনিন, এই দুজনের কথাই উত্থাপন করেছেন। আজকের বিশ্বব্যবস্থায় হাজির থেকে নিজের দেশীয় পরিসরে গণমানুষের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার শর্তগুলোর সঙ্গে যেসকল চিন্তা ও চর্চা গুরুত্বপূর্ণ, তার মধ্যে মার্কস-লেনিনের চিন্তাপ্রক্রিয়া বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পুঁজির লজিক, গতিপ্রকৃতি ও অভিমুখ বোঝার ক্ষেত্রে মার্কসের পর্যবেক্ষণ ও তার লেনিনবাদী ব্যাভার শাস্ত্র বিশেষ গুরুত্ব রাখে।
বড়বাংলার সাহিত্যের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের জনগণের মধ্যে বোঝাপড়া ও সাংস্কৃতিক গণ-ঐক্য অতিশয় জরুরি হয়ে পড়েছে। আগ্রাসী পুঁজি ও সকল প্রকার হেজিমনিকে রুখে দেওয়ার ক্ষেত্রে র ঐক্যই ভবিষ্যতে আমাদের পথ বাতলে দিতে পারে বলে মনে করি। কিন্তু তার আগে আমাদের পেটিবুর্জোয়া মানসিকতা থেকে বের হতে হবে। ফরহাদ ভাই যেমনটা বলছেন। কলকাতার বই ঢাকায় প্রবেশ করে ঢাকার মার্কেট দখল করে নিচ্ছে, তাই কলকাতার বইকে ঢ্কায় নিষিদ্ধ করা কিংবা এর পালটা কলকাতায় ঢাকাবিদ্বেষ ছড়ানোর মতো আকাম বড় বাংলার শহুরে পরিসরের লেখকদের পাতিবুর্জোয়া মানসিকতারই পরিচয়। ভূবনায়িত দুনিয়ায় এই ধরণের আলাপ ছড়ানো বাদ দিয়ে আমরা বরং বড় বাংলার বাংলা ভাষাভাষী লেখক ও চিন্তাজীবীরা, পস্পরকে বোঝার চেষ্টা করি, বুঝি। অতীতের ক্ষতগুলোর নিরাময় হোক। আমরা গণঐক্য গড়ে তোলার কাজে মন দিতে পারি, যেন আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি ও সেই আগ্রাসী পুঁঁজি দ্বারা তৈরি হওয়া জাতিবাদ যেন আমাদের গ্রাস করতে না পারে। পশ্চিমবঙ্গ হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি আধিপত্যের ফ্যাসিবাদী বাস্তবতায় এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের চোখ দিয়ে বাংলাকে বুঝতে চায়, এই চেষ্টা আত্মঘাতী। অতীতে ঐতিহাসিক অপকর্মের খেসারত দিতে গিয়ে এখন ছারখার হচ্ছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের বড়বাড়ন্ত। এই পরিস্থিতিকে অতিক্রম করার সাংস্কৃতিক গণঐক্য রাষ্ট্রীয় সীমানার ঊর্ধ্বে গিয়েই করা কায়েম করা দরকার। কেননা, পুঁজি ও পুঁজিকেন্দ্রিক ভূবনায়িত রাজনীতি ও শাসকশ্রেণীর মধ্যে কোনো সীমানা নাই। তাহলে বড় বাংলার গণচৈতন্যের মাঝেই বা সীমানা থাকবে কেন? বরং সেখানে থাকবে বৈচিত্র্য, স্বাতন্ত্র্য এবং বহুর মধ্যে একের উদ্ভাস। বাংলা ভাষা, বাংলার সংস্কৃতি ও বাংলার গণ্মানুষের জয় হোক।
এই প্রশ্নটুকু রেখে গেলাম। এবার আমরা মন দিয়ে শুনে নেবো ফরহাদ মজহারের বক্তব্য। নীচের ইউটিউব লিঙ্কটিতে ক্লিক করুন।