।। পারভেজ আলম ।।
‘ওঙ্কার’ উপন্যাসটি আমাদের সামনে বাঙলা শব্দটিকে হাজির করে এমন এক নাম হিসাবে, যার নিজের কোনো অর্থ না থাকলেও তা অর্থ উৎপাদন করতে পারে। আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যখন বাঙলা শব্দটির সাথে যুক্ত সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক মতাদর্শগুলো অর্থহীনতায় পর্যবশিত হয়েছে, যখন বাঙলা শব্দটি একটি প্রতীকী ব্যবস্থার নাম হওয়ার বদলে পরিণত হয়েছে একটি স্বৈরাচারী প্রতীকী ব্যবস্থার মতাদর্শিক প্রতীকে, যখন পশ্চিম বাংলায় এ যাবৎকাল ধরে হাজির থাকা বাঙলা ও বাঙালি ধারণার মধ্যকার স্ববিরোধিতা ও দ্ব্যার্থবোধকতাগুলো প্রকট করে তুলেছে বিজেপির রাজনৈতিক উত্থান – তখন বাঙলা শব্দটিকে এমন একটি অর্থহীন নাম ও ধ্বনি হিসাবে অনুধাবন করা বিশেষভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে যার মধ্যে নতুন অর্থ সৃষ্টির সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে। হয়তো, আহমদ ছফা যখন ওঙ্কার উপন্যাসটি লিখেছিলেন, তখনই বাঙলা শব্দটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শগুলোর অর্থহীনতার মুখোমুখি হয়েছিলেন।
ওঙ্কার ও উন্মোচন
১
“আমাদের কিছু জমিজমা ছিল। আমার বাবা নিজে করেননি। তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। সম্পত্তির সঙ্গে একখানা মেজাজও তাঁকে পূর্বপুরুষরা দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর তেজ বিশেষ ছিল না, তবে ঝাজটা ছিল খুব কড়া রকমের”।
আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’ (১৯৭৫) উপন্যাসটির একেবারে প্রথম প্যরাতেই হোমোডায়াজেটিক বর্ণনার মধ্যে বর্ণনাকারী ও পাঠকের ভেদ ঘুচে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এবং, একেবারে শুরুতেই পাঠক মুখোমুখি হতে পারেন পিতা ও পূর্বপুরুষের ইতিহাসের সাথে, একটা জিনিওলজি বা বংশপঞ্জির সাথে। যেহেতু উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭৫ সালে, সেহেতু এই বাবাকে ঐ সময় সদ্য নিহত “জাতির জনক” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এলেগরি হিসাবে পাঠ করার লোভ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। ওঙ্কার উপন্যাসটি শুরুই হয়েছে এমন এক “জনক”কে কেন্দ্র করে যিনি তার শ্রেষ্ঠ সময় হারিয়ে ফেলেছেন, যিনি প্রায়ই তার “বংশপঞ্জি” খুলে বসেন, “পিতৃপুরুষের প্রেতাত্মা”রা যার উপরে ভর করতো, এবং যিনি তার প্রজাদের উপর অত্যাচার করতেন। এই জনকের পতন ও মৃত্যুই এই উপন্যাসের প্রথম প্লট। কিন্তু জনকের পতনের এই গল্প পৃথিবীর ইতিহাসের আরো বহু পিতা ও জাতির জনকের জীবনের এলেগরি হতে পারে। অথবা হতে পারে উপনিবেশ ও বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে আধুনিক স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু নেতার এলেগরি, ফ্রানৎস ফানোঁর “জগতের লাঞ্চিত” সেই সাক্ষ্য দেবে।
অলাতচক্র উপন্যাসটিতে অবশ্য এই বাবাকে হাজির করা হয়েছে পাকিস্তান আমলের প্রথম পর্বে পতনের মুখে থাকা এক অত্যাচারী তালুকদার পিতার চরিত্রে। তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন মুঘোল আমল থেকে জারি থাকা বংশপঞ্জির, এমন একটি আদিম ক্ষমতা-কাঠামোর যার শেষ সময় উপস্থিত হয়ে গিয়েছে। তার তালুকদারি ক্ষমতা মুখোমুখি হয় নতুন উন্মোচিত গণক্ষমতার। উপন্যাসের ভাষায়; “গ্রামের মানুষ এইরকম একটা ফুটো তালুকদারের কর্তালি মেনে নেবে তারা তেমন বোকা ছিল না। সুতরাং তারা শব্দ করতো, হল্লা করতো, গান করতো, এবং চিৎকার করতো। গ্রামবাসীর সম্মিলিত জীবনধারা থেকে খসে পড়া শব্দমালা আমার জনকের গায়ে বিছুটির জ্বালা ধরিয়ে দিতো। সে জ্বালা মেটাতে যখন তখন তিনি আদালতে ছুটতেন।… এক ধারা দু ধারা থেকে আরম্ভ করে ক্রিমিনাল এক্টের সাতশো সাতাশি ধারা পর্যন্ত গরীব প্রতিবেশীর নামে মামলা ঠুকে দিতেন”। আমাদের সময়ে, এই বর্ণনাটি পাঠ করার সময় জনকের জায়গায় একজন জননীর স্মরণ নেয়ার লোভ সামলানো কঠিন। তবে এই লোভ আপাতত সংবরণ করা দরকার, কেননা এই দাবি করা যায় যে, উপন্যাসের এই অংশটুকুতেই আহমদ ছফা আমাদেরকে প্রথম বারের মতো এমন এক ভাষার ধারণা বা তার অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করিয়ে দেন, যা এই উপন্যাসটির সবচাইতে কেন্দ্রীয় বিষয় এবং ওঙ্কার নামটি এই ভাষারই একটি নাম।
গ্রামবাসীদের শব্দ, হল্লা, গান, চিৎকার ইত্যাদির বিবরণ এমন এক ভাষার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে আমাদের যা ঠিক সঙ্গা ও অর্থের উপরে নির্ভরশীল না। চিৎকার করে মানুষ কথা বলতে পারে বটে, কিন্তু চিৎকার হতে পারে পুরাপুরি অর্থহীন। তবে অর্থহীন চিৎকারের মাধ্যমে যে কোনো যোগাযোগ বা ভাবের আদান প্রদান করা যায় না তা না। রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ নানান কিছুই প্রকাশ করা যায় চিৎকারের মাধ্যমে যা পরের জন্যে বোধগম্য হয়। চিৎকারের মাধ্যমে অর্থ ছাড়াই মনের ভাব প্রকাশ করা যায়। চিৎকার ও হল্লা এমন এক ভাষার ধারণা হাজির করে যা অর্থ ছাড়াই যোগাযোগের মাধ্যম হতে পারে। গানের মধ্যে থাকতে পারে অর্থময় ও অর্থহীন দুই ধরণের শব্দই, কিন্তু গানকেও অর্থময়তার মধ্যে সংকুচিত করা সম্ভব না; এই উপন্যাসটি যা আমাদেরকে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে। বোবা বউয়ের যে গানের সমঝদার আমরা উপন্যাসের নায়ককে হয়ে উঠতে দেখি, তাও – অর্থহীন। এবং শব্দ, হল্লা, গান, চিৎকার; এই প্রতিটা জিনিসের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই আমরা জানতে পারি, তাদের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারি, তাদের কোন অর্থ বা সংজ্ঞার উপরে নির্ভরশীল না হয়েই। এইদিক থেকে তারা প্রতিনিধিত্ব করে এমন কিছু নামের, যারা নিজেদেরকে আমাদের কাছে সচ্ছভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম অর্থের উপর নির্ভর না করেই। পিতা ও শাসক শ্রেণীর বংশপঞ্জির পাশাপাশি, এই উপন্যাসের শুরুর দিকেই আমরা মুখোমুখি হই ভাষার এমন অভিজ্ঞতার সাথে, যা অর্থের উপর নির্ভরশীল নয়।
আগেই বলেছি, ওঙ্কার এক পিতার গল্প নয়। তালুকদার পিতার তিরোধানের পথ ধরেই আবির্ভাব ঘটে মোখতার আবু নসরের। শশুর, চাকরিদাতা ও আবাসদাতা হিসাবে যিনি এই গল্পের বর্ণনাকারীর দ্বিতীয় পিতাসুল্ভ চরিত্র। এই পিতাও পূর্ববর্তী পিতার মতোই ক্ষমতাবান ও অত্যাচারী, নিরীহ ব্রাহ্মণের বাড়ি দখল করে তিনি তা উপহার দেন মেয়ের জামাইকে। নতুন যে রাজনৈতিক ক্ষমতা-কাঠামোয় জায়গা হয় নাই তালুকদার বাপের, এই বাপ সেইখানে খুব সফলতার সাথে টিকে থাকেন ও বিকশিত হন। বর্ণনাকারী বা পাঠকের জন্যে বাপ পরিবর্তনের এই অভিজ্ঞতা একটি দেশের ক্ষমতা-কাঠামোয় পরিবর্তনের সাথে সমান্তরাল ও সম্পর্কযুক্ত হলেও, প্রতীকী ব্যবস্থার (Symbolic Order) ভিত্তি হিসাবে বাপের ধারাবাহিকতাই অব্যাহত থাকে এরমধ্যে। অর্থাৎ বাপ হোক বা শ্বশুর, দুই পিতা চরিত্রই এইক্ষেত্রে বর্ণনাকারীর প্রতীকী ব্যবস্থায় হাজির সেই বড় অপর (Big Other) হিসাবে, যা তারজন্যে ভাষার জগতে প্রবেশ করার, পরিণত পুরুষ বা আরেকজন বাপ হয়ে ওঠার প্রথম ও প্রধান ভিত্তি। কিন্তু ওঙ্কার উপন্যাসটি কেবল বর্ণনাকারীর সাংসারিক বা গৃহস্থালী প্রতীকী ব্যবস্থাটাই আমাদের সামনে তুলে ধরে না, বরং তার সংসারকে হাজির করে এক জাতীয় সমাজের প্রতীকী ব্যবস্থার সমান্তরালে ও তার অংশ হিসাবে। শশুরের ক্ষমতার উৎস হিসাবে হাজির থাকেন একজন রাষ্ট্রীয় বাপ – আইয়ুব খান। উপন্যাসের ভাষায়, মোখতার সাহেব আইয়ুবের রাজত্বের “খুঁটি না হলেও ঠেকনা জাতীয় কিছু একটা তো বটেই”। আর এই ঠেকনাই আমাদের নায়কের জীবনের সেই ভিত্তি, যার উপর ভর করে সে প্রবেশ করে আইয়ুবের রাজত্বের প্রতীকী ব্যবস্থায়। অর্থাৎ, ওঙ্কার উপন্যাসটিতে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বর্ণনাকারী ও পাঠক নিজেকে আবিষ্কার করেন, সে রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে প্রতীকী ব্যবস্থার উপরে নির্ভরশীল, তাতে সবচাইতে বড় বাপ বা বড় অপরের জায়গায় হাজির মার্শাল আইয়ুব। বর্ণনাকারীর ভাষিক ও রাজনৈতিক মনস্তত্বে পিতাচরিত্রের এই আধিপত্বকে অগ্রাহ্য করা পাঠকের পক্ষে অসম্ভব।
ওঙ্কারের উপন্যাসের গল্পকে নায়কের সাংসারিক ও রাজনৈতিক প্রতীকী ব্যবস্থায় প্রবেশ ও তাতে থাকার যাতনা ও সংগ্রাম হিসাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। পিতার মৃত্যু ও শ্বশুরের আবির্ভাবে যে নতুন প্রতীকী ব্যবস্থায় সে প্রবেশ করে তাতে সে শান্তি লাভ করতে পারেনা, পরিণত অথবা বাপ হয়ে উঠতে পারেন না, কেননা মাঝখানে এক অলঙ্ঘনীয় বাধা হিসাবে হাজির – বোবা বউ। কেবলই একটা প্রতীকী ব্যবস্থায় প্রবেশ করা, আরো ভালভাবে বললে একটা ক্ষমতা-কাঠামোর পুনরুৎপাদন করা, বা একটা নতুন ক্ষমতা-কাঠামোতে বিজয়ীর জায়গাটা দখল করে নেয়ার মাধ্যমে অর্থের জগতে প্রবেশ করাটা আমাদের নায়কের হয়ে ওঠেনা। তা করতে চাইলে বোবা বউ কোন বাধা নয়, তাকে এড়িয়েই প্রবেশ করা যায় ও উপস্থিত থাকা যায় সেই প্রতীকী ব্যবস্থায় – পিতৃতূল্য শশুর যার ঠেকনাস্বরূপ। কিন্তু নায়কের বাসনা তাতে পুরণ হয় না। বরং অর্থহীন যে ভাষার অভিজ্ঞতা বোবা বউ রূপে তার জীবনে হাজির, তার কথা শুনতে চান তিনি – বুঝতে চান তার অর্থ। এ এমন এক প্রিয়ার কথা শুনবার বাসনা – যিনি কথা বলেন না। যিনি শব্দ করেন, পশুর মতো অথবা যন্ত্রের মতো। সারা বাংলাদেশ যখন পুরাতন ক্ষমতা কাঠামো উপড়ে ফেলে নতুন একটি জাতিরাষ্ট্র গড়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে, ভাষা জাতীয়তাবাদের উপর সেই জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তি দাঁড় করাচ্ছে, আমাদের নায়ক সেইসময় মুখোমুখি এমন এক ভাষার অভিজ্ঞতার সাথে যা কোনো বিশেষ জাতির বিশেষ ভাষা তো নয়ই, মানুষের ভাষার মধ্যেও তাকে সীমাবদ্ধ করা যায় না, এবং এমনকি তা যোগাযোগের জন্যে অর্থের উপরেও নির্ভর করেনা।
২
অর্থহীন ভাষার অভিজ্ঞতা সংক্রান্ত সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের ইতিহাস বহু পুরাতন। ইসলামী ঐতিহ্যে এই ধরণের ভাষার নাম হলো “নাম” (ইসম)। কোরান মোতাবেক, আল্লাহ্ আদমকে সৃষ্টি করার পর তাকে সব কিছুর নাম শিখিয়েছেন বলেই তার অবস্থান ফেরেশতাদেরও উপরে যাদের এই নাম সংক্রান্ত জ্ঞান ছিলনা (আল বাকারা ৩১-৩৪)। সুফি ঐতিহ্যে কোরানে উল্লেখিত নামের মধ্যে একধরণের আদি ও অকৃত্তিম মেটা-লেঙ্গুয়েজের ধারণাকে হাজির করার চল রয়েছে। ইবনে আরাবী যেমন সূরা বাকারার ৩১ নম্বর আয়াতটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন যে, “আদমের নাম সংক্রান্ত জ্ঞানের কারণেই মানুষ অর্থ তৈরি করতে পারে” (৪৬)। জীবের জীবনে এই নামের কোন অর্থ নাই, কিন্তু এই নামের গুনাবলী সে কিছুটা অর্জন করতে পারে (চিত্তিক ৪৪)। সুফিতত্ত্ব ও কাব্বালার পথ পার হয়ে নাম ভাষার ধারণা নিয়ে আধুনিক যুগে জায়গা করে নিয়েছে ওয়াল্টার বেনিয়ামিন ও জর্জো আগামবেনের দার্শনিক চিন্তায়। আগামবেনের মতে, নাম ভাষা এমন এক ভাষার ধারণা হাজির করে যা নিজেকে ছাড়া আর কিছুরই বার্তা বহন করেনা, … যা কোন কিছুকে অর্থের মাধ্যমে প্রকাশ করেনা এবং যা নিজের দিক থেকে সম্পূর্ণ রকম স্বচ্ছ (‘ভাষা ও ইতিহাস’ ৫২)।
আগামবেন নাম ভাষার সাথে তার দর্শনে হাজির থাকা “ধ্বনি” (voice) নামক ধারণার সাথেও তুলনামূলক আলাপ টেনেছেন। আগামবেনের ব্যবহার করা ধ্বনি ধারণাটি তার দর্শনে অতোটাই কেন্দ্রীয় যতোটা কেন্দ্রীয় তার বহুল আলোচিত ধারণা “বেয়ার লাইফ” বা উন্মুক্ত জীবন; যদিও এই ধারণাটি অপেক্ষাকৃত কম বর্ণিত ও আলোচিত। হোমো স্যাকের বইটিতেই তিনি পরিষ্কার করেন যে মানুষ নগর (পলিটি, মদিনা, রাষ্ট্র) বানাবার সময় যেমন নিজের জীবসত্তাটিকে নগরের রাজনীতির বাইরে রাখে, ব্যাতিক্রম হিসাবে (নগরের আইনে বহির্ভূত হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে); তেমনি নিজের ধ্বনিকেও অর্থময় ভাষা বা কালেমার (লোগোস, ডেফিনিটিভ ডিসকোর্স) মধ্যে বহির্ভূত হিসাবে ধরে রাখে (১২)। মানুষ নিজের জীবসত্তা ও ধ্বনিকে বহিষ্কার করার মাধ্যমে নগর তৈরি করে, নগরে বসবাস করে। এই কারনেই, আগামবেনের মতে, পাশ্চাত্য চিন্তায় রাজনীতি (যা নগরের বা নাগরিক জীবনের ব্যাপার) হলো সেই দোড়গোড়া যার মধ্যে জীব সত্তা ও কালেমার মধ্যকার সেতুবন্ধ রচিত হয়েছে (হোমো স্যাকের ১২)। আগামবেন ধ্বনি বা ভয়েস বলতে যা বোঝান, তা যেমন শ্রেফ শব্দ না, আবার অর্থময় ভাষাও না। বরং তা এমন এক ভাষার অভিজ্ঞতা, যা তখন পর্যন্ত অর্থের উপর নির্ভরশীল নয়। ওঙ্কার উপন্যাসটিতে আমরা বারবার এমন ধ্বনি ভাষার মুখোমুখি হই। সবচাইতে বেশি যে অর্থহীন ধ্বনির কথা উপন্যাসটিতে বর্ণনাতে করা হয়েছে, তা বোবা বউয়ের মুখ দিয়ে বের হয়ে আসা ‘গোঁ গোঁ’ শব্দ।
আগামবেন তার ধ্বনির ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে খ্রিষ্টিয় ধর্মতাত্ত্বিক আনস্লেম ও গওনিলোর মধ্যকার একটি বিতর্কের উদাহরণ দিয়েছেন। আনস্লেমের দাবি ছিল যে একজন বিশ্বাসী যিনি আল্লাহ শব্দটির সংজ্ঞা জানেন, তার মুখে শব্দটি উচ্চারিত হলে অবধারিতভাবেই তা আল্লাহর অস্তিত্বই প্রকাশ বা প্রমাণ করে। কিন্তু গওনিলো উদাহরণ হিসাবে হাজির করেছেন এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে উচ্চারণকারীর ভাষা বুঝতে অক্ষম একজন “বার্বারিয়ান” বা “ইডিয়ট” তার সামনে হাজির। এই “বার্বারিয়ান” বা “ইডিয়ট” আল্লাহ সংক্রান্ত কোন বয়ানের অর্থ না বুঝতে পারলেও শব্দাংশ এবং বাক্যের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারবেন। তিনি যা বুঝতে পারবেন তা হলো যে তার সামনে যেই ঘটনাটি ঘটছে, তা একটা “ভাষারই ঘটনা”। সুতরাং তার সামনে আল্লাহ্ শব্দটি উচ্চারণ করলেও, তা যদি কোনো কিছুকে প্রকাশ বা প্রমাণ করে তবে তা হলো – ভাষার অস্তিত্ব। আগামবেনের মতে, এই ঘটনাটি ভাষার এমন একটা অস্তিত্বের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে যা শ্রেফ শব্দ শোনার অভিজ্ঞতা না, আবার তখন পর্যন্ত তা অর্থের অভিজ্ঞতাও না। ধ্বনি সংক্রান্ত এই চিন্তা কোন রকম অর্থের দ্বারস্থ না হয়েই ভাষার সংঘটিত হওয়ার একটি ঘটনা তুলে ধরে, এবং দেখায় যে অর্থময় প্রস্তাবের বাইরেও চিন্তা করা সম্ভব (আগামবেন “ভাষার ধারণা” ৪২)। ওঙ্কার উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে আমরাও পরিণত হই গওনিলোর ঐ “বার্বারিয়ান” বা “ইডিয়টে”, বারবার মুখোমুখি হই অর্থহীন ধ্বনির অভিজ্ঞতার। চিৎকার, হুল্লোর, গানের ঘটনাগুলো যে ভাষারই ঘটনা তা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। এবং জোরের সাথেই বলা যায় যে বাঙালিরা যদি চিৎকার বা হুল্লোর করে, গান গায়; তবে এই ঘটনাগুলাকে প্রত্যক্ষ করবার জন্যেও কোন অবাঙালির বাঙলা ভাষা শেখার দরকার নাই। অর্থ না বুঝলেও, দুনিয়ার যেকোন ভাষার মানুষের কাছেই এই ঘটনাগুলা ভাষার অভিজ্ঞতা হিসাবেই ধরা পড়বে।
কিন্তু অর্থহীন ভাষার সাথে ওঙ্কারের নায়কের প্রথম সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। বোবা-বউ রূপে যে অর্থহীন ভাষার অভিজ্ঞতা তার জীবনে ধরা দেয়, তার সৌন্দর্য সে শুরুতে উপভোগ করতে পারে না। সহকর্মী নৃপেন ও বন্ধুদের সবাক বউদের গল্প শুনে তার মধ্যে নিজ বউয়ের কথা শুনবার বাসনা আরো প্রবল হয়ে ওঠে, আর নির্বাক বউয়ের বিরুদ্ধে জমতে থাকে ক্ষোভ। এমন না যে তার বউ যোগাযোগে সক্ষম না। মোখতার আবু নসর তার আদরের বোবা মেয়ের সাথে ইশারায় কথা বলতে পারেন। বোবা এই বউ গৃহকর্তি হিসাবে কাজের মেয়েকে আদেশ নির্দেশ দিতে সক্ষম, তিনি পারঙ্গম জামাইয়ের প্রতি যত্ন ও ভালবাসা প্রকাশেও। কিন্তু তাতে আমাদের নায়কের মন ভরেনা। সে শুনতে চায় অর্থময় বাক্য ও গল্প। এতে বোঝা যায় যে বোবা বউয়ের বাকহীনতাই এইক্ষেত্রে এই দম্পত্তির মধ্যে যোগাযোগের প্রধান বাধা নয়। বরং, বোবা বউয়ের রূপকে, ভাষার জগতেই যে অর্থহীন ভাষার দেখা সে পেয়েছে, যাকে সে কবুল করে নিয়েছে, খোদ তাকেই বুঝে ওঠার এবং ভালবাসার দক্ষতা সে অর্জন করতে পারে নাই। এইক্ষেত্রে তার হালতটা হলো সেই শিক্ষানবিশ দরবেশের মতো, যিনি প্রথম খোদার নূরের এক ঝলকেই অন্ধ হয়ে গেছেন। যিনি তার মরমি অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশের উপায় না পেয়ে বিপদ ও বেদনার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি এমন এক প্রেমিক, যার সামনে নেকাব খুলে প্রিয়া নিজেকে উন্মোচন করবার পর তিনি সেই গায়েবের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার বদলে ভয় পেয়ে গেছেন। অবশ্য, এমনকি খোদ মহানবীও হেরা গুহায় প্রথম ওহী লাভ করার পর ভীত হয়ে পড়েছিলেন। বিবি খাদেজার সাহস ও ভরসায় তিনি শান্ত হন।
৩
“প্রেমিক” (আল ওয়াদুদ) কোরানে উম্মোচিত আল্লাহর নাম সমূহের একটি। সুফি ঐতিহ্যে আল্লাহকে প্রিয় এবং সুফির নিজেকে প্রিয়া হিসাবে কল্পনা করার ঐতিহ্য রয়েছে। বায়েজিদ বোস্তামির বরাত দিয়ে বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী মারেফতের সর্বোচ্চ স্তর অর্জন করা সুফিদেরকে তুলনা করেছেন আল্লাহর প্রেমিকা ও বউয়ের সাথে (১৬)। শায়খুল আকবর ইবনে আরাবীর লেখায় অবশ্য প্রেম, প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের ভেদ অনেকখানিই ঘুচে যায় যেহেতু এসবই আল্লাহর নামসমূহ, এবং সুফিও হাজির হন প্রেমিকের রূপকে (চিত্তিক ৪৩-৪৪)।
ওঙ্কারের নায়কের জীবনেও প্রেমের হাজিরা ঘটে। ‘গোঁ গোঁ’ শব্দ করে বোবা বউয়ের গান গাওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করে তিনি প্রেমে পড়ে যান। গান, যা সব ভাষাতেই চেনা যায়, তার অভিজ্ঞতা লাভ করেই তিনি তার বউকে নতুন করে বুঝতে শেখেন। বোবা বউয়ের গান গাইবার চেষ্টার মধ্যেই প্রথম সে ভাষার সেই অভিজ্ঞতা লাভ করে যা তখনো তার কাছে “ভাষা নয়”, বরং গলা দিয়ে ঝড়ে পড়া “গোল গোল নুড়ি পাথরের খণ্ড খণ্ড শব্দাংশ”। তবে সে দেখতে পায় যে কেবলি তার বাকশক্তিহীন স্ত্রীই নয়, বরং তার “শরীরের প্রতিটি কণা, প্রতিটি অণু-পরমাণু” কথা বলতে চায়। আহমদ ছফা নাম সংক্রান্ত ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের সাথে পরিচিত ছিলেন কিনা, এই বিষয়ে কোন ধারণা করা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। তবে, ওঙ্কারের বর্ণনাকারী তার বোবা বউয়ের গান গাইবার চেষ্টাটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পরিষ্কার ভাষায় বর্ণনা করেছেন; “তার মনের ভেতর সুখ-দুঃখের আকারে যা ঘটছে এবং বাইরের পৃথিবীতে সুন্দর কুৎসিত যা বিরাজমান রয়েছে, প্রতিমূহুর্তেই পরিবর্তিত হচ্ছে – সবকিছুরই একটি নাম আছে। এই নামটিকেই সে প্রকাশ করতে চায়। কিন্তু পারে না। বাকযন্ত্রটি খারাপ এবং অকেজো বলে”। ধর্মতাত্ত্বিকভাবে চিন্তা করলে, বাকযন্ত্রের উপর নামের এই নির্ভরতা জটিলতা তৈরি করে, কিন্তু আমাদের নায়ক তখন পর্যন্ত মারেফতের পথে একজন নতুন পথিক মাত্র। নিজের বোঝার অক্ষমতাকে সে চাপায় প্রেমিকার বাকযন্ত্রের ঘাড়ে। প্রেমিকার সাথে তখনো তার মিলন বাকী রয়ে গেছে।
তবে, আমাদের এই প্রেমিক মিলনে দেরি করেন না। মিলনের এই ঘটনা ছফা বর্ণনা করেছেন কো্নো বিস্তারিত বিবরণ ছাড়াই। যৌনতার সাথে দূরবর্তী সম্পর্ক রাখা ‘আদর’ শব্দটির বাইরে আর এমন কোনো শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায় না এই বর্ণনায়, যা এককভাবে যৌন মিলনের সাথে যুক্ত কোন কিছুর মেটোনিমি হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কিন্তু তারপরও মিলনের এমন একটি বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, যা খুবি বিস্তারিত কল্পনা ও অনুভব করার সুযোগ করে দেয়। ভাষার মধ্যে যৌনতাকে বাতেন রেখেই, তিনি এই মিলনের সাথে যুক্ত আবেগ ও উচ্ছাসগুলোকে জাহের করতে পেরেছেন। এই মিলনের ঘটনাটির মতোই ওঙ্কার উপন্যাসটির আরো বিভিন্ন অংশও, পল ক্লি শিল্প বলতে যা বোঝেন, তার শর্ত পুরণ করে শতভাগ – যেহেতু তা দৃশ্য উৎপাদন করেনা, বরং দেখায় বা দেখার সুযোগ করে দেয়। অথবা যদি নৃতাত্ত্বিক টিম ইনগোল্ডের ভাষা ব্যবহার করি, তবে আমাদের কল্পনায় ও বাইরের পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার আকারকে (form) পুনরুৎপাদন করাই শিল্পের কাজ নয়, বরং তার কাজ সেই শক্তিগুলোর সাথেই সম্পর্ক স্থাপন করা যা খোদ আকারকেই অস্তিত্ববান করে তোলে। ওঙ্কার উপন্যাস এমন একটি শিল্প যাতে আমরা “খারাপ বাকযন্ত্র” ও “অণু-পরমাণু”র মতো শক্তি এবং সর্বপরি অর্থহীন ভাষার সাথে এমন সম্পর্কসূত্র হাজির হতে দেখি।
এই মিলনের “দু চারদিন পরেই শরীর খারাপের নাম করে দুই মাসের” ছুটি নেন গল্পের নায়ক। “বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক” চুকিয়ে দিয়ে তিনি বাসায় “ডেরা” পাতেন। মরমি অভিজ্ঞতার প্রথম ওয়াক্তের দেখা পাওয়া একজন সুফি বা দার্শনিক সাধকের মতো তিনি সেই সাকিনা তথা অভিজ্ঞতার স্থায়ীত্ব চান। এই সময়কে তিনি বর্ণনা করেছেন তার জীবনের সবচাইতে সুখের সময় হিসাবে। দাম্পত্ব সম্পর্কে সময় দেয়ার পাশাপাশি এই সময়ে তার কাজ হয়ে ওঠে লুকিয়ে লুকিয়ে তার বোবা বউয়ের গান গাওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করা। যা আগে তার কাছে বোধগম্য ছিলনা, তখন তা বোধগম্য হওয়া শুরু হয়েছে। প্রথমবার স্ত্রীর গান গাওয়ার চেষ্টার মধ্যে হাতে পায়ে খিল ধরা হিস্টিরিয়া রোগীর যে সাদৃশ্য সে দেখতে পেয়েছিল, তখন তা তার চোখে পরিণত হয়ে গেছে “সুমিত সুন্দর একটি পিপাসা”য়। এই অবস্থায় তিনি তার স্ত্রীকেও বর্ণনা করেছেন একজন একনিষ্ঠ সাধক হিসাবে, যিনি “সুন্দরের সাধনা” করেন, যে সাধনা “ফাল্গুনের ফুল ফোটাবার জন্যে শীতে সাধনার মতো গোপন ও কঠিন”। বর্ণনাকারীর ভাষায়, ততোদিনে, “আমার চোখে তার বোবাত্ব ঘুচে গেছে”। এই সুখের সময় অবশ্য স্থায়ী হয় না। তাদের “দু’জনেরই গোপন কঠিন সাধনা”য় ছেদ ঘটে সমাজের কানাঘুসায়। কল্পনার ফেরেশতি জগত থেকে তাকে ফিরতে হয় সামাজিক, এবং তারপর রাজনৈতিক জগতের বাস্তবতায়। মরমি প্রেমের জগৎ থেকে পাঠককে ছিটকে পড়তে হয় একটি জাতীয় বিপ্লবের ইতিহাসের ময়দানে।
ওঙ্কার উপন্যাসটি শেষ প্লটের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। উপন্যাসের ভাষায়, মার্শাল আইয়ুবের সেনাদের বুটের লাথি খেয়ে তখন “গোটা দেশ আঘাতের বেদনায় গঙিয়ে উঠতো…আওয়াজে যন্ত্রনা ফুটে থাকতো”। তার বিপরীতে দেশের মানুষের তখন “চোখে আগুন, বুকে জ্বালা, কন্ঠে আওয়াজ, হাতে লাঠি”। “ঝাঁকে ঝাঁকে মিছিল”, তার বিপরীতে গুলি, আর রক্ত ঝড়া রাজপথের বর্ণনার মুখোমুখি হতে হয় পাঠককে। উপন্যাসটি সবশেষে যে অর্থহীন ভাষার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে নায়ককে, এবং পাঠককে – তাহলো মিছিলের অভিজ্ঞতা। ওঙ্কার উপন্যাসটির শেষ প্লটে আমরা অনেক মিছিলের বর্ণনা পাই, তার স্লোগানের কথা পাঠ করি ধ্বনি ও চিৎকারের নামে, কিন্তু কোনো স্লোগানের বাণী সম্বন্ধে জানতে পারি না। বোবা বউয়ের সৌন্দর্য যিনি ততোদিনে দেখে ফেলেছেন, মিছিলের সৌন্দর্য তখনো তার কাছে পরিষ্কার নয়। বরং মিছিল তিনি অপছন্দ করেন। আইয়ুব খানের পতনের আশংকায় তিনি শংকিত হন, যেহেতু ঐ ক্ষমতা-কাঠামোর একটি ঠেকনা তার শশুর। তার ভাষায়; “মার্শাল যদি যান, আমার শশুরও তবে চিৎপটাং হবেন”। নিজ প্রতীকী ব্যবস্থায় হাজির থাকা দুই পিতা চরিত্রের পতনের আশংকায়, নিজের জগতটাই ভেঙে পড়ার ভয়ে তাই সে ভীত হয়। কান চেপে রেখে, দরোজা জানাল বন্ধ করে মিছিলের আওয়াজ শুনতে সে অস্বীকার করে। মিছিলের আওয়াজ শুনলেই, তার কানে খিল ধরে। গানের আওয়াজ শোনা ও তা গাওয়ার অভিজ্ঞতা যেমন তার বোবা বউয়ের হাতে পায়ে খিল ধরাতো। হয়তো, গানকে এর অর্থহীনতার মধ্যে অনুভব করতে পারার কারনেই বোবা বউ গান গাওয়ার চেষ্টা করেছে, হয়তো বরাবরই এই কাহিনিতে তিনি এক অগ্রসর সাধক যার ভূমিকা নায়ককে পথ দেখানো মুর্শিদের ন্যায়। মিছিলের প্রতিও তাকে দেখা যায় উৎসুক ও উন্মুখ হয়ে উঠতে। সে চেষ্টা করে স্লোগান দিতে। আর নায়ক তাতে বাধা দিতে গিয়ে প্রথমবারের মতো দর্শন করেন বউয়ের রণমূর্তি।
বোবা বউয়ের মাধ্যমে ভাষার যে অভিজ্ঞতার সাথে এসময় নায়কের মুখোমুখি হতে হয়, তা গানের মতো কোমল নয়, বরং এক “ক্রুদ্ধ অশান্ত গোঁ গোঁ আওয়াজ”। এ কোন মরমী প্রেমের অভিজ্ঞতা নয়, বরং এ এক ভিন্ন ধরণের উন্মোচন (এপকেলিপ্স, মুকাশাফা)। কোরান শরীফে এই ধরণের উন্মোচনের একটি নাম “আল ক্কারিয়াহ”, যা এক নিনাদ, এক মহাবিপর্যয় (আল ক্কারিয়াহ ১-১১)। এই উন্মোচন বা এপোকেলিপ্সের ধারণা কেয়ামত ও শেষ বিচারের দিনের ধারণার সাথেও যুক্ত, এই দুনিয়ার সমাপ্তি ও অনাগত দুনিয়ার বিশ্বাসের সাথে জড়িত। ইবনে আরাবীর দর্শনে, ক্ষমা বা প্রেম যেমন আল্লাহর সৃষ্টিশীলতার উৎস, কেয়ামত ও শেষ বিচার তেমনি তার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এই ক্রোধও দিনশেষে তার ক্ষমারই একটি নাম, যেহেতু এর মাধ্যমেই তিনি তার বান্দাকে নিজের কাছে ফেরত নেন। ওঙ্কার উপন্যাসে বোবা বউয়ের ক্রোধ পাকিস্তানের সমাপ্তি এবং অনাগত বাংলাদেশের মধ্যবর্তি একটি বৈপ্লবিক সময়ে নায়কের জীবনে হাজির হওয়া এক ভীতিকর উন্মোচন। রাজপথের মিছিলের মতোই, এই ক্রুদ্ধ গো গো আওয়াজ দীর্ঘ সময় তার কাছে থেকে যায় এমন এক বিপর্যয় হিসাবে, যার সৌন্দর্য উপভোগ করতে সে সক্ষম নয়।
৪
অর্থহীন গান আর স্লোগানের অভিজ্ঞতা যদি হয় ‘ওঙ্কার’ উপন্যাসের প্রথম দুইটি মুকাশাফার অভিজ্ঞতা, তবে এই উপন্যাসটির সমাপ্তিকে তিনটি মুশাহাদা বা পর্দা উন্মোচনকারী সাক্ষ্যের ঘটনা হিসাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথম সাক্ষ্য বা শাহাদাতটি একটি ঐতিহাসিক শাহাদাত, পুলিশের গুলিতে আসাদের মৃত্যু। দ্বিতীয় শাহাদাতাটি হলো আসাদের শাহাদাতে জেগে ওঠা গণমানুষের বহু মিছিলের মধ্যে একটি মিছিলের সাক্ষ্য, যা উপন্যাসের নায়ক আমাদেরকে দেন। এই মিছিলটি প্রত্যক্ষ করার সময়ই তিনি মিছিলের সৌন্দর্য দেখা শুরু করেন, দেখতে পান তার “গতির দোলা, ছন্দের দ্যোতনা”। তিনি উপলদ্ধি করেন ও সাক্ষ্য দেন যে; “মিছিল ভয়ঙ্কর আবার সুন্দর। মিছিলে ধ্বনিত হয় ভাঙনের ধ্বংস নাদ, মিছিলে জাগে নবসৃষ্টির মহীয়ান সঙ্গীত”।
এই উপন্যাসের সর্বশেষ ও চূড়ান্ত যে সাক্ষ্যের ঘটনা তা অবশ্য এই উপন্যাসের চূড়ান্ত উন্মোচনের ঘটনাও। এই মিছিলের আনন্দে জ্বীনগ্রস্ত মানুষের মতো লাফানো বউয়ের দেহের সৌন্দর্য্যও এসময় নায়কের সামনে উন্মোচিত হয়। তার বর্ণনায়; “হঠাৎ করে একটা উপলদ্ধি জানিয়ে দিলো অঙ্গ প্রত্যঙ্গের এই বেপারোয়া সঞ্চালনেরও একটা ছন্দ রয়েছে”। এক জীবন্ত হয়ে ওঠা বর্ণনার মধ্যে আমরা নায়কের অর্থহীন ভাষা অনুভবের অভিজ্ঞতায় ক্রমপরিবর্তন এবং তা থেকে অর্থের হাজিরার বিবরণ পাই। এই অভিজ্ঞতার মধ্যে নুরি পাথরের মতো “গোল গোল শব্দাংশ”গুলার শব্দ পালটে যেতে থাকে, “গোল গোল ধ্বনিগুলো একেবেকে তেরছা, তির্যক আকার” গ্রহণ করে। বোবা বউয়ের স্লোগান তার কানে ধরা পড়ে “শিশুর অর্থবোধক বাকপ্রয়াস” হিসাবে। এবং হঠাৎ করেই নায়ক আবিষ্কার করেন যে, যেই শব্দটি বোবা বউ উচ্চারণ করতে চাইছে, তা আর কিছু নয়, বরং “মিছিলের মুখে উচ্চারিত বাংলাদেশ শব্দটি”। ইতিপূর্বে এই উপন্যাসে আর কখনো আমরা মিছিলের কোন স্লোগানের বাণী শুনতে পাই না। প্রথমবারের মতো বোবা বউয়ের মুখে উচ্চারিত গোল গোল ধ্বনিগুলো তেছরা তির্যক আকার ধারণ করে উন্মোচন করে মিছিলের একটি মাত্র শব্দ – বাংলাদেশ। তখনি সে বুঝতে পারে যে, তার বোধগম্য না হলেও “বস্তুপুঞ্জকে আমরা যে সকল নামে ডাকি” বোবা বউ এতোদিন ধরে “গো গো শব্দের মধ্য দিয়ে সেসব প্রকাশ করে এসেছে”। বোবা বউ বাংলাদেশ শব্দটি আমাদের পরিচিত আকারে হাজির না করতে পারলেও, নায়ক বাংলাদেশের পক্ষে তার এই সাক্ষ্যের অভিজ্ঞতাটি অনুভব করতে পারেন, এই ঘটনার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে পারেন। বোবা বউয়ের শাহাদাত তাই এই উপন্যাসের প্রধান ও চূড়ান্ত শাহাদাতের ঘটনা।
শাহাদাতের ঘটনাটি এখানেও শেষ হতে পারতো। কিন্তু আমাদের মতো আম পাঠকদের কাছে এই চূড়ান্ত মুকাশাফা ও মুশাহাদার প্রমাণ দিতে গিয়েই যেনবা আহমদ ছফা উপন্যাসটি শেষ করেছেন একটি কুদরত বা মিরাকলের ঘটনার মাধ্যমে। উপন্যাসের শেষে, মিছিল থেকে সঞ্চারিত উন্মাদনার চূড়ান্ত অবস্থায়, বোবা বউয়ের মুখে পরিষ্কারভাবে উচ্চারিত হয় – বাঙলা। নায়কের বর্ণনায়; “আচানক বোবা বউ জানলা সমান লাফিয়ে ‘বাঙলা’ অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করলো”। তার গলা দিয়ে রক্ত বেড়িয়ে আসে, সে সঙ্গা হারিয়ে ফেলে। এই ঘটনাটি যে একটি শাহাদাতের ঘটনা তার চূড়ান্ত সাক্ষ্য দিতে গিয়েই যেন নায়ক প্রশ্ন তোলেন; “কোন রক্ত বেশি লাল। শহীদ আসাদের, না আমার বোবা বউয়ের”। এই শাহাদাত আমাদের সামনে পরিষ্কার উচ্চারণের আকারে যা উন্মোচিত করে তাহলো – বাঙলা। বোবা বউয়ের মুখে উচ্চারিত বাঙলা শব্দটির কোন অর্থ বা সঙ্গা তুলে ধরা এই লেখাটির উদ্দেশ্য নয়। ‘ওঙ্কার’ উপন্যাসটিও বাঙলা শব্দটির তেমন কোন অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে হাজির করেনা। গত দুই শতকে শব্দটি যেসব ডিসকার্সিভ অর্থ লাভ করেছে, যেসব সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ধাতের (essence) প্রতিনিধিত্ব করবার ভার বহন করেছে, সেসব অর্থ ও ধাতবাদী মতাদর্শকে যদি আমরা আপাতত ভুলে থাকতে পারি, তবে বোবা বউয়ের মুখে উচ্চারিত বাঙলা শব্দটি আমাদেরকে মুখোমুখি করে এমন এক অর্থহীন নামের সচ্ছ অভিজ্ঞতার সাথে যা প্রকাশ ও প্রমান করে যে – বাঙলা আছে। বাঙলা, বাঙালি, বাংলাদেশ ইত্যাদি শব্দ বর্তমান দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বহুল উচ্চারিত শব্দ। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ইত্যাদি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পক্ষ এসব শব্দের বিভিন্ন ধাত ও সংজ্ঞা হাজির করেন, এসব শব্দের উপর নানান দোষ গুন আরোপ করেন। শব্দগুলো প্রতিনিয়ত পরিণত হয় বিভিন্ন পক্ষের দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধের ময়দানে, বর্তমান দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ময়দানের মতোই। কিন্তু, দক্ষিণ এশিয়ার বাঙালি ও অবাঙালি সবাইকেই যেই সত্যটির মুখোমুখি হতেই হবে তাহলো যে – বাঙলা আছে। এবং এই সত্যই ‘ওঙ্কার’ উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় মুকাশাফা ও মুশাহাদা।
এতক্ষনের আলোচনা থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌছানো যায় যে ‘ওঙ্কার’ উপন্যাসটি আমাদের সামনে বাঙলা শব্দটিকে হাজির করে এমন এক নাম হিসাবে, যার নিজের কোনো অর্থ না থাকলেও তা অর্থ উৎপাদন করতে পারে। আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যখন বাঙলা শব্দটির সাথে যুক্ত সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক মতাদর্শগুলো অর্থহীনতায় পর্যবশিত হয়েছে, যখন বাঙলা শব্দটি একটি প্রতীকী ব্যবস্থার নাম হওয়ার বদলে পরিণত হয়েছে একটি স্বৈরাচারী প্রতীকী ব্যবস্থার মতাদর্শিক প্রতীকে, যখন পশ্চিম বাংলায় এযাবৎকাল ধরে হাজির থাকা বাংলা ও বাঙালি ধারণার মধ্যকার স্ববিরোধিতা ও দ্ব্যার্থবোধকতাগুলো প্রকট করে তুলেছে বিজেপির রাজনৈতিক উত্থান – তখন বাঙলা শব্দটিকে এমন একটি অর্থহীন নাম ও ধ্বনি হিসাবে অনুধাবন করা বিশেষভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে যার মধ্যে নতুন অর্থ সৃষ্টির সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে। হয়তো, আহমদ ছফা যখন ওঙ্কার উপন্যাসটি লিখেছিলেন, তখনি বাঙলা শব্দটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শগুলোর অর্থহীনতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। আর এই কারনেই সেই অর্থহীনতার মধ্যে নতুন অর্থের সম্ভাবনাকে হাজির করতে চেয়েছেন।
আজকে যখন নাগরিকত্ব হারানো বাঙলাভাষীদের জায়গা হচ্ছে ডিটেনশন ও রিফিউজি ক্যাম্পে, যখন বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম বাঙলায় যাওয়ার পথে বাংলাদেশের নাগরিকরা গুলি খেয়ে ঝুলে থাকছে কাঁটাতারে, তখন বাঙলার এমন একটি অনাগত সমাজের কথা আমাদের চিন্তা করতে হবে যে সমাজের রাজনীতি বাঙলা শব্দটি উচ্চারণ করতে অক্ষম জীবের জীবনেরও প্রতিনিধিত্ব করবে। বোবা বউয়ের শাহাদাত এমন একটি অনাগত সমাজেরও সাক্ষ্য দেয়।
তথ্যসূত্র:
[আরাবি] Ibn Arabi, Muhi-e-Din. Contemplation of The Holy Mysteries and The Rising of The Divine Lights (Mashahid al Asrar). Translated from the arabic by Cecilia Twinch and Pablo Beneito, Anqa Publishing, 2008.
[আগামবেন] [হোমো স্যাকের] Agamben, Giorgio. Homo Sacer; Sovereign power and Bare Life, Translated by Daniel Heller-Roazen. Stanford University Press, 1998.
[আগামবেন] [ভাষার ধারণা] Agamben, Giorgio. “The Idea of Language”. Potentialities; Collected Essays in Philosophy, Ed and Trans, Daniel Heller — Roazen. Stanford University Press, 1999.
[আগামবেন] [ভাষা ও ইতিহাস] Agamben, Giorgio. “Language and History: Linguistic and Historical Categories in Benjamin’s Thought”. Potentialities; Collected Essays in Philosophy, Ed and Trans, Daniel Heller — Roazen. Stanford University Press, 1999.
[চিত্তিক] Chittik, William C. Ibn al Arabi’s Metaphysics of Imagination, The Sufi Path of Knowledge. State University of New York Press, 1989.
[জিলানি] Al-Jilani, Hadrat Ábd al-Qadir. The Secret of Secrets, Cambridge, Islamic Texts Society, 1992.
[ইনগোল্ড] Ingold, Tim. “Bringing Things Back to Life: Creative Entanglements in a World of Materials”. NCRM Working Paper. Realities / Morgan Centre, University of Manchester, 2010.
পারভেজ আলম
লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক কর্মী। ইউনিভার্সিটি অফ আমস্টার্ডামের সংস্কৃতি বিশ্লেষণ বিভাগে গবেষণারত। প্রকাশিত বইঃ মদিনা (২০২০), মুসলিম জগতের ক্ষমতা-সম্পর্কের ইতিহাস; জিহাদ ও খেলাফতের সিলসিলা (২০১৬), ডিসেপেয়ারিং পাবলিক স্ফিয়ার্স (২০১৬), শাহবাগের রাষ্ট্রপ্রকল্প (২০১৪), মুসলিম দুনিয়ার জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াই (২০১১)।