।। তাহমিদাল জামি ।।
পুরানা ধাঁচের লেখালেখি ও সাহিত্যের আমল-আদব মিমতন্ত্রে এসে বদলে যায়। দারুণ প্রতিভাদীপ্ত মিমও পুরানা শিল্পকর্মের জালালি মর্যাদা পায় না, বরং শিল্পকর্মের ধর্মভাবকে সে মামুলি করে তোলে। চিন্তা ও শিল্পকে রুহানিয়াতের গম্ভীরতা থেকে মিমতন্ত্র খোলসছাড়া ও উদোম করে। সিগনিফিকেশনের দেরি নিয়া মিমতন্ত্র যেহেতু আগ্রহী না, তাই সে ধরে নেয় যে সিগনিফায়ার বা পদ দিয়ে তাৎক্ষণিক অর্থ উৎপাদন করা যায়, ধরে নেয় যে তার অর্থসঞ্চারের বুঝদার দর্শকশ্রোতাপাঠক আগাম হাজির আছেন। মিমতান্ত্রিক চিন্তা হল মিম-সমাজের একটা আত্মকেন্দ্রিক রসোপলব্ধি। মিমতন্ত্র একরকমের রসিক নিজতন্ত্র। নিজকেন্দ্রিক চিন্তা। এবং যা অপরের তাকে ঘোষণা ছাড়াই অবলীলায় নিজের করে বাগিয়ে নিতে তার দ্বিধা নেই।
মিম হল সেই অনন্ত-মামুলিকরণের কলাপ্রকরণ যা এই মিডিয়াগ্রস্ত আবিশ্বে যেকোনও চিন্তাকেই তৎক্ষণাৎ স্যাটায়ারের বস্তু বানাতে আগাম-প্রস্তুত। যেকোন ভাব ও ভাবনারই অপর পিঠে হাজির তার অমোঘ স্যাটায়ার, এবং একালে ভাব ও তার স্যাটায়ারের মধ্যকার কালিক বিলম্ব কমে এসেছে। সমাজের আগত ও অনাগত কালচারাল ওয়ারে আপাতত মিমবাহিত স্যাটায়ার একটা প্রধান অস্ত্র।
স্যাটায়ারের গর-জালালি
সমাজে বিদ্যমান ভাবের সরস গীবতকে স্যাটায়ার বলে –- যে গীবত সমাজে হাজির সার্বভৌম ভাবের ফাঁকিঝুকি ধরিয়ে দেয়। স্যাটায়ার হল মিথ্যা ভাবের উন্মোচনের কলাপ্রকরণ, যেকোন ভাব-ধরা ভণ্ডামির গোমর ফাঁস।ভাবের ফাঁকিই স্যাটায়ারের বিষয়। অর্থাৎ কোন সত্তার ফর্ম ও কনটেন্টের অসঙ্গতি থাকলেই তাকে নিয়ে স্যাটায়ার হয়। কারো বাইরের সুরতের সাথে ভেতরের স্বরূপের গরমিল থাকলেই তাকে বিদ্রূপের লক্ষ্যবস্তু করা যায় – একথা বলে গেছেন জনাব হেগেল। “বাইরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট”, “বক ধার্মিক”, ‘বেড়াল তপস্বী’ ইত্যাদি ব্যঙ্গাত্মক বাগধারার মূল নজরটাই হল কারো বাইরের চেহারা ও ভেতরের জিনিসের মধ্যে কেমন বৈপরীত্য সেটা তুলে ধরা। শাদা বাংলায় বলি “ভাব দেখানো”, বা ‘ভাব ধরা’, তথা ‘ভেক’ বা ‘লেবাস’ ধরা। এই মেকি ভাব, ভেক বা লেবাসের উন্মোচনই বিদ্রূপের কাজ।
অন্যভাবে বলা যায়, ভুয়া জালালি ভাবকে মামুলি ভাবে পর্যবসিত করাই স্যাটায়ারের কাজ। স্যাটায়ার হল গর-জালালি আর্ট।
জালালি তথা সাবলাইম বলতে বোঝাচ্ছি, ভাব যখন স্বমহিমায় প্রবলভাবে হাজির হয়। সে যেন বা স্বয়ম্ভূ – নিজ মহিমায় ভাস্বর। বান্দার প্রতি কোন অপেক্ষতা তার নাই। উত্থিত শিশ্নের মতো সে অদম্য, অজর, শাশ্বত। যে ভাব এহেন সার্বভৌম চেহারা নিয়ে হাজির হয়, স্যাটায়ার তাকে কানে ধরে আপতিকতার কাদামাটি-জমিনে নামিয়ে আনে। যে পরমের ভেক ধরে, স্যাটায়ার তাকে আবিষ্কার করে ইতরপানা জীব হিসাবে। যেমন দেখা যায় নবারুণ ভট্টাচার্যের এই কবিতায়:
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ
এই মুলো, এই পাদ
সিপিএম-তৃণমূল লীলা
নীরবেতে কাজ সারে
দেখে যায় আড়ে আড়ে
জলে ডুব দিয়ে গডজিলা
সমাজে যখন যে ভাব সার্বভৌমের লেবাস ধরেছে, তাই স্যাটায়ারের গর-জালালি জবানের মুখে তছনছ হয়েছে —- আগে কিংবা পরে। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের অবসানের সূচনায় সারভান্তেস লিখেছিলেন ডন কুইক্সোট, যাতে নাইটদের তামাদি হওয়া শিভালরির আদর্শকে সবিস্তারে বিদ্রূপ করেছেন তিনি।
আমাদের দেশে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত ব্যঙ্গ করেছেন উদীয়মান বাবুদের, লালন ফকির বা কাজী নজরুল ইসলাম করেছেন মোল্লাতন্ত্রী ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের, মীর মশাররফ করেছেন জমিদার শ্রেণিকে, আবুল মনসুর আহমদ মোল্লা-পীর-রাজনীতিবিদদের, ফররুখ আহমদ আমলা ও অক্ষম হেজেমনদের, এম আর আখতার মুকুল করেছেন গণঘাতী পাকিস্তানি শাহীকে, আহমদ ছফা করেছেন শিক্ষক ও গোহাকিমদের, হুমায়ুন আজাদ করেছেন প্রথাবাদী ও মৌলবাদীদের, ব্রাত্য রাইসু করেছেন হালের মধ্যবিত্তকে, ব্লগারেরা করেছেন বিদ্যমান আঁতেল ও সেলিব্রিটিদের, গিয়াসউদ্দিন তাহেরি স্যাটায়ার করেন কট্টর অক্ষরবাদীদের।
শূন্য দশকের বাংলা ব্লগের স্যাটায়ার সংস্কৃতি বুঝতে একটা কবিতা উদ্ধৃত করি। সামু ব্লগে জনপ্রিয় হওয়া এই কবিতাটি ছিল জ্যোতির্ময় নন্দীর লেখা:
অই যে চশমাধারী, মারাত্মক সিরিয়াস
চেহারাসুরত, যেন সারা দীন-দুনিয়ার যাবতীয়
দায়ভার তারই বৃষ স্কন্ধে কেউ চাপিয়ে দিয়েছে;
যেন সে পটল তুললে দুনিয়া এতিম হয়ে যাবে।
কিন্তু অই চশমাধারী, মারাত্মক সিরিয়াস
চেহারাসুরত, জানে না যে ওর মতো কত শত
‘বালস্য বাল / হরিদাস পাল’ পৃথিবীর-প্রকৃতির
প্রগাঢ় প্রস্রাবের ফেনায় ভেসে গেছে…
লক্ষ্যবস্তুর মামুলিকরণ করতে গিয়ে স্যাটায়ার প্রায়ই তার শরীরী সত্তার উন্মোচন করে। জালালি ভাব প্রায়শ নিজেকে অমুজাসসিম বা কায়াতীত বলে দাবি করে বলেই বিদ্রূপ সেই জালালিকে শরীরী মামুলিতে পর্যবসিত করে, তার কায়িক সত্তার উন্মোচনের দ্বারা। মতিকণ্ঠের স্যাটায়ারে যেমন “লুঙ্গি খুলে আকাশে উড়িয়ে দেওয়া” একটা সুপ্রচলিত মেটাফর ছিল।
মানুষের শরীর একটা খোলা যন্ত্র। তাতে একদিকে খাদ্য-পানীয়-দৃশ্য-শব্দ ইত্যাদি ঢুকছে, আবার তার থেকে কর্ম-বজ্য-বায়ু-আওয়াজ ইত্যাদি নির্গত হচ্ছে। মানুষের দেহের এই দরোজাগুলো ও জগতের সাথে সেই দেহের লেনাদেনাগুলোর উন্মোচনের দ্বারা স্যাটায়ার মানুষের আপাত স্বাধীন সার্বভৌম কর্তাসত্তার গুমোর ফাঁস করে। উল্লেখ্য, সাধক ও সন্তরা যে দেহের দরোজাগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপনকে গুরুত্ব দিতেন, তা একটা সামন্ত সমাজে বা অধীনদশার মধ্যে মানুষের “সহজ” আত্মসত্তার পুনর্গঠনেরই অংশ হিসাবে দেখা যেতে পারে।
লক্ষ্যবস্তুর শারীরিক সত্তার উন্মোচনের পাশাপাশি প্রচলিত ভাষা ও আচারও স্যাটায়ারের আক্রমণের নিশানায় থাকে। যে রূপক রূপকায়িত পদার্থকে ধরতে পারে না, তাতে বান্দার মনে যে অশ্রদ্ধা জাগে, সেই অশ্রদ্ধাই স্যাটায়ারের জন্ম দেয়। তাই সমাজে রিচুয়ালি যে ভাষার আমল চলে, সেই ভাষা নিয়ে প্যারডি ও মিমিক্রি থাকে স্যাটায়ারে। হিপোক্রিসি অর্থাৎ কথায়-কাজে গরমিল যেমন মলিয়েরের তারতুফ টাইপের স্যাটায়ারের বিষয়। বাংলা সাহিত্যে যেমন পাওয়া যায় ভেকধারী বৈরাগী ও বৈষ্ণব চরিত্র, বা লেবাসধারী পীরের গল্প। লেবাসি কবিও আছে। ব্রাত্য রাইসুর ‘কবির দল’ কবিতায় বিদেশি মহিমার সান্নিধ্যপ্রত্যাশী কবিদের দেখা পাওয়া যায়:
দেখো বয়স্ক আর হাড্ডিশুখনা রামকবিদের দল
পরস্পরের পাখনা ধরে ঘোঁট পাকিয়ে পরস্পরে
রাজার ক্ষেতের পাড়ে
যেন উবে যাওয়ার আগমুহূর্তে
পায়ের পাতা শক্ত করল
মার্তৃগর্ভ ছেদন করল
তারপর তারা দাঁড়াল ভয়ঙ্কর।
যারা জায়গা পায় নি সামনাসামনি
রাজার চাইতে একটু বয়স কম
তারাও ক্ষেত ছাড়ে না
ক্ষেতের পাশেই একাডেমি
সেথায় সভার কাছেই
রাজার দিকে তাদের লম্বা হাত বাড়ানো
কাউয়া এসে বসেছে দীঘল হাতে—
তাদেরও আশা পূর্ণ হলো
রাজাটি যখন হাসিল উত্তরে।
আর ওই যে বাচ্চা কবির তরুণ ছবির করুণ দেখা পাওয়া—
তাও যাচ্ছে পাওয়া।
ওরাও, তেমন তরুণ যদিও নয়,
তবু বড় কবিদের লাগোয়া দল ওরা—
ওরা ছাপাই দঙ্গল—
ওরা নাতি কবি নাতনি কবি
আরো কবিদের সঙ্গে নিয়ে
ফুলের দণ্ডসম ওই তো ঝকমকাচ্ছে—
যেন ফুলের দলটি
কাকে দেবে আর কাকে দেবে না
নিজেদের ওরা ঠিক রাখতে পারছে না।
এরই মধ্যে
এদের মালিক যারা
ইন্ডিয়ারা
যেই,
বিমান থেকে নামিল ঢাকা ক্লাবে—
প্রথমে একজন পদ্মশ্রীই তো দৌড়ে গেলেন
তারপর গেল ফুলের দলটি
ততঃপরে মাঝারি কবি হেলতে দুলতে
বড় কবিরা রাজাটি সঙ্গে করে।
না, মহাভারত থেকে মোদীর সঙ্গে
পাইকার কোনো কবি আসে নি তাই
আপাতত তারা কুর্নিশিবেন ক্লাবে,
দেবেশ রায়ের দ্বারে।”
মিথ্যা মহিমা খর্ব করাই স্যাটায়ারের কাজ, যদিও এই কাজের পেছনে এই অনুমান নিহিত থাকতে পারে যে অন্য কোথাও আছে সত্য মহিমা। আবার নাও থাকতে পারে। স্যাটায়ারিস্ট একেবারেই সিনিকাল হতে পারেন, কিংবা হতে পারেন ডগমাটিক। কিন্তু যাই হন, স্যাটায়ারের ভেতর কাজ করে একধরনের নৈতিক প্রণোদনা: মিথ্যা মহিমার মুখোশ খোলার প্রণোদনা।
স্যাটায়ারের মামুলিকরণের লক্ষ্য হতে পারে আচারসর্বস্ব ধর্মতন্ত্র কিংবা রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিকতার নানা ভড়ং – যেমন শওকত ওসমানের বা আবুল মনসুর আহমদের স্যাটায়ার, আবার অন্য যেকোন পবিত্র গাভীও হতে পারে লক্ষ্যবস্তু, যেমন আহমদ ছফা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে লিখেছেন গাভী বিত্তান্ত। মোটকথা, যেকোন তন্ত্র যখন অন্তঃসারশূন্য হয়েও ভুয়া জালালির দাবি জারি রাখে, তখনই তাকে স্যাটায়ারের লক্ষ্য করা যায়। জীবনানন্দ দাশ যেমন স্যাটায়ার করেছিলেন সমালোচককে নিয়ে:
‘বরং নিজেই তুমি লেখোনাকো একটি কবিতা—’
বলিলাম ম্লান হেসে; ছায়াপিণ্ড দিলো না উত্তর;
বুঝিলাম সে তো কবি নয়— সে যে আরূঢ় ভণিতা:
পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের ’পর
ব’সে আছে সিংহাসনে— কবি নয়— অজর, অক্ষর
অধ্যাপক; দাঁত নেই— চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি;
বেতন হাজার টাকা মাসে— আর হাজার দেড়েক
পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি;
যদিও সে-সব কবি ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক
চেয়েছিলো— হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিলো লুটোপুটি।
জালালি রূপের প্রতীয়মানতা ভেঙে তার ভেতরের মামুলিয়ানা বের করাই স্যাটায়ারের কাজ। স্যাটায়ারে মামুলি ভাবের উন্মোচন প্রত্যক্ষ আগ্রাসনের দ্বারা নয় বরং তেরছা বচনের দ্বারা করা হয়। যেমন ‘বিলেত ফেরতা’ কবিতায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বাঙালি বাবুদের সাহেব সাজার প্রবণতাকে সোজাসুজি তিরস্কার না করে, বক্ররসে তার নকলামি ও ফাঁকিগুলো খুঁচিয়ে তুলে দেখিয়েছেন।
আমরা বিলেত ফেরতা ক’ভাই আমরা সাহেব সেজেছি সবাই।
তাই কি করি নাচার স্বদেশী আচার করিয়াছি সব জবাই।
আমরা বাংলা গিয়াছি ভুলি আমরা শিখেছি বিলিতি বুলি।
আমরা চাকরকে ডাকি বেয়াড়া… আর মুটেদের ডাকি কুলি।
রাম, কালিপদ, হরিচরণ নাম এসব সেকেলে ধরন
তাই নিজেদের সব ডে, রে ও মিটার করিয়াছি নামকরণ।
আমরা সাহেবের সঙ্গে পটি আমরা মিস্টার নামের রটি
যদি সাহেব না বলে বাবু কেহ বলে মনে মনে ভারী চটি।
আমরা ছেড়েছি টিকির আদর আমরা ছেড়েছি ধুতি ও চাদর
আমরা হ্যাট, বুট আর প্যান্ট কোট পড়ে সেজেছি বিলিতি বাঁদর।
আমরা বিলিতি ধরনে হাসি আমরা ফরাসি ধরনে কাশি
আমরা পা ফাঁক করে সিগারেট খেতে বড্ডই ভালোবাসি।
আমরা হাতে খেতে বড় ডড়াই আমরা স্ত্রীকে ছুরি কাটা ধরাই
আমরা মেয়েদের জুতো মোজা দিদিমাকে জ্যাকেট কামিজ পড়াই।
আমাদের সাহেবিয়ানার বাঁধা এইযে রংটা হয় না সাদা
তবু চেষ্টার ত্রুটি নেই ভিনোলিয়া মাখি রোজ গাদা গাদা।
আমরা বিলেত ফেরতা ক’টাই দেশে কংগ্রেস আদি ঘটাই
আমাদের সাহেব যদিও দেবতা তবু ঐ সাহেবগুলোই চটাই।
আমরা সাহেবি রকমে হাঁটি স্পীচ দেই ইংরিজি খাঁটি
কিন্তু বিপদেতে দেই বাঙালিরই মত চম্পট পরিপাটি।
একদিকে রূপ ও সত্যের অসঙ্গতি, আরেকদিক হল সেটাকে সোজাসুজি উপস্থাপন না করে তেরছা করে করতে হওয়া – এই দুই কারণে প্যারডি, ছদ্মনাম, বক্রনাম, নকল/মিমিক্রি ইত্যাদি ব্যঙ্গসাহিত্যে অতিপ্রচলিত। অর্থাৎ বাইরের রূপ যে আসল রূপ নয়, এবং আসল রূপ যে দৃশ্যমান নয়, এই অবস্থায় ভেতরের আসল রূপকে দৃশ্যমান করে তুলতে স্যাটায়ার নিজেই একরকম ত্যাড়াব্যাড়া রূপ সৃজন করে। তা হতে পারে কার্টুনচিত্রের বিচিত্র physiognomy, কিংবা প্যারডি বা মিমিক্রির বক্র নকল, কিংবা স্রেফ কাউকে একটা বিকৃত নাম দেওয়ার মধ্য দিয়ে তার “আসল” সত্তাকে উন্মোচন করার চেষ্টা। মতিকণ্ঠ যেমন বিরোধী মতাবলম্বী নানা ব্যক্তিকে নানা ব্যঙ্গাত্মক নাম দিয়ে হাস্যস্পদ বানানোর চেষ্টা করত, যথা আতা-সংবিধান বা আওলাদে মাও।
জালালিকে মামুলি করাটা একধরনের ক্যাস্ট্রেশন। দুনিয়ায় কেউ যে পরম পুরুষ নয়, কেউ যে প্রকৃত সার্বভৌম বা রব নয়, এই ক্যাস্ট্রেশনের বোধ যার আছে, স্যাটায়ারের সার্বভৌমবিরোধী বা জালালিবিরোধী বৈশিষ্ট্যের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতা থাকা সম্ভব। এক্ষেত্রে মোগল অটোক্র্যাটদের গল্পই জুতসই হবে:
কামগর খান বলে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের এক পাত্র ছিলেন। তিনি একদিন বাদশাহের কাছে এক নালিশ লিখে পাঠালেন।
নালিশে কামগর লিখলেন, মির্জা মুহম্মদ নিয়ামত খান নামক বদখত ব্যক্তি আমাকে নিয়ে কেবলই কবিতা লিখে চলেছেন। সেসব কবিতা পড়লে গা জ্বলে। এমনকি আমি যে বিয়ে করেছি, তা নিয়েও নিয়ামত সাহেব এক কবিতা লিখে বসেছেন। তাতে লিখেছেন, “লোকে বিয়েশাদি করে সাধারণত হালাল লাড়াচাড়ার (তেহরিকে জায়েজ) জন্য, কিন্তু এই ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে জোড়া বেঁধেছে দুই লুথা।” ঘরে-বাইরে এই স্যাটায়ার নিয়ে বিরাট বেইজ্জতির মুখে পড়ে গিয়েছি। অতএব হুজুরের কাছে আরজ এই সকল অপকর্ম বন্ধ করার জন্য নিয়ামত খানকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হোক। ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিষয়টি আপনাকে জানানো একান্ত জরুরি (ওয়াজিব) হয়ে গেছে।
সম্রাট আওরঙ্গজেব এই পত্র পড়ে, ‘ওয়াজিব হয়ে গেছে’ কথাটি কেটে তার উপর লিখলেন (এ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া) ‘হারাম হয়ে গেছে’। তারপর লিখলেন, ওহে সাদা-সিধা খানজাদা, এ নিয়ে যদি কথা বাড়াও তাইলে তোমার কেলেঙ্কারি কমবে তো না-ই, বরং বাড়বে। তুমি মনে হয় চাইতেছ যে নিয়ামত এখন তোমার পাশাপাশি আমারে নিয়াও লেখা শুরু করুক। দেখো, নিয়ামত আগেও আমারে নিয়া স্যাটায়ার কইরা কবিতা লিখছে। আমি তারে আরও সুযোগ-সুবিধা বাড়ায়া দিছি যেন আমারে নিয়া আর না লেখে। সে সুযোগ-সুবিধাও নিছে, কবিতা লেখাও থামায় নাই। স্যাটায়ার লিখতেছে বইলা তার জিহ্বা কাইটা, কল্লা ফালায়ে দেওয়া তো আর চলে না। অতএব আমাদের জ্বলুনি সয়ে যেতে হবে এবং এসব নিয়াই চলতে হবে। কবি বলেছেন, “বন্ধু হইল এমন যে না তোমারে ছাড়বে, না তোমারে ধরবে।”
দেখা যাচ্ছে, স্যাটায়ার – খুব বদখত স্যাটায়ারও – যথাসম্ভব সহ্য করা উচিত, এইটাই মোগল বাদশার মতামত ছিল। আমাদের যুগের শাহদের চেয়ে মোগল বাদশাহ অন্তত এই কাহিনীতে বেশি সহিষ্ণু বলে প্রতীয়মান।
উপরের আলাপ থেকে স্পষ্ট যে, স্যাটায়ার মূলত সমাজে জারি থাকা ক্ষমতার ভুয়া জবানের একটা অনিবার্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। স্যাটায়ার একপ্রকার বাসনার খেলাও বটে। যে ভাব পবিত্র হিসাবে নিজেকে হাজির করে, তার সেই ভাব-ধরার মধ্যে একধরনের আহবান বা সিডাকশন থাকে, অর্থাৎ মানুষ যেন তার ভাবচক্করে ভুলে গিয়ে তাকে মহৎ বলে মান্য করে। মহতের এই ভেকে-লেবাসে-চিহ্নের মোহে কেন ধরা পড়ে না স্যাটায়ারিস্ট? ভাবের চক্করে সিডিউসড হয় না সে। কারণ তার বাসনা বাঁধা আছে অন্য কোনখানে। পরমে তার রিদয় বাঁধা, তাই সামান্যে তার দিল টলে না। বিরাগ জাগে।
জার্মান আলেম হেগেল বলেছিলেন সমাজের বিকাশের একটা বিশেষ পর্যায়ে স্যাটায়ারের বিকাশ হয়। সেই পর্যায়টা কি? মানুষ যখন তার সামাজিক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় — তার অন্তরের আদর্শ মহৎ কিছুকে ধরতে চায়, অথচ বাইরের বাস্তবতায় পাওয়া যায় না মহৎ কিছুই — পাওয়া যায় শুধুই মামুলি, সীমাবদ্ধ সামান্য, ফ্যাসাদ আর নষ্টামি, তখন সেই অসুখি চৈতন্য আর কোন মূর্ত সুন্দরকে রূপ দিতে পারে না, বরং বিমূর্ত আদর্শকে না-পাওয়ার নেতি ও জ্বালা তাকে কায়েমি বাস্তবতার মুখর দুশমনে পরিণত করে। এই নেতিময় মুখরতা থেকেই জন্ম নেয় স্যাটায়ার।
সমাজে হাজির কোন বিধিবিধাননিয়মতন্ত্র যখন নিজেকে পবিত্র ও জালালি বলে দাবি করে, অথচ তার ভেতরে কোন আত্মিক ও মানবীয় শাঁস থাকে না, আমমানুষের প্রাণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তার যোগ থাকে না, তখন তার প্রোফেনেশন বা মামুলিকরণই স্যাটায়ারের কাজ।
হেগেল আরও অধিক গিয়েছেন। তাঁর মতে, স্যাটায়ারের বিকাশের সাথে রাষ্ট্রের বিকাশের সম্পর্ক গভীর। যখন মানুষ আত্মীয়তা-সম্পর্ক ও কৌম সমাজের নিবিড় বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, এবং রাষ্ট্র নামক নৈর্ব্যক্তিক আইনি কাঠামোর অধীন হয়, সেই নৈর্ব্যক্তিক-বিমূর্ত-অন্ধ-গদ্যময় আইনতন্ত্র মানুষের হৃদয়ের ভাষা ও রুহানিয়াতের সাথে সম্পর্কহীন এক পাথুরে বাস্তবতা ও নির্দয় নিগড় হিসাবে জারি থাকে। সেই আইনতন্ত্র এমন কোন মহৎ আদর্শ দিতে পারে না যার সাথে মানুষ একাত্ম হতে পারে। বাহ্য নিয়মের নিগড়ের সাথে অন্তরের আদর্শের এই বৈপরীত্য থেকেই মানুষ তিক্ত তাচ্ছিল্য ও কশাঘাতের ভাষা বেছে নেয়। এই কশাঘাতবাদী সাহিত্যই হল স্যাটায়ার। ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, মশকরা, ইত্যাদির মধ্য দিয়ে হাজির বাস্তবের তুচ্ছতা বিজ্ঞাপিত করাই স্যাটায়ারের কাজ।
সমাজ ও রাষ্ট্রের বিকাশের কোন জমানায় স্যাটায়ারের বিকাশ ঘটল? হেগেলের মতে রোমান সভ্যতাই প্রথম রাষ্ট্রকে একটা বিমূর্ত সর্বজনীন আইনতন্ত্র আকারে গঠন করেছে, যেখানে আইনতন্ত্র সামাজিক আদর্শ ছাপিয়ে এক গদ্যময় নিয়মের নিগড় আকারে হাজির, এবং নাগরিক সেই আইন মেনে চলতে বাধ্য।
হেগেলের এইসব ব্যাখ্যার সমস্যা গুরুতর। মানুষের এলিয়েনেশন কেবল রাষ্ট্রের উদয়ের সাথেই ঘটে না। হেগেলের চিন্তায় রাষ্ট্র যেমন কেন্দ্রে বসে থাকে, সেটা ইতিহাসের বহুত্বের বিস্মৃতি। তাছাড়া স্যাটায়ার কেবল রোমের মৌরসি পাট্টা না। ভারতীয় সভ্যতায় বা ইসলামি জাহানেও স্যাটায়ারের ফলন কম হয় নি। হেগেলের নন্দনতত্ত্বের ছাঁচে এসব সত্য আঁটানো যায় নি, ফলে তাঁর স্যাটায়ার বিষয়ক আলোচনা স্যাটায়ারের ধারণাকে নিপুণভাবে ধরতে সফল হলেও তার ইতিহাস নিয়ে খণ্ডিত বিবরণ হাজির করে।
রোমের বাইরে স্যাটায়ারের নমুনা বিস্তর। ভারতীয় সভ্যতায় জাতি-বর্ণপ্রথার নিষ্ঠুর নিগড় জন্ম দিয়েছে বহু তীক্ষ্ণজিভ ব্যঙ্গশিল্পীকে। কবীরের বীজকের কথাই ধরুন। তাতে ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরুষতন্ত্রের প্রতি আছে তীব্র কষাঘাত।
অন্যদিকে ইসলামি জাহানে মোল্লাতন্ত্র শরিয়তের ব্যাখ্যাকেই ধর্মের কেন্দ্রে স্থাপন করার কারণে রুহানি ও মানবীয় দিকটি উপেক্ষিত হওয়ার দরুন একের পর এক প্রতিভাবান কবি – যেমন শামসুদ্দীন হাফিজ – আচারসর্বস্ব সমাজকাঠামোকে ব্যঙ্গ করেছেন সরস স্যাটায়ারে। নাসিরুদ্দিন হোজ্জা বেইজ্জত করেছেন সমাজের নানা কায়েমি শক্তিকে।
আগের দিনে পুরান শহরগুলিতে মুহতাসিব বলে একপদের কর্মকর্তা থাকত। এদের কাজ ছিল হাটবাজার তদারকি করা এবং ঘুরে ঘুরে শহরে নীতিপুলিশি করা, মানে কোথায় কে নীতিবহির্ভূত আচরণ করতেছে তা নিয়ে খবরদারি করা। মাঝেমাঝে শহরের মদের আড্ডায় এরা ঢুকে পড়ে সব ভণ্ডুল করত। হাফিজ মুহতাসিবদের নিয়ে ট্রোল করে লিখেছেনঃ
শরাব আজি পুষ্পবিভোর, ছুটছে হাওয়া মাতোয়ালা
ধমকে উঠে বলছে তবু, “খাস নে রে মদ, আসছে ঠোলা।।
[আগরচে বদে ফারাহ বাখশ ওয়া বাদ গোলবিজ আস্ত
বে বং চাং মাখুর মেই কে মুহতাসিব তিজ আস্ত]
বাংলা ভাষায় লালন ফকির একজন গুরুত্বপূর্ণ স্যাটায়ারিস্ট, বিশেষ করে জাতপাত এবং বাহ্য আচারসর্বস্বতার প্রশ্নে।
স্যাটায়ারের যে গুরুত্বপূর্ণ দিক – বাহ্য ও অন্তরের বিচ্ছেদ তথা চিহ্ন ও তার মর্মের বিচ্ছেদ – এই ব্যাপার লালনের পদে ঘুরেফিরে হাজির হয়। লালন জাতপাত ও আচারের সমালোচনা করতে গিয়ে নানা হেজেমনিক চিহ্ন যে তার মর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অথবা কোন অর্থ উৎপাদন করতে পারে না, সেটা কষাঘাত সহকারে তুলে ধরেছেন।
সব লোকে কয় লালন কি জাত এ সংসারে।
লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলেম না এ নজরে।।
কেউ মালা কেউ তসবী গলে
তাই তো রে জাত ভিন্ন বলে
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়
জাতের চিহ্ন রয় কারে।।
ছুন্নত্ দিলে হয় মুসলমান
নারীর তবে কী হয় বিধান
বামন চিনি পৈতেয় প্রমাণ
বামনী চিনি কী প্রকারে।।
জগৎ বেড়ে জাতের কথা
লোকে গল্প করে যথা তথা
লালন বলে, জাতের ফাৎনা
ডুবিয়েছি সাধ বাজারে।।
স্যাটায়ার জালালি বা মহিমাকে আক্রমণ করে বলেই আক্রমণ করার আগে তাকে নিজ লক্ষ্যবস্তুকে আপাত-জালালি হিসাবে প্রতীয়মান করানো লাগে। যাকে জালালি, সার্বভৌম বা প্রাধান্যশীল বলে প্রতীয়মান করা যায় না তাকে নিয়ে স্যাটায়ারও জমে না। শনিবারের চিঠি বা মতিকন্ঠের লক্ষ্যবস্তু মূলত বড় বা উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বরাই বেশি ছিলেন। তবে ছোটদেরও যে লক্ষ্যবস্তু করা যায়, তার কারণ তাদেরও বড় হওয়ার, মহিমায়িত হওয়ার বাসনা আছে। বাচ্চাদের কথায় বা কাজে বড়রা হাসে কারণ তাতে আপাত-সিরিয়াস বা গুরুতর অর্থময়তার ফর্ম থাকে, কিন্তু কোন কনটেন্ট থাকে না —- তবে বাচ্চাদের নিয়ে বড়দের এই হাসি হয় স্নেহমিশ্রিত। অন্যদিকে সাধারণ মানুষকে নিয়ে রস করতে চাইলে অনেক সময় তাতে হাস্যরসের চেয়ে নিষ্ঠুরতাই ফুটে ওঠে।
নরমের যম
স্যাটায়ার মাত্রই কি তাইলে ভাল বা বিপ্লবী জিনিস? অন্তত মন্দের ভাল জিনিস? তা নয়। স্যাটায়ারের প্রাগমাটিক্স বা আমলবাদ একমাত্রিক নয়।
একালের চালু লিবারাল ভাষায়, স্যাটায়ারকে মোটাদাগে পাঞ্চিং আপ আর পাঞ্চিং ডাউনে ভাগ করার একটা চল আছে। পাঞ্চিং আপ মানে শক্তের যম, অর্থাৎ কায়েমি ক্ষমতাকে নিয়া বিদ্রূপ করা। আর পাঞ্চিং ডাউন মানে নরমের যম, অর্থাৎ ক্ষমতার তরফে ক্ষমতাহীনকে বিদ্রূপের বস্তু বানানো। মানে স্যাটায়ার ক্ষমতাপন্থী ও নিপীড়নবাদীও হতে পারে, আবার নিপীড়নবিরোধীও হতে পারে।
স্যাটায়ারকে অনিবার্যভাবেই প্রগতিশীল হিসাবে আগাম ধরে নেওয়া চলে না। গোপাল ভাঁড় বা বীরবল নিজ নিজ স্যাটায়ারের শক্তিতে রাজক্ষমতাকে প্রায়ই নিরস্ত্র করেছেন বটে, কিন্তু তাঁরা অন্তিমে দরবারি লোকই ছিলেন। যুগে যুগে স্যাটায়ারের আমলকারীদের অনেকেই ছিলেন অভিজাত বা উচ্চশ্রেণীর, কিংবা রক্ষণশীল মানুষ। অনেক স্যাটায়ারিস্টই বর্তমান জমানার প্রতি ব্যঙ্গ করেছেন অতীত আদর্শযুগের কল্পস্মৃতির সাপেক্ষে। অর্থাৎ সাবেকি যুগ, সত্যযুগ, স্বর্ণযুগ, সালাফ ইত্যাদির কথা মনে করেই অনেকে নিজের সমকালের দুশমনিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন। আমরা রোমের কালজয়ী স্যাটায়ারিস্ট জুভেনালের কথা বলতে পারি, যাঁর স্যাটায়ারস নামক কবিতাগুচ্ছই স্যাটায়ারকে আলাদা একটা সাহিত্যপ্রকরণ হিসাবে চিনিয়েছিল।
কেন তবে আমি সেই জমিনে আগাই,
যেখানে সদলবলে গিয়েছেন চলে আরুঙ্কার মহান লুসিলিয়াস?
বলব, যদি চুপ করে শোন তুমি আমার ব্যাখ্যান।
যখন হিজড়া লোকে বিয়ে করে সোমত্ত রমণী,
যখন মেভিয়া লড়ে তুসকানির শুয়োরের সাথে, মুক্তস্তন্য, হাতে হাতিয়ার,
যখন বেবাক অভিজাত থেকে অত্যন্ত অধিক সম্পদ রাখে সেই ব্যাটা,
যে কিনা কামাতে গিয়ে আমার গোঁফ-দাড়ি, দিয়েছিল বেমক্কা ব্যথা।
নীল নদ থেকে আসা ছোটলোক, ক্যানোপাস থেকে আসা গোলাম ক্রিস্পিনাস যবে
কাঁধে দিয়ে টাইরীয় জামাজোব্বা, গরমের সোনা বাঁধা আংটি পরে ঘামে ভেজা নিজের আঙুলে,
রত্ন পরার ভার বইতে যেহেতু ব্যাটা নিতান্ত অক্ষম।
তখন কেমন করে থাকব না লিখে স্যাটায়ার!
কে আছে সইতে পারে রোমের অধর্ম-অন্যায়!
এতই পাষাণ তারা কিছুতেই কাঁপে না পরাণ
মাথো উকিলের নব কুত্তার বাচ্চাটি যখন
গর্বমদমত্ত হয়ে আসে, পিছে সেই চর
যে কিনা লাগিয়েছিল বড়লোক বন্ধুকে খবর,
মরা কুলীনের লাশ থেকে যেন খসায় কিঞ্চিত? …
তখন কেমন ক্রোধ জ্বলে বন্ধু মোর কলিজায়!
যখন বাটপারের পাছে ধেয়ে চলে সহমত ভাইদের বিরাট দঙ্গল,
আদালতে দোষী বলে সাব্যস্ত হওয়ার পরেও,
কলঙ্কিত অনায়াসে ভোগ করে স্বধনসম্পদ! …
এইসব দেখে তবু লিখব না হোরেসের মতো?
লেখা কি জরুরি নয়? আর কি লিখব তবে? হারকুলিসি ফালতু কাহিনী?…
যখন ভাতার খায় গিন্নির প্রেমিকের টেকা
পরকীয়া রয়ে যায় আইনের ধরাছোঁয়াহীন। …
তখন আমার খাতা ভরে তুলব না?…
না থাক প্রতিভা, স্রেফ নৈতিক পেরেশানি থেকে
লিখে যাব পদ্যমালা, যেমন লেখেন ক্লুভেনিয়াস বা আমি।
জুভেনালের এই নৈতিক ওয়াজ ঠিক বিপ্লবী বা প্রগতিশীল কোন অনুভব থেকে পয়দা হয় নি। সমকালীন সমাজ যে অধর্ম ও অনাচারের পাপে ভরে উঠেছে, তা নিয়ে রক্ষণশীল, শ্রেণীবাদী, পুরুষতান্ত্রিক ও বর্ণবাদী অনুভবই তাঁকে তাড়িত করেছে। এই রক্ষণশীল অনুভবের গর্ভেই আদি স্যাটায়ারের পয়দায়েশ।
ভারতীয় সাহিত্যে ব্রাহ্মণরা জাতিভেদভিত্তিক ধর্ম ও রাষ্ট্র বিপন্ন হওয়ার কথা নিয়ে এভাবেই স্যাটায়ার জুড়তেন নিজ কাব্যে। যেমন মিথিলার ব্রাহ্মণ কবি বিদ্যাপতি সমাজের অনাচার নিয়ে লিখেছিলেনঃ
ঠাকুর ঠক ভএ গেল চোর চপ্পরি ঘর লিজ্ঝিঅ।।
দাস গোসাউনি গহিঅ ধম্ম গএ ধন্ধ নিমজ্জিঅ।।
খলে সজ্জন পরিভবিঅ কোই নহি হোই বিচারক।।
জাতি অজাতি বিবাহ অধম উত্তম কাঁ পারক।।
অখ্খর বুজ্ঝনিহার নহিঁ কইকুল ভমি ভিক্খারিভউঁ।।
তিরহুতি তিরোহিত সব্ব গুণে রা গণেস জবে সগগ গউঁ।।
অর্থাৎ রাজার মৃত্যুর পর মিথিলায় যে উপপ্লব উপস্থিত হল, সেই পরিস্থিতি নিয়ে বিদ্যাপতির খেদের অন্যতম কারণ হল জাতিভেদের বিনাশ। ভারতীয় সাহিত্যের উচ্চবর্ণের কবিরা এভাবেই যুগে-যুগে জাতিভেদের নিরাকরণকে অধর্ম-অনাচারের পরাকাষ্ঠা হিসাবে দেখিয়েছেন ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের রসে রঙিন করে। উপনিবেশের জমানায় উনিশ শতকের বাংলায় কলিকালের বাবু-বিবি নিয়ে যেসকল স্যাটায়ার প্রকাশিত হয়েছিল, তা প্রায়ই রক্ষণশীল সামাজিক মূল্যবোধ থেকেই উৎসারিত ছিল। ভবানীচরণের অমর-রচনা “নববাবুবিলাস” ও “নববিবিবিলাস” এক্ষেত্রে দ্রষ্টব্য।
ফলে স্যাটায়ার সমাজের বঞ্চিত-লাঞ্ছিত-নিপীড়িতের বিরুদ্ধেও দিব্যি কাজ করতে পারে, এবং হয়ে উঠতে পারে নিপীড়নের সপক্ষশক্তি। স্যাটায়ারকে লাগানো যায় বর্ণবাদী প্রচারণার কাজে। স্যাটায়ার হতে পারে নারীবিদ্বেষী, মুসলমানবিদ্বেষী, হিন্দুবিদ্বেষী, আদিবাসীবিদ্বেষী — মোটকথা যেকোন রকম বিদ্বেষই খাওয়াতে চেষ্টা করতে পারে স্যাটায়ার।
স্যাটায়ারের মধ্য দিয়ে নন-কমিটাল ভাবে, স্রেফ হিন্ট বা ইঙ্গিত আকারে নিপীড়নবাদী আইডিয়া পুশ করা যায়। বাংলাদেশে যেমন মতিকণ্ঠ স্যাটায়ার দিয়েই কর্তৃত্ববাদের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করত। সাম্প্রতিক সময়ে একদিকে সাংস্কৃতিক ডানপন্থীরা এবং অন্যদিকে অথোরিটারিয়ান লিবারালেরা স্যাটায়ার দিয়েই রাষ্ট্র করছে নিজেদের কর্তৃত্ববাদী ধ্যানধারণা। একদিকে যেমন কর্তৃত্ববাদ, শোষণমূলক আখেরি পুঁজিবাদ ইত্যাদি নিয়ে শিল্পীরা স্যাটায়ার করছেন, বিপরীতে সমানতালে চলছে নিপীড়নের পক্ষে স্যাটায়ার।
সুবিধাভোগী ও ক্ষমতাবান শ্রেণী ও গোষ্ঠী কেন করে স্যাটায়ার? ভাষার দ্বারা কশাঘাত করার কি দরকার, যখন তারা চামড়ার চাবুক দিয়েই কশাঘাত করতে পারে মজলুমকে? ক্ষমতাবানেরা স্যাটায়ার করে তখনই, যখন কোনও বিমূর্ত আইনতন্ত্রের উপস্থিতির দরুন ক্ষমতাবানেরা মজলুমকে সরাসরি আঘাত করতে পারে না। অগ্রসর লিবারাল পুঁজিবাদী সমাজে পোশাকি সামা ও স্বাধীনতা (ফর্মাল ফ্রিডম এন্ড ইকুয়ালিটি) জারি থাকে। বুর্জোয়া হেজেমনির দুনিয়ায় মানবাধিকার, গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার ইত্যাদি আইনি আনুষ্ঠানিকতায় বড়লোকদের পাশাপাশি গরিব- শ্রমিক-অভিবাসী-অপরাধী-নারী-সংখ্যালঘু ইত্যাদি বর্গও কমবেশি হক্কদার। অথচ মার্কস যাকে সিভিল সোসাইটি বলেন, সেই বাস্তব সমাজে এই সকল প্রান্তিক বর্গ হয় বঞ্চিত, নিপীড়িত, শোষিত। আধুনিক ভারতে জাতপাত রাষ্ট্রীয় আইনে স্বীকৃত নয়, কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশের আইনে আছে সব নাগরিকের সমান অধিকার। কিন্তু আইনে যা কিছুই থাক, সমাজের নিত্যদিনের বাস্তবতায় অসাম্য ও বেইনসাফ সর্বময় জারি আছে।
আইনি অধিকার বনাম বাস্তব বঞ্চনার এই বৈপরীত্যের মধ্যেই নিপীড়নবাদী স্যাটায়ার সৃষ্টির শর্ত হাজির। বিদ্যমান অন্তঃসারশূন্য ব্যবস্থা বা তন্ত্রকে মামুলি করে স্যাটায়ার, কিন্তু বিদ্যমান আখেরি বুর্জোয়া সমাজের ক্ষমতাতন্ত্রের নিজের ভেতরেই এমন দ্বন্দ্ব নিরন্তর উৎপাদিত হয়, যে সেখানে কায়েমি ব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভকে কায়েমি স্বার্থের পক্ষেই আত্মসাৎ করা যায়। যেকোন ফ্যাসিবাদের জনপ্রিয়তার উৎস এই গণক্ষোভের আত্মসাৎকরণ।
একালের পশ্চিমে ডানপন্থী স্যাটায়ারের অন্যতম মূল লক্ষ্য হল অভিবাসী, জাতিগত-ধর্মীয়-লিঙ্গীয় সংখ্যালঘু, ইত্যাদি গোষ্ঠী যাদেরকে বুর্জোয়া গণতন্ত্রে মানবাধিকারের হক্কদার বলে স্বীকার করা হয়, কিন্তু উগ্রডানেরা যাদের নিশ্চিহ্ন বা নিদেনপক্ষে পদানত করতে পারলেই সুখি হতো।
তেমনি বাংলাদেশে ডানপন্থী স্যাটায়ারের লক্ষ্য মূলত নারী/নারীবাদী, সেকুলার, বাম, হিন্দু, আদিবাসী ইত্যাদি বর্গ। সমাজে চলমান তথাকথিত সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে স্যাটায়ার একটা প্রধান হাতিয়ার হিসাবে আছে। উদাহরণ দিইঃ এককালে এটিম ইত্যাদি যেমন “ছাগু” ও “রাজাকার” শব্দটা দিয়ে যাকে তাকে প্রতিপক্ষ হিসাবে দাগাত, তেমনি এখন ডানপন্থীরা “শাহবাগী” বর্গটাকে অনন্ত প্রসারণের দ্বারা যেকোন সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ভিন্নমতকে দাগিয়ে তার বিরুদ্ধে বিদ্রূপ ও ঘৃণা শাণাচ্ছে।
কিংবা ধরা যাক “বাঙ্গু” ক্যাটেগরিটা। কেউ এই শব্দটা ব্যবহার করেন বাঙালি প্রাধান্যশীল সংস্কৃতির খুঁত ধরে আত্মসমালোচনা করতে, কিন্তু একইসঙ্গে অনেক ডানপন্থী স্যাটায়ারিস্ট ‘বাঙ্গু’ শব্দটার প্রয়োগের দ্বারা বাঙালি জনগোষ্ঠীকে হীন, অক্ষম ও হাস্যস্পদ বলে চিহ্নিত করতে চান। সেটা তখন সামাজিক আত্মসমালোচনার বদলে জনসাধারণের প্রতি ঘেন্না ও অবজ্ঞা উস্কানোর পন্থা হয়ে ওঠে।
স্যাটায়ারের মধ্য দিয়ে হিংসামূলক প্রোপাগান্ডা করার সুবিধা হচ্ছে আপনার plausible deniability থাকে। আপনি কারো উপর নিপীড়ন করার জন্য বা কারো অধিকার হরণ করার জন্য হাস্যরস বা বি্দ্রূপের আড়ালে ইশারা দেবেন ঠিকই, কিন্তু আবার অস্বীকার করে বলতে পারবেন যে “আমি কি ওইটা বলছি নাকি?” কিংবা “আরে ওইটা তো জোক ছিল, স্যাটায়ার ছিল”। তাছাড়া স্যাটায়ারমূলক প্রোপাগান্ডাকে হাহা-রিয়েক্ট দিয়ে বা হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ সেই হাহা নিজেই তখন স্যাটায়ারের কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া হিসাবে আত্মসাৎ হয়ে যেতে পারে।
ক্ষমতা একদিকে যেমন নিপীড়নবাদী স্যাটায়ার চালু করে, একইসঙ্গে প্রতিপক্ষের স্যাটায়ার দমন করার জন্য সে নিজেই মজলুমের বেশ ধরে হাজির হয়। ঘৃণাবাদী জবান থেকে সমাজে দুর্বল নিজের সুরক্ষা চাইতে পারে, কিন্তু দেখা যায় যে ক্ষমতাবানেরাই মজলুমের আসন দখল করে সুরক্ষার দাবিদার হয়ে বসে, এবং দণ্ডিত করে নিপীড়নবিরোধী স্যাটায়ার রচয়িতাকে। কার্টুন শিল্প যে প্রায় লুপ্ত হয়ে গেল, তার কারণ ক্ষমতাবানেরা মানহানি বা আহত-অনুভূতির দায়ে কার্টুনিস্টদের নিপীড়ন করার চর্চা জারি করেছে। রাষ্ট্রতন্ত্র, মোল্লাতন্ত্র থেকে শুরু করে যেকোন সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী, যার নিজেকে মজলুম হিসাবে হাজির করার প্রিভিলেজ আছে, তার পক্ষেই এভাবে অন্যের ব্যঙ্গ ও সমালোচনা করার স্বাধীনতা হরণের জন্য চাপ প্রয়োগ করা সহজ।
ফ্যাসিস্ট স্যাটায়ার, দমনপীড়ন-আগ্রাসনের সাথে যোগসাজশেই চর্চিত হয়। স্যাটায়ার নিজে গায়েগতরে আগ্রাসন করে না, কারণ আগ্রাসন ও সহিংসতা বীররস বা করুণরস সৃষ্টি করে। শরীর যখন আক্রান্ত হয়, তখন শরীরের নশ্বরতার উন্মোচন পাঠক বা দর্শকের সহমর্মিতা জাগাতে পারে। স্যাটায়ার সহিংসতার ক্ষেত্র রচনা করতে পারে, কিন্তু বলপ্রয়োগ যখন শুরু হয়, তখন স্যাটায়ারকে হাত গুটিয়ে নিতে হয়, কিংবা তার আগের সেই বিস্ফোরক শক্তি আর থাকে না। তবে এমন স্যাটায়ারও আছে যা শারীরিক নিপীড়নের শিকারকেও বিদ্রূপের লক্ষ্যবস্তু বানায়। আমাদের দেশে প্রতিপক্ষকে ডিমথেরাপি দেওয়ার আহবান এরকম নির্দয় স্যাটায়ার। হেফাজতে নির্যাতন যে একটা নিষ্ঠুর অমানবিক ব্যাপার তা এই স্যাটায়ারের আমলকারীদের কাছে পাত্তা পায় না। অর্থাৎ স্যাটায়ার নিজে সহিংসতায় লিপ্ত না হলেও সহিংসতার নিষ্ঠুরতাকে সরস ও গ্রহণযোগ্য চেহারায় উপস্থাপন করতে স্যাটায়ার কাজে আসতে পারে। মজলুমের প্রতি সহমর্মিতা জাগানোর জন্য মজলুমকে নিজের স্বজাতি বলে মানতে হয়। ফ্যাসিস্ট স্যাটায়ার সেই স্বজাতিবোধকে বিনষ্ট করে।
বোঝা যাচ্ছে যে স্যাটায়ার ভাল ও মন্দ দুইই হতে পারে। শক্ত বা নরম যে কারোই যম হতে পারে৷ জালিম বা মজলুম উভয়ের পক্ষে দাঁড়াতে পারে। ফলে স্যাটায়ারের হিতাহিত নিয়ে বিবেচনা বহুমাত্রিক। বাংলাদেশের শাহবাগ-হেফাজত ইত্যাদি সাংস্কৃতিক বিভেদ ও দ্বন্দ্ব গভীর করার ক্ষেত্রে ডিজিটাল পরিসরে সংবাহিত স্যাটায়ার নিঃসন্দেহে একটা বড় অস্ত্র ছিল এবং আছে।
মতিকণ্ঠ-এটিম-সিপিগ্যাং ইত্যাদির ব্লগকেন্দ্রিক স্যাটায়ারের পরের জমানায় পিনাকী ভট্টাচার্য, ফাহাম আবদুস সালামের ভিডিওমাধ্যমনির্ভর রাজনৈতিক স্যাটায়ার এবং নব্যডান-নওপুংতান্ত্রিক নানা গোষ্ঠীর সোশাল মিডিয়াকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক স্যাটায়ারের গভীর আছর পড়ছে রাজনৈতিক সমাজে। ভাবের ফাঁক ও ফাঁকি যেমন ক্রমনির্মীয়মাণ, তেমন স্যাটায়ারও। সবচেয়ে গুরুতর কথা হল, বর্তমানের নিরাকরণ করতে গিয়ে, ভাবের ফাঁকি খুঁচিয়ে বের করতে গিয়ে স্যাটায়ার নিজেও সৃষ্টি করে নতুন নতুন ফাঁকির শর্ত।
ইলেক্ট্রেট জমানায় বিদ্রূপ
স্যাটায়ারের চিরকালের হাতিয়ার ছিল মিমিক্রি। ধরুন জাক দেরিদা বা জিল দল্যুজের ন্যায় প্রফেনেশনের দার্শনিকদের লেখায় ইনডিরেক্ট ডিসকোর্স বা পরতরফি জবানের যে আধিক্য, তাও হতে পারত স্যাটায়ার, কিন্তু হয় নি। বঙ্কিমের বাক্য যেমন ঋজু, তাই তাঁর স্যাটায়ার লেখার হাত ভাল হলেও উপদেশ দিতে বসলে গুরুগম্ভীর মাস্টারসুলভ হয়। অন্যদিকে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথের তেরছা বাক্য সবসময়ই পরোক্ষ জবানের ভেতর দিয়ে নিজ জবান বের করে আনে, ফলে তার মধ্যে একপ্রকার আধা-স্যাটায়ারি চরিত্র থাকে প্রায়শ, যদিও রবি অন্তিমে ইতিবাচক ব্রহ্মবাদী বলে জ্বালা ও খোঁচা সীমিত হয়। মামুলি পাঠক হিসাবে আমার এমনই মনে হয়।
মিমিক্রির পথ বেয়ে একালে স্যাটায়ারের প্রধান এক বাহন হল মিম। মিম হল এমন ডিজিটাল ছবি বা অণুচলচ্চিত্র, যা বিশেষ কোন ঘটনাকে বিদ্রূপের বিষয় করে এবং অনেকটা বেনামা-উড়োচিঠির মতো রচয়িতার নামপরিচয় ছাড়াই ডিজিটাল পরিসরে সঞ্চালিত হয়।
প্রাগাধুনিক যুগে শিল্পী তৈরি করতেন শিল্প। অন্যে তার নকল করলে, সেই নকল হতো আসলের চেয়ে কমদরের ও হেয়। আর্টের তখন ছিল ইনডেক্সিকাল বা হাজিরাবাদী বনেদিয়ানা বা aura। পেইন্টিং বা ভাস্কর্য এক ও অদ্বিতীয় হাজিরা হিশাবে হাজির থাকত দর্শকের সামনে। ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের মতে, উনিশ-বিশ শতকে আলোকচিত্র ও চলচ্চিত্র আসার পরে শিল্প হয়ে ওঠে কলের নকলের (technological reproducibility) বস্তু। কলের নকল এসে আসল ও নকলের ভেদ মুছে দেয়।
বেঞ্জামিনের যুগ পেরিয়ে অতঃপর এই ডিজিটাল যুগে এসে শিল্পের আদি কপি বলে আর কিছু হয় না। ডিজিটাল শিল্প কোনও নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট কাঁচামালে বা ক্যানভাসে তৈরি হয় না। বরং তা নিজের জন্মমুহূর্ত থেকেই আবিশ্ব ডিজিটাল পরিসরে হাজির এক বিশ্ব-কপি। ডিজিটাল শিল্প মানেই বিশ্ব-নকল এক শিল্প। মিম হল এহেন ডিজিটাল শিল্পের একটা মোক্ষম নমুনা। মিমকে বলা যায় আসলহীন নকলের অনন্ত মোক্ষণ। বা আসলহীন অনন্ত বাজেনকল, যা ডিজিটাল অতিকলে সংবাহিত হয়।
মিম মূলত চিন্তার সবচেয়ে ডিরেক্ট, সরাসরি রূপ। কোনও মধ্যস্থতা ছাড়াই সে যেন চিন্তা সংবহন করে। মিমে নিহিত সংকেতগুলা সাধারণত মিডিয়ায় হাজির কোনও ঘটনা থেকে নেওয়া। সেই ঘটনা জানা থাকলে লোকে দেখামাত্র মিমের সংকেতের অর্থ বুঝে ফেলেন। এবং হাসেন, উথলান।
মিমে চিন্তা সরাসরি সাকার, শরীরী হয়ে হাজির হয়। চিন্তার এই অমধ্যস্থিত রূপটা ঠিক জ্ঞানের ব্যাপার না। রসের (এফেক্টিভিটি) ব্যাপার। মিমগত চিন্তায়, জ্ঞানগত দিককে টপকিয়ে তার রসগত দিক আমাদের শরীরী সত্তাকে সংক্রামিত করে। আমরা উথলাই।
মিমের এই শরীরী, সাকার তাৎক্ষণিকতায় গভীর ও দ্বান্দ্বিক চিন্তার নড়াচড়া নাই। মিমগত চিন্তা ব্যক্তি সাবজেক্টকে অন্য ব্যক্তিদের মানসের সাথে সরাসরি নিউরালি যুক্ত করে যেন। একটা মিম-সমাজ মূলত একটা আন্তঃব্যক্তিক নিউরাল নেটওয়ার্ক বা স্নায়ু-জালের মতো করে কাজ করে। মিমের রসগত সংক্রামকতাকে বায়োলজি বা সাংস্কৃতিক ট্রান্সমিশনের বাঁধাধরা ডিটারমিনিস্টিক যুক্তি দিয়ে হয়তো বোঝা ঠিক হবে না। কারণ যেকোন মিম-সমাজ একটা চির-অস্থিতিশীল সম্পর্কপ্রক্রিয়া। মিমমূলক চিন্তা যেসকল সমাগম (এসেম্বলেজ) তৈরি করে, সেগুলা কোন স্থিরনিদিষ্ট গোষ্ঠী হিসাবে বিরাজ করে না। মিমের কোন শাশ্বত মা-বাপ নেই। মিম এতিম। ঠিকানাহীন, বেওয়ারিশ। ভাষায় সিগনিফিকেশন বা অর্থবাচকতায় যে দেরি, যে ভেদবাদ, মিম তাকে অস্বীকারে আগ্রহী। মিমগত চিন্তা অনেকটা অনর্থবাদী চিন্তা (এ-সিগনিফায়িং)।
ফলে, পুরানা ধাঁচের লেখালেখি ও সাহিত্যের আমল-আদব মিমতন্ত্রে এসে বদলে যায়। দারুণ প্রতিভাদীপ্ত মিমও পুরানা শিল্পকর্মের জালালি মর্যাদা পায় না, বরং শিল্পকর্মের ধর্মভাবকে সে মামুলি করে তোলে। চিন্তা ও শিল্পকে রুহানিয়াতের গম্ভীরতা থেকে মিমতন্ত্র খোলসছাড়া ও উদোম করে। সিগনিফিকেশনের দেরি নিয়া মিমতন্ত্র যেহেতু আগ্রহী না, তাই সে ধরে নেয় যে সিগনিফায়ার বা পদ দিয়ে তাৎক্ষণিক অর্থ উৎপাদন করা যায়, ধরে নেয় যে তার অর্থসঞ্চারের বুঝদার দর্শকশ্রোতাপাঠক আগাম হাজির আছেন। মিমতান্ত্রিক চিন্তা হল মিম-সমাজের একটা আত্মকেন্দ্রিক রসোপলব্ধি। মিমতন্ত্র একরকমের রসিক নিজতন্ত্র। নিজকেন্দ্রিক চিন্তা। এবং যা অপরের তাকে ঘোষণা ছাড়াই অবলীলায় নিজের করে বাগিয়ে নিতে তার দ্বিধা নেই।
মিম হল সেই অনন্ত-মামুলিকরণের কলাপ্রকরণ যা এই মিডিয়াগ্রস্ত আবিশ্বে যেকোনও চিন্তাকেই তৎক্ষণাৎ স্যাটায়ারের বস্তু বানাতে আগাম-প্রস্তুত। যেকোন ভাব ও ভাবনারই অপর পিঠে হাজির তার অমোঘ স্যাটায়ার, এবং একালে ভাব ও তার স্যাটায়ারের মধ্যকার কালিক বিলম্ব কমে এসেছে। সমাজের আগত ও অনাগত কালচারাল ওয়ারে আপাতত মিমবাহিত স্যাটায়ার একটা প্রধান অস্ত্র।
তারপর? ইউটিউব-ফেসবুকে রোদ্দুর রায় বা হিরো আলম বা সালমান মুক্তাদির বা সেফুদাকে ছাপিয়ে টিকটক-লাইকি-রিলসের জমানায় অডিওভিজুয়াল মাধ্যমের ডিজিটাল সর্বজনীনতা সম্ভবত স্যাটায়ারের দুনিয়ায় নতুন এক পর্যায়ের সূচনা করতে চলেছে, যেখানে মানুষ গোটা বিশ্বের সামনে নিজের শরীর দিয়েই রচনা করবে নানারকম বিস্ফোরক স্যাটায়ার। সমাজে ভাবের ফাঁকির নানাপ্রকার নৈতিক উন্মোচনকে আরও প্রত্যক্ষ, আরও সর্বব্যাপী করে তুলবে এই নতুন জমানা। দেখা যাক, কোথাকার রস কোথায় গিয়ে ঠেকে।
তাহমিদাল জামি
লেখক-গবেষক এবং বেঙ্গল হিস্টরি কালেক্টিভের সমন্বয়ক, ঢাকা, বাংলাদেশ।
Durdanto rochona