।। ফরিদা আখতার ।।
“এই যুগে তিনি রোকেয়া খাতুন কিংবা মিসেস আর এস হোসেন নন, তিনি একমাত্র ‘বেগম রোকেয়া’। তাঁর নামের আগে এই বেগম জুড়ে দেয়া হয়েছে নারীমুলক সম্মান ও সংস্কারের জন্য। বেগম বলার মধ্যে পুরুষতন্ত্রের গন্ধ আছে; কিন্তু রোকেয়ার সমস্ত কর্মকাণ্ড, তাঁর লেখা, তাঁর দুরদৃষ্টি – সবকিছু মিলিয়ে নামের সাথে ‘বেগম’ যুক্ত করা একদিক থেকে ফেমিনিজমের প্রতীক হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ বেগম রোকেয়া মানে হয়ে উঠেছে ‘ফেমিনিস্ট’ রোকেয়া।”
বাংলার নারী আন্দোলনের নিজস্বতার আইকন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জীবন ও নারীমুক্তির ভাবনা বিষয়ে লিখছেন উপমহাদেশের নারী আন্দোলনের বিশিষ্টজন ফরিদা আখতার।
গত শতাব্দীর শুরু থেকে বর্তমান ২০২০ সালে এসে একটা সত্য উপলব্ধি আমাদের হওয়া দরকার। আমাদের সমাজে নারী আন্দোলনকে বাইরে থেকে যতোই ‘আধুনিক’ মনে হয় চিন্তার দিক থেকে নারী আন্দোলন একটা খুব অগ্রসর হতে পারে নি। মোটা দাগে এর পেছনে তিনটি কারণ উল্লেখ করা যায়। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য যে নারীকর্তা পয়দা করেছে তার কাছে পাশ্চাত্যের উচ্চবিত্ত শ্বেতাঙ্গ মহিলাদের আদর্শই নারীর প্রগতির একমাত্র গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড। নারী নামক কোন একাট্টা সামাজিক, সাংস্কৃতিক কিম্বা রাজনৈতিক সত্তা নাই। কৃষ্ণাঙ্গ নারীর লড়াই আর শ্বেতাঙ্গ নারীর লড়াই এক না, যেমন এক না খেটে খাওয়া মেহ্নতি কৃষক ও শ্রমিক নারী আর বিপরীতে মধ্যবিত্ত, ধনি বা সম্পদশালী নারী। আদিবাসী নারীর লড়াই বাংলাদেশী নারীর লড়াই থেকে আলাদা। কিন্তু সেই সকল বাস্তব লড়াই থেকে আমরা শিক্ষা নিতে চাই না। আমাদের আদর্শ হয় পাশ্চাত্যের শ্বেতাঙ্গ নারীবাদ।
আধুনিক পশ্চিমা শিক্ষার এই সংকীর্ণ বর্ণবাদী নারীবাদই মধ্যবিত্ত নারীকে দিয়ে অধিকাংশ সময় পয়দা করে যাচ্ছে, ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণার বাইরে সে যেতে পারে না। যখন নারী একই সঙ্গে তার সমাজের নানাবিধ পরাধীনতার সঙ্গে লড়ে, সে লড়াইয়ে সরাসরি অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে জাতীয় ক্ষেত্রে নারী তার ছাপ দিয়ে যায়। সংকীর্ণতার দ্বিতীয় কারন পাশ্চাত্য চিন্তার বাইরে, বিশেষ ভাবে বাংলার ভাবান্দোলনে, নারীপুরুষের সম্বন্ধ রচনার ক্ষেত্রে নারীর নিজের একটা দীর্ঘ লড়াই আছে। বাংলার ইতিহাসে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছটিয়ে আছে, আধুনিক শিক্ষিত নারীর সেটা নজরে পড়ে না। সেই ইতিহাস সম্পর্কে বাংলার নারীরা এখনও যারপরনাই অজ্ঞ। ঔপনিবেশিক শাসন এবং আধুনিক কালে পরমুখাপেক্ষিতা নিজেদের ভাবচর্চার ইতিহাসের সঙ্গে নাড়ির বাঁধন ছিঁড়ে দিয়ে গেছে। ফলে কাজ অনেক পড়ে আছে।
তৃতীয় কারণ হচ্ছে পর্যালোচনামূলক চিন্তা আয়ত্ব করবার অক্ষমতা। সেই ক্ষেত্রে নারী একা দোষী নয়, এই অভাব সমাজে আছে। একে কাটিয়ে তুলতে হবে।
মুসলমান সমাজে নারীকে কিভাবে অগ্রসর করে নেওয়া যায়, রোকেয়া সেই লড়াই করেছেন। নারী-পুরুষের ক্ষমতার অসমতা নিয়ে তাঁর দারুন সব কথা আছে। খুবই ভাল। ফলে নারীর মুক্তির প্রশ্নে তাঁর চিন্তা যে কোন মেয়েকেই অনুপ্রাণিত করবে সন্দেহ নাই। কিন্তু তাকে তড়িঘড়ি শস্তা পুরুষ বিরোধী নারীবাদের খোপে ফেলা অনর্থক।
ডিসেম্বরের ৯ তারিখ বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যু দিবস। দীর্ঘদিন রোকেয়ার কোন স্বীকৃতি ছিল না। এখন সরকারিভাবে পালিত হয়, সরকারি ভাবে রোকেয়া পদকে অনেককে ভূষিত করা হয়। এই দিনে সকলে বেগম রোকেয়াকে স্মরণ করেন, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয়। সেটা মন্দের ভাল। নারী শিক্ষার জন্যে বেগম রোকেয়ার সংগ্রামের সুফল আমরাও পেয়েছি। তাই আজ দু’কলম রোকেয়ার জয়গান করা আমাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।
রোকেয়া খাতুন বাংলাদেশের রংপুরের মেয়ে ছিলেন, সাখাওয়াত হোসেনের সাথে তাঁর বিয়ের পর তিনি কলকাতায় চলে যান। রোকেয়া তাঁর ভাইদের কাছে পরিবার থেকে লুকিয়ে ইংরেজী ও বাংলা শিখেছিলেন। বিয়ের পর সাখাওয়াত তাঁকে আধুনিক জগতের সাথেও পরিচয় করিয়ে দেন। সাখাওয়াত বিলেতে ছিলেন, তার সব ক্ষেত্রে ভাল যোগাযোগ ছিল। শুধু তাই নয়, তিনি সেই সময়ে রোকেয়াকে ১০,০০০ রুপী দিয়েছিলেন স্কুল করার জন্য, যার মূল্য এখন হিশাব করলে অনেক বড় অংক হবে। এ ছাড়াও তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি আরো কিছু অর্থ পেয়েছিলেন, যা তিনি তাঁর স্কুলের কাজে ব্যয় করতে পেরছিলেন। সেদিক থেকে রোকেয়া ভাগ্যবতী ছিলেন। রোকেয়া খাতুন থেকে রোকেয়া সাখোয়াত হোসেন হয়ে যাওয়া, সংক্ষেপে তৎকালীন আধুনিক নারীদের মতো মিসেস আর এস হোসেন লেখাও এক ধরনের বার্তা দেয়ার চেষ্টাই ছিল। তিনি পরিওবার থেকে বিচ্ছন্ন ব্যাক্তিতন্ত্রে ভোগেন নি। অথচ তিনি কোন অংশে কারো চেয়ে কম ছিলেন না। তাঁকে বিভিন্ন সভায় বক্তৃতার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হোত। তাঁর লেখা যেমন শক্তিশালী, তেমনি তিনি সুবক্তাও ছিলেন। কথার মধ্যে রস মিশিয়ে অনেক কঠিন সত্য সহজ করে তুলে ধরতেন।
এই যুগে তিনি রোকেয়া খাতুন কিংবা মিসেস আর এস হোসেন নন, তিনি একমাত্র ‘বেগম রোকেয়া’। তাঁর নামের আগে এই বেগম জুড়ে দেয়া হয়েছে নারীমুলক সম্মান ও সংস্কারের জন্য। বেগম বলার মধ্যে পুরুষতন্ত্রের গন্ধ আছে; কিন্তু রোকেয়ার সমস্ত কর্মকাণ্ড, তাঁর লেখা, তাঁর দুরদৃষ্টি – সবকিছু মিলিয়ে নামের সাথে ‘বেগম’ যুক্ত করা একদিক থেকে ফেমিনিজমের প্রতীক হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ বেগম রোকেয়া মানে হয়ে উঠেছে ‘ফেমিনিস্ট’ রোকেয়া।
এই ফেমিনিজমের অনুবাদ আমি নারীবাদ করলাম না কারণ বাংলায় নারীবাদ যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, বেগম রোকেয়া সেই ধরণের নারীবাদ চর্চা করেন নি। তিনি নারী মুক্তির কথা বলেছেন, কিন্তু ‘মুক্তি’ কথাটিকে দেশকালপাত্র বিবর্জিত বিমূর্ত ধারণা বানান নি। তাঁর সময়ের নারীদের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে নারীদের সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনের কথা ভাবতে হয়েছে। বিশেষ সময়ের সার্বিক সামাজিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিবেচনায় নারীর যোগ্যতা ও তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁকে সুনির্দিষ্ট কাজটি বেছে নিতে হয়েছে। পুরুষতন্ত্র নামক ক্ষমতার কোন বিমূর্ত রূপ নাই। সময় ও অবস্থা ভেদে পুরুষতন্ত্র তার সুনির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহণ করে। নারীর কোন পড়ালেখা বা শিক্ষার প্রয়োজন নাই, তার কাজ শুধু স্বামীর সেবা, সন্তান পালন এবং ঘরসংসার দেখা এটা পুরুষতন্ত্রের এমন একটি রূপ যা আমরা সাধারণত প্রাচীন সামন্ত কিম্বা প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে দেখি। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভিত্তিক পরিবার ব্যবস্থায় অস্থাবর সম্পত্তি হিশাবে যে নারীকে আমরা ইতিহাসে দেখি সেই অবস্থার সঙ্গে নারীর সংসার সর্বস্ব স্বামীসন্তান রূপ আমাদের খুবই পরিচিত। এই পরিস্থিতিতে নারীকে সচেতন সত্তা হিশাবে গণ্য করা, স্বীকৃতি দেওয়া এবং নারীর চিন্তাচেতনার সজ্ঞান বিকাশের জন্য লেখাপড়া করানো ও শিক্ষার গুরুত্ব প্রধান হয়ে ওঠে। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক এই অবস্থার দ্রুত বদল ঘটায় এবং সস্তা শ্রমশক্তি হিশাবে পরিবারের বাঁধন থেকে নারীকে ঘরের বন্ধন থেকে মুক্ত বের করে আনে। ধনতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় সস্তা শ্রমশক্তি হিশাবে আমরা নারীকে তখন দলে দলে রপ্তানিমুখী পোষাক কারখানায় নিজেদের শ্রম বিক্রি করে বেঁচে থাকার সংগ্রামে জড়িত হয়ে পড়তে দেখি। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীর লড়াই এবং নারীর মুক্তির প্রশ্নও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন চরিত্র লাভ করে। তাই বিমূর্ত ভাবে নারীবাদ, কিম্বা বিমূর্ত ভাষায় পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতা নারীর পক্ষে সুনির্দিষ্ট কর্তব্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কোন কাজে আসে না।
বেগম রোকেয়াকে নিয়ে আলোচনায় এই দিকটা গুরুত্বপূর্ণ। বেগম রোকেয়াকে বর্তমানের নারীরা যার যার পছন্দ মতো নানাভাগে ভাগ করে নিয়েছেন। তাঁর কাজের পরিধিও এতো ব্যাপক ছিল যে তিনি নিজেও সে সুযোগ সবাইকে করে দিয়েছেন। যেমন একটি গোষ্ঠি ভাবতে পছন্দ করেন যে বেগম রোকেয়া সমাজ সংস্কারক এবং মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদুত ছিলেন। আর একটি গোষ্ঠি মনে করেন তিনি স্ত্রীজাতির অবনতির চিত্র তুলে ধরেছেন, সেই নির্যাতিত নারীদের তিনি টেনে তুলতে চেয়েছেন। বর্তমান আধুনিক নারীরা ভাবতে পছন্দ করেন যে বেগম রোকেয়া ‘সুলতানার স্বপ্ন’ই শুধু লিখেছেন যেখানে পুরুষরা অন্তঃপুরে থাকছে, রান্না করছে আর নারী বাইরে আছে। আধুনিক নারীদের সমস্যা হয় বেগম রোকেয়ার পোষাক নিয়ে। শাড়ীর সাথে লম্বা হাতার ব্লাউজ, মাথায় কাপড় রোকেয়ার কথার সাথে যায় না। এই সবই রোকেয়াকে দেশকালপাত্রবিবর্জিত ভাবে খণ্ড খণ্ড ভাবে বোঝার চেষ্টা। বেগম রোকেয়াকে যারা খণ্ডিত ভাবে দেখেন এবং বুঝতে চান, রোকেয়া তাদের সবাইকেই হতাশ করছেন, কারণ তিনি এককভাবে কোন একটি দিক বেছে নেন নি। তিনি নারীকে কেন্দ্র করে তাঁর সময়ে সমাজে পুরুষতন্ত্রের সুনির্দিষ্ট রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন এবং সেই সমাজের বিরুদ্ধে তিনি লিখেছেন, কাজ করেছেন । কাজেই রোকেয়াকে খণ্ডিত ভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই।
নারী শিক্ষার কথাই ধরা যাক। তাঁর সময়ে মুসলমান পরিবারের মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর কথা চিন্তাই করা হোত না, যার কারণে একই সময়ের হিন্দু নারীদের তুলনায় মুসলমান নারীরা পিছিয়ে ছিলেন। নারী শিক্ষার কাজটি রোকেয়ার জন্যে শুধু সমাজ সংস্কারের বিষয় ছিল না, এটা মুসলমান সমাজে সেই সময়ে ইংরেজী শিক্ষার বিরুদ্ধে যে রক্ষণশীল চিন্তা ছিল, তা থেকে বের হতে গিয়ে যারা শুধু পুরুষ শিক্ষার কথা ভেবেছিলেন, রোকেয়ার লড়াই ছিল তাদের বিরুদ্ধেও। রোকেয়া প্রশ্ন তুলেছিলেন মুসলমান সমাজের অর্ধেক যদি পিছিয়ে থাকে তাহলে সে সমাজ এগুবে কিভাবে? ব্যক্তি নারী তাঁর ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল না। তিনি গোটা সমাজ নিয়ে ভেবেছেন। নারী শিক্ষার মধ্যে তিনি গোটা মুসলিম সমাজের মুক্তি দেখেছিলেন।
তাঁকে বঙ্গীয় নারী-শিক্ষা সমিতির সভানেত্রী নির্বাচন করার পর তিনি একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন (বাংলা ১৩৩৩ সাল, ইং ১৯২৬)। সেই বক্তৃতায় তিনি নারী শিক্ষার অবস্থা উল্লেখ করে বলেছিলেন “আমাদের দেশে গড় পড়তা প্রতি ২০০ বালিকার একজনও অক্ষর চিনে না, প্রকৃত শিক্ষিতা মহিলা বোধ হয় দশ হাজারের মধ্যেও একজন পাওয়া যাইবে না। কেবল এই বঙ্গদেশে তিন কোটি মুসলমানের বাস… তিন কোটি মুসলমানের মধ্যে মাত্র একটি মহিলা গ্রাজুয়েট পাওয়া গেল”। তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, “এমন জাতি যাহারা নিজেদের অর্দ্ধেক লোককে মূর্খতা ও ‘পর্দা’ রূপ কারাগারে আবদ্ধ রাখে, তাহারা অন্যান্য জাতির –যাহারা সমানে সমানে স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন করিয়াছে, তাহাদের সহিত জীবন-সংগ্রামে কিরূপে প্রতিযোগিতা করিবে?” [বঙ্গীয় নারী-শিক্ষা সম্মেলনের অধিবেশনে পঠিত, ১৩৩৩ সাল বাং] ।
তাই ঘরে ঘরে গিয়ে ছাত্রী যোগাড় করে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল চালিয়ে অনেক মুসলমান নারীকে পড়াশোনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সে সময়ের উপনিবেশিক শাসনামলে হিন্দু মেয়েরা যে খুব সহজে পড়াশোনা করতে পেরেছিল তাও নয়। রোকেয়া এই বিষয়টিও লক্ষ্য করেছেন। ব্রাহ্মণদের রক্ষণশীল আচরণের কারণে “ এটা করলে জাতি যায়, ওটা খেলে জাতি যায়; দলে দলে তারা খ্রিস্টান হতে শুরু করলেন”।… “সেই ঘোর সংকটের সময় রাজা রামমোহন রায় এবং কেশবচন্দ্র সেন প্রভৃতি সমাজ হিতৈষী লোকেরা ব্রাহ্ম-সমাজ প্রবর্তন করে হিন্দুকে সবংশে খ্রিস্টান হওয়া থেকে রক্ষা করলেন। তখন তাদের নিজের স্কুল কলেজ হ’ল”। এগুলো রোকেয়ার কথা।
মুসলমান মেয়েদের অবস্থা আরও খারাপ ছিল, তাদের লেখাপড়ার কোন সুযোগ ছিল না। কিন্তু রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল অনেক মেয়ের স্কুল শুধু নয়, কলেজে পড়ার সুযোগও তৈরি করলো। ১৯৩৯ সালে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ, বিশেষ করে মুসলিম মেয়েদের সুযোগ দেয়ার জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তী কালে যারা সমাজে নানাভাবে ‘প্রথম’ মুসলিম নারী হওয়ার মর্যাদা পেয়েছেন, তারা অবশ্যই রোকেয়ার কাছে ঋণী থাকবেন। কারণ রোকেয়া শিক্ষার দুয়ার খুলে না দিলে এই সুযোগ পেতে অনেক দেরী হোত। তবে নারী শিক্ষা বলতে যারা মনে করেন রোকেয়া বুঝি শুধু সন্তান পালনের জন্য, শিক্ষিত মা বানাতে, ভালভাবে সংসার করতে স্কুল খুলেছিলেন, তারা রোকেয়াকে চিনতে বিরাট ভুল করেছেন। ঔপনিবেশিক আমলে ধর্মীয় নেতারা মুসলমান পুরুষদের ইংরেজী শিক্ষা নিতে না দিয়ে যে ভুল করেছিলেন, একই ভুল নারী শিক্ষার বিরোধিতাকারীরাও করছেন, রোকেয়া এই কথাই স্পষ্ট করে বলেছেন। নারী শিক্ষা লাগবেই। কারন মেয়েদের জজ ব্যারিস্টার হতেই হবে।
হিন্দু নারীরা শিক্ষার সুযোগ পেলেও তাদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষিত পুরুষের মতো ছিল না। হিন্দু পুরুষরাও যখন হিন্দু নারী শিক্ষার জন্যে এগিয়ে এসেছিলেন তাতে নারীকে একটি সংসার চালাতে যতোটুকু উপযুক্ত হতে হয় ততটুকুই শিক্ষা দিয়েছিলেন। সমাজ সংস্কারক কেশব চন্দ্র সেনের ভিক্টোরিয়া কলেজে বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ ছিল না। তিনি নারীকে একজন শিক্ষিত স্ত্রী এবং মা হিশেবেই দেখতে চেয়েছিলেন, এর বেশি নামের শেষে বি.এ, এম.এ লেখার প্রয়োজন মনে করেন নি। কিন্তু রোকেয়া যখন নারী শিক্ষার কথা ভেবছেন তখন তিনি নারী-পুরুষের শিক্ষার মধ্যে কোন প্রকার বৈষম্য চান নি। তিনি নারীদের জন্যে রসায়ন, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, হর্টিকালচার, পুষ্টি, শরীর চর্চা, জিম্নাস্টিক্স, পেইন্টিং সহ সকল প্রকার কলা বিদ্যার কথাও ভেবেছেন। এই চিন্তাগুলো তাঁর অনেক লেখায় যেমন সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ –এ আরও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
বেগম রোকেয়ার মুসলিম নারী শিক্ষার যে উদ্যোগ তার মধ্যে বঙ্গের মুসলিম সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার একটা ইচ্ছা তাঁর মধ্যে প্রধান ছিল। এটা সেই সময়ের পরিস্থিতিতে খুবই প্রয়োজন ছিল। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভায় বেগম রোকেয়ার লেখা ‘ধ্বংসের পথে বঙ্গীয় মুসলিম’ পঠিত হয় যা পরে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় (জৈষ্ঠ্য, ১৩৩৮) সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এই লেখায় বেগম রোকেয়া মুসলিম নারীদের জন্য মুসলিম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করা যে কত জরুরি ছিল, যেখানে মেয়েরা আধুনিক জগতের অন্যান্য সম্প্রদায় এবং প্রদেশের লোকের সঙ্গে তাল রেখে চলবার মতো উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে পারে। তিনি বঙ্গীয় মুসলিম নারীদের ভারতের অন্যান্য প্রদেশের নারীদের থেকে পিছিয়ে থাকাটা সঠিক মনে করেন নি। তাঁর এই লেখায় যেটা পরিষ্কার সেটা হচ্ছে যে সে সময় মুসলিম নারীরা যদি পড়তে চায় তাহলে তাদের সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। এক. হিন্দু স্কুলে পড়া এবং দুই. খ্রীস্টান স্কুলে বা Convent যাওয়া। রোকেয়া বিষয়টি বোঝাবার জন্যে স্যাটায়ার করে বলছেন, “Convent –এ পড়তে গিয়ে লায়লার নাম বদলে হল ‘লিলি’ আর জয়নব হলো “জেনী”। হিন্দু স্কুলে গিয়ে আয়শার নাম হল ‘আশা’ আর কুলসুম হয়ে গেল ‘কুসুম’। যার প্রভাব পরে গিয়ে পড়েছে তাদের সন্তানের লালন পালনের ওপর।
মুসলিম নারীদের এই অসহায় অবস্থা থেকে তুলে আনার জন্যেই রোকেয়ার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল। এটা শুধুমাত্র বিদ্যালয় নয়, এটা পিছিয়ে পড়া মুসলমান সমাজকে টেনে তোলার প্রতিষ্ঠান।
‘নারীবাদ’ কিম্বা ‘নারীমুক্তি’ নামক কোন বিমূর্ত ছক দিয়ে রোকেয়াকে বোঝা যাবে না। তিনি বাঙালি মুসলমান সমাজের আত্মবিকাশের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন কোন ‘নারীবাদী’ নন। আর, এখানেই তিনি অনন্য।
ফরিদা আখতার
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ-সহ গোটা উপমহাদেশের নারী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ও তাত্ত্বিক, সমাজকর্মী, লেখক ও চিন্তক।