দিনপঞ্জি

।। জেসমিন নাহার ।।

রাফিজা ভাবির পানিতে ডুবা শর্মীর গল্প বলা শেষ হল, এবং নৌকাও পূবপাড়া ঘাটে পৌছালো। কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। কান্না শুনতে শুনতে একে একে নৌকা থেকে নামছি আমরা। নামতে গিয়ে পা পিছলে পানিতে পড়লো। পা পানিতে ডুবা মাত্র পানিকে মনে হলো বিষাক্ত। পা যখন পানি থেকে তুলছি তখন কানে আসছে রালেফ খাঁর স্ত্রীর ক্ষোভ জড়ানো আহাজারি, ওরে মোর চোহের সামনে থেহে হরা (সরা), ও আজরাইল আমার গেদির আজরাইল। আজরাইল… 

দিনপঞ্জি

– আপনের ঠাইন নানুর ফোন নম্বর আছে নি ? থাহে যুদি ফোন দিতা পারবেন নি ? আ হা হা, মানষু কই মইরা কই যায়। কাইল্লা আঙ্গো মামা মইরা গ্যাছে গা, মামারে নানু বেশ পছন্দ করতো। আপনে তো জানুইন না, হুননু চাইন গপ্পডি মনোযোগ দিয়া। ভালোলাগবো হুনলে আপনের। 

রাফির মা তার বাইরের চুলায় শাক রান্না করছে আর আমার সঙ্গে কথা বলছে। শাক রান্না করতে এতোবার কড়াইয়ে কাঠি দিয়ে নাড়া লাগে! রাফিজার কড়া নাড়া দেখি আর অবাক হই আমি। মিঞা বাড়ির রাফির মা রাফিজার মামার গল্প শুনবার সময় নাই আমার। আমি এসেছি শর্মীকে নিতে। আমি তাড়াতাড়ি তার কাজীবাড়ির নানুরে ফোন দিই। তার নানু ফোন ধরেন,কড়াইয়ে শাক নাড়তে নাড়তে রাফিজা তার মামার মৃত্যু বর্ণনা করে। সেখানে কতোটুকু শোক আর কতোটুকু মামাম্র প্রতি দরদ ছিল বোঝার উপায় ছিল না। রাফিজা কেন এতো জোরে জোরে শাক কড়াইয়ে নাড়ে সেটা বোঝাও কষ্টকর। 

– হুনছেন নি,নানু, আঙ্গো হাফেজ মামাই মইরা গ্যাছে গা। যাইবেন নি দেখতো? 

ওদিকে তার নানুরও বুঝি সময় নাই। যাবে কি যাবে না সেদিকে গেল না, সেও আল্লাহ মামুদ, আহা আহা করে ফোন রেখে দিলো।

মানুষ মারা যাবার পরে খুব কম মানুষই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যিনি মারা গেছেন তিনি একসময় নাকি নাস্তিক ছিলেন। কিন্তু এক অলৌকিক চিল্লা তাকে আস্তিকে পরিণত করেছিল। রাফির মায়ের তাই শোকের চেয়ে সেই অলৌকিক শক্তির গল্প বেশি। আমাকে ধৈর্য্য ধরে অলৌকিক কেচ্ছাগুলো শুনতে হয়। 

এই গ্রাম পানির গ্রাম। শুকনার সময় খাঁ খাঁ, কিন্তু বর্ষা এলেই সমুদ্রের মতো পানি উপচে আসে। রাফিজাদের ভিটার চারিদিক পানি পরিবেষ্টিত। এ ভিটায় আটটি পরিবারের বসবাস। এই আটটি পরিবার নিয়ে মিয়াবাড়ি। প্রত্যেকের টিনের ঘর। বড কোনও বন্যা হলেও যেন পানি না ওঠে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে  ভিত উঁচু বেঁধে। সহজ সমাধান। হিমালয় থেকে পলি নিয়ে বন্যার পানি ঢোকে হু হু করে বাংলাদেশে। সঙ্গে আসে পলি ও বালি।  বন্যা থেকে রক্ষার জন্য ভিটা উঁচু করে বাঁধা। শহরের মানুষের মতো তারা বাঁধের কথা ভাবে না। পানি ছাড়া ফসল হবে না। বন্যা ছাড়া পলি পড়ে না জমিতে। বন্যা ঠেকাবার জন্য তারা কোন বৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হয় নি। বাঁধ বাঁধতে  হয় নি। তারা বিশ্বব্যাঙ্কের নাম জানে কিনা রাফিজাকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু রাফিজার তখন শাকের প্রতি অখণ্ড মনোযোগ। ।
এ গ্রামে লোকজনের মুখে মুখে ফেরে কিছু ঝড় আর বন্যার কথা। বন্যা তাদের পাহাড়ে চলে যেতে বাধ্য করে,  ঝড় তাদের সামান্য বাতাসেও আতঙ্কিত করে তোলে। শোনা হয়নি এখনো সে ঝড়, বন্যার কথা। শুনব একদিন। তাদের উঁচু ভিতওয়ালা বাড়িতে উঠান নাই। কারণ ভিত বাঁধা পরিশ্রম ও খরচের ব্যাপার। এখানে আছে ঢাকা শহরের মতো শুধু আঁকাবাঁকা গলি। সেই গলি দিয়ে আকলিমা এবং তার শাশুড়ি  বাছিরন – এবা কখনো দেহি নাই জীবনে, ওমা অবা ক্যান! বলতে বলতে রাফিজার চুলার ধারে এসে গোল করে বসে। বিশ্বব্যাঙ্ক এবং পানি আটকানোর জন্য বিশেষজ্ঞদের বাঁধ নির্মাণের চিন্তায় হঠাৎ ছেদ পড়ে যায় আমার। 

–  ‘কবুল’ ক্যামনে কইল  হুনসুন? কি বেহায়া গেদি রে, ইট্টু যে থামবো, না থামে নাই। শরম নাই, লজ্জা নাই, কইয়া দিল নিমিষেই  ‘কবুল, কবুল, কবুল’। আমাগো সুম শরমে মইর‍্যা গেছি গা। হুনো রাফির মা, হেদিন তো কবুল কইলো থামে নাই, আইচক্যা যাইয়া দেহি কি জামাইর ঠ্যাঙের উপরে বইয়া আছাল। বিয়া বইছে, ওরা তো আর পাওন যাইবো না, ফুরাইয়া গেলে পাওন যাইবো না। 

কোনও এক বৈবাহিকতার গল্প। বাছিরন নতুন বিবাহিত দম্পতির কি পাওয়া যাবে না, সেটা আর বলে না। তবে তার বেটার বউ হালিমা বলে, 
–  থামুন চে, কুনতা বুঝি না। এহনজাইন মাইয়াগো বিয়া হইলেই কেমুনডা জাইন হইয়া যায়, হেইদিন বাঁশবাড়ি অটোত বইসা যা দেখলাম হুনুনচাইন খালি, মাইয়ার জামাই যাইতাছেগা বাড়িত। মাইয়া করে কি, বারবার মুখের কাছে মুখ ঠ্যাকাইয়া চুমুক দেয়। এবা করে, অবা করে, কি মধু কি মধু হাইরে জাইন জামাইর মুখে কি মধু! সামিনা তো তাওচাইন বাড়িত, নিজের ঘর জামাইর ঠ্যাঙের উপরে বইয়া আছাল। 

এই অজ পাড়া গাঁয়ে নতুন বিবাহিত দম্পতি একটু খেই হারায়ে ফেলে বটে। দিন দুপুরে বাড়ির সবার সামনে ঘরের দরজা দেয়। মেয়ে মুরুব্বি মানে না, বরের ঠ্যাঙের উপরে বসে পড়ে। ইয়াং ছেলে তার ছেলে বন্ধুদের তার বউয়ের সামনে দেখলে বউকে তাদের সামনেই একটু চুমু দেয়, মেয়েরা তাদের বান্ধবীর সামনে বরকে স্পর্শ করে। তাই ওদের কার্যাবলী হয়ে ওঠে পড়শীর নতুন চর্চার বিষয়। নতুন বিবাহিত ছেলেরা মুরুব্বি মানেনা। এই যে মুরুব্বি মানে না তা হতে পারে যৌবনের দোষে; আর বন্ধু বান্ধব মানে না হতে পারে ইনসিকিউর অনুভব থেকে। ওদের কথার মাঝে একটা চাপা ক্ষোভ আছে বোঝা যায়। কিসের ক্ষোভ? কার প্রতি ক্ষোভ? জানিনা ওরা শারীরিক সম্পর্কে অসুখী কিনা। অথচ কেউ কেউ তো কারও ভালোবাসার সম্পর্ক দেখে ভীষণ আনন্দিত হয়। ওরা এতো ছিঃ ছ্যাঃ করে যাচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না।

তবে আমি তাদের মনোযোগী শ্রোতা। তাদের কন্ঠস্বরের উত্থানপতন, শরীরের ভঙ্গী, ইঙ্গিত, ইশারা, অভিনয় ইত্যাদি গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করি আমি। 

রাফিজা বাটনা বাটছে। হালিমার মুখ ফোটে।
– ভালো কইরা ফাঁকি কইরেন। 

রাফিজা বলে ওঠে,
 – কান নিগা? 
তাদের কথা শেষ না হতেই বাছিরন বলে, 
– গোবরের নেদার লাগান জিবলা গ্যাছে তিতা হইয়া। রাফির মায়ে হুকনা মরিচ বাটপার নইছে, অবাই জিবলায় নাল আইছে।

গোবরের নাদ তিতা নাকি মিষ্টি তা বাছিরন কিভাবে জানে? ঘুটো দিতে গিয়ে কি সে মুখে দিয়েছিলো? ভাবলাম জিজ্ঞাসা করি। কিন্তু জিজ্ঞাসা না করে তাদের কথার দিকে মনোযোগ দিলাম,
হালিমা রাফিজাকে বলে, 
– হুকনাডা ভালো। হুকনা লাল মরিচের ফাকি খাইয়া আইচকা নাক দিয়া পানি নামাইবো আমার হরি( শাশুড়ি) । ইট্টু দেনচাইন বাটনা থাইক্কা আমার হরিরে। 
ওদের কথার মাঝে বাছিরনের ঘর থেকে বের হয়ে আসে আসমান মিঞা। আমাকে বলে,
– মোবাইল থেন গজল নামাইয়া হারুন? গজল নামাইয়া দেন চে, এবং তার স্ত্রী বাছিরন কে বলে,  কী গো সজলের মা ক্যাডা কার ঠ্যাঙের উপর বইয়া আছাল? 
বাছিরন বিটার বউদের সামনে লজ্জা পাওয়ার ভান করে,মুখে কাপড় দিয়ে বলে, তোমার হুইন্যা কাম নাই। 
আসমান মিয়া তাই মেনে নেয়। বলে কইয়ো না, আর বইলা কি হবো! 
আমাকে বলে,
– গজল রাতে শর্মীরে হিকাইবেন, আপনার বাইত্তেই তো থাকবো আইচকা? 
আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ। 
– আহারে একটা অংকের নাইগা ওই বাইত্তে দৌড়ে গেছি গা।
আসমান মিঞা দুঃখ প্রকাশ করে। তার লেখাপড়ার ইচ্ছা থাকা সত্বেও বাবা মারা যাবার পরে আর স্কুলে যেতে পারে নি। একা একা বিড়বিড় করে,যদি সে লেখা পড়া করতে পারতো তাহলে এই কালিদহে তার থাকা লাগতো না। সেও তার দুই ভাইয়ের মতো পাহাড়ে গিয়ে ঘর বানাতে পারতো। তার মুখে কষ্টের ছাপ দেখা যায়, আমাকে জিজ্ঞাসা করে,
– সন্তানগোও বালা হওন চাই, তাই না গো মা? হলে সে বান বাবা মায়ের সুখ মেলে। তার সব আক্ষেপের কষ্ট নাতনিকে দিয়ে মেটাতে চায়। 
– ওরে হিকায়ে দিয়েন চে, অর মুখে য্যান কি সুন্দর হুনা যায়। আসমান মিয়ার চোখে মুখে তৃপ্তি ফুটে ওঠে, তার নাতনির গানের গলা ভালো এই আনন্দে। অতি উৎসাহে বলতে থাকে,
– অর সাথে যুদি হুইয়া থাকুন। হারারাত হিকাইবেন। অঙ্কও হিকাইবেন। 

আমি ভাবলাম, মেনেও নিলাম। নাতনিকে অঙ্ক শেখাতে হবে, আবার রাতে পাশে শুইয়ে গজলও শেখাতে হবে। আমার ভালোলাগে। শিক্ষার দর্শন নিয়ে একটা দীর্ঘ লেখার ইচ্ছা জাগে। সেখানে কেন উঠতি বয়েসে বালিকার প্রাইভেট শিক্ষক হিশাবে রাত্রে গজল শেখানো জরুরি তার পক্ষে ভাল যুক্তি খুঁজে না পেয়ে আমি আবার হতাশ হয়ে পড়ি।  তবে এখানে গজল মানে উর্দু গজল না। নাত, হামদ বা ধর্মীয় বাংলা গান মানেই গজল। 

আসমান মিঞার ফোন এখনও আমার হাতে, তার এজমা আক্রান্ত জীর্ণশীর্ণ শরীর নিয়ে আমার হাতে রাখা তার ফোনের দিকে চেয়ে আছে। আর রাফিজার বাইরের চুলার চারপাশ জুড়ে চলছে চারজন নারীর চিরায়ত গল্প। বিশ্বের কোন খবর ওদের কাছে নাই। ওরা সুখী প্রতিবেশীর বিবাহিত জীবনের রঙঢঙের আলাপ করে। ওদের আলাপ আমার প্রিয়। আমি শুনছি। 

আসমান মিঞা মেতে ওঠে তার তিন নাতনির সাথে ইয়ার্কি আড্ডায়। আমি ইউটিউবে গজল শুনছি আর লিখছি, আসমান মিঞার ডায়েরিতে। তার বড়ো নাতনি শর্মী বাংলা বই আনে। বলে, কুনটা পড়া দিচুন আইচকা? হেইডা বের কইরা দ্যানচাইন ম্যাডাম!

শর্মীর পড়া বের করে দিলাম না, কিন্তু আসমান মিঞার ডায়েরিতে আমার লেখা দেখে আসমান মিঞা বলে ওঠে, এইয়্যা কী যা লেখে না ম্যাডাম, কুনতা বুঝিনা। 

শর্মী রাগের ভান করে।
– এইয়্যা, তোমার বুঝন নাগবো না। এই যে, আমি বুচতাছি, মাটির বাড়ি, আমার মাটির বিছানা। এবং আজ তার সিদ্ধান্তের কথা আমাকে নির্ভয়ে জানায়।  
– ম্যাডাম আইচকা আমি থাহুম না। বাইত্তে থাহুম। কাজী বাইত্তে ভয় নাগে। বললাম, আমি আছি ভয় কিসের? 
– এ হ্যাঁ, না থাহুম না। 

আমিও ওকে আর জোর করলাম না। চারিদিকে পানি, কোনও বিপদ হলে আমার হোক, ছোট বাচ্চাকে নিয়ে গিয়ে ওর বিপদ ঘটানো উচিত না। হঠাৎ আমার মধ্যেও রাত্রে আমার একাকী ঘরে একাকী থাকবার শক্তি এসে গেলো। বললাম থাকবার দরকার নাই। আমি একা থাকা একটু একটু করে শিখি। আসমান মিঞার মাথা থেকে গজল যায় না। তার নাতনিকে গজল শেখাতেই হবে।  আমাকে তাড়া দেয়,
– হারাহারি গজল লিইখ্যা দ্যান। বৃষ্টি নামব, পুবে আকাশ হাজ ( সাজ) করছে। 

রাফি, রাফাজ এবং আরিফুল বড়ো বিলে যাচ্ছে মাছ ধরতে। রাফি ওর মাকে বলে যাচ্ছে, 
– পাঙ্গাস রানদো না মা, পাঙ্গাস রানদো না। পাঙ্গাস পতিদিন বাল লাগে না। 

এখন পানির সময়, তাদের খাদ্যে থাকে অনেক মাছ, কিন্তু শুকনা ছয়মাসে এই অঞ্চলের মানুষের প্রিয় খাবারের তালিকায় থাকে পাঙ্গাশ মাছ এবং ব্রয়লার মুরগির গোশত। পানিতে এতো মাছ তবু কেন রাফির মা তার ছেলেদের অপ্রিয় পাঙ্গাশই রান্না করে!

মাহফুজা মুরগির খবর দেয়।
–  যে মুরগির ব্যারাম আছাল গ্যাদা! ওরে যবো দিসি। 
মাহার দাদি হায় হায় করে ওঠে। যথার্থই তার আক্ষেপ। গ্রামে মুরগির যখন মড়ক লাগে তখন বাড়ির পর বাড়িতে মুরগি মরতে থাকে। 
– ব্যারাম আইছে? আল্লাহ আল্লাহ কুইরকার ব্যারাম!

মুরগির রোগবালাই বছরে একবার হয়েই যায়। গ্রাম্য ভাষায় যাকে বলে ঝেটুনে রোগ। ঘর থেকে সব মুরগি ঝেঁটিয়ে বিদায় হয়। মোরগ মুরগি চুনের মতো পায়খানা করে। অনেক গ্রামে এই ঝেটুনে রোগ চুন হাগা নামে পরিচিতি লাভ করেছে। 
– আল্লাহ আল্লাহ আমার ডিম পারা (পাড়া) কুইরকা(মুরগি) ক্যামনে নক্ষা ( রক্ষা) করুম। আমার ঝিয়ে আবার ডিম নিয়ে আবো! মাহার দাদি আক্ষেপ করতেই থাকে। রাফিজা সান্ত্বনা দেয়।
– অতা চিন্তা কইরা লাব (লাভ) নাইঙ্কা। কইয়া দাও বেইত্তে ব্যারাম, অহন দেওন নাইগবো না। তাইলে সে বুঝবো, ঝামালা শ্যাষ! 

মাহার দাদির যেন সত্যিই ঝামেলা শেষ হয়। সে হাসি দিয়ে আমাকে তার স্মার্টগিরির প্রমান দিতে কঠিন প্রসঙ্গ নিয়ে আসে। 
– আঙ্গো ম্যাডাম নি, হুনছেন নি! আবার মাইনষের কয় কুন ডিঙ্গু রোগ আইতাছে। 

আমার জ্ঞান দিতে মজা হলো। বললাম, ডেঙ্গু জ্বর। এডিস নামের এক মশা কামড়ালে এই জ্বর হয়। এরপর এডিস মশা সম্পর্কে মোটামুটি গুরুগম্ভীর বয়ান দিলাম। জেনেই বকবক করলাম, মাহার দাদি কমলা বানু যখন আমাকে ‘ম্যাডাম’ বলল, আমাকে তো আমার ওজন বজায় রাখতেই হবে। আমার কথা শুনে মাহার দাদি আক্ষেপ করে।
– আর কইবেন না গো, মুশুরি (মশারি) টাঙায় তাও কেবা মশাই কামরাই (কামড়াই)।
চুলার ধারে তাদের গল্প আরো জমে ওঠে। বাছিরন এই বৈজ্ঞানিক আলাপে আনন্দ পাচ্ছিল না। রাফিজার মেয়ে নিশাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে মাথায় উকুন দেখা শুরু করে সে। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, 
– গুর্দা পুলাপানের মাথায় উকুন আনতে বালা লাগে তাই না গো? খাটা চুল। 

বাছিরন উকুন তোলায় মনোনিবেশ করে। নিশার মাথা থেকে উকুন বের করছে দেখে,জিনাত একেবারে কোলের মধ্যে বসে পড়ে তার ছোটমা হালিমার। সমবয়েসী নিশা এবং জিনাতের প্রতিযোগিতা সবসময় লেগেই থাকে। দুজনের ঝগড়া দেখলে মনে হয় বড়ো মানুষ ঝগড়া বাঁধায়েছে। কিন্তু সে ঝগড়া আধাঘন্টাও স্থায়ী হয় না। এখন চলছে তাদের মাথার উকুন তোলা প্রতিযোগিতা। হালিমা জিনাতের মাথার চুলের মধ্যে হাত দিতে দিতে বলে,
– এহন কি উকুন আনার টাইম! রানমু। 
রাফিজা চুলায় খড়ি ঠেলে দিতে দিতে ভিন্ন প্রসঙ্গ টানে। বলে,
– আরিফুলের মাতো( হালিমা) রানদে না,হালি মানসের বাড়িত বাড়িত খায়। জিনাতের মাথাথন ঢ্যালা আইনা দিবো, পুঞ্জাল আইনা দিবো, নিক আইনা দিবো, বিনিময়ে জিনাতগো বাসাত খাইবো। জিনাতের বাকপটুতা এখন ঝগড়া বাঁধাবার। বলে,
– হ মানসের বাড়িত বাড়িত খায়। হালি হাস তামশা। বাল নাগে না। 
 জিনাতের মা মেয়ের চাপার শক্তি দেখে এখন অভিভূত। বলে,
– মাইয়ার অতা চাপা হলো ক্যারে কে কইবো!  জিবলাখান খাটা করন নাগবো তো। নইলে যদি আবার কেউ কাইটা হালায়। 
– হ তোমার টা কাটবো। বলেই খ্যাক খ্যাক করে কেশে গাল থেকে এক খাবলা সর্দি বের করে জিনাত। 
বাছিরন হেসে ফোড়ন কাটে,
–  সজলের ঝিয়ের গলা কেবল ছাপ হলো, জং ধইরা আছাল। 

ইতোমধ্যে রাফিজা কড়াইতে তেল ঢালতে শুরু করেছে। তেলের বোতল থেকে সামান্যই তেল পড়ে। বোতল কড়াইয়ের উপরে ধরে আমার দিকে তাকায়। কিছুটা বিব্রত হয়। বলে,

– দেখসুন ম্যাডাম, তেলের ডিবা হুকাইয়া চ্যাড়চ্যাড়া হয়া গ্যাছে গা। 

আমি একটার পর একটা গজল ডাউনলোড দিচ্ছি আসমান মিয়ার ফোনে,আর রাফিজাদের গল্প শুনছি। সামান্য চুলার ধার এখন অসাধারণ লাগছে। কিন্তু কেন লাগছে জানিনা। শর্মি তার মাকে বলছে, 
– ও মা.. পিঠ্যা খাইবার মনে চাইছে, 
শর্মীর মা মেয়ের পিঠা খাবার বাসনাকে খুব একটা মূল্য দিল না। সে শাক রান্না করছিল। জবাব দিলো,
– হাগ দিয়া ভাত খাইয়ো, এই যে আমি হাগ রানতাছি।

রাফিজা মাছ ভাজছে অল্প তেলে আর হালিমা কে বলছে ধন্যবাদ রে তরে, তয় মাছ নিলিনা ক্যান তুই? মাছ না নেবার জন্য ধন্যবাদ দিচ্ছে আবার জিজ্ঞাসাও করছে কেন মাছ নেয়নি! এর কি কারণ তা রাফিজা আর হালিমা ভেঙে বলে না। তবে শর্মির মাকে উদ্দেশ্যে করে বলে, কির‍্যা বিষ্টি( বৃষ্টি), মাইয়ার খাবার মনে চাইছে,তুই খাওয়াইবি, তা না হাগ দেহাস মাইয়ারে?র
শর্মী ওর মাকে শাসাচ্ছে, 
– পিঠ্যা না বানালে লেখা হারুম না। মাদ্রাসাত যায়া হারুম না।
গজল ডাউনলোড দেয়া শেষ হয় আমার, আসমান মিঞা আরেকটা লিখে দেবার অনুরোধ জানায়, লেখা শুরু করা মাত্র শুনতে পাই, মাহার মা তার শাশুড়িকে ডাকছে আর বলছে,
– ওরে রালেফ খাঁর মাইয়াই মরছে, ওরে আমার হরি কুনরে, রালেফখাঁর মাইয়াই পানিতে ডুইবা মরছে। মাহার দাদি আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে আমাকে ধাক্কা দিয়ে  বাড়ি চলে যায়। আমার হাত থেকে আসমান মিয়ার ফোন ছিটকে পড়ে যায়। আসমান মিয়া হায় হায় করে ওঠে,
– এইহ্যা রে, গ্যাছে আমার ফুনডা।
ফোন ভেঙে যাবার বিপর্যয় আশঙ্কা আসমান মিঞার মধ্যে প্রভূত শক্তি জোগায়। ছোঁ মেরে অক্ষত তুলে নেয় মাটি থেকে।

রাফিজার চুলা ঘিরে মুহূর্তে নিরবতা নেমে আসে । সকলে চুলার পাড় থেকে উঠে তাড়াতাড়ি কাজ করতে শুরু করে। হাতের কাজ শেষ করে সবাই রালেফ খাঁর বাড়ি যাবে। 

রালেফ খাঁ তার ছেলে মাহিদের কাছে তার মেয়েকে রেখে, স্বামী স্ত্রী মিলে নৌকা পরিস্কার করায় ব্যস্ত ছিলো, আড়াই বছরের মেয়ে, সাঁতার শেখেনি। মাহিদ তার শিশুসুলভ কৌতূহলে পাশের বাড়িতে কল পোঁতা দেখতে চলে যায়। ছোট্ট শিশু, মা বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে পানিতে পড়ে যায়। পানিতে ডুবে মারা যায়,মরবার পরে পানির স্রোতে পানির নিচে ভাসতে ভাসতে মায়ের পায়ে গিয়ে বাঁধে। রালেফ খাঁর স্ত্রী পায়ের নিচ থেকে তুলতে তুলতে বলে,
–ওমা এ কোন গেদির পুতুল? 
তারপর হাতে তুলতে তুলতে বলে,
– ওমা এ কোন মায়ের গেদি! তারপর মুখের দিকে চেয়ে দেখে তার পেটের গেদি। সে ব্যথায় চিল্লাতে থাকে,
– মোর গেদি ডুইবা গ্যাছে গা। পানিত ডুইব্যা মরছে মোর গেদি।

কালিদহের প্রতিটি মসজিদের মাইক শোক সংবাদে ভারি হয়ে গেলো। মিঞাবাড়ির সামনে দিয়ে যতো নৌকা পূবপাড়ায় রালেফখাঁর বাড়ি গেলো এবং এলো তাদের মুখেই রালেফের মেয়ে মরবার গল্প সকলে আমার মতো শুনে নিল আর আহাজারি প্রকাশ করলো। 
মিঞাবাড়ির সকলে কাজ শেষ করল। গল্প করতে করতে যে কাজ শেষ হতে সন্ধ্যা হতো তা ওরা একঘন্টার মধ্যে শেষ করল। সন্ধ্যার সব কাজ বিকালে কেন করছে তারা, তা বোধগম্য হলো না আমার। যখন এসব ভাবছি আমি,আসমান মিঞা তখন নির্দেশ দেয়।
– কইরা হালাও, সব কাম কইরা হালাও সজলের মাও, রাতো ভয় নামবো। সন্ধ্যার আজানের পরে বাইর‍্যা নামন যাইবো না। 

আসমান মিঞার কথায় সকলে কলের পাড়ে বড়ো বড়ো কলস নিয়ে জমায়েত হলো। পানি তুললো। এক রাতে কি তারা এতো পানি পান করতে পারবে! তাদের কাজ শেষ হলে মিয়া বাড়ির সকল মানুষ এবং আমি তিনটা নৌকায় করে পূবপাড়ার রালেফ খাঁর বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা হলাম। আমি উঠলাম রাফাজের নৌকায়। তারা রালেফ খাঁর মেয়ে মরার সংবাদে তাড়াতাড়ি জাল পেতে বাড়ি ফিরেছে। নৌকা চলতে চলতে রাফিজা আমাকে বলে,
– ম্যাডাম শর্মীরে তো ছাত্রী হিশেবে পাইতেন না। মরলে আজ তেরো বছর হইতো বান। রাফাজ এবং রাফি সম্মত হয়,  বলে, হ হ ম্যাডাম। 
বললাম কি হয়েছিলো শর্মীর? রাফিজা বলে চলে,তার গল্প।
– তহন ছুট্ট আছাল শর্মী। রাফাজ এবং শর্মী এক সমান আছাল। শনিবাইর‍্যা দিন, বাত (ভাত) চড়াইছি, শর্মীর মাই হেইদিন যাবাখড়ি (জ্বালানি)হুকাইবার দিসাল, হেন থে শর্মীর মায়ে হলা হাতে নিয়া হেংসেলের বুগালে আয়া কইতাছে আমার হরিরে, (শাশুড়িরে) 
– ও ফুবু শর্মী গ্যাছে কনে? শর্মীরে তো দেহিনে, আমার হরি (শাশুড়ি)  কই।
– কী য্যা, দ্যাহো কনে এলা গ্যাছে।
শর্মীর মাও তহন হলা দুয়ারে না থুইয়া গ্যাছে হেঁসেলে আমার বুগলে, কয়, ভাবি ঊর্মিরে তো দেহিনে।
তহন খোঁজ কইরা কুল পাইনা শর্মির মাও। রাফাজ উত্তর মোড়্যা (মোড়ে), খোয়ারের (খোয়াড়ের) সামনে, রানদো ঘরের পিছে খারায়া (দাঁড়িয়ে) আছাল। শর্মিরে খোঁজতাছে বুইঝ্যা কই, ওই যে উম্মি…
শর্মীর মায়ে পাগলের নাগাল ওনথানে ঘুইর‍্যা আয়া কইতাছে, ভাবি শর্মী তো পানিতে পড়ছে।

আমি হেঁসেলের খড়ি সব চুলার ভিতরে ঢুকাইয়া গ্যাছি গা উত্তর মোড়্যা, হেনে শর্মী শুধু ক্যায়া কইড়ে নোখ দেহন যায়। কইড়ে নোখ ধইর‍্যা টান দিসি, সাহস কইর‍্যা উঠাইলাম, আমার শরীর ঝাঁকি দিলো ভয়ে। হেইসুমকা শর্মীর দুম আছাল না। এক্কেবারে মইর‍্যা গ্যাছাল। মাথায় নিয়া আমি ঝাহি ( ঝাকি) পারলাম। আমার কাছ থে নিয়া মাহার মায়ে ঝাহি দিলো, তারপর শর্মীর দাদিই ঝাহি দিলো, বাগশুদ্দা কান্না আর কান্না গেদি নাইঙ্কা, বাগের ব্যাক মদ্দ,শর্মীর বাপ সজলেও আছাল শনিবাইরা হাঁটে, আমরা মহিলারা আশা ছাইড়া দিয়া যহন মাটিত হুয়ামু তহন ওবাগের সলীমের মায়ে আয়া অনেকবার ঝাঁহি পারছে, ঝাঁহি পারতে পারতে হ্যার কান্দে শর্মী কাশ সহ ছুট্ট কলসের এক কলস ভাত পানি তুইল্যা, বমি কইরা দিসাল। বমি করা মাত্রই দুম আইছাল। 

রাফিজা ভাবির পানিতে ডুবা শর্মীর গল্প বলা শেষ হল, এবং নৌকাও পূবপাড়া ঘাটে পৌছালো। কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। কান্না শুনতে শুনতে একে একে নৌকা থেকে নামছি আমরা। নামতে গিয়ে পা পিছলে পানিতে পড়লো। পা পানিতে ডুবা মাত্র পানিকে মনে হলো বিষাক্ত। পা যখন পানি থেকে তুলছি তখন কানে আসছে রালেফ খাঁর স্ত্রীর ক্ষোভ জড়ানো আহাজারি, ওরে মোর চোহের সামনে থেহে হরা ( সরা), ও আজরাইল আমার গেদির আজরাইল। আজরাইল… 

আজরাইল! মাহিদের উদ্দ্যশ্যে মাহিদের মায়ের ক্ষোভ প্রকাশ, তার গেদিরে না দেখে কলপোতা দেখতে যাবার হিস্যা স্বরুপ সে এখন নামমাত্র আল্লহর প্রিয় ফেরেস্তা বনে গেছে ক্ষণিকের জন্য। ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছি, মাহিদের মতো ছোট্ট চঞ্চল শিশুকে তার মা ক্যামনে বিশ্বাস করে আরেক শিশুকে তার কাছে রেখে যেতে পারে! ভাবছি আর আমি এগোচ্ছি, আমার পদপ্রান্তে ছড়ানো ছিটানো বিষাক্ত ভোগ নেয়া পানি। ভোগ! আমিও কি তবে কুসংস্কার বিশ্বাস করতে শুরু করেছি? 

বাড়ির পরে বাড়ি সাজানো পূবপাড়ায়। খুব কম পরিবারের আছে উঠান। নিজেদের পরিবারের যতোটুকু স্থান তাতে লাগাতে চেষ্টা করেছে বিভিন্ন ফলের গাছ। বংশাই নদীর বানের পানি তাদের অল্প জায়গায় সকলে মিলে বসবাস করতে শিখিয়েছে। পানিতে জন্মানো নানান মাছ, শাপলা, কলমি শাক, সঞ্চি শাক, হেলেঞ্চা শাক তাদের খাদ্যের প্রধান উৎস। এরকম বাড়িকে ঢাকা শহরে বলা হবে বস্তি আর যশোরে কেউ কল্পনাও করবে না এরকম অল্প স্থানে কারো পরিবার স্বচ্ছন্দে, হাজার বছর ধরে বসবাস করতে পারে। আমার তো ভালো লেগেছে। আমি এখানে এসে শিখেছি, জীবননির্বাহ সহজে, অল্পস্থানে, আনন্দে কাটিয়ে দিয়ে করা যায়। পূবপাড়ার দশ পনেরোটি বাড়ি পেরিয়ে পৌছালাম রালেফখাঁর বাড়ি। রালেফখাঁর বাড়ি পৌছানো মাত্র আমার ছাত্র মাহিদ আমাকে দেখে আবেগি হয়ে পড়লো। মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, বোনকে রেখে কোথায় গিয়েছিলে? বলে, ওই বাইত্তে গেছিলাম। বুড়িরে লতিফাগো দেইখ্যা ওনে রাইখ্যা গেছিলাম, কিন্তু হে পানিত গিয়া পড়ছে। বলে আর কাঁদে। মাহিদের মা কাঁদে, অজ্ঞান হয় একবার, আরেকবার জ্ঞান ফেরে। মাহিদকে গালি দেয়,আবার হাত পা ছুড়ে কাঁদে, আবারো অজ্ঞান হয় এবং আবার জ্ঞান ফেরে। একইদৃশ্য বারংবার দেখছি। স্মৃতিপটে হয়তো গাঁথা হয়ে থাকবে। শর্মীর মা আমাকে ডাক দেয়,
– ম্যাডাম আহুনচে, জায়গা এল্যা। 
রালেফ খাঁর বাড়িতে অনেক মানুষের আগমন। লাশ দেখতে এসেছে তারা। কেউ নিজেদের মাঝে গল্পে ব্যস্ত আর কেউ আহাজারি করছে। ওদের রালেফ খাঁর বাড়িতে রেখে কিছু স্মৃতি নিয়ে আমরা সকলে মিলে আবার নৌকায় এসে বসলাম। নৌকা চলতে শুরু করে। রাফিজা আবার আমাকে বলে, 
– এইবার শেষটুকু হুনুনচাইন গপ্পডির। শর্মী ডুইব্যা যাবার পরে এক হুজুর আইছাল বাইত্তে, তারে দিয়া ভার (ভারণ) বহাইছাল। হেতি জিন আনছাল, হেয় জিন! যে শর্মীরে ডুবাইছিল, হেই জিনে কয়, আমি গুসোল দিয়া চুল হুকাইবার দিসি, হেয় আমার চুলো পা দিসে, আমি কি কষ্ট পাই না? কষ্ট লাগছাল, তাই হেরে পানতি ফেইল্যা দিসি। তয়, এই বাইত্তে একজন গেদি আমি নিমুই। 

রাফিজার গল্প শেষ হয়।  ঊর্মি এবার নিজের অবস্থা ব্যাখ্যা করে। বলে,
–আমার তো তিনফাড়া চইল্যা গ্যাছে তাই না গো কাক্কি? এইবার বরইয়ের সুমও ডাকছাল আমারে রাত একটার সুম। এই ডাকেই ফাড়া চইল্যা গ্যাছে গা, আমি বের হলেই আমারে মাইর‍্যা ফেলতো তাই না গো কাক্কি?

জিনভুতের গল্প শুনতে শুনতে আমরা আমাদের ঘাটে এসে পৌছায়। আমাকে কাজী বাড়ির ঘাটে নামিয়ে দেয় রাফাজ, আমি নামতেই শর্মী বলে ওঠে,
– ম্যাডাম খারানচে, মানসে মরছে আইচকা, কাজী বাইত্তে আপনে একা থাকা পারবেন নাইঙ্কা। আমি আহি। 
শর্মীর জন্য আমার বাড়তি ভালোবাসা কাজ করতে থেকে। আমি শর্মীর জন্য দাঁড়াই, মনে মনে বলি, হ্যাঁ, আসুক ও। আজ একা থাকতে সত্যিই পারবো না। নৌকা থেকে নেমে শর্মি তার দাদিরে নিশ্চিত করতে চায় যে শিক্ষার ব্যাপারে সে সচেতন। 
– ও দাদি, আমার বইয়ের ব্যাগটা দিয়া যায়ো ইট্টু।

দাদি বাছিরন খুব উৎসাহিত বোধ করে না।
– যায়া হারুম না আমি কাজী বাইত্তে,  আয়া নিয়া যা।
শর্মী বলে, আচ্চো( আচ্ছা) 

আমরা দুজনে আমার ঘরে ফিরে শরীর, হাত পা ধুয়ে সব ঘরে লাইট অন করে দিলাম। চারিদিকে সন্ধ্যার আজান বেজে উঠল। আজান শেষ হতেই গেটে ঠক ঠক আওয়াজ। দুজনে গেলাম আস্তে আস্তে গেটের কাছে, দেখি আসমান মিঞা দাঁড়িয়ে শর্মীর বইয়ের ব্যাগ হাতে। আমার হাতে ব্যাগ দিতে দিতে বলে, 
– রেতভইরে আমার নাতিনরে আইচকা গজল হিকাইবেন। কাইল্ল্যা বাইত্তে আইলে হুনমু আমি। যায় এল্যা, ভয় নামবো। 

আসমান মিঞার দৌড় দেখে শর্মীকে বললাম, ছোট্ট শিশু মারা গেছে, সে আর কি ভয় নামাবে। ভয় না নামলেও তো দেখি  তোমরা জোর করে নামাবে। শর্মি হাসে, কিছু বলে না। সে তার ব্যাগের মধ্যে কি যেন খোঁজে। মনোযোগ দিয়ে খোঁজে। আমি আমার ঘর গুছাই, হঠাৎ ও বলে ওঠে, 
– রাবাট কো? রাবাট?
কপাল কুঁচকে বললাম, রাবাট!
হি হি করে হাসি দিতে দিতে , মুখ লাজুক করে শর্মী বলে, 
– ওই যে ম্যাডাম আপনে যারে কন ইরেজার। 
এবার তার কন্ঠস্বর খুব সহজ এবং আত্মবিশ্বাসী। চেহারায় মর্যাদার আভা। 
– ম্যাডাম,আমি আপনের নাগাল ম্যাডাম হইবার চাই। মারে কইচি বিয়া করা হাম না। ম্যাডামের নাগাল এম এ পাশ দিমু। টেহা কামাই কইর‍্যা মানসের সাহায্য করমু। 

আমি বললাম তোমার দাদারও তাই ইচ্ছা । কিন্তু তুমি ভাবছো এককথা,আর আমি তো  দেখছি ভবিষ্যতের অন্য চিত্র। দুই বছর পরে আমাদের শর্মী গর্ভবতী হয়েছে। বিয়ে করে, একটি সুন্দর গোলগাল পেট নিয়ে আমার কাছে এসে বলছে, 
– ম্যাডাম বালা আছেন নি? 
শর্মীর রাগ হয়। এই রাগান্বিত ভাব অভিনয় নাকি সত্য বোঝা কঠিন,
– ম্যাডামের লগে আর কথাই কমু না। কুনতা কথা বিশ্বাস করাইতো হারি না। ম্যাডাম, আমার খুব সখ আমার রোল এক হবো। পরীক্ষাত এট্টু যদি দেহি, প্রশ্নও বান যদি লেহি নম্বর দেবেন!  হগলে যদি দেহা পারে, আমি পারুম না ক্যান? আমার আশপাশে, আমার বুগলে যারা বহে,  ব্যাকে দেইখ্যা লেহে। 
বললাম, দেখে লিখে বি এ, এম এ পাশ করতে পারবা না, তবে বিয়ে পাশ করতে পারবা। তোমার গ্যাদা গেদি আমি কোলে পিঠে নিতে পারবো। 
শর্মী হাসে,  
– এ হে হে, হইছে, ম্যাডাম হইছে, হাছায়..  ।
বললাম কী হয়েছে? বিবাহ! তোমার?  
শর্মী বলে, আরে না না, আল্লাহ আল্লাহ এনেগার কথা  আপনে শিখছুন তাই কইছি যে বলতে পারছুন। আপনে কি লেইখ্যা লেইখ্যা শিখচুন আমাগো বাষা? হবায় কইলেন, গ্যাদা গেদি। হে হে হে।
শর্মীকে আরেকটু আনন্দ দিতে বললাম, মাইয়্যাডা এতো জোরে চিল্লায় ক্যা? আমি ডরাই না! 
শর্মী আরো জোরে হাসে।
–  হইছে হইছে, আল্লাহ খোদা ম্যাডাম কি দিয়া, কন থাইক্যা হিইক্যা গেলেন। 
শর্মীকে আনন্দ দেবার জন্য আরো অনেকক্ষণ কালিদহের ভাষা চালিয়ে গেলাম। 

এটা টাঙ্গাইল। বৃহত্তর ময়মনসিংহের ভাষা। বাংলাদেশ প্রাণ, প্রকৃতি, জীবন বৈচিত্র‍্যে যেমন মানুষকে অভিভূত করে রাখে তেমনি এখানে ভাষার বৈচিত্র্যও অসাধারণ। এই ভাষা আমার এবং ওদের নয়। এটা আমাদেরই ভাষা। বাংলা ভাষা। এই ভাষা শেখার জন্য আমার আগ্রহ প্রবল। 
শর্মী সাথে নিয়ে রান্না ঘরে গেলাম। ভাত বসিয়ে তরকারি কাটতে শুরু করলাম। শর্মি স্বপ্ন দেখেছে, ওর গতরাতের স্বপ্নের কথা আমাকে শোনাতে চায়। বললাম বলো, শর্মী বলতে শুরু করে।.
– স্বপ্নে দেহি আপনে সেভেনের ক্লাসে বইয়া রইছুন, আমি বারিন্দায় খারাইয়া রইছি, সারজিনা ক্লাস থ্রির ভেতরে আছাল, আপনে টেবিলে বয়া পরীক্ষার খাতার নম্বর দেখতাছুন, আপনে ইট্টু পরে বারিন্দায় বাইরা আয়া কইতাছুন, শর্মি তোমার রোল নম্বর এক হইছে। তোমার নম্বর বেশি। আমি তো খুশিতে নাচতাছি, সারজিনা দরজার অম্ফি দাঁড়ায়া জিগাইতাছে, তর নম্বর বেশি? তর রোল এক হইছে? কয়াই কাইন্দা দিছে, ঠিক তহন আমার মায়ে ডাক দিছে, কয় এই উঠ উঠ… 

শর্মীর স্বপ্ন শুনে একটা মধুর আনন্দ আমাকে জড়িয়ে ধরল। সম্ভবত শিক্ষক ছাড়া যার উপলব্ধি করা অন্যদের পক্ষে সম্ভব না। আমি শর্মীর দিকে তাকিয়ে আবার দেখি। এই প্রথম বিশ্বাস হলো সে সত্যিই লেখাপড়া করতে চায়। তার দাদা আসমান মিয়াও চায় তাকে লেখাপড়া করাতে, তাদের মা বাবার ইচ্ছা কখনো আমার জানা হয় নাই। তবু শর্মিকে আমি পড়তে বসালাম। পড়তে বসেই, শর্মী তার দাদা কী বলেছিল মনে করিয়ে দেয়। 
–  দাদাই না কইছিল ম্যাডাম, গজল হিকাইবার এবং অঙ্ক হিকাইবার।

আমার রান্না শেষ হল, শর্মীকে পড়া থেকে উঠিয়ে দুজনে খেয়ে উঠলাম, এবং ইউটিউবে গিয়ে গজল শুনলাম অনেকবার। রাতভোর শর্মীকে গজল শিখালাম। শর্মীর গানের গলা সুন্দর। সহজে গজল একটার পরে একটা শিখে নিল। মাটির বাড়ি, আমার মাটির বিছানা যতোবার শুনলাম ততোবার চোখে দেখা যতো কবরস্থান সব ভেসে উঠল।অথচ ভয় লাগছে না।  শর্মী ভুলে গেল অন্ধকার নামা, ভয় নামা শব্দগুলো। 

সুর ধরে গজল গাইছে এক মনে। বিশাল দহ ধারণ করে যে গ্রাম সেখানে  অন্ধকার ইতিমধ্যে জমাট পাথর হয়ে যেতে শুরু করেছে। প্রকৃতিরও নিদ্রা আছে।  শর্মীর কন্ঠ কোথাও কোন দূর পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে আবার। আমার দরজা জানালা সবই বন্ধ। কিন্তু নির্ভয়ে ফিরে আসছে সুরের প্রতিধ্বনি । 

মাটির বাড়ি মাটির ঘর মাটির হবে বিছানা
আসছো একা যাইবা একা সঙ্গে কেউ তো যাবে না

জীবন মৃত্যু ভাষা বন্যা পলি শিক্ষকতা এবং গজল  সহ সুনসান অজ পাড়া গাঁয়ে আমার  আরেকটি দিন শেষ হল। 

জেসমিন নাহার

তরুণ গল্পকার। উপন্যাস লিখনেও হাত দিয়েছেন। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকাতেই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের যশোহর জেলার শার্শা উপজেলায় বাড়ি। গোরপাড়া সর্দারবাড়ির মেয়ে। বাবা নুরুল ইসলাম (রহঃ) চিশতিয়া তরিকার ফকির ছিলেন। সেই কারণে ফকিরি ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছ। মা রওশানারা বেগমের সঙ্গে বাস করেন জেসমিন। আধুনিকতার মধ্যে নামসাকিন হারিয়ে বিমূর্ত হতে চান না। প্রকৃতির মাঝে যাপিত জীবনকে মূর্তভাবে পরখ করতে চান। গদ্যেও জীবনের মূর্তভাবকে প্রকাশ করার ইচ্ছায় লেখালেখি করেন।

Share