ভাসানীর শেষ ইচ্ছায়

স্মরণ

।। আজাদ খান ভাসানী ।।

মওলানা রবুবিয়াত বা পালনবাদী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে, ‘রবুবিয়াত কোন ধর্মের কথা নহে। উহা বিশ্বব্রহ্মান্ডের একটি স্বতসিদ্ধ বিধান। ইহা সকল দেশের, সকল সম্প্রদায়ের মানুষের কল্যাণকর একটি শাশ্বত আদর্শ। সকল সৃষ্টির অন্তরালে সামগ্রিক এবং বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য রহিয়াছে। এই ক্ষেত্রে আল্লাহ্ ‘রব’ গুনে গুনান্বিত হইয়া শুধু সৃষ্টিই করিয়া যাইতেছেন না, সবকিছুকে বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে লালন পালনও করিতেছেন। স্রষ্টার এই আদর্শই হইল রবুবিয়াত।’ তিনি বলেন, ‘আমি দেখিতে পাইতেছি নানা মতবাদ, নানা পন্থা মানুষকে নতুন নতুন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া ফেলিয়াছে। শ্রেণীহীন সমাজের কথা ভাবিতে গিয়া মানুষ আত্নকেন্দ্রিক ও হিংস্র হইয়া পরিয়াছে। আমার বিশ্বাস একমাত্র রবুবিয়াতের দর্শনই জাতি, ধর্ম, মতবাদ নির্বিশেষে সকলের শান্তি দিতে পারে। সবার লক্ষ্য যদি স্রষ্টা হয়, সকল সমস্যার সমাধানকল্পে যদি স্রষ্টার নিয়ম প্রবর্তিত হয়, তাহা হইলে অশান্তি, অসাম্য ও হিংসার লেলিহান যুদ্ধবিগ্রহ চিরতরে দূর হইয়া দুনিয়ার সকল আদম সন্তান ভ্রাতৃত্বের সমাজ গড়িয়া তুলিতে সক্ষম হইবে।’   

‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ খ্যাত মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’-এর কথা শুনে আজকাল অনেকেই হয়তো আঁতকে উঠবেন। অনেকেই বিপ্লবের কথা শুনে হয়তো রোমাঞ্চিত হবেন। কেউ কেউ হয়তো একদম নাকচ করে দেবেন। তবে প্রকৃতই মওলানা ভাসানীর জীবনের সমস্ত কর্মকাণ্ড একটি গভীর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রবাহিত হয়েছিল। একদিকে তিনি যেমন সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, আধিপত্যবাদ, পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, অন্যদিকে একটি গভীর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে এই ঘুনধরা সমাজকে পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি শান্তি ও ভ্রাতৃত্বময় বিশ্ব গড়তে চেয়েছেন। বলেছেন, ‘গড়িলে ভাঙিতে হয়’। আসাম জীবন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি গ্রামে, গঞ্জে, শহর, নগর, বন্দরে, উল্কার মতো ছুটে বেড়িয়েছেন। একটি শোষণহীন সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে তাঁর কর্মসূচিকে সাধারণ জনগণের কাছে নিয়ে গিয়েছেন। শাসক ও শোষক শ্রেণীর দীর্ঘদিনের শাসন ও শোষণ কাঠামো ভেঙে একটি নতুন সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য লড়াই সংগ্রাম করেছেন। কারণ তিনি জানতেন পুরোনো, ঔপনিবেশিক আমলের শোষণ কাঠামো বজায় রেখে কেবলমাত্র বাহ্যিক সংস্কার দ্বারা আর যাই হোক সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তি আসবে না। এজন্য যেখানেই তিনি অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন দেখেছেন সেখানেই প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। জেল, জুলুম, নির্যাতন ভোগ করেছেন। কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, মেথর প্রভৃতি খেটে খাওয়া মানুষদের সংগঠিত করে তাদেরকে অধিকার সচেতন করেছেন। অপেক্ষা করেছেন বিপ্লব সংঘঠিত করবার জন্য অনুকূল পরিবেশের।

১৯৫৭ সালের ঐতিহাসিক কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন মওলানা ভাসানীর সাংস্কৃতিক বৈপ্লবিক চিন্তাধারার এক উজ্জ্বল ও অনন্য উদাহরণ। এই সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানীদের লক্ষ্য করে এবং পূর্ববঙ্গ বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে তাদের বিদায় জানাতে মওলানার কন্ঠে স্বাধীনতার প্রথম উচ্চারণ ছিল ‘আসসালামু আলাইকুম’। পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে বিশ্ববাসীকে পরিচয় করিয়ে দিতে টাঙ্গাইলের সন্তোষ ও কাগমারিতে আয়োজন করেছিলেন এক মহাযজ্ঞের। দেশী-বিদেশী ভদ্রলোকদের টেনে এনেছিলেন চিরায়ত গ্রাম-বাংলার নিভৃত এই পল্লীতে। আবহমান বাংলার মাটি, মানুষ, জলবায়ু, আবহাওয়া, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির শেকড় কত গভীর, মানবীয় এবং বিপ্লব উপযোগী তাই তিনি উপলব্ধি করাতে চেয়েছেন সকলকে। গ্রামের খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের ওপর থেকে শোষণের জগদ্দল পাথর সরাতে একত্রিত করেছিলেন কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজনীতিকসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষের জাগ্রত কন্ঠস্বরকে। অনেকেই তাঁর এই কর্মপন্থাকে স্বাগত জানিয়েছেন অতি উৎসাহে, কেউ কেউ চতুরতার সঙ্গে তাঁকে ও তাঁর কর্মসূচিকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন ক্ষমতার বাহন হিসেবে। মওলানা ভাসানী এইসব স্লোগানধর্মী, ক্ষমতালোভী, কুচক্রী মহলকে দায়ী করেছেন তাঁর বিপ্লবের পথে বড় বাধা হিসেবে। আর তাই তিনি তাঁর এই কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য সৎ, যোগ্য, দক্ষ, বিনয়ী, কর্মঠ, ধৈর্যশীল, সৎচরিত্র, নির্ভিক, বুদ্ধিমান ও সাহসী কর্মী তৈরীর চেষ্টা করে গেছেন সারা জীবন ধরে।

১৯৫৭ সালে কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী ও মানিক মিয়াঁ

মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৬৯ সালে স্বৈরাচারী আইয়্যুব শাহীর পতনের পটভূমি রচনার মধ্য দিয়ে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী-সহ সকল শ্রেণী পেশার জনগণকে সাথে নিয়ে গণঅভ্যূত্থান সৃষ্টি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। এই আন্দোলনের ফসল গুণে অনেকেই যখন ক্ষমতার মসনদে বসার হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত, মওলানা ভাসানী তখন গভীর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে একটি শোষণমুক্ত স্বাধীন দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। তাই তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচন বয়কট করেছিলেন ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ বলে। আর বিপ্লবের দর্শন ও কর্মপদ্ধতি ব্যাখ্যা করেছিলেন তাঁর ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব সম্পর্কে জরুরী কথা’ নিবন্ধে। এই বিপ্লবের লক্ষ্য সমন্ধে তিনি বলেন, ‘সাংস্কৃতিক আন্দোলন জনজীবনে এক নতুন আশার সঞ্চার করিবে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের লক্ষ্য হইতেছে : সুখী, সমৃদ্ধ, শোষণহীন, মহান সমাজ ব্যাবস্থা গড়িয়া তোলা। এই লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত বৈপ্লবিক কর্মতৎপরতা চলিতে থাকিবে।’

বহমান বাংলার মাটি, মানুষ, জলবায়ু, আবহাওয়া, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির শেকড় কত গভীর, মানবীয় এবং বিপ্লব উপযোগী তাই তিনি উপলব্ধি করাতে চেয়েছেন সকলকে।

মওলানা ভাসানী ষাটের দশকের চীনা সাংস্কৃতিক বিপ্লব অনুধাবন করলেও তার বিপ্লব দর্শন ও কর্মপন্থা ছিল ভিন্ন। মূলত সেই ১৯২১ সাল থেকে তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হুকুমাতে রাব্বানীয়ার সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। তিনি রবুবিয়াত বা পালনবাদী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে, ‘রবুবিয়াত কোন ধর্মের কথা নহে। উহা বিশ্বব্রহ্মান্ডের একটি স্বতসিদ্ধ বিধান। ইহা সকল দেশের, সকল সম্প্রদায়ের মানুষের কল্যাণকর একটি শাশ্বত আদর্শ। সকল সৃষ্টির অন্তরালে সামগ্রিক এবং বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য রহিয়াছে। এই ক্ষেত্রে আল্লাহ্ ‘রব’ গুনে গুনান্বিত হইয়া শুধু সৃষ্টিই করিয়া যাইতেছেন না, সবকিছুকে বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে লালন পালনও করিতেছেন। স্রষ্টার এই আদর্শই হইল রবুবিয়াত।’ তিনি বলেন, ‘আমি দেখিতে পাইতেছি নানা মতবাদ, নানা পন্থা মানুষকে নতুন নতুন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া ফেলিয়াছে। শ্রেণীহীন সমাজের কথা ভাবিতে গিয়া মানুষ আত্নকেন্দ্রিক ও হিংস্র হইয়া পরিয়াছে। আমার বিশ্বাস একমাত্র রবুবিয়াতের দর্শনই জাতি, ধর্ম, মতবাদ নির্বিশেষে সকলের শান্তি দিতে পারে। সবার লক্ষ্য যদি স্রষ্টা হয়, সকল সমস্যার সমাধানকল্পে যদি স্রষ্টার নিয়ম প্রবর্তিত হয়, তাহা হইলে অশান্তি, অসাম্য ও হিংসার লেলিহান যুদ্ধবিগ্রহ চিরতরে দূর হইয়া দুনিয়ার সকল আদম সন্তান ভ্রাতৃত্বের সমাজ গড়িয়া তুলিতে সক্ষম হইবে।’   
  
মওলানা ভাসানীর এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের গুরুত্ব  অনেকেই তখন অনুধাবন করতে পারেননি। কেউ কেউ না বুঝেই এর বিরোধিতা করেছেন। পশ্চিমা দুনিয়ার কাছে এই বিপ্লব ছিল কমিউনিজম জ্বর, প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্র; আর ভাসানীকে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহারকারী রাজনৈতিক উত্তরাধীকারদের কাছে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণের পথে বড় বাধা। নাগরিক পরগাছা শ্রেণীভূক্ত বুদ্ধিজীবী ও এক শ্রেণীর কমিউনিষ্টরা প্রতিক্রিয়াশীলদের মতোই তাঁর সেই বিপ্লবে সায় দেননি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা আমাদের জাতিকে শোষণের হাত থেকে মুক্ত করতে পারেনি। দুই দুইবার মানচিত্র আর পতাকার বদল হলেও শোষকের বদল হয়নি। গণতন্ত্রের লেবাসে শোষণ চলছে ভিন্ন মোড়কে। রাজনৈতিক অনাদর্শ, অদূরদর্শিতা, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও অপব্যবহারের কারণে রাষ্ট্রের আইন, বিচার ও শাসন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। নৈতিকতা বিবর্জিত হয়ে মানুষ জোড় যার মুল্লুক তার নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পরছে। স্বাধীনতার উপকারভোগী মুষ্টিমেয় মানুষের ক্ষমতা আর ভোগবিলাসের জন্যে রাষ্ট্রের সমস্ত শক্তি ও সম্পদ ব্যয়িত হচ্ছে। অপরদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক-শ্রমিক; যে কৃষক শত প্রতিকুলতার মাঝেও দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এনে দিচ্ছে; যে শ্রমিক (প্রবাসীসহ) হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশের অর্থনীতি সচল রাখছে , তাদের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্য আর অবহেলা দিন দিন বেড়েই চলছে। অথচ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল চেতনায় অন্তর্ভূক্ত ছিল কৃষক-শ্রমিক মেহনতি শ্রেণীর মুক্তি।

মওলানা ভাসানীর এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের গুরুত্ব  অনেকেই তখন অনুধাবন করতে পারেননি। কেউ কেউ না বুঝেই এর বিরোধিতা করেছেন। পশ্চিমা দুনিয়ার কাছে এই বিপ্লব ছিল কমিউনিজম জ্বর, প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্র; আর ভাসানীকে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহারকারী রাজনৈতিক উত্তরাধীকারদের কাছে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণের পথে বড় বাধা। নাগরিক পরগাছা শ্রেণীভূক্ত বুদ্ধিজীবী ও এক শ্রেণীর কমিউনিষ্টরা প্রতিক্রিয়াশীলদের মতোই তাঁর সেই বিপ্লবে সায় দেননি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা আমাদের জাতিকে শোষণের হাত থেকে মুক্ত করতে পারেনি। দুই দুইবার মানচিত্র আর পতাকার বদল হলেও শোষকের বদল হয়নি। গণতন্ত্রের লেবাসে শোষণ চলছে ভিন্ন মোড়কে।

জণগণ যাদের কাছে প্রতিকার প্রত্যাশা করে সেই রাজনৈতিক দলগুলোই লুটেরা, দখলবাজ, টেন্ডারবাজ, পারমিটবাজ, চাঁদাবাজ, ভূমিদস্যু, ফটকাবাজ, টাউট, বাটপার, সন্ত্রাস, খুনি, হাইজ্যাকার, দালাল, কমিশন এজেন্টসহ মধ্যস্বত্বভোগী পরগাছা শ্রেণীর সৃষ্টি ও লালন পালনের মাধ্যমে জনগণের ন্যায্য অধিকার জিম্মি করে রেখেছে। কেবলমাত্র ভোটের রাজনীতির জন্য ক্ষমতা আর পেশীশক্তির বাহক  হিসেবে রাজনীতিবিদরা এই অসার শ্রেণী সৃষ্টি করে রেখেছে। যারা দেশের সামগ্রিক উৎপাদন ও সৃষ্টিতে কোন অবদান রাখতে পারছে না। অফিস আদালতসহ বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানে চলছে এইসব টাউট বাটপারদের কমিশন বাণিজ্য আর দৌরাত্ম্য। রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে সম্পদের পাহাড় গড়ছে এরা। অথচ রাষ্ট্র যাদের সেবা দেয়ার কথা সেইসব নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষ পদে পদে লাঞ্ছিত হচ্ছে। গুনীর বদলে বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা ঝুলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর দলবাজিতে দ্বিধাবিভক্ত ছাত্র, শিক্ষক, আমলা, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ  অন্যান্য পেশাজীবীরা সেবার মানসিকতা ও রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব পালন না করে ক্ষমতার পদলেহনে সর্বদা নিমজ্জিত। রাজনৈতিক ক্ষমতাবান আর ধনকুবেররা বড় বড় অন্যায় ও জনগণের সম্পদ চুরি করেও পার পেয়ে যায়; অন্যদিকে সাধারণ মানুষ তার ন্যায্য সুবিচার প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত। ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আর সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেঁকে বসেছে। এর নাম আর যাই হোক গণতন্ত্র কিংবা জনগণের মুক্তি নয়।

তাই জনগণের প্রকৃত মুক্তির লক্ষ্যে এই ঘুনে ধরা সমাজ ব্যাবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। রাজনৈতিক পরগাছা ও ধনকাঙাল শ্রেণীর হাত থেকে স্বাধীনতার সুফল সবার দুয়ারে পৌঁছে দিতে হবে। দারিদ্র্য বিমোচনের নামে লুটপাট বন্ধ করতে হবে। নতুন প্রজন্মের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। সম্পদ এবং ক্ষমতার সুষম বন্টন করতে হবে। এতে কোন সন্দেহ নাই যে, দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা, আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা সকলেই এই পরিবর্তন চান।

কিন্তু কিভাবে? এর জন্য চাই প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা, সঠিক নেতৃত্ব আর কর্ম পরিকল্পনা। সেইসাথে জনগণকে সেই কর্মসূচীর সাথে সম্পৃক্ত করা। মওলানা ভাসানী সেভাবে শুরুও করেছিলেন, কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি। তাই মওলানা ভাসানীর সংগ্রামের শেষ নাই। বরং নতুন প্রজন্মের দিনবদলের প্রচেষ্টার মাঝে তাঁর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আকাঙ্খা প্রতিফলিত হচ্ছে ভীষণভাবে। এই প্রজন্মের ‘রাষ্ট্র মেরামত চাই’ শ্লোগানের মাঝে ভাসানীর আওয়াজ প্রবলভাবে আলোড়িত হচ্ছে। আশা করি আমাদের তরুণ প্রজন্ম ও যুব সমাজ ভাসানীর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে মেহনতি ও মজলুম মানুষের কল্যাণে দিন বদলে এগিয়ে আসবে। মওলানা ভাসানী যেখানে শেষ করেছিলেন, আমাদের প্রযুক্তির সন্তানেরা সেখান থেকেই শুরু করবে। দিনবদল, রেভ্যুলুশন, রেনেসাঁ, রূপাপ্তর, জাগরণ, বিপ্লব, পরিবর্তন; পরিবর্তনের এই প্রচেষ্টাকে আমরা যে নামেই অভিহিত করি না কেন সত্যিকারের দিনবদলের যাত্রীরা মওলানা ভাসানীর অসমাপ্ত বিপ্লব সংগঠিত করে বাংলাদেশকে একটি শোষণহীন কল্যাণকামী আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলবেই। লাল-সবুজের পতাকাবাহী হিসেবে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে তুলে ধরবে একটি শান্তিকামী উন্নত জাতি হিসেবে। পরিশেষে  নতুন দিনের যাত্রীদের সাথে একাত্ম হয়ে রবীন্দ্রনাথের সুরে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, ‘ওরে মন হবেই হবে, যদি পণ করে থাকিস, সে পণ রবেই রবে’।

আজাদ খান ভাসানী
আজাদ খান ভাসানী


সভাপতি, মওলানা ভাসানী কৃষক সমিতি ও সাধারণ সম্পাদক, ভাসানী পরিষদ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, E-mail: azad.bhashani@gmail.com
                                                                              

Share