।। জ্যোতি পোদ্দার ।।
মিশ্রবনের ধ্বংসের যুগে কে আর প্রাচীনতার খবর রাখে! বনবাসী, বন আর বনের লতা গুল্ম বৃক্ষের সম্পর্ক অভেদের সম্পর্ক। একা কিংবা বিচ্ছিন্ন কোনো সম্পর্ক নয়। এখন চারদিকে একই প্রজাতির গাছ— ‘টাকাবৃক্ষ’। আজ লাগাও কাল সুদে আসলে নিয়ে নাও। শালবন এখন আড়তের দোকান। বনসত্তা আর প্রাণবান সত্তা নয়। ভোগ্যক্ষেত্র— নগদের বাজার। কেন তোমার মনে নেই এই তো সেদিন কাগজে খবরে বেরিয়েছে “শেরপুরে শাল ও গজারি বনে জ্বলছে আগুন উজাড় হচ্ছে গাছ।” নিয়ত ধর্ষিত হচ্ছে গোরো হিলস। আগুন লাগছে। তারপরই উড়ে এসে জুড়ে বসে বিদেশি গাছ। আজম সে-কারণেই ডুব দেয় সোনা রঙে কাজ করা অতীতের এমব্রয়ডারিতে।
এইখানে একদিন হরিণ ছিলেন
কানের লতির মতো বাঁকানো পথের দুই পাশে ধ্যানমগ্ন শাল গজারি। মাংসল বুক ফুলিয়ে আছে সটান শিরদাঁড়া। ঘাড় কাৎ করেই তবে শালের মাথা দেখা যাবে— তার আগে নয়। আরেকটু বড় হলেই বুঝি শাল আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে। আলোর বিচ্ছরণে শালের হলুদ পাতা আর ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া সবুজ পাতার ভেতর রোদের হল্লা এক্কা দোক্কা খেলার মাঝেই খুব নীরবে খুব সর্ন্তপণে উড়তে উড়তে ঝরে পড়ছে হাওয়ার সাথে নাচতে নাচতে বয়সী শালের পাতা।
শালের পাতা মাড়িয়ে শেষ বৈশাখের রোদ মাথায় নিয়ে আমি আর আজম হাঁটছিলাম; একটু দ্রুত পায়েই হাঁটছিলাম— রোদের তাপ ও চাপকে তোয়াক্কা না করেই। সবুজ আলোর ঝলকানিতে হাঁটার গতি অবারিত সবুজ ঘাসের পরিসর আমাদের আটকে দিল পথ। বাঁকানো পিচ রাস্তা আর সবুজের সমাবেশে রোদের ভেতর স্থির দাঁড়িয়ে পড়লাম শালের মতো।
তোমাকে আমাদের সঙ্গী হতে বলেছিলাম। জল জঙ্গলে দলভারি করেই যেতে হয়। তোমার আবার ভিন্ন মত। উল্টো পথের জগত তোমার— এন্টি ক্লকওয়াইজ। দলেভারি দলে জটলা বাড়ে। নির্জনতা ক্ষুণ্ণ হয়। তোমার এই মনোভঙ্গি আমি বিনা প্রশ্নেই মেনে নিযেছি। নিজেকে নিজের মতো করে নিজের ভেতর যে ঢুকতে চায় তার দরকার ধ্যানস্থ মন। স্তব্ধ জলের পাশে তোমার বসে থাকা দেখেছি। দেখেছি জঙ্গলের ভেতর এমন ভাবে হাঁটছ বা দাঁড়িয়ে আছো যেন তুমিই শাল অথবা সারি সারি শাল মাটির গভীরে শেকড় গুঁজে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছো তুমি। তোমার এই অনন্যতার জন্য কখনো জোর করি না। তোমাকে রেখেই তাই চলে এলাম জল জমি জঙ্গলে।
এবার দল বলতে দুইজন— আমি আর আজম। তাতেও আপত্তি করাতে একটু অভিমান হয়েছে বৈকি। আজকে যে শালবনে আমরা ছিলাম— সেখানে তোমার থাকা দরকার ছিল। মনে মনে তোমাকে পাশে চেয়েছি। সবুজ আলোর ঝলকানি গায়ে মেখে ধ্যানস্থ হবার দারুণ একটা প্লেস ছিল। কিছু কিছু স্থান নিজেকে উপুড় করে ঢেলে দেয়— অসহ্য এক মায়া ও মায়াবী বলয় গড়ে তুলে। তেমনই ছিল এই শাল বন।
নিজেকে ছাড়া অন্য একজনও তোমার কাছে বাহুল্য। গলায় কাঁটা ফুঁড়লে যেমন অস্বস্তি; তেমন তুমি ভেতরে ভেতরে ছটপট ছটপট করে।অথচ তার কোন প্রতিফলন তোমার শারীরিক ভাষ্যে থাকে না। সেটি বুঝি। কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছি। সবুজ আলোর ছটায় যখন পিচ রাস্তার তাপে আমি আর আজম দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম তখনও তোমাকে কী ভীষণ তৃষ্ণার মতো মনে পড়েছে তার আর লিখে বোঝাবার নয়।তৃষ্ণতার রেশ এখন বুকের ভেতর তড়পাচ্ছে যে না লিখে তাই পারলাম না।
এটাও অজানা নয় তুমি আবার নিদিষ্ট দিন ছাড়া ইমেল চেকও করো না। আজকে লিখেছি বলেই আজকে পড়বে— তার কোনো ঠিক নেই। মন চাইছিল আজকেই তুমি লেখাটা পড়। অথচ কী অদ্ভূত চিঠি পড়বার দিনও তুমি ঠিক করে রেখেছো!নাম দিয়েছো মোলাকাত বার। প্রতি সোমবার তোমার মোলাকাত বার। সে-দিন ইমেল ওপেন করো; দাও প্রতিউত্তর–যদিও সে উত্তর দৈর্ঘ্যে প্রস্থে আড়াই লাইন। খুব যত্নে একে একে খুলো ক্যুরিয়ারে পাঠানো পার্সেলের মোড়ক। এমন কী সারা সপ্তাহের বাসি দৈনিকগুলো সারাদিন পড়ো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। মোলাকাত দিন বটে! বাইরের সাথে যুক্ত হবার সংকীর্ণ করিডোর।
গত শতকের নয়ের দশকের শুরুর দিকে যখন এখানে প্রথম আসি তখন সীমান্ত পথ হয়নি। এখন পুরো উত্তর জনপদ কালো বেল্টের মতো বেধে রেখেছে পিচরাস্তা এপাশ থেকে ওপাশ। মাঝে মাঝে বকলেসের মতো ছোট বড় ব্রিজ। সে সময়ে নদী পরাবারে ডিঙি নৌকায় পার হয়েই এই দিকে আসতে হতো। ছিল কাঁচারাস্তা-এঁলেটমাটির পথ মাড়িয়ে কালাকুমা তল্লাটের ক্ষেতের ধান বোঝাই গরু বা মহিষের গাড়ি করে নালিতাবাড়িতে ধান নিয়ে যেত এই অঞ্চলের কৃষকেরা।
মঙ্গলবারে বড় হাট আর শুক্রে ছোট হাটে গমগম করত ধানের বাজার। উমাচরণ কর্মকারের নামাঙ্কিত বড় পাল্লা পাথর ঝুলিয়ে পাশের গদিতে বসতেন বড় বড় আড়তদার। ধানের পাহাড় গড়ে উঠত তখন। ছোট ছোট কৃষকেরা গরু মহিষের গাড়ি বোঝাই করে আনত ক্ষেতের পাকা ধান। সেই সময় সুমন্তের সাথে এখানে প্রথম আসি আমি। সুমন্তকে চিনেছো তো? সুমন্ত বর্মণ। আমার বন্ধু। ছাত্র ইউনিয়ন করত। সিঁধুলি গ্রামের ছেলে। দেশ উদ্ধারে নেমে আর নিজের আর পরীক্ষার বৈতরণী পাড় হতে পারল না। ওদের গোয়ালে তখন তাগড়া তাগড়া মহিষ আর গরুর পাল। তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছে সদ্য বিয়ানো বাছুর। উঠান ভরা ধানের ঢিপি। সারা বছরের গরুর খাবারের জন্য খড়ের পাল্লা উঁচু করে বাঁধা।
জানো, সুমন্তের জন্য মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়।নানা কায়কারবারে বাথানে একটাও মহিষ থাকল না। দায় দেনায় পড়ে কখনো গৃহশিক্ষকতা কখনো নানা এনজিওয়ের মাঠকর্মী হিসেবে কাটিয়ে দিলেন জীবন।সে যাক তার কথা আরেকদিন বলব। একদমে অনেকটুকু বলে ফেলেছি। একটু চা টা খেয়ে নেই। আজকাল কালোজিরে চায়ে অভ্যাস্ত হয়ে গেছি। কালোজিরাতে তোমার আপত্তি— আমি জানি। আসছে সোমবারে তোমার ফ্লাটে এলে জিরে চা তৈরি করে খাওয়াব তোমাকে।
গরম জলে একটু বেশি সিদ্ধ হলেই কালোজিরা তেতো হয়ে ওঠে। আবার কম সিদ্ধ হলে শুধু কালো জিরাই থাকে। স্বাদ আর জিভে লাগে না। যে কাম্য অবস্থায় কালোজিরা উষ্ণ হয়ে তেজি হয়ে উঠে সেই মাত্রা জ্ঞান আমার আছে বলে তুমি যে মনে মনে মুচকি হাসবে সেটি পরিস্কার।
এখন যেখানে পিচ রাস্তার বাঁক নিয়ে সোজা বৈশাখি বাজারের দিকে গেছে সেখানে সে সময় ছিল লাল রঙের ধুলি উড়ানোর রাস্তা।নয়াবিল দিয়ে ভোগাই পাড় হয়ে সাইকেলে এসেছিলাম আমি আর সুমান্ত। এক দুপুরের পথ ছিল।
এখন তো সহজেই ইজি বাইকে আসা যাওয়া করা যায়। রাস্তাঘাট হয়েছে। ব্রিজ হয়েছে।শুধু খণ্ডিত হয়েছে শাল গজারির সংসার। শালের উঠানে এখন বিদেশি গাছের উপনিবেশ। আর দখলের রাজত্ব। আজমের সাথে এই নিয়ে টুকিটাকি গল্প করতে করতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। হঠাৎ দেখি উল্টো দিক থেকে জোসেফ’দা আসছে। তাকে দেখেই মনটা আনন্দে নেচে উঠল। জোসেফ’দার গল্পে মদ ও মাদকতা আছে। নেশা ধরে যায়।
জোসেফ’দা মানে জোসেফ সাংমা। বহুদিনের আলাপ পরিচয়। বয়সের ভাবে একটু ঝুঁকে পড়লেও দুলকি চালে হাঁটার ভঙ্গিটা আগের মতোই আছে। বেলা দশটাতেই মধ্য দুপুরের তাপে কিছুটা ঘেমে গেছেন তিনি। তিনি যখন হাঁটেন যেন তাল লয় মাত্রা নিয়েই হাঁটেন। এক স্কেলে হাঁটেন—রোদ থাক কিংবা ছায়া অথবা বৃষ্টি।
দেখেই মুচকি হাসিতে জড়িয়ে ধরলেন। অনেকদিন পরে দেখা হলে যেমন আত্মীয়ের মুখে ঔজ্জ্বল ধরে তেমনি তিনি হাসলেন। তাঁর হাসার ধরনটাই এমন। যখন হাসেন পান খাওয়া রঙিন দন্ত বিকশিত করেই হাসেন; তামাটে বর্ণের মুখে তখন সহস্রবলি রেখার ভাঁজ পড়ে। মান্দি মুখের সারল্য এখানেই—মনের ভেতরে সবটুকু মুখশ্রীতে ফুটে ওঠে।
সত্তর পেরিয়ে গেছে। চুলে কাঁচার চেয়ে পাকারই বিস্তার বেশি।শেষবার যখন এসেছিলাম তখন চোখে চশমা ছিল না। কালো মোটা ফ্রেমে এখন জোসেফ সাংমাকে দারুণ লাগছে। গোল মতো ভরাট তামাটে মুখশ্রী। হাঁটতে হাঁটতে চার্চের পাশে খোলা একটা চায়ের দোকানে গিয়ে আমরা বসি। গাহেক খুব একটা নেই।
চায়ের শেষ চুমুক দেবার আগেই আমাদের আলোচনা বহুদিকে ছড়িযে পড়ল। আজমের সাথেও ইতোমধ্যে আলাপের বিস্তার ঘটে গেছে;সবে পরিচয়ের কোন লেশমাত্র নেই—না জোসেফ’দার না আজমের।আজম জল জঙ্গলের পাগল। ঢাকার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য পড়ান। কবিতা অন্তপ্রাণ মানুষ। যখনই ছুটিছাটায় শেরপুরে আসেন গারো হিলিসে তিনি আসবেনই। যত জঙ্গলের বিস্তার তত ওর আবিষ্টতা তত মন্ত্রমুগ্ধতা নিয়ে মিশে যান প্রাণ ও প্রকৃতিতে।
শুনে অবাক হবে আজম যে জঙ্গলেই যাক না কেন নিমিষে পঞ্চাশ ষাট একশ বছর আগে চলে যায় কল্পনায়।গলা ভারি হয়ে ওঠে ওর।শরীর দুই হাজার বাইশে থাকলেও ও মন নিয়ে চলে গেছে ১৯২২ সালের গারো হিলসে;কিংবা তারও আগে। শুধু বৃক্ষরাজি কিংবা লতাগল্ম নিয়ে যে জঙ্গল সে জঙ্গলের চেয়ে আজমের ভাবনায় থাকে জঙ্গলে বেড়ানো নানা প্রাণীদের নিয়ে যে জঙ্গলের পরিসর সেই জঙ্গলে আজম বুঁদ হয়ে থাকে। কল্পনায়। আকাঙ্খায়। জোসেফ’দার সাথে আলাপচারিতাতেও একই কথা উঠেছিল। কেমন ছিল পঞ্চাশ ষাট বছর আগের গারো হিলস? জোসেফ’দা খুব আস্তে স্মিত হেসে বললেন,’ঘন অন্ধকার বন।’
মিশ্রবনের ধ্বংসের যুগে কে আর প্রাচীনতার খবর রাখে! বনবাসী,বন আর বনের লতা গুল্ম বৃক্ষের সম্পর্ক অভেদের সম্পর্ক। একা কিংবা বিচ্ছিন্ন কোনো সম্পর্ক নয়। এখন চারদিকে একই প্রজাতির গাছ—’টাকাবৃক্ষ’। আজ লাগাও কাল সুদে আসলে নিয়ে নাও। শালবন এখন আড়তের দোকান। বনসত্তা আর প্রাণবান সত্তা নয়।ভোগ্যক্ষেত্র— নগদের বাজার। কেন তোমার মনে নেই এই তো সেদিন কাগজে খবরে বেরিয়েছে “শেরপুরে শাল ও গজারি বনে জ্বলছে আগুন উজাড় হচ্ছে গাছ।” নিয়ত ধর্ষিত হচ্ছে গোরো হিলস। আগুন লাগছে। তারপরই উড়ে এসে জুড়ে বসে বিদেশি গাছ। আজম সে-কারণেই ডুব দেয় সোনা রঙে কাজ করা অতীতের এমব্রয়ডারিতে।
শুধু কী গাছ পুড়ছে? উচ্ছেদ হচ্ছে বনবাসি। পুড়ছে বনলতা বনফুল গুল্ম শিশুচারা কীটপতঙ্গ আর পাখিদের পাড়া আর হাতির পাল নিজভূমি হারিয়ে ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ-হাতিও। একে অপরকে দায়ি করার পাকচক্রে বিপন্ন গারো হিলসের প্রাণ ও প্রকৃতি।
জোসেফ’দাকে থামিয়ে গত শতকের গোড়ার দিকে প্রকাশিত বইয়ের পৃষ্ঠা বের করে গড়গড় করে পড়তে শুরু করলাম। আজমকে পঞ্চাশ বছর আগের কোনো আড্ডাতে তো আর নেয়া যাবে না বরং শত বছরের আগের পানিহাটার জল জমি জঙ্গল কেমন ছিল তা শুনিয়ে দিলাম। তুমিও একটু কান পাতো তোমাকে শুনিয়ে দেই। শুধু তোমাকে না সকলকে ডেকে ডেকে শুনিয়ে দিতে খুব ইচ্ছা করে।আজম শুনছে। জোসেফ’দা চশমা টেবিলে রেখে থুতনিতে হাত রেখে চোখ বন্ধ করলেন।
“এই অসমতল গ্রামের উত্তর প্রান্তে ঘন বন আর সমাকীর্ণ উচ্চ পাহাড়, এখানে সেখানে ছোট বড় টিলা, মাঝে মাঝে উপত্যকায় শস্যক্ষেত্র ও জন বসতি। কোনো কোনো স্থানে শাল,চম্বল,গাম্বিয়া কড়ই,শিমুল প্রভৃতির গহিন বন। বনের নিন্মভূমি ঘন লতাগুল্মের রহস্যলোক।বনের অফুরন্ত সবুজের সমাবেশ নয়ন মনের তৃপ্তিদায়ক। অযত্ন সম্ভূত নানা জাতীয় ফার্ণ অর্কিড ও বিচিত্র বর্ণের বনফুল এই প্রকৃতিক শোভাকে অতুলনীয় করিয়াছে। ছোট বড় পাহাড়ের গায়ে বাড়ি গুলো ছবির মতো দেখায়।উত্তরে উচ্চতর গারো পাহাড়ের শ্রেণি সবুজের ঢেউ খেলিয়া দিগন্তে মিশিয়া গিয়াছে। বর্ষাকালে মেঘগুলি সবুজের গায়ে গায়ে মায়ালোকের সৃষ্টি করিয়া ভাবুকের চোখে অঞ্জনের প্রলেপ লাগাইয়া দেয়।”
একটু বড় হলো উদ্ধৃতি। হোক, তবু আজমের একটু মনোতৃষ্ণ কমুক। জোসেফ’দা চশমা খুলে তাকিয়ে রইলেন সদ্য কাটা শালবনের দিকে।জানি দৃষ্টি বেশিদূর যেতে পারেনি। আটকে গেছে ঝুলন্ত প্যানায়। নিজের দখল সত্ত্ব জাহির করে ঝুলিয়ে রেখেছে রঙিন প্যানা। জোসেফ সাংমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই গ্রামেই। পরিবর্তনের নানা ধরন ধারন দেখে দেখে বিরক্ত। একদিকে ইজারা অন্যদিকে দখলে দখলে গারো হিলসের গারো পাড়া শহরমুখী।
হাকিমপুরি জর্দাসহ ভরামুখে পান চিবাতে চিবাতে বললেন, “এই জঙ্গল তো শুধু মান্দির জঙ্গল ছিল না— সকলের জঙ্গল ছিল। মান্দিপাড়ার ওপাশে খাড়ির মতো একটা ঢালু পথ ছিল। ছিলেন একট ছোট্ট ঝরা। সেখানেই ছিলেন শুকরের পাল। গুদগুদ করতে করতে মান্দি পাড়া মাথায় তুলতো।”শুকুর মান্দি পাড়ার সৌন্দর্য—জীবন জীবিকার সাথে সম্পর্কিত।
আর কী ছিল দাদা? আরেকটু কাছে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করতেই
— চিতা বাঘ ছিলেন
— হরিণ ছিলেন
—হাতি ছিলেন
— বানর ছিলেন
— লাল বনমোরগও ছিলেন
— কাঠবিড়ালি ছিলেন
— ছিলেন পাখ পাখালি আর পাখিদের ডাকাডাকি
চোখ ভিজে এলো জোসেফ’দার। তার চোখের দিকে তাকাতে না তাকাতেই কানে আছড়ে পড়ল ‘ছিলেন’ ক্রিয়াপদ। আজমের দিকে ফিরে তাকাবার আগেই দেখি ওর চোখেও ‘ছিলেন’ ক্রিয়াপদ। বিষ্ময় আর শ্লেষ মিশ্রিত অবাক গলায় বললাম—
“বানর ছিল— ছিলেন নয
শূকর ছিল—ছিলেন নয়,দাদা”
শুনেই হাসলেন। লালচে হয়ে যাওয়া দন্ত বিকশিত করেই তিনি হাসলেন। চশমা পরতে পরতে বললেন,”ছিলেন তো আরে হরিণ ছিলেন তো।”
ছিল / ছিলেন ক্রিয়াপদ ব্যবহারের ভেদ বিভেদের পার্থক্য জোসেফ’দার কাছে বিবেচ্য নয়। তার যাপনে তার বিশ্বাসে— হোক সে মানুষ বৃক্ষ বা শুকুর বা পাহাড়ি ঝরা— সকলেই সেই এক অরূপের নানা বিভাব। এক প্রাণ ছড়িয়ে আছে সবখানে,সবখানে। আজ জোসেফ সাংমা নানা চাপে তাপে ভাপে খ্রিস্টিয় বিশ্বাসের শরণ নিলেও যে রক্ত মান্দির রক্ত, যে রক্তে মিশে আছে সাংসারেক ভাব ভাবনার সর্বপ্রাণের বীজ তা জোসেফ সাংমা এড়াবেন কীভাবে ? ছোট বড় জড় জীবের ভেদবুদ্ধি তার নাই। তাঁর হৃদয় সকলকে জড়িয়ে আছে—অভেদের সন্ধানে। ছিল আর ছিলেন ক্রিয়াপদের ভেদ তার কাছে তুচ্ছ।
পানিহাটা থেকে ফিরেছি অনেকক্ষণ হলো। আজম রাতের গাড়িতে ঢাকা ফিরবেন। তুমি যখন এই চিঠি পড়বে ততক্ষণ ভোগাই নদীর জল অনেক দূরের যাত্রী হয়ে গেছেন। তোমার মোলাকাত বার আসতে আরো কয়েক দিন বাকি। কিন্তু জোসেফ সাংমার হৃদয়বৃত্তি আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আবিষ্ট করে রেখেছেন। অপরতার সাথে সম্পর্ক ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতাই জীবনের সাধর্ম। সব কিছুই অনন্য। সকলেই অনন্য।এক গাছের দুইটি পাতা এক নয়; ছোট বড় নয়, বরং অনন্য বনুনের বয়ান।
জ্যোতি পোদ্দার
জন্ম ১৯৭৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের নয়ের দশকের কবি। বাসস্থান বাংলাদেশের শেরপুর জেলার নালিতা বাড়ি। পেশা শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত। প্রকাশিতকাব্যগ্রন্থ: ‘(a+b)2 উঠোনে মৃত প্রদীপ’ (১৯৯৭), ‘সীতা সংহিতা’ (১৯৯৯),
‘রিমিক্স মৌয়ালের শব্দঠোঁট’ (২০০২), ‘ইচ্ছে ডানার গেরুয়া বসন’ (২০১১), ‘করাতি আমাকে খুঁজছে’ (২০১৭) এবং ‘দুই পৃথিবীর গ্যালারি’ (২০১৯)।
চমৎকার লিখনী।বরাবরই সুন্দর লিখেন তবে প্রাণ প্রকৃতির লেখাগুলো আমাকে বেশি আকৃষ্ট করে।
পুরো লেখাটাই পড়লাম কিন্তু সেই তুমি টাকে চিনতেই পারলাম না।তবে জোসেফ দা পুরো লেখায় একটা প্রাণান্ত চরিত্র ছিলো।
আবারও একবার প্রকৃতির সাথে দেখা করার সুযোগ হলো। মাধ্যম বরাবরের মত এবারও লেখক জ্যোতি। আজমকে খুব হিংসে হলো, কারন ইচ্ছে তো আমারও করে প্রকৃতির ভিতর হারিয়ে যেতে। কিন্তু ইচ্ছের ঘোরেই ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছি কেবল..।
জোসেফ দা’র সাথে দেখা করে সামনাসামনি বসে তার ক্রিয়াপদের ব্যবহারটা শুনার জন্য মনটা আকুপাকু করছে!
জ্যোতির লেখনিটা আগের চেয়ে আরাম লেগেছে। কিন্তু বানান এবং দাড়ি-কমার ভুলগুলো কষ্ট দিয়েছে।