আজ বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

গারো পাহাড়ের চিঠি

।। জ্যোতি পোদ্দার ।।

চুনিকণ্ঠির মতো একটু উষ্ণতার জন্য তারা আসেননি। তারা এসেছিল নিপীড়নে। জানমাল সম্ভ্রম নিয়ে পালিয়ে এসেছিল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে। তখন জমিনে দাগ দেয়া হয়ে গেছে। এপার আমার ওপার তোমার। যার যার তার তার আলাদা উঠান। রাজনীতি কেমন অদ্ভুত!  মানুষের জন্য মানুষের দ্বারা রাজনীতি হুট করেই দাগ দিল জমিনে। তোমার মত ভিন্ন তোমার ধর্ম ভিন্ন তোমার জাত আলাদা। তুমি পশ্চিম মুখী– যে মানুষ আরেক মানুষের পাশাপাশি আপনজন– সেই-ই দাগ কেটে এপার ওপার গড়লো মত-ভিন্নতার সংসার। হিংসা-দ্বেষ আর ঘৃণার চাদরমোড়া দেশ– যার যার দেশ। রাজনৈতিকতা এভাবেই আপনজনকে দাঁড় করাল একজনের মুখোমুখি অন্যজনকে। জমিনের দাগ কী ভয়াবহ!

নাম তাঁর চুনিকণ্ঠি।একবার এখানে  পরক্ষণেই হাওয়া। এই যে দাঁড়িয়ে আছি তাঁর আর দেখা পাই না। চারদিকে এতো এতো ঘন ঝোপঝাড় আর ফ্যাকাশে অন্ধকার যে খুব দ্রুত ও বারবার স্থানও পরিবর্তন করতেও পারছি না। কিঞ্চিৎ শব্দ হলেই শহিদ ভ্রু কুঁচকে বলছে, ‘চুপ, চুপ– একদম চুপ’। আমি স্থির দাঁড়িয়ে আছি জলার ভেতর চারদিকে জঙলাঘরের বেষ্টনী মাথায় নিয়ে।

জয় ক্যামেরা তাক করে আছে অনেকক্ষণ। চোখ স্থির। আঙুলও রেডি।ফ্রেমের ভেতর এলেই ক্লিক ক্লিক। স্যাঁতস্যাঁতে জলাশয় থেকে কেমন যেন গন্ধ নাকের ভেতর আসতেই আমার গা গুলাতে শুরু করল। চারদিকে লতাগুল্মের বনতল ছাতার মতো করে মেলে আছে। কাল রাতের বৃষ্টির পরশে সবুজ পাতা থেকে টুপটাপ জলে শরীর ভিজে গেছে। হাতের ডান পাশে কাঁটায় এমন আঁচড় পড়েছে যে জ্বলছে বটে কিন্তু রক্ত বের হচ্ছে না।ঘামে আরো অসহ্য জ্বলুনি। একটু সরে দাঁড়াবার ফুসরত নেই। চারদিকে সবুজঅন্ধকার। কী করে যে ঢুকলাম টিম লিডার শহীদই জানে। হাঁটলেই জলের শব্দে শহীদের ভ্রু কথা বলে ওঠে।

এই যে লতা গুল্ম পড়শীর ভেতর আছি সকলের নাম জানি না বলে এতোটুকু অস্বস্তি লাগছে না। অথচ পাশে বসা কোনও অপরিচিত মানুষের তত্ত্বতালাশ ঠিকঠাক না করতে পারলে মনের ভেতর নানা সন্দহের বীজ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে; তেমনটি আমার এখন লাগছে না। জানাজানির ভেতর যে পুলক তার চেয়ে অজানার ভেতর অজানার সাথে অধিক পুলকতার অর্জন বুঝি বনেই সম্ভব। বিস্ময়ের ঘোর লেগে থাকে মনের চিলেকোঠায়। যা একান্তই যার যার তার তার।  অংশটুকুও ভাগ করে নেবার সুযোগ নেই। প্রকাশ করতে লেগেই কোথায় যেন টান পড়ে।তখন শব্দের ভেতর দিয়ে নানা মানে ঢুকিয়ে ইশারায় প্রতীকে কিছুটা বলা গেলেও অপ্রকাশিত থেকে যায় আনন্দের উত্তেজনা।

একটু নোক্তা দিয়ে রাখি, এমন বনতলেই চুনিকণ্ঠির বসত।পরিযায়ী পাখি, অতিথি পাখি। কিন্তু এখননও তাঁর টিকিও দেখলাম না। পাখিকে পাখির জায়গায় রেখেই দেখতে হয়। পরিপ্রক্ষিত নিয়েই পাখি দেখা। সেন্স অব প্লেস নিয়ে পাখি দেখলেই বার্ডওয়াচারের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। তখন সেও প্লেসের অংশ। একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। বিচ্ছিন্ন করে দেখা আসলে কোনও দেখাই নয়।

তুমি যে কেন বনে আসতে চাও না সেটা জানি। অথচ বনের কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তোমার জানতে চাওয়ার তৃষ্ণা দেখে প্রায়ই ভাবি আরেকটু কেন বনের ভেতর ঢুকলাম না! যাই হোক, যা লিখছিলাম, পরিপ্রক্ষিত নিয়ে যে  সহজ রূপের পাখি, আনন্দে মশগুল পাখি দেখাই পাখালদের কাজ। আর তখনই জয়ের ক্যামেরা ক্লিক ক্লিক ওঠে। টপাটপ সাটার সাটারে সেলুলয়েডে গ্রেফতার হয় পাখির মুহূর্ত।

দৌড়ে দৌড়ে পাখি দেখা– পাখিকে ভীত সন্ত্রত করে যে পাখি দেখা সেটি পাখালদের কাজ নয়। যে পাখি ভীত সে সবটুকু মেলে দেয় না। ভেতরে ভেতরে বেলুনের মতো চুপসে যায়। পাখনায় গলায় ফুটে ওঠে ভয়ের করুণ আর্তি। পাখালরা বুঝে পাখিরও মন আছে। পাখিও ভয় পায়। আনন্দে পুচ্ছ তুলে নাচে;রাগে ফুলে ওঠে গলা–ফুটে ওঠে মুখে খাবার নিয়ে বাড়ির ফেরার ত্রস্ততা।মা-পাখির উদ্বিগ্নতা। সব– সবই পাখালের ক্যামেরায় ধরা পড়ে।

কতিপয় ছবি মেইলে এ্যাটাচড করে দিলাম। পাশাপাশি রাখা পাখির ছবির দিকে একটু নিবিড় নজর দিয়ে দ্যাখো, পাবে পাখিদের মানস মানচিত্র। তখন নিজেই টের পাবে, বার্ডওয়াচিং সমগ্রের ভেতরে পাখির যাপন দেখা। পাখির ওড়াওড়ি দেখা। এই যে দূর্গম লতা গুল্মের প্রাচীর। প্রায় শুকিয়ে যাওয়া ডোবা। স্যাঁতস্যাঁতে কম্পিত জলে আকাশ উবু হয়ে আছে তার পাশেই চুনিকণ্ঠি নিয়ে সমগ্রের ফ্রেম। এমন  কী এই আমি আর শহীদ, আমরাও এর অংশীদার। এই ফ্রেমের ভেতর এলেই শহীদের আঙুলও সচল হয়ে উঠবে। চিরকালের একটি মুহূর্ত ফ্রেমের ভেতর বন্দি হয়ে যাবে। সেটির জন্যেই শহীদের অপেক্ষা– চাতক পাখির অপেক্ষা।

সত্যি বলছি আমার সেই ধৈর্য্য নেই। অস্থির চোখ আর মনের অস্থিরতার সাথে পাল্লা দিয়ে খুঁজছি চুনিকণ্ঠি। এইখানে সে বসত গড়েছে। একটু উষ্ণতার জন্য দেশে দেশে ভ্রমি সে আবার ফিরে যাবে তার উৎসমূলে।মূল ভুখণ্ডে।শুধু চুনিকণ্ঠি না, তার মতো আরও আরও মেহমান এসেছেন; এখানে সে খালি হাতে বেড়াতে আসে না। পাকস্থলীতে বহন করে আনে নানা জায়গার ফুল ফলের বীজ বা এখানকার কোন বীজ নিয়ে যায় অন্য কোনো দেশে। সেই বীজ ঠিকঠিক মাটির গর্ভ পেলে বেড়ে ওঠে ভ্রুণ।

প্রাকৃতিক গোলকায়নের সৈনিক হল পাখি। কে জানে হয়তো চুনিকণ্ঠির মতো কোন মেহমান এই গারো হিলিসের মেজবানের কোলে কোনও একদিন ফেলে গেছিল চেরী লরেলের বীজ। চেরীর স্বভাব ঘন চিরহরিতের প্রাচীর নির্মাণ করা। মাটি বদল হয়েছে তো কী হয়েছে– স্বভাব তো আছে। স্বভাবগুণেই চেরী ছেয়ে গেছে রাঙাজান। এই তল্লাটে এতো এতো চেরী লরেল দেখব ভাবিনি। বেশখানিক জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে আছে।মিহিদানা পাপড়ি– কালচে সবুজ পাতার বিস্তারে ঝোকাঝোকা সাদা ফুল। মাটিতে স্থিতি পেয়ে গেছে। 

এইদিকে জনবসতি কম।ইজারার লেবু বাগান অনেকখানি এলাকা জুড়ে। বড় বড় লেবু। সবুজ হতে হতে হলুদ হয়ে ঝুলে আছে গাছে গাছে। রসালো কিন্তু টক– চোখ বন্ধ করা দাঁত খিঁলচানো টক।দুয়েকটা বলের মতো হলদে লেবু ব্যাগে ভরলেও এখন ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে।

রাঙাজানের ঢুকার মুখেই মানুষের পাড়া। লাগুয়া ঘর।সত্তর পঁচাত্তর বছরের থিতু এই পাড়া।এখন এই তল্লাটেরই বাসিন্দা।স্থানিক ভোটার।ঘর গেস্থালি এখানকার রঙে রঙিন।কোন একদিন এখানে তারা চলে এসেছিল ভাগ্য তাড়িত হয়ে– বাধ্য হয়ে।

চুনিকণ্ঠির মতো একটু উষ্ণতার জন্য তারা আসেনি। তারা এসেছিল নিপীড়নে। জানমাল সম্ভ্রম নিয়ে পালিয়ে এসেছিল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে। তখন জমিনে দাগ দেয়া হয়ে গেছে। এপার আমার ওপার তোমার। যার যার তার তার আলাদা উঠান। রাজনীতি কেমন অদ্ভুত!  মানুষের জন্য মানুষের দ্বারা রাজনীতি হুট করেই দাগ দিল জমিনে। তোমার মত ভিন্ন তোমার ধর্ম ভিন্ন তোমার জাত আলাদা। তুমি পশ্চিম মুখী– যে মানুষ আরেক মানুষের পাশাপাশি আপনজন– সেই-ই দাগ কেটে এপার ওপার গড়লো মত-ভিন্নতার সংসার। হিংসা-দ্বেষ আর ঘৃণার চাদরমোড়া দেশ– যার যার দেশ। রাজনৈতিকতা এভাবেই আপনজনকে দাঁড় করাল একজনের মুখোমুখি অন্যজনকে। জমিনের দাগ কী ভয়াবহ!

সেই দাগের যাঁতা কলে নিপীড়িত মানুষ এই রাঙাজানের মানুষ। আজকের প্রজন্ম এখানকার মাটির রঙে রাঙিয়ে নিয়েছে মন ও শরীর। তাদের বাপ-দাদারই সেই দাগের স্মৃতি নিয়ে মরেছে দাগের এই পাশে– জন্ম বেড়ে ওঠা স্মৃতি কাতরতা দাগের ওপাশে।

সাতচল্লিশের অভিঘাতে সম থেকে বিতাড়িত মানুষই এই তল্লাটের মাটিতে গড়েছিল ভ্রুণ। আর চেরী লরেল বীজ–পাখির পাকস্থলি বাহিত;এই মাটিতে পুঁতেছে ভ্রুণ। একটিতে ভালোবাসা– উড়তে উড়তে এই মাটিতে পুঁতে ছিল বীজ। অন্যটিতে রাজনৈতিকতা– হিংসা বিদ্বেষে তাড়িত হয়ে বাঙালি মুসলমান অসম থেকে দাগের এপারে এসেছিল। 

সেখানে রুটি রুজির জন্য তাদেরকে নিয়ত লড়তে হয়েছে কখন অসমীয়াদের সাথে কখনো বর্ণবাদী হিন্দুদের সাথে। সেই লড়াই কম নয়।কখনো বাংলা ভাষাভাষী হিন্দু মুসলমান একসঙ্গে লড়েছে অসমীয়ার সঙ্গে। আবার কখনও অসমীয়া আর হিন্দু মিলে নাস্তানাবুদ করেছে বাঙালি মুসলমানদের। 

জমিনে রাজনৈতিক দাগই সব উলটপালট করে দিল। কথার বিরুদ্ধে কথা বলার রেওয়াজ পাল্টে গেলো– মুখোমুখি হয়ে পড়ল তলোয়ার আর ত্রিশূল। এই এক রাজনীতি বটে– মানুষের জন্য মানুষের দ্বারা ঘৃণার চাষাবাদ। 

রাঙাজান পেরুলেই সীমান্ত, কাঁটতার।ওপাশে মেঘালয়। সন্ধ্যায় ফিরেছি ঝমঝম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। কেটলির জল টগবগ করে লাফাচ্ছে। বড্ড চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। বৃষ্টির ছাঁট এখনো কমেনি। অমাবতীর ভেতর বৃষ্টি। মাটির রজঃস্বলা হবার বৃষ্টি। এ সময়ে একটু বেশিই বৃষ্টি হয়। তা হোক। ধারাবাহিক ধারাপাত বৃষ্টিপাত হোক। আজ এইটুকু। সময় পেলে মেইল করো।

জ্যোতি পোদ্দার

জন্ম ১৯৭৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের নয়ের দশকের কবি। বাসস্থান বাংলাদেশের শেরপুর জেলার নালিতা বাড়ি। পেশা শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত। প্রকাশিতকাব্যগ্রন্থ: ‘(a+b)2 উঠোনে মৃত প্রদীপ’ (১৯৯৭), ‘সীতা সংহিতা’ (১৯৯৯),
‘রিমিক্স মৌয়ালের শব্দঠোঁট’ (২০০২), ‘ইচ্ছে ডানার গেরুয়া বসন’ (২০১১), ‘করাতি আমাকে খুঁজছে’ (২০১৭) এবং ‘দুই পৃথিবীর গ্যালারি’ (২০১৯)।

Share

3 thoughts on “গারো পাহাড়ের চিঠি”

  1. লেখক যদি পাখাল হয়, তাহলে তার লেখায় আমাদের মনে আমাদের চোখেও দেখা হয় পাখি। জানা হয় পাখি ও মনুষের যাপিত জীবন। লেখা অসম্ভব সুন্দর হয়েছে, বন্ধু।

  2. পড়লাম, মুগ্ধতা নিয়ে, সাথে বিষাদও। দেশভাগ আর মানুষের ভাগ হওয়ার ব্যাথাভারাতুর সত্য আর প্রকৃতির সৌন্দর্য – দুয়ের প্রকাশই চমৎকার। শুভেচ্ছা।

  3. গারো পাড়ের চিঠি পড়লাম, আর ঈর্ষা হলো। এতো দিন থেকে পাহাড়ে যাই জ্যোতির মতো এমন উপলব্ধি তো হয় না। আসলে যে ঢেঁকির যে কাজ। আমার ভালোবাসা আর জ্যোতির ভালোবাসার মধ্যে ব্যবধান এই। ও খোঁজে পায় সাহিত্যের উপাদান আর আমি পাখি আর গাছের নতুন প্রজাতি। দারুন লেখা! যারা পাহাড়ে যায়নি তারা এই লেখা পড়ে পাহাড়ে মানস ভ্রমন করবে। পড়লাম আর ভাবলাম কবি, সাহিত্যেকদের জন্য পাহাড়, নদী, বিল এক কথায় প্রকৃতিকে বাঁচানোর দ্বায়িত্ব আমাদের। প্রকৃতি বাঁচলে জ্যোতির কলম থেকে বেরিয়ে আসবে প্রকৃত জ্যোতি। আরও এমন লেখা চাই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top