।। জেসমিন নাহার ।।
নৌকায় মানুষ পারাপার চলছে। জেলেরা একমনে মাছ ধরছে। কচুরিপানা এক এলাকা থেকে স্রোতে ভেসে অন্য এলাকায় যেতে ব্যস্ত। সূর্য একেবারে আগুনের গোলার মতো। নিজেকে আত্মগোপন করবার আগে ঝিম ধরে বসে আছে। প্রায় ১৭৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বংশাই শুরু হয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে। তারপর জামালপুর-টাঙ্গাইল-গাজীপুর দিয়ে তুরাগ নদীতে মিশে গেছে। টাঙ্গাইলে তার অংশ রয়েছে ৭৬ কিলোমিটার। যার প্রায় পুরোটাই এখন দখলে কিম্বা মরাখালে পরিণত হয়েছে। ধনবাড়ী হয়ে মধুপুর দিয়ে বাসাইল ও মির্জাপুর দিয়ে বয়ে গেছে বংশাই নদী। বর্ষা মৌসুমে নদীটিতে কিছুদিন পানির প্রবাহ থাকে, বছরের বাকি সময় ময়লা আবর্জনায় ভরা থাকে আর চাকদহের মতো গ্রামে অসুখবিসুখ ছড়ায়।
বংশাই
বংশাই নদী। বর্ষাকালে পানিতে ফুলে ফেঁপে ওঠা নদী, শরৎকালে তার যৌবন খোয়ায়। তবু তেজ এক ফোঁটা কমে না। আপন বেগে কচুরিপানার বোঝা টেনে নিয়ে যাচ্ছে, কচুরিপানাগুলোও ফুর্তি করতে করতে তার পিছে ছুটছে। বংশাইয়ের তীরে একটা বজরা বাঁধা। কাঠের বজরায় মেশিন বসানো নৌকা, যার বর্তমান নাম শ্যালো।
শ্যালোয় বসে আছে দুজন কিশোরী। আর কয়েকজন শিশু। শ্যালোর একটু দূরে চড়কজাল পেতে বসে আছে এক কিশোর। কিশোর চড়কজাল তুলছে আর কিশোরী দুজন হেসে উঠছে। জালে মাছ উঠছে না। উঠছে একটা দুটো কাকিলা মাছ আর উঠছে অলস কিন্তু শক্ত খোসার মধ্যে সুরক্ষিত শামুক।
কাকিল্ল্যা বা কাকিলা মাছের ঠোঁট লম্বা, কিন্তু সেখানে চোখা চোখা অনেকগুলো দাঁত আছে। কাকিলার শরীর উপরের অংশ হালকা নীল, পড়ন্ত বেলার রোদে এখন তা কিঞ্চিৎ কালচে। নিচের অংশ সাদা। পানিতে দৌড়ায় দ্রুত। কিন্তু জালে ধরা পড়ল। কিশোরিদের হাসি কিশোরকে বিশেষ বিচলিত করে না। কারণ খেতে বেশ মজা। কিশোর মাছ দুটো নিয়ে হাতে কিছুক্ষণ নড়াচড়া করে। বেশীক্ষণ না। কিছুক্ষণ ধরে রাখলে এই মাছের শরীর থেকে প্যাঁচাটে গন্ধ আসে।
নদীর পারের গ্রামে সব জালই আছে। এমনকী কারেন্ট জালও। কারেন্ট জালের ব্যবহার প্রায় বিশ বছর আগে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যুক্তি আছে। পরিবেশবিদ ও মাছের বিজ্ঞানিরা ইলিশ, মিঠাপানি ও সামুদ্রিক মাছ বিলুপ্ত হওয়ার জন্য এই জালকে দায়ী করছেন। রাষ্ট্রকে নয়, কারণ গরিবের জীবিকা নিশ্চিত করবে কে? মানুষের সঙ্গে মাছেদের একটা যুদ্ধ জারি আছে। এই যুদ্ধে কে কার পক্ষে নির্ণয় করা কঠিন।
তবে এই মুহূর্তে কিশোর কিশোরিদের মনোযোগ কাকিলা মাছের প্রতি। জালে মাছ উঠছে না সেই জন্য তাদের তামাশার অন্ত নাই।
কারেন্ট জাল, চড়ক জাল, চায়না জাল, ঘের জাল, খেওয়া জাল সবই গ্রামে আছে। যখন যা দরকার। চড়ক জাল তৈরিতে বাঁশ প্রধান। মাছ ধরবার জন্য বসার ব্যবস্থা লাগে। তার জন্য বাঁশের তৈরি জায়গা থাকে। তিনদিকে তিনটা বাঁশ চলে যায়। এই তিন বাঁশ জাল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয় আপাদমস্তক। তিনটা ঘের হয় এক চড়কের। তাই পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়। মাছের ঝাক এলে তোলা হয়। কিন্তু ঝাঁক আসাটা জানা যায় না। তাই কিছুক্ষণ পর পর তুলে দেখতে হয়।
শ্যালোর চারপাশে ডানকানা মাছ ঘুরছে। বংশাইয়ের ধারের মানুষ ডানকানাকে চ্যালামাছ বলে। কিশোরী দু’জন পেয়ারার খোসা খেয়ে ফেলছে পানির মধ্যে। দাঁতে পিষ্ট করা পেয়ারার খোসা খাবার জন্য মাছেরা ভিড় জমাচ্ছে, খাবার সময় একে অপরের সাথে লড়াই বাঁধাচ্ছে। তাই দেখে কিশোর তার চড়কজাল ফেলে ডাক দেয় –
— ঐ লাইবাহ, ঐ জিনাত,
— একটু ছ্যাপ ফালাইয়া দ্যাখ, মাছের মইদ্যে, তাইলে মজা পাবি।
মাছেগো খেলা রাইখ্যা লাইবাহ এবং জিনাত তার দিকে তাকায়, কিশোর তখন জাল উঁচু করে। জিনাত জবাব দেয়,
— তর নাগাল গিদোড় না আমরা।
— চ্যালামাছ ছ্যাপই খায় মজা কইর্যা। দিয়া দ্যাখ খালি। মিছা না।
লাইবাহ আগ্রহ দেখায়।
— হ, জিনাত, মিছা না। এই মাছ ছ্যাপ খাইতেই পছন্দ করে।
জিনাতের মনে বিশ্বাস জাগানোর ইচ্ছা হয় লাইবাহর। লাইবাহ একটু থুতু ফেলে। চ্যালামাছ সব থুতুর মধ্যে মুখ রাখে। কিশোর হাসে। সেই হাসির মধ্যে চাকদহে শিশু কিশোরদের বাল্যলীলা এই অতিমাত্রায় অভাবি ও বাংলাদেশের মানচিত্রে প্রায় অদৃশ্য চাকদহ ঝলমল করে ওঠে।
—হাছা না?
বিশ্বাস তৈরি করা কঠিন বিষয়। কিন্তু এই গ্রামে বিশ্বাসের অর্থ হচ্ছে স্মৃতি ও বর্তমান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। শূন্যস্থানে পরকাল স্থাপন করা। তবুও দুয়েকজন বৃদ্ধ আছেন, যঁারা এক ভয়ানক ভূমিকম্পের কথা বলতে পারেন
— কবে?
— আঙ্গো বাপদাদাগোরও আগে।
গবেষকরা বলবেন ১৮০৫ সালে হতে পারে। সেই ভূমিকম্প থেকে বংশী নদীর উৎপত্তি। যার নাম এখন বংশাই।
দূরে তাকিয়ে ডাক দেয় কিশোর,
— ওই দ্যাখ জিনাত, এই লাইবাহ, হান্দার, বাইদা, বোদ যাইতাছে নাও দিয়া, ফচকা দ্যাখ চালাইতাছে কেমনে, হান্দারের লগে লাইবাহর বিয়া দিম, পায়খানা ছাপ কইর্যা বেড়াইবো। সেই টেস্ট নাগবো।
লাইবাহ একটা পেয়ারা কিশোরের গায়ে ছুঁড়ে মারে। কিশোর সরে যায়, কিন্তু হাত বাড়িয়ে পেয়ারা ধরে ফেলে।
— মারুফ, তুই এইটা কইতে পারলি, ছুট ভাই হয়া, আমার শশুর বাড়ি গেলেগা তরে খাইতে দিম না।
— না দিবা না। তহন পথ চাইয়া বয়া থাকবা, ভাই কহন আইবো, কহন আইবো।
— জিন্দেগীতে না।
দূরে জেলেরা জালি জালে মাছ ধরছে। চারিধারে জেলে আর জাল। জাল বাঁচিয়ে বংশাইয়ের নরম স্রোতে কচুরিপানা হাসতে হাসতে ভেসে যাচ্ছে। জিনাত সেদিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে,
— দ্যাখছোত লাইবাহ, মনে হইতাছে, কোন এক গেদি তার ব্যাক পুলাপান নিয়া বাবার বাইত্তে যাইতাছে গা।
— হ, রে জিনাত, দূর্গা যাইতাছে তার বাবার বাইত্তে।
— নারে দূর্গা না, চাইরমোড়্যা দুর্গাপূজার ঢাকঢোল বাজাইয়া হে তো আইসা বয়া হুইয়্যা চইল্যাও গ্যাছে গা।
— ওহো, দুর্গা আইছে তো ঘোড়ায়, এবার গ্যাছে গাও ঘোড়ায়। তাইলে স্রোতে যাইতাছে যে, হে আঙ্গো জিনাত।
জিনাত হাসে, হঠাৎ যেন বংশাইও জিনাতের হাসি শুনে তার স্রোত থামায়। পাখিরা দূর আকাশে উড়তে উড়তে জিনাতের দিকে চায়, জেলেরা মাছ ধরতে ধরতে মাথা উঁচু করে দেখে, আলাপ করে,
— কার ঘরের গেদি ওঙন্যা। মেয়েপান এতো জোড়ে হাসিতামশা করতাছে।
মারুফ উঠে দাঁড়ায়, চড়ক জালের বাঁশে টান দেয় একহাতে, আরেক হাত উঠায় জেলেদের দিকে,
— আঙ্গো পাড়ার গেদি গো। আমি আছি এনো ওগো পাহারা দিবার নাইগ্যা । এ লাইবাহ, এই জিনাত হাস তামশা কম কর, পাহাড়ের ব্যাক জাইল্যা হুইন্যা যাইতাছে গা। এদিকে চড়কে মাছ উঠতাছে না। হাস তামশা না কইর্যা নু যাই এল্যা, চ্যালামাছ ধরি।
লাইবাহ এবং জিনাতের মারুফের কথায় কোন আগ্রহ নাই। জিনাত এবং লাইবাহ কখনো হাসে, কখনো গল্প করে,
— জানোস জিনাত ফেইসবুকে একটা লেহা পড়ছি।
— কেমনে জানমু, আঙ্গো ফোন আমি কাইলক্যা বিকাল থেইক্যা ছুই নাই। কি জানছোস তুই?
শুনবার জন্য আগ্রহে হেলে আসে লাইবাহর দিকে,
— ক, চে হুনি।
— হিন্দু গো বিশ্বাস, দুর্গা বাহন হিসাবে ঘোড়ায় আইছে, ঘোড়ায় গেছে তার নেইগ্যা নাকি দেশে অশান্তি নাইগ্যা থাকবো।
— কয় কী? হাছায়?
জিনাত এবং মারুফ জোরে জোরে হাসে লাইবার কথা শুনে। কিন্তু লাইবা ভাবুক দার্শনিকের ন্যায় কচুরিপানা যাওয়া দেখে। তাকে দেখে মনে হয়,কিছুক্ষণ আগে সে কিছুই বলে নাই। মারুফ তার সাদা সব দাঁত বের করে,
— তুই বিশ্বাস করছত এডি লাইবা? হা হা হে হে।
—এই আমার আর লাইবার মইদ্যে তুই ছুট মানুষ,বাহাত পুরিস ক্যা মারুফ? চুপ থাক।
—হাসিতামশা বাদ দিই, নু এল্যা তিনজনে চ্যালাপুটি ধরি।
— দ্যাখছোত লাইবা! কয় কী! চ্যালামাছ ধরন কি সহজ নিহি? কঠিন। নৌকার মইদ্যে দুইমোড়্যা দুটো টিন দেও, বইঠ্যা দিয়া পানি হেচা দেও। হেচা দিলে মাছ সাদা টিনের ডেরায় যাবো, তারপর নিহি মাছ নৌকার মইদ্যে পড়বো।
— কিন্তু খাইতে তো মজা।
— মজা তো, তুই ধরগা। আঙ্গো কস ক্যা? আমরা মায়া মানুষ পারুম নিহি ধরতো?
দূরে, বংশাইয়ের ওপারে রাসোড়া থেকে মাঝিরা নৌকায় মানুষ তুলে বংশাইয়ের এপারে চাকদহে নামায়ে দিচ্ছে। পারাপারের নৌকার মাঝে একটা নৌকার দিকে হাত উঁচিয়ে মারুফ দেখায় জিনাতকে
—ওই যে নাও বায়া তর আব্বু আসতাছে, প্রেম করস যে মাদ্রাসায় যায়া, কয়া দিম।
— এ হ্যাঁ না, আব্বু যদি কিছু জিজ্ঞেস করে কইস না কিন্তু ।
— ব্যাক কিছু কয়া দিম, চুমাচাট্টির কথা।
— না, উন্যা না, এই পড়া কম পারি। এই বিষয়ে কয়া দিস, প্রেম বিষয়ে কিছু কইস না।
লাইবার ভাবুক ভাব চলে গেছে। সে জিনাতের দিকে তাকিয়ে পেয়ারা দিতে বলে, পেয়ারায় কামড় দেয়, আর জিনাতকে জিজ্ঞাসা করে
— হরতাল মানে বোঝোস? আমি কাইলকা পড়ছি ডিকশনারি থেইক্যা বাইর কইর্যা। দ্যাশের পরিস্থিতি খারাপ। তাই বিরোধী দল হরতাল দিছে। আবার অবরোধ মানেও হিকছি। সম্মেলন মানেও। দুর্গার বাহনের দুষ না, এল্যা দ্যাশের ক্রান্তিকাল, সুমটা খারাপ।
—অতা হরতাল, অবরোধ বুইঝ্যা আঙ্গো কাম নাইঙ্কা।
— কাম আছে। আমরা ছুট বইল্যা কুন্তা বুঝি না।
মারুফ চড়ক জাল তুললো। চড়ক জাল বারবার তোলা লাগে। বাঁশের সাথে জাল বেঁধে তিনকোনা সেওতির আকারের চড়কজাল। জিনাতের দাদি এসে বসে শ্যালোতে। মারুফকে জিজ্ঞাসা করে,
– ঝাঁক আহে মাছের?
কিন্তু জিজ্ঞাসায় শেষ। ঝট করে উঠে চলে যায়। জবাবের অপেক্ষা করে না। চড়ক জালে একটা কাকিলা মাছ উঠলো। কিন্তু জালের ফাঁকা জায়গা দিয়ে মাছটি পড়ে গেল। জাল তিনভাগে বিভক্ত। একভাগে কাকিলা উঠে পড়ে গেল। আরেক অংশে একটা শামুক উঠলো। শামুকটি দেখে জিনাত মারুফকে ডাক দেয়,
— মারুফ একটা ডিম উঠছে, ভাইজা খা।
— হামুক খাওন যায়। খাইছোত কহনো?
— এন্না গন্ধ, এন্না খাওন যায় না। তুই খাইছোত?
— সমুদ্রের ইছামাছ খাইছি।
লাইবাহ হাসি তামাশা দেখছিলো। বলল,
—ওরে গাধা নিহি তরা, ঐঙন্যা সমুদ্রের না, হাতক্ষীরার (সাতক্ষীরার) গলদা ইছা মানে চিংড়ি।
— ভাবুক, তোমার ভাবা শ্যাষ হইছে? কবি হইবা তুমি?
—ভাবমু না ক্যারে, তুই জানস যুদ্ধ হইতাছে?
— জানমু না ক্যারে? ব্যাক বুঝি তুই জানবি? ইউক্রেন আর রাশিয়ায় যুদ্ধ চলতাছে।
— যুদ্ধ চলতাছে ইজরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে। ব্যাক বুঝিনাইঙ্কা। কিন্তু মা, শিশু সহ ব্যাকটিরে ইজরায়েল মাইরা ফেলতাছে।
ছোটছোট বাচ্চারা ওদের কাছে ভিড় করতেই ওরা যুদ্ধের আলাপ ভুলে যায়। জিনাত ছোটদের বকা দেয়।
—জাগা তরা, আমরা দুনো মিইল্যা পারসোনাল গল্প করমু। বকাবাদ্য দিয়ে তাড়িয়ে দিলো বাচ্চাদের।
বাচ্চারা দূরে গেলো। কিন্তু শ্যালো থেকে নেমে গেলো না। তারা একপাশে বসে খেলা শুরু করলো। খেলার চেয়ে খিলখিল করে হাসছেই বেশি। নির্দিষ্ট কোন খেলা বাচ্চারা খেলতে পারে না। তাদের খেলা শুধু পরিবর্তন হয়। কখনো মাছ ধরাধরি, কখনো ডাল দিয়ে চড়কজাল বানিয়ে উঁচু করছে। উঁচু করতে গিয়ে পানিতে ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে। জিনাতের দাদি এসে বাচ্চাদের কাছে বসতে যায়। কিন্তু জিনাত তার দাদিকে ডাকে,
— ও দাদি, ও উজালা বুড়ি, তুমি হুদায় ঐহানে প্যাচাল পাড়বা ক্যারে? এইহানে আহো।
— বাচ্চাগো তাড়াইয়া দিলি যে?
— বাচ্চা আর তুমি কি এক হবার পারো? হুনো তুমি, একটা কথা কই?
— ক চেইন!
— আমি কি বেশি কথা কই?
জিনাতের বৃদ্ধ দাদি উজালা হাসে। উজালা তার নাতিনকে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলায়,
— আমার বোইনেরও দেহি আমার নাগাল অবস্থা। আমিও আমার বড়োদের কাছ থেহে অনুমতি নিয়ে কথা কইতাম। আমার বোইনের নাগালই স্বাভাবিক কথা।
জিনাত তার দাদির কাছ থেকে মাথা টেনে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছোটদের তাড়াতে। উজালাও উঠে চলে যায় বাড়ির দিকে।
— এই এহানে বড়ো মানুষ গল্প করে, এনো তোরা কি করস? এই যাবি তোরা যাবি! এই আরোবী যাবি?
নৌকায় মানুষ পারাপার চলছে। জেলেরা একমনে মাছ ধরছে। কচুরিপানা এক এলাকা থেকে স্রোতে ভেসে অন্য এলাকায় যেতে ব্যস্ত। সূর্য একেবারে আগুনের গোলার মতো। নিজেকে আত্মগোপন করবার আগে ঝিম ধরে বসে আছে। প্রায় ১৭৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বংশাই শুরু হয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে। তারপর জামালপুর-টাঙ্গাইল-গাজীপুর দিয়ে তুরাগ নদীতে মিশে গেছে। টাঙ্গাইলে তার অংশ রয়েছে ৭৬ কিলোমিটার। যার প্রায় পুরোটাই এখন দখলে কিম্বা মরাখালে পরিণত হয়েছে। ধনবাড়ী হয়ে মধুপুর দিয়ে বাসাইল ও মির্জাপুর দিয়ে বয়ে গেছে বংশাই নদী। বর্ষা মৌসুমে নদীটিতে কিছুদিন পানির প্রবাহ থাকে, বছরের বাকি সময় ময়লা আবর্জনায় ভরা থাকে আর চাকদহের মতো গ্রামে অসুখবিসুখ ছড়ায়।
দূরের জেলেদের কেউ কেউ মাছ নিয়ে ঘরে ফিরছে। মারুফ তার বাবাকে দেখে নদীর ওপারে। ডাক দেয়।
— বাবা, ও ও ও বাবা,আহো চেইন। বসো এহানে।
— আহি, ইট্টু বহো।
দুজন বালক মাছ ধরতে যাচ্ছে। তারা সুন্দর নৌকা বাইছে। আর মিটি মিটি হাসতে হাসতে রাসোড়ার দিকে যাচ্ছে। মারুফ বলে,
— এ রাফি, এ মুজাহিদ আব্বারে একটু পার কইরা দে চ্যান?
— না না পারুম না। আইচ্ছা দিই।
নৌকা বারবার আসছে আর যাচ্ছে। মানুষ বোঝাই হতে দেরি লাগছে না। দূরে একজন মানুষ চড়কজালে বসে আছে। বকের মতো। সূর্য মামা আমাদের কাছ থেকে আত্মগোপনে গেলো, এখন ইউরোপ, জাপানের দিকে এখন প্রকট হবে। বংশাই তার আপন গতিতে বয়ে যাচ্ছ। হাঁসেরা ঘরে ফিরছে। কিন্তু ভরা বর্ষায় এই হাঁস বংসাইয়েই ঘর বাঁধে। ঘরে আনতে হলে কৃষাণীর বড়ো বেগ পেতে হয়।
রাতের জ্যোস্নায় বংশাই রূপবতী।তার পানির স্রোতের ধারা শব্দ সৃষ্টি করে। সন্ধ্যায় পাহাড়িরা আসছে দলে দলে বংশাইয়ে মাছ ধরতে। চাকদহরা মাছ ধরে না বেশি। কিনে খায়। চাকদহরা নিজেদের ঘরে পালা মুরগি বিক্রি করে ব্রয়লারো কিনে খায়। ওদের কাছে ওদের বিশুদ্ধ জিনিসের দাম ই (টাকা) প্রধান, পুষ্টি নয়। চারিদিকে হঠাৎ একটা স্তব্ধ শান্তি নেমে আসে। যা সহজে গ্রাহ্য হয়। লাইবাহ এবং জিনাত কথা বলে।
— আহ এহন শান্তি..
— হরে, বংশীর ধার এহন সুন্দর, শান্ত।
তাদের এই শান্তি স্তুতির কারণ হল, এতোক্ষন একটাবাড়িতে ধানভাঙা মেশিন পরিবেশ উত্তপ্ত করে রেখেছিল। সেটা কেবলই বন্ধ হল
— দেহ চে লাইবাহ, কতাগুলান পাহি। অতিথি আইসা গ্যাছেগা। আহ,সন্ধ্যার পরিবেশ সুন্দর কইরা দিল।
—আইচকা দেখলি! ওই দ্যাহ আস (হাঁস) আর বক তর আমার নাগাল পাশাপাশি বইস্যা বন্ধু পাতাইছে।
— আইচ্চো, লাইবাহ, ঐ বকটা যে টাগৈর মইদ্দ্যে পলানটুক খেলছে ও কি ঐহানেই থাকব
— কী জানি, থাকব না কি করবো। নু জিনাত একদিন আঙ্গো নদীর মুখ দেইখ্যা আসি। বংশীর মুখ দেখমু না কখনো এডি মাইন্যা নেওন যায় না।
হাজারো সারস মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। মারুফ ঘুরে ফিরে আবার তার বাবার কাছে আসে। তার বাবাকে উঠিয়ে দেয়। চড়কজালের পাটাতনে বসে হাতে ধরে রাখা মশার কয়েল ঈগলের প্যাকেট খোলে। সেখান থেকে দুটো জড়ানো কয়েল খুলতে গিয়ে একটা ভেঙে যায়। রাগ করে।
— দূরো কয়েল।
— এ মারুফ আমার কাছে দে, খুইলা দিম।
— নিয়া যা চেইন।
জিনাত মারুফের কাছ থেকে মশার কয়েল নিয়ে,প্যাচ খুলে, ম্যাচ দিয়ে ধরিয়ে চড়কজালে ঝুলিয়ে রাখা কয়েলের পাত্রে লাগিয়ে দিল। শ্যালো নৌকায় লাইবার কাছে ফিরে আসবার সময় রাস্তার দিকে চেয়ে দেখে এক কিশোর।
— এ লাইবাহ,ওই দ্যাখ সাব্বির!
— আর একদিন ওই ছ্যামড়া নিয়া আমার লগে হাস তামশা করলে দেহিস কী করি!
— আমার দুষ কী? আমারে খালি কবার কইছে, আমি কইছি।
— আমি নগে নগে না করছি তবু তুই হাস তামশা করস ক্যা?
— এ জিনাত, এ লাইবাহ তোরা নাড়াই করস ক্যা? সাব্বির লাইবারে প্রেম প্রস্তাব দিসে?
— না, ঝিঁঝিঁ পোকা উড়ছে। তাই নেইগ্যা কইতাছি, লুবনা নু বাড়ি যায়গা। কিন্তু যাইতাছে না তাই ঝগড়া করতাছি।
— হ, এইন্যা রাত্রে টি টি করে।
— এইন্যাগো ঝিঁঝিঁ না ভুরুঙ্গি কয়।
ঘুঘরো পোকাকে ঝিঁঝিঁ পোকা নাকি ভুরুঙ্গি পোকা বলে তাই নিয়ে ওদের মাঝে বাকবিতন্ডা চলছে। সূর্য অনেক আগেই নিজেকে ডুবিয়েছে। বক ঘরে ফিরছে। চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। মাঝিরা নৌকা পারাপারে ব্যস্ত এখনো। প্রজাপতি রাত সন্ধ্যা বোঝে কিনা জানিনা। শরীর ছুঁইছে। শিশুরা চিৎকার করছে,
— প্রজাপতি জিনাত বুবুরে ছুঁইছে, বুবুর বিয়া হবো।
নদীর পাড়ের মহিলারা তাদের সান্ধ্যকালীন কাজ গোছাতে ব্যস্ত। চারিদিকে মাগরিবের আজান পড়ছে। একসাথে সব মসজিদে। লাইবাহ এবং জিনাত মাথায় কাপড় দিচ্ছে। গৃহিনী মহিলারাও মাথায় কাপড় দিতে ব্যস্ত।
মারুফ মাথায় তিনবার আল্লাহ বলে থাবা দিল। ওরা কোনমতেই শয়তানকে ওদের শরীরে প্রশ্রয় দেবে না। আজান শেষ হয়। ওরা ঘরে ফেরার তাড়া বোধ করে। শ্যালো থেকে ধুপ ধাপ নামে। মারুফ মশা মারার ধোঁয়া ওঠা বিষের মাঝে বসে চড়কজালের দিকে চেয়ে বসে থাকে।
কচুরিপানা বংশাইয়ের স্রোতে ক্রমাগত ভেসে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামছে। কচুরিপানার ভেসে যাওয়ার বিরাম নাই। কচুরিপানারও কাজ আছে নিশ্চয়ই। বংশাইয়ের ভুলে যাওয়া স্মৃতি বা ইতিহাসের সন্ধান করে যাওয়া। সন্ধ্যার পর রাত নামবে। কিন্তু কচুরিপানার অভিযান চলবে।
জেসমিন নাহার
তরুণ গল্পকার। উপন্যাস লিখনেও হাত দিয়েছেন। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকাতে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের যশোহর জেলার শার্শা উপজেলায় বাড়ি। গোরপাড়া সর্দারবাড়ির মেয়ে। বাবা নুরুল ইসলাম (রহঃ) চিশতিয়া তরিকার ফকির ছিলেন। সেই কারণে ফকিরি ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছ। মা রওশানারা বেগমের সঙ্গে বাস করেন জেসমিন। আধুনিকতার মধ্যে নামসাকিন হারিয়ে বিমূর্ত হতে চান না। প্রকৃতির মাঝে যাপিত জীবনকে মূর্তভাবে পরখ করতে চান। গদ্যেও জীবনের মূর্তভাবকে প্রকাশ করার ইচ্ছায় লেখালেখি করেন।