।। জেসমিন নাহার ।।
রাইমাকে গল্প এতটুকু শোনানো মাত্র তার মায়ের মাথায়, শরীরে টপাটপ কিল ঘুসি পড়তে থাকে। রাইমার দাদি তার ছেলের সাথে কথা বলেছে মাত্র। ছেলে পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে শিরিনাকে ছেড়ে দেবে। পাঁচ বছর যাবত এক কথা বলা সত্ত্বেও কেন শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে শিরিনা চলে যাচ্ছে না সেই রাগ এবং ক্ষোভে রাইমার দাদি তার বৌমাকে মারতে থাকে! মারতে মারতে বলতে থাকে, ছিনাল মাগি, তোর কী আছে! রূপ না যৌবন? আমার ছেলে তোকে কেন রাখবে? যা মাগি ভাগ, তুই বিদায় হলে আমার ছেলে বাড়ি ফিরে তার পছন্দের পাত্রীকে বিয়ে করবে।
দুনিয়ার সব গল্প গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে আছে
মায়ের কাছে যে গল্পই শোনে তা রাইমার কাছে সত্য বলে মনে হয়। কোনো কো্নো সকালে মা ঘুম থেকে উঠে সাপের কথা বলে। স্বপ্ন দেখেছে মায়ের মাথার উপর দিয়ে সাপ উড়ে যাচ্ছে! রাইমা কল্পনায় সেই সাপ দেখে। শোয়ার সময় সেও মায়ের মত কল্পনা করে ঘুমায় যে ঘুমের মধ্যে সাপ উড়ছে! মাথার উপর দিয়ে সাপ উড়ে যাচ্ছে।!কিন্তু সাপ ওড়ে না, বরং মায়ের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বপ্ন সে দেখে। সে দেখে, পুকুরে সাঁতার কাটছে আর সাপ তাকে তাড়া করেছে! সে জোরে সাঁতার দিয়ে কূলে যাচ্ছে আর আত্মরক্ষার্থে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ’ পড়ছে! এক নাগাড়ে কয়েকদিন সে তেড়ে আসা সাপের স্বপ্নই দেখতে থাকে!
আরও দেখে, পুকুর ভর্তি সাপ। তার পায়ের সামনে সাপ। সে ওই সাপ ডিঙাতে ভয় পাচ্ছে। সে কয়েকদিন পরে আবার মায়ের কাছে গল্প শোনে মস্ত বড় ঢেঁকিবুড়া সাপ এক পুকুরে গাছের গুঁড়ির মতো পড়েছিল। ছেলেমেয়েরা সেই সাপের উপরে বসে গোসল করতো। এক সময় তাদের সকলের গায়ে চুলকানি বের হলো। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো তাদের সকলকে। ডাক্তার অভিভাবকদের জিজ্ঞাসা করেন, তারা গোসল কোথায় করে? অভিভাবকদের কাছ থেকে উত্তর যায়, পুকুরে। ছেলে মেয়েরা অতি পুরাতন গাছের গুঁড়িতে বসে। তখন ডাক্তার অভিভাবকদের সাথে গ্রামে আসেন। পুরাতন গাছের গুঁড়ির উপরে লোহা গরম করে ছ্যাঁক দেন। প্রকাণ্ড গাছের গুঁড়ি নড়ে ওঠে। ডাক্তার গ্রামবাসীকে জানায়ে দেয়, এই পুকুরে মস্তবড় অজগর বাস করে! এখানে গোসল করা বারণ!
রাইমার মায়ের এই গল্পটা খুব ভালোলাগে। সে পুকুরে গোসল করতে গিয়ে কাঠের গুঁড়ির উপরে বসেই ভাবে মস্তবড় অজগরের গায়ের উপরে বসে গোসল করছে। স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সাথে অজগরের গল্প বলে। অনেকে তার গল্প বিশ্বাস করে আবার অনেকে হেসে উড়িয়ে দেয় কল্প কাহিনী বলে। কয়েকদিন পর যখন অজগরের গুঁড়ির উপরে বসে গোসলের স্বপ্ন তার কেটে যায়, তখন মায়ের কাছে আবার সাপের গল্প শোনে।
পুণরায় মা তাকে সাপের গল্প বলে, সত্য গোখরো সাপের গল্প। ও পাড়ার কেলে শাহজানের বউ তার সাত বছরের মেয়ে ইয়াসমিনকে নিয়ে কাশেমের পল গাদার পল চুরি করতে গিয়ে মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে দাঁড় করাবে না করাবে সাপের গায়ের উপরে দাঁড় করিয়েছিলো। সাপে কেটেছিল তাকে। পনেরো মিনিটের মাঝে ইয়াসমিন বমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল! আর ওঠেনি! রাইমা ভয় পায়। যখন তার স্বপ্ন জুড়ে এরকম সাপ জুড়ে আছে তখন সে মায়ের কাছে প্রকৃত সাপের গল্প শুনে আঁতকে ওঠে। সাপ তার নিকট বিভীষিকায় পরিণত হয়। সে তখন হেলে সাপ, ঢোঁড়া সাপ দেখেও চমকে ওঠে! ভয়ে দৌড়ে গিয়ে মায়ের বুকে মুখ লুকায়! মা তাকে বোঝায় সব সাপের বিষ নাই। খুব অল্প সাপেরই বিষ আছে। তারা হেলে ঢোঁড়াদের মত সচরাচর বাইরে বের হয় না।
রাইমা প্রাণ দিয়ে মায়ের কথা বিশ্বাস করে। হাসি মুখে মাকে জড়িয়ে ধরে। আদর খায়, আদর দেয়। ঘুমানোর সময় নিজেকে ইয়াসমিন ভেবে ইয়াসমিনের মায়ের দুখে কেঁদে বালিশ ভাসায়। স্বপ্নের মাঝে ইয়াসমিনের মায়ের স্থানে নিজের মাকে দেখে ‘মা’ বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে রাইমা। মা তাকে বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু দিতে দিতে বলে, পাগল মেয়ে এই না আমি। মা বুঝতে পারে মেয়ের মনের উপরে ইয়াসমিনের মৃত্যু প্রভাব ফেলেছে। গল্পের মাঝে ভিন্নতা আনে রাইমার মা।
রাইমার মা অবসরে রাইমাকে ডাকাতদের গল্প বলে। এক ভাই তার বড়লোক বোনের বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়েছিলো। বোনের তখন সদ্য বাচ্চা প্রসব হয়েছে। ভাই তার ডাকাত দলকে নির্দেশ দিয়েছে কোন প্রকার তার বোনের ঘরে যেন না যাওয়া হয়। কিন্তু ডাকাত দল ডাকাতি শেষে সোনাদানা গহনা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ফেরার পথে দেখে নিচ তলার একটা ঘরে টিম টিম বাতি জ্বলে কিন্তু তাদের ওই ঘরে আক্রমণ করা হয় নি। তখন ওই ঘরে যায় এবং দেখে শিশু সহ মা ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে। ডাকাত দলের সর্দার ওই সময় হুতাশভরে বোনের ঘরের সামনে এসে বলে ফেলে, তোদের কি নিষেধ ছিল না আমার বোনের ঘরে ঢুকবি না? ভাইয়ের কথা বোন শুনে ফেলে। ভাইয়ের প্রতি বোনের আজীবন অভিমান… অনুশোচনায় ভোগে ভাই।
মায়ের ডাকাতের গল্প শুনে রাইমার কয়েকদিনের চিন্তায় কেবলই ডাকাত! রাতে শোবার সময় সে কল্পনা করে, ডাকাত দলের সর্দার তার ভাই এবং সে ডাকাত সর্দারের বোন। ভাইয়ের কৃত অপরাধের দরুণ সে ভাইকে কখনো ক্ষমা করে না।
মায়ের গল্প রাইমার শিশু মনে ভাবনার জগত তৈরি করেছে। খেলতে খেলতে কখনো মা, কখনো বোন আবার কখনো ডাকাত সর্দারের অভিনয় করে। আপন মনে হাসে আবার আপন মনে কাঁদে। এক গল্প অনেকদিন বলতে বলতে বন্ধুদের কান ঝালাপালা করে দিয়েছে। একটা গল্প তার সম্পূর্ণ আবেদন না হারানো পর্যন্ত সে মায়ের কাছে আবদার করে না ভিন্ন গল্প শুনবার। বন্ধুরা যখন বিরক্তি প্রকাশ করে, তখন লেখাপড়া শেষে মায়ের কাছে রাইমা ভিন্ন ডাকাতের গল্প শুনবার আবদার।
মা তাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে গল্প বলে। এক ডাকাত দল এক গেরস্থ বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়েছিল। গিয়ে দেখে, রান্নাঘরের পাচকেরা জেগে আছে। তারা গামলা গামলা মাছ ধোয়ায় ব্যস্ত। মাছ তারা ধুতেই আছে, ধুতেই আছে, ধুতেই আছে। মাছ ধোয় আর মাছ ধোয়া পানি জিভে দিয়ে দ্যাখে। সমস্ত রাত পাচকেরা মাছ ধৌত করে আর পানি চেখে দ্যাখে। ডাকাতদলও ডাকাতি ভুলে পাচকদের মাছ ধোয়া দেখতাছে! রাত দু’প্রহর গড়িয়ে গেলে পাচকদের মাছ ধোয়া শেষ হয়। ডাকাত সর্দার তার দলের একজন সঙ্গীকে রেখে অন্যদের বিদায় দেয়। এবং সেদিন দুপুরে ওই গেরস্থ বাড়িতে ডাকাতির বদলে ডাকাত সর্দার হয়ে ওঠে একজন অতিথি! তারা পাচকদের সমস্ত রাত ব্যয় করে ধোয়া মাছ দিয়ে ভাত খায়। খেয়ে বিদায় নেবার সময় বাড়ির কর্তাকে বলে, আমরা আপনার বাড়িতে গতরাতে ডাকাতি করতে এসেছিলাম। কিন্তু আপনার পাচকদের সমস্ত রাত জেগে মাছ ধোয়ার কারণে আমরা ডাকাতি করবার সুযোগ পায়নি। তারা জিভে মাছ ধোয়া পানি চেখে দ্যাখে।
মাছ ধোয়া পানিতে কী আছে? আর আপনার বাড়িতে রান্না হওয়া মাছের স্বাদ কেমন তাই জানতে আজ আমরা আপনার বাড়ির অতিথি হয়েছি। বেশ স্বাদ এই মাছের।
তখন গেরস্থ জবাব দেয়, ‘মাছ ধুলে মিটে, গোশ ধুলে সিটে’। অর্থাৎ মাছ ধুলে মিঠে হয়, আর গোশ্ত ধুলে সিঁটে হয়ে যায়’। ডাকাত সর্দার ডাকাতি ভুলে মাছ ধোয়ার মন্ত্র শিখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
মায়ের বলা এই গল্পটা রাইমার বেশ পছন্দ হয়। সে তার মায়ের মাছ ধোয়া খেয়াল করে, যখনই তার মা মাছ কেটে ধোয়, সে দ্যাখে তার মা মাছ ধোয়া পানির স্বাদ নিয়ে দেখে না, কিন্তু বেশ সময় নিয়ে মাছ ধোয়। গল্প শোনার আগেও তার মায়ের রান্না করা মাছ মজার ছিল। পরেও ঠিক একই রকম মজা। বিকালের খেলার সাথীদের সাথে সে ডাকাত ডাকাত খেলতে গিয়ে এই গল্পের বিভিন্ন চরিত্র সাজিয়ে নিজে ডাকাত সর্দার হয়ে অভিনয় করে। স্কুলের বন্ধুদের সাথে, পাড়ার মা চাচিদের কাছে শিশু রাইমা ছড়া কেটে বেড়ায়, ‘মাছ ধুলে মিটে, গোশ ধুলে সিটে’। কেউ কেউ শুনে হাসে আর কেউ কেউ বলে ওরে জানি রে আমরা জানি। ও প্রবাদ জানি। তোর আর বলে বেড়াতি হবে না।
রাইমার বাবা সৌদি আরব থাকে। রাইমার বয়স যখন দুই বছর তখন তার বাবা বিদেশ চলে গিয়েছে। তখন থেকে সে মায়ের আদরে বড় হয়েছে। বিদেশ যাবার ছয় মাসের মধ্যে তার বাবা তাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। তার বাবা শুধু তার দাদা দাদির সাথে যোগাযোগ করে। টাকা পাঠায়। কিন্তু রাইমা এবং তার মা শিরিনার কোন খবরই নেয় না। শোনা যায় রাইমার বাবা তার মাকে ছেড়ে দিতে চায়। তাই মা মেয়ের সম্পর্কের যোগ বেশি নিবিড়। একে অপরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। দু’জন দু’জন কে চোখে হারায়। পৃথিবীর যত আনন্দ তারা দুজনের মাঝে খুঁজে নেয়।তার দাদা-দাদি তাকে ভালোবাসে কিন্তু তার মা যেন তাদের চক্ষুশূল।ছেলের কথাও তাদেরই কথা। শ্বশুরবাড়িতে মায়ের আশ্রয় মাত্র এই শিশু মেয়ে। মেয়ে যেদিকে যায় মায়ের চোখের তারা সেদিকে খেলা করে।মেয়ে হবার পর থেকে সে খাদ্য কম খেয়ে মেয়ের জন্য তুলে রাখে। বাবার বাড়ি গেলে রাইমার নানি তার মাকে খাওয়ানোর জন্য খোশামোদ করে আর রাইমার মা সেই খাদ্যটুকু ব্যাগে ভরে রাইমার জন্য দিয়ে দিতে বলে।স্কুলের সময় ছাড়া মেয়েকে সে দূরে রাখে না। দিনের সমস্ত কাজ গুছিয়ে তাই সন্ধ্যাবেলা পরিপাটি হয়ে মেয়েকে আগে লেখাপড়া করিয়ে নেয়। তারপর নানান গল্প শোনানোর পালা। মায়ের সকল গল্পই বিশ্বাস করে মেয়ে। মনোযোগ দিয়ে শুনে আয়ত্ব করে নেয়। একেকটা গল্পের রেশ মেয়ের মনে থেকে যাওয়া অবধি আরেকটা গল্প শোনায় না। মাছ ধুলে মিটে, গোশ ধুলে সিটের গল্পই বেশ কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী ছিল মেয়ের মনে। আজ সন্ধ্যায় আবার রাইমাকে তার মা গল্প শোনাবে। তাকে আজ তার মা দৈত্যদানবের গল্প শোনাতে চায়। কিন্তু রাইমার বাহানা সে ডাকাতের গল্প শুনবে।
অগত্যা তাকে ডাকাতের গল্প বলা শুরু করতে হলো। কাল্পনিক গল্প সে আর বলতে পারলো না। জানা নেই তার। সে তাদের পাশের গ্রামের মিজান ডাকাতের গল্প শোনায়।
মিজান ডাকাত প্রথমে চোর ছিলো। সিঁধ কেটে মানুষের ঘর থেকে মূল্যবান দ্রব্য চুরি করতো। সিঁধ কেটে চুরি করতে করতে এক সময় তার হাত পেকে যায়। সে একটা ডাকাতদল তৈরি করে। রহিমপুর এলাকার যত গেরস্থ বাড়ি আছে সব বাড়িতেই ডাকাতি করেছে মিজান ডাকাত। রহিমপুর ছেড়ে পাশের থানা রামচন্দ্রপুরের গেরস্থ বাড়ির দিকে চোখ দেয়। একদিন রামচন্দ্রপুরের জলিল স্যারের বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে দুই ডাকাতদল একই সাথে এক বাড়িতে ঢুকে পড়ে। ডাকাত দলের থানা ভাগ করা ছিল। অন্য থানার ডাকাত দেখে রামচন্দ্রপুরের ডাকাতদের মাথা বিগড়ে যায়। তারা জলিলের বাড়ির মানুষদের ঘরে বন্দী করে রেখে মিজান ডাকাতদের উপরে এলোপাথাড়ি মার দিতে থাকে। দিশা না পেয়ে মিজান ডাকাতের দল যে যেদিকে পারে ছুটতে থাকে। রামচন্দ্রপুরের ডাকাতরা চেয়েছিল মিজান ডাকাতকে খুন করতে! কিন্তু মিজান পাঁচিল টপকে বের হয়ে পড়ে। রহিমপুরের সমস্ত ডাকাতকে তাড়ানো হয়ে গেলে রামচন্দ্রপুরের ডাকাত দল ডাকাতি করে ফিরে যায়। কিন্তু মিজান ডাকাত পাচিল টপকে ড্যাবড্যাবা সারগর্তের মাঝে ডুবে যায়। হাত দুটো এবং মাথাটা শুধু গোবরেরে উপরে থাকে। আর সমস্ত দেহ গোবরের নিচে।! রাত শেষ হয়ে সকাল হয়ে যায়। সার গর্তের পাশেই রাস্তা। রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাচল শুরু হয়ে যায়। মিজান ডাকাত মুখ আর নাকটা শুধু বাইরে রেখে ঘাপটি মেরে গোবরের মধ্যে পড়ে থাকে। সারাদিনে তাকে খোঁজের জন্য কোন মানুষ যায় না। জলিলের বাড়ি থেকেও কেউ সারগর্তে গোবর ফেলতে যায়নি ওইদিন। এমনকি রাস্তার মানুষও কেউ গোবরগাদার দিকে সারাদিনে চেয়েও দেখেনি। পুরা একটাদিন এবং একটা রাত মিজান ডাকাতের কেটে গোবরগর্তের মধ্যে পড়ে থাকতে হয়। পরের দিন সকালে জলিলের বড় ভাবি গোয়াল পরিস্কার করে গোবর ফেলতে সারগর্তে যায়। গিয়ে গোবর ফেলে ফেরার সময় শোনে কেউ তাকে মা সম্বোধনে ডাকছে। পেছন ফিরে কাউকে দেখে না, আবার চলতে শুরু করে, শোনে ‘মা’। জলিলের ভাবি ভালো করে চারিদিকে চেয়ে দেখে মানুষের মাথা মুখ এবং হাত। সে ভয় পায়। জিজ্ঞাসা করে, কে? উত্তর পায্ আমি রহিমপুরের মিজান ডাকাত।
রাইমাকে গল্প এতটুকু শোনানো মাত্র তার মায়ের মাথায়, শরীরে টপাটপ কিল ঘুসি পড়তে থাকে। রাইমার দাদি তার ছেলের সাথে কথা বলেছে মাত্র। ছেলে পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে শিরিনাকে ছেড়ে দেবে। পাঁচ বছর যাবত এক কথা বলা সত্ত্বেও কেন শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে শিরিনা চলে যাচ্ছে না সেই রাগ এবং ক্ষোভে রাইমার দাদি তার বৌমাকে মারতে থাকে! মারতে মারতে বলতে থাকে, ছিনাল মাগি, তোর কী আছে! রূপ না যৌবন? আমার ছেলে তোকে কেন রাখবে? যা মাগি ভাগ, তুই বিদায় হলে আমার ছেলে বাড়ি ফিরে তার পছন্দের পাত্রীকে বিয়ে করবে। শিরিনা কোন কথার উত্তর না দিয়ে রাইমাকে নিয়ে ঘরে দোর দিয়ে শুয়ে পড়ে। এই কথাগুলো সে এতবার শুনেছে যে তার আর এই নিয়ে কোনো তাপ-উত্তাপ নেই, গায়ে লাগে না আর কথাগুলো। মেয়ে ব্যতীত পৃথিবীর আর কোন কিছুর প্রতিই তার দরদ নাই, মোহ নাই, টান নাই। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে, নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে । সকালে ভাপ দেওয়া ধান বারান্দা থেকে বের করে উঠানে ফেলে, মেয়েকে খাওয়ায়ে, পরিপাটি করে স্কুলে পাঠায়। নিজেও ধান বিছানো, খাওয়াদাওয়া শেষ করে। ঘরে গিয়ে দড়িতে টাঙানো শাড়িটা টেনে নিয়ে খাটে দাঁড়িয়ে ফ্যানের সাথে বাঁধে ।
পৃথিবীর সমস্ত মায়া ত্যাগ করে রাইমার মা ঝুলে পড়লো!
বেলা এগারোটার দিকে রাইমার স্কুলে খবর গেলো তার মা মারা গিয়েছে। শিশু রাইমা মায়ের আদর বোঝে, মায়ের ঘুম বোঝে কিন্তু মৃত্যু বোঝে না। বাড়ি ফিরে দেখলো মা ঘুমায়। মাকে গিয়ে কয়েকবার ডাকলো, কিন্তু মায়ের ঘুম ভাঙলো না।তাদের বাড়ি ভর্তি মানুষ। তার নানা বাড়ির আত্মীয়স্বজন একে একে সবাই তাদের বাড়িতে চলে এলো। সকলে বিষণ্ণ। নানি তার মায়ের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কাঁদছে। নাকে মুখে চোখে চুমু দিচ্ছে আর পাগলের প্রলাপ বকছে। রাইমা বুঝতে পারছে না মৃত্যু কী!! তার মা তাকে ইয়াসমিনের মৃত্যুর গল্প বলেছে। তাই সে বিশ্বাস করে মানুষ কে বিষধর সাপে কামড়ালেই শুধু মানুষ মরে। দাদি মারলে, গালি দিলে, দাদা চোখ রাঙালে সে শুধু জানে তার মা তাকে নিয়ে ঘরে গিয়ে খাটে বুকে জড়িয়ে রাখে। কিন্তু মৃত্যু কীভাবে এলো? সকলে বলছে, তোর মা গলায় দঁড়ি দিয়ে মরেছে! কিন্তু মায়ের গলার সাথে মায়ের গতকালের পরণের শাড়িটা পেঁচানো আছে। দুপুর গড়াতে গড়াতে তার মাকে একটা গাড়ি এসে নিয়ে গেল।লোকে তাকে বললো, তোর মায়ের ময়নাতদন্ত হবে। রাইমা ভাবছে ময়না বলে তো তার মা তাকে ডাকে। তদন্ত তাহলে কী?
তার সব ভাবনা মনে রইলো। তার মাকে ময়নাতদন্ত শেষে তার নানা বাড়ির কবর স্থানে মাটি দেওয়া হলো। তার মায়ের কী হলো রাইমা বুঝার আগেই সকলে তার মায়ের কপাল চেরা, চোখ গর্তে ভরা বিকৃত একটা মুখ একপলক দেখিয়ে মাটি চাপা দিলো। সারাদিন এইভাবে কাটলো। সন্ধ্যাবেলা মায়ের অপেক্ষায় বসে রইলো রাইমা। মা আসে না বলে সে ছটফটিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। তার নানি তাকে তার মায়ের মতই অষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বুকে রেখে দিলো। কিন্তু রাইমা শান্তি পেলো না। এ তার মায়ের ঘ্রাণ নয়। এখন তার নানির বুকে নয় মায়ের বুকে শুয়ে মিজান ডাকাতের বাকি গল্পটুকু শোনার কথা। কিন্তু দুনিয়ার সব গল্প গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে আছে।
এখন তার নানির বুকে শুয়ে মনে পড়ছে মা তার ডাক শোনেনি। মা হেঁটে হাসপাতালে যায় নি। মায়ের মুখ ক্ষত-বিক্ষত ছিল। রাইমার সমস্ত কান্না, রাগ, ক্ষোভ মায়ের নিথর মুখের উপরে হলো। সে তার নানির মুখ নখের আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত করে বললো, আমার মা বাড়িতে, বারান্দায় বসে, পড়াবে এখন আমাকে। মাটি চাপা দিয়েছো যাকে সে একজন বোবা, সে আমার মা না।
রাইমার কান্না এবং চিৎকার তার নানির সমস্ত হৃদয় তছনছ করে দিলো। সেও বোবা হয়ে নাতনিকে ছেড়ে দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো।
কিন্তু গল্প আর ফিরে এলো না। গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে রইল।
জেসমিন নাহার
ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর। বাড়ি যশোহর জেলার শার্শায়। গোড়পাড়া সর্দারবাড়ির মেয়ে। বাবা নুরুল ইসলাম। চিশিতিয়া তরিকার ফকির ছিলেন। মা রওশানারা বেগম। গল্প লেখক। উপন্যাসও লিখছেন।