আজ বৃহস্পতিবার, ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাঘবে

।। খুকুমনি হাঁসদা।।

আসলে ক্রমশ উচ্চবর্ণতন্ত্র ও ঔপনিবেশিকতার আগ্রাসনে কালো-বাদামি চামড়ার মানুষের অবৈদিক পরম্পরা লুঠ হয়ে যাওয়ার ইতিহাসচেতনাই মেঘনাদের হত্যার অন্দরে রয়ে গিয়েছে। রামায়ণের বিনির্মাণে রচিত মেঘনাদবধ কাব্যে চাইলেই মধুকবি মেঘনাদ ও তাঁর বাবা রাবণের বিজয় দেখাতে পারতেন। কিন্তু তিনি সে পথে হাঁটেননি। বরং অনার্যের ট্র্যাজিক পরাজয়, অনার্যের ভূমিজ সম্পদ, প্রাচুর্য ও স্বাধীনতা লুঠ হয়ে যাওয়ার ঐতিহাসিক চেতনাই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর মহাকাব্যে। কিন্তু তিনি রাক্ষস রাজপুত্র ও রাক্ষসকুলপতিকেই জাতীয় বীর হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। অন‌্যদিকে তিনিই প্রথম বাংলার সাহিত‌্যকলায় উন্মোচিত করেছেন মায়াবী কূটকৌশলের রাজা, সন্ন্যাসীর ভেকধারী রাম, লক্ষণের আগ্রাসনকে। মাইকেলের ইন্দ্রজিৎ হয়তো বা স্বাধীন নবাব সিরাজ। আর বিভীষণ হয়তো-বা মির্জাফর, নবকৃষ্ণ দেব, জগৎ শেঠ, কৃষ্ণচন্দ্রের মতো বাংলার জাতীয় বেইমানরা। যেখান থেকে এ লেখা শুরু হয়েছিল, সে কথা আবারও উল্লেখ করতে হয়, মাইকেল সেই পরম্পরার মানুষ, যিনি স্বেচ্ছায় সাংস্কৃতিকভাবে শ্রেণিচ্যুত। যিনি গোত্রবাদের বা বৈদিক ধর্মকাঠামোর বিরুদ্ধে শুধু সাহিত্যে জেহাদ করেই ক্ষান্ত থাকেননি, বরং ব্যক্তিজীবনে কুলীন কায়েত পরিবারের সন্তান হয়েও আব্রাহামিক ধর্মের একটিতে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। যা জাতিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর জেহাদ একদিকে, অন্যদিকে সাংস্কৃতিকভাবে শ্রেণিচ্যুত হওয়া…

রুষিলা দানব-বালা প্রমীলা রূপসী;–
“কি কহিলি, বাসন্তি? পর্ব্বত-গৃহ ছাড়ি,
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,
কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?
দানব-নন্দিনী আমি,রক্ষ-কুল-বধূ;
রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী,–
আমি কি ডরাই,সখি,ভিখারী রাঘবে?
পশিব লঙ্কায় আজি নিজ ভূজ-বলে;
দেখিব কেমনে মোরে নিবারে নৃমনি?…

মেঘনাদবধ কাব‌্য, তৃতীয় সর্গ

আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাঘবে

কুলীন কায়স্থ বংশে জন্মগ্রহণ করেও যিনি বাংলায় সাংস্কৃতিক শ্রেণিচ্যুত হওয়ার বিপ্লবী পরম্পরায় বৈদিক ধর্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, এবং বৈদিক ধর্মের আইকন শ্রীরামের পক্ষ অবলম্বন না করে রাক্ষস কুলপতি রাবণ ও তাঁর বীরপূত্র ইন্দ্রজিতের পক্ষ নিয়েছিলেন, সেই মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম দ্বিশতবর্ষ পূর্ণ হল। তাঁর জন্মের একশত বছর পরে উপমহাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি ও সংঘ পরিবার তৈরি হয়। কিন্তু বঙ্গীয় তথা উপমহাদেশীয় কমিউনিস্টরা একশো বছরের মধ্যেই ইতিহাসে ফের কোণঠাসা হলেও সংঘ পরিবার তাদের সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংকে সফল করেছে ইতিমধে‌্যই। মেঘনাদবধ কাব্যের জনক মধুকবির যখন জন্ম দ্বিশতবর্ষ পূর্ণ হচ্ছে, তখনই অযোধ্যায় উদ্বোধন হয়েছে রামমন্দির। ১‌৯৯২ সালে গোটা উপমহাদেশ বিপণ্ণ বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিল, একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে ভেঙে দুরমুশ করে ফেলার ছবি! আর তার বত্রিশ বছর পর একজন গণহত্যাকারীর নেতৃত্বে রামমন্দির উদ্বোধনের ছবিটাও পরখ করল দক্ষিণ এশিয়া-সহ গোটা দুনিয়া। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চরিত্রকে পুরোপুরি খণ্ডন করে ক্রমশই ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ কায়েম হয়ে যাওয়ার মাঝে চাপা পড়ে রইল অনেক অশ্রু, হাহাকার, উচ্ছেদ, গুমখুন থেকে শুরু করে অনেক বিশ্বাস, আচার, সংস্কৃতি মুছে ফেলার চিত্রাবলি। বহু কামরা বিশিষ্ট রেলগাড়ির মতো ভারত আর দৃশ্যমান নয় বরং একটিই সুদীর্ঘ বিলাশবহুল কামরায় বিত্তশালী, প্রভাবপ্রতিপত্তিময় মানুষদের নিয়ে নতুন করে যাত্রা শুরু করছে ভারত। বলতে বাধা নেই যে সংঘ পরিবার তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে অনেকাংশেই সফল হয়েছে ইতিমধ্যেই। যুক্তরাষ্ট্রিয় কাঠামোর ভারতের বিনির্মাণে একদেশ, একজাতি ও একধর্মের পূর্ণ ঐপনিবেশিক জাতিরাষ্ট্র কায়েম করার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা। আর তাদের এই কাজের সামনে চিরবাধা হিসাবে যে বঙ্গ ছিল চির ঋজু হয়ে, তা ঔপনিবেশিক প্রভুদের সাহায্যে ৭৫ বছর আগেই ভাগ হয়েছে। আর এখন ভারতের মধ্যে থাকা সকল বঙ্গীয় অঞ্চলের অবৈদিক সাংস্কৃতিক পরম্পরা ও সমাজতাত্ত্বিক চরিত্রকে মুছে দিয়ে বঙ্গদেশের খণ্ডিত অংশগুলোকেও হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের পাকস্থলীর অন্তঃস্থ করতে প্রবলভাবে তৎপর গেরুয়া শিবির। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে মাইকেলের জন্মদ্বিশতবর্ষ সম্পূর্ণ হল। যাঁর সৃষ্টির মণিমুক্তোমালার মধ্যে চিরউজ্জ্বল মেঘনাদবধ কাব্য। যেখানে রাবণ বীর, নীতিবান, কূলবান, প্রবল জ্ঞানী এবং তাঁর পুত্র বীর, সম্মুখ সময়ে যিনি আগ্রাসী রামের মোকাবিলা করতে গিয়ে শাহাদত বরণ করেন। যে মহাকাব্যে রাবণজায়া ‘ভিখারি’ বলে রামকে চিহ্নিত করেন, যে মহাকাব্যে রাক্ষসদের জয়গান ধ্বনিত হয়েছে হয়েছে বারবার। সেই মধুকবিকে আজকের প্রেক্ষিতে স্বল্প পরিসরে স্মরণ করা যাক।

যশোহরের সাগরদাঁড়ি গ্রামের কুলীন কায়েত পরিবারের সন্তান মধুসূদনের জীবনে তাঁর অমর সব কব্য ও নাটক সৃষ্টির বাইরে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ধর্মান্তরিত হওয়া। যদিও খ্রিস্টধর্মে তাঁর ধর্মান্তরিত হওয়া এবং পাশ্চাত্য সাহিত্য ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার নিরিখে কেউ কেউ তাঁকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঘনিষ্ঠ হিসাবেও দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু তাঁর জীবন ও সৃজনসমূহ পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, তাঁর ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি আসলে চতুর্বর্ণভিত্তিক বৈদিক জাতিবাদী ধর্মকাঠামোর বিরুদ্ধে ইন্ডিভিজুয়ালের সাংস্কৃতিক জেহাদ।আব্রাহামিক প্রতিটি ধর্মের বৈশিষ্ট‌ হল, এই ধর্মগুলি গোত্রবাদ বিরোধী। সম্ভবত সে কারণেই একটি আব্রাহামিক ধর্মের ছত্রছায়ায় স্থিত হন তিনি। নির্দিষ্টভাবে খ্রিস্টধর্মের প্রতি তাঁর আগ্রহের পিছনে অবশ্য ইয়ং বেঙ্গল ও কলকাতার তৎকালীন তরুণ সমাজের আবহ প্রাথমিক ভূমিকা রেখেছিল। এছাড়া বহির্বিশ্ব ও সাংস্কৃতিক বহুত্বের প্রতি তাঁর আগ্রহ, মধুকবির জীবন ও সাহিত্য পর্যালোচনা থেকে প্রকট হয়ে ওঠে। তিনি একদিকে যেমন সংস্কৃত সাহিত্যের বাল্মিকী, কালিদাসের প্রতি শ্রদ্ধাবান, তাঁদেরকে তিনি কাব্যের উজ্জ্বল নক্ষত্রের আসনে ঠাঁই দিয়েছেন, তেমনই কৃত্তিবাস ওঝা থেকে শুরু বঙ্গের প্রাক আধুনিক এবং প্রাচীন কবি ও তাঁদের কাব্যের ব্যাপারে তাঁর অনুরাগ তিনি বারবার ব্যক্ত করেছেন। আবার একইসঙ্গে ইংরাজি সাহিত্যের রোম্যান্টিক কবিদের ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ তাঁকে প্রভাবিত করেছে। ছাত্রবস্থায় বায়রনের ভক্ত হয়ে ওঠেন তিনি। পরে পাশ্চত্যের মহাকাব্যগুলো থেকেও প্রাণিত হয়েছেন। আসলে বৃহৎ বঙ্গ তার সমাজ জীবনে, বাণিজ্যে ও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানে ঔপনিবেশিক শাসনের বহু আগে থেকেই আন্তর্জাতিকতাবাদকে ধারণ করেছে নিজের মতো করে। ভাণ্ডে স্থিত হয়ে ব্রহ্মাণ্ডকে নিরীক্ষণ করা বঙ্গদেশের স্বভাবজাত। তাই গুটেনবার্গিয় টেকনোলজি বা মুদ্রণমাধ্যম বিকাশের পর বাংলা কাব্যে মধুসূদএর আত্মপ্রকাশেই তাঁর সাহিত্যসৃজনের লক্ষ্য করা গিয়েছে বৃহৎ বঙ্গের সেই সাংস্কৃতিক ঔদার্যকে। মাইকেল একদিকে যেমন বহুত্ববাদী, আন্তর্জাতিক, অন্যদিকে নিজদেশ ও তার সংস্কৃতির কাছে নিজেকে স্থিত রেখেছেন। মাতৃভাষার ও বঙ্গদেশের প্রতি তাঁর মমত্ব সর্বজনবিদিত। একই সঙ্গে মাইকেল স্থানীয় ভাষাব্যবস্থা বা বাংলার নিজস্ব ভাষিক বৈচিত্র্যকে ধারণ করেছেন, অন্যদিকে আরবী, ফার্সি থেকে শুরু করে ল্যাটিন, ফরাসি, ইতালিয় ভাষা ও সাহিত্য থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছেন অবলীলায়। প্রাথমিকভাবে পশ্চিমা সভ্যতার প্রতি তাঁর অনুরাগ যে ছিল, এ সত্য লুকিয়ে যাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু বাদামি-কালো চামড়ার মানুষের ভূমি বঙ্গদেশ ও বাংলা ভাষাকে তিনি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন নিজের উপলব্ধি ও কলাজগতে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানের মধ্য দিয়ে। যে রাজনীতি হল বর্ণাশ্রমবাদী বৈদিক ধর্মের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ।

এই সেই মাইকেল, যিনি নিজেই একদা ইয়ংবেঙ্গল দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, আবার পরবর্তীতে ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ নাটকে নব্য ইয়াঙ্কি বাবু সমাজকে নিয়ে তীব্র প্রহসন তুলে ধরেছেন। মনে করা জরুরি যে উনিশ শতকের দোড়গোড়ায় তৎকালীন পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত নাগরিক তরুণ প্রজন্ম ইওরোপীয় আলোকায়ন সূত্রে একদিকে ‘যুক্তিবাদ’ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে অন্যদিকে তাঁদের মধ্যে দেখা গিয়েছে প্রগতীর নামে উশৃঙ্খল আচরণ ও সমাজবিচ্ছিন্নতা। গোত্রবাদ বা জাতিবাদ দূরীকরণ, স্ত্রীশিক্ষা প্রণয়ন, বিধবা বিবাহ ইত্যাদি ইতিবাচক সক্রিয়তার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হলে যে ‘চারিত্রিক দৃঢ়তা’র দরকার ছিল, তা অনেকাংশেই ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত নগরকেন্দ্রিক নব্যবাবু সমাজের মধ্যে। আর তাই ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ নাটককে ইয়াঙ্কি নব্যবাবু সমাজকে নিয়ে প্রহসনের চূড়ান্ত রচনা করেন মাইকেল। অন্যদিকে ‘বুডো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকে একদিকে চতুর্বর্ণ কাঠামো নির্ভর বৈদিক ধর্মের কূপমণ্ডূকতা, ভণ্ডামি, লাম্পট্য এবং অসাড় সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। নাটকটির প্রথমে নাম ছিল ‘ভগ্ন শিব মন্দির’। বিশিষ্ট প্রবান্ধিক ক্ষেত্র গুপ্ত জানাচ্ছেন, “মধুসূদন একটি চিঠিতে বুড়ো শালিকের একটি পৃথক নামের উল্লেখ করেছিলেন— ‘ভগ্ন শিবমন্দির’। লিখবার সময় এই নামই দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু যখন ছাপা হয়ে বের হল, দেখা গেল বর্তমান নামই রয়েছে। নাম কেন বদলানো হল জানা যায় না। এমন হওয়া অসম্ভব নয়, লেখকের পৃষ্ঠপোষকরা হিন্দু সমাজের মাথা ছিলেন এবং ‘ভগ্ন শিবমন্দির’ নামটি তাঁদের পছন্দ হয় নি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে নাটকের চূড়ান্ত কাণ্ড ভাঙা শিবমন্দিরের কাছে ঘটেছিল বলেই এরকম নামকরণ, কিন্তু এর গভীরতর তাৎপর্য অনুভব করা যায়। একটা বিশেষ ভাঙা মন্দিরের সামনে কি ঘটল, তার চেয়ে বড় কথা ভক্তপ্রসাদেরা তাদের ভণ্ডামি, মিথ্যাচার আর সনাতন আদর্শের নামে তার সত্যে নিত্য আঘাত করে হিন্দুদের মনুষ্যত্বের আদর্শ শিবমন্দিরটি রোজই ভাঙছিল। এ প্রহসন তাই ‘ভগ্ন শিবমন্দিরের’ কাহিনী।” অর্থাৎ ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনার আগেই বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকটির মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্য বা উচ্চবর্ণের সমাজের অন্তর্গত কদর্য রূপের প্রকাশ করেছেন মাইকেল। এবং তারপর মেঘনাদবধের করুণ ট্র্যাজিডি রচনা করতে গিয়ে তিনি ছত্রে ছত্রে রামায়ণকে মোকাবিলা করেছেন।

আসলে ক্রমশ উচ্চবর্ণতন্ত্র ও ঔপনিবেশিকতার আগ্রাসনে কালো-বাদামি চামড়ার মানুষের অবৈদিক পরম্পরা লুঠ হয়ে যাওয়ার ইতিহাসচেতনাই মেঘনাদের হত্যার অন্দরে রয়ে গিয়েছে। রামায়ণের বিনির্মাণে রচিত মেঘনাদবধ কাব্যে চাইলেই মধুকবি মেঘনাদ ও তাঁর বাবা রাবণের বিজয় দেখাতে পারতেন। কিন্তু তিনি সে পথে হাঁটেননি। বরং অনার্যের ট্র্যাজিক পরাজয়, অনার্যের ভূমিজ সম্পদ, প্রাচুর্য ও স্বাধীনতা লুঠ হয়ে যাওয়ার ঐতিহাসিক চেতনাই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর মহাকব্যে। কিন্তু তিনি রাক্ষস রাজপুত্র ও রাক্ষকুলপতিকেই জাতীয় বীর হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। অন্যদিকে তিনিই প্রথম বাংলার সাহিত্যকলায় উন্মোচিত করেছেন মায়াবী কূটকৌশলের রাজা, সন্ন্যাসীর ভেকধারী রাম, লক্ষণের আগ্রাসনকে। মাইকেলের ইন্দ্রজিৎ হয়তো বা স্বাধীন নবাব সিরাজ। আর বিভীষণ হয়তো-বা মির্জাফর, নবকৃষ্ণ দেব, জগৎ শেঠ, কৃষ্ণচন্দ্রের মতো বাংলার জাতীয় বেইমানরা। যেখান থেকে এ লেখা শুরু হয়েছিল, সে কথা আবারও উল্লেখ করতে হয়, মাইকেল সেই পরম্পরার মানুষ, যিনি স্বেচ্ছায় সাংস্কৃতিকভাবে শ্রেণিচ্যুত। যিনি গোত্রবাদের বা বৈদিক ধর্মকাঠামোর বিরুদ্ধে শুধু সাহিত্যে জেহাদ ঘোষণা করেই ক্ষান্ত থাকেননি, বরং ব্যক্তিজীবনে কুলীন কায়েত পরিবারের সন্তান হয়েও আব্রাহামিক ধর্মের একটিতে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। যা জাতিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর জেহাদ একদিকে, অন্যদিকে সাংস্কৃতিকভাবে শ্রেণইচ্যুত হওয়া। তাঁর বহু আগে নদীয়ায় শ্রীচৈতন্য ব্যক্তিজীবনে ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হয়েও শঙ্করাচার্যের চিন্তাকাঠামোর বিরুদ্ধে বৌদ্ধিক স্তরে লড়াই করার পাশাপাশি ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে লড়াই করেছেন। নিজের পৈতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন জলে। সাংস্কৃতিকবাবে শ্রেণিচ্যুত হওয়ার এই পরম্পরাই অনুসরণ করেছেন মাইকেল। অথচ তাঁর জন্মের একশো বছরের মধ্যেই বাংলায় ঔপনিবেশিক শিকড় সুগভীরে প্রথিত হয়ে যায় এবং উপমহাদেশে জন্ম নেয় ব্রাহ্মণ্যবাদী সংঘ পরিবার। বাংলার ঔপনিবেশিক রাজনীতির ইতিহাসে অপ-আবির্ভাব হয় জাতীয় বেইমান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। যার দলবলের ঠ্যাঙ খোঁড়া করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন নেতাজী সুভাষ, সেই শ্যামাপোকার দলবলেরা মাইকেলের জন্মের দ্বিশতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার ২০২৪ সালে শুধু রামমন্দির তৈরি করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং এনআরসি, সিএএ ইত্যাদির মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিনিবিড় নমশূদ্র বাঙালি, আদিবাসী ও বাঙালি মুসলিমকে বাস্তুচ্যুত করার পাঁয়তারা করছে। ১৯২৪-২০২৪– এই কালপর্বে সংঘ পরিবার তাদের মতো করে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রকে হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানি ব্রাহ্মণ্যবাদী ও মনুবাদী সমাজকাঠামোয় বিনির্মাণ করার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু ঠিক এই কালপর্বেই কমিউনিস্ট পার্টির আবির্ভাব, বিকাশ, বিভাজন ও ক্রমশ পিছু হঠার সাক্ষীও থেকেছে আমজনতা। কেননা, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের দেশীয় প্রয়োগ এবং একানকার ভাববস্তুর দ্বৈতলীলার পটভূমিকে উপেক্ষা করেছে এবং এঙ্গেলসীয় চশমায় ইওরোপের ইতিহাস পর্যালোচনার ছকে বঙ্গ তথা উপমহাদেশের ইতিহাস ও সমাজ বিবর্তন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সোকল্ড বামপন্থীরা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে ক্রমশ। ঔপনিবেশিক লুঠ ও উপনিবেশবাদের দেশীয় তাঁবেদারদের প্রতিহত করার পাশাপাশি আগ্রাসী বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতিকে রুখতে গেলে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কপিল মুনি, মৎস্যেন্দ্রনাথ, গৌতম বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য, নিত্যান্নদ, লালন সাঁই, রামকৃষ্ণ, হরিচাঁদ ঠাকুরদের চিন্তা-চর্চা ও স্ট্রাগেল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। বঙ্গে ইসলামের আগমন, সমাজ জীবনে তার ইতিবাচক প্রভাব এবং নবী মোহাম্মদের দার্শনিক ও রাজনৈতিক আবেদনগুলোকে বাংলা প্রেক্ষিতে আমলে নিতে হবে।

এমনকী বাংলার শিল্প-সাহিত্যের সংস্কৃত বাবুয়ানি ও ইওরোসেন্ট্রিক পশ্চিমা ভাবের বিনির্মাণ ঘটিয়ে আমাদের পারম্পরিক মহাকাব্য, মঙ্গললকাব্য, পুঁথি, পাঁচালি, ছড়া, পটচিত্র, পারম্পরিক পারফর্মিং আর্ট ইত্যাদিকে ব্যবহার করে গণমানুষের গণস্মৃতি থেকে অবলুপ্ত অবৈদিক দেশীয় পরম্পরাকে আবার জাগ্রত করতে হবে। তাহলে শেষতক মেঘনাদ আর বধ হবে না, বরং ভিখারী , বিজাতীয় রাম দেশ ছাড়া হবে। বঙ্গে থাকবেন রাধাকৃষ্ণের মতো করে কৃত্তিবাসী সীতারাম। যে রাম সীতার বিহনে বিলাপ করেন, যে রাম স্ত্রৈণ। যে রাম শম্বুককে নিচু জাতের মানুষ বলে মুণ্ডচ্ছেদ করেন না। যে রাম প্রাণারাম হয়ে জীবের অন্তরে সদাহাস্যময় হয়ে থাকেন বিরাজমান।

খুকুমনি হাঁসদা

প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী। পেশায় সাংবাদিক। বাড়ি রাঙামাটি, বাংলাদেশ। বাসা কলকাতা।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top